শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম22%

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13876 / ডাউনলোড: 5690
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বাংলা

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

মূল: শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ মুহাম্মদ বাকের সাদর (রহঃ)

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

মূলঃ শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ মুহাম্মদ বাকের সাদর (রহঃ)

অনুবাদঃ মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান

সম্পাদনাঃ মোহাম্মাদ আশরাফউদ্দিন খান

সহযোগিতায়ঃ আল মুয়াম্মাল কালচারাল ফাউন্ডেশন,কোম ইরান এবং শহীদ আল্লামা বাকের সাদর (রহ.)বিশ্ব সম্মেলন কমিটি,কোম,ইরান।

প্রকাশকঃ আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি (সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান)

প্রকাশকালঃ ২১ রমজান,১৪৩০ হিজরী,১২ সেপ্টেম্বর,২০০৯ খৃষ্টাব্দ

 

Shia probanata o islam, Author: Shaheed Ayatullah Sayyid Muhammad Baqir al-Sadr, Translator: Muhammad Munir Hossain Khan, Editor: Muhammad Ashrafuddin Khan, Sponsored: Al-Mu ammal Cultural Foundation and Muzes fee Usule Din of Sayyid Muhammad Baqir al-Sadr, qum, Iran. Published by: Amar desh Bangladesh Society. ৩২/১, T.B Cross Road, Khulna, Bangladesh.

সম্মেলন কমিটির বক্তব্য

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন,ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহী আত-তাহেরীন।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর ভাগ্যাকাশে ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। যার পরিণতিতে বিচ্যুত,অবনতি আর জড়তার আধার উম্মাকে ছেয়ে ফেলেছিল। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মুসলিম উম্মার পুনর্জাগরণ শুরু হয়। ইমাম খোমেইনীর (রহ.)নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে তা পরিপুর্ণতা অর্জন করে,ইসলামী শক্তি পুনরায় আবির্ভূত হয়।দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদী ও অত্যাচারীদের হাতে শোষিত হওয়ার পর উম্মার ভাগ্যে যে বিপর্যয় ঘটেছিল তা থেকে মুক্ত হয়ে আবার সে শক্তি সঞ্চয় করেছে,মাথা উচু করে দাড়িয়েছে। মুসলিম উম্মার এ পুনর্জাগরণ সাম্রাজ্যবাদীদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে,উপনিবেশবাদী লোলুপ দৃষ্টি পোষণকারীদের আশা আকাঙ্ক্ষার কবর রচনা করেছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মার মধ্যে আজ যে নব জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে সে ক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনী(রহ.)মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাশাপাশি চিন্তাগত ও তত্ত্বগত দিক থেকে উম্মার মধ্যে যে জোয়ার এসেছে সেক্ষেত্রে শহীদ আল্লামা বাকের সাদর নিঃসন্দেহে মৌলিক অবদান রেখেছেন। ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন নজিরবিহীন। তার চিন্তাধারা ও লেখনি একদিকে যেমন চিন্তার জগতে নব-দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে অপরদিকে গভীরতা ও ব্যপকতার দিক থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে সমসাময়িক মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশকারী বিভিন্ন চিন্তাধারার পারস্পরিক সংঘাতময় পরিবেশেও তিনি বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাবিদদের মহলে ব্যাপকভাবে ইসলামী চিন্তাধারার প্রসার ঘটিয়েছিলেন।

শহীদ আয়াতুল্লাহ বাকের সাদর তার নজিরবিহীন ব্যক্তিত্ব,অসাধারণ যোগ্যতা ও গতিশীল ইসলামী চিন্তাধারার মাধ্যমে আধুনিক বস্তুবাদী দার্শনিক ও চিন্তাবিদদেরকে অত্যন্ত সফলতার সাথে মোকাবিলা করেছেন। বস্তুবাদী সভ্যতার তত্ত্বগত ভিত্তিহীনতা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে তিনি সবাইকে চিন্তাগত দাসত্বের শৃঙ্খল,(প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের)অন্ধ অনুকরণ ও খোদাবিমুখতা থেকে ফিরিয়ে রাখেন। বাস্তব জীবনে মানব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলামের যে নজিরবিহীন ক্ষমতা রয়েছে তা তিনি ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তিনি আরো প্রমাণ করেছেন আধুনিক বিশ্ব যদি ইসলামী বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় তাহলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবকুলের সৌভাগ্য রচিত হবে,মানব সমাজ কল্যাণ লাভ করবে।

শহীদ আল্লামা বাকের সাদর অত্যন্ত গতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। তার চিন্তাধারা কোন বিশেষ গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিলনা,বরং জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। ইসলামী অর্থনীতি,তুলনামূলক দর্শন (ইসলামী ও পশ্চাত্য দর্শন),আধুনিক যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি সাম্প্রতিককালে উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনায়াসে প্রবেশ করেছেন এবং নতুন নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। উসূল ও ফেকাহশাস্ত্র,দর্শনশাস্ত্র,যুক্তিবিদ্যা,কালামশাস্ত্র,তাফসীর,ইতিহাস ইত্যাদি ক্লাসিক বিষয়েও পদ্ধতিগত ও বিষয়-বস্তুগত উভয় দিক থেকে নতুন নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং চিন্তাগত বিপ্লব ঘটিয়েছেন।

আল্লামা বাকের সাদরের শাহাদতের পর দু দশকেরও বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে,কিন্তু আজও পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণামূলক কার্যক্রমে তার চিন্তাধারার প্রভাব অটুট রয়েছে। যে কোন বিষয় ভিত্তিক পর্যালোচনা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে তার রেখে যাওয়া রচনাবলী,বিশেষ করে চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি যে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন তা সবার জন্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই শহীদ আল্লামা বাকের সাদর বিশ্ব সম্মেলন পরিচালনা কমিটির প্রধান দায়িত্ব হবে চিন্তাগত ও জ্ঞানগত বিভিন্ন বিষয়ে তার রেখে যাওয়া মূল্যবান রচনাবলীর পুনরুজ্জীবন ও উপযুক্ত সংরক্ষণ। যেহেতু তার রচনাবলী অত্যন্ত ব্যাপক তাই এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালনের ক্ষেত্রে দু টি দিকের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবেঃ

প্রথমতঃ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা ও সূক্ষ্ণ দৃষ্টিসহকারে পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় এগুলোর অনুবাদ এবং প্রকাশ।

দ্বিতীয়তঃ অত্যধিকবার প্রকাশিত হওয়া এবং উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে তার প্রকাশিত অনেক বই যেগুলো আংশিকভাবে বিকৃত হযেছে সেগুলোকে মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা এবং সংশোধন করা।

সবশেষে আমরা আল্লামা বাকের সাদরের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের,বিশেষ করে তার স্বনামধন্য পুত্র জনাব সাইয়্যেদ জাফর সাদর(আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন)-এর অবদানের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। এ বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া এবং আল্লামা বাকের সাদরের বিভিন্ন রচনাবলী প্রকাশ ও পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ সম্মতি প্রদান করেছেন সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

পরিচালনা কমিটি

শহীদ আল্লামা বাকের সাদর বিশ্ব সম্মেলেন

ভূমিকা

ইসলামে শিয়াদের ইতিহাস রক্ত আর অশ্রুর ইতিহাস। শিয়া ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত যে সকল ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তা নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ। বুদ্ধিজীবি মহলে শিয়া মতবাদকে ভূলভাবে বুঝা হয়ে থাকে এবং তাই তার ভূল ব্যাখ্যা দেয়া হয়। শীর্ষস্থানীয়দের সামান্যতম কু-ধারণা কালক্রমে জনতার কাছে বিপদজনক আকার ধারণ করে। পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে সামান্যতম মতপার্থক্য বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ উপমহাদেশের স্বণামধন্য ব্যক্তিগণ তথা নবাব সিরাজউদ্দৌলা,টিপু সুলতান,হাজী মুহাম্মদ মুহসীন,তীতুমীর প্রমূখ জা ফরী ফিকাহ (শিয়া মাজহাব)এর অনুসারী হওয়া স্বত্বেও এবং এ দেশে আগত অনেক পীর-কামেল ইমাম হযরত আলী (আ.)এর ধারার অনুসারী হওয়ার পরও এ মাযহাব বিরুদ্ধবাদীদের বিষাক্ত ছোবলে ক্ষতবিক্ষত। এর অন্যতম কারণ বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এ সম্পর্কে তেমন কোন বাংলা বই পুস্তক ও কিতাবাদি ছিল না এবং বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে দ্বীনের দাওয়াতী ও প্রচারমূলক কর্মকান্ডও তেমন লক্ষণীয় ছিল না।

   আন-নাশআ-তুশ-শীয়া মহান মনীষী ও গবেষক শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বাকের সাদর (রহ.)-এর আরবী ভাষায় লিখিত একটি সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ। শীয়া মতবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে এটি একটি মৌলিক গ্রন্থ। এ বইটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হলে এ মাযহাব সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষীগণ সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এর ফলে সার্বিকভাবে উপকৃত হবে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ।

   এ বইটি মূল আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদ করে আমাদের দেশের বিশিষ্ট গুণীজন ও অনুবাদক জনাব মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান এক অনবদ্য দায়িত্ব পালন করেছেন। বইটি সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট আলেম জনাব মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন খান। তাদের উভয়কে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। বইটি প্রকাশে সহযোগিতা করায় জনাব আলী নেওয়াজকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। বইটি অনুবাদে সহযোগিতা করায় শহীদ আল্লামা বাকের সাদর (রহ.)বিশ্ব সম্মেলনে কমিটি,কোম, ইরান এর প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

অবতরণিকা

কিছু কিছু আলোচক ও পর্যালোচক মুসলিম উম্মাহ্ বহির্ভূত এক সম্প্রদায় হিসেবে শিয়া মাযহাব সর্ম্পকে আলোচনা করে থাকেন । তাঁরা এ মাযহাবটিকে মুসলিম উম্মাহর এমন এক অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন যার উদ্ভব কালক্রমে কতগুলো সুনির্দিষ্ট সামাজিক ঘটনা ও পরিবতর্নের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছে,এ সব ঘটনা প্রবাহ ও পরিবর্তনসমূহ মুসলিম উম্মাহর সেই অংশ-বিশেষের (শিয়া মাযহাব) চিন্তাগত ও মাযহাবী অস্তিত্বের এক বিশেষ রূপরেখা প্রদান করেছে । অতঃপর ধীরে ধীরে সেই অংশটি (সম্প্রদায়টি) বিকাশ লাভ করতে থাকে ।

এসব আলোচক ও পর্যালোচক (শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি সংক্রান্ত) এ ধরনের ধারণা পোষণ করার পাশাপাশি ঐ সব ঘটনা ও পরিবর্তন সর্ম্পকেও যথেষ্ট মতপার্থক্য পোষণ করে থাকেন যা শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ । এসব আলোচক ও পর্যালোচকের মধ্যে কারো কারো ধারণা হচ্ছে এই যে,‘‘ আবদুলাহ্ বিন সাবা ও তার কল্পিত রাজনৈতিক তৎপরতাই শিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তির মূল কারণ আবার কোন কোন পর্যালোচক ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল এবং তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সাথে ‘‘ শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন আবার কোন কোন আলোচক মনে করেন যে, ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত-কালোত্তর মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ঘটনা-প্রবাহের মাঝেই নিহিত রয়েছে শিয়া মাযহাবের উৎপত্তির কারণ

আমার দৃষ্টিতে যে কারণে এসব আলোচকের অনেকেই শিয়া মাযহাবকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বহিরাগত (অনুপবেশকারী) এক সম্প্রদায় হিসেবে ধারণা করছেন,তা হল এই যে,শিয়া সম্প্রদায় ইসলামের শুরু থেকেই মুসলিম উম্মাহর এক সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ বই আর কিছুই ছিল না।

আর এ অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,শিয়া না হওয়া ছিল সে সময়কার মুসলিম সমাজে প্রচলিত একমাত্র নিয়ম । আর শিয়া হওয়াটাই ছিল সেই প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম এবং (মুসলিম) উম্মাহ্ বহির্ভূত এমন বিষয় বা ঘটনা যার উৎপত্তির কারণসমূহ (তৎকালীন) প্রচলিত অবস্থার বিপক্ষে সংগ্রাম ও প্রতিরোধের ক্রমবিবর্তন ধারার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক ।

অথচ সংখ্যাধিক্য এবং আপেক্ষিক সংখ্যালঘুতকে নিয়ম ও ব্যতিক্রম নির্ণয় বা মূল-অমূলের পার্থক্য নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয় । তাই সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে শিয়া বহির্ভূত ইসলামকে মৌলিকত্ব প্রদান এবং সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে শিয়া ইসলামকে অমূলক ও ইসলাম বহির্ভূত বলে বিবেচনা করাটাও এক মারাত্মক ভুল । কেননা এটা বিশ্বাস-কেন্দ্রিক বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি বিরোধী । কারণ অনেক ক্ষেত্রে আমরা একই রিসালতের অবকাঠামোর মধ্যে বিশেষ কোন বিশ্বাস-কেন্দ্রিক বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে থাকি যা উক্ত রিসালতের কতিপয় চিহ্ন ও নিদর্শনের সীমারেখা সুনির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান মতপার্থক্যভিত্তিক । আবার কখনো কখনো দু টি আদর্শিক (বিশ্বাস-কেন্দ্রিক) সম্প্রদায় যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে সমান নয়,তবুও সমানভাবে বিতর্কিত ঐ রিসালতটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে থাকে । যেমনভাবে ইসলামী রিসালতের অবকাঠামোর আওতায়‘‘ শিয়া তত্ত্বের উৎপত্তির বিষয়টি একটি পরিভাষা এবং মুসলমানদের মধ্যকার একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের এক বিশেষ নাম হিসেবে শিয়া বা তাশাইয়ু শব্দের সাথে জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না,তদ্রুপ সংখ্যাগত দিক থেকে শিয়া অশিয়া-এ দু ভাগে ইসলামী রিসালতের অবকাঠামোর ভিতরে আদর্শিক বিভক্তি সংক্রান্ত আমাদের ধারণাও কোনক্রমে সঠিক হবে না । কারণ শাব্দিক নাম ও পরিভাষাসমূহের উৎপত্তি এক জিনিষ আর অন্তর্নিহিত মূল নির্যাস বা বিষয়,সত্যিকার দৃষ্টিভঙ্গি এবং (পান্ডিত্যপূর্ণ)তত্ত্বের উৎপত্তি আরেক জিনিষ। তাই মহানবীর জীবদ্দশায় বা তাঁর তিরোধানের পর প্রচলিত ভাষায় আমরা শিয়া শব্দের অস্তিত্ব যদি খুজে নাও পাই তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে না যে,(মহানবীর জীবদ্দশায় বা তাঁর ওফাতোত্তর কালে) শিয়া তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির আদৌ কোন অস্তিত্ব ছিল না ।

সুতরাং এ মানসিকতার আলোকে শিয়া বা তাশাইয়ু (শিয়া প্রবণতা) সম্পর্কে আলোচনা এবং নিম্নোক্ত প্রশ্ন দু টির উত্তর দেয়া জরুরী । প্রশ্ন দু টি :

১ । শিয়া প্রবণতার(تشیع ) উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে?

২ । শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে?

তাশাইয়ু বা শিয়া প্রবণতার উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে?

v ভবিষ্যতের দাওয়াতের বিষয়ে নেতিবাচব পদক্ষেপ ।

v শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে মহানবীর (সা.) খলিফা নির্ধারণের ইতিবাচক পদক্ষেপ ।

v সরাসরি বাছাই ও প্রত্যক্ষ মনোনয়নের ভিত্তিতে মহানবীর (সা.) উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করণের ইতিবাচক পদক্ষেপ ।

প্রথম প্রশ্ন অর্থাৎ শিয়া প্রবণতা বা তাশাইয়ুর উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে? আমরা এতদসংক্রান্ত চিন্তা করে বলতে পারি যে,তাশাইয়ু হচ্ছে পবিত্র ইসলাম ধর্মেরই এক স্বাভাবিক পরিণতি এবং সেই তত্ত্বেরই বাস্তব রূপ যা একমাত্র দাওয়াত বা ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের সুষ্ঠু বিকাশের নিশ্চয়তা বিধান করতে সক্ষম । তাই এ প্রচার কার্যক্রম কর্তৃক তা অর্জিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন । আর মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব,কার্যক্রমের গঠন-প্রকৃতি এবং তাঁর (সা.) সমসাময়িক পরিস্থিতি ও অবস্থার কারণেই দিয়েছিলেন । আর এ ইসলাম প্রচার কার্যক্রম থেকেই সরাসরি এ তত্ত্ব অর্থাৎ শিয়া মাযহাবের তত্ত্ব যুক্তিপূর্ণভাবে নির্ণয় করা সম্ভব ।

কারণ মহানবী (সা.) বৈপ্লবিক প্রচার কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিতেন এবং তিনি সমাজ, সামাজিক রীতি-নীতি,প্রথা-ব্যবস্থা এবং চিন্তা ও ভাবধারায় বাস্তবে আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেছেন । আর এ পরিবর্তন প্রক্রিয়াটি ক্ষণস্থায়ী কোন প্রক্রিয়া ছিল না বরং তা ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক যা জাহেলিয়াত (অন্ধকার যুগ) ও ইসলাম ধর্মের মধ্যকার বিরাজমান আধ্যাত্মিক ব্যবধান ও পার্থক্যের মতই দীর্ঘ ও ব্যাপক । তাই যে ইসলাম প্রচার কার্যক্রম মহানবী (সা.) তাঁর নিজ জীবদ্দশায় পরিচালনা করেছেন,কথা ছিল যে,তা জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগের অজ্ঞ,বর্বর মানুষকে এক নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করবে এবং তাকে (আদর্শ) ইসলামী ব্যক্তিত্বে পরিণত করবে,যে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন আলোর বার্তা পৌঁছে দিবে এবং জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটন করবে ।

মহানবী (সা.) সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বিস্ময়কর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন । আর উচিৎ ছিল যে,এই সংস্কারমূলক কার্যক্রম প্রক্রিয়া এমনকি মহানবীর (সা.) ওফাতের পরও অব্যাহতভাবে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমণ করবে । মহানবী (সা.) তাঁর ওফাতের কিছুকাল আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে,তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত অতি নিকটবর্তী,তাই তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় বিদায় হজ্বেও ব্যক্ত করেছিলেন । আর মৃত্যুও তাঁর কাছে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়নি । এর অর্থ দাঁড়ায় যে,তিনি তাঁর ওফাতের পরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেয়েছিলেন । এমনকি যদি এক্ষেত্রে আমরা অদৃশ্য জগতের সাথে তাঁর যোগাযোগ ও সম্পর্ক এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে রিসালতের সরাসরি সংরক্ষণ করার বিষয়টি আদৌ বিবেচনায় না আনি।

অতএব,এ আলোচনার আলোকে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে,মহানবী (সা.)-এর সামনে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত কেবলমাত্র তিনটি পথই উন্মুক্ত ছিল:

প্রথমতঃ নেতিবাচক পথ বা পদক্ষেপ।

দ্বিতীয়তঃ শূরা বা পরামর্শভিত্তিক ইতিবাচক পথ বা পদক্ষেপ এবং

তৃতীয়তঃ সরাসরি বাছাই,মনোনয়ন এবং নিযুক্তি ।

আর এক্ষেত্রে তিনটি আলোচনা রয়েছে ।

ভবিষ্যতের দাওয়াতের বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান

প্রথম পথ : খেলাফত বা মহানবীর উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করার ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়া এবং অবহেলা প্রদর্শন করা ।

আর এর অর্থ হল ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর নেতিবাচক পদক্ষেপ এবং কেবলমাত্র তাঁর নিজ জীবদ্দশায় ইসলামী প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্বদান ও পথ-প্রদর্শনই যথেষ্ট মনে করা এবং ইসলামী দাওয়াত বা প্রচার কর্মকান্ডের ভবিষ্যৎকে অজ্ঞাত, অজানা পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আকস্মিকতার হাতে ছেড়ে দেয়া ।

এ ধরনের নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ মহানবী (সা.)-এর ক্ষেত্রে মোটেও ভাবা যায় না । কারণ দু টি বিষয় থেকে এ ধরনের নেতিবাচকতার উৎপত্তি । আর এ দু টি বিষয় মহানবীর ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও চিন্তা করা যায় না (অর্থাৎ এ দু টি বিষয় মহানবী (সা.)-এর কর্মপদ্ধতির সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না) ।

প্রথম বিষয় : এ ধরনের বিশ্বাস করা যে,খেলাফত বা মহানবীর উত্তরাধিকার ও স্থলাভিষিক্ত নিযুক্তিকরণ সংক্রান্ত নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন ভবিষ্যতে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের উপর মোটেও প্রভাব ফেলবে না এবং ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের আশু দায়িত্বভার গ্রহণকারী মুসলিম উম্মাহ্ নিজেই প্রচার কাজের সহায়ক যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিচ্যুতির হাত থেকে তা রক্ষা করতেও সক্ষম ।

আসলে এ ধরনের বিশ্বাসের বাস্তব কোন ভিত্তি নেই । বরং প্রকৃত বাস্তবতা এর বিপক্ষে । কারণ তিনি ইসলাম প্রচার কার্যক্রমকে সূচনালগ্ন থেকেই এক বৈপ্লবিক সংস্কারমূলক কর্মকান্ড হিসেবে একটি জাতি গঠন এবং সব ধরনের জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার মূলোৎপাটন করার ব্রত ও লক্ষ্য নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন । আর এ প্রচার কার্যক্রম চরম বিপদের সম্মুখীন হবে যখন তা নেতা ও নেতৃত্ববিহীন হয়ে যাবে এবং তা কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও রূপরেখা ছাড়াই চলতে থাকবে । তাই এক্ষেত্রে বহু বিপদ রয়েছে । আর এসব বিপদ হচ্ছে :

প্রথমতঃ (ইসলামী দাওয়াত বা প্রচার কার্যের) কোন পূর্ব-পরিকল্পনা ও রূপরেখা না থাকার কারণে সৃষ্ট শূন্যতা মোকাবেলা করার গতি-প্রকৃতি এবং মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের কারণে উদ্ভূত ব্যাপক অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই পদক্ষেপ গ্রহণের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা থেকে সৃষ্ট বিপদসমূহ । কারণ মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন না করেই যদি ময়দান ত্যাগ করেন তাহলে প্রথম বারের মত এবং শীঘ্রই নেতাবিহীন অবস্থায় প্রচার কাজের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমস্যা মোকাবেলা করার গুরুদায়িত্ব উম্মাহর উপরই বর্তাবে ।

আর এ ব্যাপারে উম্মাহর কোন পূর্ব-ধারণা ও অভিজ্ঞতাই নেই । সমস্যার ভয়াবহতা যতই তীব্র হোক না কেন এক্ষেত্রে উম্মাহর কাছ থেকে তাৎক্ষণিক ও অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করতে হবে । কেননা এ ধরনের শূন্যাবস্থা চলতে দেয়া যায় না । উম্মাহর প্রাণহানিকর এ ক্ষতির মুহূর্তে  উম্মাহকে দ্রুত এ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে । কারণ এমতাবস্থায় উম্মাহ্ অনুভব করতে পারে যে,তারা তাদের মহান নেতাকে হারিয়েছে । আর সেই সাথে মহান নেতাকে হারানোর প্রচন্ড আঘাত ও ক্ষতিটাও উম্মাহ্ উপলব্ধি করতে পারে যা মানুষের চিন্তাশক্তিকে প্রচন্ডভাবে স্থবির ও লন্ড-ভন্ড করে দেয়,এমনকি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রচন্ড আঘাত জনিত কারণেই ঘোষণা করতে থাকেন যে, মহানবী (সা.) মৃত্যুবরণ করেননি এবং কখনো মৃত্যুবরণ করবেনও না। সুতরাং উম্মাহ্ কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপ ও আচরণ হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক । আর এর পরিণতি কখনো শুভ হবে না ।

দ্বিতীয়তঃ রিসালতের দায়িত্ব পালনে মুসলমানদের যোগ্যতার অভাব এবং অপরিপক্কতা জনিত কারণে সৃষ্ট বিপদ ও সংকটসমূহ । আর এ রিসালতী যোগ্যতা ও পরিপক্কতা যে মাত্রায় আগেই মহানবী (সা.)-এর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের রিসালতী কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করার নিশ্চয়তা বিধান করেছিল এবং যার ফলে তিনি (সা.) মুহাজির-আনসার,কুরাইশ-অকুরাইশ অথবা মক্কা-মদীনা কেন্দ্রিক শ্রেণী-বিভক্তির কারণে মুসলমানদের অন্তরে লুক্কায়িত বৈষম্য ও চাপা ক্ষোভ মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন ঠিক সেই মাত্রায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিদ্যমান ছিল না ।

তৃতীয়তঃ বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণকারী একটি গোষ্ঠী যারা সর্বদা মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত তাদের থেকে উদ্ভূত বিপদাপদ ও সংকটসমূহ । আর এ গোষ্ঠীটিকে পবিত্র কোরানে মুনাফিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর এদের সাথে যদি আরো বিরাট সংখ্যক জনগণকে যোগ করি যারা মক্কা বিজয়ের পর বিদ্যমান বাস্তব পরিস্থিতির কাছে নতিস্বীকার করে কিন্তু সত্য গ্রহণের মানসিকতা না নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল,তাহলে আমরা এ সকল দল ও গোষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট বিপদাপদ ও আশঙ্কার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারব । আর এ সকল চক্র নিশ্চয়ই ময়দানে নেতার অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট বিরাট শূন্যাবস্থায় ব্যাপক অপতৎপরতা চালানোর এক মোক্ষম সুযোগও লাভ করে থাকবে ।

তাই মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর তাঁর খলীফা বা উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণের সীমাহীন গুরুত্ব শুধুমাত্র সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নয়,আদর্শিক কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এমন যে কোন নেতার কাছেই গোপন থাকা একেবারে অসম্ভব ।

আর হযরত আবু বকর যদি খেলাফত ও শাসন সংক্রান্ত সতর্কতা অবলম্বনের অজুহাতে প্রশাসনের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা বিধান করতে গিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে ময়দান ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং যখন ঘাতকের হাতে আহত হওয়ার পর জনসাধারণ হযরত উমরের কাছে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগল, হে আমীরুল মুমেনীন,আপনি যদি কাউকে আপনার পরে খলিফা মনোনীত করতেন ? আর মহানবী(সা.)-এর ওফাতের পর ইসলাম প্রচার কার্যক্রম যে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সৃষ্টি করেছিল তা সত্ত্বেও এসব কিছুই ছিল খলীফার অবর্তমানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তার আশঙ্কায় । আর জনসাধারণ খলীফা বিহীন অবস্থায় যে বিপদাপদের আশঙ্কা করেছিল খলীফা উমর সে আশঙ্কা ও অনুভূতির প্রতি সাড়া দিয়ে যখন পরবর্তী খলীফা নির্বাচন করার জন্য ছয় জনের ব্যাপারে অসিয়ত করেছিলেন, আর হযরত উমর যখন সকীফা দিবসে প্রথম খলিফা নির্বাচনের অপরিসীম গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করেছিলেন এবং কোন পূর্ব-প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই হযরত আবু বকরের খেলাফত ও শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত যাবতীয় জটিলতা ও প্রতিক্রিয়ার কথা উপলব্ধি করে বলেছিলেন, হযরত আবু বকরের বাইআত ছিল আকস্মিক ঘটনা তবে মহান আল্লাহ এ ঘটনার অনিষ্টতা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন । ১০ আর যখন হযরত আবু বকর ত্বরা করে শাসনভার গ্রহণ করার পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেছিলেন যে,তিনি খলীফা নিযুক্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপক গুরুত্ব এবং যে কোন উপায়ে (মহানবীর ওফাতের পরে নেতাবিহীন অবস্থায় সৃষ্ট সংকট ও সমস্যা) সমাধান করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,(আর তিনি শাসন-কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য মৃদু নিন্দা ও ভৎসনারও শিকার হয়েছিলেন) মহানবী (সা.) যখন ইন্তেকাল করেন তখন জনগণ জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ থেকে সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে (অর্থাৎ তারা নব্য মুসলমান) । তাই আমি ভয় পেলাম যে,তারা (নব্য মুসলমানরা) মহানবীর অবর্তমানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে । আর বন্ধুরাও আমার উপর জোর করেই খেলাফতের দায়িত্ব চাপিয়ে দিল । ১১ আর এসব কিছুই যদি সত্য হয় তাহলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে,ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের কর্ণধার এবং নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিঃসন্দেহে নেতিবাচক পদক্ষেপের (অর্থাৎ মহানবীর ওফাতের পর ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের পরিচালনা ও নেতৃত্ব দানের জন্য একজন খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত মনোনীত না করা) কুফল ও বিপদ ইতিবাচক পদক্ষেপের বাস্তবতার আলোকে এবং স্বয়ং হযরত আবু বকরেরও স্বীকারোক্তি অনুযায়ী জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ থেকে সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী উম্মাহর আমূল সংস্কার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়ের নিরিখে সবচেয়ে বেশী উপলব্ধি করেছিলেন এবং সবার চেয়ে বেশী অনুধাবন করেছিলেন ।

দ্বিতীয় বিষয় (স্বার্থকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি): দ্বিতীয় বিষয়টি যা সম্ভবতঃ নেতার মৃত্যুর পর ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতার নেতিবাচক পদক্ষেপের একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে তা হল যে,এ ধরণের নেতিবাচক পদক্ষেপের কুফল ও বিপদ উপলব্ধি করা সত্ত্বেও নেতা ঐ বিপদের মোকাবেলায় প্রচার কাজের সঠিক সংরক্ষণের জন্য কোন চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাননি । কেননা তিনি প্রচার কার্যক্রমকে ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির উপায় হিসেবে দেখেন ও বিবেচনা করেন । তাই যে পর্যন্ত তিনি জীবিত আছেন কেবলমাত্র সে পর্যন্ত এ প্রচার কার্যক্রম থেকে লাভবান হওয়ার জন্যই উক্ত প্রচার কার্যক্রমটিকে টিকিয়ে রাখা বা সংরক্ষণ করাই হচ্ছে তার (নেতার) একমাত্র ব্রত ও উদ্দেশ্য । আর তার মৃত্যুর পরে দাওয়াত বা প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ করার ব্যাপারে তার কোন চিন্তা-ভাবনাই নেই ।

এ ধরনের ব্যাখ্যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে মোটেও প্রযোজ্য নয়,এমনকি যদি আমরা নবুওয়াত ও রিসালত সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ে তাঁকে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত বলে মনে নাও করি এবং তাঁকে অন্যান্য মিশনারী নেতার মত নিছক একজন মিশনারী নেতা হিসেবে বিবেচনা করি । কারণ জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলাম-ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে যে নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা মহানবী (সা.) প্রদর্শন করেছেন তার কোন নজীর মিশনারী নেতাদের জীবনেতিহাসে বিদ্যমান নেই । তাঁর (সা.) পুরো জীবন থেকে এ বিষয়টি প্রমাণিত । তাই মহানবী (সা.) মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে এবং তীব্র অসুস্থতার মাঝেও এমন এক যুদ্ধের কথা চিন্তা করেছিলেন যার পরিকল্পনা তিনি নিজেই প্রণয়ন করেছিলেন এবং রণাঙ্গনে প্রেরণের জন্য তিনি নিজেই হযরত উসামা বিন যায়েদের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত ও সজ্জিত করেছিলেন । এ কারণেই তিনি (সা.) অসুস্থতা সত্ত্বেও বলেছিলেন, উসামার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত কর- উসামার সেনাবাহিনীকে রণাঙ্গনে প্রেরণ কর । আর তিনি এ কথাটি বারবার বলছিলেন আর কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর মূর্ছা ও যাচ্ছিলেন১২ । অতএব,কোন এক সামরিক বিষয়ে মহানবী (সা.) মৃত্যু শয্যায় শায়িতাবস্থায়ও যদি এতবেশী উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত থাকেন এবং উক্ত যুদ্ধের ফলাফল হাতে আসার আগেই যে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন তা তাঁর জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি এ বিষয়টি (অর্থাৎ উসামার নেতৃত্বে উক্ত সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে প্রেরণ করা) থেকে মোটেও বিরত না হন,আর আমরা এটাও দেখতে পাই যে,শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহূর্তেও মহানবী (সা.) ঐ যুদ্ধ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করছেন,তাহলে আমরা কিভাবে ভাবতে পারি যে,মহানবী (সা.) ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না বা কোন চিন্তা-ভাবনাও করবেন না এবং ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার যাতে করে তাঁর ওফাতের পরে নানা প্রকার কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত সংকট,সমস্যা ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকে সেজন্য তিনি কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও রূপরেখাও দিয়ে যাবেন না ?!!

আর সবশেষে মহানবী (সা.)-এর সর্বশেষ অসুস্থতায়ও তাঁর আচরণের মধ্যে এমন এক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যা প্রথম পদক্ষেপটিকে (নেতিবাচক পদক্ষেপ) সর্বৈব মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট । আর এ থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে,বিপদাশঙ্কা না করা বা বিপদ সম্পর্কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ভীত না হওয়ার কারণে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে মহানবী (সা.) অনেক দূরে ছিলেন ।

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে মুসলমানদের সকল সহীহ হাদীস গ্রন্থে মৃত্যু শয্যায় শায়িতাবস্থায় মহানবীর যে আচরণের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা হয়েছে তা হল যখন মহানবী (সা.)-এর ওফাত নিকটবর্তী হল এবং ঘরে অনেক লোক ছিল আর তাদের মধ্যে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবও ছিলেন তখন তিনি (সা.) বললেন, কাগজ ও কলম নিয়ে এসো । আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে যাব যার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না । ১৩

মহান নেতার পক্ষ থেকে আন্তরিক এ প্রচেষ্টা যার বর্ণনা ও সত্যতা সম্পর্কে সকলেরই ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে তা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.) প্রচার কার্যের ভবিষ্যৎ বিপদের কথা চিন্তা করতেন । আর বিকৃতি,বিচ্যুতি ও বিলুপ্তির হাত থেকে মুসলিম উম্মাহ্ এবং ইসলাম প্রচার কার্যক্রম সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা ও রূপরেখা প্রণয়ন করা যে একান্ত প্রয়োজন তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তাই যে কোন অবস্থায় মহানবী (সা.)-এর পক্ষে নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ধারণা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব এবং মোটেও যুক্তিসংগত নয় ।

শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে খলীফা নির্ধারণের ইতিবাচক পদক্ষেপ

দ্বিতীয় পথ : সম্ভাব্য দ্বিতীয় পদক্ষেপটি হচ্ছে যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ওফাতের পরে দাওয়াত বা ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন এবং এতদসংক্রান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার ভিত্তিতে তিনি ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব এ উম্মাহরই প্রথম আদর্শিক প্রজন্ম অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে আনসার ও মুহাজিরদের মাঝেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন । অতএব,উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী এ প্রজন্মটিই হবে সরকার বা প্রশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি এবং উন্নয়ন ও প্রগতির পথে ধাবমান ইসলাম-প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্বধারার কেন্দ্রবিন্দু ।

তবে বাস্তবতা,মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচার কার্যক্রম এবং প্রচারকদের স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল সর্বসাধারণ অবস্থার কারণে সম্ভাব্য দ্বিতীয় পদক্ষেপ সংক্রান্ত অনুমান ও ধারণা সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায় । আর এর পাশাপাশি মহানবী (সা.) যে শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে অগ্রগামী প্রজন্ম অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারদের সাথেই তাঁর ওফাতের পরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব-ধারাকে জুড়ে দিয়েছেন- এতদসংক্রান্ত সকল অনুমান এবং জল্পনা-কল্পনারও অবসান হয়ে যায় । নিম্নোল্লেখিত কিছু কিছু বিষয় থেকেও উপরোক্ত বক্তব্যের একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা ও জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় ।


3

4

5

6

7

8

9