ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38817
ডাউনলোড: 5737

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38817 / ডাউনলোড: 5737
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করব?

মৃত্যুকে গ্রহণ করা সন্দেহাতীতভাবে মানুষের পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। যেহেতু মৃত্যুভয় মানুষের জন্য একটি বড় দুর্বলতা সেহেতু মানুষের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে এটি। যেমন অপমানকে গ্রহণ,অসম্মানজনক অধীনতা গ্রহণ করা এরূপ হাজারো দুর্গতি। যদি কেউ মৃত্যুকে ভয় না পায় তাহলে তার পুরো জীবনই পাল্টে যাবে। মহৎ ব্যক্তিরা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে সাহসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। (অবশ্য আত্মহত্যার ফল আমরা বলছি না। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দায়িত্ব মনে করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কথা বলছি। যারা আত্মহত্যা করে তারা তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এ কাজ করে।)

যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তবে মানুষের জন্য তা সাফল্য। ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন,

إنّی لا أری الموت إلا سعادة و لا الحیاة مع الظالمین إلا برما

আমি মৃত্যুকে সাফল্য ছাড়া কিছু মনে করি না আর জালেমদের সঙ্গে বেঁচে থাকাকে অপমান ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। (লুহুফ,পৃ. ৬৯)

মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণকে আল্লাহ প্রেমিক ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না। যাদের কাছে মৃত্যু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থান পরিবর্তনের মতো। ইমাম হুসাইনের ভাষায় একটি সাঁকো অতিক্রম করার মতো,এ ছাড়া কিছু নয়। ইমাম হুসাইন আশুরার দিন সকালে তার সাথীদের বলেন,

ما الموت إلا قنطرة تعبر بکم عن البؤس و الضّرّاء إلی الجنان

মৃত্যু একটি পুলের মত যার উপর দিয়ে তোমরা অতিক্রম করবে ও জান্নাতকে আলিঙ্গন করবে (কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। (মায়ানী আল আখবার সাদুক,পৃ. ২৮৯)৮৬

হে আমার সাথীরা! আমাদের সম্মুখে শুধু একটি সাঁকো রয়েছে যার নাম মৃত্যু- এটা অতিক্রম করলেই আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যু নিকটবর্তী হচ্ছিল ইমাম হুসাইনের চেহারা তত সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল হচ্ছিল।

যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন ইমাম হুসাইন ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উমর ইবনে সা দের একজন সহযোগী যে এ দৃশ্য লক্ষ্য করছিল সে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে উমর ইবনে সা দকে বলল, অনুমতি দাও,ওর জন্য কিছু পানি নিয়ে আসি। এখন তো ও মারাই যাচ্ছে,পানি খেলেও কিছু করতে পারবে না। উমর ইবনে সা দ অনুমতি দিলে সে যখন পানি নিয়ে ফিরছিল তখন দেখল পাষণ্ড ও অভিশপ্ত শিমার ইমামের মাথা নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে দেখার অভিব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছে-

و لقد شغلتی نور وجهه عن الفکرة فی قتله

  তার চেহারার নূরে এতটা মোহিত হয়েছিলাম যে,তার নিহত হওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

পূর্ণ মানব সে-ই যার উপর কোন পরিস্থিতিই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না (ক্ষমতা,প্রভাব,দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ কোন অবস্থাতেই সে তার ভারসাম্য ও ব্যক্তিত্বকে হারায় না)। যেমন আলী (আ.) এরূপ এক নমুনা যিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ ও মর্যাদার সকল স্তরেই অবস্থান করেছেন; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ খেলাফত থেকে সর্বনিম্ম পদ শ্রমিকের কাজও তিনি করেছেন। আলী আলওয়ারদী বলেছেন, আলী (আ.) কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আলীর কুড়ে ঘরেরঁ জীবনের সঙ্গে (শ্রমিক অবস্থায়) প্রাসাদের জীবনের (খেলাফতের সময়কাল,যদিও প্রকৃতপক্ষে আলী প্রাসাদে বাস করতেন না,তবে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে) কোন পার্থক্য ছিল না। শ্রমিক আলীর চিন্তার সঙ্গে খলিফা আলীর চিন্তার কোন পার্থক্য ছিল না। এজন্যই আলী (আ.) পূর্ণ মানব।

আলী (আ.)-এর গোপনে দাফন

আমরা কেন আজকে এখানে সমবেত হয়েছি? সমবেত হয়েছি এক পূর্ণ মানব-এর শোক পালন করতে। যেহেতু এ পূর্ণ মানবকে গোপনে দাফন করতে হয়েছে। কেন? কারণ তার যেরূপ পরম বন্ধু রয়েছে সেরূপ পরম শত্রুও রয়েছে। আলী (আ.)-এর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গ্রন্থে (বাংলায় অনূদিত হয়েছে) আমরা উল্লেখ করেছি এ ধরনের ব্যক্তিরা যেমন প্রচণ্ড আকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি বিকর্ষণ ক্ষমতারও। তাদের বন্ধুও যেমনি থাকে চরম অন্তরঙ্গ ও উচ্চ পর্যায়ের যারা যে কোন সময়ে তার জন্য প্রাণ দিতে অকুণ্ঠিত তেমনি শত্রুও থাকে যারা তার রক্তের জন্য পিপাসার্ত বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও নিকটতম শত্রু। যেমন খারেজীরা দীনের বাহ্যিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ও ঈমানের অধিকারী,কিন্তু দীনের মূল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আলী (আ.) নিজেই বলেছেন,এরা ঈমানদার,কিন্তু অজ্ঞ। তার ভাষায়-

لا تقولوا الخوارج بعدی فلیس من طلب الحق فأخطاه کمن طلب الباطل فأدرکه

খারেজীদের আমার মৃত্যুর পর আর হত্যা করো না,যেহেতু যারা সত্যের সন্ধানী,কিন্তু ভুল করছে তারা যারা অসত্যকে জানার পরও তার অনুসরণ করছে এক সমান নয়। খারেজীদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের তুলনা করে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর এদের হত্যা করো না। এদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য রয়েছে,এরা সত্যকে চায়,কিন্তু বোকা (তাই অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়) ও ভুল করে। কিন্তু মুয়াবিয়াপন্থীরা সত্যকে জেনেই তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।

তাই কেন আলীকে এত বন্ধু ও সুহৃদ থাকা সত্ত্বেও রাত্রিতে গোপনে দাফন করা হয়েছে? এই খারেজীদের ভয়ে। যেহেতু তারা বলত আলী মুসলমান নয়,তাই ভয় ছিল তারা জানতে পারলে কবর থেকে তার লাশ বের করে অপমান করত।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ের শেষ দিকে প্রায় শত বছর পর্যন্ত নবী পরিবারের ইমামরা ব্যতীত কেউই জানত না যে,ইমাম আলী (আ.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে।

একুশে রমযানের ভোরে ইমাম হাসান (আ.) জানাযার আকৃতিতে সাজিয়ে একটি খাটিয়া কিছু ব্যক্তির হাতে দেন মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যাতে লোকজন মনে করে আলী (আ.)-কে মদীনায় দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু ইমাম আলীর সন্তানগণ ও কিছু সংখ্যক অনুসারী যারা তার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানতেন তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। বর্তমানে কুফার নিকটে নাজাফে যে স্থানে আলীর সমাধি রয়েছে সেখানে তারা গোপনে যিয়ারতে আসতেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় যখন খারেজীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং আলীর প্রতি অসম্মানের সম্ভাবনা রহিত হয় তখন ইমাম সাদিক তার এক সাহাবী সাফওয়ান (রহ.)-কে সে স্থান চিহ্নিত করে গাছ লাগিয়ে দিতে বলেন। এরপর থেকে সবাই জানতে পারে ইমাম আলীর কবর সেখানে এবং তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার কবর যিয়ারত করতে শুরু করে।

যে রাতে আলীকে দাফন করা হয় খুব কম সংখ্যক লোক তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন,সে সাথে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী। তাদের মধ্যে সামায়া ইবনে সাওহান যিনি আলী (আ.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুসারী ছিলেন তিনি একজন তুখোর বক্তাও ছিলেন। আলীকে দাফনের সময় তাদের অন্তর যেরূপ বিরাগ বেদনায় স্তব্ধ ও কণ্ঠ বায়ুরূদ্ধ হচ্ছিল,সে সাথে মনে অনুভূত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। এরূপ অবস্থায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই কাঁদছিলেন সামায়া যার হৃদয় প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল তিনি কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মাথা ও সারা শরীরে মাখতে শুরু করলেন। কবরের মাটিকে বুকে চেপে ধরে বললেন,

السلام علیک یا أمیر المؤمنین لقد عشت سعیدا و متّ سعیدا

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম। আপনি সৌভাগ্যের সাথে জীবন যাপন করেছেন,সৌভাগ্যের সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল সাফল্যমণ্ডিত,আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করেছেন,আল্লাহর ঘর মসজিদেই শাহাদাত বরণ করেছেন। জীবনের শুরুও আল্লাহর ঘরে,জীবনের পরিসমাপ্তিও আল্লাহর ঘরে। হে আলী! আপনি কতটা মহৎ ছিলেন আর এ মানুষরা কতটা হীন!

যদি এ সম্প্রদায় আপনার কথা মতো চলতلاکلوا فوقهم و من تحت أرجلیهم তবে আসমান ও তাদের পায়ের নীচে থেকে নেয়ামত বর্ষিত হতো। তারা আখেরাতে ও দুনিয়ার সাফল্য লাভ করত। কিন্তু আফসোস! এ জনগণ আপনার মর্যাদা বোঝেনি। আপনার অনুসরণ না করে বরং আপনাকে কষ্ট দিয়েছে,আপনার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আপনাকে এ অবস্থায় কবরে পাঠিয়েছে।

لا حول و لا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের পর্যালোচনা

পূর্ণ মানব (বর্তমানের ভাষায় আদর্শ মানব) কে,তা জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি মতাদর্শেই আদর্শ মানবের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। যেহেতু আমরা ইসলামের পূর্ণ ও আদর্শ মানবের প্রতিকৃতি ও স্বরূপ জানতে চাই সেহেতু প্রচলিত অন্য সব মতবাদের আদর্শ মানবের প্রকৃতির পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব। গত দিনের আলোচনায় বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি। আজকে আমাদের আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ দিয়ে শুরু করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ

প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় মানুষের অস্তিত্বের মূল বিষয় ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তি। তাদের মতে মানুষের আমিত্ব হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল। যেমনভাবে মানবদেহ তার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় তেমনিভাবে তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত সত্তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল হলো তার চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা। মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো যা দ্বারা সে চিন্তা করে।

মানুষ যা দ্বারা চোখে দেখে তা চিন্তার হাতের একটি উপকরণ মাত্র,তেমনি যা দ্বারা কল্পনা করে,যা দ্বারা চায়,যা দ্বারা ভালোবাসে বা মানুষ যে সত্তার কারণে জৈবিক চাহিদার অধিকারী এ সবই চিন্তার সত্তার হাতের একেকটি উপকরণ। মানব সত্তার মৌল উপাদান তার চিন্তাশক্তি। তাই পূর্ণ মানব তিনিই যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছেছেন। চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছার অর্থ বিশ্ব ও অস্তিত্বজগতকে ঠিক যে রূপে আছে সে রূপেই উদ্ঘাটন ও জানা।

এ মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলকে মানব সত্তার মৌল উপাদান বলে জানে। এ ছাড়াও বিশ্বাস করে যে,বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তা-শক্তির দ্বারা বিশ্বকে তার প্রকৃত রূপে উদ্ঘাটন করা সম্ভব। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি অস্তিত্বজগতকে তার আসল রূপে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করার ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক আয়নার¡মত বিশ্বজগৎ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এতে প্রতিফলিত হয়।

ইসলামী দার্শনিক সমাজ যারা এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তারা বিশ্বাস করেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ও কোরআনের আলোকে ঈমান বলতে বিশ্বকে ঠিক যেমনভাবে আছে তেমনভাবে জানাই বোঝানো হয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিশ্বে বিরাজমান শৃঙ্খলা,প্রচলিত বিধান,বিশ্বের গতি ও লক্ষ্য এগুলোকে জানা। তারা বলেন,কোরআনে যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস,বিশ্বজগৎ আল্লাহর সৃষ্টি এ বিষয়ে বিশ্বাস,আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে লক্ষ্যহীন ছেড়ে দেননি,বরং একে হেদায়েত ও পরিচালনা করছেন,যেমন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করছেন তা জানা,সব কিছু আল্লাহ্ থেকে এসেছে এবং তার প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী প্রভৃতি- এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো বিশ্বজগতকে তার প্রকৃতরূপে জানা। তারা ঈমানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,ঈমান পরিচিতি-জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতীত কিছু নয়। অবশ্য তাদের এ প্রজ্ঞা বা পরিচিতি জ্ঞানেরঅর্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা আংশিক জ্ঞান নয়,বরং এ জ্ঞান ও পরিচয় দার্শনিক ও প্রজ্ঞাগত। দার্শনিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিসমাপ্তি,অস্তিত্বের ধারা ও পর্যায়কে সামগ্রিকভাবে জানাও উদ্ঘাটন করা।

এ মতাদর্শের বিপরীত মতবাদ

এ মতাদর্শ যা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ বলে আমরা উল্লেখ করেছি এর বিপরীতে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে যে মতবাদগুলো এ মতবাদের বিরোধী ও সমালোচক। মুসলিম বিশ্বে প্রথম যে মতবাদটি এ মতবাদের বিরেুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো এশরাকী,সূফী ও খোদাপ্রেম মতবাদ। এরপর রয়েছে আহলে হাদীসের অনুসারীরা। শিয়াদের মধ্যে আখবারী এবং সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী ও আহলে হাদীস দার্শনিকদের বিপরীতে আকলকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন,দার্শনিকরা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপারে যত বেশি গুরুত্ব দেয় আকলের গুরুত্ব এত অধিক নয়।

এদের থেকেও ইন্দ্রিয়বাদীরা বর্তমান সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির চরম সমালোচক। বিগত তিন-চার শতকধরে ইন্দ্রিয়বাদীদের জয়-জয়কার। তাদের মতে বুদ্ধিবৃত্তিকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তা ততটা মূল্যের অধিকারী নয়। আকলের তেমন কোন গুরুত্ব নেই,বরং আকল ইন্দ্রিয়ের অনুগত। মানবের মূল তার ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিসমূহ। আকল খুব বেশি হলে যা করতে পারে তা হলো ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উপর কাজ করা। যেমন কোন কারখানাকে যদি আমাদের বিবেচনায় আনি,সেখানে যেরূপ কাঁচামাল প্রবেশ করে তৎপর কারখানার মেশিনের মধ্যে তা মিশ্রিত বা বিভাজিত হয়,উদাহরণস্বরূপ কাপড় বুনন কারখানায় প্রথমে তুলা থেকে সুতা বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বুননের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাপড়ের আকৃতি দেয়া হয়। তেমনি আকল মেশিনের মতো শুধু ইনিদ্রয়লব্ধ কাঁচামালকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ তার নিজের স্থানে এখনও অটল। এখানে আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোচনা করব না,বরং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার চেষ্টা করব।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের (মারেফাত) মৌলিকত্ব

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদে কয়েকটি বিষয় আছে যার প্রতিটিকে যাচাই করে দেখব যে,সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল কিনা। প্রথম বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের মৌলিকত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্বের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে এবং এ জ্ঞান ও পরিচিতি মৌলিক,নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ।

অনেক মতবাদই বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতায় বিশ্বাসী নয়। এখন আমরা দেখব ইসলামী উৎসগুলো থেকে আমাদের নিকট এ ধরনের দলিল-প্রমাণ রয়েছে কিনা যে,বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী হতে পারি। ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে যাতে আমরা বলতে পারি ইসলামের মতো কোন মতাদর্শেই আকলকে এত অধিক পৃষ্ঠপোষকতা করা হযনি বা প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে আকলকে অন্য কোন ধর্মেই ইসলামের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আপনি খ্রিষ্টধর্মকে ইসলামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন খ্রিষ্টধর্ম ঈমানের গণ্ডীতে আকলের প্রবেশের বিরোধী। তাদের মতে মানুষ যখন কোন কিছুর উপর ঈমান আনবে তখন এর উপর চিন্তা করার অধিকার তার নেই। চিন্তা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ তাই বিশ্বাসগত বিষয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আকলকে কি কেন এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া যাবে না। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি,বিশেষত ঈমানের রক্ষক চার্চের অধিপতির দায়িত্ব হলো ঈমানের গণ্ডিতে যুক্তি,চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রবেশকে প্রতিহত করা। মূলত খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে (উসূল) বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেমন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার ধর্মের একটি মৌলিক বিষয় বলুন। আপনি হয়তো বললেন,তাওহীদ (একত্ববাদ)। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করাহয়,কেন আপনি এক আল্লাহ্য় ঈমান এনেছেন? আপনাকে অবশ্যই এজন্য যুক্তি পেশ করতে হবে যেহেতু ইসলাম আকল ব্যতীত আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে না। যদি বলেন, আমি এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করি,কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি পেশ করতে পারব না। আমার দাদীমার থেকে শুনে আমি বিশ্বাস করেছি। অবশেষে এক সত্যে পৌছেছি যেভাবেই হোক দাদীমার কাছে শুনে অথবা স্বপ্নদেখে। ইসলাম বলে, না,যদিও এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী হও,কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্বপ্ন বা পিতা-মাতার অন্ধ অনুকরণ অথবা পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে,তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর যুক্তির ভিত্তিতে যদি আপনি ঈমান আনয়ন করেন তবেই তা গ্রহণ করা হবে নতুবা নয়।

খ্রিষ্টবাদে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটাই খ্রিষ্টবাদের ভিত্তি। একজন খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব হলো এই গণ্ডিতে আকল ও চিন্তার প্রবেশকে রোধ করা। ইসলামে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের স্থান সংরক্ষিত। আকল ব্যতীত অন্য কোন কিছুর এ গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার নেই।

ইসলামের উৎসসমূহে অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহয় আকলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখা যায়। প্রথমত কোরআন সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা করেছে। তদুপরি আমাদের হাদীস গ্রন্থসমূহেও বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব ও মৌলিকত্ব এতটা প্রকট যে,এ গ্রন্থসমূহ খুললেই দেখা যায়,তাতে প্রথম অধ্যায় হিসেবে কিতাবুল আকল এসেছে এবং এ অধ্যায়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) আকল সম্পর্কিত একটা আশ্চর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ্পাকের দু টি হুজ্জাত (দলিল) রয়েছে। এ দু টি হুজ্জাত দু টি নবী। একটি অভ্যন্তরীণ নবী বা আকল,দ্বিতীয়টি বাহ্যিক নবী অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ যারা নিজেরা মানুষ এবং অন্য মানুষদের দীনের দিকে দাওয়াত করেন। আল্লাহ্পাকের এ দু টি হুজ্জাত একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ যদি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি থাকে,কিন্তু পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরিত না হয়,তবে মানুষের পক্ষে সফলতার পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। তেমনি যদি নবী থাকেন,কিন্তু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী না হয় তাহলেও সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। আকল ও নবী একসঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করে। এর চেয়ে উত্তমরূপে আকলকে সম্মানিত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান আর কোনভাবে সম্ভব কি?

এ ধরনের বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্ভবত আরো শুনে থাকবেন। যেমন জ্ঞানীর নিদ্রা অজ্ঞের ইবাদত হতে উত্তম , জ্ঞানীর খাদ্যগ্রহণ মূর্খের রোযা অপেক্ষা উত্তম , জ্ঞানীর নিরবতা অজ্ঞের কথা বলা হতে শ্রেয় , আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি এ অবস্থার পূর্বে যে,তার আকল পূর্ণতায় পৌছায় ও সমগ্র উম্মত থেকে তার বুদ্ধিবৃত্তি উচ্চতর হয় ইত্যাদি। আমরা রাসূল (সা.)-কে বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্র রূপ বলে জানি। আমাদের এ ধারণা খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যশীল। যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দীনকে পৃথক বলে জানে। কিন্তু আমরা আমাদের নবীকে আকলের পরিপূর্ণ রূপ মনে করি।

সুতরাং পরিচিতিজ্ঞান ও প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে আমরা আকলকে দলিল বলে জানি এ অর্থে যে,বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান ও পরিচয় লাভ সম্ভব। দার্শনিকদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম সমর্থন করে।