আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11738
ডাউনলোড: 2718

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11738 / ডাউনলোড: 2718
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

প্রভুর বিচারব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং পারস্পরিক সম্পর্কোচ্ছেদ :

ঐ জগতে সকল বাস্তবতা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হবে৭০ এবং প্রভুর শাসন ব্যবস্থা ও রাজত্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে আর সৃষ্টির উপর এমন আতংকের ছায়া নেমে আসবে যে,কারোই উচ্চবাচ্য করার কোন সামর্থ্য থাকবে না । প্রত্যেকেই নিজ নিজ অদৃষ্টের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে এবং এমনকি সন্তানরা পিতা-মাতা থেকে,নিকটজন ও আত্মীয়-স্বজন পরস্পর থেকে পলায়ন করবে । মূলত: আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবে এবং পার্থিবলাভ ও শয়তানী মানদণ্ডের ভিত্তিতে যে সকল বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল,সে সকল সম্পর্ক শত্রুতায় পরিণত হবে । ইতিপূর্বে কৃত অপরাধের জন্যে অনুতাপ ও অনুশোচনায় হৃদয় আবিষ্ট হবে ।

প্রভুর ন্যায়দণ্ড :

অতঃপর প্রভুর ন্যায়দণ্ডভিত্তিক বিচারালয় রূপ লাভ করবে এবং সকল বান্দাদের কৃতকর্ম উপস্থিত হবে ,আমলনামাসমূহ বিতরণ করা হবে ,কোন কর্তার কৃতকর্ম এতটা সুস্পষ্ট যে,কাউকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হবে না যে,কী করেছে ?

এ বিচারালয়ে ফেরেশতাগণ,নবীগণ ও আল্লাহর নির্বাচিতগণ সাক্ষীরূপে উপস্থিত হবেন ।৮০ এমনকি মানুষের হস্ত,পদ এবং ত্বকও সাক্ষ্য প্রদান করবে । সকল মানুষের হিসাব পুঙ্খানুপঙ্খ রূপে ও প্রভুর ন্যায়দণ্ডের ভিত্তিতে পরিমাপ করা হবে এবং ন্যায় ও আদলের ভিত্তিতে তাদের বিচার করা হবে । প্রত্যেকেই তার চেষ্টা ও শ্রমের ফল লাভ করবে । সৎজনকে তার কর্মের দশগুণ বেশী পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং কেউই কারও বোঝা বহন করবে না। কিন্তু যারা অন্যান্যদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে,তারা নিজেদের পাপ ছাড়াও পথভ্রষ্টদের পাপও স্বীয় স্কন্ধে ধারণ করবে ।৮৭ (তাদের পাপ লাঘব তো হবেই না) উপরন্তু তাদের নিকট থেকে (তাদের পাপকর্মের পরিবর্তে) কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না৮৮ এবং (তাদের জন্যে) কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না ।৮৯ কেবলমাত্র তাদের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে,যারা মহান আল্লাহর অনুমতি প্রাপ্ত হবেন এবং তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদণ্ডের ভিত্তিতে শাফায়াত করবেন ।৯০

অনন্ত জীবনের পথে :

অতঃপর আল্লাহর আদেশ ঘোষণা করা হলে সৎকর্ম সম্পাদনকারী ও অন্যায়কারীরা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাবে। বিশ্বাসীগণ আনন্দিত ও হাস্যেজ্জ্বল বদনে বেহেশতে এবং অবিশ্বাসীরা অপমানিত,লাঞ্ছিত ও মলিনবদনে দোযখের পথে যাত্রা করবে । সকলেই দোযখের পথ অতিক্রম করবে । তবে বিশ্বাসীগণের বদন থেকে জ্যোতি নির্গত হবে এবং স্বীয় পথকে উজ্জ্বল করবে আর কাফের ও মুনাফিকরা অন্ধকারে পতিত হবে।

যে মুনাফিকরা পৃথিবীতে মু মিনদের সাথে মিশে ছিল,তারা মু মিনগণের নিকট তাদের দিকে ফিরে তাকাতে ফরিয়াদ করবে,যাতে তাদের জ্যোতি ব্যবহার করে মুক্তির পথ খুজে বের করতে পারে। মু মিনদের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হবে জ্যোতি লাভ করতে পশ্চাতে (পৃথিবীতে) ফিরে যাও! মুনাফিকরা বলবে : আমরা কি পৃথিবীতে তোমাদের সাথে ছিলাম না ? জবাবে বলা হবে : কেন,তবে বাহ্যিকভাবে আমাদের সাথে ছিলে। কিন্তু নিজেদেরকে পরিবেষ্টিত করেছিলে এবং তোমাদের অন্তরগুলো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও নির্মমতায় জড়িয়ে পড়েছিল। আর অদ্য তোমাদের সকল ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়ে গিয়েছে এবং তোমাদের থেকে ও কাফেরদের থেকে (শাস্তির) বিকল্প হিসেবে কিছুই গ্রহণ করা হবে না। অবশেষে কাফের ও মুনাফিকদেরকে নরক গহ্বরে নিক্ষেপ করা হবে।

যখন বিশ্বাসীগণ বেহেশতের নিকটবর্তী হবে তখন এর দ্বারগুলো খুলে যাবে এবং রহমতের ফেরেশতারা তাদেরকে স্বাগতম জানাতে আসবে। তারা সম্মান ও সালামের সাথে তাদেরকে (মু মিনগণকে) অনন্তসৌভাগ্যের সুসংবাদ দিবে অপরদিকে যখন কাফের ও মুনাফিকরা দোযখের নিকটবর্তী হবে,তখন এর দ্বারগুলোও খুলে যাবে এবং আযাবের ফেরেশতারা তাদেরকে রূঢ়তাসহকারে ভর্ৎসনা করবে। তারা (আযাবের ফেরেশতারা) অনন্তশাস্তির প্রতিশ্রুতি দিবে।

বেহেশত :

বেহেশতে বিস্তৃত কাননসমূহ,প্রশস্ত আকাশসমূহের ছায়ায়,বিস্তৃত ভূমির উপর অবস্থান করবে,১০০ যে গুলোতে নানাবিধ বৃক্ষরাজি,সকল প্রকার পরিপক্ক ফল (বেহেশতবাসীর) নাগালের মধ্যে অবস্থান করবে।১০ আর থাকবে আড়ম্বরপূর্ণ ইমারতসমূহ১০ ,স্বচ্ছ পানি১০ এবং পবিত্র পেয়,দুগ্ধ ও মধুর ঝর্ণাধারা ।১০ এ ছাড়া যা কিছুই বেহেশতবাসীর কাংখিত,১০ বরং তাদের যাঞ্চারও অধিক বৈভবে পরিপূর্ণ থাকবে ঐ বেহেশত ।১০ বেহেশতবাসীগণ বিভিন্ন প্রকার সৌন্দর্য ও চিত্রাংকিত মসৃন রেশমী পোশাকে সজ্জিত হয়ে১০ মণিমুক্তা খচিত আরামদায়ক সুকোমল সজ্জায় পরস্পরের মুখোমুখী অবস্থানে হেলান দিয়ে বসে থাকবে১০ এবং প্রভুর প্রশংসা ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে ।১০ অনর্থক কোন কথা বলবে না বা শুনবে না । ১০ হিমেল বা তপ্ত বাতাস কোনটিই তাদেরকে কষ্ট দিবে না ।১১ তাদের থাকবে না কোন দুর্ভোগ,ক্লান্তি ও বিষাদ১১ কিংবা থাকবে না কোন ভয় ও বেদনা১১ অথবা থাকবে না তাদের কোন হিংসা বা ক্রোধ।১১ সুদর্শন সেবকগণ তাদের চারপাশে পরিভ্রমণরত থাকবে ।১১ স্বর্গীয় সুন্দর পানপাত্র থেকে তাদেরকে পান করানো হবে,যা তাদের বর্ধিত আনন্দ ও উপভোগের কারণ হবে এবং কোন প্রকার র্দুদৈবই তাদেরকে স্পর্শ করবে না ।১১ নানাবিধ ফল-মূল ও পাখীর মাংস তারা ভক্ষণ করবে ।১১ নিষ্কলুষ অপরূপ সুদর্শনা ও দয়াশীলা সঙ্গীগণের কোমল স্পর্শে তারা হবে ধন্য ।১১ সবকিছুর উর্ধ্বে তারা প্রভুর পক্ষ থেকে আত্মিক তুষ্টির মত নেয়ামতের অধিকারী হবে ।১১ তারা তাদের প্রভুর করুণা ও দয়ায় ধন্য হবে,যা তাদেরকে মহার্ঘ্যে নিমজ্জিত করবে এবং কারও পক্ষেই সে আনন্দের সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । ২০ আর এ অতুলনীয় সৌভাগ্য,অবর্ণনীয় বৈভব এবং প্রভুর অনুগ্রহ,তুষ্টি ও সান্নিধ্য সর্বদা সেথায় বিরাজ করবে১২ ,যা কখনোই শেষ হবে না ।১২

দোযখ :

দোযখ সে সকল কাফের ও মুনাফিকদের আবাসস্থল,যাদের অন্তরে ঈমানের কোন প্রকার জ্যোতিরই অস্তিত্ব নেই ।১২ আর এ দোযখের ধারণক্ষমতা এত বেশী যে,সমস্ত অন্যায়কারীদেরকে ধারণ করার পরও বলবে هذا من مزید অর্থাৎ আরও আছে কি ?১২ সেথায় আছে শুধু আগুন আর আগুন,শাস্তি আর শাস্তি !

আগুনের লেলিহান শিখাগুলো সবদিক থেকে (জাহান্নামীদেরকে) গ্রাস করবে। আর কর্ণবিদারী,ক্রোধানিত গর্জনে দোযখবাসীর ভয়-ভীতির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে ।১২৫ কদাকার,ভগ্ন কৃষ্ণকায়,কুৎসিৎ চেহারার এ দোযখবাসীরা এমন কি দোযখের ফেরেস্তাদের চেহারায়১২ ও কোন প্রকার দয়া করুনা ও নমনীয়তার ছোঁয়া দেখতে পাবে না ।১২ নরকবাসীরা লোহার গলাবন্ধ,জিঞ্জির দ্বারা বাঁধা থাকবে ।১২ আগুন তাদের আপদমস্তক গ্রাস করবে১২ এবং স্বয়ং তারাই সে আগুনের ইন্ধন হবে । ৩০ নরকের এহেন পরিবেশে নরকবাসীদের ক্রন্দন,চিৎকার,আহাজারী এবং নরক প্রহরীদের হুংকার ব্যতীত কিছুই শুনতে পাওয়া যাবে না।১৩ পাপীদের আপদমস্তকে ফুটন্ত পানি ঢালা হবে। ফলে তাদের দেহের অভ্যন্তরভাগও গলে যাবে ।১৩ যখনই পিপাসার প্রচণ্ডতা ও প্রদাহে পানি প্রার্থনা করবে তখনই উত্তপ,কলুষিত ও দুর্গন্ধময় পানি তাদেরকে প্রদান করা হবে,যা তারা গোগ্রাসে পান করবে ।১৩ তাদের খাবার হবে যাক্কুম বৃক্ষের ফল,যা আগুন থেকে জন্ম গ্রহণ করে। আর এ ফল ভক্ষণে তাদের অভ্যন্তরের যন্ত্রণা অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে।১৩ তাদের পোশাক হবে এক প্রকার কৃষ্ণকায় পদার্থ থেকে তৈরীকৃত,যা আঠালো এবং তাদের দুর্ভোগবৃদ্ধির কারণ হবে ।১৩ তাদের সঙ্গী হবে শয়তান ও পাপিষ্ঠ জীনরা যাদের কাছ থেকে তারা পলায়ন করতে চাইবে ।১৩ আর তারা পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ ও অভিসম্পাত করবে ।১৩

যখনই তারা মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাইবে,তখন দূর হও,চুপ কর,ইত্যাদি বাক্য দ্বারা তাদেরকে স্তব্ধ করে দেয়া হবে ।১৩ অতঃপর দোযখের প্রহরীদের শরণাপন্ন হয়ে বলবে যে ,তোমরা আল্লাহর কাছে চাও,যাতে আমাদের শাস্তি কিছুটা হ্রাস করে। উত্তরে শ্রবণ করবে : মহান আল্লাহ কি নবীগনকে (আ.) প্রেরণ করেননি? এবং তোমাদেরকে কি তারা চূড়ান্ত দলিল প্রদর্শন করেননি ? ১৩

অতঃপর তারা মৃত্যু কামনা করবে। জবাবে বলা হবে যে, তোমরা অনন্তঃকাল দোযখে অবস্থান করবে । ৪০ যদিও মৃত্যু তাদেরকে সর্বদিক থেকে আগ্রাসন করবে,কিন্তু তারা মরবে না ।১৪ যতবারই তাদের শরীরের চামড়া ঝলসে যাবে,ততবারই নতুন চামড়া সৃষ্টি হবে;আর এ ভাবে তাদের আযাব চলতে থাকবে ।১৪

বেহেশতবাসীদের নিকট থেকে কিঞ্চিৎ পানি ও খাবার ভিক্ষা করলে বলা হবে, মহান আল্লাহ বেহেশতের নেয়ামত তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছেন ।১৪ বেহেশতবাসীগণ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে,তোমাদের এ দুর্ভাগ্যের কারণ কী এবং কী কারণে তোমাদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করা হয়েছে ? জবাবে দোযখবাসীরা বলবে,আমরা মহান আল্লাহর এবাদত ও সালাত পাঠ করতাম না এবং নিঃস্ব ও দরিদ্রদেরকে সাহায্য করতাম না,পাপীষ্ঠদের সহযোগিতা করতাম,আর কিয়ামতের দিনকে অস্বীকার করতাম ।১৪

অতঃপর দোযখবাসীরা পরস্পরের সাথে কলহে লিপ্ত হবে ।১৪ বিপথগামীরা,যারা তাদেরকে বিপথগামী করেছে,তাদেরকে বলবে : তোমরাই আমাদেরকে বিপথগামী করেছিলে। তারা জবাবে বলবে : তোমরা স্বেচ্ছায় আমাদেরকে অনুসরণ করেছিলে ।১৪

অধীনস্থরা ক্ষমতাধরদেরকে বলবে : তোমরাই আমাদের এ হতভাগ্যের জন্যে দায়ী। তারা জবাবে বলবে : আমরা কি তোমাদেরকে জোরপূর্বক তোমাদের সত্য পথ থেকে বিরত রেখেছিলাম ।১৪ অবশেষে শয়তানকে বলবে : তুই-ই আমাদের বিপথগামীতার কারণ। সে জবাবে বলবে : মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,তোমরা তা অগ্রাহ্য করেছ। আর আমি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম,তোমরা তা গ্রহণ করেছিলে। সুতরাং আমাকে ভৎসনা করার পরিবর্তে,তোমাদের নিজেদেরকে ভৎসনা কর। অদ্য আমরা কেউই কারও উপকারে আসতে পারব না ।১৪

আর এভাবে নিজেদের কুফরি ও অবাধ্যতার শাস্তি ভোগ ব্যতীত তাদের আর কোন উপায় থাকবে না এবং অনন্তকাল তারা সেথায় আযাব ভোগ করতে থাকবে ।১৪

১১তম পাঠ

ইহকাল ও পরকালের মধ্যে তুলনা

ভূমিকাঃ

বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত পথে পরজগতের যে পরিচয় আমরা লাভ করেছি,তার মাধ্যমে পৃথিবী ও আখেরাতকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলনা করতে পারি। সৌভাগ্যবশতঃ এ ধরনের তুলনা স্বয়ং পবিত্র কোরানেও সংঘটিত হয়েছে এবং আমরা কোরানের উদ্ধৃতির মাধ্যমে পার্থিব জীবন এবং পরকালীন জীবনের সঠিক মূল্যায়ন করতঃ পরকালীন জীবনের শ্রেষ্ঠত্বকে উপস্থাপন করতে পারি ।

নশ্বর পৃথিবী ও অবিনশ্বর আখেরাত :

পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল : পৃথিবীর আয়ুষ্কালের সীমাবদ্ধতা ও আখেরাতের চিরন্তনতা। এ পৃথিবীতে সকল মানুষেরই জীবনকালের পরিসমাপ্তি বিদ্যমান যা অতিসত্বর বা অনতিসত্বর ঘটে থাকবেই। এমনকি যদি কেউ শতসহস্র কালও এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে,তবে অবশেষে এ প্রাকৃতিক বিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি অর্থাৎ যখন (نفخ صور اول )প্রথম ফুৎকার ধ্বনিত হবে,তখনই তার জীবনাবসান ঘটবে,যেমনটি আমরা পূর্ববর্তী পাঠসমূহে জানতে পেরেছি। অপরদিকে কোরানের প্রায় অষ্টাদশ সংখ্যক আয়াত আখেরাতের চিরন্তনতা ও অবিনশ্বরতার প্রমাণ বহন করে। ৫০ আর এটা সুস্পষ্ট যে,যা নশ্বর তা যত সুদীর্ঘকালই থাকুক না কেন,অবিনশ্বরের সাথে তার কোন তুলনা হতে পারে না ।

অতএব পরজগত অমরত্ব ও চলিষ্ণুতার দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর উপর এক বিরাট শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। এই বিষয়টিই পবিত্র কোরানের একাধিক আয়াতে পরকালের আবকা (ابقی ) অর্থে উল্লেখিত হয়েছে।১৫ এছাড়া পৃথিবীর কালিল(قلیل ) অর্থাৎ অতি সামান্য হওয়ার কথাও স্মরণ করা হয়েছে।১৫ অপর কিছু আয়াতে পার্থিব জীবনকে ঐ সকল উদ্ভিদের সাথে তুলনা করা হয়েছে,যেগুলো কেবলমাত্র অতিক্ষুদ্র সময়ের জন্যে সবুজ ও মনোরম হয়,অতপর হলুদাভ ও বিবর্ণরূপ ধারণ করে এবং অবশেষে শুষ্ক ও লীন হয়ে যায়।১৫ এছাড়া একটি আয়াতে সামগ্রিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :

) مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ(

তোমাদের নিকট যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। ( নাহল -৯৬)

আখেরাতের আযাব থেকে নেয়ামতের পৃথকীকরণ :

পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবনের মধ্যে অপর মৌলিক পার্থক্যটি হল : পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি কষ্ট ও ক্লেশমিশ্রিত এবং এমনটি নয় যে,এক শ্রেণীর মানুষ সর্বদা সর্বাবস্থায় নেয়ামতের অধিকারী হবে এবং সদানন্দ বিহারে জীবনাতিবাহিত করবে ;আর অপর একশ্রেণীর মানুষ সর্বদা কষ্টক্লিষ্ট জীবন যাপন করবে;বরং সকলেই একদিকে যেমন কমবেশী আনন্দ ও ভোগ-বিলাসের অধিকারী অপরদিকে তেমনি কষ্ট,ক্লেশ ও উদ্বেগেরও অধিকারী। কিন্তু পরজগৎ দু টি স্বতন্ত্র (বেহেশত ও দোযখ) ভাগে বিভক্ত। একাংশে কষ্ট-ক্লেশ ও ভয়-ভীতির লেশমাত্র নেই। আর অপরাংশে ব্যথা,বেদনা,অগ্নিযন্তনা,ভয়-ভীতি ব্যতীত অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই। স্বভাবতঃই আখেরাতের ভোগ-বিলাসে ও কষ্ট-ক্লেশ পৃথিবীর তুলনায় চুড়ান্ত মাত্রায় পরিলক্ষিত হবে।

এধরনের মূল্যায়নও পবিত্র কোরানে উদ্ধিৃত হয়েছে। আর পরকালীন নেয়ামত এবং প্রভুর সান্নিধ্য ও নৈকট্যের শ্রেষ্ঠত্ব,পার্থিব নেয়ামতের তুলনায় অধিক গুরুত্ব পেয়েছে;১৫ যেমনকরে পরকালীন আযাব ও কষ্ট-ক্লেশ,পার্থিব কষ্ট-ক্লেশের চেয়ে অধিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে।১৫

আখেরাতই মূল :

পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যে অপর গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি হল : পার্থিব জীবন,আখেরাতের সূচনাস্বরূপ এবং অনন্ত সৌভাগ্য লাভের মাধ্যম। আর পরকালীন জীবনই হল চূড়ান্ত ও মূল জীবন,যদিও পার্থিব জীবন ও এতে বিদ্যমান বস্তুগত ও অবস্তুগত নেয়ামতসমূহ মানুষের জন্যে জরুরী,কিন্তু যেহেতু এর সবগুলোই হল পরীক্ষাস্বরূপ এবং সত্যিকারের উৎকর্ষ ও অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যম,তাই এর কোন মৌলিকত্ব নেই। পার্থিব নেয়ামতসমূহের প্রকৃত মূল্যমান ঐ সকল রসদের উপর নির্ভরশীল,যেগুলো কোন ব্যক্তি অনন্ত জীবনের জন্যে সংগ্রহ করে থাকে।১৫

অতএব,যদি কেউ পরকালীন জীবনকে বিস্মৃত হয় এবং পার্থিব রূপ-যৌলুসের উপরই আপন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে,কিংবা এ জীবনের ভোগ-বিলাসকেই চূড়ান্ত লক্ষ্যরূপে নির্ধারণ করে তবে সে এর প্রকৃত মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর জন্যে ভ্রান্ত মূল্যমান নির্ধারণ করেছে। কারণ সে মাধ্যমকেই চূড়ান্ত লক্ষ্যরূপে চিহিৃত করেছে। আর এ ধরনের কর্মের অর্থ ক্রীড়া-কৌতুক ও প্রতারিত হওয়া বৈ কিছুই নয়। এ কারণেই পবিত্র কোরান পার্থিব জীবনকে ক্রীড়া-কৌতুক ও প্রতরণার মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে১৫ এবং পরকালীন জীবনকে প্রকৃত জীবন বলে গণনা করেছে।১৫ কিন্তু স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে,পৃথিবীর প্রতি যে সকল ভৎসনা নিক্ষিপ্ত হয়েছে তার অধিকাংশই হল দুনিয়া পূজারী মানুষেরই এক ধরনের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফল। নতুবা পার্থিব জীবন আল্লাহর যোগ্য মানুষ যারা এর বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত এবং একে মাধ্যমে হিসেবে গণনা করেন ও স্বীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনন্তসৌভাগ্য অর্জনের পথে নিয়োগ করেন,তারা এ পার্থিব জীবনকে ভৎসনাতো করেনই না বরং এর জন্যে অভূতপূর্ব মূল্যমান নির্ধারণ করে থাকেন।

পার্থিব জীবনকে নির্বাচনের পরিণতি :

পরকালীন জীবনের বিশেষত্ব ও পার্থিব ভোগ-বিলাসের উপর স্বর্গীয় নেয়ামতসমূহের অবর্ণনীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভুর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যের কথা বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে,পরকালীন জীবনের পরিবর্তে পার্থিব জীবনকে নির্বাচন করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।১৫ আর এর ফলশ্রুতি দুর্ভোগ ও দূঃখ ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু এ ধরনের নির্বাচনের কদর্যতা ও অসারতা তখনই অধিকতর প্রকাশ লাভ করে যখন জানব যে,পৃথিবী ও এর ভোগ-বিলাসের প্রতি আকর্ষণ,কেবলমাত্র অনন্ত সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ারই কারণ নয় বরং চিরন্তন দুর্ভোগেরও গুরুতর কারণ।

এর ব্যাখ্যা এরূপ : যদি মানুষ অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধির পরিবর্তে দ্রুত অপসৃয়মান পার্থিব ভোগ- বিলসকে এমনভাবে নির্বাচন করতে পারত যে,চিরন্তন জীবনের জন্যে এর কোন বিরুপ প্রভাব থাকবে না,তারপরও পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির সীমাহীন অগ্রাধিকারের কথা বিবেচনা করলে এ ধরনের কর্ম,নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করত। তদুপরি অনন্ত জীবন থেকে কেউই পলায়ন করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনের জন্যেই তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং পরকালীন জগৎকে ভুলে গিয়েছে কিংবা অস্বীকার করেছে,তবে সে কেবল স্বর্গীয় বৈভব থেকেই বঞ্চিত হবে না বরং চিরকালের জন্যে সে নরকযন্ত্রণা ভোগ করবে এবং অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬০

এ কারণে পবিত্র কোরান একদিকে পরকালীন নেয়ামতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে এবং সতর্ক করে দেয়,যাতে পার্থিব জীবন তাকে প্রতারিত না করতে পারে।১৬ আবার অপরদিকে পৃথিবীর প্রতি আসক্তি ও আখোরাতকে ভুলে যাওয়া কিংবা অস্বীকার করা অথবা এ সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার নির্মম পরিণতি সম্পর্কে অবহিত করে এবং সতর্ক করে দেয় যে,এহেন কর্ম চিরন্তন দুর্দশা ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে থাকে ।১৬ আর এমনটি নয় যে,পৃথিবীকে নির্বাচনকারী পরকালীন পুরস্কার থেকেই কেবলমাত্র বঞ্চিত হবে বরং এ ছাড়াও সে অনন্ত শাস্তিতেও পতিত হবে।

এর নিগূঢ় তথ্য হল এখানে : দুনিয়াপূজারী,মহান আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতাসমূহকে বিনষ্ট করেছে। আর যে বৃক্ষ অনন্তসৌভাগ্যের ফলধারণ ক্ষমতাকে শুষ্ক ও নিষ্ফল করে ফেলেছে এবং প্রকৃত বৈভবদাতার অধিকারকে (আল্লাহর উপাসনা) ক্ষুন্ন করেছে,তার প্রদত্ত নেয়ামতকে তারই অসন্তুষ্টির পথে ব্যয় করেছে,এহেন ব্যক্তিই যখন তার মন্দ ও ভ্রান্ত মনোনের ফল দেখতে পাবে,তখন এ প্রত্যাশ্য করবে যে,হায় যদি মৃত্তিকা হতাম! তবে এ নির্মম পরিণতির শিকার হতাম না ।১৬