ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38811
ডাউনলোড: 5736

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38811 / ডাউনলোড: 5736
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আত্মপ্রবঞ্চনা

কখনো কখনো মানুষ নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে। এটা কোন হিসেবেই বোঝা সম্ভব নয় কিরূপ মানুষ নিজের অভ্যন্তর হতে প্রতারিত হয়। কোরআন বলছে,بل سولت لکم أنفسکم বরং তোমরা নিজেরাই নিজেকে প্রবঞ্চিত কর। আত্মপ্রবঞ্চনা মনোবিজ্ঞান সম্মত একটি যথার্থ পরিভাষা যা কোরআনে এসেছে।

আত্মপ্রবঞ্চনা অর্থ মানুষ কখনো কখনো নিজের অভ্যন্তর হতে প্রতারিত হয়। এ ধরনের ব্যক্তির মন যদি কোন কিছু চায় তাহলে ঐ বস্তুকে তার অন্তর এমন আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তার নিকট প্রদর্শন করে যে,ঐ বস্তুর বিষয়ে অলীক চিন্তা ও কল্পনা শুরু করে যাকে অতিরঞ্জন বলা যেতে পারে। এ কাজটি মানুষের মনোজগত নিজের থেকেই করে তাকে প্রতারিত করার জন্য। আত্মপ্রবঞ্চনা বাস্তবিকই আশ্চর্যের বিষয়। বর্তমানে মনোবিজ্ঞান উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করে যথার্থ ও গভীরভাবে এ বিষয়টি উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছে। মনোবিজ্ঞানিগণ এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে,কখনো কখনো দৈহিক বা স্নায়বিক বৈকল্য ব্যতীতই মানুষ পাগলামী করে যার কারণ তার অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা। উদাহরণ স্বরূপ যখন দুঃখ সহ্য করা তার জন্য খুব কঠিন ও অসাধ্য হয়ে পড়ে তখন সে এ কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।

কবির ভাষায়-

হে সতর্কজন! জগতে যারেই দেখি কষ্ট সঙ্গী তার

হে মন! হও পাগল,কষ্ট তোমার সঙ্গী হবে না আর।

এটা একটা মনোবিজ্ঞানগত মৌলতত্ত্ব।

আত্মপ্রবঞ্চনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরফানে এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। স্বার্থপরতার তৃতীয় পর্যায় এবং আত্মপ্রবঞ্চনা-বিষয় দু টি মানুষকে নৈতিকতা বিরোধী করে তোলে,এটা একটা রোগ যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকেও নীচে নামিয়ে দেয়-এরফানে এ বিষয়গুলো সর্বোত্তমরূপে বর্ণিত হয়েছে এবং এমন অনেক বিষয় সেখানে উল্লিখিত হয়েছে যা মানুষকে আশ্চর্যান্বিত করে। আমাদের আশ্চর্য হতে হয় যে,ছয়-সাতশ বা হাজার বছর পূর্বে কিরূপে মনোবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কথা বলেছেন যা বিংশ শতাব্দীর মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন।

যা হোক আত্মপ্রবঞ্চনার এ বিষয়টি আরেফগণ কোরআন থেকেই গ্রহণ করেছেন। যেহেতু আরেফগণ যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন তাই খুব ভালোভাবেই কোরাআন থেকে এ বিষয়টি হস্তগত করতে পেরেছেন। আমরা নীচের শিরোনামে মাওলানা রুমী থেকে আত্মপ্রবঞ্চনার বিষয়ে কিছু আলোচনা করব।

গোপন মানসিক জটিলতা

বর্তমানে এ বিষয়টি সর্বসম্মত যে,কখনো কখনো মানুষের মনের গহীনে মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ তলানীর মত জমে থাকে (ঠিক চৌবাচ্চার নীচে জমে থাকা কাদার মত) যা বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়,এমনকি ঐ ব্যক্তি নিজেও এ সম্পর্কে সচেতন নয়। কোন বিশেষ এক অবস্থায় যখন তাতে নাড়া পড়ে,সে লক্ষ্য করে হঠাৎ করে তার অভ্যন্তর থেকে এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করেছে,তখন সে নিজেই আশ্চর্যান্বিত হয়। মাঝে মাঝে সে বিশ্বাস করতে পারে না যে,তার মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। কখনো কখনো মানুষ নিজের প্রতি আস্থাবান হয় এ ভেবে যে,নিজের অন্তরে কোন কলুষতা নেই,কোন হিংসা-দ্বেষ নেই। কিন্তু কোন এক পরিস্থিতিতে (কোরআনের ভাষায় পরীক্ষার মুহর্তে) পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে দেখে তার আত্ম অহংকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে,হিংসা-দ্বেষ,পরশ্রীকাতরতার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পাচ্ছে,অথচ এর কারণ অনুদ্ঘাটিত। মাওলানা রুমী বলেন,

প্রবৃত্তি তোমার সুপ্ত অজগর কখন ঘুমিয়েছে

উপায়হীন বলেই সে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

মানুষের প্রবৃত্তি বিষাক্ত সাপের মতো। বিষাক্ত সাপসমূহ শীতের সময় সুপ্তাবস্থায় নিশ্চল জীবন কাটায়। যদি কোন মানুষ তাকে স্পর্শ করে তবুও সে নড়াচড়া করে না। এমনকি কোন শিশু তাকে নিয়ে খেললেও তাকে কামড়ায় না। হয়তো কেউ ভাবতে পারে,এই সাপ খুব শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যখন গ্রীষ্মকালের সূর্যালোক এর উপর পতিত হয় যেন হঠাৎ করেই এ সাপের মধ্যে এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা য়ায়। এক শিকারী যে পাহাড় থেকে শীতকালে একটি সাপ ধরে এনেছিল তার গল্প বলতে গিয়ে মোল্লা রুমী উপরিউক্ত এ কবিতার চরণটি এনেছেন যে,

প্রবৃত্তি তোমার সুপ্ত অজগর কখন ঘুমিয়েছে

উপায়হীন বলেই সে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

অর্থাৎ তুমি এটা ভেবো না,তোমার প্রবৃত্তি মৃত্যুবরণ করেছে বরং সে শত জরাগ্রস্ত অজগরের মতো,যদি গ্রীষ্মের উত্তাপ পায় তখন সে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে।

মাওলানা অন্য একটি স্থানে মানুষের নাফ্সকে (প্রবৃত্তির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে) এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা মনোবিজ্ঞানীদেরও আশ্চর্যান্বিত করে। তিনি বলেছেন,

প্রবৃত্তির বাসনা যেন জীবন্ত কুকর

লুক্কায়িত আছে স্বাভ্যন্তরে তার সুরাসুর

নেই শক্তি তাই ক্রিয়াহীন শান্ততম

অগ্নি হতে দূরে পড়ে আছে যেন জ্বালানী কাষ্ঠসম।

কখনো দেখেছেন,একদল কুকুর কোন স্থানে ঘুমিয়ে রয়েছে দু পায়ে মাথা রেখে,চোখ দু টি বন্ধ করে বিশ্রাম করছে,দেখে কেউ ভাববে একদল শান্ত ছাগলছানা বা মেষ যেন।

যদি কভু মিলে শবদেহের সন্ধান

সহসা ঘটবে প্রকাশ লালসা অনির্বাণ।

পথে এক গাধার মৃতদেহ পতিত হলো যখন

শত ঘুমন্ত কুকুর জাগ্রত হলো তখন।

কিন্তু যদি এদের সামনে (যে কুকরগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে একদল মেষের মতো পায়ের উপর হাত রেখে) একটি মৃতদেহ রাখা হয় তাহলে দেখা যাবে হঠাৎ করে এদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে,চোখগুলো সজাগ হয়ে গেছে,গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে,ক্রমে হিংস্র হয়ে উঠছে যেন তাদের প্রতিটি লোম একেকটি ধারালো দাঁতে পরিণত হয়েছে।

সুপ্ত লালসা জেগে উঠেছে সহসা

পেয়েছে তাদের শবদেহের নেশা

প্রতিটি লোম যেন দাঁতে পরিণত হয়েছে

প্রতারণার ফন্দিীত তাই লেজ নাড়ছে।

এ পর্যন্ত উপমাস্বরূপ বলেছেন তারপর প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলছেন,

শত কুকুর ঘুমিয়ে রয়েছে এ দেহে যে

শিকারই নেই তাই রয়েছে শান্তরূপে সে।

অত্যন্ত সূক্ষ্ম,বাস্তব ও যথার্থ এ উপমা।

কোরআন ও হাদীসে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম

এ পর্যন্ত এরফান যা বলেছে তা যথার্থ এবং পুরোপুরি ঠিক। কোরআন-হাদীসও এ বিষয়টিকে সমর্থন করে,যা আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলব,এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,মানুষ তার পশুত্বের প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে এবং এ পর্যায়ে অন্যের মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা না করাটা তার জন্য স্বাভাবিক,যেহেতু তার মধ্যে লোভ নামক এক ব্যাধি রয়েছে যা আত্মিক ও মানসিক বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এ সবই সত্য,তবে এ বিষয়ে আমাদের করণীয় কি? করণীয় এটাই যে,যখন প্রবৃত্তির মধ্যে লোভ জাগরিত হবে এবং প্রবৃত্তির বাসনা ঘুমন্ত কুকুরের মতো আত্মগোপন করে বা সুপ্তাবস্থায় থাকবে তখন তাকে বিনাশ করতে হবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে। অর্থাৎ যে প্রবৃত্তি নিকৃষ্ট কর্মের দিকে আহবান জানায়-কোরআনের ভাষায় নাফ্সে আম্মারা বিস্ সু -তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত হতে হবে। যে পর্যায়ে প্রবৃত্তি ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য এক টুকরা রুটি চায় তার এ চাওয়া নিকৃষ্ট কর্ম নয়,বরং তা প্রবৃত্তির সহজাত চাহিদা যা মঙ্গল করে। কিন্তু তার এ চাওয়া যখন লোভ,কৃপণতা,হিংসা,ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আকার লাভ করে তখন এ প্রবৃত্তিকে নিকৃষ্ট কর্মের প্রতি আহবানকারী বলা হবে। কোরআন এরূপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বলেছে-

) فَأَمَّا مَن طَغَىٰ وَآثَرَ‌ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَىٰ وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَ‌بِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ(

সুতরাং যে ব্যক্তি বিদ্রোহ করে এবং এ দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয় পরিণামে নিশ্চয় জাহান্নামই হবে তার আবাসস্থল। কিন্তু যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের মর্যাদাকে ভয় করে এবং স্বীয় আত্মাকে নীচ কামনা-বাসনা হতে বিরত রাখে নিশ্চয় জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল। (সূরা নাযিয়াত : ৩৭-৪১)

সুতরাং কোরআন কুপ্রবৃত্তিকে মোকাবিলা করার এবং আত্মাকে নীচ কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার আহবান জানায়। অন্য একস্থানে কোরআন বলছে,أَفَرَ‌أَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ   ঐ ব্যক্তিকে দেখেছ কি যে নিজের হীন প্রবৃত্তিকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে? অথবা হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাষায় কোরআন বলছে,وَمَا أُبَرِّ‌ئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَ‌ةٌ بِالسُّوءِ আমি আমার নাফ্সকে ত্রুটিমুক্ত মনে করি না। হযরত ইউসুফ যিনি নিজের উপর আস্থাবান হওয়া সত্ত্বেও বলছেন,

إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَ‌ةٌ بِالسُّوءِ নিশ্চয় প্রবৃত্তি মন্দ কাজের নির্দেশ প্রদানে অত্যন্ত তৎপর। এটা বলার অর্থ মানব প্রবৃত্তি বা সত্তা এত জটিল যে,সম্ভাবনা রয়েছে এর কোন এক স্থানে হয়তো কোন হীন বাসনা লুক্কায়িত রয়েছে যা সে নিজেই জানে না। তাই নিজের নাফসের উপর তিনি নির্ভর করেন না। প্রতিটি মুমিনই নাফসের মন্দ কাজের প্রতি ঝোঁকের কারণে তার প্রতি বিশ্বাস করেন না। সুতরাং ইসলাম প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শুধু সমর্থনই করে না,বরং বাস্তবে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিভাষাটিই ইসলামের। একদা একদল সাহাবী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তন করে সমবেতভাবে রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা করতে আসলে তিনি এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন। দেখুন রাসূল কতটা সুযোগসন্ধানী (হেদায়েতের জন্য)! তিনি জানেন কোন্ মুহর্তে কোন্ কথাটি বলতে হবে। একদল লোক যুদ্ধ হতে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে। রাসূল তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন সে সাথে সর্বোত্তম নৈতিক শিক্ষাটিও তাদের দিচ্ছেন-

مرحبا بقوم فضوا الجهاد الأصغر و بقی علیهم الجهاد الأکبر সাবাস হে ক্ষুদ্র দল যারা যুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছ,তোমাদের সামনে বড় যুদ্ধ রয়ে গেছে। তারা প্রশ্ন করলেন, হে রাসূলাল্লাহ্! বড় যুদ্ধ কি? রাসূল বললেন, নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। নাফ্সে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ অন্য মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে কঠিন। সুতরাং নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইসলামই বলেছে। তাই এ ক্ষেত্রে এরফানের বক্তব্য সঠিক।

তবে এরফানী বা সুফী মতবাদ নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ,স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ব্যক্তিসত্তার উপর এতটা আঘাত হেনেছে যে,ইসলাম তাকে সমর্থন করে না। তবে আমি বলছিনা যে,বড় আরেফগণও এ ভুলটি করেছেন,বরং আমার উদ্দেশ্য এটা বলা যে,এ মতবাদের প্রচুর ব্যক্তির মধ্যে এ ভুলটি লক্ষ্য করা যায়।

কঠিন সাধনার বিষয়টি যখন এতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌছায়- ইসলাম বলে তোমার দেহ তোমার উপর অধিকার রাখে- রাসূলের কোন কোন সাহাবী এরূপ কঠিন সাধনায় লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন,রাসূল তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে কঠিন ভূমিকা নেন। তদুপরি,কখনো কখনো দেখা যায় কেউ কেউ এরূপ সাধনায় লিপ্ত হন যা ইসলাম সমর্থন করে না। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়।

প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম দু ধরনের। কখনো যোগ সাধনার মাধ্যমে অর্থাৎ দেহকে প্রচণ্ড কষ্ট দানের মাধ্যমে। খুব কম খাদ্য গ্রহণ করে ও অত্যন্ত কম ঘুমিয়ে দেহকে এমনভাবে প্রস্তত করা যাতে তাকে দিয়ে সব কিছু সহ্য করানো যায়। এরূপ যোগ সাধনার মাধ্যমে এমন অবস্থা করা সম্ভব যে,মানুষ দিনে মাত্র কয়েকটি বাদাম খেয়ে,২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৫ মিনিট ঘুমিয়ে অভ্যস্ত হতে পারে। দেহের উপর এরূপ যোগ সাধনা ভারতবর্ষের যোগীদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের মধ্যে এটা কম দেখা যায়। কারণ ইসলাম এরূপ সাধনার প্রচলনকে অনুমতি দেয় না।

প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্য পথটি দেহের উপর কষ্ট প্রয়োগের মাধ্যমে নয়,বরং কুপ্রবৃত্তি ও বক্র মানসিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রবৃত্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করা। তবে এটাও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। এ পদ্ধতিতেও কখনো কখনো এমন অনেক বিষয় লক্ষ্য করা যায় যা- ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের পূর্ণ মানব এরূপ নয়। এখানে এরূপ কিছু বিষয় আপনাদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করব।

নিজেকে মন্দরূপে প্রচারের পদ্ধতি

সুফীপন্থীদের অনেকের মধ্যে একটি রীতি প্রচলিত রয়েছে যা সবার মধ্যে কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে তা হলো বাহ্যিকভাবে নিজেকে মন্দ দেখানো বা মালামাতি পদ্ধতি । মালামাতি পদ্ধতি কি? মালামাতি পদ্ধতি ঠিক রিয়া বা লোক দেখানো ভালো কর্মের বিপরীত বিষয়। রিয়াকারী ব্যক্তির অন্তর কলুষিত,কিন্তু বাহ্যিকভাবে লোক দেখানোর জন্য সে ভাল কাজ করে। মালামাতকারী ব্যক্তি ভালোমানুষ,কিন্তু মানুষ যেন তাকে ভালো মনে না করে সেজন্য বাহ্যিকভাবে খারাপ কাজ করার ভান করে। যেমন হয়তো সে মদ্য পান করে না,কিন্তু মদ্যপায়ীর মতো ভাব দেখায় কিংবা জেনা করে না কিন্তু বাহ্যিকভাবে এমন স্থান দিয়ে চলাফেরা করে যাতে সবাই তাকে তা মনে করে। কিন্তু কেন সে এরূপ করে? জবাবে বলে,আমার নাফ্সকে ধ্বংস ও দমন করার জন্য আমি এরূপ করি। বাস্তবিক অর্থে অবশ্যই তার এ কাজ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামের প্রতীক যেহেতু মানুষ চায় সাধারণের মধ্যে তার সম্মান থাকুক,মানুষ তাকে বিশ্বাস করুক,তদুপরি এরূপ ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করে যাতে কেউ তাকে বিশ্বাস না করে। কখনো বা মানুষের জিনিস নিয়ে অন্য স্থানে রাখে যাতে তাকে চোর মনে করে লোকে প্রহার করে। যদি কেউ বুঝতে না পারে তবে হয়তো সে জিনিস পূর্বের স্থানেই নিয়ে রাখত। কখনো মদের বোতল সঙ্গে বহন করে যদিও মদ্যপায়ী নয়।

এখন প্রশ্ন ইসলাম এরূপ কর্মকে সমর্থন করে কি? অবশ্যই নয়। ইসলাম বলে মুমিনের সম্মান একান্ত তার নিজের নয়। মুমিনের এ অধিকার নেই যে,এমন কাজ করবে যা মানুষের মধ্যে তার সম্মান ও মর্যাদার হানী ঘটাবে। ইসলাম যেরূপ লোক দেখানো ভালোর বেশ ধরা বা রিয়াকারীকে সমর্থন করে না তদ্রূপ বাহ্যিকভাবে মন্দ বেশ ধরাকেও সমর্থন করে না। ব্যবহারিক জীবনে এ দু ধরনের মিথ্যার প্রকাশই ইসলামী দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।

এরফানী সাহিত্য পবিত্র আধ্যাত্মিক অর্থসমূহকে বাহ্যিকভাবে অশালীন শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করেছে। যেমন মদ ও বাঁশী বা প্রেমিকা ও প্রেম প্রভৃতি। এটা এ কারণে যে,নিজেরা যা ছিলেন তা প্রদর্শন না করা। হাফেজ শিরাজী যিনি রিয়া ও মালামাত দু টিরই বিরোধী ছিলেন তদুপরি তিনি এগুলো বলেছেন-

এ হৃদয় চাও কি তোমায় করব পথ প্রদর্শন

কর না তবে দুশ্চরিত্রে অহংকার আর বকধার্মিকতার আকর্ষণ।

হাফেজ যে মালামাত বা রিয়াবাদী কোনটিই ছিলেন না- এ কবিতায় তা বলছেন। যা হোক মালামাতি বা আত্মনিন্দা প্রচার সুফী মতবাদে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি পদ্ধতি যা ইসলাম গ্রহণ করে না। তবে সুফীদের মধ্যে সকলেই এরূপ ছিলেন না। সুফীদের মধ্যে অনেকেই খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারীর মতো শরীয়তের বাহ্যিক আচার রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। তদুপরি কারো কারো মতে এ বিষয়টি লক্ষণীয়। কথিত আছে,খোরাসানের সুফীদের মধ্যে মালামাতের প্রচলন অধিক ছিল। আমাদের কথা হলো ইসলাম আত্মনিন্দা প্রচার বা মালামাতকে অনুমোদন করে না।

তাসাউফ ও আত্মমর্যাদাবোধ

কখনো কখনো তাসাউফ বা সুফী মতবাদ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ লাভের উদ্দেশ্যে (যাতে করে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা যায় এবং সে কোন নির্দেশ দানে অপারগ হয়) আত্মসম্মানকে বিসর্জন দান করে। কিরূপে তা উদাহরণের মাধ্যমে বলছি। যেমন কোন ব্যক্তি হয়তো কোথায়ও নিজেকে আত্মমর্যাদা হানী হতে রক্ষা করতে পারে কিন্তু তা করে না। মুমিনের সম্মান বলে যে কিছু রয়েছে সুফী মতবাদের অনেকের কাছে এর অর্থ নেই।

এ মতবাদের অনেকের মধ্যেই একটি বিষয় প্রচলিত রয়েছে-যখন কোন মুরীদ (যে তাসাউফের পথে উস্তাদের অধীনে অগ্রসর হতে চায়) তার পীর বা শিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তখন সে পীর বা আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু তাকে খুবই নীচ পর্যায়ের কাজ করার নির্দেশ দেন। যেমন তাকে বলে অবশ্যই তোমাকে কিছুদিন মেথরের কাজ বা পশুর মল সংগ্রহের,কখনো এর থেকে নিম্ন শ্রেণীর কোন কাজ করতে হবে যাতে তার নাফসের মৃত্যু ঘটে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না।

ইবরাহীম আদহাম যিনি তাসাউফের একজন গুরু তিনি বলেন, আমি আমার জীবনে কোন সময়েই তিনটি ঘটনায় যেরূপ খুশী হয়েছিলাম সেরূপ খুশী হতে পারিনি : একবার আমি অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে শুয়েছিলাম। এতটা অসুস্থ ছিলাম যে,উঠবার মতো শক্তি ছিল না। এমন সময় মসজিদের খাদেম এসে সব ফকির ও মুসাফির যারা মসজিদে ঘুমিয়ে ছিল তাদের উঠিয়ে দিল। আমার নিকটও এসে রাগতস্বরে বলল : এ্যাই,উঠ! সেই সাথে পা দিয়ে আমাকে কয়েকটি লাথি মারল। যখন সে দেখল তবুও আমি উঠছি না তখন একটি মৃতদেহের মতো আমার পা ও হাত ধরে মসজিদের বাইরে ছুড়ে মারল। আমি এতে খুবই খুশী হলাম এ ভেবে যে,আমার নাফ্স যা সম্মানের আকাঙ্ক্ষা করে তা এ অসম্মানের ফলে লাঞ্ছিত হচ্ছে ।

দ্বিতীয় ঘটনা হলো,একবার প্রচুর লোকের সঙ্গে নৌকায় করে যাচ্ছিলাম। ভাঁড় টাইপের এক লোক এই নৌকায় ছিল যে তার ভাঁড়ামো ও গল্প বলার মাধ্যমে নৌকার যাত্রীদের হাসাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলল : একবার এক যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ করলাম,যুদ্ধে অনেক কাফের হত্যা করলাম। তার মধ্যে এক দাড়িওয়ালা ছিল। আমি তার দাড়ি টেনে ধরলাম। এ কথা বলে এদিক ওদিক লক্ষ্য করে দাড়ি টানার কায়দা দেখানোর জন্য আমাকে ছাড়া অন্য কোন লোক না পেয়ে এসে আমার দাড়ি ধরে টেনে দেখালো। এতে সবাই হাসল। এখানেও খুব খুশী হয়েছিলাম নাফসের অপমান ও দুদর্শা দেখে।

তৃতীয় ঘটনা : এক শীতকালে রৌদ্রের মধ্যে কম্বল বের করে দেখলাম ছার পোকার পরিমাণ এতবেশী যে,পশম অধিক না ছারপোকা অধিক তা বুঝতে পারছিলাম না। তখন খুব খুশী হয়েছিলাম।

হ্যাঁ,এ সবই নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত,কিন্তু এরূপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে ইসলাম সমর্থন করে না। কেন করে না তা পরে বর্ণনা করব। যে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানুষকে অসম্মানিত করে,প্রথমত কারো সঙ্গে ভাঁড়ামী করে লোক হাসানো একটি বেহুদা ও অশালীন কাজ যা ইসলাম সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত আমাকে কেউ অসম্মানিত করুক,ইসলাম এটাও চায় না। এটা কেমন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম যে,এক ব্যক্তি এসে আমার দাড়ি ধরে এদিক-ওদিক টানবে আর আমি কিছুই বলব না? ইসলাম বলে,মুমিনের দায়িত্ব তার সম্মান ও মর্যাদার সীমা রক্ষা করা। ইসলামের বিধান অনুযায়ী ইবরাহীম আদহামের উপর ফরজ ছিল সেই ভাঁড়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলা, ভাঁড়ামো বন্ধ কর। বিতাড়িত হও,বেয়াদব!

অন্য এক সুফী বলেন, এক রাত্রিতে এক ব্যক্তি তার বাড়িতে ইফতারের জন্য আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল,কিন্তু রাতে যখন তার দরজায় উপস্থিত হলাম তখন আমাকে তাড়িয়ে দিল। এরূপ দ্বিতীয়,তৃতীয় বার আমাকে দাওয়াত করেও আমার সঙ্গে এরূপ আচরণ করল। শেষে আশ্চর্য হয়ে বলল :আমি তোমাকে তিন বার দাওয়াত করে তিন বারই এরূপ আচরণ করেছি তারপরও আমি দাওয়াত করলে কেন আসো? আমি বললাম : কুকরও এরূপ,তাকে শতবার বিতাড়িত করলেও বার বার ফিরে আসে।

কিন্তু ইসলাম আত্মসম্মান ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করাকে বা অপমানিত হওয়াকে সমর্থন করতে পারে না। এর রহস্য এখানেই।

আমরা ইসলামে এক স্থানে দেখি যেখানে প্রবৃত্তির কথা এসেছে-তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলেছে,নাফ্স বা প্রবৃত্তিকে নিকৃষ্ট কর্মের দিকে আহবানকারী বলে উল্লেখ করেছে। অন্য স্থানে আবার নাফসের সম্মান বা আত্মমর্যাদাবোধের কথা একইভাবে বা আরো বেশি উল্লেখ করেছে। আসল কথা হলো মুমিনের নাফ্স সম্মানিত,স্বয়ং মুমিন মর্যাদার অধিকারী। তাই ইসলামী নৈতিকতা মান-মর্যাদার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। আর এজন্যই বলেছে নিজের আত্মসম্মানের হানী করো না।

এখন প্রশ্ন হলো এটা কিভাবে সম্ভব? ইসলাম একদিকে বলছে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো আবার অন্য দিকে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদাকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বলছে আত্মসম্মানের হানী করো না। তাহলে কি দু টি নাফসের অস্তিত্ব রয়েছে যার একটির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে এবং অন্যটিকে সম্মানদান করতে হবে?

জবাবে বলব,দু টি নাফ্স এ অর্থে যে,ব্যক্তিসত্তা দু টি এরূপ নয়। বরং বাস্তবে নাফ্স একটিই তবে তার উচ্চতর ও নিম্নতর পর্যায় রয়েছে। নাফসের উচ্চতর পর্যায় সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী এবং এই নাফ্সই নিম্নতর পর্যায়ে যখন অসৎ পথে আহবান করে,তখন তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়টিতে যেমনভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল,এরফানী মতবাদের কারো কারো মধ্যে সেরূপ লক্ষ্য করা যায় না। তাদের অনেকেরই ভাষায় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্থানে নাফসের সম্মানিত পর্যায়কেও আক্রমণ করা হয়েছে,শুধু নাফসের নিম্নতর পর্যায়ে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি।