আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11743
ডাউনলোড: 2719

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11743 / ডাউনলোড: 2719
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

১৮তম পাঠ

বিশ্বাসীদের বিশেষ সুবিধা

ভূমিকা :

খোদাপরিচিতি পর্বে১৮ আমরা জানতে পেরেছি যে,প্রভুর ইরাদা মূলতঃ কল্যাণ ও কামালের সাথেই সম্পর্কিত। আর অকল্যাণ ও অপূর্ণতা (মানুষের ইচ্ছার) অনুগামীক্রমে প্রভুর ইরাদার সাথে সম্পর্কিত হয়। স্বভাবতঃই মানুষের ক্ষেত্রেও প্রভুর মূল ইরাদা মানুষের উৎকর্ষ অনন্তসৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া ও চিরন্তন নেয়ামত ভোগ করার সাথে সম্পর্কিত। আর অনাচারিদের শাস্তি ও দুর্ভাগ্য,যা তাদের অপইচ্ছার ফল,তা অনুগামীক্রমে প্রভুর প্রজ্ঞাময় ইরাদার আওতাভুক্ত হয়। যদি শাস্তি ও দুঃখ দুর্দশা মানুষেরই কুপ্রবণতার অপরিহার্য বিষয় না হত,তবে প্রভুর বিস্তৃত রহমতের দাবী হত এই যে,সৃষ্টির কোন সদস্যই আযাব ও শাস্তিতে পতিত হবে না।১৮ কিন্তু প্রভুর এ অসীম রহমতের ফলেই স্বাধীনতা ও নির্বাচনাধিকার সহকারে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। আর ঈমান ও কুফর এ দু পথের যে কোন একটি নির্বাচনের অপরিহার্য ফল হল সৌভাগ্যময় বা দুর্ভাগ্যময় পরিণামে উপনীত হওয়া। তবে পার্থক্য শুধু এটুকু যে,সৌভাগ্যময় পরিণামে উপনীত হওয়া প্রভুর প্রকৃত ইরাদার সাথে সম্পর্কিত;আর দুর্ভাগ্যময় পরিণাম অনুগামীক্রমে প্রভুর ইরাদার সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং এ পার্থক্যেরই দাবী হল এই যে,সৃষ্টি ও বিধান উভয় ক্ষেত্রেই কল্যাণের দিকটি অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ অস্তিত্বগতভাবে মানুষ এমনভাবে সৃষ্টি হবে যে, কল্যাণকর্মসমূহ তার ব্যক্তিত্বে অপেক্ষাকৃত গভীর প্রভাব ফেলে,আর বিধিগতভাবে সহজ ও সরল দায়িত্ব লাভ করে,যাতে সৌভাগ্য ও চিরন্তন শাস্তি থেকে মুক্তির পথে কোন কঠিন দুরূহ দায়িত্ব পালণের প্রয়োজনীয়তা না থাকে।১৮ অপরদিকে পুরস্কার ও শাস্তির ক্ষেত্রে,পুরস্কারের ব্যাপার অগ্রাধিকার পাবে। আর রহমত ও ক্রোধের ক্ষেত্রে রহমত অগ্রাধিকার পাবে।১৮ রহমতের এ অগ্রাধিকারের স্ফুরণ যে সকল বিষয়ে প্রকাশ পায়,সে গুলোর মধ্যে কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরব।

পুণ্য বৃদ্ধি :

পরকালীন সৌভাগ্য কামনাকারীদের জন্যে মহান আল্লাহ প্রথম যে প্রাধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,তা হল : কেবলমাত্র আমলের সমপরিমাণ পুণ্যই তাকে দেয়া হবে না,বরং বর্ধিত মানের পূণ্য তাকে দেয়া হবে। এ বিষয়টি পবিত্র কোরানে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন :

) مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِنْهَا(

যে কেউ সৎকর্ম নিয়ে আসবে সে উৎকৃষ্টতর প্রতিফল পাবে। (সূরা নামল- ৮৯)

) وَمَنْ يَقْتَرِفْ حَسَنَةً نَزِدْ لَهُ فِيهَا حُسْنًا(

যে উত্তম কাজ করে আমি তার জন্যে তাতে কল্যাণ বর্ধিত করি। (শুরা- ২৩)

) لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ(

যারা মংগলকর কার্য করে তাদের জন্যে আছে মংগল এবং আরো অধিক। (ইউনুস-২৬)

) إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا(

আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না এবং অণু পরিমাণ পুণ্য কার্য হলেও আল্লাহ তা দিগুণ করেন,আর আল্লাহ তার নিকট হতে মহা পুরস্কার প্রদান করেন। (নিসা-৪০)

) مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ(

কেউ কোন সৎ কার্য করলে সে তার দশগুণ পাবে এবং কেউ কোন অসৎকার্য করলে তাকে শুধু তারই প্রতিফল দেয়া হবে। আর তার প্রতি জুলম করা হবে না। (আনআম- ১৬০)

ক্ষুদ্র পাপসমূহের জন্যে ক্ষমা লাভ :

অপর প্রাধিকারটি হল মু মিনগণ যদি বড় গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকেন,তবে দয়াময় আল্লাহ তাদের ক্ষুদ্র গুনাহসমূহ ক্ষমা করতঃ ঐগুলোর কুফল থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন । যেমন :

) إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا(

তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো মোচন করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। (নিসা-৩১)

স্পষ্টতঃই এ ধরনের ব্যক্তিবর্গের জন্যে ক্ষুদ্র গুনাহসমূহের ক্ষমাকরণ তওবাহর শর্তাধীন নয় । কারণ তওবাহ্ বড় গুনাহসমূহ থেকেও মুক্তি লাভের কারণ।

অন্যের কর্ম থেকে লাভবান হওয়া :

মুমিনদের অপর একটি সুবিধা হল,কোন ফেরেশতা ও আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তিরা যদি তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে মহান আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।১৮ অনুরূপ অন্যান্য মু মিনগণের দোয়া ও ইস্তিগফার তাদের জন্যেও মঞ্জুর করা হয়। এমনকি কোন মু মিন ব্যক্তির জন্যে যদি কেউ কারও আমল উৎস্বর্গ করে,তবে তার নিকটও (অন্য এক মু মিন) তা পৌঁছে।

আলোচ্য বিষয়গুলো অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে শাফায়াতের সাথে জড়িত সেহেতু এ বিষয়টি সম্পর্কে তুলনামূলক ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। ফলে এখানে আমরা এতটুকু ইঙ্গিত দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছি।

১৯তম পাঠ

শাফায়াত

ভূমিকা :

মহান আল্লাহ মু মিনদের জন্যে অপর যে সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করেছেন,তা হল : যদি মু মিন ব্যক্তি আমৃত্যু স্বীয় ঈমানকে সংরক্ষণ করে এবং যদি এমন কোন গুনাহে লিপ্ত না হয়,যার ফলে সামর্থ্যহৃত হয়,দুর্ভাগ্যময় পরিণতির স্বীকার হয় ও অবশেষে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পতিত হয় কিংবা সত্যকে অস্বীকার করে,এককথায় যদি বিশ্বাসী অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করে,তবে চিরন্তন শাস্তিতে পতিত হবে না। তার ক্ষুদপাপসমূহ,বড়গুনাহ থেকে দূরে থাকার কারণে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর বড় পাপসমূহ পূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য তওবাহর মাধ্যমে ক্ষমা করা হবে। যদি এরূপ তওবাহ করতে সক্ষম না হয় তবে,পার্থিব কষ্ট-ক্লেশের মাধ্যমে তার গুনাহের বোঝা লাঘব করা হবে এবং বারযাখে ও পুনরুত্থানের প্রারম্ভেই কষ্ট ভোগের মাধ্যমে তাকে কলুষতা থেকে মুক্ত করা হবে। এর পরও যদি সে তার গুনাহের কলুষতা থেকে মুক্ত না হতে পারে,তবে শাফায়াতের (মহান আল্লাহর অসীম ও বিস্ততৃ অনুগ্রহের জ্যোতিকণা,যা নবীগণ (আ.),বিশেষ করে মহানবী (সা.) ও তার মহান আহলে বাইতগর্ণের (আ.) উপর আপতিত হয়েছে) মাধ্যমে নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করবে।১৮ অসংখ্য হাদীসে যে মাকামে মাহমূদ” ৯০ বা প্রশংসিত স্থানের উল্লেখ রয়েছে,যার প্রতিশ্রুতি পবিত্র কোরানে মহান নবীকে (সা.) প্রদান করা হয়েছে মূলতঃ তা এ শাফায়াতেরই স্থান। এ ছাড়াও উল্লেখ করা হয়েছে :

) وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى(

অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে অনুগ্রহ দান করবেন আর তুমি সন্তষ্ট হবে। (যোহা- ৫)

উপরোক্ত আয়াতটি যারা শাফায়াতলাভের যোগ্য,হযরতের (সা.) শাফায়াতের মাধ্যমে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে -এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।

অতএব মু মিন পাপীদের সর্ববহৎ ও সর্বশেষ আশা হল শাফায়াত। তথাপি প্রভুর রোষানলে পতিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে এবং সর্বদা এ ভয় অন্তরে পোষণ করতে হবে যে,যদি বা এমন কোন কাজ করে ফেলে,যা দুর্ভোগময় পরিণাম ডেকে আনবে ও অন্তিমমুহূর্তে ঈমানহারা হয়ে যাবে;কিংবা যদি বা পার্থিব বিষয়বস্তুর প্রতি হৃদয়ে এমন আকর্ষণ সৃষ্টি হয় যে,(আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন) মহান আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করবে,আর তখনই জানতে পারবে যে,একমাত্র তিনিই (মহান আল্লাহ) তাদের ও তাদের মনোহারীদের মধ্যে মৃত্যুর মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করেন।

শাফায়াতের তাৎপর্য :

শাফায়াত যাشفع প্রকৃতি থেকে,জোড়া বা যুগল’অর্থে গৃহীত হয়েছে। সাধারণের কথোপকথনে এরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয় যে,কোন সম্মানিত ব্যক্তি তার সম্মানের বিনিময়ে কোন অপরাধীকে তার শাস্তি থেকে নিস্কৃতি দিতে চায় অথবা কোন সেবকের পুরস্কার বৃদ্ধি করতে চায়। সম্ভবতঃ এ ক্ষেত্রে শাফায়াত শব্দের ব্যবহারের কারণ হল এই যে,অপরাধী ব্যক্তির একাকী,ক্ষমালাভের যোগ্যতা নেই অথবা সেবকের একাকী বর্ধিত পুরষ্কারলাভের যোগ্যতা নেই;কিন্তু সুপারিশকারী বা শাফী র (شفیع ) সাথে প্রাগুক্তদের যুগল আবেদনের কারণে এ যোগ্যতা অর্জিত হয় ।

প্রচলিত নিয়মে,যে ব্যক্তি সুপারিশকারীর সুপারিশ গ্রহণ করেন,তা এ কারণে করেন যে,তিনি ভয় করেন যদি সুপারিশ গ্রহণ না করেন তবে সুপারিশকারী বিব্রত বোধ করবেন। আর এ বিব্রতবোধের ফলে তার (সুপারিশকারীর) আন্তরিকতা ও সেবা থেকে সুপারিশ গ্রহণকারী বঞ্চিত হতে পারেন বা তার পক্ষ থেকে ক্ষতিপ্রস্ত হতে পারেন। মুশরিকরা বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাকে মানবীয় গুণে গুণান্বিত করে থাকেন । যেমন : মনে করেন যে স্ত্রীর ভালবাসা,বিদূষক,সাহায্যকারী ও সহকারীর প্রয়োজন অথবা মনে করেন যে সৃষ্টিকর্তা অংশীদার ও সহকর্মীদের ভয়ে ভীত হন। তারা মহান আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে কিংবা তার রোষানল থেকে মুক্তিলাভের জন্যে কল্পিত খোদাদের আঁচলে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন এবং ফেরেশতা ও জিনদের পূজা-অর্চনায় আত্মনিয়োগ করেন;মূর্তি ও প্রতীমার নিকট শির নত করে,আর বলে :

) هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ(

এরাই আল্লাহর নিকট আমাদের জন্যে সুপারিশকারী। ( ইউনুস-১৮)১৯

কিংবা বলে :

) مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى(

আমরা তো এদের পূজা এই জন্যেই করি যে,এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে। (যুমার- ৩ )

পবিত্র কোরান এ ধরনের অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণার জবাবে বলে :

) لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ(

আল্লাহ ব্যতীত তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না। (আনয়াম-৭০)

কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে,এ ধরনের সুপারিশকারী ও তার সুপারিশ অস্বীকার করার অর্থ চূড়ান্তরূপে সুপারিশের অস্বীকৃতি নয়। বরং পবিত্র কোরানে আল্লাহর অনুমতিক্রমে সুপারিশের স্বপক্ষে অনেক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া সুপারিশকারী ও সুপারিশভুক্তদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর অনুমোদিত সুপারিশকারীদের সুপারিশ মহান আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত হবে। তাদের (শাফায়াতকারীদের) ভয়ে ভীত হওয়ার কারণে কিংবা তাদের নিকট ঋণী বলে নয়,বরং এটা এমন এক মাধ্যম,যা মহান আল্লাহ তার ঐ সকল বান্দাদের জন্যে উম্মুক্ত করেছেন যারা তার পক্ষ থেকে ন্যূনতম করুণা লাভের যোগ্যতা রাখেন। আর এ জন্যে শর্ত ও মানদণ্ডসমূহও নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সঠিক সুপারিশ ও অংশীবাদী সুপারিশের প্রতি বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য সেরূপই,যেরূপ পার্থক্য মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিলায়াত বা পরিচালনার বিশ্বাস ও স্বাধীনভাবে পরিচলানার বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে খোদাপরিচিতি পর্বে বর্ণিত হয়েছে ।১৯

শাফায়াত শব্দটি কখনো কখনো আরও বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং সকল কল্যাণকর্ম,যা অপরের জন্যে মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত হয়,তাকেও সমন্বিত করে। যেমন : পিতা-মাতা সন্তানের জন্যে,কিংবা সন্তান পিতা-মাতার জন্যে যা করে থাকে। অনুরূপ শিক্ষক বা সতর্ককারী ছাত্রদের জন্যে,এমনকি মুয়াযযিন তাদের জন্যে যা করে থাকেন,যারা তার আযান শুনে নামাযের কথা স্মরণ করতঃ মসজিদে গিয়ে থাকেন,এর সবই হল শাফায়াত। প্রকৃতপক্ষে যে সকল কল্যাণকর্ম পার্থিব জীবনে সম্পন্ন করা হয়েছে,তা-ই পরকালে শাফয়াতরূপে ও পথের দিশারূপে আত্মপ্রকাশ করে ।

অপর একটি বিষয় হল : পাপীদের জন্যে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করাও এ পৃথিবীতে এক ধরনের শাফায়াত। এমনকি অপরের জন্যে দোয়া করা এবং তাদের অভাব পূরণ করার জন্যে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করাও প্রকৃতার্থে মহান আল্লাহর নিকট থেকে শাফায়াত বলে পরিগণিত হয়। কারণ এগুলোর সবকটিই অন্যের কল্যাণকরণ ও তাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষাকরণের জন্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মাধ্যমরূপে পরিগণিত হয় ।

শাফায়াতের মানদণ্ড :

যেমনটি ইতিপূর্বে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে,শাফায়াতলাভ ও শাফায়াতকরণের জন্যে মূল শর্ত,মহান আল্লাহর অনুমতি লাভ করা। যেমন : পবিত্র কোরানে বর্ণিত হয়েছে :

) مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ(

কে সে,যে তার অনুমতি ব্যতীত তার নিকট সুপারিশ করবে ? (সূরা বাকারা -২৫৫)

) مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ(

তার অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই। (সূরা ইউনুস- ৩)

) يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا(

দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত,কারও সূপারিশ সেই দিন,কোন কাজে আসবে না । (তোহা- ১০৯)

) وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ(

যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। (সাবা-২৩)

উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সামগ্রিকভাবে প্রভুর অনুমতির’শর্তটি প্রমাণিত হয়। কিন্তু অনুমতি প্রাপ্তদের শর্ত ও বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রমাণিত হয় না। তবে অন্যান্য আয়াতসমূহ থেকে দু পক্ষের জন্যেই শর্তসমূহ সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় । যেমন :

) وَلَا يَمْلِكُ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ(

আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে,সুপারিশের ক্ষমতা তাদের নেই,তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে তার সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত। (যুখরুক- ৮৬)

সম্ভবতঃمن شهد بالحق এ সাক্ষি বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা প্রভুর জ্ঞান ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আমলসমূহ ও নিয়্যাতসমূহ সম্পর্কে অবগত হতে পারেন এবং তাদের আচরণের প্রকৃতি ও মূল্য সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারেন। যা হোক উল্লেখিত বাক্যের উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের সম্পর্ক থেকে আমরা পাই : শাফায়াতকারীগণকে এমন জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে যে,শাফায়াত লাভের জন্যে মানুষের যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে সক্ষম। আর নিশ্চতরূপে যারা এ দু শর্তের অধিকারী হয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন মাসুমগণ (আ.)।

অপরদিকে অন্য কিছু আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে,শাফায়াত লাভকারীদেরকে মহান আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতে হবে । যেমন :

) وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى(

তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যে যাদের প্রতি তিনি সন্তষ্ট। (সূরা আম্বিয়া-২৮)

আকাশে কত ফেরেশতা আছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তষ্ট তাকে অনুমতি না দেন। (নাজম-২৬)

স্পষ্টতঃই শাফায়াতলাভকারীকে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতে হবে। এর অর্থ এ নয় যে,তার সকল কর্মই মহান আল্লাহর পছন্দ অনুযায়ী হবে। তাহলে তো শাফায়াতের কোন প্রয়োজনই ছিল না। বরং দ্বীন ও ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বয়ং ব্যক্তির প্রতি সন্তষ্ট অর্থে বুঝানো হয়েছে;যেভাবে হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে ।

অপরপক্ষে কিছু কিছু আয়াতে,যারা শাফায়াতলাভের যোগ্য নয় তাদের কথাও বর্ণিত হয়েছে । যেমন : পবিত্র কোরানে মুশরিকদের কথা উল্লেখ করতে যেয়ে বলা হয় :

) فَمَا لَنَا مِنْ شَافِعِينَ(

পরিণামে,আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই। (শুয়ারা-১০০)

এবং সূরা মুদাছ্ছিরের (৪০-৪৮) নং আয়াতে অপরাধীদের দোযখে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে (অপরাধীদেরকে) প্রশ্ন করা হলে তারা উত্তরে নামাযত্যাগ,১৯৩ দুস্থ মানবতাকে সাহায্য না করা ও বিচার দিবসকে অস্বীকার করার মত বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা উল্লেখ করে। অতঃপর বলা হয় :

فما تنفعهم شفاعة الشّافعین

ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবেনা।

উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে আমরা দেখতে পাই যে,মুশরিক ও ক্বিয়ামতকে অস্বীকারকারীরা,যারা মহান আল্লাহর ইবাদত করে না,অভাবগ্রস্তদেরকে সাহায্য করে না ও সঠিক নীতিতে বিশ্বাস করে— না,তারা কখনোই শাফায়াত লাভ করবে না । নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে ইস্তিগফারও এ পৃথিবীতে এক প্রকার শাফায়াত বলে পরিগণিত হয় এবং তার ইস্তিগফার,যারা তার নিকট ইস্তিগফার ও শাফায়াতের আবেদন জানাতে অপ্রস্তত তাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে না১৯ -এর আলোকে আমরা দেখতে পাই যে,শাফায়াতকে অস্বীকারকারীরাও শাফায়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়;যেমনটি হাদীসেও এসেছে১৯

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে,প্রকৃত ও চূড়ান্ত শাফায়াতকারীকে মহান আল্লাহর অনুমোদন প্রাপ্তি ছাড়াও স্বয়ং পাপাচারী হতে পারবেন না এবং তাকে অপরের আনুগত্য ও পাপাচারের সঠিক মূল্যায়ন করার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। আর এ ধরনের ব্যক্তিদের (শাফী) সঠিক অনুসারীরাও তার আলোকে সীমিত মাত্রার শাফায়াতকরণের অধিকারী হতে পারেন। যেমন : শহীদ ও সিদ্দীকীনের মত তার অনুসারীগণ এ যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হবেন।১৯৬ অপরদিকে যারা মহান আল্লাহর অনুমতি ছাড়াও মহান অল্লাহ,তার নবীগণ (আ.) এবং যা কিছু মহান আল্লাহ তার পয়গাম্বরগণের (আ.) প্রতি অবতীর্ণ করেছেন যেমন : শাফায়াত ইত্যাদির প্রতি সঠিক বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করবেন,আর এ বিশ্বাস,আমৃত্যু সংরক্ষণ করবেন,তারাই শাফায়াতলাভের যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন ।