আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 14827
ডাউনলোড: 3102

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14827 / ডাউনলোড: 3102
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

নবীগণের ( আ.) প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া :

যখন আল্লাহর নবীগণ (আ.) জনগণকে এক আল্লাহর উপাসনা করতে৪২ ও তার আদেশের আজ্ঞাবহ হতে,মূর্তি ও মিথ্যা উপাস্যগুলোকে বর্জন করতে,শয়তান ও স্বেচ্ছাচারীদের নিকট থেকে দূরে থাকতে,অন্যায়,অত্যাচার,পাপাচার ও কদর্যপূর্ণ কর্ম থেকে বিরত হতে মানুষকে আহবানে উদ্যোগী হতেন,তখন সাধারণতঃ জনগণের বিরোধীতা ও তিরস্কারের সম্মুখীন হতেন।৪৩ বিশেষ করে সমাজের ধনিক শ্রেনী ও সমাজপাতি,যারা আরাম-আয়েশে নিমগ্ন থাকত৪৪ এবং স্বীয় ধন-সম্পদ,মর্যাদা ও বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে অহংকার করত,৪৫ তারা নবীগণের (আ.) বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হত। তারা অন্যান্য শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষকেও নিজেদের দিকে আকর্ষণ করত এবং সত্য পথের অনুসরণ থেকে তাদেরকে বিরত রাখত।৪৬ তবে ক্ষুদ্র কিছু জনসমষ্টি যারা সাধারণতঃ সমাজের বঞ্চিত শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত,তারাই ক্রমাগত নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতেন।৪৭ খুব কম ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটত যে,সঠিক বিশ্বাস ন্যায়-নীতি ও মহান আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে একটি সমাজ রূপ লাভ করেছে। উদাহরণতঃ যেমনটি হযরত সোলায়মানের (আ.) সময় ঘটেছিল।

যা হোক নবীগণের (আ.) শিক্ষার কোন কোন অংশ ক্রমান্বয়ে সমাজের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করত এবং এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে বিস্তৃতিলাভ করত ও অনুসৃত হত। আবার কখনো কখনো কাফের সমাজপতিদের কৃতিত্বের বিষয় রূপে উপস্থাপিত হত। যেমন : বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয় যে,ঐশী গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেন অথচ এর উৎসের নাম উচ্চারণে বিরত থাকেন ও নিজেদের চিন্তা ও চেতনা রূপে সমাজে উপস্থাপন করেন।

নবীগণের (আ.) বিরোধিতা করার কারণ ও প্রবণতা :

নবীগণের (আ.) বিরোধিতা করার সামগ্রিক কারণ,কুপ্রবৃত্তি ও উচ্ছৃংখল প্রবণতা ব্যতীত অন্যান্য কারণও ছিল৪৮ যেমন : স্বেচ্ছাচারিতা,দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতা যা ধনিক,বণিক ও উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে পরিলক্ষিত হত।৪৯ এ ছাড়া পূর্ব পুরুষদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন রীতি-নীতির ও ভ্রান্ত মূল্যবোধের গোড়ামী নবীগণের (আ.) প্রতিকূল সমাজে প্রচলিত ছিল ।৫০ অনুরূপ অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সামাজিক অবস্থান অটুট রাখা ছিল ধনিক,শাসক ও বুদ্ধিজীবী কর্তৃক,নবীগণেরে (আ.) প্রতিকূলে অবস্থান নেয়ার অপর একটি শক্তিশালী কারণ।৫১ অপরদিকে সাধারণ জনসমষ্টির অজ্ঞতা ও মূর্খতা ছিল কাফের নেতৃবর্গ কর্তৃক প্রতারিত হওয়ার এবং পূর্বপুরুষ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের পথ অনুসরণের এক বৃহৎ কারণ। আর এ জন্যে তারা নিজেদের অনুমান ও কল্পনার উপরই আত্মতুষ্টি লাভ করত এবং সে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন থেকে বিরত থাকত,যে ধর্ম সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোক,যারা সামাজিক মর্যাদায় ছিলেন বঞ্চিত ও উচ্চ শ্রেণী ও সংখ্যাগুরু কর্তৃক প্রত্যাখিত,তারা ব্যতীত কেউ গ্রহণ করেননি। তেমনি সমাজের এ সংখ্যালঘু বঞ্চিত শ্রেণীর উপর শাসকশ্রেণী ও স্বেচ্ছাচারিদের নিস্পেষণের কথাও অগ্রাহ্য করার মত নয়।৫২

নবীগণের ( আ.) সাথে বিরোধিতা করার পদ্ধতিসমূহ :

নবীগণের (আ.) প্রতিপক্ষরা তাদের প্রচার কার্যের সম্প্রসারণে বাঁধা প্রদানের জন্যে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল :

ক) অবজ্ঞা ও বিদ্রুপঃ প্রথমে একদল,আল্লাহর বার্তাবাহকগণকে অবজ্ঞা ও বিদ্রুপ করার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বহানী করতে চেয়েছিল,৫৩ যাতে সাধারণ জনগণ তাদেরকে কোন গুরুত্ব প্রদান না করে।

খ) অপবাদ ও কুৎসা রটনা : অতঃপর তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার,অপবাদ দান ও কুৎসা রটনা করত। যেমন : তাদেরকে নির্বোধ মস্তিষ্কবিকৃত বলত৫৪ এবং যখন মু জিযাহ প্রদর্শন করতেন তখন তাদেরকে জাদুমন্ত্রের অপবাদ দিত।৫৫ তদনুরুপ আল্লাহর বাণীসমূহকে রূপকথা বা পৌরাণিক কাহিনীসমূহ বলে নামকরণ করত।৫৬

গ) ভ্রমাত্মক যুক্তি প্রদর্শন ও অহেতুক তর্ক : যখন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ প্রজ্ঞাপূর্ণ যুক্তি সহকারে বক্তব্য রাখতেন অথবা সূন্দর বাগ্মিতা সহকারে বিতর্ক ও কথোপকথন করতেন কিংবা জনগণকে উপদেশ দিতেন এবং অবাধ্যতা,অংশীবাদ ও অত্যাচারের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে দিতেন,তদনুরূপ আল্লাহর আনুগত্য করার লাভজনক ও শুভপরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেন এবং বিশ্বাসী ও সৎকর্মকারিদেরকে ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণের সুসংবাদ প্রদান করতেন তখন কাফের গোত্রপতিরা জনগণকে তাদের বক্তব্য শ্রবণ করতে নিষেধ করত। অতঃপর তারা দুর্বল ও বোকামিপূর্ণ যুক্তির মাধ্যমে তাদেরকে জবাব দিত এবং চেষ্টা করত সাজানো বক্তব্যের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে প্রতারণা করতে৫৭ ও নবীগণের (আ.) অনুসরণ থেকে তাদেরকে বিরত রাখতে। আর এ কর্মে তারা সাধারণতঃ পূর্বপুরুষদের রীতি-নীতি অনুসরণ করত৫৮ এবং নিজেদের ধন-সম্পদ ও সম্মৃদ্ধিকে সাধারণ মানুষের সম্মুখে উপস্থাপন করত। অপরদিকে নবীগণের (আ.) অনুসারীগণের বৈষয়িক অস্বচ্ছলতা ও পশ্চাৎপদতাকে তাদের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের অসারতারূপে প্রতিপাদন করার চেষ্টা করত।৫৯ তারা বিভিন্ন অজুহাত,নিজেদের বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : কেন মহান আল্লাহ রাসূল ও প্রেরিত পুরুষগণকে ফেরেস্তাগণের মধ্য থেকে নির্বাচন করেননি ? অথবা কেন কোন ফেরেস্তাকে তাদের সাথে প্রেরণ করেনি? কিংবা কেন তাদেরকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক সম্মৃদ্ধি প্রদান করেননি ?৬০ আবার কদাপি এ বাড়াবাড়ির মাত্রাটা এমন স্থানে পৌছত যে,বলত : আমরা একমাত্র তখনই ঈমান আনব যখন স্বয়ং আমাদের নিকট ওহী আসবে অথবা আল্লাহকে দেখতে পাব ও তার কথা প্রত্যক্ষভাবে শুনতে পাব।৬১

ঘ) ভীতি প্রদর্শন ও প্রলুব্ধকরণ : অপর যে পদ্ধতিটি পবিত্র কোরানে বিভিন্ন উম্মতের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে তা হল,আল্লাহর নবীগণ ও তাদের অনুসারীগণকে বিভিন্ন প্রকারের অত্যাচার,দেশ ও শহর থেকে বহিষ্কার,পাথর নিক্ষেপ ও হত্যার ভয়-ভীতি প্রদর্শন।৬২ অপরদিকে প্রলোভনের সকল মাধ্যমও তারা (পথভ্রষ্টরা) ব্যবহার করত এবং বিশেষ করে অজস্র সম্পদ ব্যয় করে জনগণকে নবীগণের (আ.) অনুসরণ থেকে বিরত রাখত।৬৩

ঙ) সহিংসতা ও হত্যা : অবশেষে নবী (আ.) গণের ধৈর্য,স্থৈর্য,দৃঢ়তা ও অবিচলতা৬৪ এবং অপপ্রচার ও ভীতি প্রদর্শনের সকল হাতিয়ারের কার্যকর ব্যবহার সত্ত্বেও সত্যবাদী নবীগণের সৎ অনুসারীগণের অদম্য প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার পর্যবেক্ষণে নিরাশ হয়ে (মিথ্যাবাদীরা )সহিংসতার পথ বেছে নিত। যেমন : তারা অনেক নবীকেই হত্যা করেছিল।৬৫ আর মানব সমাজকে প্রভু কর্তৃক প্রদত্ত উৎকৃষ্টতম বৈভব ও অনুগ্রহ এবং সমাজের যোগ্যতম সংস্কারক ও পথপ্রদর্শকগণের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছিল ।

সামাজিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আল্লাহর কতিপয় রীতি- পদ্ধতি:

নবীগণের (আ.) নবুয়্যত লাভের পশ্চাতে প্রকৃত উদ্দেশ্য হল এই যে,মানবসম্প্রদায় ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য সম্পর্কে অবগত হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ওহীর মাধ্যমে কাঁটিয়ে উঠবে অর্থাৎ তাদের প্রতি দলিল ও যুক্তি প্রদর্শন চূড়ান্ত করা।৬৬ তবে মহান আল্লাহ স্বীয় রহমতের প্রতিফলন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ তত্বাবধানের মাধ্যমে নবীগণের আহবানে সারা দেয়ার জন্যে জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতেন,যা মানুষের উৎকর্ষ প্রাপ্তির পথে সহায়ক হয়েছিল। যেহেতু সৃষ্টির সকল অপরিহার্য জ্ঞাতব্যের প্রতি উদাসীনতা ও অভাবমুক্ত হওয়ার উপলব্ধি৬৭ ছিল খোদাকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার মূল কারণ,সেহেতু প্রজ্ঞাবান প্রভু এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেন,যাতে নিজের অভাবের প্রতি মনোযোগ দেয়ার ক্ষেত্র,মানব সম্প্রদায়ের জন্যে প্রস্তুত হয় এবং উদাসীনতা,দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতার অবসান ঘটে। আর এ জন্যেই মহান আল্লাহ মানুষের সম্মুখে বিভিন্ন সংকট ও সমস্যার সৃষ্টি করতেন যাতে ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত,যে কোন ভাবেই হোক নিজেদের অক্ষমতা সম্পর্কে তারা সচেতন হয় ও আল্লাহর দিকে মুখ ফিরায়।৬৮

কিন্তু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গৃহীত এ পদক্ষেপও সার্বিক ও সার্বজনীনভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে যারা অজস্র ধন-সম্পদের অধিকারী ছিল সুদীর্ঘ সময়ের অত্যাচার-অবিচার ও অন্যায়ের মাধ্যমে আরাম-আয়েশের সকল উপকরণ নিজেদের আয়ত্বে এনেছিল,কোরানের ভাষায় যাদের অন্তর প্রস্তরসম কঠিন হয়ে গিয়েছিল,তারা তাদের চৈতন্য ফিরে পায়নি।৬৯ তখনও তারা উদসীনতায় নিদ্রামগ্ন ও স্বীয় ভ্রান্ত পথেই যাত্রা অব্যাহত রেখেছিল। যেমন : নবীগণের (আ.) আদেশ,নিষেধ ও সতর্কবাণীও তাদের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। আর যখনই মহান আল্লাহ সংকট ও সমস্যাসমূহ দূরীভূত করে মানুষের জন্যে তার নিয়ামতসমূহকে পুনরায় প্রেরণ করতেন,তখন তারা বলত : সুখ-দুঃখ,দুর্দশা-স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদির পালা পরিবর্তন ও দোদুল্যমানতা মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ,যা পূর্বপুরুষদের জন্যেও আপতিত হয়েছিল।৭০ আর এ ভাবে তারা পুনরায় অন্যায় অত্যাচারের হাত প্রসারিত করে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তুলতে প্রয়াসী হত। অথচ তারা ভুলে যেত যে,ধণ-সম্পদের এ সংগ্রহই তাদের ইহ ও পারলৌকিক দুর্ভাগ্যেও ফাঁদ,যা প্রভুর পক্ষ থেকে পাতা হয়েছে।৭১

যা হোক নবী (আ.) গণের অনুসারীগণ যখন সংখ্যা ও সামর্থ্যরে দিক থেকে এমন পরিমাণে পৌছত যে,একটি স্বতন্ত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা ও নিজেদেরকে রক্ষা করতে এবং আল্লাহর শক্রদের সাথে সংগ্রাম করতে সক্ষম,তখন জিহাদের জন্য আদিষ্ট হতেন।৭২ আর তখন নবীগণের (আ.) মাধ্যমে কাফির ও অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর আযাব নেমে আসত।৭৩ অন্যথায় মু মিনিন,নবীগণের (আ.) আদেশে কাফেরদের থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। অতঃপর আল্লাহর আযাব অন্য কোনভাবে ঐ সমাজের উপর পতিত হত,যে সমাজের সংশোধন ও প্রত্যাবর্তনের কোন প্রত্যাশা থাকত না।৭৪ আর এটাই হল মানব সমাজের তত্বাধানের ক্ষেত্রে প্রভুর অপরিবর্তনীয় ও অলংঘনীয় নিয়ম।৭৫

১১তম পাঠ

ইসলামের নবী (সা.)

ভূমিকা :

শত-সহাস্রাধিক আল্লাহর নবী ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং মানব সম্প্রদায়ের হিদায়াত ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথ রূপে পালন করতঃ মানব সমাজে জাজ্বল্যমান কীর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন জনসমষ্টিকে সঠিক বিশ্বাস ও সমুন্নত মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং অন্যদের জন্যে পরোক্ষ ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তাওহীদি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ঐ সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নবীগণের (আ.) মধ্যে হযরত নূহ (আ.),হযরত ইব্রাহীম (আ.),হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থান ও কাল উপযোগী ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিয়ম-নীতি ও চারিত্রিক দায়িত্ব সমন্বিত ঐশী কিতাবসমূহ লাভ করেছিলেন এবং মানুষের নিকট উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এ কিতাবগুলো হয় কালের আবর্তে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল অথবা যথেচ্ছা শব্দগত ও ভাবার্থগত বিচ্যুতিতে পতিত হয়েছিল। ফলে সকল ঐশী ধর্ম ও শরীয়তসমূহ বিকৃতরূপ ধারণ করেছিল । যেমন : মুসা (আ.) এর তৌরাতে অসংখ্য বিকৃতি পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং ঈসার (আ.) ইঞ্জিল নামক কোন কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। বরং তার অনুসারী বলে পরিগণিত হত এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের হস্তলিপিসমূহকে সংগ্রহ করে পবিত্র বাইবেল রূপে নামকরণ করা হয়েছে।

যে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিই যদি প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ নামক পুস্তকদ্বয়ের (তৌরাত ও ইঞ্জিল) বিষয়বস্তুকে বিবেচনা করে তবে দেখতে পাবে যে,এ গুলো কোনটিই হযরত ঈসা ও মুসার (আ.) উপর অবতীর্ণ কিতাব নয়। যেমন : তৌরাত মহান আল্লাহকে (العیاذ بالله ) এমনভাবে মানুষের মত করে উপস্থাপন করে যে,তিনি অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখেন না৭৬ বা অনেকবার স্বীয় কর্মের জন্যে অনুতপ্ত হয়েছেন৭৭ অথবা তার এক বান্দার [হযরত ইয়াকুব (আ.)] সাথে কুস্তি লড়তে গিয়ে পারাস্তপ্রায় হয়ে,অবশেষে প্রতিপক্ষের নিকট অনুরোধ করেন তাকে ছেড়ে দিতে যাতে তার বান্দাগণ তাকে এ দুরবস্থায় দেখতে না পায়।৭৮ এ ছাড়া আল্লাহর নবীগণ (আ.) সম্পর্কেও একাধিক কুৎসার অবতারণা করেছে। (العیاذ بالله ) যেমন : অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দেয়া হয়েছে হযরত দাউদের (আ.) উপর৭৯ অনুরূপ মদ পান ও মাহারামের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দেয়া হয়েছে হযরত লুতকে (আ.)৮০ । এ সকল মিথ্যাচার ছাড়াও হযরত মুসার (আ.) (তৌরাতের বাহক) মৃত্যু কোথায় এবং কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছে।৮১

এ কিতাব হযরত মূসার (আ.) নিকট অবতীর্ণ হওয়া কিতাব নয়,তা প্রমাণের জন্যে শেষোক্ত বিষয়াটিই কি যথেষ্ট নয় ?

অপরদিকে ইঞ্জিলের অবস্থা আর ও লজ্জাষ্কর। কারণ প্রথমতঃ হযরত ঈসার (আ.) উপর অবতীর্ণ এমন কোন কিতাব খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি স্বয়ং খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারীরাও এরূপ দাবি করেন না যে,বর্তমানে প্রচলিত ইঞ্জিল,সে কিতাবই যা মহান আল্লাহ হযরত ঈসার (আ.) উপর অবতীর্ণ করেছেন। বরং এর বিষয়বস্তুকে ঈসার (আ.) কয়েকজন সহচর কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদন বলে গণনা করা হয়ে থাকে। তদুপরি উক্ত কিতাবে মদ পাণের বৈধতা প্রদানসহ এর আবিষ্কারকে ঈসার (আ.) মু জিযাহরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।৮২ এককথায় বলা যায়,এ দু জন মহান নবীর (আ.) নিকট প্রেরিত ওহীসমূহ বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ফলে সেগুলো মানব সম্প্রদায়কে হিদায়াত করতে স্বকীয় ভূমিকা রাখতে অপারগ। তবে কেন এবং কিরূপে এ সকল বিচ্যুতি ও বিকৃতি সংঘটিত হয়েছিল,সে ঘটনা অনেক বিস্তৃত,যার বর্ণনা দেয়ার সুযোগ এখানে নেই ।৮৩

খ্রীষ্টোত্তর ষষ্ট শতাদ্বীতে যখন সমগ্র বিশ্ব অত্যাচার ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল,হিদায়াত ও মুক্তির সকল আলোক বর্তিকাগুলো যখন নিভন্তপ্রায়,ঠিক এমনই সময় মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকে (সা.) তদানিন্তন সময়ের অন্ধকারতম ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে প্রেরণ করেছেন যাতে ওহীর জ্যোতির্ময় শিখা সর্বকালের জন্যে এবং সকল মানুষের জন্যে প্রজ্জলিত হয়। আর সেই সাথে চিরন্তন ও অবিক্রিত অপরিবর্তিত ঐশী কিতাবকে মানুষের নিকট পৌছে দেয়া যায় এবং প্রকৃত জ্ঞাতব্য,ঐশী প্রজ্ঞাসমূহ ও বিধি-বিধান সম্পর্কে মানব সম্প্রদায়কে অবহিত করা যায়। আর সেই সাথে সকল মানুষ ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের পথে পরিচালিত হয়।৮৪

আমিরুল মু মিনিন হযরত আলী (আ.) তার বক্তব্যের একাংশে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নবীরূপে আত্মপ্রকাশের সমসাময়িক বিশ্বপরিস্থির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

মহান আল্লাহ মহানবীকে (সা.) এমন এক সময় রিসালাতের অধিকারী করেছিলেন যখন পূর্ববর্তী নবীগণ (আ.) থেকে সুদীর্ঘ সময় অতিবাহীত হয়ে গিয়েছিল,মানবকুল সুদীর্ঘ ও গভীর নিদ্রায় আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল,বিশৃংখলার সলিতাগুলো সারা বিশ্বে জ্বলে উঠেছিল,কীর্তির বাঁধনগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল,যুদ্ধবিগ্রহের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বলছিল,পাপ ও অজ্ঞতার তিমিরে নিমগ্ন ছিল সারা বিশ্ব,কপটতা ও প্রতারণা ছিল বিবস্ত্র,মানবজীবন বৃক্ষের শ্যামল পত্ররাজি শুষ্কপ্রায়,ফলধারণের কোন আশাই তাতে ছিল না,জলরাশি অতলে গিয়েছিল হারিয়ে,হিদায়াতের দীপগুলো হিমশীতল ও নিস্প্রভ হয়ে গিয়েছিল,অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার ধ্বজাগুলো স্ব-শব্দে ছিল উড্ডীয়মান,কদর্য ও হতভাগ্য মানব সম্প্রদায়ের উপর স্বীয় কুৎসিত রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ অন্যায় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অহন,যখন অনিয়ম ও বিশৃংখলা ব্যতীত কিছু বয়ে আনত না এবং জনগণের উপর যখন ভয়-ভীতি ও নিরপত্তাহীনতা আধিপত্য বিস্তার করেছিল তখন রক্তললুপ অসি ব্যতীত মানুষের কোন আশ্রয়স্থল ছিলনা।৮৫

ইসলামের নবীর (সা.) আবির্ভাবের সময় থেকে প্রত্যেক সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি (খোদা পরিচিতির পর) হল,হযরত (সা.) এর নবুয়্যত ও রিসালাত সম্পর্কে

এবং পবিত্র ধর্ম ইসলামের উপর গবেষণা করা। এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সঠিক বিশ্বাসসমূহকে প্রতিপাদনের এবং মূল্যবোধসমূহ ও এ বিশ্বের শেষাবধি সকল মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা প্রদানের নিশ্চিত পথের সন্ধান পাওয়া যায় এবং বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শের অন্যান্য বিষয়সমূহের সমাধানের চাবিকাঠি হস্তগত হয়। আর সেই সাথে যুগপৎ পবিত্র কোরানের সত্যতা এবং মানবসম্প্রদায়ের নিকট বিদ্যমান বিচ্যুতি ও বিকৃতি থেকে সংরক্ষিত একমাত্র ঐশী পুস্তক হিসেবে এর বিশ্বস্ততাও প্রতিপন্ন হয়ে থাকে ।

ইসলামের নবীর ( সা.) রিসালাতের প্রমাণ :

সাতাশতম পাঠে বলা হয়েছে যে,নবীগণের নবুয়্যত তিনটি উপায়ে প্রতিপাদনযোগ্য : একটি হল তাদের মন-মানসিকতা সম্পর্কে জানা ও নিশ্চিত সূত্রের ব্যবহার । দ্বিতীয়টি হল পূর্ববর্তী নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী। আর তৃতীয় উপায়টি হল মু জিযাহ প্রদর্শন।

ইসলামের নবী (সা.) এর ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতিই প্রযোজ্য ছিল। মক্কার মানুষ হযরত (সা.) এর সুখ্যাতিপূর্ণ চল্লিশ বছরের জীবন-যাপন পদ্ধতি খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তার এ দীর্ঘ চল্লিশ বছরে এমন কোন ক্ষুদ্রতম বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়নি যা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। উপরন্তু তার সত্যবাদিতা ও সদাচারের এমন পরিচয় তারা পেয়েছিলেন যে,তাকে আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। স্বভাবতঃই এ ধরনের ব্যক্তির পক্ষে মিথ্যা বলা ও মিথ্যা দাবি করার কোন সম্ভাবনা থাকে না।

অপরদিকে : পূর্ববতী নবীগণ (আ.) ও হযরতের (সা.) নবুয়্যতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।৮৬ এ জন্যে একদল আহলে কিতাব তার আবির্ভবের আশায় অপেক্ষমাণ ছিলেন এবং তার সুস্পষ্ট ও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন সম্পর্কেও তারা অবগত ছিলেন।৮৭ এমনকি আরব মোশরেকরা বলত যে,হযরত ইসমাঈলের (আ.) সন্তানদের মধ্যে (যারা আরব সম্প্রদায় ও গোত্রসমূহের প্রতিষ্ঠাতা) এমন কেউ নবুয়্যত প্রাপ্ত হবেন যে,পূর্ববর্তী সকল নবী ও সকল তাওহীদি ধর্মকে সত্যায়িত করবেন।৮৮ ইহুদী ও নাসারাদের মধ্য থেকে একদল পণ্ডিত এ ভবিষ্যৎ বাণীর ভিত্তিতেই রাসূল (সা.) এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন৮৯ -যদিও অন্য একদল আবার কুমন্ত্রণা ও শয়তানী প্রবণতার কারণে দ্বীন ইসলামকে গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছিল।

পবিত্র কোরান এ পদ্ধতি সম্পর্কে ইংগিত করতে গিয়ে বলে :

) أَوَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ آيَةً أَنْ يَعْلَمَهُ عُلَمَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ(

এই নিদর্শনই কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যা সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের আলেমগণ বিশেষভাবে অবগত আছে!? (সূরা শুয়ারা-১৯৭)

বনী ইসরাঈলের আলেমদের মাধ্যমে এবং পূর্ববর্তী নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী ও পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভিত্তিতে ইসলামের নবীর (সা.) পরিচয় লাভ একদিকে যেমনি সকল আহলে কিতাবের জন্যে হযরতের (সা.) রিসালাতের সত্যতার সুস্পষ্ট দলিল ছিল। অপরদিকে তেমনি সুসংবাদ প্রদানকারী নবীগণের সত্যবাদিতার এবং তদনুরূপ অন্যান্যদের জন্যে হযরত মুহম্মদ (সা.) এর সত্যতার,চূড়ান্ত ও তুষ্ট প্রমাণ রূপে পরিগণিত হত। কারণ এ ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের সত্যতা এবং এর সাক্ষী ও হযরত (সা.) সম্পর্কে বর্ণিত নিদর্শনসমূহকে তারা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ ও নিজেদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করতেন।

বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে,এ বিকৃত তৌরাত ও ইঞ্জিলেই এ ধরনের সুসংবাদগুলোকে নির্মূল করার সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এমন সকল বিষয় খুঁজে পাওয়া যায় যা সত্যান্বেষীদের জন্যে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যেমন : ইহুদী ও নাসারা আলেমগণের মধ্যে অনেকেই যারা সত্যানুসন্ধিৎসু ছিলেন,তারা এ সকল বিষয় ও সুসংবাদের মাধ্যমেই হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং পবিত্র দ্বীন ইসালামে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।৯০

অনুরূপ মহানবী (সা.) কর্তৃক অসংখ্য মু জিযাহ প্রদর্শিত হয়েছিল,যা ইতিহাস ও হাদীসগ্রন্থসমূহে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং এ গুলোর অধিকাংশই বহুল আলোচিত হাদীসের অন্তর্গত হয়েছে।৯১ তবে সর্বশেষ নবী ও তার চিরন্তন দ্বীনের পরিচয় দানের ক্ষেত্রে প্রভুর অনুগ্রহের দাবি হল : সমসাময়িক মানুষের জন্যে চূড়ান্ত রূপে দলিল -মু জিযাহসমূহ প্রদর্শন ও অন্যরা সংগতভাবে উদ্ধৃতিগত পথে ঐ গুলো সম্পর্কে অবগত হবে;তদুপরি এমন এক অমর ও চিরন্তন মু জিযাহ তাকে সম্প্রদান করবেন,যা সর্বদা সর্বযুগের বিশ্ববাসীর জন্যে চূড়ান্ত দলিল হিসেবে থাকবে। আর তা হল পবিত্র কোরান।

অতএব পরবর্তী পাঠে আমরা এ সম্মানিত গ্রন্থের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।