ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 11%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43208 / ডাউনলোড: 7316
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানবাত্মার ব্যাধি

প্রথমে আমরা যে সকল বস্তু মানবাত্মাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বঞ্চনা আত্মিক রোগের অন্যতম উৎস। অধিকাংশ মানসিক রোগের কারণ হলো বঞ্চনা। আপনারা জানেন ফ্রয়েড বাড়াবাড়িমূলকভাবে এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন,বিশেষত যৌনতার বিষয়ে। যা হোক বঞ্চনা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ। বঞ্চনা মানুষের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। যখন মানুষ অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করে তখন তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং যতক্ষণ না তাকে হত্যা বা লাঞ্ছিত করতে পারে ততক্ষণ শান্তি লাভ করতে পারে না। এ প্রতিশোধ স্পৃহাটি কি?

হিংসুক ব্যক্তি যখন কারো ভালো বা কল্যাণ দেখে তখন তার সমগ্র কামনা হয়ে ওঠে এটা যে,ঐ ব্যক্তি থেকে এ কল্যাণ যেন দ্রুত অপসারিত হয়। নিজের বিষয়ে তখন সে আর চিন্তা করে না,বরং ঐ ব্যক্তির অমঙ্গলের চিন্তায় মগ্ন হয়। সুস্থ চিন্তার মানুষ প্রতিযোগিতা করে,হিংসা করে না। সুস্থ মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। সব সময় এগিয়ে থাকার চিন্তা করা সুস্থতার পরিচয়,এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্যেরা সব সময় পিছে পড়ে থাক- এ চিন্তা অসুস্থতার পরিচায়ক। হিংসুক ব্যক্তির অসুস্থতা কখনো কখনো এতটা অধিক হয় যে,নিজের একশ ভাগ ক্ষতি করেও যদি অপরের পাঁচ ভাগ ক্ষতি করা যায় তাতে সে খুশী।

হিংসা রোগের নমুনা

একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে এসেছে। কোন এক খলিফার সময় একজন ব্যক্তি একদাস কিনে এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার সঙ্গে দাসের মতো আচরণ না করে বরং সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করত। সব সময় ভাল খাবার দিত,তার জন্য ভাল পোষাক কিনত,বিশ্রামের জন্য উত্তম উপকরণ এনে দিত। মোট কথা,তার সঙ্গে নিজের সন্তানের মত আচরণ করত। মনে হতো লালন-পালনের জন্যই তাকে আনা হযেছে। দাসটি লক্ষ্য করত তার মনিব সব সময়ই বিষন্ন ও চিন্তিত। কিন্তু তার কারণ সে জানত না। একদিন মনিব তাকে ডেকে বলল, আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে চাই,সে সাথে প্রচুর অর্থও দিতে চাই। কিন্তু তুমি কি জান কেন তোমাকে এত আদর ও স্নেহ করেছি? এজন্য যে,তুমি যেন আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর। তুমি যদি তা রক্ষা কর তবে আমার আদর-স্নেহের প্রতিদান দিলে এবং এর জন্য আরো অধিক কিছু তোমাকে আমি দেব। কিন্তু যদি তা না কর তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট। দাস বলল, যেহেতু আপনি আমার মনিব এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন,আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব। মনিব বলল, না,তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে,আমার ভয় হয় যদি রাজি না হও। দাস বলল, যে কোন প্রস্তাব দিন আমি রাজী হব। যখন দাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখন মনিব বলল, আমার অনুরোধ হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে নির্দেশ দেব। তুমি আমার মাথা গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। দাস বলল, আমি তা করতে পারব না। মনিব বলল, না,অবশ্যই তোমাকে তা করতে হবে। কারণ তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। মাঝ রাতে মনিব দাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটি ধারালো ছুরি হাতে দিয়ে তাকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ীর ছাদে গেল আর বলল, এখানেই আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন কর,তারপর যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। দাস বলল, কেন এটা করব? সে বলল, যেহেতু এই প্রতিবেশীকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু আমার কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সে আমার থেকে অগ্রগামী। সব কিছুতেই সে আমার থেকে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। আমি হিংসার আগুনেজ্বলে মরছি। আমি চাই সে খুনী বলে পরিচিত হোক ও শাস্তি ভোগ করুক। যদি এমন হয় তবেই আমি শান্তি পাব। আমার শান্তি এখানেই যে,যদি আমাকে এখানে হত্যা কর,কালকে সবাই বলবে (যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশ তার বাড়ির ছাদে পাওয়া গেছে) সে-ই আমাকে হত্যা করেছে। অতঃপর তাকে বন্দীকরা হবে ও পরে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ হবে। দাস বলল, যেহেতু তুমি এমন বোকা লোক সেহেতু কেন আমি এটা করব না। তুমি এটার জন্যই উপযুক্ত। অতঃপর সে মনিবের মাথা বিচ্ছিন্ন করল এবং টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল। পরের দিন সবখানে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঐ বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু সবাই বলাবলি করতে লাগল যদি সে খুনীই হতো তবে নিজের বাড়ির ছাদে খুন করতে যাবে কেন? সম্ভবত কিছু একটা আছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। দাসের বিবেক তাকে চিন্তায় ফেলল। অবশেষে বিচারকের কাছে গিয়ে সত্য ঘটনা বর্ণনা করে সে বলল, আমি তার ইচ্ছাতেই তাকে হত্যা করেছি। সে প্রতিহিংসায় এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,মৃত্যুকে জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যখন প্রমাণিত হলো ঘটনা এ রকম তখন দাস এবং ঐ বাড়ির মালিক দু জনকেই মুক্তি দেয়া হলো।

সুতরাং এটা বাস্তব যে,মানুষ প্রকৃতই হিংসা রোগে অসুস্থ হয়। কোরআন বলছে,

( قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا)

সে-ই সফলকাম হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং সে-ই অকৃতকার্য হলো যে তা প্রোথিত করল। কোরআনের প্রথম কর্মসূচী আত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নয়ন এবং হৃদয়কে মানসিক রোগ,সমস্যা,অশান্তি,অন্ধকার ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা।

রূপান্তরিত মানুষ

রূপান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রূপান্তর অর্থ কি? নিশ্চয় শুনেছেন পূর্বকালে এক উম্মত ছিল যারা প্রচুর গুনাহের কারণে তৎকালীন নবীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অন্য এক পশুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন বানর,শূকর,নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণীতে। এটাকেই রূপান্তর বলা হচ্ছে। এই রূপান্তর প্রকৃতপক্ষে কিরূপ ছিল? মানুষ কি প্রকৃতই পশুতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এখন এর ব্যাখ্যা করব। এটি অনস্বীকার্য যে,মানুষ দৈহিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত নাহলেও মানসিক ও আত্মিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত হয়,এমনকি কখনো কখনো এত নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয় যে,যার নজীর পৃথিবীতে খুজে পাওয়া বিরল। কোরআন বলছে-( بل هم أضلّ )   অর্থাৎ চতুষ্পদ জন্তু হতেও নিকৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো মানুষ কি প্রকৃতই মানসিক ও আত্মিকতার দিক থেকে পশুতে পরিণত হতে পারে? উত্তর হলো,হ্যাঁ। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব তার চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। যদি কোন মানুষের চারিত্রিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য কোন হিংস্র প্রাণীর বা চতুস্পদ পশুর মত হয় তবে সে প্রকৃতই রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আত্মা প্রকৃতই রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে এক পশুতে পরিণত হয়েছে। শূকরের দেহ তার আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দৈহিকভাবে শূকরের মত না হয়েও শূকরের সকল স্বভাব ধারণ করতে পারে। যদি কোন মানুষ এরূপ হয় তবে সে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তব ও অন্তর্দৃষ্টিতে সে প্রকৃতই একটি শূকর বৈ কিছু নয়। তাই ত্রুটিযুক্ত মানুষ কখনো কখনো রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়। আমরা এ সব কথা কম শুনি এবং অনেকেই মনে করেন এগুলো metaphoric বা allegory (রূপক) এবং এগুলো বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু এটা খুবই সত্য।

এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে, ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। উপর থেকে লক্ষ্য করলাম ময়দান হাজীতে পূর্ণ। ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললাম : কি পরিমাণ হাজী এ বছর এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। ইমাম বললেন : চিৎকার এত বেশি,কিন্তু হাজী খুবই কম। ঐ ব্যক্তি বলেছে, তারপর জানি না ইমাম এমন দৃষ্টি শক্তি দান করলেন আমাকে এবং বললেন : লক্ষ্য কর। আমি লক্ষ্য করলাম সম্পূর্ণ ময়দান যেন পশুতে পূর্ণ- যেন পশু আলয়ের (চিড়িয়াখানা) মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ চলাচল করছে। ইমাম বললেন : এখন দেখ বাতেন (অপ্রকাশ্য) কিরূপ! যারা অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী তাদের নিকট এ বিষয়টি প্রদীপের মতই উজ্জ্বল। এখন যদি আধুনিক চিন্তাধারার কেউ তা অস্বীকার করতে চায় তাহলে ভুল করবে। আমাদের এখনকার সময়ও ব্যক্তি-বিশেষ ছিলেন এবং আছেন যারা মানুষের সত্তাকে অনুভব করেন এবং দেখেন।

যে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু খাওয়া,ঘুমানো,যৌন চাহিদা পূরণ ছাড়া (প্রাণীর) অন্য কোন চিন্তা করে না,তার চিন্তা শুধু এটাই যে,খাবে,ঘুমাবে আর দৈহিক আনন্দ অনুভব করবে,প্রকৃতপক্ষে তার আত্মা একটা চতুস্পদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। তার অন্তর একটি রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়েছে। যার স্বভাব রূপান্তরিত,তার মানবিক বৈশিষ্ট্য রূপান্তরিত- কিভাবে তা ব্যাখ্যা দেব। অর্থাৎ তার মনুষ্যত্ব তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,ঐ স্থানে সে নিজের জন্য চতুষ্পদ ও হিংস্র পশুর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।

সূরা নাবায় আমরা পড়ি সে দিন যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। এবং আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে ফলে তা বহু দ্বারে বিভক্ত হয়ে পড়বে। পর্বতকে বিচলিত করা হবে ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা : ১৮-২০) কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে পুনরুত্থিত ও সমবেত হবে। রাসূলগণ সব সময়ই বলেছেন,শুধু মানুষের একটি দল মানুষের চেহারায় পুনরুত্থিত হবে। কোন কোন দল পিপীলিকার মত,কোন দল সাপের মত,কোন দল নেকড়ের মত চেহারা নিয়ে হাশরের ময়দানে আবির্ভূত হবে। কেন? এটা কি সম্ভব কোন কারণ ছাড়াই মহান আল্লাহ্ মানুষকে এ রকম আকৃতিতে পুনরুত্থিত করবেন? যে ব্যক্তির পৃথিবীতে মানুষকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া কোন কাজ ছিল না,যার সকল আনন্দ অন্যদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে নিহিত ছিল সে প্রকৃতই একটি বিষাক্ত বিচ্ছু। তাই সে সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যে ব্যক্তির বাঁদরামী করাই একমাত্র স্বভাব ছিল কিয়ামতে প্রকৃতই সে বাঁদরের চেহারা নিয়ে আবিভূত হবে। এমনিভাবে যার স্বভাব কুকরের মতো সে কুকর হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। মানুষ তার নিয়্যতের (কাজের) উপর ভিত্তি করেই পুনরুত্থিত হবে। (মুসনাদে আহমদ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৯২)

কিয়ামতে মানুষ তার নিয়্যত,উদ্দেশ্য,ইচ্ছা,তার স্বভাব ও তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থিত হবে। আপনি এ পৃথিবীতে কি চেহারাতে আছেন? কি হতে চান? কি বস্তু চান? আপনার ইচ্ছাগুলো কি মানুষের চাওয়া নাকি কোন হিংস্র পশুর চাওয়া ? নাকি এক তৃণভোজীর মতো চাওয়া? যা আপনি চান আপনি তা-ই এবং সে চেহারাতেই আপনি পুনরুত্থিত হবেন যে রকম আছেন।

এটাই আমাদের আল্লাহ্ ব্যতীত সকল কিছুর উপাসনা থেকে বিরত করে। আমরা যা কিছুর উপাসনা করব তার মতোই হব। যদি টাকার উপাসনা করি,যদি অর্থ আমাদের অস্তিত্ব ও অস্তিুত্বের অংশে পরিণত হয়,এ অর্থ কিয়ামতে সে-ই উত্তপ্ত ধাতব পদার্থে পরিণত হবে। কোরআন এ পৃথিবীতে যাদের অস্তিত্ব এই ধাতব পদার্থের অস্তিুত্বের সাথে মিশে গিয়েছে এবং এই ধাতুর উপাসনা ছাড়া যার কোন কাজ নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছে, এবং যারা সোনা-রূপা মজুদ করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না,তুমি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সে দিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে,পার্শ্বদেশে ও তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে এটা সেই বস্তু যা তোমরা নিজেদের জন্য প্রস্তত করতে। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

এ অর্থই সে দিন উত্তপ্ত করা হবে- তার জন্য জাহান্নামের আগুনে পরিণত হবে। এটা অন্যতম উপাদান যা মানুষকে রূপান্তরিত করে।

আমি এ বৈঠকে ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন মানুষের বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম। সমস্যাগ্রস্ত (মানসিক) মানুষ একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। যে মানুষ পৃথিবীর কোন বস্তুকে উপাসনা করে-তার দৈনন্দিন কাজে বস্তু ব্যবহারকারী নয়,বরং এর উপাসনাকারী- সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত এবং একজন রূপান্তরিত মানুষ।

পবিত্র রমযান মাসের মানুষ গঠনের পরিকল্পনা

আসলেই পবিত্র রমযান মাসের কর্মসূচী মানুষ গঠনের পরিকল্পনার । অর্থাৎ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য এটাই যে,এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা নাফ্স বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি,মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার উপর বুদ্ধিবৃত্তি,ঈমান ও ইচ্ছা শক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।

এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী,সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উড্ডয়ন,আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয় যে,পবিত্র রমযান মাস এল,মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল,উদাহরণস্বরূপ রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল,এখানে ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল,তারপর ঈদ আসলো,কিন্তু রমযানের পূর্বের দিন থেকে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,তাহলে ঐ রোযা তার জন্য কোন উপকারই বয়ে আনেনি। ইসলাম তো এটা চায় না যে,মানুষ এমনিই মুখ বন্ধ করে রাখবে। মানুষ মুখ বন্ধ করুক আর না করুক ইসলামের জন্য কোন পার্থক্য নেই,বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা যে,মানুষ সংশোধিত হবে। কেন হাদীসসমূহে এমন এসেছে,প্রচুর রোযাদার আছে যারা রোযা থেকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না,তাদের রোযা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়। হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গীবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।

রোযা যে বাতেনী,আধ্যাত্মিক ও আত্মিক তার প্রমাণ- একদিন এক রোযাদার মহিলা রাসূল(সা.)-এর নিকট আসল। রাসূল দুধ অথবা অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও পান কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোযা আছি। রাসূল বললেন, তুমি রোযা রাখনি এবং এ বলে পুনরায় তাকে খেতে নির্দেশ দিলেন। মহিলা বলল, আসলেই আমি রোযা আছি। (যেহেতু তার বিবেচনায় রোযা আছে বলে মনে করল,যেমন বাহ্যিক রোযা আমার রাখি)। রাসূল বললেন, তুমি কেমন রোযা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ পূর্বেই তোমার মুমিনভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গীবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে,মাংস খেয়েছ। ভেতর থেকে এখনই তা উল্টিয়ে ফেল। তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোযা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে,কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দ্বারা পূর্ণ করে।

কেন আমাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে যে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুগন্ধ ছড়াবে। এ দুগন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।

পরনিন্দা ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ গীবত থেকেও খারাপ,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গীবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গীবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু টি কবীরা গুনাহ এক সঙ্গে আঞ্জাম দেয়া হয়।

এটা কি উচিত,রমযান মাস শেষ হয়ে যায়,অথচ এ মাসে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ করতে থাকি? রমযান মাস এজন্য যে,মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে,মসজিদে একত্র হবে। এজন্য নয় যে,একে অপরকে দূরে সরানোর জন্য এ মাসকে ব্যবহার করবে।

و لا حول و لا قوّة ألا بلله العلی العظیم

মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ

প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার সঙ্গে অন্য অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ণ মানুষ এবং পূর্ণ ফেরেশতা এক নয়। যদি কোন ফেরেশতা,ফেরেশতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা সম্ভাব্য পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌছায়,তা মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানো থেকে ভিন্ন।

মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্যের কারণ

যিনি আমাদের ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি (আল্লাহ্) বলেছেন,ফেরেশতারা এমন এক সৃষ্টি যারা নিখাদ আকল দিয়ে সৃষ্ট হয়েছেন,তাদের সৃষ্টির মূল কেবল চিন্তা ও বিবেচনা ছাড়া কিছুই নয় অর্থাৎ পার্থিব,জৈবিক চাহিদা,উত্তেজনা,উগ্রতা এগুলোর অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অন্যান্য জীব শুধু শারীরিক এবং কোরআন যাকে রূহ বলছে তা থেকে বঞ্চিত। শুধু মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে ফেরেশতাদের যা আছে তা লাভ করেছে আবার অন্যান্য সৃষ্টির যা আছে তারও সে অধিকারী। সে যেমন স্বর্গীয় তেমন পার্থিব। সে যেমন সর্বোচ্চ সৃষ্টি তেমনি সর্ব নিকৃষ্টও হতে পারে। এরই ব্যাখ্যায় উছুলে কাফীতে একটি হাদীস এসেছে এবং আহলে সুন্নাতও এর কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করেছে। মাওলানা রুমী তার মাসনভীতে এ হাদীস এভাবে কবিতার মাধ্যমে এনেছেন-

হাদীসে এসেছে গৌরবময় স্রষ্টা মহাজন,

সৃষ্টি জগতে করিলেন তিন রকম সৃজন।

তারপর বলছেন,এক দলকে নিখাত নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন অন্য দলকে (উদ্দেশ্য জীবজন্তু) শুধুই উত্তেজনা এবং জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু মানুষকে এ দু য়ের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পরিপূর্ণ মানুষ যেমন একটি পরিপূর্ণ পশুর থেকে ভিন্ন (উদাহরণস্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি ঘোড়া থেকে আলাদা) তেমনি একজন পূর্ণ ফেরেশতা থেকেও ভিন্ন।

ফেরেশতা ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পাথর্ক্যের কারণ তার সত্তার উপাদান যেমন কোরআন বলছে, আমরা মানুষকে এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে অনেক কিছুর মিশ্রণ রয়েছে। আধুনিকতার ভাষায় বললে তার জীনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মেধা,যোগ্যতা ও ক্ষমতার সমন্বয় হয়েছে। মানুষ এমন মর্যাদায় পৌছেছে যে,আমরা তাকে পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করেছি। এটি অত্যন্ত.গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমরা তাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা ও নম্বর প্রদানের জন্য যোগ্য মনে করেছি। ( إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ) নিশ্চয়ই মানুষকে এমন বীর্য যা বহু গুণাবলী ও শক্তির মিশ্রণ তা থেকে সৃষ্টি করেছি। এজন্যই তাকে পরীক্ষা,পুরস্কার,শক্তি ও নম্বর প্রদান করেছি। কিন্তু অন্য কেউ যোগ্যতা রাখে না।

 ) فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا(

অতঃপর আমরা তাকে সম্যক শ্রবণকারী এবং দর্শনকারী করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি,হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে,নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সূরা দাহর : ২-৩)

এর থেকে ভালো ও সুন্দরভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং এর মূল ভিত্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছি,উত্তীর্ণের পথও তাকে বলে দিয়েছি। এখন সে নিজেই বেছে নিবে কোন্ দিকে সে যাবে।

সুতরাং কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কার হয় যে,পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার কারণ এ বহুবিধ গুণাবলী ও শক্তি। তাই ফেরেশতার সঙ্গে তার পার্থক্য।

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27