আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: নবুয়্যত

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 14825
ডাউনলোড: 3102

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 32 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14825 / ডাউনলোড: 3102
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

১৩তম পাঠ

কোরান বিকৃতি থেকে মুক্ত

ভূমিকা :

যেমনটি ইতিপূর্বে ইংগিত করা হয়েছে যে,নবুয়্যতের অপরিহার্যতার দলিলের আবেদন হল আল্লাহর বাণীকে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও সংরক্ষিত অবস্থায় মানুষের নিকট পৌছানো যাতে এর মাধ্যমে তারা ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে।

অতএব মানুষের নিকট পৌছানো পর্যন্ত,অন্যান্য ঐশীগ্রন্থের মতই অবিকৃত ও সংরক্ষিত ছিল এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তবে আমরা জানি যে,অন্যান্য ঐশীগ্রন্থসমূহ মানুষের হস্তগত হওয়ার পর কমবেশী বিচ্যুতি ও বিকৃতির সম্মুখীন হয়েছিল অথবা কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছিল। যেমন : হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত নূহ (আ.) এর কিতাবের কোন চিহ্নমাত্র আজ আর আমাদের হাতে নেই এবং হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসার (আ.) কিতাব প্রকৃতরূপে পাওয়া যায় না।

অতএব প্রশ্নের অবকাশ থাকে,আমাদের নিকট এখন ঐশীগ্রন্থ হিসেবে যা বিদ্যমান,কোথা থেকে আমরা জানব যে,এটা ঠিক সেই গ্রন্থই যা স্বয়ং হযরত নবী (সা.) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেনি অথবা কোন কিছুই এতে সংযোজন হয়নি কিংবা কোন কিছুই এ থেকে হ্রাস পায়নি ?

তবে যদি কেউ ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান রাখেন অথবা কোরানের সংকলন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র উত্তরাধিকারীগণের (আ.) প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবগত থাকেন তদনুরূপ যদি কোরানের আয়াত মুখস্থ করণের ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে পারেন,(যেমন : শুধুমাত্র এক যুদ্ধেই সত্তর হাজার কোরানের হাফেজ শহীদ হয়েছিলেন)। অনুরূপ দীর্ঘ চৌদ্দশত বছরে যদি কোরানের বহুল প্রচারিত হওয়ার কথা এবং আয়াত সংখ্যা,শব্দ ও অক্ষর সংখ্যা ইত্যাদির গণনায় মুসলমানদের অক্লান্ত শ্রম সম্পর্কে ধারণা রেখে থাকেন তবে তিনি কখনোই এ পবিত্র গ্রন্থের ন্যূনতম বিকৃতি ঘটেছে বলে মনে করতে পারেন না। তবে ইতিহাসের এ বিশ্বস্ত সূত্রের সাহায্য ছাড়াও কোরানের পবিত্রতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত দলিলের সমষ্টিগত আলোচনার মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ সর্বপ্রথমে কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারে। অতঃপর আমাদের হাতে বিদ্যমান এ কোরান যে,মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে তা প্রমাণিত হওয়ার পর পবিত্র কোরানের আয়াতের মাধ্যমে এ থেকে কোন কিছু হ্রাস বা ঘাটতি না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যেতে পারে।

অতএব কোন প্রকার বিকৃতি থেকে সম্মানিত গ্রন্থ কোরানের সংরক্ষিত থাকা সম্পর্কে আমরা দু টি স্বতন্ত্র শিরোনামে আলোচনা করব।

পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযুক্ত হয়নি :

পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযুক্ত হয়নি,এ ব্যাপারে সকল মুসলমানই একমত। এমনকি বিশ্বের সকল বিজ্ঞজনই এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষন করেন। এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি,যা কোরানে কোন কিছু সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাব্য উৎস হবে এবং এ ধরনের সম্ভাবনার কোন প্রমাণ নেই। উপরন্তু পবিত্র কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে নিম্নরূপে অগ্রাহ্য করা যায় :

যদি মনে করা হয় যে,কোন একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় পবিত্র কোরানে সংযোজিত হয়েছে তবে তার অর্থ হল,কোরানের সদৃশ কিছু আনা সম্ভব হয়েছে। আর এ ধরনের ধারণা,কোরানের অলৌকিকতা ও এর সমকক্ষ কিছু করতে মানুষের অপরাগতার সাথে সামঞ্ছস্যপূর্ণ হতে পারেনা। যদি মনে করা হয় যে,শুধুমাত্র এক শব্দ অথবা একটি ক্ষুদ্র আয়াত (যেমন :مدهامّتان )৯৮ সংযোজিত হয়েছে -যার অপরিহার্য অর্থ হল বক্তব্যের শৃংখলা বিনষ্ট হওয়া ও আলৌকিকতাপূর্ণ প্রকৃতরূপ থেকে বিচ্যুত হওয়া। আর এ রকমটি হলে,তা হবে অনুকরণযোগ্য ও সাদৃশ্য আনয়নযোগ্য। কারণ কোরানের সুবিন্যস্ত বিষয়বস্তুর অলৌকিকত্ব,শব্দ ও অক্ষরের নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এর ব্যতিক্রম ঘটলে কোরানের অলৌকিকত্ব হারায়।

অতএব যে দলিলের উপর ভিত্তি করে পবিত্র কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হয়,ঠিক সে দলিলের মাধ্যমেই কোন প্রকারের অতিরিক্ত সংযোজন থেকে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমনকরে একই দলিলেই শব্দ ও বাক্যের অনুপস্থিতি ঘটার ফলে কোরানের অলৌকিকত্ব বিনষ্ট হওয়ার ব্যাপারটিও নিষিদ্ধ হয়ে থাকে। তবে একটি পূর্ণ সূরা বা একটি পূর্ণ বিষয়ের ঘাটতি না ঘটার ব্যাপারটি প্রমাণের জন্যে অন্য এক প্রকার দলিলের প্রয়োজন। কারণ এরূপ ঘাটতি,অন্য কোন আয়াতের অলৌকিকত্বের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না।

পবিত্র কোরান থেকে কোন কিছু হ্রাস পায়নি :

প্রখ্যাত শিয়া ও সুন্নী আলেমগণ সুস্পষ্ট ভাষায় গুরুত্বারোপ করেন যে,যেমনিকরে পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযোজিত হয়নি,ঠিক তেমনি এ থেকে কিছুই হ্রাস পায়নি। আর এ বিষয়কে প্রমাণের জন্যে তারা অসংখ্য যুক্তির অবতারণা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে,বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাদীসগ্রন্থসমূহে কিছু কিছু প্রতারণাপূর্ণ রেওয়ায়েতের উদ্ধৃতির ফলে এবং কোন কোন বিশ্বস্ত রেওয়ায়েতের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যার কারণে৯৯ কেউ কেউ ধারণা করেছেন,এমনকি অনুমোদন দিয়েছেন যে,কোরানের কোন আয়াত বাদ পড়েছে।

তবে যে কোন প্রকারের বিচ্যুতি ( হ্রাস বা বৃদ্ধি) থেকে কোরানের মুক্ত থাকার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক সূত্র ব্যতীত এবং শব্দ বা আয়াতের ঘাটতি কোরানের অলৌককতাপূর্ণ বিন্যাস ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে,মু জিযাহর দলিলের মাধ্যমে তা অগ্রাহ্য হওয়া ছাড়াও কোন আয়াত বা পূর্ণাঙ্গ সূরার ঘটতি থেকে কোরান সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি স্বয়ং পবিত্র কোরানের মাধ্যমেই প্রমাণ করা যেতে পারে।

অর্থাৎ বিদ্যমান সমস্ত কোরান আল্লাহর কালাম এবং কোন কিছুই এতে সংযোজিত হয়নি এ বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর,এর আয়াতসমূহকে দৃঢ়তম উদ্ধৃতিগত বিশ্বাসগত ও চূড়ান্ত দলিল রূপে উপস্থাপন করা যায়। কোরানের এরূপ একটি আয়াত থেকে আমার জানতে পারি যে,মহান আল্লাহ যেকোন প্রকার বিচ্যুতি থেকে এ কোরানকে সংরক্ষণ করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন,যা অন্যান্য ঐশীগ্রন্থসমূহের ব্যতিক্রম। কারণ ঐ গুলোর সংরক্ষণের দায়িত্ব মানব সম্প্রদায়ের উপর অর্পণ করেছিলেন। যেমন : ইহুদী ও নাসারাদের আলেমদের ব্যাপারে পবিত্র কোরানে এসেছে

) بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ(

কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল তার সাক্ষী। ( সূরা মায়িদাহ -৪৪)

উল্লেখিত বিষয়টি কোরানের নিম্নলিখিত আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায় :

) إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ(

আমরাই কোরান অবতীর্ণ করিয়াছি এবং আমরাই উহার রক্ষক। ( সূরা হিজর-৯)

এ আয়াতটি দু টি বাক্যের সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে। প্রথম বাক্যটিতে إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ   অর্থাৎ নিশ্চয় আমরাই এ কোরান নাযিল করেছি -এর মাধ্যমে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে,পবিত্র কোরান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাযিল হয়েছে এবং অবতীর্ণ হওয়ার সময় এতে কোন প্রকার বিকৃতি ঘটেনি। অপর বাক্যে যথা :وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘‘ এবং নিশ্চয় আমরাই একে সংরক্ষণ করব’’ -এর মাধ্যমে এবং গুরুত্ব প্রদানকারী প্রত্যয়সমূহ ও বাক্যের গঠনে এর অবিরত অবস্থার উপর গুরুত্বারোপের মাধ্যমে,যে কোন প্রকার বিকৃতির হাত থেকে কোরানের সার্বক্ষণিক সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

বর্ণিত আয়াতটি কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযোজিত না হওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেও এ ধরনের বিকৃতিকে নিষিদ্ধকরণের জন্যে এ যুক্তির অবতারণা এক ধরনের আবর্তন প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারণ কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার ধারণা এ আয়াতটিকেও সমন্বিত করে। ফলে এ ধরনের ধারণাকে স্বয়ং ঐ আয়াতের মাধ্যমে অগ্রাহ্য করা সঠিক হতে পারে না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ঐ ধারণাকে কোরানের অলৌকিকত্বের দলিলের মাধ্যমে বর্জন করেছিলাম । অতঃপর এ আয়াতটির মাধ্যমে আয়াত বা পূর্ণ সূরার ঘাটতি লাভ (এমনরূপে যে,এর অলৌকিকত্বপূর্ণ বিন্যাস ব্যবস্থার কোন ক্ষতি হয়না) থেকে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটিও প্রতিপাদন করেছিলাম। আর এভাবেই হ্রাস বা বৃদ্ধির মত যে কোন প্রকার বিকৃতি থেকে পবিত্র কোরানের সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত দলিলের সমম্বয়ে প্রমাণিত হয়।

পরিশেষে এ বিষয়টি স্মরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি যে,সকল প্রকারের বিকৃতি থেকে কোরান সংরক্ষিত থাকার অর্থ এ নয় যে,যেখানেই কোরান নামে কোন গ্রন্থ পাওয়া যাবে,তা-ই পূর্ণ কোরান হবে এবং মুদ্রণজনিত ও সূত্রগত সকল প্রকার ত্রুটির উর্ধ্বে থাকবে অথবা এর কোন প্রকারের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যগত ত্রুটি অসম্ভব কিংবা এর আয়াত ও সূরাসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমানুসারে সজ্জিত হয়েছে। বরং এর অর্থ হল এই যে,কোরান মানুষের নিকট এরূপে বিদ্যমান থাকবে যে,সত্যানুসন্ধিৎসুগণ সকল আয়াতসমূহকেই এমনরূপে পাবে,ঠিক যে রূপে অবতীর্ণ হয়েছে।

অতএব এ কোরানের কোন কোন খণ্ডের অসম্পূর্ণতা ও অশুদ্ধি অথবা পঠন প্রক্রিয়ার বিভিন্নতা কিংবা অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমিকতার ব্যতিক্রমে আয়াত ও সূরাসমূহের পুনর্বিন্যাস অথবা তাৎপর্যগত বিকৃতি ও বিচিত্র প্রকারের তাফসির বা ব্যাখ্যার উপস্থিতি,পূর্ববর্ণিত বিকৃতি থেকে কোরানের সংরক্ষিত থাকার সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না।

১৪তম পাঠ

ইসলামের সার্বজনীনতা ও চিরন্তনতা

ভূমিকা :

আমরা জেনেছি যে,সকল নবীর (আ.) উপর বিশ্বাস স্থাপন এবং তাদের বক্তব্যসমূহকে গ্রহণ করা অপরিহার্য (দ্বিতীয় খণ্ড পাঠ-৯)। অনুরূপ কোন এক নবীকে অস্বীকার করা অথবা তার কোন একটি হুকুমকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে আল্লাহর বিধিগত প্রতিপালনকে অস্বীকার করা ও ইবলিসের মতই অবাধ্য হওয়ার শামিল।

অতএব ইসলামের নবী (সা.) এর রিসালাতকে প্রতিপাদন করার পর তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তার প্রতি অবতীর্ণ সকল আয়াতের প্রতি ও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আনিত সকল বিধি-নিষেধের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য ।

কিন্তু সকল নবী (আ.) ও ঐশী গ্রন্থসমূহের উপর বিশ্বাস করার ফলে সকল শরীয়তানুসারে কর্ম সম্পাদন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে না। যেমন : মুসলমানরা সকল উলুল আজম (আ.) ও সকল ঐশীকিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। কিন্তু পূর্ববর্তী শরীয়তানুসারে কার্য সম্পাদন করতে পারে না বা করা নিষিদ্ধ। ইতিপূর্বেও আমরা উল্লেখ করেছি যে,সকলকেই তাদের সংশ্লিষ্ট নবীর আদেশানুসারে কর্ম সম্পাদন করতে হবে (দ্বিতীয় খণ্ড পাঠ-৯) ।

অতএব সকল মানুষের জন্যে ইসলামের শরীয়তের অনুসরণ তখনই অপরিহার্য হবে,যখন ইসলামের নবীর (সা.) রিসালাত কোন নির্দিষ্ট গোত্রের বা জাতির (যেমন : আরব) জন্যে নির্ধারিত না হবে এবং তদনুরূপ যখন তার পরে অন্য কোন নবীর আবির্ভাব না ঘটে,যার ফলে তার শরীয়ত রহিত হবে কিংবা অন্য কথায় : যখন ইসলাম সার্বজনীন ও চিরন্তন ধর্ম হবে।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টিকে আলোচনার বিষয়রূপে বিবেচনা করা অপরিহার্য যে,ইসলামের নবী (সা.) এর রিসালাত কি সার্বজনীন ও চিরন্তন,নাকি কোন নির্দিষ্ট গোত্র ও কালের জন্যে সীমাবদ্ধ ?

এটা সুস্পষ্ট যে,এ ধরনের কোন বিষয়কে নির্ভেজাল বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা যায় না। বরং উদ্ধৃতিগত ও ঐতিহাসিক বিষয়ের উপর গবেষণা পদ্ধতির সাহায্য নেয়া উচিৎ । অর্থাৎ বিশ্বস্ত কোন সূত্র ও সনদের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি কেউ পবিত্র কোরানের সত্যতা কিংবা ইসলামের নবীর (সা.) নবুয়্যত ও ইসমাত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে,তবে তার জন্যে কিতাব ও সুন্নতের চেয়ে বিশ্বস্ত কোন সনদ থাকতে পারেনা।

ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম :

ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম এবং কোন নির্দিষ্ট গোত্র ও স্থানের জন্যে নির্ধারিত না থাকা,এ ঐশী ধর্মের অপরিহার্য শর্ত। এমনকি যারা এ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেনি তারাও জানে যে,ইসলামের আহ্বান হল সার্বজনীন এবং কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়।

এছাড়া এটা ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত যে,মহানবী (সা.) বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান যেমন : রোমের কাইসার,ইরানের বাদশাহ,মিশর,ইথিওপিয়া,সিরিয়ার অধিপতিগণ এবং তদনুরূপ আরবের বিভিন্ন গোত্রপতি ও অন্যান্যদের নিকট পত্র লিখেছিলেন। তাদের নিকট বিশেষ দূত প্রেরণ করেছেন এবং সর্বসাধারণকে এ পবিত্র দ্বীনের ছায়ায় আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাথে এ দ্বীনকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।১০০ আর যদি ইসলাম বিশ্বজনীন না হত তবে এ ধরনের উদাত্ত আহবান জানাতেন না এবং তখন অন্যান্য জাতি ও গোত্রের জন্যে এ দ্বীনকে গ্রহণ না করার যথেষ্ট অজুহাতের অবকাশ থাকত।

অতএব ইসলামের সত্যতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও এ শরীয়তানুসারে কার্য সম্পাদনের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য করা যায় না। ফলে কাউকেই এ দ্বীনের অনুসরণের দায়িত্ব থেকে ব্যতিক্রম মনে করা সম্ভব নয়।

ইসলামের সার্বজনীনতার স্বপক্ষে কোরানের দলিল :

যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে,এ ধরনের বিষয়সমূহকে প্রমাণের জন্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও বিশ্বস্ত সনদ হল কোরান,যার বিশ্বস্ততা ও সত্যতা পূর্ববর্তী পাঠসমূহে সুস্পষ্টরূপে আলোচনা করা হয়েছে। যদি কেউ এ ঐশী গ্রন্থটি মোটামুটি একবার পাঠ করে থাকেন তবে দেখতে পাবেন যে,এর আহ্বান সর্বসাধারণ ও সার্বজনীন এবং বিশেষ কোন গোত্র,জাতি ও ভাষার জন্যে নির্ধারিত নয়।

বিশেষ করে অধিকাংশ আয়াতেই সকল মানুষকেیا ایها الناس অর্থাৎ হে মানুষ ও১০১ یا بنی ادم হে আদম সন্তান১০২ ;রূপে সমোধন করা হয়েছে এবং সকল মানুষকে (الناس ১০৩ এবংالعلمین ১০৪ )এ হিদায়াতের পথে আহ্বান জানিয়েছে। অনুরূপ অনেক আয়াতে মহানবী (সা.) এর রিসালাতকে সকল মানুষের জন্যে নির্ধারণ করা হয়েছে (الناس ১০৫ এবংالعلمین ১০৬ ) এবং এ রকমই একটি আয়াতে তার আহ্বান,যে কেউ এ সম্পর্কে জ্ঞাত হবে তার জন্যে প্রযোজ্য হবে বলে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।১০৭ অপরদিকে অন্যান্য দ্বীনের অনুসারীদেরকে আহলুলকিতাব (اهل الکتاب ) বলে সম্বোধন ও ভর্ৎসনা করেছেন১০৮ এবং মহানবীর (সা.) রিসালাতকে তাদের উপর সুস্থিত করেছেন। আর সেই সাথে অন্যান্য দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয়কে পবিত্র কোরান অবতীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্যরূপে বিবেচনা করেছেন।১০৯

অতএব এ আয়াতসমষ্টির আলোকে,কোরানের আহ্বানের সার্বজনীনতা ও পবিত্র দ্বীন ইসলামের বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকতে পারে না।

ইসলামের চিরন্তনতা :

উল্লেখিত আয়াতসমূহ সাধারণ শব্দসমষ্টি (যেমন : বনি আদম,নাস ও আলামিন) এবং অনারব ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরকে (যেমন : ইয়া আহলাল কিতাব) আহ্বানের মাধ্যমে,ইসলামের সার্বজনীনতা ও বিশ্বজনীনতার প্রমাণ বহন করে। তদনুরূপ কালের সীমাবদ্ধতাকে দূরীকরণের

৫০

মাধ্যমে কোন নিদিষ্ট সময়ের শর্তের আওতাবহির্ভূত করা হয়েছে। বিশেষ করে لیظهر علی الدین کله অর্থাৎ সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্যে ১০ -এ বক্তব্যটির পর আর কোন প্রকার দ্বিধার অবকাশ থাকে না। এ ছাড়া নিম্নলিখিত আয়াতটির মাধ্যমে যুক্তি প্রদান করা যেতে পারে :

( وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ)

নিশ্চয় এটা এক সম্মানিত গ্রন্থ,অগ্র ও পশ্চাৎ কোন মিথ্যাই এতে অনুপ্রবেশ করবেনা। এটা প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ। (ফুসসিলাত-৪২)

এ আয়াতটি এ যুক্তির অবতারণা করে যে,পবিত্র কোরান কখনোই তার নির্ভুলতা ও বিশ্বস্ততা হারাবে না। অপরদিকে মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে নবুয়্যতের ধারার সমাপ্তির (যা অন্য একটি পাঠে আলোচনা করা হবে) দলিলের উপস্থিতিতে অন্য কোন নবী ও শরীয়তের মাধ্যমে এ ঐশী দ্বীনের রহিতকরণের সকল সম্ভাবনা পরিত্যাক্ত হয়। অনুরূপ এ বিষয়ের উপর অসংখ্য রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। যেমন :

حلال محمد حلال الی یوم القیامة و حرامه حرام الی یوم القیامة

অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক যার বৈধতা প্রদত্ত হয়েছে তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বৈধ,আর যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে।১১১

তদুপরি বিশ্বজনীনতার মতই ইসলামের চিরন্তনতাও এ ঐশী দ্বীনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য,যা ইসলামের সত্যতার প্রমাণের অধিক কোন দলিলের আবেদন করে না।

কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন :

ইসলামের শত্রুরা,যারা এ ঐশী দ্বীনের বিস্তার রোধ করতে বদ্ধপরিকর,তারা কোন প্রকার নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনেই পিছ পা হয়নি বা হবে না। যা হোক এখন তারা এ ভ্রান্ত ধারণা প্রচারে প্রয়াসী হয়েছে যে,ইসলাম শুধুমাত্র আরবদের জন্যেই অবতীর্ণ হয়েছে এবং অন্যান্য জনসমষ্টির জন্যে কোন প্রকার রিসালাত নিয়ে আসেনি !

বিশেষ করে এ আয়াতসমূহকে তারা ব্যবহার করেছেন যে,মহানবীকে (সা.) নিজ আত্মীয়- স্বজন অথবা মক্কাবাসী ও মক্কার আশেপাশের লোকজনকে হিদায়াত করণের জন্যে আদেশ দেয়া হয়েছিল।১১২ অনুরূপ সূরা মায়িদাহর ৬৯ নং আয়াতটিতে ইহুদী,সাবেঈন ও খ্রীষ্টানদের প্রতি ইঙ্গিত করণের পর সৌভাগ্যের প্রতিশ্রুতিস্বরূপ ঈমান ও সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যের শর্তরূপে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মত কোন নামই স্মরণ করা হয়নি। এ ছাড়া ইসলামের ফিকাহশাস্ত্রে আহলে কিতাব ও মুশরিকরা একই স্তরে নয়। বরং জিযিয়াহ কর (খুমস ও যাকাত,যা মুলসলমানরা প্রদান করে তা ব্যতীত) প্রদানের মাধ্যমে ইসলামী সরকারের শাসন ব্যবস্থায় তারা (আহলে কিতাব) নিরাপত্তা লাভ করতঃ স্বীয় শরীয়তানুসারে কার্য সম্পাদন করতে পারে,যা এ সকল ধর্মের স্বীকৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।

জবাব : ঐ সকল আয়াত,যেগুলোতে মহানবী (সা.) এর আত্মীয়- স্বজনকে ও মক্কাবাসীদেরকে আহ্বানের কথা স্মরণ করা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তাতে দাওয়াতের পর্যায়সমূহকে বর্ণনা করা হয়েছে,যা তার স্বজন ও পরিজন থেকে শুরু করে মক্কা ও এর আশে-পাশের অন্যান্য জনগণ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং সর্বশেষে সমস্ত বিশ্ববাসীর দ্বারপ্রান্তে পৌছবে। আর এ ধরনের আয়াতকে ঐ সকল আয়াতের সীমাবদ্ধকারী হিসেবে মনে করা যায় না,যেগুলোতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাতের বিশ্বজনীনতা ফুটে উঠেছে। কারণ এ সকল আয়াতের বাচনভঙ্গি সীমাবদ্ধ করণের পরিপন্থী হওয়া ছাড়াও উল্লেখিত শর্তের অপরিহার্য ফলশ্রুতি হল অধিকাংশের সীমাবদ্ধকরণ (تخصیص الاکثر ) যা বিজ্ঞসমাজে অশিষ্ট ও অগ্রহণযোগ্য হতে বাধ্য।

অপরদিকে সূরা মায়িদাহর উল্লেখিত আয়তটি এ বিষয়ের বর্ণনা করে যে,প্রকৃত কল্যাণ লাভের জন্যে কেবলমাত্র এ ধর্ম বা ঐ ধর্মের অনুসারী হওয়াই যথেষ্ট নয়। বরং কল্যাণের চাবিকাঠি হল প্রকৃত বিশ্বাস এবং ঐ সকল কর্ম সম্পাদন,যেগুলো মহান আল্লাহ তার বান্দাগণের জন্যে নির্ধারণ করেছেন। তদুপরি ইসলামের বিশ্বজনীনতা ও চিরন্তনতার প্রমাণবহ দলিলানুসারে ইসলামের নবীর (সা.) আবির্ভাবোত্তরে প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হল এ দ্বীনের হুকুম-আহকামের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

যা হোক ইসলামে অন্যান্য কাফেরদের উপর আহলে কিতাবদের যে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে,তার অর্থ ইসলামের আনুগত্য প্রকাশ ও এর আহকাম অনুসারে কার্য সম্পানের বাধ্যবাধকতা থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া নয়। বরং ভব্যতাহেতু তাদের অধিকার রক্ষা করা হয়েছে বৈ কি। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে এ সুযোগটুকও সাময়িক এবং ইমাম মাহদীর (আ.) (মহান আল্লাহ তার আবির্ভাবকে তরান্বিত করুন) আবির্ভাবের পর তিনি তাদের জন্যে চূড়ান্ত ঘোষণা প্রদান করবেন। আর তখন আহলে কিতাবদের সাথে ও অন্যান্য কাফেরদের মতই আচরণ করা হবে,যা আমরা নিম্নলিখিত আয়াতটি থেকে অনুধাবন করতে পারি ।

) لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ(

(ইসলামকে) সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্যে। (তওবাহ-৩৩)