আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11735
ডাউনলোড: 2718

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11735 / ডাউনলোড: 2718
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

৭ম পাঠ

ক্বিয়ামত সম্পর্কে প্রভুর প্রতিশ্রুতি

ভূমিকা :

পবিত্র কোরান একদিকে পুনরুত্থান সম্পর্কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট সংবাদরূপে যা প্রেরিত হয়েছে তার উপর গুরুত্বারোপ করেছে এবং একে প্রভুর নিশ্চিত ও অলংঘনীয় প্রতিশ্রুতি বলে গণনা করেছে। আর পবিত্র কোরান এভাবে মানুষের জন্যে চূড়ান্ত দলিল সম্পন্ন করে থাকে। অপরদিকে পুনরুত্থানের আবশ্যকতার উপর বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি প্রদর্শন করে,যাতে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতির পক্ষে মানুষের আকাংখা পূর্ণ হয় এবং দলিল শক্তিশালী হয়।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরুত্থানের প্রমাণের ক্ষেত্রে কোরানের বক্তব্যকে আমরা দু টি শ্রেণীতে বিভক্ত করব এবং প্রতিটি শ্রেণীর জন্যে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ থেকে উদাহরণ তুলে ধরব।

প্রভুর অনিবার্য প্রতিশ্রুতি :

পবিত্র কোরান,ক্বিয়ামতের সংঘটন ও পরকালে সকল মানুষের পূনর্জীবন লাভের ঘটনাকে একটি সুনিশ্চিত ঘটনা বলে উপস্থাপন করেছে :

) إِنَّ السَّاعَةَ لَآتِيَةٌ لَّا رَ‌يْبَ (

কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী,ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। (সূরা গাফির -৫৯)২৭

এ ছাড়া কোরান ক্বিয়ামতকে সত্য ও অলংঘনীয় প্রতিশ্রুতি বলে বর্ণনা করেছে

) بَلَىٰ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا (

হ্যাঁ (প্রভুর) প্রতিশ্রুতি এ ব্যাপারে সত্য (নাহল -৩৮)।২৮

মহান আল্লাহ একাধিকবার কিয়ামত সংঘটনের ব্যাপারে শপথ ঘোষনা করেছেন। যেমন :

) قُلْ بَلَىٰ وَرَ‌بِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَٰلِكَ عَلَى اللَّـهِ يَسِيرٌ‌ (

বল,নিশ্চয়ই (পুনরুত্থিত) হবে,আমার প্রতিপালকের শপথ তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হইবে। অতঃপর তোমরা যা করতে সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে এবং তা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সূরা তাগাবুন-৭)২৯

পবিত্র কোরানে পুনরুত্থানের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করাকে নবীগণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে গণনা করা হয়েছে। যেমন :

) يُلْقِي الرُّ‌وحَ مِنْ أَمْرِ‌هِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ‌ يَوْمَ التَّلَاقِ (

তিনি তার বান্দাদিগের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা ওহী প্রেরণ করেন স্বীয় আদেশসহ,যাতে সে সতর্ক করতে পারে ক্বিয়ামত দিবস সম্পর্কে। (গাফির-১৫)৩০

এছাড়া পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারীদের জন্যে অনন্ত শাস্তি ও নরক যন্ত্রণার কথা উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে :

) وَأَعْتَدْنَا لِمَن كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيرً‌ا (

এবং যারা ক্বিয়ামতকে অস্বীকার করে তাদের জন্যে আমি প্রস্তত রাখিয়াছি জলন্ত অগ্নি। (ফুরকান-১১)৩১

অতএব যে কেউ এ ঐশী গ্রন্থের সত্যতা সম্পর্কে জানতে পারবে,পুনরুত্থান সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও একে অস্বীকার করার মত কোন অজুহাতই তার থাকবে না। এছাড়া পূর্ববর্তী পাঠে সুস্পষ্ট হয়েছে যে,কোরানের সত্যতা সকল সত্যানুসন্ধিৎসু ও ন্যায়পন্থী মানুষের জন্যে অনুধাবনযোগ্য। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে কারও নিকটই ক্বিয়ামতকে অগ্রাহ্য করার অজুহাত নেই -তবে তারা ব্যতীত,যাদের বুদ্ধি ও জ্ঞানের স্বল্পতা আছে অথবা অন্য কোন কারণে কোরানের সত্যতাকে উপলব্ধি করতে অপারগ

বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের প্রতি ইঙ্গিত :

কোরানের অনেক আয়াতই পুনরুত্থানের প্রয়োজনীয়তার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকে। এ সকল আয়াতকে প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক দলিলসমূহের প্রতীক বলা যেতে পারে। যেমন : তিরস্কারমূলক প্রশ্নাকারে বলে :

) أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْ‌جَعُونَ (

তোমরা কি মনে করেছিলে যে,আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না ? (সূরা মু মিনুন-১১৫)।

উল্লিখিত আয়াতটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে,যদি পুনরুত্থান ও আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটি না থাকত,তবে এ বিশ্বে মানুষের সৃষ্টিই অনর্থক হয়ে যেত। কিন্তু প্রজ্ঞাময় প্রভু অনর্থক কর্ম সম্পাদন করেন না। অতএব নিজের দিকে প্রত্যাবর্তন করানোর জন্যে তিনি অপর এক জগতের ব্যবস্থা করবেন।

এ দলিলটি হল,একটি ব্যতিক্রমী যুক্তি ব্যবস্থা। এর প্রথম ভূমিকাটি (যা একটি শর্তযুক্ত যুক্তিবাক্য) এ যুক্তি উপস্থাপন করে যে,এ বিশ্বে মানুষের সৃষ্টি তখনই প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট হবে যখন মানুষ এ পার্থিব জীবনের পর,মহান প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে এবং পরকালে স্বীয় কর্মফল ভোগ করবে। আমরা এ অনিবার্য বিষয়টিকে প্রজ্ঞাগত দলিলের বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করেছিলাম। ফলে পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।

আর দ্বিতীয় ভূমিকাটি (মহান আল্লাহ অনর্থক কর্ম সম্পাদন করেন না) হল,প্রভুর প্রজ্ঞা এবং তার কর্ম অনর্থক না হওয়া,যা খোদাপরিচিতি অধ্যায়ে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া তা প্রজ্ঞাগত দলিলের বর্ণনায়ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অতএব উল্লিখিত আয়াতটি সম্পূর্ণরূপে বর্ণিত দলিলের উপর সমাপতনযোগ্য।

এখন মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছিল,এর আলোকে বলা যায়,যদি এ বিশ্বে মানুষের অনর্থক সৃষ্টি প্রজ্ঞাবিরোধী কর্ম হয়,তবে পৃথিবীর সৃষ্টিও হবে অনর্থক ও অহেতুক। এ বিষয়টিকে আমরা সে আয়াত থেকে অনুধাবন করতে পারি,যাতে পরকালের অস্তিত্বকে এ বিশ্ব সৃষ্টির প্রজ্ঞাপূর্ণ দাবী বলে মনে করা হয়েছে । যেমন : জ্ঞানীগনের (اولو الالباب ) বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ পূর্বক বলা হয় :

) وَيَتَفَكَّرُ‌ونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْ‌ضِ رَ‌بَّنَا مَا خَلَقْتَ هَـٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ‌ (

এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ( এবং বলে ) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করনি,(নিরর্থক কর্ম সম্পাদন থেকে) তুমি পবিত্র। তুমি আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি হতে রক্ষা কর। (সুরা আল ইমরান -১৯১)

এ আয়াত থেকে আমরা আরও বুঝতে পারি যে,বিশ্বের সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তাকরণ মানুষকে প্রভুর প্রজ্ঞা সম্পর্কে অবহিত করে। অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান প্রভু তার এ মহান সৃষ্টির পশ্চাতে এক প্রজ্ঞাপূর্ণ উদ্দেশ্যকে বিবেচনা করেছেন এবং একে অহেতুক ও বৃথা সৃষ্টি করেননি। যদি অন্য এমন কোন জগতের অস্তিত্ব না থাকে,যা বিশ্বসৃষ্টির চুড়ান্ত উদ্দেশ্য বলে পরিগণিত হবে,তবে স্রষ্টার সৃষ্টি বৃথা ও নিরর্থক হয়ে পড়বে।

পুনরুত্থানের আবশ্যকতার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের ইঙ্গিতবহ,অপর এক শ্রেণীর আয়াতকে,ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক দলিল বলে গণনা করা যেতে পারে।৩২ অর্থাৎ প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার দাবী হল,সৎকর্মকারী ও দুষ্কৃতকারীদেরকে তাদের কর্মের পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা এবং তাদের পরকালীন জীবনকে পৃথক করা। আর যেহেতু এবিশ্বে এ ধরনের কোন পার্থক্য বিরাজ করে না,সেহেতু ন্যায়পরায়ণ প্রভুর জন্যে অপর এক জগৎ সৃষ্টিকরণ আবশ্যক,যাতে স্বীয় ন্যায়পরায়ণতাকে বাস্তবায়িত করতে পারেন। যেমন :

) أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَ‌حُوا السَّيِّئَاتِ أَن نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ(

দুষ্কৃতকারীরা কি মনে করে যে,আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়া উহাদিগকে তাহাদিগের সমান গণ্য করিব,যাহারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে ? উহাদিগের সিদ্ধান্ত কত মন্দ (এবং যেমনিকরে পার্থিব আনন্দ-বেদনা,দুঃখ-কষ্ট ও নিয়ামতের অংশীদার,মৃত্যুর পরও তেমনি তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকিবে না ?) (জাসিয়াহ -২১)

) وَخَلَقَ اللَّـهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْ‌ضَ بِالْحَقِّ وَلِتُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ (

আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মানুযায়ী ফল পেতে পারে,আর তাদের প্রতি জুলম করা হবে না। (জাছিয়া -২২)

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে,وَخَلَقَ اللَّـهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْ‌ضَ بِالْحَقِّ (অর্থাৎ আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে) এ বাক্যটিকে প্রজ্ঞাভিত্তিক দলিলের ইঙ্গিতবহ বলে গণনা করা যেতে পারে;যেমনিকরে ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক দলিলকে মুলতঃ প্রজ্ঞাভিত্তিক দলিলের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কারণ যেমনটি আমরা প্রভুর ন্যায়পরায়ণতা শীর্ষক আলোচনায় ব্যাখ্যা করেছিলাম যে,ন্যায়পরায়ণতা (عىل ) হল প্রজ্ঞারই (حكمت ) একটি দৃষ্টান্ত।

৮ম পাঠ

পরকালীন জগতের বিশেষত্বসমূহ

ভূমিকা :

যে সকল বিষয় সম্পর্কে মানুষের কোন অভিজ্ঞতা নেই অথবা যেগুলোকে অন্তর্দৃষ্টিগত ও প্রত্যক্ষ সচেতন জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করেনি কিংবা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেও অনুভব করতে পারেনি,তবে সে সকল বিষয় সম্পর্কে মানুষ পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারেনা। ফলে এ বিষয়টির আলোকে আমাদের মনে রাখতে হবে,পরকালীন জীবনের স্বরূপ ও ঘটনাপ্রবাহসমূহকে সঠিকরূপে অনুধাবন করতে পারব -এটা আশা করা অনুচিত। বরং বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অথবা ওহীর মাধ্যমে পরকালের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারি,তাতেই তুষ্ট থাকব এবং ততোধিক ভাবনা থেকে বিরত থাকব।

পরিতাপের বিষয় হল,একদিকে একদল লোক পরজগৎকে ইহজগতের মত বলে প্রচার করার চেষ্টা করছেন এবং এমনকি তাদের কল্পনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে,তারা বলেন : পরকালীন বেহেশত আকাশেরই এক বা একাধিক স্তরে ইহজগতেই বিদ্যমান। আর একদা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ সেথায় অবস্থান গ্রহণ করবে এবং অনাক্লিষ্ট ও পরিতৃপ্ত জীবনের অধিকারী হবে।

অপরদিকে অপর একদল,পরকালের বাস্তবতাকেই অস্বীকার করেছেন এবং চিরন্তন বেহেশতকে চারিত্রিক মূল্যবোধ বলেই মনে করেছেন,যা সমাজের বিভিন্ন মুক্তমনা ও সেবক মানুষের কামনা হয়ে থাকে। এছাড়া এ ধরনের লোকেরা ইহ ও পরকালের পার্থক্যকে লাভ ও মূল্যমানের পার্থক্যের মত মনে করেছেন।

প্রাগুক্ত প্রথম দলের কাছে প্রশ্ন করার অবকাশ থাকে : যদি চিরন্তন বেহেশত অপর এক গ্রহে থেকে থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেখানে যাবে এ কথা সঠিক হয়ে থাকে,তবে পুনরুত্থান দিবসে যে সকল মানুষকে জীবিত করা হবে,যা পবিত্র কোরানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে,তার অর্থ কী?

অনুরূপ দিতীয় দলের কাছেও প্রশ্ন থাকতে পারে : যদি বেহেশত কেবলমাত্র চারিত্রিক মূল্যবোধ ব্যতীত কিছুই না হয়ে থাকে এবং স্বভাবতঃই দোযখও যদি কেবলমাত্র মূল্যবোধ বিরোধী বৈ কিছুই না হয়ে থাকে,তবে পুনরুত্থান ও পুনর্জীবন লাভের বিষয়াটি প্রমাণ করার জন্যে কোরানের এত পীড়াপীড়ি কেন? এটাই কি ভাল ছিল না যে,আল্লাহর বাণীবাহকগণ এ অর্থটিকেই সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করতেন,যাতে অতসব বিরোধিতা,উন্মাদাখ্যা ও প্রলাপবকা ইত্যাদি অপবাদে ভূষিত না হন ?

যা হোক এ সকল অনর্থক বাক্যাল্যাপের যবনিকা টেনে শারীরিক ও আত্মিক পুনরুত্থানের বিষয়ে দার্শনিক ও কালামবিদদের মধ্যে যে বিরোধ ও মতপার্থক্য বিদ্যামান সে গুলোতে মনোনিবেশ করব। এছাড়া ঐ সকল বিষয় সম্পর্কেও আলোচনা করব যে,এ বস্তুজগৎ কি সম্পূর্ণরূপে বিনাশিত হবে,না কি হবে না ? এবং পরকালীন দেহ কি পুরোপুরি এ পার্থিব দেহই,না এর মত হবে ? ইত্যাদি।

সত্য উদঘাটন অথবা বাস্তবতার নিকটবর্তী হওয়ার জন্যে এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক প্রচেষ্টা যতই প্রশংসাযোগ্য কিংবা এর ছায়ায় চিন্তাগত দূর্বল ও শক্তিশালী দিকগুলো যতই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হোক না কেন,এটা আশা করা কখনোই উচিৎ নয় যে,এ সকল আলোচনার মাধ্যমে পরকালীন জীবন যেমন আছে ঠিক তেমনটিই অনুধাবণ করতে পারব। প্রকৃতপক্ষে অদ্যাবধি এ পৃথিবীর বাস্তবতাসমূহও কি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করা গিয়েছে? পদার্থবিদ,রসায়নবিদ ও জীববিজ্ঞানী এবং অন্যান্য মনীষীগণ কি বস্তু,শক্তি ও অন্যান্য শক্তি বৈচিত্রের স্বরূপ উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন ? তারা কি বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত ধারণা দিতে সক্ষম ? তারা কি জানেন,যদি এ বিশব্রম্মাণ্ড থেকে মহাকর্ষশক্তির অপসারণ করা হয় অথবা ইলেকট্রনের গতিকে স্তব্ধ করা হয়,তবে কি ঘটনা ঘটতে পারে ? কিংবা এ ধরনের ঘটনা ঘটবে কি না ?

দার্শনিকগণও কি এ বিশ্বের সকল বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়সমূহকে নিশ্চিতরূপে সমাধান করতে ? বস্তু সমূহ (اجسام ),প্রকারান্ত গঠনসমূহ (صور نوعیه ) এবং আত্মা ও দেহের সম্পর্ক ইত্যাদির মত বিষয়সমূহের বাস্তবতাকে উদঘাটনের জন্যে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন নয় কি? (নিশ্চয়ই)

তবে কিরূপে আমরা নিজেদের এ সকল সীমাবদ্ধ ও সল্প জ্ঞান ও চিন্তার মাধ্যমে এমন এক জগতের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করব,যার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই ?

তবে মানুষের জ্ঞানের সল্পতার অর্থ এ নয় যে,মানুষ কোন কিছুকেই কোন ভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় কিংবা বাস্তব অস্তিত্বকে অপেক্ষাকৃত ভাল ভাবে অনুধাবন করার জন্যে চেষ্টা করা অনুচিত। নিঃসন্দেহে আমরা প্রভু প্রদত্ত বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকাংশ বাস্তবতাকেই উপলব্ধি করতে সক্ষম। অনুরূপ সক্ষম ইন্দ্রিয় ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতির অনেক রহস্যের অবগুন্ঠন উন্মোচন করতে। তবে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারের সমৃদ্ধি ঘটাতে,বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রচেষ্টার পথে চলার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তির শক্তি সীমা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পারঙ্গমতা সম্পর্কে আমাদের জানা থাকতে হবে। আর তাই অনর্থক উচ্চাভিলাষ থেকে নিজেদেরকে সংযত করব এবং স্বীকার করে নিব যে,

) وَمَا أُوتِيتُم مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا (

তোমাদিগের নিকট জ্ঞানের ক্ষুদ্রাংশ ব্যতীত কিছুই আসে নাই।(ইসরা -৮৫)

হ্যাঁ জ্ঞানীরূপ বাস্তবদর্শিতা,প্রজ্ঞাধিকারীরূপ বিনতী ও দায়িত্বশীলরূপ ধর্মীয় সংযমের দাবী হল এই যে,ক্বিয়ামত ও অদৃশ্যজগৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত মতবাদ ব্যক্তকরণ কিংবা অযৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান থেকে সংযত থাকব। তবে যতটুকু বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি এবং কোরানের সুস্পষ্ট দলিল অনুমতি দেয়,ঠিক ততটুকু ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হব ।

যা হোক প্রত্যেক বিশ্বাসী ব্যক্তির জন্যে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়,তার সত্যতাকে স্বীকার করাই যথেষ্ট,যদিও ঐগুলোর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নির্ধারিতরূপে জানতে অথবা ঐগুলোর ব্যাখ্যা দিতে অপারগ। বিশেষকরে ঐ সকল বিষয় যেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে এবং আমাদের জ্ঞান ঐগুলোতে পৌঁছতে অপারগ।

এখন আমরা চেষ্টা করে দেখব,বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে পরজগতের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব এবং ইহজগতের সাথে এর পার্থক্য সম্পর্কে কতটুকু ধারণা লাভ করতে পারি।

বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরজগতের বিশেষত্বসমূহ :

পুনরুত্থানের আবশ্যকতার স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলিলের উপর চিন্তা করলেই পরজগতের বিশেষত্বসমূহ খূজে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো উল্লেখযোগ্য ।

১। পরজগতের প্রথম বিশেষত্ব যা প্রথম দলিল থেকে অর্জিত হয় তা হল : পরজগৎ চিরন্তন ও অনন্ত হতে হবে। কারণ ঐ দলিলে চিরন্তন জীবনের সম্ভাবনা ও এ ধরনের জীবনের উপর মানুষের ফিত্রাতগত চাহিদার গুরুত্ব এবং এর সংঘটন প্রভুর প্রজ্ঞার দাবী বলে পরিগণিত হয়েছে।

২। অপর যে বিশেষত্ব,যা উভয় দলিল থেকে অর্জিত হয় এবং যা প্রথম দলিলের অন্তরালে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল : পরজগতের নিয়ম-শৃংখলা এমন হতে হবে যেন,ঐ সকল ব্যক্তিই নির্মল অনুগ্রহ এবং কষ্টক্লেশমুক্ত বৈভবের অধিকারী হতে পারেন যারা চরম মানবীয় উৎকর্ষে পৌঁছতে পেরেছেন এবং কোন প্রকার পাপাচার ও বিচ্যুতিতে লিপ্ত হননি,যা ইহজগতের ব্যতিক্রম। ইহজগতে এ ধরনের কোন নিরংকুশ সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। বরং পার্থিব সৌভাগ্য হল,আপেক্ষিক ও কষ্টক্লেশ মিশ্রিত।

৩। তৃতীয় বিশেষত্ব হল : কর্মফল লাভের জন্যে পরজগতের কমপক্ষে অনুগ্রহ ও শাস্তি,এ দু টি বিভাগ থাকতে হবে,যাতে সুকীর্তিকারী ও দুস্কৃতিকারীরা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফল লাভে সক্ষম হয়। আর এ দু টি বিভাগ ঠিক তা-ই যা শরীয়তের ভাষায় বেহেশত ও দোযখ বলে পরিচিত।

৪। চতুর্থ বিশেষত্ব,যা বিশেষকরে ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক দলিল থেকে অর্জিত হয় তা হল : পরজগৎকে এতটা বিস্তৃত হতে হবে যে,সকল মানুষের সুকর্ম ও দুষ্কর্ম অনুসারে তাদেরকে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা যায়। যেমন : যদি কেউ লক্ষ লক্ষ মানুষকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে থাকে,তবে তাকে শাস্তি দেয়া যেমন সম্ভব হয় তেমনি যদি কেউ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নির্বাহের ব্যবস্থা করে থাকে তবে তাকেও পুরস্কৃত করা সম্ভব হয়।

৫। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অপর বিশেষত্বটি,যা এ ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক দলিল থেকেই হস্তগত হয় এবং উক্ত দলিল উপস্থাপনের সময় ইঙ্গিত করা হয়েছে যে,পরকাল হল কর্মফল লাভের স্থান কর্ম সম্পাদনের স্থান নয়।

এর ব্যাখ্যা হল : পার্থিব জীবন এরূপ যে,মানুষ পরস্পরবিরোধী ইচ্ছা ও আকাংখা পোষণ করে থাকে এবং সর্বদা দ্বিধা-বিভক্ত পথপ্রান্তে অবস্থান নিয়ে থাকে । ফলে এ দু য়ের মধ্যে যে কোনটিকে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। আর এ বিষয়টিই সে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে,যা জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত অবিরত চলতে থাকে। প্রভুর প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়ণতার দাবী হল,যারা নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেননি,তারা যথোপযুক্ত পুরস্কার লাভ করবে এবংএর অন্যায়কারীরা নিজ কর্মের শাস্তি ভোগ করবে।

এখন যদি আমরা কল্পনা করি যে,কর্মক্ষেত্র ও এর নির্বাচন পরজগতেও বিদ্যমান তবে প্রভুর অনুগ্রহ ও কল্যাণের দাবী হল : কর্ম সম্পাদন ও নির্বাচনের অন্তরায় না হওয়া। আর এভাবে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদানের জন্যে অপর এক জগৎ আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। তখন যে জগৎকে আমরা পরজগৎ হিসেবে কল্পনা করেছি,প্রকৃতপক্ষে তা অপর এক ইহজগৎ রূপে পরিগণিত হয়। আর প্রকৃত পরকালীন জগৎ হল সর্বশেষ ও চূড়ান্ত জগৎ,যেখানে আর কোন দায়িত্ব,পরীক্ষা ও এর ক্ষেত্র (অর্থাৎ একাধিক চাহিদার মধ্যে কোন বিরোধ) থাকবে না।

আর এখানেই ইহ ও পর জগতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য প্রকাশ লাভ করে। অর্থাৎ ইহজগৎ হল এমন এক জগৎ,যেখানে নির্বাচন ও পরীক্ষার ক্ষেত্র বিদ্যমান। অপরদিকে পরজগৎ হল সেই জগৎ,যেখানে ইহজগতে যে সকল সুকর্ম ও দুষ্কর্ম সম্পাদন করেছে,সেগুলোর চিরন্তন পুরস্কার,শাস্তি ও ফল গ্রহণের ক্ষেত্র বিদ্যমান। আজ প্রকৃতপক্ষে কর্ম সম্পাদনের সময়,হিসেবের সময় নয়,আর কাল হল হিসেবের সময়,কর্ম সম্পাদনের সময় নয়। (নাহজুল বালাগ্বা,খোতবাহ -৪২)