ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38820
ডাউনলোড: 5737

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38820 / ডাউনলোড: 5737
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আত্মিক শক্তি ও ক্ষমতা

এখানে আমরা রাসূল (সা.)-এর জীবনী হতে একটি ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতার মাপকাঠি কি- তা আলোচনা করব। হাদীস গ্রন্থসমূহে এসেছে,রাসূল (সা.) একদিন মদীনার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন,একদল মুসলমান যুবক পাথর উত্তোলনের (ভারত্তোলনের) মাধ্যমে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করছে। যে যত অধিক ওজনের পাথর উঠাতে পারে সে তত শক্তিশালী। সকলেই চেষ্টা করছিল অপর হতে অধিক ভার উত্তোলনের। নবী (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা চাইলে তোমাদের এ প্রতিযোগিতার আমি বিচারক হতে পারি। সবাইখুশী হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে যে, আপনি আমাদের এ প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে ঘোষণা করবেন আমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে শক্তিশালী। নবী বললেন, প্রয়োজন নেই তোমরা এ জন্য পাথর উত্তোলন করবে। আমি তোমাদের হাতে শক্তি মাপার একটি মানদণ্ড দান করব। সবাই বলল, তা কি? নবী বললেন, কোন ব্যক্তির প্রবৃত্তি যখন তাকে গুনাহ করার জন্য প্ররোচিত করে তখন যদি সে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় ও যে গুনাহের প্রতি তার মন আকৃষ্ট হয়েছে তা থেকে বিরত হয় তাহলে সে-ই সবচেয়ে শক্তিশালী।

এখানে নবী (সা.) ইচ্ছাশক্তি ও মানসিক ক্ষমতাকে প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে উল্লেখ করেছেন। কারণ শক্তি ও ক্ষমতা শুধু এটাই নয় যে,মানুষ শারীরিক শক্তিতে ভারী পাথর উত্তোলন করবে যা ক্ষমতার দৈহিক প্রকাশ মাত্র এবং সকল প্রাণীই এ শক্তির অধিকারী। তাই এরূপ শক্তির ক্ষেত্রে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী একই পর্যায়ে রয়েছে। অবশ্যই আমরা এটা বলছি না যে,এরূপ শক্তি ও ক্ষমতা পূর্ণতা নয়। বরং আমরা বলছি এটাও এক প্রকার পূর্ণতা কিন্তু দৈহিক শক্তির যে পূর্ণতা তা হতে উচ্চতর পূর্ণতা হলো মানুষের ইচ্ছা ও মানসিক শক্তি যা তার আত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ। মানুষের আত্মিক শক্তি তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার বিপরীতে তাকে দাঁড়ানোর শক্তি ও ক্ষমতা দান করে।

এ যুক্তিতেই ইসলামী নৈতিকতায় বিশেষত এরফানী সাহিত্যে আত্মিক শক্তিকেই প্রকৃত ক্ষমতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, أشجع النّاس من غلب هواه মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি হলো সে-ই যে তার প্রবৃত্তির ইচ্ছার উপর জয়ী হয়েছে। এখানে সাহসিকতা,ক্ষমতা ও জয়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন সা দী বলেন,

পৌরুষ তা নয় যা দ্বারা আঘাত হানা হয় পরের মুখে

পৌরুষ তা-ই যা প্রবৃত্তির মোকাবিলায় অপরকে রাখে সুখে।

পৌরুষ (শক্তি ও ক্ষমতা) এটা নয় যে,মানুষ তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে কারো মুখে আঘাত হানবে,বরং পৌরুষ সেটাই যে,মানুষ তার প্রবৃত্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যকে সন্তুষ্ট ও তার ইচ্ছা পূরণ করে।

মৌলভী (রুমী) বলেন,

ক্রোধ ও লালসায় সংযত সেই পুরুষ কোথায়?

যারে খুঁজে ফিরি আমি পর্বত হতে পর্বত চুড়ায়।

মাওলানা রুমী ক্ষমতাবান মানুষকে ক্রোধ ও লিপ্সার সময় খুজেছেন। যখন ক্রোধে মানুষ লেলিহান শিখায় পরিণত হয় তখন ক্ষমতাবান পুরুষ চরম আত্মিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় এ ক্রোধাগ্নির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যখন প্রবৃত্তির লালসা তার মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে তখন সে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের চেষ্টায় রত হয়। এটাকেই ক্ষমতা ও শক্তি বলা হয়। নৈতিকতার যে সুন্দর বৈশিষ্ট্যসমূহের কথা নীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং নী চে দুর্বলতা বলে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন,যদি সঠিক ভাবে আমরা সেগুলো যাচাই করি তাহলে দেখব এ সবই ক্ষমতা। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি,কখনো কখনো এমন অনেক বিষয় যা শক্তি ও ক্ষমতা নয় কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতা বলে ভুল হয়। তাই নীতিশাস্ত্রবিদরা বলেন,স্নেহ-ভালোবাসা বুদ্ধিবৃত্তি ও ঈমান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অর্থাৎ যেখানেই আমাদের স্নেহও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটবে দেখতে হবে তা যুক্তিসঙ্গত কিনা?

স্নেহও সহানুভূতির সঠিক ও অযাচিত প্রকাশ

প্রথমে সা দীর একটি কবিতা ও পরে কোরআনের একটি আয়াত আপনাদের জন্য পড়ব। সা দীতার কবিতায় বলেছেন,

যদি দেখাও সহানুভূতি ধারালো দাঁতের নেকড়ের প্রতি

জুলুম করলে তুমি নিরীহ মেষ শাবকের প্রতি।

কোন চিতা বা নেকড়ের প্রতি সহানুভূতি দেখানো মেষদের প্রতি জুলমের শামিল। অর্থাৎ শত শত মেষ হত্যাকারী কোন নেকড়েকে যদি হত্যা করা হয় আর তাতে কারো ঐ নেকড়ের প্রতি মায়া জন্মে, তবে মেষদের প্রতি অবিচার করা হলো। এটি অবশ্য সা দী উদাহরণ দিয়েছেন। মূলত তার উদ্দেশ্য অত্যাচারী এবং তার অধীন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষরা। দুর্বল আত্মার লোকেরা অত্যাচারীদের প্রতি অজ্ঞতাবশত সহানুভূতি প্রদর্শন করে থাকে।

জেনাকারী পুরুষ ও নারীর ব্যপারে কোরআনে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। যদি স্ত্রী রয়েছে এরূপ কোন পুরুষ বা স্বামী রয়েছে এরূপ কোন নারী জেনা করে ইসলামে তার শাস্তি হচ্ছে তাদেরকে পাথর ছুড়ে হত্যা করতে হবে। কোরআন বলছে,এদের শাস্তিদান ও হত্যার সময় একদল মুমিনকে সেখানে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে।

( وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ ) এ রকম ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ যারা সমাজের উচ্চতর সঠিক কল্যাণের দিকটি লক্ষ্য করে না তাদের সহানুভূতি জেগে উঠে বলতে পারে,এ কাজ না করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ দেখানো উচিত।

কোরআন বলছে,وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَ‌أْفَةٌ فِي دِينِ اللَّـهِ আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়।

এটা ঐশী বিধান কার্যকর করার স্থান যে ঐশী বিধান উচ্চতর কল্যাণ ও মানবতার সার্বিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য প্রণীত হয়েছে,তাই এখানে সহমর্মিতার স্থান নেই। কেউ এরূপ ক্ষেত্রে সহমর্মিতা দেখালে তা সমাজের প্রতি জুলমের শামিল।

এরূপ অপর একটি বিষয় যা অনেকেই বলে থাকেন তা হলো মৃত্যুদণ্ড আবার কেন? মৃত্যুদণ্ড অত্যন্তু অমানবিক বিষয়। অপরাধী যে অপরাধই করুক তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না। এরা এদের এ কর্মকাণ্ডকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে,অপরাধীকে সংশোধন করতে হবে।

কত বড় ভুল কথা! এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে,মানুষকে সংশোধন করতে হবে,কিন্তু অবশ্যই তা অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে যাতে করে কোন অপরাধ সংঘটিত না হয়। কিন্তু অধিকাংশ সমাজেই শিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই,বরং অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খলার উপাদান পুরো মাত্রায় বিদ্যমান। কিংবা ধরি,কোন সমাজে নৈতিক প্রশিক্ষণের সকল সুবিধা বিদ্যমান,কিন্তু সমাজে সব সময় একদল অপরাধ প্রবণ বিচ্যুত ব্যক্তি রয়েছে যারা ঐ সমাজেও অপরাধে লিপ্ত হয়। এদের জন্য কি করা উচিত? আমরা অপরাধীকে সংশোধন করব- এ অজুহাতে অপরাধীকে অপরাধ করার সুযোগ দেব আর তারপর যখন অপরাধ সংঘটিত হবে তখন তাকে সংশোধন করতে যাব। এভাবে সকল অপরাধীকে গ্রীন সিগনাল দেয়া হবে এবং তারা অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। সে নিজেকে বলবে,সমাজ এতদিন আমার সংশোধনের চিন্তায় ছিল না- যখন আমি কিশোর ছিলাম তখন আমার পিতা আমাকে প্রশিক্ষিত করার ও সংশোধনের পদক্ষেপ নেননি,যখন বড় হয়ে সমাজে প্রবেশ করেছি তখনও সমাজ তা করেনি,এখন অপরাধ করার পর জেলে আমাকে প্রশিক্ষিত ও সংশোধন করা হবে। তাই প্রথমে একটি অপরাধ করি তাহলে সমাজ আমাকে সংশোধনের সুযোগ পাবে।

আরেক দল বলেন,চোরের হাত কাটা হবে কেন? যে সকল মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণ তারাই এ কথা বলেন। আপনারা দৈনিক পত্রিকার পাতাগুলো লক্ষ্য করুন,দেখবেন চুরি-ডাকাতির কারণে কি পরিমাণ সম্পদ মানুষের হাতছাড়া হয় শুধু তাই নয়। কত মানব হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত হয় যদি চোরের যথাযথ শাস্তি হয় এবং চোর জানে যে,পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তার চার আঙ্গুল কাটা যাবে যা মৃত্যু পর্যন্ত তার দেহে চুরির সাক্ষ্য হিসেবে থাকবে তবে সে কখনই চুরি করবে না। যদি কয়েকজন,এমনকি একজন চোরকেও এ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়,তবে চুরির পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে।

যে সকল হাজী পঞ্চাশ-ষাট বছর (এ গ্রন্থটি প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বের) পূর্বে মক্কা গিয়েছিলেন তারা দেখেছেন,আর যারা না গিয়েছেন তারা হয়তো শুনেছেন যে,তখন সৌদি আরবে চুরি কিরূপ ভয়াবহ ছিল! সে সময় যেহেতু বাস বা প্লেন ছিল না,সবাই উট বা এরূপ অন্য কোন বাহনে হজ্ব করতে যেত। সশস্ত্র ব্যক্তিসহ দু হাজার ব্যক্তির কফেলা না হলে মরুপথে হাজীরা হজ্বে যাওয়ার সাহস পেতেন না। তদুপরি প্রতি বছর শোনা যেত অনেক ব্যক্তি মরুদস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন,তাদের সম্পদসমূহ লুণ্ঠিত হয়েছে। যদিও দস্যুরাও অনেকেই নিহত হতো,কিন্তু মৃত্যু তাদের জন্য একটি সম্ভাবনা বিধায় তারা এ কাজ হতে সহজেই নিবৃত্ত হতো না। সৌদি সরকার অন্তত এ একটি বিষয়ে পৃথিবীতে সফল হয়েছে (তাদের অন্য কর্মকাণ্ড খারাপ কি ভালো সে আলোচনায় না গিয়ে)। শুধু এক বা দু বছর চোরের হাত কাটার কারণে চুরি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্বে প্রতি বছরই শত শত চোর ও হাজী নিহত হতেন তাতে কোন প্রভাব পড়ত না। কিন্তু যখন চোরকে আরাফাত বা মিনা বা অন্য কোথাও এনে প্রকাশ্যে হাত কাটার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হলো এবং কয়েকবার এ কাজের পূনরাবৃত্তি করা হলো তখন দেখা গেল যারা এ কাজ করত তারা ভীত হয়ে এ কাজ হতে বিরত হলো এবং চুরি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। যে দেশটিতে চুরির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল সে দেশটিতেই হাজীদের সুটকেস ও মালপত্র কয়েকদিন এক স্থানে পড়ে থাকে,অথচ কেউ সাহস করে না তাতে হাত দেয়ার বা পা দিয়ে নেড়ে দেখার। যতক্ষণ পর্যন্ত এর মালিককে পাওয়া না যায় তা এভাবেই পড়ে থাকে। এর কারণ হলো চোরের যথাযথ শাস্তির বিধান কার্যকর করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

( وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَ‌أْفَةٌ فِي دِينِ اللَّـهِ )

তাই এরূপ অপরাধীর প্রতি যে কোনরূপ সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শন অযৌক্তিক অর্থাৎ তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন নিরপরাধ ব্যক্তিদের প্রতি নিষ্ঠুরতারই নামান্তর। তাই এরূপ সহানুভূতির কোন স্থান ইসলামে নেই,বরং এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ শক্তিমত্তার প্রকাশ।

সুতরাং ক্ষমতার মতবাদের অনুসারী যারা সব সময় বলে পূর্ণ মানব হলো শক্তিমান মানব,তারা অন্য সকল মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষাই শুধু করেনি,স্বয়ং ক্ষমতাকে বুঝতে ও সনাক্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

হাদীসসমূহের প্রকৃত ক্ষমতা

ক্ষমতা হচ্ছে এটাই যে,মানুষ অন্যের সহযোগিতায় তার হাত প্রসারিত করবে। শক্তিমান আত্মার অধিকারী ব্যক্তি তার সন্তানকে বলেন, کونا للظالم خصما و للمظلوم عونا হযরত আলী (আ.) তার প্রিয় পুত্রদ্বয় ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে আমার সন্তানেরা! সব সময় তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা মজলুমের সহযোগিতায় জালেমের প্রতিরোধে দ্রুত অগ্রসর হবে। এটা ক্ষমতার নিদর্শন। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)

বাস্তবত হিংসা,বিদ্বেষ,অন্যের অকল্যাণ কামনা এরূপ যে সব বিষয় নী চে জন্মদানের চেষ্টা করেছেন এর সবই দুর্বলতাপ্রসূত।

যে ব্যক্তি সব সময় অন্যদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং অন্যদের কষ্ট দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে এগুলো ক্ষমতাপ্রসূত নয়,বরং দুর্বলতাপ্রসূত। মানুষ যত শক্তিমান হবে তার মধ্য হিংসা-দ্বেষ তত কমে আসবে।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একটি হাদীস খুবই আকর্ষণীয়। তিনি বলেছেন, القدرة تذهت الحفیظة   ক্ষমতা মন হতে বিদ্বেষ দূর করে। অর্থাৎ যখন মানুষ নিজের মধ্যে ক্ষমতা অনুভব করে তখন অন্যদের প্রতি তার বিদ্বেষ আর থাকে না। (বালাগাতুল হুসাইন,পৃ. ৮৯)

দুর্বল ব্যক্তিরাই কেবল বিদ্বেষ পোষণ করে এবং হিংসাকে লালন করে থাকে। ইমাম হুসাইনের এ কথাটি যথার্থ মনোতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

হযরত আলীর গীবত সম্পর্কে একটি বাণী রয়েছে। তাকে প্রশ্ন করা হলো কিরূপ ব্যক্তি গীবত করে অর্থাৎ মানুষের অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা ও দোষ ত্রুটি বর্ণনা করে আনন্দ পায়? আলী (আ.) বলেন, দুর্বল ও অক্ষমরা الغیبة جهد العاجز অর্থাৎ গীবত অক্ষমদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ৪৬১)

একজন শক্তিমান মানুষ যে আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান,গীবত তার নিকট লজ্জার বিষয় এবং সে এ কাজকে নিকৃষ্ট ও দুর্বলদের কাজ বলে মনে করে। তাই প্রকৃত ক্ষমতাবান মানুষ যেমন অন্যদের গীবত করেন না তেমনি শুনতেও চান না। আলী (আ.) তাই গীবতকে দুর্বলতাপ্রসূত বলে উল্লেখ করে বলেছেন,শক্তিমান আত্মার অধিকারী মানুষ কখনও গীবত করে না।

ইমাম আলী (আ.) এমনকি জেনাকেও দুর্বলতাপ্রসূত মনে করেন। তিনি বলেছেন,ما زنی غیور قطّ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি জেনা করতে পারে না। পৃথিবীতে যে ব্যক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ রয়েছে সে কান নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না। তাই কেবল আত্মসম্মানহীন ব্যক্তি যে নিজের মধ্যে এ বিষয়ে দুর্বলতা অনুভব করে সে-ই এরূপ কাজ করে। কারণ আত্মসম্মানহীন ব্যক্তি স্ত্রীর সঙ্গে যদি অন্য পুরুষ অনুরূপ কাজ করে তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। এ জন্যই আলী (আ.) বলেছেন,ما زنی غیور قطّ (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ৩০৫)

কিন্তু জনাব নী চে এরূপ ক্ষমতাকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার দৃষ্টিতে ক্ষমতা পেশী শক্তি ও অস্ত্রবল অর্থাৎ তরবারী ধারণ করতঃ অন্যের উপর আঘাত হানা। তার দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছে মানুষরূপী শক্তিধর কোন পশু যার বাহুর শক্তি অধিক। তাই তার নিকট আত্মিক শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। অতএব,ইসলামী মতাদর্শে নিঃসন্দেহে ক্ষমতা একটি মানবীয় মূল্যবোধ এবং মানুষের পূর্ণতার পথের অন্যতম পূর্ণরূপ। তাই ইসলাম দুর্বল ব্যক্তিকে পছন্দ করে না। إنّ الله یبغض المؤمنین الضعیف  অর্থাৎ দুর্বল ও অক্ষম মুমিনকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। (কাফী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫৯)

সুতরাং প্রথমত ইসলাম ক্ষমতাকে মানুষের একমাত্র মূল্যবোধ বলে মনে করে না বরং এর পাশাপাশি পূর্ণতার অন্যান্য মূল্যবোধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয়ত ইসলাম ক্ষমতা বলতে যা বুঝে তা নী চে,সংশয়বাদী দার্শনিক ম্যকিয়াভেলী এবং অন্যদের ধারণা হতে পৃথক। ইসলাম মানুষের মধ্যে এমন অনেক ক্ষমতায় বিশ্বাসী এবং সেগুলোর বিকাশে প্রয়াসী যার ফল নী চের ধারণার বিপরীত এবং যা সমাজের জন্য কল্যাণকর।

নী চে বলেন,দুর্বলের জন্য সহমর্মিতা দুর্বলতা হতে উদ্ভূত। তাকে বলতে চাই,সহমর্মিতা শুধু নয়,এখানে ভালোবাসা,ক্ষমা,দানশীলতা- সর্বোপরি কল্যাণকামিতা রয়েছে। কেন প্রতিটি বিষয়কে এক চোখে দেখেন? আপনার নিকট প্রশ্ন একজন ক্ষমতাবান মানুষের দান ও অনুগ্রহ অন্যদের নিকট পৌছে নাকি এক দুর্বলের? তাই জবাব দিন অনুগ্রহ ক্ষমতা হতে উৎসারিত নাকি দুর্বলতা হতে? অবশ্যই ক্ষমতা হতে,দুর্বলতা হতে নয়। যা হোক আমরা এখন অন্য আলোচনা শুরু করব।

ভালোবাসার মতবাদ

অন্য যে মতবাদটি মূলত ভারতে এবং অন্য স্থানে খ্রিষ্টবাদের মধ্যে প্রচলিত তা হলো ভালোবাসা বা প্রেমের মতবাদ। অবশ্য খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসা এবং প্রেমের ধর্ম বলে প্রচার করে। এক্ষেত্রে তারা এতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়েছে যে,তাদের ধর্মকে দুর্বলতার মতবাদ -এর অন্তুর্ভুক্ত বলা যায়। অর্থাৎ তাদের এ মতবাদকে প্রেমের মতবাদ না বলে দুর্বলতার মতবাদ বলাই শ্রেয়। ভারতীয়দের মতবাদকে প্রেমের মতবাদ বলা যেতে পারে (আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু তত্ত্ব নিয়ে,বাস্তবে তাদের আচরণ নিয়ে নয়)। এখন প্রশ্ন হলো প্রেমের মতবাদ কি?

প্রেমের মতবাদ মানুষের পূর্ণতাকে মানুষ ও সৃষ্টির সেবার মধ্যে নিহিত বলে মনে করে। এটা নী চের মতবাদের ঠিক বিপরীতে অবস্থান করছে। নী চে যে বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন তারা সে বিষয়গুলোকে গ্রহণীয় বলে মনে করেন। তাই তারা বলেন,প্রকৃত পূর্ণ মানব সেই ব্যক্তি যার থেকে সৃষ্টি কল্যাণ লাভ করে। মানবতার অর্থও তাই সৃষ্টির কল্যাণ করা। পাশ্চাত্যের মতবাদগুলো যখন মানবতার কথা বলে তখন মানব সেবা ও মানব প্রেমই তাদের লক্ষ্য যদিও কার্যত এ কথার প্রতি তারা তেমন দৃঢ় নয়। আমাদের পত্রিকা ও সাময়িকীগুলোও যখন বলে,এ বিষয়টি মানবিক,ঐ বিষয়টি অমানবিক তখন ঐ অর্থের প্রতিই ইঙ্গিত করে। মানবিক বিষয়গুলো তাদের জন্য অকল্যাণকর। সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে মানবতা হলো মানুষ ও সৃষ্টির সেবা।

কখনো কখনো আমাদের কবিদের মধ্যেও এ বিষয়ে অতিরঞ্জন লক্ষ্য করা যায়। যেমন সা দীবলেছেন,

ইবাদত সৃষ্টির সেবা বৈ কিছু নয়

তাসবিহ,জায়নামাজ ও আলখাল্লা নয়।

অবশ্য সা দীর উদ্দেশ্য এখানে ভিন্ন। একদল দুনিয়াত্যাগী সুফীর প্রতি তার এ কথা- যাদের কাজ তাসবীহ,জায়নামাজ আর দরবেশী পোশাক নিয়ে। মানবকল্যাণমূলক কাজ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে তারা এ সব নিয়ে ব্যস্ত। যদিও সা দী নিজে একজন সুফী তদুপরি এরূপ দরবেশদের কাজে তিনি বীতশ্রদ্ধ ও অসন্তুষ্ট। তাই অনেকটা অতিরঞ্জনের ভাষায় বলেছেন,ইবাদত সৃষ্টির সেবা বৈ কিছু নয়।

কেউ কেউ এ বিষয়টি অন্যভাবে বলে থাকেন যা ঠিক নয়। তারা বলেন, শরাব পানে মাতাল হয়ে পড়ে থাক,তবুও মানুষকে কষ্ট দিও না। তাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে শুধু একটি অকল্যাণ বিদ্যমান আর সেটা হচেছ অপরকে কষ্ট দান,আর কল্যাণও একটি,তা হলো মানুষের সেবা ও সৃষ্টির কল্যাণ। প্রেমের মতবাদের বাণী একটি,আর তা হলো মানবতার কল্যাণ করো। তাদের দৃষ্টিতে ত্রুটিও একটি,তা হলো মানুষকে কষ্ট দান।

সৃষ্টির কল্যাণ সাধন ও আত্মত্যাগের প্রতি কোরআনের আহবান

এ বিষয়ে ইসলামী মতবাদেরও একটি পর্যালোচনা দরকার। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সেবা ও কল্যাণ যে স্বয়ং একটি স্বর্গীয় ও মানবীয় মূল্যবোধ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মানব প্রেম ও সেবা,মানুষের কষ্ট অনুধাবন ও সহমর্মিতা ইসলামের দৃষ্টিতে এক প্রকার পূর্ণতা ও মূল্যবোধ,তাই এর মর্যাদাও অনেক বেশি,কিন্তু ইসলাম সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী নয়। বক্তব্যের শুরুতে আমি এ আয়াতটি পাঠ করেছি,

( إِنَّ اللَّـهَ يَأْمُرُ‌ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ‌ وَالْبَغْيِ )

আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ন্যায়বিচার (মানুষের অধিকারকে রক্ষা করার),সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার এবং নিষেধ করছেন অশ্লীলতা,অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্য হতে।

এখানে আল্লাহ্ শুধু মানুষের অধিকার রক্ষার কথাই বলেননি,বরং নিজের অধিকার হতেও তাদের প্রতি দান করা ও সদাচরণের নির্দশ দিয়েছেন।

আত্মত্যাগ কোরআনের একটি মৌলিক বিষয়। আত্মত্যাগ অর্থ নিজের অধিকার ত্যাগ করা এবং যে বস্তু তার নিজের ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অন্যের প্রয়োজনে তার উপর ঐ ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া। আত্মত্যাগ মনুষত্বের এক মহৎ ও গৌরবময় প্রকাশ এবং কোরআন আত্মত্যাগকে আশ্চর্যজনকরূপে প্রশংসা করেছে। রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে আনসাররা মুহাজিরদের নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি কোরআন এভাবে বলেছে-

( وَيُؤْثِرُ‌ونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ)

এবং সূরা দাহরে হযরত আলী,ফাতেমা এবং ইমাম হাসান ভ্রাতৃদ্বয়ের আত্মত্যাগের বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

( وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرً‌ا إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّـهِ لَا نُرِ‌يدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورً‌ا )

তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত,এতিম ও বন্দিদের আহার্য দান করে। তারা বলে : কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। এ আয়াতের শানে নুযূল এরূপ যে,ইমাম হাসান ও হুসাইন অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত আলী ও ফাতিমা (আ.) তিন দিন রোযা রাখার জন্য নযর করেন। হযরত আলী কাজ করে কিছু যবের আটা যোগাড় করেন এবং হযরত ফাতিমা তা দিয়ে রুটি তৈরি করেন। ইফতারের সময় একজন মিসকিন এসে খাদ্য চাইলে তারা পুরো আহার্যই তাকে দান করেন। এরূপ দ্বিতীয় দিনএকজন এতীম এবং তৃতীয় দিন একজন বন্দি এসে খাদ্য চাইলে পরপর তিন দিন তারা এ আত্মত্যাগ করেন এবং নিজেরা অভুক্ত থাকেন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।

আত্মত্যাগ মানব মর্যাদার এক গৌরবময় ও মহান বিষয় যা ইসলাম প্রশংসা করেছে এবং ইসলামের ইতিহাসে আত্মত্যাগের এরূপ অসংখ্য নমুনা রয়েছে।

স্নেহ-ভালোবাসার একটি উদাহরণ :

স্নেহ,ভালবাসা ও অনুগ্রহ সব সময় ইসলামে পুণ্য কর্ম হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ঘটনাটি হয়তো শুনে থাকবেন যে,একদিন এক জাহেলিয়াতের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে লক্ষ্য করল তিনি তার এক নাতীকে কোলে বসিয়ে আদর করে চুমু খাচ্ছেন। লোকটি রাসূলকে লক্ষ্য করে বলল, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু আমার সারা জীবনে তাদের কাউকে একবারও চুমু খাইনি। একটি বর্ণনায় এসেছে,فالتمع وجه رسول الله তার এ কথায় রাসূল এতটা অসন্তুষ্ট হলেন যে,তার মুখের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং ঐ লোকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,من لا یَرحم لا یُرحم যে অন্যকে দয়া ও অনুগ্রহ করে না,আল্লাহ্ও তার প্রতি দয়া করেন না। (জামেয়ুস সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ১৮৩)

অন্য বর্ণনায় এসেছে- আল্লাহ্ যদি তোমার হৃদয় হতে দয়া উঠিয়ে নেন তাহলে আমি কি করব?

এ বিষয়ে প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর জীবন দয়া ও মহানুভবতার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি প্রকৃতই দয়া ও রহমতের প্রতীক। দুর্বলের মুখোমুখি দাঁড়ালে দয়া ও অনুগ্রহ তার মধ্যে ফল্গুর ন্যায় প্রবাহিত হতে শুরু করত।