শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম0%

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ মুহাম্মদ বাকের সাদর (রহঃ)
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বিভাগ:

ভিজিট: 12467
ডাউনলোড: 4232

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 12467 / ডাউনলোড: 4232
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

শিয়া প্রবণতা ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: আমার দেশ বাংলাদেশ সোসাইটি
বাংলা

২-উম্মাকে ( আগামী প্রজন্মকে ) চিন্তাগতভাবে মিশনারী দায়িত্বের জন্য সংগঠিত না করা :

মহানবী (সা.) যদি মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে অগ্রগামী প্রজন্ম মুহাজির ও আনসার সাহাবাদেরকে তাঁর ওফাতের পরে দাওয়াত বা ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং আমূল সংস্কার প্রক্রিয়া পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণই করতেন তাহলে তাঁর করণীয় ছিল এ প্রজন্মটিকে চিন্তামূলকভাবে ও মিশনারী দায়িত্ববোধ সহকারে সর্বদিক থেকে গড়ে তোলা যাতে তারা ইসলামী মতাদর্শ পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে এবং এ মতাদর্শের আলোকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও সচেতনতার সাথে ইসলাম প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজও সম্পন্ন করতে পারে । আর এর ফলে এ কার্যক্রম বিরামহীন যে সব সমস্যার সম্মুখীন হবে তার সমাধানও রেসালতী আদর্শের আলোকে তারা দিতে সক্ষম হবে । বিশেষতঃ তখনই যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি যে,মহানবী যিনি পারস্য সম্রাট খসরু এবং রোমান সম্রাট কায়সারের পতনের শুভ সংবাদ দিয়েছেন;২১ তিনি জানতেন যে,অচিরেই ইসলাম প্রচার কার্যক্রম ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে এবং অতি শীঘ্রই পৃথিবীর নতুন নতুন জাতি,দেশ ও রাজ্য মুসলিম উম্মাহর করায়ত্তে আসবে । আর তখনই ইসলামের সাথে বিজিত জাতিসমূহকে পরিচিত করার দায়িত্ব মুসলমানদের উপর বর্তাবে । মুসলমানদের সাথে বিজিত জাতি ও জনপদসমূহের সংমিশ্রণের সমূহ বিপদাপদ এবং অনিষ্ট থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করা এবং বিজিত জনপদ ও দেশসমূহে ইসলামী শরীয়ত ও আইন কানুন বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও উক্ত প্রজন্মের উপরই বর্তাবে । মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম নিঃসন্দেহে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে যে সব প্রজন্ম লাভ করেছিল তন্মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও কলুষতামুক্ত এবং ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন । তা সত্ত্বেও ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্ত সমূদয় প্রয়োজনীয় ধ্যান-ধারণা সম্পর্কিত গভীর ও ব্যাপক শিক্ষাদানের কোন নিদর্শনই আমরা খুজে পাই না । আর বাস্তবে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের কোন নিদর্শন না থাকার বিষয়টি সমর্থন করে এমন সব দলীল-প্রমাণের সংখ্যা প্রচুর যা এ ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্ত করা সম্ভব নয় । আর এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে,শরয়ী বিধি-বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাহাবাসূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস বা ঐতিহাসিক দলীল-প্রমাণের সংখ্যা কয়েকশোর বেশী হবে না । অথচ ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহের মতে মহানবীর সাহাবা সংখ্যা ১২০০০ (বার হাজার)-এর অধিক ছিল ।২২ আর যেখানে মহানবী (সা.) তাঁর হাজার হাজার সাহাবার সাথে একই শহরে একই মসজিদে কত সকাল-সন্ধ্যা অতিবাহিত করেছেন সেখানে এ সংখ্যাগুলোর মাঝেও কি বিশেষ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের সামান্য নিদর্শন খুজে পাওয়া সম্ভব নয়?!!

মহানবী (সা.)-এর সাহাবাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ রীতি এটাই ছিল যে,তাঁরা মহানবী (সা.)-কে প্রথমেই প্রশ্ন শুরু করতেন না বা এ থেকে বিরত থাকতেন এমনকি তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি মদীনার বাইরে থেকে কোন আরব বেদুঈনের আগমনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন,যে নাকি এসে মহানবীকে প্রশ্ন করবেন আর এ সুযোগে তিনি ঐ প্রশ্নটার উত্তর মহানবীর কাছ থেকে শুনে নিবেন ।২৩ তাঁরা (সাহাবাগণ) মনে করতেন যে,যে সব বিষয় সংঘটিত হয়নি সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা বাহুল্য বই আর কিছুই নয় যা অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত । আর এ কারণেই হযরত উমর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মহান আল্লাহর শপথ,যে বিষয় বা ব্যাপার সংঘটিত হয়নি সে সম্পর্কে যদি কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করে,তাহলে আমি তার উপর কঠোরতা আরোপ করব । কারণ মহান আল্লাহ যা ঘটে বা ঘটছে অবশ্যই তা বর্ণনা করেছেন। ২৪ তিনি আরো বলেছেন, যা ঘটেনি সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা কারো জন্য বৈধ হবে না । কারণ মহান আল্লাহ যা ঘটে বা ঘটবে সে বিষয়ে অবশ্যই ফয়সালা দিয়েছেন। ২৫ একদিন এক ব্যক্তি ইবনে উমরের কাছে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ইবনে উমর তাকে বলেছিলেন, যে জিনিস ঘটেনি তা জিজ্ঞেস করো না । কারণ আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে যে জিনিস ঘটেনি সে বিষয়ে প্রশ্নকর্তাকে অভিসম্পাত দিতে শুনেছি। ২৬ এক ব্যক্তি উবাই ইবনে কা বকে কোন সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, হে বৎস,যে বিষয়টা সম্পর্কে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছ তা ঘটেছে কি? তখন ঐ লোকটি বলেছিল- না । তখন তিনি বললেন, অতএব,তা ঘটা পর্যন্ত তুমি আমাকে সময় দাও । ২৭

একদিন হযরত উমর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে করতে এ আয়াতটিতে পৌঁছলেন, অতঃপর আমরা তথায় শস্যবীজ, আঙ্গুর, ইক্ষু, জলপাই, খেজুর, উদ্যানরাজি, ফল এবং দুর্বাঘাস( اب ) সৃষ্টি করেছি ২৮ তখন তিনি বলতে লাগলেন এ সব কিছুই তো বুঝলাম কিন্তু اب কি? এরপর তিনি বললেন, খোদার কসম আসলেই এটা একটা কষ্টদায়ক ব্যাপার তাই তোমাদের জানা ওয়াজিব হবে না যে, اب শব্দের অর্থ কি পবিত্র কোরানের যে অংশের অর্থ তোমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে কেবল সেটুকর অনুসরণ কর এবং তদনুযায়ী আমল (কাজ) কর আর কোরানের যা কিছু তোমরা জান না তা তার প্রভুর কাছে সঁপে দাও ২৯

আর এভাবে আমরা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকার এক সার্বিক প্রবণতা সাহাবাদের মধ্যে দেখতে পাই । আর এ প্রবণতাই হচ্ছে মহানবী (সা.) থেকে সাহাবাদের বর্ণিত হাদীসসমূহের সংখ্যা খুব কম হওয়ার মূল কারণ । আর এ স্বল্পতার কারণেই পরবর্তী কালে (খুটি-নাটি বিষয়ে ইসলামী বিধি-বিধান প্রণয়ন করার জন্য) ইস্তেহসান ও কিয়াসের মত পবিত্র কোরান ও সুন্নাহ বহির্ভূত অন্যান্য উৎসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । আর এই ইস্তেহসান ও কিয়াস হচ্ছে ঐ ধরনের ইজতিহাদ যাতে মুজতাহিদের ব্যক্তিগত অভিরুচির উপস্থিতি ও প্রভাব রয়েছে । আর এ কারণেই শরয়ী বিধি-বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি ও চিন্তাধারা সমেত তার ব্যক্তিত্বের অনুপ্রবেশ ঘটে যায় । আর এ প্রবণতাটি রিসালতী দায়িত্ব ও সচেতনতাবোধ সম্পন্ন করে প্রশিক্ষিত করার বিশেষ কার্যক্রমের ধ্যান-ধারণা থেকে যে বহু দূরে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আর এ বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হত অগ্রগণ্য ঐ প্রজন্মটিকে (মুহাজির-আনসারগণ) ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সংক্রান্ত উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রশিক্ষিত করা ।

ঠিক যেমনভাবে সাহাবাগণ মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থেকেছেন ঠিক তেমনভাবে ইসলামী বিধি-বিধানের দ্বিতীয় প্রধান উৎস হওয়া সত্ত্বেও মহনবীর হাদীস ও সুন্নাহ্ লিপিবদ্ধ করা থেকে বিরত থেকেছেন । বলা বাহুল্য যে,লিখন প্রক্রিয়াই হচ্ছে বিলুপ্তি ও বিকৃতির হাত থেকে হাদীস ও সুন্নাহ্ সংরক্ষণ করার একমাত্র পন্থা । উদাহরণস্বরূপ হিরাভী যাম্মুল কালাম গ্রন্থে ইয়াহ্ইয়া বিন সা দের সূত্রে আব্দুল্লাহ্ বিন দিনার থেকে বর্ণনা করেছেন, সাহাবাগণও হাদীস লিপিবদ্ধ করেননি আর তাবেয়ীগণও তা করেননি । তাঁরা কেবল হাদীসগুলোর শাব্দিক বর্ণনা করতেন এবং হিফয বা মুখস্তকরণ প্রক্রিয়ায় হাদীস গ্রহণ করতেন।৩০ তবে দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব- তাবাকাতে ইবনে সা দের বর্ণনানুসারে- মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্ সংরক্ষণের ব্যাপারে সর্বোত্তম কোন্ পন্থা নেয়া যায় সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। দীর্ঘ একমাস চিন্তা-ভাবনা করার পর তিনি মহানবীর হাদীস ও সুন্নাহ্ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেন।৩১ আর এ নিষেধাজ্ঞার কারণে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ-যা হচ্ছে পবিত্র কুরআনের পর ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস তা অদৃষ্টের হাতে ১৫০ বছরের জন্য ছেড়ে দেয়া হল,যার ফলে মহানবীর অগণিত হাদীস ও সুন্নাহ বিস্মৃতি ও বিকৃতির শিকার হল এবং হাদীসের অসংখ্য হাফেজের মৃত্যুতে আমাদের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল ।

এর ব্যতিক্রম হচ্ছে আহলে বাইতের দৃষ্টিভঙ্গি ও গৃহীত পদক্ষেপ । তাঁরা প্রথম শতক থেকেই হাদীস সংরক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন । আহলে বাইতের ইমামদের থেকে মুস্তাফিজ*সূত্রে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত আছে যে,আহলে বাইতের ইমামগণের কাছে হযরত আলীর হস্তে লিখিত মহানবী (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীর (হাদীসের) একটি বিশাল গ্রন্থ আছে যাতে সংরক্ষিত রয়েছে মহানবীর সমূদয় সুন্নাহ ।৩২

(*মুস্তাফিজ রেওয়ায়েত : মশহুর ও মুতাওয়াতির রেওয়ায়েতের মাঝামাঝি অর্থাৎ মশহুর অপেক্ষা উচ্চপর্যায়ের এবং মুতাওয়াতিরের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের- অনুবাদক) খোদার শপথ, বাস্তবিকই যদি ব্যাপারটি অতি সাদামাটাই হয়ে থাকে তাহলে,ঐ সরল দৃষ্টিভঙ্গি যা কোন ঘটনা ঘটার আগে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় এবং মহানবীর পবিত্র সুন্নাহ্ সংরক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করে,তা সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমণের সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নতুন রিসালতের নেতৃত্বদানের জন্য কি উপযুক্ত ও যথেষ্ট ?

মহানবী (সা.) তাঁর সুন্নাহ্ সংরক্ষণ ও লিপিবদ্ধ না করেই ইহলোক ত্যাগ করে পরপারে চলে যাবেন অথচ তিনিই আবার কিভাবে তাঁর সুন্নাহ্ আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য সবাইকে আদেশ করবেন ?৩৩

মহানবী (সা.) যদি শূরা ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোন অধিকারের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা করেই যেতেন তাহলে মহানবী কর্তৃক শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার যাবতীয় বিধি-বিধান সুনির্দিষ্ট করে বর্ণনা করার কি প্রয়োজন ছিল না ? যাতে শূরা ব্যবস্থা একটি স্থায়ী নির্দিষ্ট পথে চলতে পারে এবং কারো প্রবৃত্তির ক্রীড়নকে পরিণত না হয় সেজন্য মহানবী (সা.) অবশ্যই তাঁর সুন্নাহ্ সংরক্ষণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ।

আর মহানবী (সা.)-এর গৃহীত এ পদক্ষেপের একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি এটাই নয় যে, তিনি ইমাম আলীকে তাঁর ওফাতের পরে সমূদয় ধর্মীয় বিষয় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রামাণিক উৎস ও বৈধ কতৃপক্ষ (المرجعیة ) এবং ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্বদানের জন্য প্রস্তুত করেছেন । আর তাঁর (সা.) সমূদয় সুন্নাহ্ তাঁর (আলী) কাছে আমানত রেখেছেন এবং জ্ঞানের এক হাজার দুয়ার তাঁর কাছে উন্মোচিত করেছেন ।৩৪

মহানবী (সা.)-এর ওফাত-পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয় যে,অনেক বড় বড় সমস্যার সুনির্দিষ্ট সমাধান সংক্রান্ত কোন জ্ঞান ও শিক্ষা আনসার ও মুহাজির প্রজন্মের ছিল না । মহানবীর ওফাতের পরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রম এসব সমস্যার সম্মুখীন হবে,সে সম্পর্কে পূর্ব থেকেই ধারণা করা হয়েছিল । এমনকি মুসলমানদের বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিরাট বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ সংক্রান্ত শরয়ী বিধি-বিধান,মুহাজিরদের মধ্যেই কি তা বন্টন করতে হবে নাকি সমগ্র মুসলিম জনসাধারণের জন্য তা ওয়াক্ফ করা হবে,এতদসংক্রান্ত কোন সুস্পষ্ট ধারণা খলীফা ও তাঁর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছিল না।৩৫ অতএব,আমরা কি ধারণা করতে পারি যে,মহানবী (সা.) যেখানে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বলতেন,তারা শীঘ্রই পারস্য সম্রাট খসরু এবং রোমান সম্রাট কায়সারের সাম্রাজ্য জয় করবে এবং ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয়াভিযানের দায়িত্ব আনসার-মুহাজির প্রজন্মের হাতে তিনি অর্পণ করবেন, সেখানে তিনি অদূর ভবিষ্যতে ইসলামের অগ্রযাত্রা ও বিজয়াভিযানের মাধ্যমে অর্জিত পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ সংক্রান্ত অতি প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদেরকে (মুহাজির-আনসার প্রজন্ম ও সর্বসাধারণ মুসলমানদেরকে) বিন্দুমাত্র অবহিত করেননি?!!

বরং এর চেয়ে আরো মারাত্মক যে বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করি তা হল,মহানবী (সা.)-এর সমসাময়িক (মুহাজির-আনসার) প্রজন্মের এমনকি নিছক ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রেও স্বচ্ছ জ্ঞান ও ধারণা ছিল না । উল্লেখ্য যে,মহানবী (সা.) এসব বিষয় সাহাবাদেরকে শত শত বার বাস্তবে করে দেখিয়েছেন । উদাহরণস্বরূপঃ এ প্রসঙ্গে আমরা জানাযার নামাযের কথা উল্লেখ করতে পারি । জানাযার নামায ছিল একটি ইবাদত যা মহানবী (সা.) মুসল্লী ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগদানকারীদের উপস্থিতিতে শত শত বার আদায় করেছেন । কিন্তু এতদসত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন সাহাবারা যে পর্যন্ত মহানবী (সা.) জানাযার নামায আদায় করেছেন সে পর্যন্ত তারা কেবলমাত্র মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ করেছেন এবং এ ইবাদতটি শেখার প্রয়োজনীয়তা মোটেও অনুভব করেননি। আর এ জন্যই মহানবীর ওফাতের পর জানাযার নামাযে কয়টা তাকবীর আছে সে ব্যাপারেও সাহাবাদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইব্রাহীমের সূত্রে তাহাবী বর্ণনা করেছেন : মহানবী যখন ইন্তেকাল করলেন তখন জানাযার নামাযের তাকবীর সংখ্যা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছিল । তাদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বলেছিল,‘‘ আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে পাঁচবার তাকবীর বলতে শুনেছি। আবার কোন কোন ব্যক্তির বক্তব্য ছিল,‘‘ মহানবী (সা.)-কে চারবার তাকবীর বলতে শুনেছি । আর এ ব্যাপারে তাদের মতবিরোধ হযরত আবু বকরের মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে । অতঃপর উমর ইবনুল খাত্তাব যখন খলীফা হলেন তখন জানাযার নামাযের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্য তাঁর জন্য পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়াল । তাই তিনি মহানবীর কতিপয় সাহাবীকে পত্র লিখে বলেছিলেন, হে মহানবী (সা.)-এর সম্মানিত সাহাবীবৃন্দ,আপনারা যতক্ষণ সাধারণ মুসলিম জনতার সামনে মতপার্থক্য করে যাবেন ততক্ষণ তারাও আপনাদের পর মতপার্থক্য জিইয়ে রাখবে । আর যখন আপনারা তাদের সামনে ঐকমত্য পোষণ করবেন তখন তারাও ঐক্যবদ্ধ থাকবে । সুতরাং আপনারা যে সব বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন কেবলমাত্র সে সব বিষয়েই আপনাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত। উমর ইবনুল খাত্তাব যেন তাদেরকে জাগ্রত করলেন । অতঃপর তাঁরা (সাহাবাগণ) বললেন, হে আমীরুল মুমেনীন,আপনি যা মনে করেন তাই উত্তম। ৩৬

আর এভাবে আমরা দেখতে পাই যে,সাহাবাগণ মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রধানতঃ তাঁর উপরই নির্ভর করতেন । আর যতদিন মহানবী (সা.) জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত তাঁরা (সাহাবাগণ) শরয়ী বিধি-বিধান ও ধর্মীয় বিষয়াদির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জন ও বুৎপত্তি লাভ করার প্রয়োজনীয়তা মোটেও অনুভব করেননি ।

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে যে,সাহাবাদের যে চিত্রটি এখানে তুলে ধরা হয়েছে এবং নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে তাদের অযোগ্যতার যে সব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা মহানবীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ব্যাপক সাফল্য এবং তিনি (সা.) যে এক অতি উন্নত মিশনারী প্রজন্মের জন্ম দিয়েছিলেন সে সংক্রান্ত আমাদের ধারণা ও কিয়াসের পরিপন্থী ।

এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হয়েছে তা থেকে আমরা মহানবী (সা.)-এর ওফাতকালীন সময়ের সেই বিশাল প্রজন্মটির (মুহাজির-আনসার প্রজন্ম) প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছি । আর এক্ষেত্রে মহানবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত করেছেন সেটার ইতিবাচক মূল্যায়ন-পরিপন্থী কোন কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি । কারণ আমরা যে মুহূর্তে বিশ্বাস করি যে,মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল এক উন্নত ঐশ্বরিক আদর্শ এবং যুগে যুগে নবুওয়াতী কর্মধারার ইতিহাসে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক রিসালতী মিশন,ঠিক সে মুহূর্তে  আমরা দেখতে পাই যে,এ ব্যাপারে বিশ্বাস এবং এ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ফলাফলের একটা যথার্থ মূল্যায়নে উপনীত হওয়া আসলে উক্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা ও পরিবেশ থেকে ফলাফলকে আলাদা করে কেবলমাত্র তা পর্যবেক্ষণ করার উপরই যেমনভাবে নির্ভরশীল নয়,ঠিক তেমনিভাবে পরিমাণের উপরও নির্ভরশীল নয়,যা গুণ ও মান বিবর্জিত । এ বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করার জন্য এখানে একটি উপমা উল্লেখ করব । মনে করি যে,একজন শিক্ষক ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়ে থাকেন । আমরা যদি তাঁর শিক্ষকতার দক্ষতার একটি মূল্যায়ন করতে চাই তাহলে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের কি পরিমাণ জ্ঞান ও তথ্য এ সব ছাত্র-ছাত্রীর অর্জিত হয়েছে কেবলমাত্র তা যাচাই করে দেখলে চলবে না;বরং ইংরেজী ভাষা কোর্সের সময়কাল,কোর্সে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের পূর্ববর্তী অবস্থা,ইংরেজী ভাষা ও পরিবেশের সাথে তাদের পরিচিতির,নৈকট্য ও দূরত্বের মাত্রা,ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কোর্সের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা এবং এ শিক্ষা কোর্সের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবেচনা করে দেখতে হবে এবং স্পষ্ট করে তা বর্ণনা করতে হবে । আর এর পাশাপাশি পাঠদানের বিভিন্ন অবস্থার সাথে উক্ত ভাষা-শিক্ষকের পাঠদানের সর্বশেষ অবস্থার ফলাফলের সম্পর্কটাও নির্ণয় করতে হবে ।

সুতরাং মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সার্বিক মূল্যায়ন করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা উচিত:

(ক) মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সময়কাল ছিল অত্যন্ত সীমিত ও সংক্ষিপ্ত। কেননা মহানবী (সা.)-এর স্বল্পসংখ্যক প্রবীণ সাহাবীগণ যারা ইসলাম প্রচার কালের শুরু থেকে তাঁর সাথে ছিল তাদের ক্ষেত্রেও ঐ সময়কাল দু যুগের বেশী হবে না । আর এ একই সময়কাল বিরাট সংখ্যক আনসার সাহাবাদের ক্ষেত্রে একযুগের বেশী হবে না । আর বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী যারা হুদাইবিয়ার সন্ধি থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের ক্ষেত্রে তিন-চার বছরের বেশী হবে না ।

দ্বিতীয়তঃ মহানবী (সা.)-এর সমাজ-সংস্কার কার্যক্রম ও কর্মতৎপরতা শুরু করার আগে চিন্তামূলক,মানসিক,ধর্মীয় এবং আচার আচরণগত দিক থেকে মুহাজির,আনসার ও তৎকালীন আরবদের ইসলাম পূর্বাবস্থা,সাদামাটা ও সহজ-সরল জীবন যাপন,চিন্তা,আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে বিরাজমান শূন্যতা এবং স্বতঃস্ফুর্ত মনোবৃত্তি ।

আমি এ বিষয়টির আর বাড়তি ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না । কারণ এগুলো হচ্ছে পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট । কেননা পবিত্র ইসলাম ধর্ম শুধুমাত্র সমাজের বাহ্যিক অবস্থার সংস্কারই করেনি বরং তা হচ্ছে সমাজের আমূল সংস্কার প্রক্রিয়া এবং একটি নতুন উম্মাহর বৈপ্লবিক ভিত্তি । আর এর অর্থই হচ্ছে ইসলাম-পূর্ব অবস্থা ও পরবর্তী অবস্থার মধ্যে বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবধান রয়েছে,যা লক্ষ্য করেই মহানবী (সা.) উম্মাহর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ করেছিলেন ।

তৃতীয়তঃ মহানবী (সা.)-এর সময়কার বিভিন্ন ঘটনা এবং বহুমুখী রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের বিভিন্ন রূপ যা মহানবী ও তাঁর সাহাবাদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি ও ধরনকে হযরত ঈসা (আ.) ও তদীয় শিষ্যদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি ও ধরন থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে । তাই মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবাদের মধ্যকার সম্পর্ক প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মত নয় । তবে তা হচ্ছে এমনই এক সম্পর্ক যা একজন প্রশিক্ষক,সেনাপতি এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহানবীর অবস্থা ও মর্যাদার সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ।

চতুর্থত: আদর্শিক-সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি যা মুসলিম উম্মহকে মোকাবেলা করতে হয়েছে কারণ এভাবে বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় সংস্কৃতি-সভ্যতা এবং আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসার কারণে এবং নতুন ধর্মীয় প্রচার কার্যক্রমের পূর্ববর্তী ধর্মীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষায় দীক্ষিত শত্রুগণ কর্তৃক ময়দানে পরিচালিত অপতৎপরতা লাগাতার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং উত্তেজনার কারণ হয়েছিল । আর আমরা সবাই জানি যে,এ ধরনের অপতৎপরতা পরবর্তীকালে এমন এক ইস্রাঈলী (ইহুদীদের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্বলিত) চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিল যা আপনা-আপনি অথবা অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল।৩৭ এই প্রতি-বিপ্লবী ইস্রাঈলী চিন্তাধারার ব্যাপকতা এবং তা খণ্ডন করার ব্যাপারে ঐশী মনোযোগ ও দৃষ্টির মাত্রা নির্ণয় করার জন্য পবিত্র কোরানে সামান্য অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি রাখাই যথেষ্ট ।৩৮

পঞ্চমত : যে সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য মানবতার মহান পথ প্রদর্শক ও শিক্ষক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যাপক ও সর্বসাধারণ পরিসরে অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন এবং সাধনা করেছেন তা ছিল ঐ পর্যায়ে একটি সৎ ও জনপ্রিয় গণফোরামের প্রতিষ্ঠা । আর এ প্লাটফর্ম বা গণফোরামের সাথে মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ওফাতোত্তর রিসালতী মিশনের নতুন নেতৃত্বধারা হবে পূর্ণ সংগতিশীল এবং এর মধ্য দিয়েই তা (নতুন নেতৃত্বধারা) সমুদয় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতাও অর্জন করবে । এখানে উল্লেখ্য যে,এ নেতৃত্বধারার শীর্ষে উম্মাহর উত্তরণেরও ছিল না পর্যায়ভিত্তিক কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । কারণ এ উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রিসালত ও নবুওয়াতী মিশন সংক্রান্ত পূর্ণ জ্ঞান,দ্বীন ও শরীয়তের বিধি বিধান সংক্রান্ত ব্যাপক-গভীর বুৎপত্তি এবং ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারার সাথে সুগভীর নিরঙ্কুশ সংবদ্ধতা ও সংযুক্তি। আর তৎকালীন মুসলিম উম্মাহ্ এ সব কিছুর অধিকারী ছিল না । আর ঐ পর্যায়ে পূর্বোল্লেখিত মানে রিসালতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা ছিল এক সর্বৈব যুক্তিসংগত ব্যাপার যা (মহানবী কর্তৃক পরিচালিত) সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি থেকেও সুনির্দিষ্ট ও অবধারিত হয়ে যায় । কারণ,নিছক কতগুলো বাস্তব ইতিবাচক সম্ভাব্যতার আলোকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা মোটেও যুক্তিসংগত হবে না । ইসলাম তৎকালীন জাহেলী অনগ্রসর বর্বর আরব সমাজে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে,ঠিক সে রকম পরিস্থিতির ন্যায় যে কোন পরিস্থিতিতে যদি কোন বাস্তব সম্ভাব্যতা থেকেও থাকে তাহলে তা কেবলমাত্র আমাদের উল্লেখিত সীমারেখার মধ্যেই রয়েছে । কেননা নতুন রিসালত ও ধর্ম (ইসলাম) এবং আরবের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত জাহেলী দূর্নীতি পরায়ণ বাস্তব সামাজিক অবস্থার মধ্যকার আদর্শিক,চিন্তাগত এবং আধ্যাত্মিক গুণ ও মানগত পার্থক্যটাই এ রিসালত বা ইসলাম ধর্মের নেতৃত্বের পর্যায়ে উম্মাহর উত্তরণের পথে সার্বিকভাবে এক বিরাট অন্তরায় ছিল ।

ষষ্ঠতঃ মহানবী (সা.)-এর রেখে যাওয়া উম্মতের এক বিরাট অংশই ছিল বিজিতআত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ তারা মহানবীর মক্কা বিজয় এবং আরব উপদ্বীপে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়,সাফল্য ও নেতৃত্ব লাভ করার পর এ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।৩৯ বিজয়ের পর কেবলমাত্র অতি সীমিত ও সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং অল্প সময়ের জন্য মহানবী (সা.) এসব নব দীক্ষিত মুসলমানদেরকে পবিত্র ইসলামের সাথে পরিচিত এবং তাদের সাথে ইসলামী প্রশিক্ষণের কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন । এদের সাথে মহানবীর অধিকাংশ আচার-আচরণ ও সম্পর্ক ছিল অনেকটা প্রজার সাথে শাসকের আচার-আচরণ ও সম্পর্কের মত। আর মুআল্লাফাতুল কুলব সংক্রান্ত ধারণার উন্মেষও এ পর্যায়েই হয়েছিল । (মুআল্লাফাতুল কুলব ঐ সকল ব্যক্তিদেরকে বলা হয় যাদের অন্তঃকরণ ধন-সম্পদ ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়েছে) । আর তা ইসলামের যাকাত-বিধান৪০ এবং অন্যান্য নির্বাহী ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান ও গুরুত্ব লাভ করেছিল । এখানে উল্লেখ্য যে,উম্মাহর এ অংশটি (মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীরা) অপরাপর অংশ থেকে কখনোই পৃথক ও বিচ্ছিন্ন ছিল না;বরং তাদের সাথে এরা মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল এবং তারা একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিতও হত (অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের পর যারা মুসলমান হয়েছিল তারা এবং উম্মাহর অন্যান্য অংশ একে অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছে) ।

অতএব,এ ছ টি বিষয়ের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে,মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এক বিরাট ফলাফলের জন্ম দিয়েছিল,এক অনন্য সাধারণ পরিবর্তন সাধন করেছিল এবং রিসালতী প্রচার কার্যক্রমের নতুন অভিজ্ঞতার নেতৃত্বধারাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ ও সমবেত হওয়ার লক্ষ্যে সৎ জনপ্রিয় গণ-প্লাটফর্ম গঠনের সত্যিকার যোগ্যতাসম্পন্ন একটি সৎ প্রজন্মেরও উদ্ভব ঘটিয়েছিল । এ কারণেই আমরা প্রত্যক্ষ করি যে,যতদিন মহানবী (সা.)-এর কর্তৃত্বে সুপথপ্রাপ্ত নেতৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল ততদিন পর্যন্ত এই প্রজন্মটি সৎ জনপ্রিয় গণপ্লাটফর্ম হিসেবে নিজ দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেছে । আর এই সুপথপ্রাপ্ত নেতৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থার যদি মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর ঐশী পথ পরিক্রমণ করা সম্ভব হত তাহলে উক্ত জনপ্রিয় গণ-প্লাটফর্মটি তার সঠিক ভূমিকা পালন করে যেত । তবে এ কথার অর্থ কস্মিনকালেও এটা হতে পারে না যে,উক্ত গণ-প্লাটফর্মটি কার্যতঃ এ নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ এবং স্বয়ং নিজেই এ নতুন নবুওয়াতী প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ছিল উপযুক্ত ও প্রস্তুত । কারণ এ ধরণের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন রিসালত বা নবুওয়াতী মিশনের সাথে আত্মিক ও ঈমানীভাবে একীভূত হওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের সংবদ্ধতা ও সংযুক্তি । আর সেই সাথে প্রয়োজন রিসালতের সমুদয় বিধি-বিধান,ধ্যান-ধারণা এবং মানবজীবন সংক্রান্ত রিসালতের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত ব্যাপক-পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান এবং মুনাফিক,অনুপবেশকারী শত্রু এবং মুআল্লাফাতুল কুলবদের থেকে রিসালতী প্রচার কার্যক্রমের সকল স্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিশুদ্ধি । আর এসব গোষ্ঠী (মুনাফিক,অনুপবেশকারী শত্রু এবং মুআল্লাফাতুল কুলব) উক্ত প্রজন্মের একটা অংশ হিসেবে তখনও বিদ্যমান ছিল যাদের ছিল সংখ্যাগত গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক অবস্থান ও ভূমিকা ।

তারা প্রচুর নেতিবাচক প্রভাব-প্রতিক্রিয়ারও অধিকারী ছিল । কারণ,পবিত্র কোরানে মুনাফিক গোষ্ঠী এবং তাদের চক্রান্ত ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত প্রচুর আয়াত রয়েছে ।৪১ উক্ত প্রজন্মের মাঝে হযরত সালমান,হযরত আবুযার,এবং হযরত আম্মার (রা.)-এর মত এমন লোকজনও বিদ্যমান ছিলেন যাঁদেরকে মহানবী (সা.) নবুওয়াতী কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার আলোকে অতি উন্নত নবুওয়াতী দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন করে গঠন করেছিলেন এবং তাঁদেরকে রিসালতী বা নবুওয়াতী মিশনের আদর্শের সাথে পরিপূর্ণরূপে একাকার করে দিয়েছিলেন ।

আমি বলতে চাই যে,ঐ মহান প্রজন্মের মাঝে (আম্মার,সালমান,আবুযার প্রমুখ ব্যক্তিদের মত) এসব ব্যক্তিদের অস্তিত্ব থেকে প্রমাণিত হয় না যে,সম্পূর্ণ প্রজন্মটি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল বলেই শূরা ভিত্তিক ব্যবস্থার আলোকে রিসালতী কার্যক্রমের গুরুদায়িত্বভার তাদের (উক্ত প্রজন্মের) উপরই ন্যস্ত করা হয়েছিল । এমনকি এসব ব্যক্তি যাঁরা উক্ত প্রজন্মের মাঝে রিসালতী মিশনের অতি উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন তাঁদের তীব্র নিষ্ঠা এবং ইসলামের প্রতি গভীর আবেগ-অনুরাগ এবং ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও চিন্তামূলক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবুওয়াতী প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্বদানের যোগ্যতা তাঁদের ছিল না । এর কারণ ইসলাম কোন মানবরচিত তত্ত্ব নয় যা অনুশীলন ও প্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব এবং এর যাবতীয় ধ্যান-ধারণা নিখাদ অভিজ্ঞতার আলোকে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে । ইসলাম হচ্ছে মহান আল্লাহর রিসালত যার সমূদয় বিধি-বিধান এবং ধ্যান-ধারণা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত ও নির্ধারিত হয়েছে । রিসালতী কর্মকান্ড ও কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সমূদয় সাধারণ অনুশাসন ও নীতিমালা সহকারে আধ্যাত্মিকভাবে এ ধর্মটিকে সজ্জিত ও উপস্থাপিত করা হয়েছে । অতএব,ইসলামের যাবতীয় সীমা-পরিসীমা খুঁটি-নাটি বিষয় এ ধর্মের রিসালতী ও নবুওয়াতী কার্যক্রমের নেতৃত্বকে আবশ্যিকভাবে নখদর্পণে রাখতে হবে । আর এমনটি যদি না হয় তাহলে উক্ত নেতৃত্বকে আবশ্যিকভাবে ও বাধ্য হয়েই তখন জাহেলী চিন্তাধারা এবং গোত্রীয় ধ্যান-ধারণা,প্রীতি এবং সমর্থনের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হতে হবে এবং এ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে । আর এভাবে রিসালতী ও নবুওয়াতী কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার ধারায় ফাটল ধরবে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে । বিশেষ করে যেখানে ইসলাম হচ্ছে সর্বশেষ আসমানী রিসালত যা সর্বযুগে টিকে থাকবে এবং সকল প্রকার সময়ভিত্তিক,আঞ্চলিক এবং জাতিগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করবে । আর যেহেতু সর্বকালে এ ধর্মের টিকে থাকার মূলভিত্তিকে একমাত্র এর নেতৃত্ব ধারাই সৃষ্টি করে থাকে তাই তা (ইসলামের নেতৃত্বধারা) কখনো কখনো ভুল করবে আবার কখনো কখনো নির্ভুল ও সঠিক হবে- এধরনের ভ্রান্তি ও নির্ভুলতার অভিজ্ঞতার ক্রীড়নকে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা যা কখনো ভুলও হতে পারে আবার ঠিকও হতে পারে তাতে ভুলের পর ভুল স্তূপিকৃত হতে থাকবে এবং কিছুকাল এভাবে চলতে থাকলে এমন এক ভয়াবহ ফাটল বা রন্ধ্রের সৃষ্টি হবে যা রিসালতী কার্যক্রমের অভিজ্ঞতাকে ধ্বংস ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবে ।

যা আলোচনা করা হল তা থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,মহানবী (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে সর্বসাধারণ পর্যায়ে যে সচেতনতাবোধের অনুশীলন ও চর্চা করেছিলেন তা রিসালতী ও নবুওয়াতী প্রচার কার্যক্রম এবং সংস্কার-প্রক্রিয়ার ভবিষ্যতের আদর্শিক,চিন্তামূলক এবং রাজনৈতিক সচেতন নেতৃত্বধারা তৈরি করার জন্য যে মাত্রায় থাকা প্রয়োজন ঠিক সে মাত্রায় বিদ্যমান ছিল না । বরং তা ছিল যে মাত্রায় নবুওয়াতী প্রচার কার্যক্রমের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ ও সমবেত সচেতন গণ-প্লাটফর্ম সৃষ্টি করা যায় ঠিক সেই মাত্রার সচেতনতাবোধ ।

অতএব,মহানবী (সা.) তাঁর ওফাতের পর ইসলামী রিসালতী প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের দায়-দায়িত্ব সরাসরি আনসার ও মুহাজির প্রজন্মের হাতে অর্পণ করার রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন বলে যে ধারণা পোষণ করা হয় তা থেকে সবকিছুর অগোচরে সংস্কার কার্যক্রমের ইতিহাসে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মিশনারী নেতা অভিযুক্ত হয়ে যান যে, তিনি প্রচার কার্যক্রমের জননন্দিত প্লাটফর্ম পর্যায়ের কাঙ্খিত সচেতনতাবোধ এবং প্রচার কার্যক্রমের আদর্শিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব-পর্যায়ের কাঙ্খিত সচেতনতাবোধের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম ।

৩-উম্মাহ্ তখনও জাহেলী রীতি - নীতি হতে মুক্ত হয়নি : প্রচার কার্যক্রমই হচ্ছে সংস্কার প্রক্রিয়া এবং মানব জীবনের নয়া পদ্ধতি । আর এটা হচ্ছে একটি উম্মাহকে নতুন করে গড়ে তোলা এবং এর জীবন থেকে জাহেলীয়াতের সকল শিকড় এবং খাদ ও তলানী পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করার দৃঢ় সংকল্পস্বরূপ । সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ বড় জোর এক যুগ মহানবীর এ সংস্কার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছে । স্বাভাবিকভাবে আদর্শিক রিসালতী যৌক্তিকতার আলোকে এ সংক্ষিপ্ত সময়কাল যথেষ্ট নয় । অর্থাৎ এ সময়কাল যে প্রজন্মটি প্রচার কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানে মাত্র দশ বছর অতিবাহিত করেছে সেই প্রজন্মটির সচেতনতা,বস্তুনিষ্ঠতা অতীতের সকল জাহেলী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি এবং নতুন প্রচার কার্যক্রমের অবদানসমূহ পূর্ণরূপে আয়ত্ত করার পর্যায়ে উপনীত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় যা ঐ প্রজন্মটিকে রিসালতের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্ব এবং প্রচার কার্যক্রমের সমূদয় দায়-দায়িত্ব গ্রহণ এবং নেতা ছাড়াই সংস্কার প্রক্রিয়াকে চালিয়ে নেয়ার জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলবে । বরং আদর্শিক রিসালতী যৌক্তিকতা ও দর্শন থেকে অবধারিত হয়ে যায় যে,উক্ত কাঙ্খিত অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধায়কের পর্যায়ে উত্তরণের জন্য উম্মাহকে বেশ সুদীর্ঘ সময়কাল আদর্শিক তত্ত্বাবধায়কের তত্ত্বাবধানে চলতে হবে ।

আর এটা এমন কোন ব্যাপার নয় যা কেবলমাত্র আমরাই গবেষণা করে বের করেছি । বরং এটা এমন এক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে যা মহানবী (সা.)-এর ওফাতোত্তর ঘটনা-প্রবাহ থেকেও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় । আর এ নিগুঢ় বাস্তবতা অর্ধশতাব্দী বা তার চেয়েও অল্প সময়ের মধ্যে আনসার-মুহাজির প্রজন্ম কর্তৃক ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ ও পরিচালনা করার মাধ্যমে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠে । কারণ এ তত্ত্বাবধান কার্যক্রমের বয়সকাল ২৫ বছর গত হতে না হতেই খেলাফতে রাশেদাহ্ (সুপথ প্রাপ্ত খিলাফত) এবং ইসলামী দাওয়াত বা প্রচার কার্যক্রম যার নেতৃত্ব এবং পরিচালনার ভার আনসার-মুহাজির প্রজন্ম গ্রহণ করেছিল তা ইসলামের আদি শত্রুদের তীব্র আক্রমণ ও আঘাতের মুখে ভেঙ্গে পড়ে । তবে এটা ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের অবকাঠামোর ভিতর থেকেই হয়েছিল,বাইরে থেকে নয়। কারণ ইসলামের আদি শত্রুরা ধীরে ধীরে ইসলাম প্রচার কার্যক্রমের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রভাব-কেন্দ্রসমূহে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং অসচেতন নেতৃত্ব থেকে ফায়দা হাসিল ও স্বার্থোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল । তারপর তারা ঐ নেতৃত্বকেই চরম নির্লজ্জতার সাথে এবং কঠোরভাবে জবরদখল করে অগ্রগামী বরেণ্য প্রজন্মসহ মুসলিম উম্মাহকে নিজ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের আসন থেকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। আর এরই ফলশ্রুতিতে,ইসলামী দাওয়াত বা প্রচার কার্যক্রমের নেতৃত্বধারা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল । আর এ রাজতন্ত্র মুমিন-মুসলমানদের মান-মর্যাদা হানি করতে মোটেও দ্বিধাবোধ করত না,পূণ্যাত্মাদেরকে ঠান্ডামাথায় হত্যা করত,জনসাধারণের ধনসম্পদ লুন্ঠন করত,শরীয়তের দন্ডবিধি প্রয়োগ করত না এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান বন্ধ করে দিয়েছিল এবং জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলত । তখন ফাই (যেসব ভূমি যুদ্ধ ছাড়াই চুক্তির ভিত্তিতে রসুলের হস্তগত হয়) এবং সওয়াদ (গ্রাম-গ্রামাঞ্চল) কোরাইশদের উদ্যানে পরিণত হয়েছিল । খেলাফত ও উমাইয়া বংশীয় অর্বাচীন তরুণ ও যুবকদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল।৪২

অতএব,মহানবীর ওফাতোত্তর অভিজ্ঞতা এবং ২৫ বছর পরে লব্ধ ফলাফলসমূহ থেকে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তেরই সমর্থন পাওয়া যায় । যা থেকে সবিশেষ গুরুত্বের সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরই আনসার-মুহাজির প্রজন্মের হাতে সরাসরি আদর্শিক ও রাজনৈতিক নেতৃতার্পণ আসলেই হবে এক অপরিপক্ক ও অদূরদর্শী এবং সঠিক সময়ের আগেই নেয়া পদক্ষেপ । আর এ কারণেই মহানবী (সা.) যে এ ধরনের অপরিপক্ক ও কাঁচা কাজ করতে পারেন তা পুরোপুরি অযৌক্তিক এবং অমূলক ।