ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 38809
ডাউনলোড: 5735

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 38809 / ডাউনলোড: 5735
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানুষের নৈতিকতা

মানবসত্তা ও তার স্বরূপ সম্পর্কে বিশেষ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট অন্য একটি বিষয়ে কোন মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। আর তা হলো এমন বিষয়ের অস্তিত্ব যা বস্তু বা বস্তুগত নয়- যাকে নৈতিকতা নামকরণ করা যেতে পারে এবং যা মানুষকে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব দান করে। মানুষ বলতে তার এই বৈশিষ্ট্য ধারণকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি তাকে এ বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করা হয় তাহলে পশুর সাথে তার কোন পার্থক্য থাকে না। অন্যভাবে বলা যায়,মানুষের মনুষ্যত্ব তার বাহ্যিক দেহাবয়বে নয় যে,কারো একটি মাথা,দু টি কান,প্রশস্ত নখ,পরিমিত উচ্চতা ও যা ইচ্ছে তা-ই করুক না কেন তাকে মানুষ বলা যাবে। না,তেমনটি নয়। শেখ সা দী যথার্থই বলেছেন,

দেহ তোমায় মহান করে না,করে যা আত্মায়,

হৃদয় রাঙানো পোশাকে তোমার সৌন্দর্য নয়,

নয় তাতে মনুষ্য পরিচয়।

চক্ষু,কণ্ঠ,জিহ্বা আর নাসিক্যে যদি হয় মনুষ্য পরিচয়,

কি তফাৎ বল দেয়ালের ঐ ছবি আর মানবসত্তায়?

যদি এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারীকেই মানুষ বলা হয়,তবে সকলেই মানুষ (আমরা দৈনন্দিন জীবনে মানুষ থাকা ও মানুষ হওয়া এ কথাগুলো ব্যবহার করি,এমনকি এ দৃষ্টান্ত ধর্মীয় ছাত্রদের মধ্যেও ব্যাবহৃত হয়,যেমন মোল্লা হওয়া কত সহজ,কিন্তু মানুষ হওয়া কত কঠিন!) হিসেবেই মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিত। কিন্তু না। মানুষ হওয়া মানে হলো বিশেষ গুণ,চরিত্র ও অর্থের অধিকারী হওয়া। যার ফলে তাকে মানুষ বলা যায় এবং সে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব অর্জন করে। ইদানিংএ সকল বিষয়ই (যার উপস্থিতি মানুষকে মূল্যবোধ দান করে আর যার অনুপস্থিতি তাকে পশুর সামিল করে)- মানবিক মূল্যবোধ নামে পরিচিত।

অদ্যকার এ সভায় আমার বক্তব্যকে পূর্ববর্তী সভার আলোচ্য বিষয়ের ধারাবাহিকতায় অনুবর্তন করব। উল্লেখ্য যে,ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিচ্যুতিসমূহকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের বিচ্যুতি আছে যাতে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধ -এর বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেমন : অন্যায় ন্যায়ের বিরুদ্ধে,ভয়-ভীতি মুক্তির বিরুদ্ধে,খোদার প্রতি উদাসীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা খোদার উপাসনা ও শৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে; অজ্ঞতা ও মূখতা জ্ঞান,বিবেক ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সম্ভবত অধিকাংশ বিচ্যুতিই উল্লিখিত ধরনের নয় যাতে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেখানে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয় সেখানে প্রথমোক্তটি (মূল্যবোধহীনতা) অপনোদিত হয়। মানবকুলের অধিকাংশ বিচ্যুতিই নদীর জোয়ার ভাটার মতই। কখনো কখনো কোন বিশেষ মূল্যবোধ অপর মূল্যবোধসমূহ অপেক্ষা এতটা প্রবৃদ্ধি লাভ করে যে,অন্যান্য মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলে। যেমন : সংযম ও ধর্মানুরাগ একটি মূল্যবোধ যা মনুষ্যত্বের মানদণ্ডসমূহের মধ্যেও একটি। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যুহদের (দুনিয়া বিমুখতা) প্রতি এতটা ঝুকে পড়ে যে,তাতে বিলীন হয়ে যায় এবং অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অবশেষে এমন এক মানুষে পরিণত হয় যার একটি অঙ্গই (যেমন : নাক) প্রবৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য অঙ্গ অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কষ্ট এবং তার ফল

চরম বস্তুবাদী মতবাদগুলোও এক নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী- এ ভূমিকা দিয়ে বলা যেতে পারে সকল মানবীয় মূল্যবোধ এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে সারসংক্ষিপ্ত হয় যা নিজেই একটি শাখায় পরিণত হয় এবং তা এমন এক প্রেক্ষাপট যা আরেফগণের পরিভাষায় যেমনটি এসেছে তেমনি এসেছে সমসাময়িক আলেমগণের পরিভাষায়ও। তবে আরেফগণের পূর্বেই তা ইসলামের মূল পাঠ্যসমূহে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ঐ প্রেক্ষাপটকে এভাবে বর্ণনা করা যায় যে,মূলত মনুষ্যত্বের প্রকৃত মানদণ্ড তা-ই যার ফলে কষ্ট কষ্ট প্রাপক -কে ব্যাখ্যা করা যায়। মানুষ এবং অন্যের (প্রাণীর) মধ্যে পার্থক্য হলো যে,সে কষ্ট ও বেদনাকে অনুভব করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী তা পশুই হোক কিংবা মানুষের দেহাবয়বে মনুষ্যত্বহীন মানবই হোক- কষ্টের অনুভূতি সম্পন্ন নয়।

অতএব,প্রারম্ভেই কষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করব। হয়তো প্রথমত একটা আশ্চর্য বিষয় মনে হবে যে,এর মানে কি?

অবশ্য স্মরণযোগ্য,আমরা কষ্ট এবং কষ্টের উৎস এ দু য়ের মধ্যে ভুল অর্থ করি। যেমন কোন অসুখ বা জখমের মন্দের কারণ হলো জীবাণু; আর তার উপস্থিতিই হলো অসুখ বা জখম- যা দেহে অনুপ্রবেশ করে কষ্টের সৃষ্টি করে। অনুরূপ কোন ক্ষত যা অন্ত্রে হয় এবং মানুষ তার ব্যথা অনুভব করে তা ঐ ক্ষতের ফলেই। বেদনা মানুষের জন্য অস্বস্তির হলেও জ্ঞান ও জাগরণের কারণও বটে,এমনকি শারীরিক ব্যথা যা মানুষ বা পশুর জন্য অভিন্ন তাও মানুষের জ্ঞান এবং জাগরণের কারণ। যখন কারো মাথা ব্যথা হয় তখন এটা ধারণা করা অসম্ভব যে,কোন কারণ ব্যতিরেকেই ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যথা অনুভূত হওয়ার ফলে মাথার কোন অসুস্থতা বা ক্ষত সম্পর্কে মানুষ অবগত হয় এবং তখন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ঠিক যেন কোন কারখানা বা গাড়ীর সূচকের মতো। যেমন কোন সূচক তৈলের পরিমাণ ইঙ্গিত করে আবার কোনটি পানির তাপমাত্রার পরিমাণ। যদি কোন সূচক ইঙ্গিত করে যে,পানির তাপমাত্রা খুব উচ্চে আছে তাহলে সেটা কি ভালো না খারাপ? অবশ্যই তা ভালো। কারণ তা আপনাকে গাড়ীর অবস্থা সম্পর্কে খবর দেয় বা সতর্ক করে দেয়। যদি ব্যথা বা এর অনুভূতি মানুষের মধ্যে না থাকত তবে প্রথমত এর সম্পর্কে অবগত হতো না। দ্বিতীয়ত এ ব্যথা মানুষকে এক নিযুক্ত কর্মচারীর মতো উপায় অনুসন্ধানের জন্য বাধ্য করে এবং তাকে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহবান করে। যেহেতু ব্যথা আছে তা তাকে অস্বস্তিকর করে তুলে এবং নিয়মিত তাকে বলে যেভাবেই হোক এ ব্যথার উপশম করো।

সুতরাং ব্যথা এমনকি শারীরিক বা আঙ্গিক হলেও তাতে অনুগ্রহ আছে,অনুভূতি আছে,আছে জ্ঞান ও জাগরণ। অবগতি ও জাগরণ সর্ববস্থায়ই উত্তম,এমনকি তা শারীরিক কোন ক্ষত সম্পর্কে হলেও। এ প্রসঙ্গে মোল্লা অপূর্বই বলেছেন,

অনুতাপ ও তিক্ততায় জর্জড়িত যে পীড়িত

পীড়ার ক্ষণের সবটুকুতেই সে হয় আলোড়িত

তাই জেনে রাখ,এ সত্যটুকু হে সত্যানুরাগী

তিক্ততা যার জীবনে আছে,সে-ই পেয়েছে সুগন্ধ অমৃতলোভী

যে যতটুকু জাগরিত ততটুকুই ব্যথিত

যে যতটুকু হয় অনুতপ্ত,ততটুকই হয় বিমর্ষিত।

অতঃপর এখানে এসে বাকচাতুর্য প্রদর্শন করেন এবং বলেন,ব্যথিতের বেদন ব্যথিত ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারে না। বিশেষ করে সে এ বিষয়ে আর সকলের চেয়ে বেশি অবগত। বেদনাহীনতা মানে উদাসীনতা; বোধহীনতা,অনুভূতিহীনতা বা অবোধ্যতা। অপরদিকে বেদনার উপলব্ধি মানে হলো জ্ঞাতী,জাগরণ,বোধগম্যতা এবং বেদনাহীনতা যার অর্থ অজ্ঞতা।

যদি মানুষের জীবনে দু টি পর্যায় থাকে- বেদনাহীনতা ও অজ্ঞতা এবং তার বিপরীতে বেদনা ও বোধ্যতা- তবে কোনটিকে নির্বাচন করবে? মানুষ বেদনা ও বোধ্যতাকে প্রধান্য দিবে,না অজ্ঞতা বা নির্বুদ্ধিতা ও বেদনাহীনতাকে? নিশ্চয়ই বুদ্ধিদীপ্ত কষ্টকর জীবন নির্বোধ সুখকর জীবনের চেয়ে শ্রেয়তর।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,স্হুল শূকর হওয়ার চেয়ে দুর্বল সক্রেটিস হওয়া অনেক উত্তম। অর্থাৎ যদি মানুষ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হয় কিন্তু বঞ্চিত,তবে তা এক নির্বোধ শূকর- যার জন্য সকল কিছুই সহজলভ্য তার চেয়ে অনেক উত্তম।

জ্ঞানের প্রতি অভিযোগ

একটি বিষয় আমাদের সাহিত্যকর্মে পরিলক্ষিত হয় যা হলো জ্ঞান সম্পর্কে অভিযোগ। আমরা সাহিত্যকর্মে- বিশেষ করে আমাদের কবিতাসমূহে খুব বেশি দেখতে পাই যে,অনেকেই জ্ঞানের প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, হায়,যদি আমার জ্ঞান না থাকত! কি লাভ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে,আর সমাজে জ্ঞানী,সতর্ক এবং সংবেদনশীল হয়ে? এই সংবেদনশীলতা,জ্ঞান আর সতর্কতাই মানুষের অশান্তির কারণ।

আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার

হায়,যদি উন্মুক্ত না হতো দৃষ্টি আমার,শ্রবণ আমার।

আরেক জন বলেছেন,

জ্ঞানী হয়ো না- বেদনায় হবে উন্মাদ

উন্মাদ হও- তোমার সমব্যথী হবে জ্ঞানীজন।

অর্থাৎ এ ধরনের লোকেরা জীবনের উন্মাদনাপূর্ণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে,দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ জীবন যা জ্ঞান,চিন্তা ও অনুভূতি সম্পন্ন তার উপর প্রাধান্য দান করেন। কিন্তু এ কথাগুলো ভ্রান্ত ধারণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি মনুষ্যত্বের ধাপে উন্নীত হয়েছে এবং কষ্ট ও সংবেদনশীলতার অর্থ অনুভব করতে পেরেছেন,তিনি কখনো বলবেন না, আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার বরং নবী (সা)-এর হাদীস থেকে বলবেন-

صدیق کلّ امریء عقله و عدوّه جهله

প্রত্যেকেরই প্রকৃত বন্ধু তার বিবেক (আকল) আর তার সত্যিকারের শত্রু তার অজ্ঞতা (জাহেল)। (উসূলুল কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ১১)

যিনি বলেছেন আমার বুদ্ধি ও বিবেকই জীবনের শত্রু আমার এবং বুদ্ধি ও বিবেক থেকে উৎসারিত দুঃখ-কষ্টকে এভাবে অভিযুক্ত করেছেন; অনুমান করা যায় তিনি অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত দুঃখ-কষ্টকে অনুভব করেননি,যদি তাই হতো তবে এ কথাগুলো বলতেন না। হ্যাঁ,যদি ব্যথার কারণ না থাকে এবং মানুষ ব্যথা অনুভব না করত,তবে ব্যথার কারণ বিদ্যমান না থাকার ফলে ব্যথা না থাকাটাই শ্রেয় হতো। কিন্তু যদি ব্যথার কারণ বিদ্যমান থাকে বা ব্যথার উৎস থাকে,অথচ মানুষ ব্যথা অনুভব নাকরে,তবে তার জন্য দুরবস্থাই বয়ে আনবে। মানুষের শারীরিক অসুস্থতার ব্যপারটিও তাই। যে সকল অসুস্থতায় ব্যথা বা অস্বস্তি অনুপস্থিতি থাকে তা মানুষকে নীরবে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। কারণ সে তখনই কেবল বুঝতে পারে যখন নিরাময় তার নাগালের বাইরে চলে যায়। প্রাণঘাতী ক্যান্সারে মানুষের মৃত্যুর কারণও এটাই। ক্যান্সার হলে অন্তত প্রাথমিক পর্যাযে অস্বস্তি অনুভূত হয় না। যদি প্রাথমিক পর্যায়েই অস্বস্তি অনুভূত হতো তবে হয়তো রক্ত বা লসিকায় প্রবেশের পূর্বেই সম্পূর্ণরূপে নিমূল করা যেত। আর ক্যান্সারের ভয়াবহতার কারণ এটাই- নীরবে,নিঃশব্দে মানুষের দেহে তার অনুপ্রবেশ ঘটে।

সুতরাং মানুষের অমূল্য সম্পদগুলোর মধ্যে একটি মূল্যবান সম্পদ হলো ব্যথার অনুভূতি থাকা। তাই ব্যথা খারাপ কিছু বলে একে উপেক্ষা করা যায় না।

মানুষ ও ব্যথা

মানুষের ক্ষেত্রে ব্যথা কি? যদি কারো মাথা ব্যথা হয়,তাহলে তা এ দৃষ্টিকোণ থেকে নয় যে,সে মানুষ। কারণ একটি চতুস্পদ প্রাণীরও (যেমন দুম্বা ) মাথা ব্যথা হতে পারে। মানুষের হাত-পায়ের ব্যথা অন্যান্য প্রাণীর অঙ্গের ব্যথার মতোই। কিন্তু যারা মানুষের ব্যথা এবং ব্যথার ধারক হিসেবে মানুষ- এ সম্পর্কে কথা বলছেন তাদের লক্ষ্য এ ব্যথা নয়,বরং সে ব্যথা যা মানুষের জন্য অমূল্য রত্ন এবং তা অন্য কিছু।

একদল লোক (যেমন আরেফগণ) ব্যথাকেই মানুষের মধ্যে অনুসন্ধান করেন এবং নিয়মিত যার পবিত্রতা রক্ষা করেন- তা হলো মহান আল্লাহর অনুসন্ধান। তারা বলেন,এ ব্যথা একমাত্র মানুষেরই বৈশিষ্ট্যগত ব্যাপার,এমনকি ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মানুষের ব্যথা আছে,ফেরেশতাদের ব্যথা নেই।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সেই বাস্তবতা যার মধ্যে বিধাতার ফু উদগত হয়েছে,অন্য এক ভূবন থেকে যার আবির্ভাব ঘটেছে এবং প্রকৃতিতে যে সকল বস্তু রয়েছে তার সাথে সে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এখানে সে এক বিশেষ ধরনের নির্বাসন,ভিন্নতা ও সকল সৃষ্টির সাথে বৈসাদৃশ্য অনুভব করে। এর কারণ প্রতিটি জিনিসই ধ্বংসশীল,পরিবর্তনশীল এবং নিরাসক্তিযুক্ত,কিন্তু মানুষের মধ্যে রয়েছে অমরত্বের এক বিশেষ সম্ভাবনা। আর এ ব্যথা (খোদার অনুসন্ধান) তা-ই যা মানুষকে মহান আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার দিকে পরিচালিত করে। অনুরূপ আপন চাওয়া-পাওয়ার আর্তি মহান প্রভুর কাছে প্রকাশ করার,তার সান্নিধ্য লাভ করার এবং মূলে ফিরে যাওয়ার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করে।

মানুষের কষ্ট সম্পর্কিত কয়েকটি দৃষ্টান্ত

লক্ষ্য করবেন,কি রকম দৃষ্টান্ত আমাদের এরফানশাস্ত্রে এ সম্পর্কে দৃষ্টিগোচর হয়েছে! কখনো উদাহরণস্বরূপ বলা হয়,একটি তোতাপাখি হিন্দুস্থানের অরণ্য থেকে এনে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে। সে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে কখন এ খাঁচা ভাঙবে? কখন সে ফিরবে আপন কুলায়? কখনো মানুষকে একটি মোরগ যে তার বাসা থেকে দূরে চলে গেছে তার সাথে তুলনা করা হয়। এমনি একটি চমৎকার তুলনা মৌলভী রুমী তার মাসনভীর প্রথমে উল্লেখ করেছেন। তিনি মানুষকে সেই বাঁশের সাথে তুলনা করেছন যাকে তার জন্মস্থান থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তদবধি সে সারাক্ষণ ক্রন্দনরত। তার এ ক্রন্দন,আর্তনাদ যেন তার জন্মভূমির বিরহ ব্যথাকে চিত্রিত করে।

শোন ঐ বাঁশের বাঁশীর করুণ কাহিনী

সে করছে বর্ণন তার বিরহগীতি

যখন আমায় করেছে বিচ্ছিন্ন জন্মস্থান থেকে

আর্তনাদ আর ক্রন্দন ধ্বনি বিমর্ষিত করেছে নারী আর নরে।

ইচ্ছে করে হৃদয় বিদীর্ণ করি বিরহে

বলি বেদনার মর্মকথা হৃদয় নিনাদে।

অতঃপর বলেন,

যেন দু টি সুখ রয়েছে আমার

একটি তার লুকিয়ে আছে ওষ্ঠাধরে।

কখনো মৌলভী একটু ভিন্নতা দিয়ে উপমিত করেন-

হস্তী যখন ঘুমায়; স্বপনে দেখে হিন্দুস্থান

গাধা কখনো দেখে না হিন্দুস্থান

কারণ হিন্দুস্থান যে নয় তার জন্মস্থান।

কথিত আছে,যে হাতীকে হিন্দুস্থান থেকে আনা হয়,তাকে সব সময় একটা কঠোর অবস্থার মধ্যে রাখা হয় যাতে করে সে হিন্দুস্থানের স্মরণে নিজেকে ব্যস্ত না রাখতে পারে। মৌলভী এখানে বলেন,একমাত্র হাতীই হিন্দুস্থানকে স্বপ্নে দেখে,কারণ সে হিন্দুস্থান থেকে এসেছে। গাধা কখনো হিন্দুস্থানকে স্বপ্নে দেখে না। কারণ সে হিন্দুস্থান থেকে আগমন করেনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি বলতে চান,একমাত্র মানুষই অন্য এক জগতে প্রত্যাবর্তনের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়,যার রয়েছে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক ব্যথা-বেদনা; বেদনার আর্তিতে সে খুজে ফিরে সত্য ও মহান প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনের পথ। তারই রয়েছেুঁ মুক্তির নিমিত্তে বেদনা,মহাসত্যের সাথে পুনর্মিলনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।