আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11734
ডাউনলোড: 2717

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11734 / ডাউনলোড: 2717
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

১২তম পাঠ

দুনিয়া ও আখেরাতের সম্পর্ক

ভূমিকা :

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে,মানুষের জীবন কেবলমাত্র দ্রুত অপসৃয়মান এ পার্থিব জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং পুনরায় পরকালে জীবন লাভ করবে এবং চিরকাল সেথায় বেঁচে থাকবে। অনুরূপ জানতে পেরেছি যে,পরকালীন জীবনই হল প্রকৃত ও সত্যিকারের জীবন। মূলতঃ পার্থিব জীবন এদিক থেকে পরকালীন জীবনের তুলনায় জীবন নামকরণেরই অযোগ্য। এমন নয় যে,পরকালীন জীবনের অর্থ ভাল বা মন্দ নাম অথবা কাল্পনিক বিষয় বা কোন সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত বিষয়।

এখন পার্থিব ও পরকালীন জীবনের মধ্যে তুলনা ও এতদ্ভয়ের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণের পালা এসেছে। তবে পূর্ববর্তী পাঠসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে এ সম্পর্কের প্রকৃতি কিছুটা হলেও প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান নানাবিধ বক্রচিন্তার কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন মনে করছি। আর বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ ও কোরানের বক্তব্যসমূহের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কিরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান,তা পরিষ্কার হওয়া জরুরী ।

দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র :

এখানে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুতের সাথে বিবেচনা করতে হবে,তা হল : পরকালীন জীবনের সুঃখ,দুঃখ পৃথিবীতে মানুষের আচার-ব্যবহারের অনুগামী। এমনটি নয় যে,পরকালীন বৈভব অর্জনের জন্যে ঐ জগতেই চেষ্টা ও শ্রম ব্যয় করতে হবে এবং যারা অধিক দৈহিক শক্তি ও তীক্ষ্ণচিন্তার অধিকারী,তারা অধিক নেয়ামত ভোগ করতে পারবেন অথবা কেউ কেউ প্রতারণার মাধ্যমে অপরের অর্জিত বৈভব অপব্যবহার করতে পারবেন;যেমনটি কোন কোন নির্বোধ ব্যক্তি ধারণা করে এবং পরজগৎকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে।

পবিত্র কোরানের ভাষায় কোন কোন কাফেরের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে : 

) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا(

(দুনিয়াপূজারী ব্যক্তি বলল) আমি মনে করি না যে,ক্বিয়ামত হবে,আর আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই,তবে আমি তো নিশ্চয়ই এটা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। (কাহ্ফ-৩৬)

অন্য এক প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى(

আমি মনি করি না যে,কিয়ামত সংঘটিত হবে,আর আমি যদি আমার প্রতি পালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হই-ও,তার নিকট তো আমার জন্যে কল্যাণই থাকবে। (ফুসসিলাত-৫০)

এ ধরনের ব্যক্তিরা মনে করেছেন যে,পরকালীন জীবনেও পৃথিবীর মতই স্বীয় চেষ্টায় অসংখ্য নেয়ামতের অধিকারী হতে পারবেন অথবা ধারণা করেছেন যে,এ পার্থিব জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী হওয়া,তার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের নিদর্শন,সুতরাং পরকালেও এ ধরনের অনুগ্রহেরই অধিকারী হবেন !

যা হোক যদি কেউ পরকালীন জগৎকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন জগতরূপে বিবেচনা করে থাকেন এবং পৃথিবীতে যে সুকর্ম ও দুষ্কর্ম সম্পাদন করেছেন আখেরাতের নেয়ামত ও শাস্তির জন্যে এর কোন প্রভাব আছে বলে মনে না করেন তবে যে পরকাল সকল ঐশী ধর্মেরই মৌলিক বিশ্বাস,তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কারণ এ মূলনীতিটি পার্থিব জগতে সম্পাদিত কর্মের পুরস্কার ও শাস্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীকে আখেরাতের বাজার বা আখেরাতের শস্যক্ষেত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং এখানে শ্রম দিতে হবে,বীজ বপন করতে হবে,প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং ফসল ও সম্পদ পরজগতে লাভ করতে হবে।১৬ পুনরুত্থানের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলিলের দাবী এবং কোরানের বক্তব্যও তা-ই,যার জন্যে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

পার্থিব বৈভবসমূহ পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির কারণ নয় :

কেউ কেউ মনে করেন যে,ধন-সম্পদ,সন্তান-সন্তুতি ও অন্যান্য পার্থিব আরাম,আয়াশের উপকরণ,আখেরাতেও সুখ-সমৃদ্ধির কারণ হবে এবং সম্ভবতঃ মৃতদের সাথে স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান পাথরসমূহ,এমনকি খাদ্যসমাগ্রী সমাধিস্থকরণের ব্যাপারটি এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকেই উৎসারিত।

পবিত্র কোরান গুরুত্বারোপ করে যে,ধন-দৌলত,সন্তান-সন্ততি স্বয়ং (তাদের কাজ-কর্ম বিবেচনা না করে) মহান আল্লাহর নৈকট্যের কারণ হবে না,১৬ বা পরকালে কাউকে লাভবান করবে না।১৬ মূলতঃ এ ধরনের পার্থিব সম্পর্ক ও উপকরণ পরকালে ছিন্ন ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে১৬ প্রত্যেকেই স্বীয় ধন-সম্পদ ত্যাগ করবে১৬ এবং সম্পূর্ণ একাকীই মহান আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে।১৬ কেবলমাত্র আত্মিক ও ঐশি সম্পর্কই প্রতিষ্ঠিত থাকবে । সুতরাং যে সকল মু মিন তাদের স্ত্রী,সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈমানী সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন,তারা বেহেশতে একত্রে বসবাস করবেন । ৭০

অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে,পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত নয় এবং এমনটি নয় যে,যে কেউ পৃথিবীতে ক্ষমতা ও শক্তিধর,সুন্দর,প্রফুল্ল,ভাগ্যবান ও অনন্দচিত্তের অধিকারী,তিনি পরকালে ও সেরকমই পরিগণিত হবেন। নতূবা ফেরাউন ও কারুনরা অধিকতর পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী হওয়াই যুক্তিসঙ্গত হত। বরং যারা পৃথিবীতে অক্ষম,দরিদ্র,কষ্ট-ক্লীষ্ট জীবন-যাপন করেন কিন্তু প্রভুর প্রতি সকল দায়িত্ব সম্পাদন করেন,তারা পরকালে সবল,সুন্দর,সক্ষম বলে পরিগণিত হবেন এবং অনন্ত বৈভবের অধিকারী হবেন।

) وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلًا(

আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ,সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট। ( ইসরা-৭২)

কোন কোন ব্যক্তি ধারণা করেছেন : উপরোল্লিখিত আয়াতটি দলিল প্রদর্শন করে যে,পার্থিব সুস্থতা ও সৌভাগ্য পরকালীন সুস্থতা ও সৌভাগ্যের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছেন যে,উপরোক্ত আয়াতে অন্ধতের মানে বাহ্যিক চক্ষুর অন্ধত্ব নয় বরং এর অর্থ হল অন্তরচক্ষুর অন্ধত্ব। যেমন : অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে :

) فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ(

বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ নয়,বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। (হাজ্জ-৪৬)

অপর এক স্থানে এসেছে :

) وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا(

যে আমার স্মরণে বিমুখ তাহার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল,কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (তোহা- ১২৪-১২৬)

অতএব পরকালে অন্ধতের কারণ হল,ইহকালে মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে বিস্মৃত হওয়া,বাহ্যিকচক্ষুর অন্ধত্ব নয়। সুতরাং ইহ ও পরকালের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক,কারণ ও কার্যের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত নয়।

পার্থিব বৈভবসমূহ পরকালীন দুর্দশার কারণও নয় :

অপরদিকে কেউ কেউ ধারণা করেছেন যে,পার্থিব বৈভব ও পরকালীন বৈভবের মধ্যে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং তারাই পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির অধিকারী হবেন,যারা পার্থিব বৈভব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বিপরীতক্রমে যারা পার্থিব নেয়ামতসমূহের অধিকারী,তারা পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রাগুক্ত ধারণাপোষণকারীরা ঐ সকল আয়াতের শরণাপন্ন হয়েছেন,যেগুলো এ যুক্তি প্রদর্শন করে যে,দুনিয়াপূজারীরা পরকালীন সুখ-সম্মৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হবে।১৭ তারা ভুলে গিয়েছেন যে,দুনিয়াপূজারী হওয়া আর পার্থিব নেয়ামতের অধিকারী হওয়া সমান কথা নয়। বরং দুনিয়াপূজারী সে-ই,যে পার্থিব ভোগ-বিলাসকে স্বীয় প্রচেষ্টার লক্ষ্যরূপে স্থির করেছে এবং এগুলো লাভ করার জন্যেই সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে। যদিও নিজের চাওয়া-পাওয়া ও লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে থাকে। অপরদিকে পরকালপিয়াসু হলেন তিনিই,পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি যার হৃদয় লালায়িত নয় এবং তার লক্ষ্য হল পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি,যদিও ইহকালে প্রাচুর্যের অধিকারী হয়ে থাকেন। যেমনঃ হযরত সুলাইমান (আ.),আল্লাহর অনেক ওলী ও নবীগণ (আ.) পার্থিব প্রাচুর্য ও নেয়ামতের অধিকারী ছিলেন কিন্তু এগুলোকে পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করেছেন।

অতএব পার্থিব বৈভব থেকে লাভবান হওয়া ও পরকালীন বৈভব থেকে ভোগ করার মধ্যে যেমনি কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই,তেমনি কোন ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক ও নেই। বরং পার্থিব সৌভাগ্য ও সুখ-সমৃদ্ধি এবং দুঃখ-দুর্দশা উভয়ই প্রভুর প্রজ্ঞার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে১৭ আর এগুলোর সবকিছুই হল তার পরীক্ষার উপকরণ ।১৭

সুতরাং পার্থিব নেয়ামত থেকে বঞ্চিত বা লাভবান হওয়া,স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রভুর নৈকট্য বা প্রভুর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়া অথবা পরকালীন সৌভাগ্য বা দুর্ভাগের কোন নিদর্শন নয়।১৭

উপসংহার :

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,পৃথিবী ও আখেরাতের মধ্যে বিদ্যমান সকল প্রকার সম্পর্ককে অস্বীকার করার অর্থ হল পুনরুত্থানকে অস্বীকার করা । অথচ পার্থিব নেয়ামত ও পরকালীন নেয়ামতের মধ্যে যেমন কোন সম্পর্ক নেই,তেমনি পার্থিব নেয়ামত ও পরকালীন শাস্তির মধ্যেও কোন সম্পর্ক নেই,অনুরূপ এর বিপরীত ক্ষেত্রেও। সামগ্রিকভাবে বলা যায়,পৃথিবী ও পরজগতের সম্পর্ক,পার্থিব বিষয়বস্তুসমূহের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত নয় কিংবা এ সম্পর্ক পদার্থ ও জীববিদ্যার কোন নিয়ম-কানুনের মধ্যেও পড়ে না। বরং যা পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি অথবা শাস্তির কারণ,তা হল : পৃথিবীতে মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ড। তা-ও কেবলমাত্র শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় এবং বস্তুগত পরিবর্তন সংঘটনের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং তা,ঈমান ও কুফরের দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসারিত হয়। আর এ কারণেই পবিত্র কোরানে পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধিকে,মহান আল্লাহর প্রতি,পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ও নবীগণের (আ.) প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের এবং আল্লাহর তুষ্টিযুক্ত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে গণনা করা হয়েছে। যেমন : নামাজ,রোজা,জিহাদ,আল্লাহর বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ ও দান,সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ অত্যাচার্রী কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম,ন্যায় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি হল মহান আল্লাহর পছন্দনীয় কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে পরকালীন অনন্ত আযাব বা শাস্তি ভোগের কারণ হল কুফর,শিরক,অন্যায়কর্ম সম্পাদন,কিয়ামত ও নবীগণকে অস্বীকার করা এবং বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া অসংখ্য আয়াতে সামগ্রীকভাবে পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির কারণরূপে বিশ্বাস ও সৎকর্ম সম্পাদন”১৭ এবং দুর্দশার কারণরূপে কুফর ও পাপাচারের”কথা উল্লেখ করা হয়েছে।১৭

১৩তম পাঠ

ইহ ও পরকালের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি

ভূমিকা :

ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,একদিকে ঈমান ও সৎকর্ম এবং অপরদিকে প্রভুর সান্নিধ্য ও পরকালীন নেয়ামতসমূহের মধ্যে,প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। অনুরূপ একদিকে কুফর ও পাপাচার এবং অপরদিকে প্রভুর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া ও অনন্ত নেয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান । আবার ঈমান ও সৎকর্ম,পরকালীন শাস্তির সাথে এবং কুফর ও পাপাচার চিরস্থায়ী নেয়ামতসমূহের সাথে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রক্ষা করে। এ সম্পর্কসমূহের মূলনীতি সম্পর্কে কোরানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই এবং এগুলোকে অস্বীকার করার অর্থ হল কোরানকে অস্বীকার করার শামিল।

তবে এ জরুরী বিষয়টি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা হয়। ফলে এ সম্পর্কে আলোচনা ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন। যেমনঃ বর্ণিত সম্পর্কগুলো কি বাস্তব ও সুনির্ধারিত সম্পর্ক,না কি কেবলমাত্র কল্পিত বা স্বীকৃত সম্পর্ক ? ঈমান ও সৎকর্ম এবং তদনুরূপ কুফর ও পাপাচারের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কি ? স্বয়ং সৎকর্ম ও কুকর্ম পরস্পরের উপর কোন প্রভাব ফেলে কি ?

আলোচ্য পাঠে প্রথম প্রশ্নটির উপর আলোচনা করতঃ ব্যাখ্যা করব যে,উপরোল্লিখিত সম্পর্কসমূহ কোন কৃত্রিম ও স্বীকৃতমূলক সম্পর্ক নয়।

বাস্তব সম্পর্ক না কি স্বীকৃতমূলক সম্পর্ক :

ইতিপূর্বে আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি যে,পার্থিব কর্মকাণ্ড ও পরকালীন নেয়ামত ও শাস্তির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক,বস্তুগত ও সাধারণ সম্পর্কের মত নয় এবং একে পদার্থগত,রাসায়নিক ইত্যাদি কোন নিয়মের আলোকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করা সম্ভব নয়। এমনকি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনে মানুষের যে শক্তি ব্যয় হয়,শক্তি ও বস্তুর নিত্যতা সূত্র মতে এরা পরস্পর পরিবর্তিত হয় এবং পরকালীন নেয়ামত ও শাস্তিরূপে প্রকাশ লাভ করে -এমনটি ধারণা করাও ঠিক নয় । কারণ :

প্রথমতঃ একজন মানুষের কথা ও কর্মে ব্যবহৃত শক্তি সম্ভবতঃ এমন পরিমাণেও হবে না যে,একটি আপেলের বীজে পরিবতির্ত হতে পারে,অগণিত বেহেশতী নেয়ামত তো দূরের কথা ।

দ্বিতীয়তঃ বস্তু ও শক্তির পরিবর্তন,বিশেষ কারণানুসারে সম্পন্ন হয় এবং সুকর্ম,দুষ্কর্ম ও কর্তার নিয়্যাতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া কোন প্রাকৃতিক নিয়মের ভিত্তিতেই আন্তরিকতাপূর্ণ ও ভণ্ডামীপূর্ণ কর্মের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা সম্ভাব নয়,যাতে করে বলা যাবে যে,কারো শক্তি নেয়ামতে,আবার কারও শক্তি শাস্তি বা আযাবে পরিণত হয়।

তৃতীয়তঃ যে শক্তি একবার ইবাদতের পথে ব্যয় হয়,অন্যবার সে শক্তি পাপাচারেও ব্যয় হতে পারে।

কিন্তু এ ধরনের সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করার অর্থ চূড়ান্তরূপে বাস্তব সম্পর্ককে অস্বীকার করা নয়। কারণ অজ্ঞাত ও অভিজ্ঞতা বিবর্জিত সম্পর্কও বাস্তব সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যেমনিকরে পার্থিব ও পরকালীন বিষয়সমূহের সাথে কার্যকারণগত সম্পর্ককে প্রমাণ করতে অক্ষম,তেমনি এ গুলোর মধ্যে বিদ্যমান কার্য ও কারণগত সম্পর্ককে অস্বীকার করতেও অপারগ। অপরদিকে এরূপ ধারণা করা যে,সৎকর্ম ও দুষ্কর্ম মানুষের আত্মার উপর সত্যিকারের প্রভাব ফেলে এবং এ আত্মিক প্রভাবই পরকালীন নেয়ামত ও শাস্তি লাভের কারণ হয়,(যেমন : পার্থিব অলৌকিক বিষয়ের উপর কোন কোন আত্মার প্রভাব) তবে তা অযৌক্তিক নয়। বরং বিশেষ দার্শনিক নীতির মাধ্যমে তা প্রমাণ করা সম্ভব। তবে এ গুলোর আলোচনা এ পুস্তকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।

কোরানের বক্তব্য :

কোরানের বক্তব্যসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে,আমাদের মস্তিষ্কে কৃত্রিম ও স্বীকৃত সম্পর্কেরই প্রতিফলন ঘটে। যেমন : প্রতিদান ও শাস্তি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ ।১৭ কিন্তু অন্যান্য আয়াতের সাহায্য নিয়ে বলা যায় যে,মানুষের কর্মকাণ্ড ও পরকালীন পুরষ্কার ও শাস্তির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক স্বীকৃত সম্পর্কের উর্ধ্বে। অতএব আমরা বলতে পারি যে,প্রথম শ্রেণীর ব্যাখ্যা সহজবোধ্য এবং যেখানে অধিকাংশ মানুষের অবস্থা বিবেচনা করা হয়েছে,যাদের মস্তিষ্ক এ ধরনের অর্থ বা তাৎপর্যের সাথে পরিচিত।

অনুরূপ হাদীস শরীফেও এমন অসংখ্য সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে যে,মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডসমূহ একাধিক মালাকুতী রূপ পরিগ্রহ করে,যে গুলো বারযাখে ও কিয়ামতে প্রকাশ লাভ করবে।

এখন আমরা যে সকল আয়াত,মানুষের কর্মকাণ্ডের সাথে পরকালীন প্রতিদানের বাস্তব সম্পর্কের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে,সেগুলো উপস্থাপন করব :

) وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ(

তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু নিজেদের জন্যে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে। (বাকারা-১১০) {এ ছাড়া সূরা মুযাম্মিল -২০ দ্রষ্টব্য }

) يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا(

যে দিন প্রত্যেকে,সে যে ভাল কাজ করেছে এবং সে যে মন্দ কাজ করেছে তা পাবে,সে দিন সে নিজের ও তার মধ্যে দূর ব্যবধান কামনা করবে। (আলে ইমরান-৩০)

) يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ(

সেই দিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে। (নাবা- ৪০)

) فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ(

কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখবে। যিলযাল (৭-৮)

) هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ(

তোমরা যা করতে তার প্রতিফল ব্যতীত কিছুই তোমাদেরকে দেয়া হচ্ছে কি? (নামল- ৯০){ অনুরূপ কাসাস -৮৪ দ্রষ্টব্য }

) إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا (

যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে,তারা তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষণ করে। (নিসা- ১০)

স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,মানুষ পরকালে দেখবে যে,পৃথিবীতে কি কি কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছে,কেবলমাত্র তা-ই তাদের পুরস্কার ও শাস্তি নয়। বরং এগুলো হল মালাকুতি পাপসমূহ,যেগুলো বিভিন্ন নেয়ামত ও শাস্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ব্যক্তি ঐগুলোর মাধ্যমে নেয়ামত ও আযাব লাভ করবে। যেমন : শেষোক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে,অনাথের সম্পদ ভক্ষণের অব্যক্ত রূপ হল অগ্নি ভক্ষণ করা এবং যখন অপর এক জগতে সকল বাস্তবতা ও সত্য আত্মপ্রকাশ করবে,তখন দেখতে পাবে যে,কোন হারাম খাবারের অব্যক্তরূপ ছিল অগ্নি। ফলে তখন অভ্যন্তরভাগে এর জ্বালা যন্ত্রণা সে অনুভব করবে এবং তাকে বলা হবে : ওহে,এ অগুন সে হারাম সম্পদ ব্যতীত কিছু কি যা ভক্ষণ করেছিলে ?!