আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 14824
ডাউনলোড: 3101

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14824 / ডাউনলোড: 3101
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

১৫তম পাঠ

নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি

ভূমিকা :

ইসলামের সার্বজনীনতার ভিত্তিতে এর রহিতকারী কোন নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়। কিন্তু এ ভ্রান্ত ধারণার অবকাশ থাকে যে,অন্য এক নবী ইসলামের প্রচারক রূপে আবির্ভূত হবেন। যেমন : পূর্ববর্তী অনেক নবীই এ ধরনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর নবী শরীয়তের অধিকারী পয়গাম্বরগণের সমসায়িক ছিলেন। যেমন : হযরত লুত (আ.),হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সমসাময়িক এবং তার শরীয়তের অনুসারী ছিলেন। আবার অন্য এক শ্রেণীর নবী ছিলেন,যারা শরীয়তের অধিকারী নবীগণের পরে আবির্ভূত হয়ে পূর্ববর্তী নবীর শয়ীয়তের অনুসরণ করেছিলেন। যেমন : বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ নবী-ই এ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের নবী (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির বিষয়টিকে স্বতন্ত্ররূপে আলোচনা করব,যাতে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণার কোন অবকাশ না থাকে ।

নবুয়্যতের ধারার পরিসমাপ্তির স্বপক্ষে কোরানের দলিল :

ইসলামের পরম বিশ্বাসসমূহের মধ্যে একটি হল এই যে,নবুয়্যতের ধারা ইসলামের নবী (সা.)- এর সাথে যবনিকারেখা টেনেছে এবং তার পরে আর কোন নবী অসেননি বা আসবেও না। এমন কি বিধর্মীরাও জানে যে,এ বিষয়টি ইসলামের বিশ্বাসসমূহের অন্তর্গত এবং সংগত কারণেই প্রত্যেক মুসলমানকে এরূপ বিশ্বাস রাখতে হবে। দ্বীনের অন্যান্য অপরিহার্য বিশ্বাসসমূহের মতই এর কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। তদুপরি এ বিষয়টিকে একদিকে যেমন পবিত্র কোরানের মাধ্যমে প্রমাণ করা যায়,অপরদিকে তেমনি বহুল প্রচারিত বা মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমেও প্রমাণ করা যায়। পবিত্র কোরানে সূস্পষ্ট ভাষায় হযরত (সা.) কে সর্বশেষ নবীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

) مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ(

মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। (আহযাব -৪০)

ইসলামের শত্রুদের মধ্যে কেউ কেউ মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রে এ আয়াতের দলিলত্ব সম্পর্কে দু টি সমস্যার উল্লেখ করে থাকে : একটি হল خاتم (খাতাম) শব্দটি আংটি অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে এবং সম্ভবতঃ এ আয়াতটিতেও এ অর্থেই (আংটি) স্থান পেয়েছে। অপরটি হল  خاتم (খাতাম) সে সর্বজনস্বীকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে মনে করলে আয়াতের ভাবার্থ এই যে,(কেবলমাত্র) নবীগণের ধারাই হযরত (সা.) এর মাধ্যমে পরিসমাপ্ত হয়েছে -রাসূলগণের ধারা নয়।

যা হোক প্রথম সমস্যাটির জবাব এই যে,خاتم (খাতাম ) অর্থ সমাপ্ত করার মাধ্যমمایختم به الشیئ অর্থাৎ যার মাধ্যমে কোন কিছু সমাপ্ত করা হয় এবং আংটিও এ অর্থেই আংটি নামকরণ হয়েছে। কারণ (পূর্বে) পত্র এবং পত্রজাতীয় বিষয়সমূহের যবনিকা টানা হত আংটির মাধ্যমে মোহরাংকিত করে।

দ্বিতীয় সমস্যাটির জবাব এরূপ : সকল রিসালাতের অধিকারী পয়গাম্বরই নবুয়্যতের মর্যাদায়ও অভিষিক্ত এবং নবীগণের ধারার পরিসমাপ্তির মাধ্যমে রাসূলগণের ধারারও পরিসমাপ্তি ঘটে। যেমনটি ইতিপূর্বেও বলা হয়েছে১১৩ যে,নবী (نبی ) অভিধাটি রাসূল (رسول ) অভিধাটির চেয়ে ব্যাপক না হলে ও বিষয় বিশেষে নবী (نبی ) পরিভাষার বিস্তৃতি রাসূল (رسول ) পরিভাষাটির চেয়ে বিস্তৃততর।

নবুয়্যাতের ধারার পরিসমাপ্তির স্বপক্ষে হাদীসের দলিলাদি :

ইসলামের নবী (সা.) এর মাধ্যমে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির স্বপক্ষে শতশত হাদীস সুস্পষ্ট ও গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল হাদীসে মানযিলাত এ হাদীসটি শিয়া এবং সুন্নী উভয় উৎস থেকেই বহুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এ হাদীসটির বিষয়বস্তু তে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। নিম্নে হাদীসে মানযিলাতটি বর্ণিত হল :

যখন ইসলামের নবী (সা.) মদীনা থেকে তাবুকের যুদ্ধে যাত্রা করলেন তখন আমীরুল মু মিনিন আলীকে (আ.) মুসলমানদের দায়িত্ব প্রদান করে স্বীয় স্থানে নিয়োগ দিয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) এ জিহাদে অংশ গ্রহণের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবেন বলে কিছুটা দুঃখিত হলেন এবং তার আঁখিযুগল থেকে পবিত্র অশ্রুরাশি গড়িয়ে পড়ল । ফলে মহানবী (সা.) তাকে বললেন :

اما ترضی ان تکون بمنزلة هارون من موسی الا انّه لا نبی بعدی

তুমি কি এতে তুষ্ট নও যে,তোমার সাথে আমার সে সম্পর্ক হোক,যে সম্পর্ক ছিল হারুনের সাথে মুসার ? কোন প্রকার বিরতি না দিয়েই বললেন : তবে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে,আমার পরে আর কোন নবী আসবে না।

ফলে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ থাকে না। অপর একটি হাদীসটিতে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে

ایها الناس انّه لا نبی بعدی و لا امّة بعدکم

হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমার পরে কোন নবী আসবে না এবং তোমাদের পরে কোন উম্মতও আসবে না।১১৪

অনুরূপ অপর একটি হাদীসে হযরত (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :

ایّها الناس انّه لا نبیّ بعدی و لا سنّة بعد سنّتی

হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমার পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না এবং আমার সুন্নতের পর আর কোন সুন্নত নেই ।১১৫

এছাড়া, নাহজুল বালাগাহর বেশ কয়েকটি খুতবায়১১৬ এবং পবিত্র ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত,দোয়াসমূহ ও যিয়ারতেও এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে,যেগুলোর উদ্ধৃতি দিলে আলোচনার কলেবর বৃদ্ধি পাবে।

নবুয়্যতের ধারার পরিসমাপ্তির প্রকৃত রহস্য :

ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম১১৭ যে,নবীগণের একাধিক্য ও পূর্ববর্তী সময়ে পরম্পরায় আবির্ভাবের যথাযথ কারণ হল : একদিকে পৃথিবীর সর্বত্র ও সকল জনসমষ্টির নিকট ঐশী রিসালাতের প্রচার,এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না। অপরদিকে নবীন সমাজের উদ্ভব,সম্পর্কের জটিলতা ও বিস্তৃতি,নতুন নিয়মের উদ্ভব অথবা পূর্ববর্তী নিয়মের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। অপরপকক্ষে কালের আবর্তে অথবা অজ্ঞতা ও ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির স্বার্থ রক্ষার্থে যে বিকৃতি ও বিচ্যুতি সাধিত হয়েছে,তাতে অন্য এক নবী প্রেরণের মাধ্যমে ঐশী শিক্ষার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করণের প্রয়োজনীয়তা।

অতএব যদি পৃথিবীর সর্বত্র ঐশী রিসালাতের প্রচার একজন নবী এবং তার সহচর ও উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে সম্ভব হয় অথবা এক শরীয়তের আহকাম ও কানুন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মানব সমাজের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হয় কিংবা উক্ত শরীয়তে নতুন কোন সমস্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান থাকে,তদনুরূপ কোন প্রকার বিকৃতি থেকে উক্ত শরীয়তের সংরক্ষিত থাকা ও অবিস্মৃত থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় তবে অন্য কোন নবীর আবির্ভাবের কোন কারণ থাকবে না।

তবে মানুষের সাধারণ জ্ঞান এ ধরনের শর্তসমূহকে চিহ্নিত করতে অপারগ এবং একমাত্র মহান আল্লাহই স্বীয় অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে এ শর্তসমূহের বাস্তবায়ন কাল সম্পর্কে অবহিত আছেন। তিনিই পারেন নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির ঘোষণা দিতে। আর এ কর্মটিই তিনি সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থে সম্পাদন করেছেন।

কিন্তু নবুয়্যতের ধারার পরিসমাপ্তি মানে আল্লাহর সাথে তার বান্দাগণের হিদায়াতের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া নয়। বরং যখনই মহান আল্লাহ প্রয়োজন মনে করবেন তার যোগ্য বান্দাগণকে অদৃশ্যের জ্ঞান প্রদান করতে পারবেন -যদিও তা নবুয়্যতের ওহী না হয় । যেমন : শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে,এ ধরনের জ্ঞান মহান আল্লাহ পবিত্র ইমামগণকে (আ.) দান করেছেন। মহান আল্লাহর কৃপায় পরবর্তী পাঠসমূহে ইমামত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির আলোচনায় মনোনিবেশ করব।

একটি ভ্রান্ত ধারণার জবাব :

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমারা অবগত হয়েছি যে,নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির গুঢ় রহস্য হল : প্রথমতঃ ইসলামের মহানবী (সা.) তার সহচর ও উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে স্বীয় রিসালাতের আহ্বান সমগ্র বিশ্ববাসীর কর্ণে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ সকল প্রকার বিকৃতি থেকে তাকে প্রদত্ত ঐশী গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে এবং তৃতীয়তঃ ইসলামের শরীয়ত এ জগতের শেষাবধি মানুষের সকল প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম।

কিন্তু কেউ হয়ত শেষোক্ত বিষয়টি সম্পর্কে এরূপে সমস্যা উত্থাপন করতে পারেন যে,যেমনিকরে পূর্ববর্তী সময়গুলোতে সামাজিক সম্পর্কের জটিলতার কারণে নতুন আহকাম প্রণয়নের ও পূর্ববর্তী আহকামের পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল,যার ফলশ্রুতিতে অন্য এক নবীর আবির্ভাব ঘটেছিল,ঠিক তেমনি ইসলামের নবী (সা.) এর পরও সামাজিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে ও সামাজিক সম্পর্ক আরও জটিলতর হয়েছে। সুতরাং আমরা কোথা থেকে নিশ্চিত হব যে,এ ধরনের পরিবর্তন নতুন কোন শরীয়তের দাবি করেনি ?

জবাব : যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে যে,কিরূপ পরিবর্তন মূল নিয়মের পরিবর্তনের আবেদন করে,তা চিহ্নিত করা সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বহির্ভূত কর্ম। কারণ আহকাম ও নিয়মের দর্শনের উপর আমাদের পূর্ণ জ্ঞান নেই। বরং ইসলামের চিরন্তনতা ও মহানবী (সা.) এর খাতামিয়্যাতের দলিল থেকে উদঘাটন করতে পারি যে,ইসলামের মূল নিয়মের পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই।

তবে আমরা সামাজিক কোন কোন নতুন বিষয়ের প্রেক্ষাপটে নতুন কোন শর্তের আবেদন থাকতে পারে তা অস্বীকার করি না। কিন্তু ইসলামের শরীয়তে এ ধরনের আংশিক নিয়ম প্রণয়নের জন্যে মূলনীতি ও পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে যাতে উপযুক্ত ব্যক্তিগণ ঐ মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নিয়ম প্রণয়ন করতঃ তা সমাজে প্রচলন করতে পারেন। এ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্যে ইসলামী ফিকাহশাস্ত্রে বর্ণিত ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অধিকার (পবিত্র ইমাম ও ওয়ালীয়ে ফকীহ্ ) নামক আলোচ্য বিষয়ে অনুসন্ধান করতে হবে।

১৬তম পাঠ

ইমামত

ভূমিকা :

মহানবী (সা.) এর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর এ শহরের জনগণের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ( যার ফলে সম্মানার্থে আনসার নামে ভূষিত হয়েছিলন) এবং মক্কা থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের (মুহাজির) নিয়ে একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর মাসজিদুন্নাবী একদিকে যেমন উপসনালয় ও ঐশী রিসালাতের প্রচার,প্রশিক্ষণ ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার কেন্দ্র ছিল। অপরদিকে তেমনি মুহাজির ও সমাজের বঞ্চিত,নিগৃহীত মানুষের আশ্রয়স্থলও ছিল। এ মসজিদেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও জীবিকা নির্বাহের কর্মসূচী নেয়া হত। এখানেই বিচার-বিবাদের মীমাংসা এবং সামরিক সিদ্ধান্ত,যুদ্ধের জন্যে সৈন্য প্রেরণ,যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। মোটকথা মানুষের ধর্মীয় ও পার্থিব সকল বিষয় মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমেই পরিচালিত হত। মুসলমনরাও হযরত (সা.)-এর আদেশের আজ্ঞাবহ হওয়াটা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ মহান আল্লাহ রাজনৈতিক বিচার ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে হযরত (সা.)-এর নিঃশর্ত আনুগত্য করার আদেশ প্রদান১১৮ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহেও তার আজ্ঞাবহ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।১১৯

অন্য কথায় : মহানবী (সা.) নবুয়্যত,রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান,তেমনিকরে ইসলামের নবী (সা.) প্রচার,প্রশিক্ষণ ও (আধ্যত্মিক) পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহর নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এটা অনস্বীকার্য যে,যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়,সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে,যা ইমামত নামে অভিষিক্ত,তাও হতে পারে না।

কিন্তু কথা হল মহানবী (সা.) এর তিরোধানের পর,কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন ? এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন ? মহান আল্লাহ এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে (সা.) দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি ? নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে,তা-ও বিধিসম্মত ? মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে ? না নেই ?

আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা,যা মহান আল্লাহ কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ,মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু মিনিন আলীকে (আ.) তার উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তারই সন্তানদের মধ্য থেকে পরম্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে,ইমামত নবী (সা.)-এর তিরোধানের সাথে সাথে নবুয়্যত ও রিসালাতের মতই যবনিকায় পৌছেছে এবং এর পর থেকে ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব মানুষের উপর অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে,যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়,তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১২০ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী,অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!

প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সম্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস,এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই,যেগুলো মহানবী (সা.) এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।

অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।১২১ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।

উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে,যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন,সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে,অনুসন্ধান ও গবেষনার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে,এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।

ইমামতের তাৎপর্য :

ইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা,পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম (امام ) বলা হয়ে থাকে -হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন : পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে (ائمة الکفر ) অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা (সূরা তওবাহ-১২) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন,তাকে ইমামুল জামা নামকরণ করা হয়।

কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।

শিয়া সম্প্রদায়ের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে,যখন তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে (সহকারী হিসেবে নয়) যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন,তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম,একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে (সা.),মহান আল্লাহ প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তার বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য,তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তার আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।

এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় :

প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

তৃতীয়ত : ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে ।

তবে মা সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও (সালামুল্লাহ আলাইহা) মা সুম ছিলেন,যদিও তিনি ইমামতের আধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম (আ.) ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহর ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন,যদিও আমরা তাদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাদেরকে চিনা সম্ভব নয়।