ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 7%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43209 / ডাউনলোড: 7316
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইনসানে কামেল

মূল : শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী

অনুবাদ : এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর

মানুষের আত্মিক ও মানসিক ত্রুটি

আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ইসলামের দৃষ্টিতে ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানব। ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানব অর্থ আদর্শ মানুষ,সর্বোত্তম মানুষ বা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। অন্যান্য বস্তু বা জিনিষের মত মানুষেরও পূর্ণতা ও অপূর্ণতা রয়েছে,এমনকি ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন হওয়ার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ত্রুটি মুক্ত মানুষ আবার দু ধরনের : পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত মানুষ এবং অপূর্ণ ত্রুটিমুক্ত মানুষ। পূর্ণ বা আদর্শ মানুষকে চেনা ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ যদি আমরা পূর্ণমুসলমান হতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে পূর্ণ মানব কিরূপ। যেহেতু ইসলাম চায়পূর্ণ মানব তৈরি করতে এবং ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণ মানব গড়ে তুলতে,সুতরাং আদর্শ মানুষের নমুনা আমাদের সামনে থাকতে হবে। এখানে আমরা পূর্ণ মানবের প্রকৃতি,তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করছি। সে কেমন প্রকৃতির,তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতি কেমন,একজন পরিপূর্ণ মানুষের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যসমূহ কি? যদি আমরা তা জানতে পারি তবেই নিজেকে ও সমাজকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারব। যদি আমরা পরিপূর্ণ মানুষকে চিনতে না পারি তাহলে কোনক্রমেই পূর্ণ মুসলমান হতে পারব না। অন্যভাবে বলা যায় যে,আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে একজন অপূর্ণ মানুষে পরিণত হব।

 

ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেলকে চেনার উপায়

 ইসলামের দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ মানুষকে চেনার জন্য দু টি পথ রয়েছে। একটি পথ হচ্ছে প্রথমত আমরা দেখব কোরআন ও দ্বিতীয়ত সুন্নাত ইনসানে কামেলকে কিভাবে বর্ণনা করেছে। যদিও কোরআন ও সুন্নাতে এভাবে ইনসানে কামেলের ব্যাখ্যা করা হয়নি,বরং পরিপূর্ণ মুসলমান ও পূর্ণ মুমিনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছে,তবে এটা স্পষ্ট যে,পরিপূর্ণ মুসলমান অর্থ- যে মানব ইসলামের মধ্যে দিয়ে পূর্ণতায় পৌছেছে এবং পরিপূর্ণ মুমিন সে-ই যে ঈমানের ছায়ায় পরিপূর্ণতায় পৌছেছে। আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে কোরআন ও সুন্নাত পরিপূর্ণ মানুষকে কিভাবে বর্ণনা করেছে এবং পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিকৃতির বিষয়ে প্রচুর বর্ণনা এসেছে।

পরিপূর্ণ মানুষকে চেনার দ্বিতীয় পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে কোরআন ও সুন্নাতে পরিপূর্ণ মানুষ সম্পর্কে কিরূপ বর্ণনা এসেছে তা থেকে নয়,বরং ঐ সকল ব্যক্তিকে তাদের জীবনী থেকে চিনব যাদের উপর. আমরা আস্থা লাভ করেছি যে,ইসলাম ও কোরআন যেভাবে চায় তারা সেভাবে গড়ে উঠেছেন। ইসলামের পূর্ণ মানুষের হুবহু প্রতিকৃতি হলেন তারা। যেহেতু ইসলামের পরিপূর্ণ মানুষ শুধু আদর্শিক,কল্পনা ও চিন্তাগত কোন বিষয় নয় যে,বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকবে না। পরিপূর্ণ মানুষ সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন উভয় পর্যায়েই বাস্তবে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

 মহানবী (সা.) নিজেই পূর্ণ মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। হযরত আলী (আ.) অন্য এক পূর্ণ মানবের নমুনা। আলী (আ.)-কে চেনা অর্থ পরিপূর্ণ মানুষেকে চেনা। কিন্তু আলীকে চেনা এটা নয় যে,তার পরিচয় পত্র জানা। কখনো মানুষ আলীকে পরিচয় পত্র থেকে চিনে যে,তার নাম আলী,আবু তালিবের পুত্র,আবু তালিব আবদুল মুত্তালিবের পুত্র,মাতা ফাতেমা যে আসাদ ইবনে আবদুল ওজ্জার কন্যা,তিনি (আলী) মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমার সহধর্মী,হাসান ও হুসাইনের পিতা,অমুক বছর জন্মগ্রহণ করেছেন,অমুক বছর শাহাদাত বরণ করেছেন,অমুক অমুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন-এগুলো আলীর পরিচয় জানা। অর্থাৎ যদি চাই আলীর জন্য একটি পরিচয় পত্র তৈরি করব ও পরিচয়পত্র সম্পর্কে জানব তবে তা এরূপই হবে। কিন্তু আলীর পরিচয় পত্র জানা আলীকে জানা নয় বা একজন পরিপূর্ণ মানুষকে চেনাও নয়। অর্থাৎ আলীকে জানা তার ব্যক্তিত্বকে জানা,ব্যক্তি আলীকে নয়। আলীর সম্মিলিত ব্যক্তিত্বের যতটুকু আমরা জানব,ইসলামের পরিপূর্ণ মানুষকে ততটূকু চিনব। আর শুধু নাম ও শাব্দিক অর্থে নয়,বরং কার্যক্ষেত্রে পূর্ণ মানুষকে যতটুকু অনুসরণ করেছি তাকে সে পরিমাণ ইমাম বা নেতা হিসেবে মেনেছি ও তার পথে চলেছি; তার অনুসারী ও অনুগামী হয়েছি ও যতটুকু চেষ্টা করছি নিজেকে সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি করতে ঠিক সেই পরিমাণ এ কামেল পুরুষের অনুসারী হয়েছি। যেহেতু শহীদ (প্রথম) লোমআ গ্রন্থেالشیعة من شایع علیا -এ বাক্যের অর্থ করতে গিয়ে বলেন,(অন্যরাও তা বলেছেন) শিয়া ঐ ব্যক্তি যে আলীর সহযাত্রী হয়েছে। অর্থাৎ শুধু বলার মাধ্যমে শিয়া হবে না (যে আমি শিয়া),নাম ধারণ করলেই শিয়া হবে না,শুধু ভালবাসা ও পছন্দের দাবিতে শিয়া হবে না। তাহলে কিভাবে শিয়া হবে? সহযাত্রী হয়ে অর্থাৎ পদানুসরণের মাধ্যমে। যখন কেউ একজন যে পথে চলে আপনি তার পেছনে পেছনে বা সঙ্গে যাবেন আপনাকে তার সহযাত্রী বা পদাঙ্কনুসারী (شایع ) বলা হবে। আলীর শিয়া অর্থ আলীর কর্মের পদাঙ্কনুসারী।

তাহলে পূর্ণ মানবকে চেনার দু টি পথ ও সে সাথে এ সম্পর্কে আলোচনার উপকারিতাও জানতে পারলাম। সুতরাং ইনসানে কামেল বিষয়টি শুধু একটি দার্শনিক ও জ্ঞানগত বিষয় নয় যে,কেবল জ্ঞানগত প্রভাব রয়েছে। যদি ইসলামের পূর্ণ মানবকে কোরআন ও সুন্নাতের বর্ণনা থেকে ও কোরআন দ্বারা পরিবর্ধিত রূপে না জানি তাহলে ইসলাম নির্দেশিত পথে চলতে পারব না এবং প্রকৃত ও সত্যিকারের মুসলমান হতে পারব না। অনুরূপ আমাদের সমাজও একটি ইসলামী সমাজ হতে পারবেনা। সুতরাং ইসলামের পূর্ণ,শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের মানুষকে চেনা অপরিহার্য।

কামাল (کمال ) ও (تمام ) তামামের পার্থক্য

এখন প্রশ্ন হলো কামেল کمال)) এর প্রকৃত অর্থ কি? ইনসানে কামেল -এর অর্থই বা কি? আরবী ভাষায় এ দু শব্দের অর্থ কাছাকাছি হলেও এক নয়; যদিও দু টিরই বিপরীত শব্দ এক অর্থাৎ শব্দটি কখনো প্রথমটির বিপরীত শব্দ হিসেবে আবার কখনো দ্বিতীয়টির বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়,এমনকি ফার্সীতে ঐ দু টি শব্দের পরিবর্তে একটি শব্দই রয়েছে। ঐ দু টি শব্দ আরবীতে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও  کمال এবং تمام দু টিরই বিপরীত শব্দ ناقص (নাকিস) অর্থাৎ অসম্পূর্ণ। যেমন ফার্সীতে বলা হয় : এটা(کمال) বা সম্পূর্ণ এবং ওটাناقص বা অসম্পূর্ণ; তেমনি বলা হয়,এটাتمام ওটাناقص

আল কোরআনের একটি আয়াতে এ দু টি শব্দই এসেছে-

) الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي(

 “ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করলাম। (সূরা মায়েদা : ৩)

এখানে এটা বলা হয়নি যে,وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي বা,أَكْمَلْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي যদি তা বলা হতো,তবে আরবী ব্যাকরণে ভুল বলে গণ্য হতো। এখন এ দু শব্দের পার্থক্য কি? যদি আমরা এ দু য়ের পার্থক্যকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ না করি তাহলে আমাদের আলোচনা শুরু করতে পারব না। অর্থাৎ আমাদের আলোচনার শুরু হবে এ দু শব্দের অর্থ জানার মাধ্যমে।

تمام কোন বস্তুর জন্য তখনই বলা হবে যখন ঐ বস্তুর বাস্তব অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই অস্তিুত্বে এসে থাকে। অর্থাৎ যদি তা থেকে কিছু জিনিস অনুপস্থিত থাকে,তবে বস্তুটি ঐ বস্তু হওয়ার ক্ষেত্রে অপূর্ণ অথবা বলা যায় বস্তুটি তার অস্তিুত্বের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। যেমন অর্ধেক অস্তিুত্ব লাভ করেছে,এক-তৃতীয়াংশ অস্তিুত্ব লাভ করেছে বা দুই-তৃতীয়াংশ অস্তিুত্ব লাভ করেছে ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ একটি পরিকল্পিত মসজিদের বিল্ডিংয়ের জন্য হলরুম দরকার। রুমের জন্য দেয়াল,ছাদ,দরজা,জানালা ও অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন। যদি ঐ বিল্ডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় এ সকল অংশ বিদ্যমান না থাকে তবে ঐ বিল্ডিং ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। যখন প্রয়োজনীয় সব কিছু বিদ্যমান থাকবে তখন বলা যাবে বিল্ডিং সম্পূর্ণ (তামাম) হয়েছে। এ শব্দের বিপরীত স্থানকে নির্দেশ করতে অসম্পূর্ণ বা নাকিস ব্যবহার করা হয়। কোন বস্তু সম্পূর্ণতা লাভ করলেই তা পূর্ণতা লাভ করেছে বলা যায় না,বরং বস্তুটি হয়তো কখনো এর থেকে এক স্তর উপরের পর্যায়ের,কখনো কয়েক স্তর উপরের পর্যায়ের পূর্ণতা লাভ করে,এভাবে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। যদি এই کمال বা পূর্ণতা ঐ বস্তুর না থাকে তবুও তা ঐ বস্তুরই। কিন্তু পূর্ণতা লাভ করার অর্থ তা থেকে এক স্তর উপরে অবস্থান লাভ করা।

কামাল বা পূর্ণতাকে আড়াআড়ি বা সমান্তরালভাবে বর্ণনা করা হয়। যখন বস্তু সমান্তরালভাবে শেষপ্রান্তে বা পরিসীমায় পৌছায় তখন বলা হয় সম্পূর্ণ(تمال) হয়েছে এবং বস্তু যখন লাম্বিকভাবে উপরের দিকে বাড়তে থাকে বা উন্নতি লাভ করে তখন বলা হয় পূর্ণতা کمال)) লাভ করেছে। যদি বলা হয় অমুক ব্যক্তির বুদ্ধি (আকল) পূর্ণতা লাভ করেছে,এর অর্থ পূর্বেও তার বুদ্ধি ছিল,কিন্তু তার বুদ্ধি পূর্বের চেয়ে উপরের পর্যায়ে পৌছেছে বা পরিপক্ব হয়েছে। অথবা যদি বলা হয় অমুক ব্যক্তির জ্ঞান পূর্ণর্তা লাভ করেছে তাহলে এর অর্থ পূর্বেও তার জ্ঞান ছিল ও সে তা ব্যবহার করত,কিন্তু এখন তার জ্ঞান পূর্ণতার এক স্তর অতিক্রম করেছে। সুতরাং আমরা দেখছি,একজন সম্পূর্ণ মানুষ আছে যার বিপরীতে সমান্তরালভাবে চিন্তা করে অসম্পূর্ণ মানুষও আছে অর্থাৎ অর্ধেক মানুষ বা মানুষের ভগ্নাংশ। উদাহরণস্বরূপ এক-তৃতীয়াংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানুষ নয়। অন্য এক প্রকার মানুষও আছে যে মানুষ সম্পূর্ণ ও এই সম্পূর্ণ মানুষ পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে-এভাবে সর্বোচ্চ পরিসীমা পর্যন্ত যার উপর কোন পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না যাকে পরিপূর্ণতম বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষ বলা যায়।

ইনসানে কামেলের ব্যাখ্যা

সপ্তম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী সাহিত্যে ইনসানে কামেলের কোন ব্যাখ্যা ছিল না। বর্তমানে ইউরোপেও মানুষ সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা প্রচলিত থাকলেও ইসলামী বিশ্বে মানুষ সম্পর্কে এ ভাষা সপ্তম হিজরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। যিনি মানুষ সম্পর্কে প্রথম ইনসানে কামেল শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি হলেন বিখ্যাত আরেফ মহিউদ্দিন আরাবী আন্দালুসী তায়ী। মহিউদ্দিন আরাবী ইসলামী এরফানের (আধ্যাত্মিকতার) জনক। সপ্তম হিজরীর পর থেকে যত আরেফ ইসলামী জাতিসমূহের মধ্যে এসেছেন,যেমন ইরানী ও ফার্সী ভাষার আরেফগণ সকলেই মহিউদ্দিন আরাবীর ছাত্র। মৌলভী (মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী) মহিউদ্দিন আরাবীর মক্তবের ছাত্র। রুমী তার সকল মর্যাদাসহ এরফানের দৃষ্টিতে মহিউদ্দিন আরাবীর তুলনায় কিছূই নন। মহিউদ্দিন আরব জাতিভুক্ত ও হাতেম তায়ীর বংশধর এবং আন্দালুসের অধিবাসী ছিলেন। তার সকল ভ্রমণ ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি সিরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবর দামেস্কে। সিরিয়ায় মৃত্যুবরণ করা ও সেখানে দাফন হওয়ায় তাকে শামী বলা হয়। তার ছাত্রদের মধ্যে সদরুদ্দিন কৌনাভী তার পরে সবচেয়ে বড় আরেফ হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে ইসলামী এরফান যে একটি জ্ঞানের রূপে এসেছে তা শুধু মহিউদ্দিন আরাবী ও সদরুদ্দীন কৌনাভীর কর্মপচেষ্টার ফলেই। সদরুদ্দিন কৌনাভী তুরস্কের কৌনীর বাসিন্দা ও মহিউদ্দিন আরাবীর স্ত্রীর পূর্ববতী স্বামীর ঔরসজাত পুত্র ছিলেন। অর্থাৎ মহিউদ্দীন তার শিক্ষকও ছিলেন আবার সৎ পিতাও। মৌলভী জালালুদ্দিন রুমী সদরুদ্দিন কৌনাভীর সমসাময়িক ছিলেন। সদরুদ্দিন একটি মসজিদের জামায়াতের ইমাম ছিলেন। মৌলভী সেখানে যেতেন ও তার পেছনে নামাজ পড়তেন। মহিউদ্দিন আরাবীর চিন্তা সদরুদ্দিনের মাধ্যমে মৌলভীর কাছে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

অন্যতম যে বিষয়টি এ ব্যক্তি উপস্থাপন করেন তা ইনসানে কামেল সম্পর্কিত। তবে তিনি বিষয়টি এরফানের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে সাহেবে মানজুমে খ্যাত মাহমুদ সাবেস্তারীর সবচেয়ে উন্নত ও মূল্যবান সাহিত্যমান সম্পন্ন বই গুলশানে রজ -এ যে প্রশ্নগুলো ইনসানে কামেলের ব্যপারে এসেছে সদরুদ্দিন এরফানের দৃষ্টিতে সেগুলোর জবাব দিয়েছেন। সুতরাং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ বিষয়টি ইনসানে কামেল শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন ও এরফানের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। অন্যরাও ইনসানে কামেলকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ও রূপে বর্ণনা করেছেন। আমরা দেখতে চাই ইনসানে কামেল কোরআনের দৃষ্টিতে কেমন মানুষ। আলোচনাকে সম্পূর্ণ মানুষ অসম্পূর্ণ মানুষ দিয়ে শুরু করছি যেন এ বিষয়ের উপর পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করতে পারি।

শারিরীক ও মানসিক ক্রটি

আমাদের মধ্যে কি ত্রুটিহীন এবং ত্রুটিযুক্ত মানুষও রয়েছে? সুস্থতা ও অসুস্থতা (ত্রুটি) কখনো কখনো মানুষের দেহের সাথে সম্পর্কিত। সন্দেহ নেই যে,কিছু মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ ও ত্রুটিমুক্ত এবং কিছু মানুষ ত্রুটিযুক্ত ও অসুস্থ। উদাহরণস্বরূপ শারীরিক ত্রুটি,যেমন দৃষ্টিহীনতা ও অন্ধত্ব,পঙ্গুত্বও পক্ষাঘাতগ্রস্ততা প্রভৃতি। কিন্তু এগুলো ব্যক্তি-মানুষের সাথে সম্পর্কিত,মানুষের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নয়। কোন ব্যক্তি যদি অন্ধ,বধির,পঙ্গু,খাটো বা কুৎসিত চেহারার হন,এ ত্রুটিগুলোকে আপনি তার মর্যাদা,ব্যক্তিত্ব ও মনুষত্বের ক্ষেত্রে ত্রুটি হিসেবে দেখেন না। যেমন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস যাকে নবীদের পরবর্তী পর্যায়ের জ্ঞানী বলে ধরা হয় তিনি পৃথিবীর এক কদাকার মানুষ ছিলেন। কিন্তু কেউই তার এ কদাকৃতিকে একজন মানুষ হিসেবে তার ত্রুটি বলে মনে করেন না। অথবা আবুল আলা মাযারি (আরব কবি) এবং ত্বাহা হোসেইন (মিশরীয় সাহিত্যিক) যারা উভয়ই অন্ধ ছিলেন,তাদের এ শারীরিক ত্রুটি ব্যক্তিগত ত্রুটি হিসেবে পরিগণিত হলেও তাদের ব্যক্তিত্বের জন্য ত্রুটি বলে গণ্য হবে কি? অবশ্যই নয়। সুতরাং মানুষের ব্যক্তি দিক তার ব্যক্তিত্বের দিক হতে যে ভিন্ন তা প্রমাণিত সত্য। একটি তার দেহের সাথে,অন্যটি তার রূহের সাথে সম্পর্কিত। মনের বিষয় তার দেহ থেকে ভিন্ন। যারা মনে করেন মানুষের মন একশ ভাগ দেহের অনুগত তাদের ভুল এখানেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষের দেহ পুরোপুরি সুস্থ থাকলেও তার অন্তর কি অসুস্থ হতে পারে? এটা একটা প্রশ্ন সুতরাং যারা রূহ বা আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চান এবং রূহের সকল বৈশিষ্ট্যকে মানুষের স্নায়ুর সরাসরি প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন,তারা প্রকৃতপক্ষে বলতে চান যে,মন কিছুই নয়,সবই দেহের অনুগামী। তাদের মতে মন অসুস্থ হওয়ার অর্থ তার দেহ অসুস্থ। অর্থাৎ মানসিক অসুস্থতা এবং দৈহিক অসুস্থতা একই।

এটা আনন্দের বিষয় যে,বর্তমানে এটা প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে একজন মানুষ শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে (যেমন শরীরে লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ দেহে ভিটামিনের পরিমাণ,পরিপাকতন্ত্রের মেটাবলিক কার্যক্রম,এমনকি নিউরোলজিক দৃষ্টিকোণ থেকে) সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে। কিভাবে তা সম্ভব? আধুনিক পরিভাষায় একে মানসিক জটিলতা বলা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান মানসিক জটিলতাসম্পন্ন মানুষকে অসুস্থ বলে মনে করে। এমন ব্যক্তিরদেহে শারীরিক কোন জটিলতা সৃষ্টি না হয়েই মানসিক জটিলতার সৃষ্টি য়েছে। তাই এ ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসা শারীরিকভাবে না করে মানসিকভাবে করতে হয়। যেমন অহংকার যা মানসিক জটিলতা থেকে উদ্ভূত,একটি রোগ বলে বর্তমানে প্রমাণিত তা প্রকৃতপক্ষেই একটি আত্মিক ও মানসিক রোগ। কিন্তু কোন ঔষধের দোকানে অহংকার রোগের ঔষধ পাওয়া যাবে কি? কিংবা বাস্তবে এটা কি সম্ভব যে,অহংকারী ব্যক্তি একটি ট্যাবলেট খাবে আর সাথে সাথে তার অহংকার বিলুপ্ত হয়ে সে এক নিরহংকার ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে? না,এটা কখনোই সম্ভব নয় যে,জল্লাদ ও পাষাণ হৃদয়ের শিমারের মত কাউকে একটা ইনজেকশন পুশ করা হবে বা একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়া হবে আর সে রাতারাতি একজন দয়ালু,হৃদয়বান ও প্রশস্ত অন্তরের মানুষে পরিণত হয়ে যাবে। তবে এ ব্যাধিগুলোর চিকিৎসার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে যা এভাবে নয়।

এমনকি শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসাও কখনো কখনো মানসিকভাবে করা সম্ভব। যেমনভাবে কখনো কখনো মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা শারীরিকভাবে করা হয়ে থাকে। যেমন কোন রোগ হয়তো শারীরিক,কিন্তু মানসিক উদ্দীপনা ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তার চিকিৎসা করা হয়। এ বিষয়ে আলোচনা বেশ ব্যাপক এবং বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার মতোও বটে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়,মানুষ দেহ ও মনের সমন্বয়ে এক সৃষ্টি এবং মানুষের মন তার দেহ হতে স্বাধীন ও সম্পূর্ণরূপে দেহের অনুগামী নয়। তেমনিভাবে দেহও পুরোপুরি মনের অনুগামী নয়। তবে এরা একে অপরকে প্রভাবিত করে। জ্ঞানীদের ভাষায় দেহ ও মন একে অপরের উপর গঠনমূলক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ যেমনভাবে দেহ মনের উপর প্রভাব ফেলে তেমনভাবে মনও দেহের উপর প্রভাব ফেলে। সেই সাথে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবেও কাজ করে। তাই মানুষের মনোজগৎ একটি স্বাধীন জগতের অধিকারী।

আমরা পূর্ণ মানবের আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে ত্রুটিহীন ও ত্রুটিযুক্ত মানুষের বিষয়টি এনেছি এজন্য যে,আমাদের নিকট এটা পরিষ্কার হওয়া যে,আমাদের উদ্দেশ্য এখানে শারীরিক সুস্থতা বা ত্রুটি নয় এবং আমাদের উদ্দেশ্য এটাও নয় যে,মানব দেহ কতটা সুস্থ তা নিরীক্ষা করা। প্রকৃতপক্ষে তা দিয়ে আমাদের কাজও নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো বাস্তবে এটা প্রমাণ করা যে,মানুষ যেমনভাবে মানসিকভাবে সুস্থ হতে পারে তেমনিভাবে ত্রুটিযুক্ত ও অসুস্থও হতে পারে। কোরআন এ সত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে বলছে,

) فِي قُلُوبِهِم مَّرَ‌ضٌ فَزَادَهُمُ اللَّـهُ مَرَ‌ضًا(

তাদের অন্তরে অসুস্থতা রয়েছে,অতঃপর আল্লাহ তাদের এ অসুস্থতাকে বৃদ্ধি করে দেন। (সূরা বাকারাহ্ : ১০)

এখানে আল্লাহ্ বলছেন তাদের অন্তর রোগাক্রান্ত ও রূহ অসুস্থ,এটা বলেননি যে,তাদের চক্ষু অসুস্থ। এখানে লক্ষণীয় কোরআন হৃদয় বা অন্তর বলতে যা বুঝিয়েছে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানের হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড নয় যে,এর আরোগ্যের জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কোরআনের বর্ণিত হৃদয় হলো মানুষের আত্মা ও মানস। যেমন কোরআন অন্যত্র বলছে,

) وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْ‌آنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَ‌حْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ(

  আমরা কোরআনে যা কিছু অবতীর্ণ করেছি তা মুমিনদের জন্য আরোগ্য লাভের উপায় ও রহমতস্বরূপ। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮২)

সুতরাং কোরআন মুমিনদের জন্য আরোগ্য লাভের উপায়।

আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন,الا و انّ من البلاء الفاقة জেনে রাখ,নিশ্চয়ই দারিদ্র্য একটি বড় বিপদو اشد من الفاقة مرض البدن এবং দারিদ্র্য হতে মন্দ শারীরিক অসুস্থতা

  و اشد من مرض البدن مرض القلب এবং শারীরিক অসুস্থতা হতে মন্দ ও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা। কোরআনের অন্যতম পরিকল্পনা হলো সুস্থ মানুষ তৈরি। তাই আমাদের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পূর্বে সুস্থ ও ত্রুটিহীন মানুষ হতে হবে।

মানবাত্মার ব্যাধি

প্রথমে আমরা যে সকল বস্তু মানবাত্মাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বঞ্চনা আত্মিক রোগের অন্যতম উৎস। অধিকাংশ মানসিক রোগের কারণ হলো বঞ্চনা। আপনারা জানেন ফ্রয়েড বাড়াবাড়িমূলকভাবে এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন,বিশেষত যৌনতার বিষয়ে। যা হোক বঞ্চনা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ। বঞ্চনা মানুষের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। যখন মানুষ অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করে তখন তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং যতক্ষণ না তাকে হত্যা বা লাঞ্ছিত করতে পারে ততক্ষণ শান্তি লাভ করতে পারে না। এ প্রতিশোধ স্পৃহাটি কি?

হিংসুক ব্যক্তি যখন কারো ভালো বা কল্যাণ দেখে তখন তার সমগ্র কামনা হয়ে ওঠে এটা যে,ঐ ব্যক্তি থেকে এ কল্যাণ যেন দ্রুত অপসারিত হয়। নিজের বিষয়ে তখন সে আর চিন্তা করে না,বরং ঐ ব্যক্তির অমঙ্গলের চিন্তায় মগ্ন হয়। সুস্থ চিন্তার মানুষ প্রতিযোগিতা করে,হিংসা করে না। সুস্থ মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। সব সময় এগিয়ে থাকার চিন্তা করা সুস্থতার পরিচয়,এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্যেরা সব সময় পিছে পড়ে থাক- এ চিন্তা অসুস্থতার পরিচায়ক। হিংসুক ব্যক্তির অসুস্থতা কখনো কখনো এতটা অধিক হয় যে,নিজের একশ ভাগ ক্ষতি করেও যদি অপরের পাঁচ ভাগ ক্ষতি করা যায় তাতে সে খুশী।

হিংসা রোগের নমুনা

একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে এসেছে। কোন এক খলিফার সময় একজন ব্যক্তি একদাস কিনে এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার সঙ্গে দাসের মতো আচরণ না করে বরং সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করত। সব সময় ভাল খাবার দিত,তার জন্য ভাল পোষাক কিনত,বিশ্রামের জন্য উত্তম উপকরণ এনে দিত। মোট কথা,তার সঙ্গে নিজের সন্তানের মত আচরণ করত। মনে হতো লালন-পালনের জন্যই তাকে আনা হযেছে। দাসটি লক্ষ্য করত তার মনিব সব সময়ই বিষন্ন ও চিন্তিত। কিন্তু তার কারণ সে জানত না। একদিন মনিব তাকে ডেকে বলল, আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে চাই,সে সাথে প্রচুর অর্থও দিতে চাই। কিন্তু তুমি কি জান কেন তোমাকে এত আদর ও স্নেহ করেছি? এজন্য যে,তুমি যেন আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর। তুমি যদি তা রক্ষা কর তবে আমার আদর-স্নেহের প্রতিদান দিলে এবং এর জন্য আরো অধিক কিছু তোমাকে আমি দেব। কিন্তু যদি তা না কর তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট। দাস বলল, যেহেতু আপনি আমার মনিব এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন,আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব। মনিব বলল, না,তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে,আমার ভয় হয় যদি রাজি না হও। দাস বলল, যে কোন প্রস্তাব দিন আমি রাজী হব। যখন দাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখন মনিব বলল, আমার অনুরোধ হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে নির্দেশ দেব। তুমি আমার মাথা গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। দাস বলল, আমি তা করতে পারব না। মনিব বলল, না,অবশ্যই তোমাকে তা করতে হবে। কারণ তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। মাঝ রাতে মনিব দাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটি ধারালো ছুরি হাতে দিয়ে তাকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ীর ছাদে গেল আর বলল, এখানেই আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন কর,তারপর যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। দাস বলল, কেন এটা করব? সে বলল, যেহেতু এই প্রতিবেশীকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু আমার কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সে আমার থেকে অগ্রগামী। সব কিছুতেই সে আমার থেকে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। আমি হিংসার আগুনেজ্বলে মরছি। আমি চাই সে খুনী বলে পরিচিত হোক ও শাস্তি ভোগ করুক। যদি এমন হয় তবেই আমি শান্তি পাব। আমার শান্তি এখানেই যে,যদি আমাকে এখানে হত্যা কর,কালকে সবাই বলবে (যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশ তার বাড়ির ছাদে পাওয়া গেছে) সে-ই আমাকে হত্যা করেছে। অতঃপর তাকে বন্দীকরা হবে ও পরে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ হবে। দাস বলল, যেহেতু তুমি এমন বোকা লোক সেহেতু কেন আমি এটা করব না। তুমি এটার জন্যই উপযুক্ত। অতঃপর সে মনিবের মাথা বিচ্ছিন্ন করল এবং টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল। পরের দিন সবখানে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঐ বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু সবাই বলাবলি করতে লাগল যদি সে খুনীই হতো তবে নিজের বাড়ির ছাদে খুন করতে যাবে কেন? সম্ভবত কিছু একটা আছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। দাসের বিবেক তাকে চিন্তায় ফেলল। অবশেষে বিচারকের কাছে গিয়ে সত্য ঘটনা বর্ণনা করে সে বলল, আমি তার ইচ্ছাতেই তাকে হত্যা করেছি। সে প্রতিহিংসায় এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,মৃত্যুকে জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যখন প্রমাণিত হলো ঘটনা এ রকম তখন দাস এবং ঐ বাড়ির মালিক দু জনকেই মুক্তি দেয়া হলো।

সুতরাং এটা বাস্তব যে,মানুষ প্রকৃতই হিংসা রোগে অসুস্থ হয়। কোরআন বলছে,

( قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا)

সে-ই সফলকাম হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং সে-ই অকৃতকার্য হলো যে তা প্রোথিত করল। কোরআনের প্রথম কর্মসূচী আত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নয়ন এবং হৃদয়কে মানসিক রোগ,সমস্যা,অশান্তি,অন্ধকার ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা।

রূপান্তরিত মানুষ

রূপান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রূপান্তর অর্থ কি? নিশ্চয় শুনেছেন পূর্বকালে এক উম্মত ছিল যারা প্রচুর গুনাহের কারণে তৎকালীন নবীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অন্য এক পশুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন বানর,শূকর,নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণীতে। এটাকেই রূপান্তর বলা হচ্ছে। এই রূপান্তর প্রকৃতপক্ষে কিরূপ ছিল? মানুষ কি প্রকৃতই পশুতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এখন এর ব্যাখ্যা করব। এটি অনস্বীকার্য যে,মানুষ দৈহিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত নাহলেও মানসিক ও আত্মিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত হয়,এমনকি কখনো কখনো এত নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয় যে,যার নজীর পৃথিবীতে খুজে পাওয়া বিরল। কোরআন বলছে-( بل هم أضلّ )   অর্থাৎ চতুষ্পদ জন্তু হতেও নিকৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো মানুষ কি প্রকৃতই মানসিক ও আত্মিকতার দিক থেকে পশুতে পরিণত হতে পারে? উত্তর হলো,হ্যাঁ। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব তার চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। যদি কোন মানুষের চারিত্রিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য কোন হিংস্র প্রাণীর বা চতুস্পদ পশুর মত হয় তবে সে প্রকৃতই রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আত্মা প্রকৃতই রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে এক পশুতে পরিণত হয়েছে। শূকরের দেহ তার আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দৈহিকভাবে শূকরের মত না হয়েও শূকরের সকল স্বভাব ধারণ করতে পারে। যদি কোন মানুষ এরূপ হয় তবে সে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তব ও অন্তর্দৃষ্টিতে সে প্রকৃতই একটি শূকর বৈ কিছু নয়। তাই ত্রুটিযুক্ত মানুষ কখনো কখনো রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়। আমরা এ সব কথা কম শুনি এবং অনেকেই মনে করেন এগুলো metaphoric বা allegory (রূপক) এবং এগুলো বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু এটা খুবই সত্য।

এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে, ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। উপর থেকে লক্ষ্য করলাম ময়দান হাজীতে পূর্ণ। ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললাম : কি পরিমাণ হাজী এ বছর এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। ইমাম বললেন : চিৎকার এত বেশি,কিন্তু হাজী খুবই কম। ঐ ব্যক্তি বলেছে, তারপর জানি না ইমাম এমন দৃষ্টি শক্তি দান করলেন আমাকে এবং বললেন : লক্ষ্য কর। আমি লক্ষ্য করলাম সম্পূর্ণ ময়দান যেন পশুতে পূর্ণ- যেন পশু আলয়ের (চিড়িয়াখানা) মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ চলাচল করছে। ইমাম বললেন : এখন দেখ বাতেন (অপ্রকাশ্য) কিরূপ! যারা অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী তাদের নিকট এ বিষয়টি প্রদীপের মতই উজ্জ্বল। এখন যদি আধুনিক চিন্তাধারার কেউ তা অস্বীকার করতে চায় তাহলে ভুল করবে। আমাদের এখনকার সময়ও ব্যক্তি-বিশেষ ছিলেন এবং আছেন যারা মানুষের সত্তাকে অনুভব করেন এবং দেখেন।

যে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু খাওয়া,ঘুমানো,যৌন চাহিদা পূরণ ছাড়া (প্রাণীর) অন্য কোন চিন্তা করে না,তার চিন্তা শুধু এটাই যে,খাবে,ঘুমাবে আর দৈহিক আনন্দ অনুভব করবে,প্রকৃতপক্ষে তার আত্মা একটা চতুস্পদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। তার অন্তর একটি রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়েছে। যার স্বভাব রূপান্তরিত,তার মানবিক বৈশিষ্ট্য রূপান্তরিত- কিভাবে তা ব্যাখ্যা দেব। অর্থাৎ তার মনুষ্যত্ব তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,ঐ স্থানে সে নিজের জন্য চতুষ্পদ ও হিংস্র পশুর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।

সূরা নাবায় আমরা পড়ি সে দিন যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। এবং আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে ফলে তা বহু দ্বারে বিভক্ত হয়ে পড়বে। পর্বতকে বিচলিত করা হবে ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা : ১৮-২০) কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে পুনরুত্থিত ও সমবেত হবে। রাসূলগণ সব সময়ই বলেছেন,শুধু মানুষের একটি দল মানুষের চেহারায় পুনরুত্থিত হবে। কোন কোন দল পিপীলিকার মত,কোন দল সাপের মত,কোন দল নেকড়ের মত চেহারা নিয়ে হাশরের ময়দানে আবির্ভূত হবে। কেন? এটা কি সম্ভব কোন কারণ ছাড়াই মহান আল্লাহ্ মানুষকে এ রকম আকৃতিতে পুনরুত্থিত করবেন? যে ব্যক্তির পৃথিবীতে মানুষকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া কোন কাজ ছিল না,যার সকল আনন্দ অন্যদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে নিহিত ছিল সে প্রকৃতই একটি বিষাক্ত বিচ্ছু। তাই সে সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যে ব্যক্তির বাঁদরামী করাই একমাত্র স্বভাব ছিল কিয়ামতে প্রকৃতই সে বাঁদরের চেহারা নিয়ে আবিভূত হবে। এমনিভাবে যার স্বভাব কুকরের মতো সে কুকর হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। মানুষ তার নিয়্যতের (কাজের) উপর ভিত্তি করেই পুনরুত্থিত হবে। (মুসনাদে আহমদ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৯২)

কিয়ামতে মানুষ তার নিয়্যত,উদ্দেশ্য,ইচ্ছা,তার স্বভাব ও তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থিত হবে। আপনি এ পৃথিবীতে কি চেহারাতে আছেন? কি হতে চান? কি বস্তু চান? আপনার ইচ্ছাগুলো কি মানুষের চাওয়া নাকি কোন হিংস্র পশুর চাওয়া ? নাকি এক তৃণভোজীর মতো চাওয়া? যা আপনি চান আপনি তা-ই এবং সে চেহারাতেই আপনি পুনরুত্থিত হবেন যে রকম আছেন।

এটাই আমাদের আল্লাহ্ ব্যতীত সকল কিছুর উপাসনা থেকে বিরত করে। আমরা যা কিছুর উপাসনা করব তার মতোই হব। যদি টাকার উপাসনা করি,যদি অর্থ আমাদের অস্তিত্ব ও অস্তিুত্বের অংশে পরিণত হয়,এ অর্থ কিয়ামতে সে-ই উত্তপ্ত ধাতব পদার্থে পরিণত হবে। কোরআন এ পৃথিবীতে যাদের অস্তিত্ব এই ধাতব পদার্থের অস্তিুত্বের সাথে মিশে গিয়েছে এবং এই ধাতুর উপাসনা ছাড়া যার কোন কাজ নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছে, এবং যারা সোনা-রূপা মজুদ করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না,তুমি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সে দিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে,পার্শ্বদেশে ও তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে এটা সেই বস্তু যা তোমরা নিজেদের জন্য প্রস্তত করতে। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

এ অর্থই সে দিন উত্তপ্ত করা হবে- তার জন্য জাহান্নামের আগুনে পরিণত হবে। এটা অন্যতম উপাদান যা মানুষকে রূপান্তরিত করে।

আমি এ বৈঠকে ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন মানুষের বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম। সমস্যাগ্রস্ত (মানসিক) মানুষ একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। যে মানুষ পৃথিবীর কোন বস্তুকে উপাসনা করে-তার দৈনন্দিন কাজে বস্তু ব্যবহারকারী নয়,বরং এর উপাসনাকারী- সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত এবং একজন রূপান্তরিত মানুষ।

পবিত্র রমযান মাসের মানুষ গঠনের পরিকল্পনা

আসলেই পবিত্র রমযান মাসের কর্মসূচী মানুষ গঠনের পরিকল্পনার । অর্থাৎ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য এটাই যে,এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা নাফ্স বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি,মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার উপর বুদ্ধিবৃত্তি,ঈমান ও ইচ্ছা শক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।

এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী,সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উড্ডয়ন,আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয় যে,পবিত্র রমযান মাস এল,মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল,উদাহরণস্বরূপ রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল,এখানে ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল,তারপর ঈদ আসলো,কিন্তু রমযানের পূর্বের দিন থেকে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,তাহলে ঐ রোযা তার জন্য কোন উপকারই বয়ে আনেনি। ইসলাম তো এটা চায় না যে,মানুষ এমনিই মুখ বন্ধ করে রাখবে। মানুষ মুখ বন্ধ করুক আর না করুক ইসলামের জন্য কোন পার্থক্য নেই,বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা যে,মানুষ সংশোধিত হবে। কেন হাদীসসমূহে এমন এসেছে,প্রচুর রোযাদার আছে যারা রোযা থেকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না,তাদের রোযা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়। হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গীবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।

রোযা যে বাতেনী,আধ্যাত্মিক ও আত্মিক তার প্রমাণ- একদিন এক রোযাদার মহিলা রাসূল(সা.)-এর নিকট আসল। রাসূল দুধ অথবা অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও পান কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোযা আছি। রাসূল বললেন, তুমি রোযা রাখনি এবং এ বলে পুনরায় তাকে খেতে নির্দেশ দিলেন। মহিলা বলল, আসলেই আমি রোযা আছি। (যেহেতু তার বিবেচনায় রোযা আছে বলে মনে করল,যেমন বাহ্যিক রোযা আমার রাখি)। রাসূল বললেন, তুমি কেমন রোযা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ পূর্বেই তোমার মুমিনভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গীবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে,মাংস খেয়েছ। ভেতর থেকে এখনই তা উল্টিয়ে ফেল। তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোযা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে,কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দ্বারা পূর্ণ করে।

কেন আমাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে যে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুগন্ধ ছড়াবে। এ দুগন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।

পরনিন্দা ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ গীবত থেকেও খারাপ,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গীবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গীবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু টি কবীরা গুনাহ এক সঙ্গে আঞ্জাম দেয়া হয়।

এটা কি উচিত,রমযান মাস শেষ হয়ে যায়,অথচ এ মাসে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ করতে থাকি? রমযান মাস এজন্য যে,মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে,মসজিদে একত্র হবে। এজন্য নয় যে,একে অপরকে দূরে সরানোর জন্য এ মাসকে ব্যবহার করবে।

و لا حول و لا قوّة ألا بلله العلی العظیم

মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ

প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার সঙ্গে অন্য অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ণ মানুষ এবং পূর্ণ ফেরেশতা এক নয়। যদি কোন ফেরেশতা,ফেরেশতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা সম্ভাব্য পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌছায়,তা মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানো থেকে ভিন্ন।

মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্যের কারণ

যিনি আমাদের ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি (আল্লাহ্) বলেছেন,ফেরেশতারা এমন এক সৃষ্টি যারা নিখাদ আকল দিয়ে সৃষ্ট হয়েছেন,তাদের সৃষ্টির মূল কেবল চিন্তা ও বিবেচনা ছাড়া কিছুই নয় অর্থাৎ পার্থিব,জৈবিক চাহিদা,উত্তেজনা,উগ্রতা এগুলোর অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অন্যান্য জীব শুধু শারীরিক এবং কোরআন যাকে রূহ বলছে তা থেকে বঞ্চিত। শুধু মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে ফেরেশতাদের যা আছে তা লাভ করেছে আবার অন্যান্য সৃষ্টির যা আছে তারও সে অধিকারী। সে যেমন স্বর্গীয় তেমন পার্থিব। সে যেমন সর্বোচ্চ সৃষ্টি তেমনি সর্ব নিকৃষ্টও হতে পারে। এরই ব্যাখ্যায় উছুলে কাফীতে একটি হাদীস এসেছে এবং আহলে সুন্নাতও এর কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করেছে। মাওলানা রুমী তার মাসনভীতে এ হাদীস এভাবে কবিতার মাধ্যমে এনেছেন-

হাদীসে এসেছে গৌরবময় স্রষ্টা মহাজন,

সৃষ্টি জগতে করিলেন তিন রকম সৃজন।

তারপর বলছেন,এক দলকে নিখাত নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন অন্য দলকে (উদ্দেশ্য জীবজন্তু) শুধুই উত্তেজনা এবং জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু মানুষকে এ দু য়ের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পরিপূর্ণ মানুষ যেমন একটি পরিপূর্ণ পশুর থেকে ভিন্ন (উদাহরণস্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি ঘোড়া থেকে আলাদা) তেমনি একজন পূর্ণ ফেরেশতা থেকেও ভিন্ন।

ফেরেশতা ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পাথর্ক্যের কারণ তার সত্তার উপাদান যেমন কোরআন বলছে, আমরা মানুষকে এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে অনেক কিছুর মিশ্রণ রয়েছে। আধুনিকতার ভাষায় বললে তার জীনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মেধা,যোগ্যতা ও ক্ষমতার সমন্বয় হয়েছে। মানুষ এমন মর্যাদায় পৌছেছে যে,আমরা তাকে পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করেছি। এটি অত্যন্ত.গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমরা তাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা ও নম্বর প্রদানের জন্য যোগ্য মনে করেছি। ( إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ) নিশ্চয়ই মানুষকে এমন বীর্য যা বহু গুণাবলী ও শক্তির মিশ্রণ তা থেকে সৃষ্টি করেছি। এজন্যই তাকে পরীক্ষা,পুরস্কার,শক্তি ও নম্বর প্রদান করেছি। কিন্তু অন্য কেউ যোগ্যতা রাখে না।

 ) فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا(

অতঃপর আমরা তাকে সম্যক শ্রবণকারী এবং দর্শনকারী করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি,হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে,নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সূরা দাহর : ২-৩)

এর থেকে ভালো ও সুন্দরভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং এর মূল ভিত্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছি,উত্তীর্ণের পথও তাকে বলে দিয়েছি। এখন সে নিজেই বেছে নিবে কোন্ দিকে সে যাবে।

সুতরাং কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কার হয় যে,পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার কারণ এ বহুবিধ গুণাবলী ও শক্তি। তাই ফেরেশতার সঙ্গে তার পার্থক্য।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27