আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)0%

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: কিয়ামত

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 11733
ডাউনলোড: 2717

পাঠকের মতামত:

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 11733 / ডাউনলোড: 2717
সাইজ সাইজ সাইজ
আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

আক্বায়েদ শিক্ষা (তৃতীয় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

১৬তম পাঠ

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

ভূমিকা :

ইসলামী সংস্কৃতির সাথে যাদের যথেষ্ট পরিচয় নেই এবং যারা মানবীয় প্রবৃত্তিকে বাহ্যিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে থাকেন;এ ছাড়া কর্তার প্রবণতা ও নিয়্যাতের গুরুতের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করেন না,অর্থাৎ পারিভাষিক অর্থে যাকে বলা হয় হুসনে ফায়েলী (হুসনে ফে’লীর বিপরীতে) নেই,অথবা কেবলমাত্র অপরের পার্থিব জীবনের সুখ-সমৃদ্ধিতে আপন কর্মের প্রভাবকেই কর্মের মানদণ্ড বলে মনে করেন,তবে এ ধরনের ব্যাক্তিরা ইসলামের অনেক বিশ্বাস ও পরিচিতির ব্যাখ্যায় ভ্রান্তপন্থা অবলম্বনে বাধ্য হয় অথবা ঐগুলোকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। যেমন : ঈমানের ভূমিকা ও সৎকর্মের সাথে ঈমানের সম্পর্ক,কুফর ও শিরকের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা ইত্যাদি ব্যাখ্যা কোন কোন গরিষ্ঠ পরিমাণের ও বিস্তৃত সময়ের কর্মকাণ্ডের উপর লঘিষ্ট পরিমাণের ও ক্ষুদ্র সময়ের কর্মকাণ্ডের অগ্রাধিকারের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তারা বক্রচিন্তার আশ্রয় গ্রহণ করে। অর্থাৎ তারা এরূপ মনে করেন যে,মহান আবিষ্কারকগণ যে অপরের সুখ-সমৃদ্ধির উপকরণের যোগান দিয়েছেন অথবা মুক্তিকামীগণ যে তাদের জাতির মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করেছেন,তারা সঙ্গত কারণেই পরকালে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হবেন -যদিও আল্লাহ ও পুনরুত্থান দিবসের প্রতি তাদের কোন বিশ্বাস না থেকে থাকে। কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছেন যে,প্রকৃত সুখ-সমৃদ্ধির জন্যে জরুরী ঈমানকে,এ পৃথিবীরই শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও তাদের বিজয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার’কথা উল্লেখ করে থাকে । এমনকি খোদাকেও’তারা মূল্যবোধ ও চারিত্রিক আদর্শের তাৎপর্যের আওতায় ব্যাখ্যা করে থাকেন ।

যদিও পূর্ববর্তী পাঠসমূহের আলোচিত বিষয়বস্তু থেকে এ রকমের ধারণার দুর্বলতা ও আসরতা সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব,তথাপি আজকের যুগে এ রকমের ধারণার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে তা যে,বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে,তা বিবেচনা করলে,ঐগুলো সম্পর্কে অধিকতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করাটা সময়োচিত বলে মনে করি।

তবে এ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ও সর্বাত্মক আলোচনার জন্যে যথেষ্ট সময় ও সুযোগের প্রয়োজন। ফলে আমরা এখানে ঐগুলোর বিশ্বাসগত দিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এ পুস্তকের বৈশিষ্ট্যের কথা বিবেচনা করে,কেবলমাত্র মূল বিষয়সমূহের উল্লেখেই সচেষ্ট হব।

মানুষের প্রকৃত উৎকর্ষ বা কামাল :

যদি আমরা একটি ফলবতী আপেল বৃক্ষকে একটি ফলবিহীন আপেল বৃক্ষের সাথে তুলনা করি,তবে ফলবতী বৃক্ষটিকে ফলবিহীন বৃক্ষটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশী মূল্যবান বলে গণনা করব। আর এটা কেবলমাত্র এ কারণেই নয় যে,মানুষ ফলবতী বৃক্ষ থেকে অধিকতর লাভবান হয় বরং এটা এ কারণে যে,ফলবতী বৃক্ষ অস্তিত্বের দিক থেকে পূর্ণতর এবং এর অস্তিত্বগত প্রভাব অপেক্ষাকৃত বেশী,ফলে সত্তাগতভাবেই মূল্যবান। কিন্তু এ আপেল বৃক্ষই যখন রোগাক্রান্ত ও পূর্ণতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তখন তা স্বীয় মূল্য হারায় এবং এমনকি অপরকে কলুষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার উৎসেও পরিণত হতে পারে।

মানুষও অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় এরূপ। যদি সে তার উপযুক্ত উৎকর্ষে পৌঁছতে পারে এবং তার ফিত্রাত সংশ্লিষ্ট অস্তিত্বগত প্রভাব প্রকাশ লাভ করে থাকে,তবে সে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে অধিকতর মর্যাদা ও মূল্যমানের অধিকারী হবে। কিন্তু যদি সে ব্যাধিগ্রস্ত ও বিচ্যুত হয় তবে অন্যান্য প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্টতর ও ক্ষতিকারক হতে পারে। যেমন : পবিত্র কোরানে কোন কোন মানুষকে সকল প্রাণীর চেয়ে নিকৃষ্ট ও চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও মূঢ় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

) إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ(

আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সে বধির ও মূক,যারা কিছুই বুঝে না। (আনফাল-২২)

) أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ(

এরা পশুর ন্যায় বরং তা অপেক্ষাও অধিক মূঢ়। (আ রাফ-১৭৯)

অপরদিকে যাদি কেউ আপেল বৃক্ষকে কেবলমাত্র অংকুরিত অবস্থায়ই দেখে থাকেন,তবে তার ধারণা এই যে,এর বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায় হল অংকুরিত হওয়াই এবং ততোধিক পূর্ণতা আর নেই। অনুরূপ যদি কেউ কেবলমাত্র মানুষের মধ্যম ধরনের পূর্ণতার সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন তবে তিনি প্রকৃত কামাল বা পূর্ণতার সঠিক ধারণা লাভে ব্যর্থ হবেন । কেবলমাত্র তারাই মানুষের সঠিক মূল্যায়নে সক্ষম হবেন,যারা তার চূড়ান্ত উৎকর্ষ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকবেন।

তবে মানুষের প্রকৃত উৎকর্ষ বা কামাল বস্তুগত ও প্রকৃতিগত উৎকর্ষের মত নয়। কারণ যেমনি আমরা ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছিলাম যে,মানুষের মনুষ্যত্ব রূহে মালাকুতী বা আত্মার উপর নির্ভরশীল এবং বস্তুতঃ প্রকৃত মানবীয় উৎকর্ষ হল এ আত্মারই উৎকর্ষ যা স্বীয় ইচ্ছাধীন কর্মতৎপরতার মাধ্যমে অর্জিত হয় হোক তা অন্তর্গত বা আত্মিক তৎপরতা কিংবা হোক বাহ্যিক ও শরীরবৃত্তিক তৎপরতা। আর এ ধরনের কামাল বা পূর্ণতাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা ও সংখ্যাগত মানদণ্ডের ভিত্তিতে শনাক্ত করা যায় না বা অনুমান করা যায় না। ফলে স্বভাবতঃই এ উৎকর্ষ সাধনের পথও পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত উপকরণের মাধ্যমে অনুধাবনযোগ্য নয়। অতএব যিনি স্বংয় এ ধরনের উৎকর্ষ লাভ করতে পারেননি এবং একে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞানের মাধ্যমে অনুধাবন করতে পারেননি,তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে অথবা ওহী ও ঐশী গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে।

ওহীর মতে এবং কোরান ও পবিত্র আহলে বাইত ও মাসুমগণের (আ.) বর্ণনা মতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে,মানুষের চূড়ান্ত কামাল বা উৎকর্ষ হল তারই অস্তিত্বের একটি পর্যায় যা প্রভুর নৈকট্য”রূপে বর্ণিত হয়েছে। আর এ উৎকর্ষের প্রভাব হল অনন্ত বৈভবসমূহ ও প্রভুর সন্তুষ্টি,যা পরকালে আত্মপ্রকাশ করবে। বস্তুতঃ এ উৎকর্ষের সামগ্রীক পথ হল প্রভুর ইবাদত বা উপাসনা ও তাকওয়া,যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সকল স্তরকে সমন্বিত করে।

তবে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে,অনেক জটিল যুক্তি-প্রমাণও এ বিষয়ের উপর বর্ণনা করা যেতে পারে,যার জন্যে একাধিক দার্শনিক প্রারম্ভিকার প্রয়োজন হয়। ফলে আমরা এখানে সহজ- সরলভাবে বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টা করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা :

মানুষ ফিতরাতগতভাবেই অসীম কামাল বা পূর্ণতা কামনা করে। জ্ঞান ও সামর্থ্য এর বহিঃপ্রকাশ বলে পরিগণিত হয়। আর এ ধরনের পূর্ণতা লাভই অসীম ভোগ-বিলাস ও চিরস্থায়ী সুখ-সমৃদ্ধির কারণ। মানুষের জন্যে এ পূর্ণতা বা কামাল তখনই সম্ভব হবে যখন অসীম জ্ঞান,ক্ষমতা ও পরমপূর্ণতার আধারের সাথে অর্থাৎ মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর এ সম্পর্কই আল্লাহর সান্নিধ্য (قرب ) নামে পরিচিত।১৭ অতএব মানুষের প্রকৃত উৎকর্ষ বা পূর্ণতা,যা হল তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য,তা মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে ও তারই নৈকট্যের ছায়ায় অর্জিত হয়। আর যে ব্যক্তি এই কামাল বা উৎকর্ষের সর্বনিম্নস্তরে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় অর্থাৎ দুর্বলতম পর্যায়ের ঈমানও যার না থাকে তবে সে সেই বৃক্ষের মতই,যে বৃক্ষ এখনও ফলবতী হয়নি ও ফল প্রদান করেনি। আর যদি এ ধরনের বৃক্ষ মড়কের ফলে ফলপ্রদানের ক্ষমতা ও সার্মথ্য হারায়,তবে তা হবে নিষ্ফল বৃক্ষসমূহ থেকেও নিকৃষ্ট।

অতএব মানুষের কামাল বা পূর্ণতা ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের পথে ঈমানের ভূমিকা এ দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ববহ যে,মানুষের আত্মা বা রূহের মূলবিশেষত্বই হল মহান আল্লাহর সাথে সচেতন ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সম্পর্ক থাকা। আর এ সম্পর্ক ব্যতীত যথোপযুক্ত উৎকর্ষ ও তার প্রভাব থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যভাবে বলা যায় : কার্যক্ষেত্রে তার মনুষ্যত্ব লাভ হয় না। আর যদি স্বাধীনতার অপব্যবহারের ফলে এ রকম সমুনত যোগ্যতাকে বিনষ্ট করে তবে সে ভয়ংকরতম অত্যাচারের বোঝা স্বীয় স্কন্ধে ধারণ করল,যার ফলে সে অনন্ত শাস্তিতে পতিত হতে বাধ্য হবে। পবিত্র কোরান এ ধরনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলে :

) إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الَّذِينَ كَفَرُوا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ(

আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা কুফরী করে এবং ঈমান আনে না।(আনফাল -৫৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে,পূর্ণতা ও সুখ-সমৃদ্ধির অথবা অধঃপতন ও দুঃখ-দুর্দশার পথে ধাবিত হওয়ার দিক নির্ধারণ করে,যথাক্রমে ঈমান অথবা কুফর। স্বভাবতঃই (ঈমান ও কুফরের মধ্যে) যে কোনটি সর্বশেষে অবস্থান নেয়,তাই চূড়ান্ত ও ভাগ্য নির্ধারণী ভূমিকা রাখবে।

উদ্দীপক নিয়্যাতের ভূমিকা :

উপরোল্লিখিত নীতির আলোকে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,মানুষের ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের প্রকৃত মূল্য নির্ভর করে সত্যিকারের পূর্ণতা বা কামাল অর্জনের পথে অর্থাৎ মহান আল্লাহর নৈকট্যের পথে,ঐ গুলোর প্রভাব বা ভূমিকার উপর। যদিও ব্যক্তির কর্মকাণ্ডসমূহ প্রকারান্তরে (এমনকি একাধিক মাধ্যমান্তে) অপরের পূর্ণতার ক্ষেত্র প্রস্তত করে থাকে,তবে সেগুলো সুন্দর ও প্রকৃষ্টরূপে গুণান্বিত হলেও কর্তার অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঐ কর্মগুলোর ভূমিকা নির্ভর করে,তার আত্মার উৎকর্ষ সাধনের পথে তার কর্মকাণ্ডের প্রভাবের উপর ।

অপরদিকে বাস্তব কর্মকাণ্ডের সাথে কর্তার আত্মা বা রূহের সম্পর্ক,ইচ্ছা বা ইরাদার মাধ্যমে অর্জিত হয়,যা হল তার প্রত্যক্ষকর্ম। আর কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা,কর্মফলের প্রতি তার ঝোঁক,প্রবণতা ও আকর্ষণ থেকে জন্ম নেয় । এ প্রবণতা বা ঝোঁকই উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তার আত্মায় গতিসঞ্চার করে এবং কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছারূপে প্রজ্জোলিত হয়। অতএব ইচ্ছাধীন কর্মসমূহের মূল্য কর্তার ঝোঁক ও নিয়্যাতের অনুগামী এবং কর্মের সততা (حسن فعلی ) কর্তার সততা (حسن فاعلی ) ব্যতীত আত্মার উৎকর্ষ ও অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে না। আর এ জন্যেই,যা বস্তুগত ও পার্থিব উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হয়,অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধির পথে তা কোন ভূমিকা রাখবে না এবং সামাজিক কল্যাণে বৃহত্তম কর্মতৎপরতাও যদি আত্মম্ভরিতাহেতু চালানো হয়,তবে পরকালে কর্তার জন্যে তা ন্যূনতম লাভও বয়ে আনবে না । ৮০ বরং তার জন্যে ক্ষতিকর ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে। এ কারণেই পবিত্র কোরান পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির পথে সৎকর্মের প্রভাবকে ঈমান ও স্রষ্টার নৈকট্যলাভের আশা করার শর্তাধীন বলে উল্লেখ করেছে ।১৮

و اراد وجه الله و ابتغاء مرضات الله

অর্থাৎ আল্লাহর জন্যে ইরাদা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে প্রচেষ্টা।’

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,প্রথমতঃ সৎকর্ম,অপরের কল্যাণ সাধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দ্বিতীয়তঃ অপরের কল্যাণ সাধনও ব্যক্তিগত ইবাদতের মত তখনই চূড়ান্ত উৎকর্ষ ও অনন্ত সুখ-সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে যখন ঐশী উদ্দেশ্য থেকে উৎসারিত হবে।

১৭তম পাঠ

কর্ম নিষ্ফল হওয়া ও পাপমোচন

ভূমিকা :

পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির সাথে ঈমান ও সৎকর্মের সম্পর্ক এবং অপরদিকে অনন্ত দুঃখ-দুর্দশার সাথে কুফর ও গুনাহের সম্পর্ক”শিরোনামে যে বিষয়টি আলোচিত হয় তা হল : পরকালীন ফলাফলের সাথে ঈমান ও কুফরের প্রতি মুহূর্তের সম্পর্ক,অনুরূপ পুরস্কার ও শাস্তির সাথে সকল সুকর্ম ও দুষ্কর্মের সম্পর্ক কি চূড়ান্ত,অপরিবর্তনীয় ও স্থায়ী,না কি পরিবর্তনশীল? যেমন : পাপাচারের কুফলকে,সুকর্মের মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়া যায় কি? কিংবা বিপরীতক্রমে সুকর্মের সুফল পাপাচারের মাধ্যমে বিনষ্ট হতে পারে কি ? যদি কেউ জীবনের কিছু অংশ কুফর,পাপাচারে এবং কিছু অংশ ঈমান ও আনুগত্যের পথে অতিবাহিত করে,তবে কি সে কিছু সময় শাস্তি ভোগ করবে,আবার অপর কিছু সময় পুরস্কারের অধিকারী হবে? কিংবা এ দুয়ের সম্মিলিত চূড়ান্ত ফলাফলের মাধ্যমেই কি অনন্ত জীবনে মানুষের সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য নির্ধারিত হয় ? না কি এর ব্যতিক্রম কোন বিষয় ?

প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টি হল তা-ই, যা হাবিত ও তাকফির ১৮ নামে যুগ যুগ ধরে আশয়ারী ও মো তাযেলী কালমশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে আলাপ-আলোচনার বিষয় বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। আমরা এখানে শিয়া মতবাদের দৃষ্টিকোণে এ বিষয়টি সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করব ।

ঈমান কুফরের সম্পর্ক :

পূর্ববর্তী পাঠসমূহ থেকে আমরা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি যে,কোন সুকর্মই মৌলিক বিশ্বাসসমূহের উপর আস্থা স্থাপন ব্যতীত,অনন্তঃ সুখ-সমৃদ্ধির কারণ হতে পারে না। অন্য কথায় : কুফর,পুণ্যকর্মসমূহের নিষ্ফলতার কারণ। এখানে উল্লেখ করব যে,জীবনের শেষার্ধে যদি কেউ ঈমান আনে,তবে তা পূর্বকত কুফরীর সকল কুপভাব মোচন করে এবং উজ্জল-দীপ্তিময় শিখার মত পূর্বের্র সকল অমানিশাকে বিদূরিত করে। বিপরীতভাবে সর্বশেষে কৃত কুফর,পূর্বকৃত ঈমানের সকল সুফলকে বিনষ্ট করে এবং ব্যক্তির জীবনের সকল পাতাগুলোকে কালো ও দুর্ভাগ্যের তিমিরে পরিণত করে,আর খড়ের স্তপে পতিত অগ্নিস্তফুলিংগের মত সর্বস্ব ভস্মিভূত করে। উদাহরণস্বরূপ : ঈমান উজ্জল দীপের মত অন্তরাত্মার ঘরকে উজ্জল-দীপ্তিময় করে তুলে এবং অন্ধকার ও তিমিরকে হৃদয় গহ্বর থেকে দূরীভূত করে। অপরদিকে কুফর সে নির্বাপিত দীপের মতই যা আলোর অবসান ঘটিয়ে অন্ধকারের সূচনা করে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানবাত্মা এ পরিবর্তনশীল ও বস্তুগত বিশ্ব ও অস্থিতিশীল অবস্থার সাথে সম্পর্কিত থাকবে,ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বদা অন্ধকার ও আলোর তীব্রতা ও ক্ষীণতার সীমায় অবস্থান করবে। আর এ অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকবে,যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এ ক্ষণস্থায়ী আবাসস্থল ছেড়ে পরপারে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হবে এবং ঈমান ও কুফরের পথ তার জন্যে বন্ধ হবে। তখন সে যতই পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে এসে অন্ধকার থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা করুক না কেন,তা তার কোন উপকারে আসবে না । [ পাঠ- ৪৯ দ্রষ্টব্য ] পবিত্র কোরানের মতে ঈমান ও কুফরের এ পারস্পরিক প্রভাব সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই এবং পবিত্র কোরানের অসংখ্য আয়াত এ বিষয়ের স্বপক্ষেই সাক্ষি প্রদান করে। যেমন :

) وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ(

যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে,তিনি তার পাপ মোচন করবেন। (তাগাবুন-৯)

অপর এক আয়াতে বলা হয় :

) وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ(

তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন হতে ফিরে যায় এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারী রূপে মৃত্যু মুখে পতিত হয়,ইহকাল ও পরকালে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। তারাই অগ্নিবাসী,সেখানে তারা স্থায়ী হবে। (বাকারা- ২১৭)

সুকর্ম ও দুষ্কর্মের সম্পর্ক :

ঈমান ও কুফরের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মত সুকর্ম ও দুষ্কর্মের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের উদাহরণও বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তা সামগ্রিকভাবে নয় এবং এ রূপে নয় যে,হয় মানুষের আমলনামায় সর্বদা সৎকর্মসমূহ লিপিবদ্ধ হয় ও পূর্ববর্তী অপকর্মসমূহ মুছে যায় অথবা সকর্ল অপকর্মসমূহ লিপিবদ্ধ হয় ও পূর্ববর্তী সকল সৎকর্ম মুছে যায় (যেমনটি কোন কোন মো তাযেলী কালামশাস্ত্রবিদগণ মনে করেছেন)। কিংবা এ রকমটিও নয় যে,সর্বদা পূর্ববর্তী কর্মসমূহের গুণ ও মানের আলোকে মোট চূড়ান্ত ফল তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয় (যেমনটি অপর কেউ কেউ মনে করেছেন)। বরং মানুষের আমলের বিষয়টিকে আরও সূক্ষ্ণ ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করতে হবে। অর্থাৎ কোন কোন সৎকর্ম (যদি সঠিক ও কাঙ্খিত রূপে সম্পন্ন করা হয়) পূর্ববর্তী সকল অপকর্মের ফলাফলকে দূরীভূত করে। যেমন : তওবাহ যদি কাঙ্খিতরূপে সম্পাদন করা হয়,তবে ব্যক্তির পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।১৮ ঠিক আলোকচ্ছটার মত সরাসরি অন্ধকার বিন্দুতে আলোকবিম্ব ফেলে ও আলোকিত করে। কিন্তু সকল সৎকর্মই সকল প্রকার পাপাচারের কুফলকেই দূরীভূত করে না। ফলে এ দৃষ্টিকোণ থেকে মু মিন ব্যক্তি পরকালে একটি বিশেষ সময় ধরে শাস্তি ভোগ করার পর,পরিশেষ চিরন্তন বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারে। যেন মানবাত্মার একাধিক দিক বিদ্যমান এবং প্রত্যেক শ্রেণীর কর্মকাণ্ড,সুকর্ম ও কুকর্ম এর বিশেষ নীতি-কৌশলের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন : ক’নীতি-কৌশলের সাথে সংশ্লিষ্ট সৎকর্ম, খ’নীতি-কৌশলের সাথে সংশ্লিষ্ট পাপাচারের কুফলকে বিনষ্ট করে না,যদি না সৎকর্ম এতটা জ্যেতির্ময় হয় যে,আত্মার অপরাপর অংশেও বিচ্ছুরিত হয় কিংবা পাপ এতটা কলুষতা’সৃষ্টিকারী হয় যে,অপরাপর অংশকে ও কলুষিত করে। উদাহরণতঃ হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে,গ্রহণযোগ্য নামায,পাপাসমূহকে ধৌত করে এবং পাপ ক্ষমার কারণ হয়। পবিত্র কোরানে বলা হয় :

) وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ(

সালাত কায়েম করিবে দিবসের দুই প্রান্ত ভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে । সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়।(হুদ-১১৪)

পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও মদপানের মত কিছু কিছু পাপকর্ম নিদির্ষ্ট সময়ের জন্যে ইবাদত কবুলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কিংবা কারও প্রতি অনুগ্রহ করার পর তাকে ছোট করার ফল্রে ঐ কর্মের সুফল বিনষ্ট হয়ে যায়। যেমনটি পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে :

) لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى(

দানের কথা প্রচার করে এবং ক্লেশ দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে নিষ্ফল করনা। (বাকারা-২৬৪)

কিন্তু সৎকর্ম ও দুষ্কর্মের পারস্পরিক প্রভাবের প্রকৃতি ও পরিমাণ সম্পর্কে ওহী ও মাসূমগণের (আ.) মাধ্যমে অবগত হতে হবে এবং এগুলোর প্রত্যেকটি সম্পর্কে কোন সাধারণ নিয়ম নির্ধারণ করা যায় না ।

সর্বশেষে এতটুকু বলার অবকাশ থাকে যে,সৎকর্ম ও অসৎকর্ম কখনো কখনো এ পার্থিব জগতেই সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের অথবা অপর কোন কর্ম সম্পাদনের সামর্থ্য লাভ ও সামর্থ্য হারানোর কারণ হয় । যেমন : অপরের প্রতি দয়াদ্র হওয়া,বিশেষ করে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার,দীর্ঘায়ু লাভের ও রোগ-বালাই দূর হওয়ার কারণ হয়। অপরদিকে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের বিশেষ করে ওস্তাদ ও শিক্ষকমণ্ডলীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন,সামর্থ্য হারানোর কারণ হয়। কিন্তু এর প্রভাবের ফল চূড়ান্ত পুরস্কার ও শাস্তি লাভার্থে নয়। পুরস্কার ও শাস্তি লাভের প্রকৃত স্থান হল অনন্ত ও চিরন্তন জগৎ।