ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38816
ডাউনলোড: 5737

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38816 / ডাউনলোড: 5737
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

আত্মসচেতনতা খোদা সচেতনতা

আল্লাহ্ মানুষের এত নিকটবর্তী যে,মানুষের আল্লাহ্ সচেতনতা আত্মসচেতনতা একই বস্তু। যখন মানুষ আত্মসচেতন হবে তখন সে খোদা সচেতন না হয়ে পারে না। এটা অসম্ভব যে,মানুষ আত্মসচেতন হবে,অথচ খোদা সচেতন হবে না। কোরআন বলছে,

( وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّـهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ )

তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে আর তাই আল্লাহ্ তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন,তারাই অবাধ্য।

যে কেউ আল্লাহকে ভুলে গেছে সে কার্যত নিজেকেই ভুলে গেছে। মানুষ তখনই নিজেকে ফিরে পাবে যখন তার স্রষ্টাকে ফিরে পাবে। যদি মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে যায় তাহলে সে তার সত্তাকেই ভুলে যায়। তাই কোরআন অস্তিত্ববাদীদের বিপরীত কথা বলে। তারা বলে,যদি মানুষ খোদা সচেতন হয় তবে সে আত্মবিস্মৃত হয়। আর কোরআন বলে,মানুষ তখনই আত্মসচেতন হতে পারে যখন সে খোদাসচেতন হয়। এটা মানবিকতার সর্বোচ্চ মর্যাদার যথার্থ ব্যাখ্যা যা কোরআন আশ্চর্যজনকভাবে বর্ণনা করেছে।

কোরআন বলছে,মানুষ কখনো কখনো নিজেকেই হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ তার সত্তাই পরাজিত হয়। সে বলছে,সবচেয়ে বড় পরাজয় এটা নয় যে,মানুষ অর্থ বা সম্পদ হারায়,এমনকি যে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা হারিয়ে অন্যের দাসে পরিণত হয় বা তার নীতি ও পবিত্রতা বিসর্জন দেয় তার পরাজয়ও বড় পরাজয় নয়,বরং বড় পরাজয় হলো মানুষের তার সত্তাকে হারানো। যখন মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে তখন সে সব কিছুকেই হারিয়েছে। আর যখন সে নিজেকে খুজে পায় তখন সে সব কিছুকেই অর্জন করে।

ইবাদতের দর্শন কি? ইবাদতের দর্শন হচ্ছে মানুষ আল্লাহকে অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে অর্জন করবে। এ দর্শন আত্মসত্তা অর্জন ও প্রকৃত আত্মসচেতনতা লাভের দর্শন যে অর্থ কোরআন বর্ণনা করেছে এবং ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী ব্যতীত অন্য কেউ তা অর্জনে সক্ষম হয়নি। কখনো একজন মহিউদ্দিন আরাবীর জন্ম হয় এবং তিনি মানুষের আত্মসচেতনতার বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তার ছাত্রদের মধ্য থেকে মাওলানা রুমীর মতো ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে যারা কোরআন অবতীর্ণের ছয়শ বছর পর কোরআন হতে এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হন। যদিও তারা কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার ছয়শ বছর পর এসেছেন,কিন্তু বর্তমান দার্শনিকদের হতে সাতশ বছর পূর্বে এ ব্যাখ্যা প্রদানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। মাওলানা রুমী মানুষের আত্মসচেতনতা যে খোদা সচেতনতা হতে ভিন্ন নয় তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

আত্মসচেতনতা তাই প্রাণের দাবি জেনো হে পথিক

সেই প্রাণ শক্তিশালী যার আত্মসচেতনতা ততোধিক।

মাওলানা রুমী প্রাণকে আত্মসচেতনতার সমার্থক বলে উল্লেখ করে বলছেন,যে যত আত্মসচেতন সে তত শক্তিশালী। মানুষের প্রাণ অন্যান্য প্রাণী হতে শক্তিশালী। কারণ তার আত্মসচেনতা তাদের হতে অধিক। অতঃপর তিনি আরো গভীরে প্রবেশ করে বলেছেন,মানুষ তখনই আত্মসচেতন হতে পারে যখন সে খোদা সচেতন হয়।

সুতরাং যারা মনে করছেন,যে কোন বস্তুসংশ্লিষ্টতা স্বাধীনতা পরিপন্থী তাদের বলছি,হ্যাঁ,যে কোন বস্তু সংশ্লিষ্টতা স্বাধীনতার অন্তরায় একমাত্র খোদা সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত। কারণ খোদা সংশ্লিষ্টতা আত্মসংশ্লিষ্টতার পূর্ণতর রূপ। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ব্যতীত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। সুতরাং খোদা সচেতনতা অপরিহার্যরূপে আত্মসচেতনতার সর্বোচ্চ পর্যায়। মানুষ তার একাকিত্ব ও ইবাদতে যতবেশি আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হবে ও তাকে স্মরণ করবে তত বেশি সে নিজেকে চিনতে পারবে।

অনেক মহৎ ব্যক্তিবর্গ এ পথেই আধ্যাত্মিক আত্মসচেতনতার উচ্চতর পর্যায়ে পৌছে ছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে একজন মহান ব্যক্তি যিনি একজন বড় মুজতাহিদ ও নাজাফ হতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং একজন শরীয়ত বিশারদ আরেফও ছিলেন তিনি হলেন মির্জা জাওয়াদ মেলকি তাবরীজী। তিনি মরহুম হোসেইন কুলি হামেদানির ছাত্র। তিনি কোমের অধিবাসী ও প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। তার লিখিত গ্রন্থগুলোতে যেখানে তিনি নিজ আত্মসচেতনতার বিবরণ দিয়েছেন সেখানে আধ্যাত্মিক আত্মসচেতনার আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,মানুষ নিজ সত্তাকে অনুধাবন করতে পারে এবং তিনি আরো উল্লেখ করেছেন,তিনি এমন ব্যক্তিকে চেনেন যিনি স্বপ্নে আত্মসচেতনতাকে অনুধাবন করে জাগরিত হওয়ার পরও আত্ম অভ্যন্তরে তার রেশ অব্যাহতভাবে অনুভব করেন (তিনি নিজেই সে ব্যক্তি,অথচ বলেননি)। এই আত্মসচেতনতা প্রকৃত অর্থে খোদাসচেতনতার একটি শাখা এবং এটা প্রকৃত ইবাদত ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। একজন মনোবিজ্ঞানী সহস্র বছর মনোগবেষণা চালিয়েও এ প্রকৃত আত্মসচেতনতায় পৌছতে পারে না। হযরত আলীর একটি বাণী অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। তিনি বলেছেন,

عجبت لمن ینشد ضالته و قد أضلّ نفسه فلا یطلبها

আমি ঐ ব্যক্তি হতে আশ্চর্য বোধ করি যে কোন সম্পদ হারিয়ে ফেললে তা পাওয়ার জন্য সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকে,অথচ নিজ সত্তাকে হারিয়ে ফেললেও তার সন্ধান করে না।

কেন সে নিজেকে খোঁজে না? হে মানব! তুমি জান না তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। যাও নিজেকে সন্ধান কর। কারণ তোমার সত্তা হারিয়ে যাওয়া সকল বস্তু হতে অধিক মূল্যবান।

কয়েকটি সমস্যার জবাব

আল্লাহর প্রতি ঈমান মানবীয় মূল্যবোধের বিস্মৃতির কারণ- এ কথার জবাবে বলতে চাই,ভিন্ন সত্তার মাঝে হারিয়ে যাওয়া মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধগুলোকে ভুলে যাওয়ার কারণ,এটা ঠিক। কিন্তু যা আপন সত্তারই পূর্ণতম রূপ তা মানুষের মাঝে মানবীয় মূল্যবোধের অধিকতর বিকাশের সহায়ক উপাদান। এ কারণেই যে সকল ব্যক্তি ইবাদতের পথে উচ্চ পর্যায়ে পৌছেন,তাদের মাঝে সকল মানবীয় মূল্যবোধ শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি আরো ধারালো,তাদের ভালোবাসা গভীরতর,মানসিক শক্তি আরো উন্নত,আত্মসম্মানবোধ আরো তীক্ষ্ণ এবং তাদের মানুষের মাঝে বসবাসের ক্ষমতা অধিকতর হয়। কারণ এ সকল বিষয় পরম সত্তা অর্থাৎ আল্লাহর গুণেরই প্রকাশ।

খোদা সম্পৃক্ততা মানবীয় বিকাশের প্রতিবন্ধক- এ কথার জবাবে বলব,তারা মনে করেছেন,আল্লাহ্ একটি বৃক্ষের মতো,তাই যদি আল্লাহর সাথে কেউ সম্পৃক্ত হয় সে কোন সসীম বস্তুর দ্বারা সীমিত হয়ে পড়েছে ফলে তার গতিসীমা রুদ্ধ হয়েছে। অস্তিত্ববাদীদের বলব,আল্লাহ্ হচ্ছেন অপরিসীম প্রকৃত সত্তা। কখনো মানুষ একটি সীমিত ক্ষেত্রে,উদাহরণস্বরূপ একশ বর্গকিলোমিটারে বন্দি হয়ে রয়েছে- এটা মানুষের জন্য সীমাবদ্ধতা। কারণ সে বলতে পারে,আমি যে সীমাকে অতিক্রম করেছি তার শেষে সীমার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু যদি মানুষকে কোন সীমাহীন ক্ষেত্রে বন্দি করা হয়,তবে তাকে পরিসীমিত করা হয়নি,কারণ সীমাহীন ক্ষেত্র গতিরুদ্ধ নয়। অর্থাৎ হে মানব! তুমি যদি অসীমের দিকে যাত্রা কর,তবেই পূর্ণতায় পৌছবে। আল্লাহ্ এক অপরিসীম সত্তা। তাই পূর্ণতম মানুষ যিনি শেষ নবী (সা.) তিনিও যদি অনন্তকাল অগ্রসর হতে থাকেন তার যাত্রা শেষ হবে না।আল্লাহ্ এমন এক অস্তিত্ব যার শেষ সীমা নেই। তাই মানুষের পূর্ণতার ক্ষেত্রে একমাত্র অসীম যাত্রাপথ হলো তার দিকে যাত্রা।

আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে যে,আমরা যে নবীর উপর দরুদ ও সালাওয়াত পড়ি- এর অর্থ কি এবং আল্লাহর নিকট নবীর জন্য রহমত ও কল্যাণ কামনার কি প্রভাব রয়েছে? কেউ কেউ বলেন,প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ মানব নবীর জন্য রহমতের প্রার্থনা এ জন্য যে,নবী প্রতি মুহূর্তে গমনাবস্থায় রয়েছেন। অনন্তকাল তিনি এক অসীম লক্ষ্যের দিকে গতিশীল রয়েছেন। সুতরাং পরম প্রভুর সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানুষের গতি স্থবিরতায় পর্যবসিত হওয়া নয়।

লক্ষ্যের পূর্ণতা ও মাধ্যমের পূর্ণতা

অস্তিত্ববাদীরা লক্ষ্য এবং মাধ্যমের মধ্যে একটি ভুল করেছেন। স্বাধীনতা মানুষের জন্য একটি পূর্ণতা। কিন্তু স্বাধীনতা মাধ্যমগত পূর্ণতা,লক্ষগত পূর্ণতা নয়। মানুষের লক্ষ্য স্বাধীন হওয়া নয়,কিন্তু তাকে স্বাধীন হতে হবে এজন্য যে,যাতে সে পূর্ণতায় পৌছতে পারে। যেহেতু স্বাধীনতা অর্থ পথ নির্বাচনের অধিকার এবং অস্তিত্বশীল প্রাণীদের মধ্যে মানুষ একমাত্র স্বাধীন অস্তিত্ব,বিধায় তাকে নিজের পথ নিজেই নির্বাচন করতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়,মানুষকে নিজ হতেই নিজেকে খুজতে হবে।

মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন,কিন্তু মানুষ স্বাধীন বলেই পূর্ণতায় পৌছেছে নাকি পূর্ণতার পথকে নির্বাচনের অধিকার লাভ করেছে এজন্য যে,যাতে পূর্ণতায় পৌছতে পারে। মানুষ স্বাধীনতার মাধ্যমে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারে আবার এর মাধ্যমে সর্বনিম্ন পর্যায়েও নেমে যেতে পারে।

স্বাধীন অস্তিত্ব সেই অস্তিত্ব যার নিয়ন্ত্রণ-রজ্জু তার হাতে দেয়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে,হে মানব! তুমি পূর্ণতাপ্রাপ্ত অস্তিত্ব,তুমি প্রকৃতি ও অস্তিত্ব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞাত,তুমি ব্যতীত অন্য সকল অস্তিত্ব অপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত।

( إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرً‌ا وَإِمَّا كَفُورً‌ا )

আমরা পথ প্রদর্শন করেছি,হয় সে শোকর গুজার ও কৃতজ্ঞ হবে নতুবা অকৃতজ্ঞ। আমরা তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছি কিন্তু তোমার নিজেকেই এ পথ নির্বাচন করতে হবে।

স্বাধীনতা স্বয়ং মানুষের পূর্ণতা নয়,বরং মানুষের পূর্ণতার মাধ্যম। অর্থাৎ মানুষ স্বাধীন না হলে পূর্ণতায় পৌছতে সক্ষম হতো না। কারণ বাধ্যতার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়। তাই স্বাধীনতা মাধ্যমগত পূর্ণতা,লক্ষগত নয়।

স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদিতাও আনুগত্যের ন্যায়। যেহেতু মানুষ স্বাধীন সেহেতু সে অবাধ্য ও বিরোধী হতে পারে অর্থাৎ যে কোন বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাকে অস্বীকার করতে পারে। অন্যরা ভেবেছেন,এ অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণও পূর্ণতা এবং যে কোন আনুগত্যের বিরোধিতা ও পূর্ণতা।

তারা অবাধ্যতার সত্তাগত মূল্য দিয়েছেন। ফলে এ মতবাদের পরিণতি বিশৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হয়েছে । কারণ কোন মতবাদ অবাধ্যতাকে মূল্যবোধ মনে করলে তা শৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে না। স্বয়ং এ মতবাদের প্রবক্তা সারটার তার ও তার মতবাদের উপর আরোপিত এ অভিযোগকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ইসলামী মতাদর্শে বিরোধিতার সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষের মূল্য রয়েছে অর্থাৎ মানুষ বিরোধিতা করতে পারে,আবার আনুগত্যও করতে পারে,সে যেমন উচ্চতর পর্যায়ে পৌছতে পারে তেমনি নিম্নতর পর্যায়েও নেমে যেতে পারে। যারা (যে সকল অস্তিত্ব) বিরুদ্ধাচরণে সক্ষম নয় তারা মানুষ হতে উচ্চতর সৃষ্টি নয় যেহেতু তারা এ ক্ষমতারই অধিকারী নয়। আনুগত্য ও বিরোধিতা পরস্পর ভারসাম্য পরিমাপক বলেই এগুলো পূর্ণতার মাধ্যম। অন্য সৃষ্টি এরূপ শক্তি ও ক্ষমতা রাখে না বলেই স্বাধীন ও মুক্ত নয়।

এজন্যই বিরুদ্ধাচরণের পর তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন মানুষের জন্য একটি পূর্ণতা। বিরুদ্ধাচরণের পর প্রত্যাবর্তন আছে বলেই আল্লাহ্ পাকের অন্যতম সুন্দর নামغفور বা ক্ষমাশীল বাস্তবে রূপ নেয়। যদি বিরোধিতা না থাকত তাহলে তওবা বা প্রত্যাবর্তনও থাকত না,তখন আমরা আল্লাহর গফুর নামের পরিচয় পেতাম না। বিরোধিতা পতন এবং তওবা প্রত্যাবর্তন ও পতন হতে মুক্তি। তাই বিরুদ্ধাচরণের পর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমাশীলতা বাস্তব রূপ নেয়।

রেওয়ায়েতে এসেছে,আল্লাহ্পাক বলেছেন, আমি পৃথিবীতে যে মানবকূলকে সৃষ্টি করেছি তারা যদি বিরুদ্ধাচরণ ও গুনাহ না করত,তবে অন্য কোন প্রাণীদের সৃষ্টি করতাম যারা অন্যায় ও পাপ করে তওবা করবে যাতে আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি। সুতরাং বিরুদ্ধাচরণ নিজে সত্তাগত মূল্যের দাবিদার নয়,তবে তওবা একটি মূল্যবোধ।

স্বাধীনতা অর্থ কোন প্রতিবন্ধক,বাধ্যবাধকতা ও শর্তহীনতা। আমি স্বাধীন,তাই নিজ পূর্ণতার পথকে স্বাধীনভাবে অতিক্রম করতে পারি। শুধু স্বাধীন হওয়ার কারণেই পূর্ণতায় পৌছেছি তা সঠিক নয়। তাই স্বাধীনতা পূর্ণতার পূর্বশর্ত,কিন্তু নিজেই পূর্ণতা নয়। যে অস্তিত্বকে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে ও তার পূর্ণতার পথের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়েছে সে স্বাধীনতার সেই পর্যায়ে পৌছেছে যাতে করে পূর্ণতার ঐ পথকে অতিক্রম করতে পারে। স্বাধীনতার বিশেষ পর্যায়ে পৌছানো পূর্ণতার পথ অতিক্রমের প্রাথমিক ধাপ।

তাই এ মতবাদের প্রথম ভুল হলো তারা মনে করেছেন,আল্লাহর অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ারের বৈপরীত্য রয়েছে। তাদের দ্বিতীয় ভুল হলো তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সম্পৃক্ততা অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ততার ন্যায় স্থবিরতা,বিচ্যুতি ও মূল্যবোধের পতন সৃষ্টি করে। তাদের তৃতীয় ভুল হলো তারা স্বাধীনতাকে মানুষের পূর্ণতার লক্ষ্য মনে করেছেন,অথচ স্বাধীনতা পূর্ণতার প্রাথমিক ধাপ।

স্বাধীনতা কি পূর্ণতা? নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা ব্যতীত মানুষ পূর্ণতায় পৌছতে পারে না। আল্লাহ্পাক মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন,যে স্বাধীনতা ও এখতিয়ারকে ব্যবহার করে তার পূর্ণতার পথকে অতিক্রম করবে। স্বাধীনতা ও এখতিয়ার ব্যতীত এ পথ অতিক্রম করা সম্ভব নয়। যদি বাধ্যবাধকতা আসে,তবে পূর্ণতার এ পথ যেন সে অতিক্রমই করেনি।

ইসলামী পরিভাষায় স্বাধীনতা

এখানে স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামে যে ব্যাখ্যা এসেছে তা আলোচনা করব। ইসলাম স্বাধীনতাকে অন্যতম মানবীয় মূল্যবোধ বলে স্বীকার করেছে। তবে এ মূল্যবোধ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় বা এ স্বাধীনতা উদ্ভাবিত কোন পরিভাষাও নয় বরং এটা এর প্রকৃত অর্থে একটি মূল্যবোধ। নাহজুল বালাগার দীর্ঘতমপত্র মালিক আশতারের প্রতি হযরত আলীর পত্র। এর ঠিক পরে একটি অসিয়তনামা রয়েছে যা তিনি ইমাম হাসান (আ.)-কে লিখেছেন। এর একটি বাক্য হলো

أکرم نفسک عن کلّ دنیّة و إن ساقتک إلی الرّغائب فإنّک تعتاض بما تبذل من نفسک عوضا

:(নাহজুল বালাগাহ্,পত্র ৩১) তোমার আত্মাকে সকল নীচতা ও অপমান হতে সম্মানিত রাখ (নিজ আত্মসম্মানকে হেফাজত কর,কখনও তা বিকিয়ে দিও না)

 فإنّک تعتاض بما تبذل من نفسک عوضا যেমনটি কোরআন বলেছে সবচেয়ে বড় পরাজয় নিজেকে হারানোর পরাজয়,তেমনি আলী (আ.)ও বলেছেন, হে পুত্র! যে কোনবস্তুই তুমি বিক্রি কর অথবা হারাও তার মূল্য নির্ধারণ সম্ভব,কিন্তু এমন এক বস্তু যার বিক্রিয়মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয় তা হলো তোমার সত্তা ও আত্মসম্মান। যদি সমগ্র পৃথিবীও তোমাকে দেয়া হয় তবু তা তার সমতুল্য নয়।

আলীর সন্তান ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, কেবল একটি বস্তু তোমার প্রাণ ও সত্তার বিনিময় হতে পারে,আর তা হলো আল্লাহ্পাক। আল্লাহর নিকট নিজের প্রাণ বিক্রী করা যায় আর তার বিনিময়ে আল্লাহকে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু বিশ্বজগতের কোন কিছুই প্রাণের বিনিময় হতে পারে না। এ পত্রেই হযরত আলী বলেছেন,

و لا تکن عبد غیرک فقد جعلک الله حرّا

হে পুত্র! অন্যের দাস হয়ো না। কারণ আল্লাহ্ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।    নাহজুল বালাগাহ্ থেকে আরেকটি উদ্ধৃতির আলোচনা করে আমার বক্তব্য শেষ করব। হযরত আলী (আ.) ইবাদতসমূহের স্তর বিন্যাস করে বলেছেন, মানুষ ইবাদতের ক্ষেত্রে তিন পর্যায়ের : একদল আল্লাহর শাস্তি ও আজাবের ভয়ে তাকে ইবাদত করে যাতে তিনি তাদের শাস্তি না দেন; তাদের ইবাদত একজন দাসের ন্যায়,যে তার মনিবের ভয়ে কাজ করে। তাই এর তেমন কোন মূল্য নেই। একদল বেহেশতের আশায় আল্লাহর ইবাদত করে,তারা শুনেছে আল্লাহর এমন বেহেশত রয়েছে যার তলদেশে ঝরণা ধারা প্রবাহিত( تَجْرِ‌ي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ‌ ) তাতে হুররা রয়েছে,পাখির সুস্বাদু মাংস রয়েছে(لهم طیر مما یشتهون ),তাই তারা হুর,পাখির মাংস আর মণি-মুক্তার লোভে আল্লাহর ইবাদত করে যাতে এগুলো অর্জন করতে পারে। আলী (আ.) বলেছেন, تلک عبادة التّجار এটি ব্যবসায়ীদের ইবাদত যারা মুনাফার লোভে কাজ করে। কিন্তু একদল লোক আল্লাহকে কৃতজ্ঞ চিত্তে শোকর আদায়ের লক্ষ্যে ইবাদত করে। তারা না বেহেশতের লোভে,না জাহান্নামের শাস্তির ভয়ে আল্লাহর ইবাদত করে,তারা শুধু আল্লাহকেই চায়।

মানুষের অন্যতম মানবিক বিষয় হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মানুষের বিবেক বলে,আল্লাহ্পাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত,চাই বেহেশত থাকুক বা না থাকুক এবং জাহান্নাম থাকুক বা না থাকুক। তাই সে তার ইবাদত করবে।

তিনি কি স্বয়ং নবী (সা.) নন যিনি এত ইবাদত করতেন যে,তার পবিত্র পা ফুলে যেত। তাকে প্রশ্ন করা হলো, হে রাসূলাল্লাহ্ আল্লাহ্পাক আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন তদুপরি আপনি কেন এত ইবাদত করেন? তিনি জবাব দিলেন, কেউ আল্লাহর ইবাদত করলে তা কি কেবল বেহেশতের আশায় ও জাহান্নামের ভয়ে করে থাকে?

(ألا أکون عبدا شکورا ) তবে কি আমি তার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?

সুতরাং প্রথম দলের ইবাদত দাসের ইবাদতের ন্যায় এবং দ্বিতীয় দলের ইবাদত ব্যাবসায়ীর ন্যায়। তৃতীয় দল স্বাধীন ব্যক্তির ন্যায় ইবাদতকারী। আলী (আ.)-এর যুক্তিতে স্বাধীন মানুষ এমনকি বেহেশত ও জাহান্নামের সঙ্গেও সংযুক্ত নয়,বরং এগুলো থেকেও সে মুক্ত। তার সংযুক্ততা রয়েছে শুধু আল্লাহর সঙ্গে।

যদিও ইচ্ছা ছিল স্বতন্ত্র এক বৈঠকে এ পর্যন্ত সমগ্র বক্তব্যকে সংক্ষেপে বর্ণনা করে ইসলামের পূর্ণমানবের নমুনা পেশ করব,কিন্তু তা সম্ভব হলো না। তবে এই মতবাদগুলোর আলোচনার মাঝে ইসলামের পূর্ণ মানবের রূপও বর্ণনা করেছি। যা হতে বোঝা যায় ইসলাম একপেশে মূল্যবোধকে ধারণ করে না,বরং ইসলাম তার চোখ দিয়ে সকল মূল্যবোধকে দেখতে পায়। তাই দর্শন পূর্ণ মানবের ক্ষেত্রে যা বলেছে ইসলাম অনেক পূর্বেই তার উল্লেখ করেছে ও দেখেছে। তদ্রূপ শক্তির মতবাদ,সামষ্টিক মালিকানার মতবাদ,স্বাধীনতার মতবাদসহ অন্যান্য মতবাদ পূর্ণ মানবের যে রূপ উপস্থাপন করেছে ইসলাম সেগুলো অপেক্ষা অনেক উত্তম ও পূর্ণরূপে তা উপস্থাপন করেছে এবং এ সকল মতবাদের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে ইসলামের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রযোজ্য নয়। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বব্যাপী ও পূর্ণ। তাই আমাদের নিকট প্রমাণিত হয় যে,ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।

এ মতবাদগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানিগণ উপস্থাপন করেছেন তদুপরি ইসলামের মোকাবিলায় এগুলো বর্ণহীন হয়ে পড়ে। তাই যদিও নবী (সা.) পৃথিবীর বিরল ব্যক্তিত্ব তদুপরি তার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ও অক্ষর জ্ঞান না শেখা একজন ব্যক্তির জন্য এরূপ পূর্ণ রূপ উপস্থাপন অসম্ভব বিষয়। এ থেকে বোঝা যায়,তিনি মানব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে কোন শক্তি হতে এ শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং আল্লাহ্ হতেই তা এসেছে- অন্য সকল মতবাদের উপর এ মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। অন্যান্য মতবাদের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে প্রকৃতরূপে তা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়।

لا حول ولا قوّة إلا بالله العلی العظیم