ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38640
ডাউনলোড: 5691

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38640 / ডাউনলোড: 5691
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইনসানে কামেল

মূল : শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী

অনুবাদ : এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর

মানুষের আত্মিক ও মানসিক ত্রুটি

আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ইসলামের দৃষ্টিতে ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানব। ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানব অর্থ আদর্শ মানুষ,সর্বোত্তম মানুষ বা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। অন্যান্য বস্তু বা জিনিষের মত মানুষেরও পূর্ণতা ও অপূর্ণতা রয়েছে,এমনকি ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন হওয়ার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ত্রুটি মুক্ত মানুষ আবার দু ধরনের : পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত মানুষ এবং অপূর্ণ ত্রুটিমুক্ত মানুষ। পূর্ণ বা আদর্শ মানুষকে চেনা ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ যদি আমরা পূর্ণমুসলমান হতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে পূর্ণ মানব কিরূপ। যেহেতু ইসলাম চায়পূর্ণ মানব তৈরি করতে এবং ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণ মানব গড়ে তুলতে,সুতরাং আদর্শ মানুষের নমুনা আমাদের সামনে থাকতে হবে। এখানে আমরা পূর্ণ মানবের প্রকৃতি,তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করছি। সে কেমন প্রকৃতির,তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতি কেমন,একজন পরিপূর্ণ মানুষের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যসমূহ কি? যদি আমরা তা জানতে পারি তবেই নিজেকে ও সমাজকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারব। যদি আমরা পরিপূর্ণ মানুষকে চিনতে না পারি তাহলে কোনক্রমেই পূর্ণ মুসলমান হতে পারব না। অন্যভাবে বলা যায় যে,আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে একজন অপূর্ণ মানুষে পরিণত হব।

 

ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেলকে চেনার উপায়

 ইসলামের দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ মানুষকে চেনার জন্য দু টি পথ রয়েছে। একটি পথ হচ্ছে প্রথমত আমরা দেখব কোরআন ও দ্বিতীয়ত সুন্নাত ইনসানে কামেলকে কিভাবে বর্ণনা করেছে। যদিও কোরআন ও সুন্নাতে এভাবে ইনসানে কামেলের ব্যাখ্যা করা হয়নি,বরং পরিপূর্ণ মুসলমান ও পূর্ণ মুমিনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছে,তবে এটা স্পষ্ট যে,পরিপূর্ণ মুসলমান অর্থ- যে মানব ইসলামের মধ্যে দিয়ে পূর্ণতায় পৌছেছে এবং পরিপূর্ণ মুমিন সে-ই যে ঈমানের ছায়ায় পরিপূর্ণতায় পৌছেছে। আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে কোরআন ও সুন্নাত পরিপূর্ণ মানুষকে কিভাবে বর্ণনা করেছে এবং পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিকৃতির বিষয়ে প্রচুর বর্ণনা এসেছে।

পরিপূর্ণ মানুষকে চেনার দ্বিতীয় পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে কোরআন ও সুন্নাতে পরিপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে কিরূপ বর্ণনা এসেছে তা থেকে নয়,বরং ঐ সকল ব্যক্তিকে তাদের জীবনী থেকে চিনব যাদের উপর. আমরা আস্থা লাভ করেছি যে,ইসলাম ও কোরআন যেভাবে চায় তারা সেভাবে গড়ে উঠেছেন। ইসলামের পূর্ণ মানুষের হুবহু প্রতিকৃতি হলেন তারা। যেহেতু ইসলামের পরিপূর্ণ মানুষ শুধু আদর্শিক,কল্পনা ও চিন্তাগত কোন বিষয় নয় যে,বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকবে না। পরিপূর্ণ মানুষ সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন উভয় পর্যায়েই বাস্তবে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

 মহানবী (সা.) নিজেই পূর্ণ মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। হযরত আলী (আ.) অন্য এক পূর্ণ মানবের নমুনা। আলী (আ.)-কে চেনা অর্থ পরিপূর্ণ মানুষেকে চেনা। কিন্তু আলীকে চেনা এটা নয় যে,তার পরিচয় পত্র জানা। কখনো মানুষ আলীকে পরিচয় পত্র থেকে চিনে যে,তার নাম আলী,আবু তালিবের পুত্র,আবু তালিব আবদুল মুত্তালিবের পুত্র,মাতা ফাতেমা যে আসাদ ইবনে আবদুল ওজ্জার কন্যা,তিনি (আলী) মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমার সহধর্মী,হাসান ও হুসাইনের পিতা,অমুক বছর জন্মগ্রহণ করেছেন,অমুক বছর শাহাদাত বরণ করেছেন,অমুক অমুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন-এগুলো আলীর পরিচয় জানা। অর্থাৎ যদি চাই আলীর জন্য একটি পরিচয় পত্র তৈরি করব ও পরিচয়পত্র সম্পর্কে জানব তবে তা এরূপই হবে। কিন্তু আলীর পরিচয় পত্র জানা আলীকে জানা নয় বা একজন পরিপূর্ণ মানুষকে চেনাও নয়। অর্থাৎ আলীকে জানা তার ব্যক্তিত্বকে জানা,ব্যক্তি আলীকে নয়। আলীর সম্মিলিত ব্যক্তিত্বের যতটুকু আমরা জানব,ইসলামের পরিপূর্ণ মানুষকে ততটূকু চিনব। আর শুধু নাম ও শাব্দিক অর্থে নয়,বরং কার্যক্ষেত্রে পূর্ণ মানুষকে যতটুকু অনুসরণ করেছি তাকে সে পরিমাণ ইমাম বা নেতা হিসেবে মেনেছি ও তার পথে চলেছি; তার অনুসারী ও অনুগামী হয়েছি ও যতটুকু চেষ্টা করছি নিজেকে সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি করতে ঠিক সেই পরিমাণ এ কামেল পুরুষের অনুসারী হয়েছি। যেহেতু শহীদ (প্রথম) লোমআ গ্রন্থেالشیعة من شایع علیا -এ বাক্যের অর্থ করতে গিয়ে বলেন,(অন্যরাও তা বলেছেন) শিয়া ঐ ব্যক্তি যে আলীর সহযাত্রী হয়েছে। অর্থাৎ শুধু বলার মাধ্যমে শিয়া হবে না (যে আমি শিয়া),নাম ধারণ করলেই শিয়া হবে না,শুধু ভালবাসা ও পছন্দের দাবিতে শিয়া হবে না। তাহলে কিভাবে শিয়া হবে? সহযাত্রী হয়ে অর্থাৎ পদানুসরণের মাধ্যমে। যখন কেউ একজন যে পথে চলে আপনি তার পেছনে পেছনে বা সঙ্গে যাবেন আপনাকে তার সহযাত্রী বা পদাঙ্কনুসারী (شایع ) বলা হবে। আলীর শিয়া অর্থ আলীর কর্মের পদাঙ্কনুসারী।

তাহলে পূর্ণ মানবকে চেনার দু টি পথ ও সে সাথে এ সম্পর্কে আলোচনার উপকারিতাও জানতে পারলাম। সুতরাং ইনসানে কামেল বিষয়টি শুধু একটি দার্শনিক ও জ্ঞানগত বিষয় নয় যে,কেবল জ্ঞানগত প্রভাব রয়েছে। যদি ইসলামের পূর্ণ মানবকে কোরআন ও সুন্নাতের বর্ণনা থেকে ও কোরআন দ্বারা পরিবর্ধিত রূপে না জানি তাহলে ইসলাম নির্দেশিত পথে চলতে পারব না এবং প্রকৃত ও সত্যিকারের মুসলমান হতে পারব না। অনুরূপ আমাদের সমাজও একটি ইসলামী সমাজ হতে পারবেনা। সুতরাং ইসলামের পূর্ণ,শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের মানুষকে চেনা অপরিহার্য।

কামাল (کمال ) ও (تمام ) তামামের পার্থক্য

এখন প্রশ্ন হলো কামেল کمال)) এর প্রকৃত অর্থ কি? ইনসানে কামেল -এর অর্থই বা কি? আরবী ভাষায় এ দু শব্দের অর্থ কাছাকাছি হলেও এক নয়; যদিও দু টিরই বিপরীত শব্দ এক অর্থাৎ শব্দটি কখনো প্রথমটির বিপরীত শব্দ হিসেবে আবার কখনো দ্বিতীয়টির বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়,এমনকি ফার্সীতে ঐ দু টি শব্দের পরিবর্তে একটি শব্দই রয়েছে। ঐ দু টি শব্দ আরবীতে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও  کمال এবং تمام দু টিরই বিপরীত শব্দ ناقص (নাকিস) অর্থাৎ অসম্পূর্ণ। যেমন ফার্সীতে বলা হয় : এটা(کمال) বা সম্পূর্ণ এবং ওটাناقص বা অসম্পূর্ণ; তেমনি বলা হয়,এটাتمام ওটাناقص

আল কোরআনের একটি আয়াতে এ দু টি শব্দই এসেছে-

) الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي(

 “ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করলাম। (সূরা মায়েদা : ৩)

এখানে এটা বলা হয়নি যে,وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي বা,أَكْمَلْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي যদি তা বলা হতো,তবে আরবী ব্যাকরণে ভুল বলে গণ্য হতো। এখন এ দু শব্দের পার্থক্য কি? যদি আমরা এ দু য়ের পার্থক্যকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ না করি তাহলে আমাদের আলোচনা শুরু করতে পারব না। অর্থাৎ আমাদের আলোচনার শুরু হবে এ দু শব্দের অর্থ জানার মাধ্যমে।

تمام কোন বস্তুর জন্য তখনই বলা হবে যখন ঐ বস্তুর বাস্তব অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই অস্তিুত্বে এসে থাকে। অর্থাৎ যদি তা থেকে কিছু জিনিস অনুপস্থিত থাকে,তবে বস্তুটি ঐ বস্তু হওয়ার ক্ষেত্রে অপূর্ণ অথবা বলা যায় বস্তুটি তার অস্তিুত্বের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। যেমন অর্ধেক অস্তিুত্ব লাভ করেছে,এক-তৃতীয়াংশ অস্তিুত্ব লাভ করেছে বা দুই-তৃতীয়াংশ অস্তিুত্ব লাভ করেছে ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ একটি পরিকল্পিত মসজিদের বিল্ডিংয়ের জন্য হলরুম দরকার। রুমের জন্য দেয়াল,ছাদ,দরজা,জানালা ও অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন। যদি ঐ বিল্ডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় এ সকল অংশ বিদ্যমান না থাকে তবে ঐ বিল্ডিং ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। যখন প্রয়োজনীয় সব কিছু বিদ্যমান থাকবে তখন বলা যাবে বিল্ডিং সম্পূর্ণ (তামাম) হয়েছে। এ শব্দের বিপরীত স্থানকে নির্দেশ করতে অসম্পূর্ণ বা নাকিস ব্যবহার করা হয়। কোন বস্তু সম্পূর্ণতা লাভ করলেই তা পূর্ণতা লাভ করেছে বলা যায় না,বরং বস্তুটি হয়তো কখনো এর থেকে এক স্তর উপরের পর্যায়ের,কখনো কয়েক স্তর উপরের পর্যায়ের পূর্ণতা লাভ করে,এভাবে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। যদি এই کمال বা পূর্ণতা ঐ বস্তুর না থাকে তবুও তা ঐ বস্তুরই। কিন্তু পূর্ণতা লাভ করার অর্থ তা থেকে এক স্তর উপরে অবস্থান লাভ করা।

কামাল বা পূর্ণতাকে আড়াআড়ি বা সমান্তরালভাবে বর্ণনা করা হয়। যখন বস্তু সমান্তরালভাবে শেষপ্রান্তে বা পরিসীমায় পৌছায় তখন বলা হয় সম্পূর্ণ(تمال) হয়েছে এবং বস্তু যখন লাম্বিকভাবে উপরের দিকে বাড়তে থাকে বা উন্নতি লাভ করে তখন বলা হয় পূর্ণতা کمال)) লাভ করেছে। যদি বলা হয় অমুক ব্যক্তির বুদ্ধি (আকল) পূর্ণতা লাভ করেছে,এর অর্থ পূর্বেও তার বুদ্ধি ছিল,কিন্তু তার বুদ্ধি পূর্বের চেয়ে উপরের পর্যায়ে পৌছেছে বা পরিপক্ব হয়েছে। অথবা যদি বলা হয় অমুক ব্যক্তির জ্ঞান পূর্ণর্তা লাভ করেছে তাহলে এর অর্থ পূর্বেও তার জ্ঞান ছিল ও সে তা ব্যবহার করত,কিন্তু এখন তার জ্ঞান পূর্ণতার এক স্তর অতিক্রম করেছে। সুতরাং আমরা দেখছি,একজন সম্পূর্ণ মানুষ আছে যার বিপরীতে সমান্তরালভাবে চিন্তা করে অসম্পূর্ণ মানুষও আছে অর্থাৎ অর্ধেক মানুষ বা মানুষের ভগ্নাংশ। উদাহরণস্বরূপ এক-তৃতীয়াংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানুষ নয়। অন্য এক প্রকার মানুষও আছে যে মানুষ সম্পূর্ণ ও এই সম্পূর্ণ মানুষ পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে-এভাবে সর্বোচ্চ পরিসীমা পর্যন্ত যার উপর কোন পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না যাকে পরিপূর্ণতম বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষ বলা যায়।

ইনসানে কামেলের ব্যাখ্যা

সপ্তম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী সাহিত্যে ইনসানে কামেলের কোন ব্যাখ্যা ছিল না। বর্তমানে ইউরোপেও মানুষ সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা প্রচলিত থাকলেও ইসলামী বিশ্বে মানুষ সম্পর্কে এ ভাষা সপ্তম হিজরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। যিনি মানুষ সম্পর্কে প্রথম ইনসানে কামেল শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি হলেন বিখ্যাত আরেফ মহিউদ্দিন আরাবী আন্দালুসী তায়ী। মহিউদ্দিন আরাবী ইসলামী এরফানের (আধ্যাত্মিকতার) জনক। সপ্তম হিজরীর পর থেকে যত আরেফ ইসলামী জাতিসমূহের মধ্যে এসেছেন,যেমন ইরানী ও ফার্সী ভাষার আরেফগণ সকলেই মহিউদ্দিন আরাবীর ছাত্র। মৌলভী (মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী) মহিউদ্দিন আরাবীর মক্তবের ছাত্র। রুমী তার সকল মর্যাদাসহ এরফানের দৃষ্টিতে মহিউদ্দিন আরাবীর তুলনায় কিছূই নন। মহিউদ্দিন আরব জাতিভুক্ত ও হাতেম তায়ীর বংশধর এবং আন্দালুসের অধিবাসী ছিলেন। তার সকল ভ্রমণ ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি সিরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবর দামেস্কে। সিরিয়ায় মৃত্যুবরণ করা ও সেখানে দাফন হওয়ায় তাকে শামী বলা হয়। তার ছাত্রদের মধ্যে সদরুদ্দিন কৌনাভী তার পরে সবচেয়ে বড় আরেফ হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে ইসলামী এরফান যে একটি জ্ঞানের রূপে এসেছে তা শুধু মহিউদ্দিন আরাবী ও সদরুদ্দীন কৌনাভীর কর্মপচেষ্টার ফলেই। সদরুদ্দিন কৌনাভী তুরস্কের কৌনীর বাসিন্দা ও মহিউদ্দিন আরাবীর স্ত্রীর পূর্ববতী স্বামীর ঔরসজাত পুত্র ছিলেন। অর্থাৎ মহিউদ্দীন তার শিক্ষকও ছিলেন আবার সৎ পিতাও। মৌলভী জালালুদ্দিন রুমী সদরুদ্দিন কৌনাভীর সমসাময়িক ছিলেন। সদরুদ্দিন একটি মসজিদের জামায়াতের ইমাম ছিলেন। মৌলভী সেখানে যেতেন ও তার পেছনে নামাজ পড়তেন। মহিউদ্দিন আরাবীর চিন্তা সদরুদ্দিনের মাধ্যমে মৌলভীর কাছে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

অন্যতম যে বিষয়টি এ ব্যক্তি উপস্থাপন করেন তা ইনসানে কামেল সম্পর্কিত। তবে তিনি বিষয়টি এরফানের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে সাহেবে মানজুমে খ্যাত মাহমুদ সাবেস্তারীর সবচেয়ে উন্নত ও মূল্যবান সাহিত্যমান সম্পন্ন বই গুলশানে রজ -এ যে প্রশ্নগুলো ইনসানে কামেলের ব্যপারে এসেছে সদরুদ্দিন এরফানের দৃষ্টিতে সেগুলোর জবাব দিয়েছেন। সুতরাং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ বিষয়টি ইনসানে কামেল শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন ও এরফানের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। অন্যরাও ইনসানে কামেলকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ও রূপে বর্ণনা করেছেন। আমরা দেখতে চাই ইনসানে কামেল কোরআনের দৃষ্টিতে কেমন মানুষ। আলোচনাকে সম্পূর্ণ মানুষ অসম্পূর্ণ মানুষ দিয়ে শুরু করছি যেন এ বিষয়ের উপর পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করতে পারি।

শারিরীক ও মানসিক ক্রটি

আমাদের মধ্যে কি ত্রুটিহীন এবং ত্রুটিযুক্ত মানুষও রয়েছে? সুস্থতা ও অসুস্থতা (ত্রুটি) কখনো কখনো মানুষের দেহের সাথে সম্পর্কিত। সন্দেহ নেই যে,কিছু মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ ও ত্রুটিমুক্ত এবং কিছু মানুষ ত্রুটিযুক্ত ও অসুস্থ। উদাহরণস্বরূপ শারীরিক ত্রুটি,যেমন দৃষ্টিহীনতা ও অন্ধত্ব,পঙ্গুত্বও পক্ষাঘাতগ্রস্ততা প্রভৃতি। কিন্তু এগুলো ব্যক্তি-মানুষের সাথে সম্পর্কিত,মানুষের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নয়। কোন ব্যক্তি যদি অন্ধ,বধির,পঙ্গু,খাটো বা কুৎসিত চেহারার হন,এ ত্রুটিগুলোকে আপনি তার মর্যাদা,ব্যক্তিত্ব ও মনুষত্বের ক্ষেত্রে ত্রুটি হিসেবে দেখেন না। যেমন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস যাকে নবীদের পরবর্তী পর্যায়ের জ্ঞানী বলে ধরা হয় তিনি পৃথিবীর এক কদাকার মানুষ ছিলেন। কিন্তু কেউই তার এ কদাকৃতিকে একজন মানুষ হিসেবে তার ত্রুটি বলে মনে করেন না। অথবা আবুল আলা মাযারি (আরব কবি) এবং ত্বাহা হোসেইন (মিশরীয় সাহিত্যিক) যারা উভয়ই অন্ধ ছিলেন,তাদের এ শারীরিক ত্রুটি ব্যক্তিগত ত্রুটি হিসেবে পরিগণিত হলেও তাদের ব্যক্তিত্বের জন্য ত্রুটি বলে গণ্য হবে কি? অবশ্যই নয়। সুতরাং মানুষের ব্যক্তি দিক তার ব্যক্তিত্বের দিক হতে যে ভিন্ন তা প্রমাণিত সত্য। একটি তার দেহের সাথে,অন্যটি তার রূহের সাথে সম্পর্কিত। মনের বিষয় তার দেহ থেকে ভিন্ন। যারা মনে করেন মানুষের মন একশ ভাগ দেহের অনুগত তাদের ভুল এখানেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষের দেহ পুরোপুরি সুস্থ থাকলেও তার অন্তর কি অসুস্থ হতে পারে? এটা একটা প্রশ্ন সুতরাং যারা রূহ বা আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চান এবং রূহের সকল বৈশিষ্ট্যকে মানুষের স্নায়ুর সরাসরি প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন,তারা প্রকৃতপক্ষে বলতে চান যে,মন কিছুই নয়,সবই দেহের অনুগামী। তাদের মতে মন অসুস্থ হওয়ার অর্থ তার দেহ অসুস্থ। অর্থাৎ মানসিক অসুস্থতা এবং দৈহিক অসুস্থতা একই।

এটা আনন্দের বিষয় যে,বর্তমানে এটা প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে একজন মানুষ শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে (যেমন শরীরে লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ দেহে ভিটামিনের পরিমাণ,পরিপাকতন্ত্রের মেটাবলিক কার্যক্রম,এমনকি নিউরোলজিক দৃষ্টিকোণ থেকে) সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে। কিভাবে তা সম্ভব? আধুনিক পরিভাষায় একে মানসিক জটিলতা বলা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান মানসিক জটিলতাসম্পন্ন মানুষকে অসুস্থ বলে মনে করে। এমন ব্যক্তিরদেহে শারীরিক কোন জটিলতা সৃষ্টি না হয়েই মানসিক জটিলতার সৃষ্টি য়েছে। তাই এ ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসা শারীরিকভাবে না করে মানসিকভাবে করতে হয়। যেমন অহংকার যা মানসিক জটিলতা থেকে উদ্ভূত,একটি রোগ বলে বর্তমানে প্রমাণিত তা প্রকৃতপক্ষেই একটি আত্মিক ও মানসিক রোগ। কিন্তু কোন ঔষধের দোকানে অহংকার রোগের ঔষধ পাওয়া যাবে কি? কিংবা বাস্তবে এটা কি সম্ভব যে,অহংকারী ব্যক্তি একটি ট্যাবলেট খাবে আর সাথে সাথে তার অহংকার বিলুপ্ত হয়ে সে এক নিরহংকার ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে? না,এটা কখনোই সম্ভব নয় যে,জল্লাদ ও পাষাণ হৃদয়ের শিমারের মত কাউকে একটা ইনজেকশন পুশ করা হবে বা একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়া হবে আর সে রাতারাতি একজন দয়ালু,হৃদয়বান ও প্রশস্ত অন্তরের মানুষে পরিণত হয়ে যাবে। তবে এ ব্যাধিগুলোর চিকিৎসার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে যা এভাবে নয়।

এমনকি শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসাও কখনো কখনো মানসিকভাবে করা সম্ভব। যেমনভাবে কখনো কখনো মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা শারীরিকভাবে করা হয়ে থাকে। যেমন কোন রোগ হয়তো শারীরিক,কিন্তু মানসিক উদ্দীপনা ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তার চিকিৎসা করা হয়। এ বিষয়ে আলোচনা বেশ ব্যাপক এবং বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার মতোও বটে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়,মানুষ দেহ ও মনের সমন্বয়ে এক সৃষ্টি এবং মানুষের মন তার দেহ হতে স্বাধীন ও সম্পূর্ণরূপে দেহের অনুগামী নয়। তেমনিভাবে দেহও পুরোপুরি মনের অনুগামী নয়। তবে এরা একে অপরকে প্রভাবিত করে। জ্ঞানীদের ভাষায় দেহ ও মন একে অপরের উপর গঠনমূলক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ যেমনভাবে দেহ মনের উপর প্রভাব ফেলে তেমনভাবে মনও দেহের উপর প্রভাব ফেলে। সেই সাথে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবেও কাজ করে। তাই মানুষের মনোজগৎ একটি স্বাধীন জগতের অধিকারী।

আমরা পূর্ণ মানবের আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে ত্রুটিহীন ও ত্রুটিযুক্ত মানুষের বিষয়টি এনেছি এজন্য যে,আমাদের নিকট এটা পরিষ্কার হওয়া যে,আমাদের উদ্দেশ্য এখানে শারীরিক সুস্থতা বা ত্রুটি নয় এবং আমাদের উদ্দেশ্য এটাও নয় যে,মানব দেহ কতটা সুস্থ তা নিরীক্ষা করা। প্রকৃতপক্ষে তা দিয়ে আমাদের কাজও নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো বাস্তবে এটা প্রমাণ করা যে,মানুষ যেমনভাবে মানসিকভাবে সুস্থ হতে পারে তেমনিভাবে ত্রুটিযুক্ত ও অসুস্থও হতে পারে। কোরআন এ সত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে বলছে,

) فِي قُلُوبِهِم مَّرَ‌ضٌ فَزَادَهُمُ اللَّـهُ مَرَ‌ضًا(

তাদের অন্তরে অসুস্থতা রয়েছে,অতঃপর আল্লাহ তাদের এ অসুস্থতাকে বৃদ্ধি করে দেন। (সূরা বাকারাহ্ : ১০)

এখানে আল্লাহ্ বলছেন তাদের অন্তর রোগাক্রান্ত ও রূহ অসুস্থ,এটা বলেননি যে,তাদের চক্ষু অসুস্থ। এখানে লক্ষণীয় কোরআন হৃদয় বা অন্তর বলতে যা বুঝিয়েছে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানের হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড নয় যে,এর আরোগ্যের জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কোরআনের বর্ণিত হৃদয় হলো মানুষের আত্মা ও মানস। যেমন কোরআন অন্যত্র বলছে,

) وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْ‌آنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَ‌حْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ(

  আমরা কোরআনে যা কিছু অবতীর্ণ করেছি তা মুমিনদের জন্য আরোগ্য লাভের উপায় ও রহমতস্বরূপ। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮২)

সুতরাং কোরআন মুমিনদের জন্য আরোগ্য লাভের উপায়।

আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন,الا و انّ من البلاء الفاقة জেনে রাখ,নিশ্চয়ই দারিদ্র্য একটি বড় বিপদو اشد من الفاقة مرض البدن এবং দারিদ্র্য হতে মন্দ শারীরিক অসুস্থতা

  و اشد من مرض البدن مرض القلب এবং শারীরিক অসুস্থতা হতে মন্দ ও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা। কোরআনের অন্যতম পরিকল্পনা হলো সুস্থ মানুষ তৈরি। তাই আমাদের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পূর্বে সুস্থ ও ত্রুটিহীন মানুষ হতে হবে।