শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস16%

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 18574 / ডাউনলোড: 5283
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

৩৯। অত্যাচারীদের সাথে অসহযোগিতা করা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

যেহেতু জুলুম ও অত্যাচার সবচেয়ে বড় পাপ ও বিচ্যুতি এবং এর পরিণামও অত্যন্ত কুৎসিত তাই মহান আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে সাহায্য করা ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন-

অত্যাচারীদের সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা করো না। তাহলে আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। মহান আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু নেই এবং কেউই তোমাদেরকে সাহায্য করবে না। (সূরা হুদ - ১১৩)

অত্যাচারীদেরকে ঘৃণা করা এবং সাহায্য ও সহযোগিতা করা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে এটাই হলো কোরআন ও আহলে বাইতের (আ.) প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। তাদেরকে শক্তিশালী করা ,তাদের অত্যাচারে অংশগ্রহণ করা ,তাদেরকে সাহায্য করা বর্জনীয় এমনকি খোরমার অর্ধাংশ পরিমাণও। ইমামগণ (আ.) থেকে এমন অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল অত্যাচারীদের সহযোগিতা করা এবং তাদের কুকর্মকে না দেখা। তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ,এমনকি তাদের সাথে আন্তরিকভাবে মেলামেশা করতেও তারা কুন্ঠিত হয়নি। তাদের জুলুম-অত্যাচারেও তারা সহযোগিতা করেছিল। সত্যিই কতটা অপরাধ ,কলুষতা ও সত্য থেকে বিচ্যুতি মুসলমান সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল! আর এর বিষাক্ত প্রভাবে ধীরে ধীরে মুসলমানরা দুর্বল হয়েছে ও তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। অদ্য মুসলমানদের অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে ,দ্বীন ইসলামের পরিচয় মুছে গিয়েছে। এমন মুসলমান কিংবা মুসলমান নামধারীরা এবং যারা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে ,তারা মহান আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতার অধিকারী হতে পারে না। তারা আল্লাহর সাহায্য থেকে আজ যখন এমনভাবে বঞ্চিত হয়েছে যে ইহুদিদের মত দুর্বলতম নিকৃষ্টতম শত্রু ও অত্যাচারীদের মোকাবেলা করতেও অপারগ তখন শক্তিশালী ক্রুশধারীদের মোকাবেলার কথাতো বলাই বাহুল্য।

যে সকল কর্মকাণ্ড অত্যাচারীদের সাহায্যের কারণ হত পবিত্র ইমামগণ (আ.) যথাসাধ্য তাদের শীয়া বা অনুসারীদেরকে তা থেকে দূরে থাকতে বলতেন। আর কঠোরভাবে তাদের বন্ধুদেরকে অত্যাচারীদের প্রতি ন্যূনতম সহযোগিতা ও সখ্যতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করতেন। এ সম্পর্কে তাদের অগণিত বক্তব্য রয়েছে।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর বক্তব্য এ প্রসংগে উল্লেখ করা যেতে পারে। মোহাম্মদ ইবনে মোসলেম যাহরীর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি তাকে অত্যাচারীদের অত্যাচারের সহযোগিতা হয় এমন কর্ম পরিহার করার কথা বলতে গিয়ে বলেন-

ওহে তোমাকে কি তারা এজন্য নিমন্ত্রণ করেনি যে ,তোমাকে তাদের জুলুমের যাতার কেন্দ্রকাঠি বানাবে ,তাদের মন্দ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তোমাকে পুল বানাবে ,পথভ্রষ্টার দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য সিঁড়ি বানাবে এবং তাদের জুলুমের আহবায়ক ও প্রচারক বানাবে ?তারা তোমাকে তাদের মাঝে নিয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের হৃদয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। আর তোমার দ্বারা অজ্ঞদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। তাদের কুকর্মকে সুকর্ম হিসেবে প্রচার করেছে এবং নিজেদের দিকে বিশেষ ও সাধারণ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তোমাকে ব্যবহার করে। এমনটি তাদের অতি নিকটবর্তী মন্ত্রী ও শক্তিশালী সহযোগীর থেকেও পায়নি। তুমি যা পেয়েছ তা ,যা তুমি দান করেছ তদপেক্ষা অতি সামান্য। এটি অতি সামান্য তার তুলনায় যে পরিমাণ অশ্লীলতা তোমার মাধ্যমে তারা বপন করেছে। তোমার নিজের কথা ভাব। কারণ তুমি ব্যতীত কেউই এ সম্পর্কে ভাববে না। নিজেকে এমনভাবে হিসাবের কাঠগড়ায় দাড় করাও যেমনভাবে একজন দায়িত্বশীল ও দায়িত্ব পরায়ণ ব্যক্তি হিসাব করে থাকে।

এই যে শেষ বাক্যটি নিজেকে এমনভাবে হিসাবের কাঠগড়ায় দাড় করাও যেমনভাবে একজন দায়িত্বশীল দায়িত্ব পরায়ণ ব্যক্তি হিসাব করে থাকে একটি বৃহৎ কথা। কারণ যখন কুপ্রবৃত্তি মানুষের উপর জয়লাভ করার পর কোন ব্যক্তি স্বয়ং নিজেকে অতি ছোট ও মূল্যহীন দেখতে পায়। অর্থাৎ নিজেকে স্বীয় কর্মের জন্য দায়ী মনে করে এবং অনুধাবন করে যে এর জন্য তাকে হিসাব দিতে হবে। এ ধরনের পন্থা অবলম্বনের রহস্য হলো তার নফসে আম্মারা।

অতএব ,ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এখানে যা বুঝাতে চেয়েছেন তা হলো যাহরীকে এ আত্মিক রহস্য সম্পর্কে অবহিত করা যা সর্বদা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে ,যাতে তার উপর খেয়াল খুশী চেপে না বসে আর সে তার দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যূত হয়।

উপরে বর্ণিত বিষয়ে আরো অধিক শক্তিশালী বর্ণনা হলো উটের অধিকারী সাফবানের সাথে ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) এর কথোপকথন। সাফবান ছিলেন সপ্তম ইমামের (আ.) অনুসারী এবং হাদীসের বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী যিনি হযরত (আ.) থেকে হাদীস বর্ণনা করতেন।

কাশশী কর্তৃক লিখিত সাফবানের জীবনীতে কথোপকথনটি নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে-

ইমাম : হে সাফবান ! তোমার সমস্ত কর্মকাণ্ডই উত্তম কেবলমাত্র একটি কাজ ব্যতীত।

সাফবান : আপনার জন্য উৎসর্গিত হব ঐ কাজটি কী ?

ইমাম : এই যে নিজের উটগুলোকে হারুনুর রশিদকে ভাড়া দাও।

সাফবান : আল্লাহর কসম! আমি আমার উটগুলোকে কোন হারাম ও বাতিল কর্মকাণ্ড বা শিকার ও আরাম-আয়াশের জন্য ভাড়া দেই না। বরং মক্কার পথ অতিক্রম করার জন্য ভাড়া দিয়েছি। আমি নিজেও তার সাথে যাইনা। আমার গোলামদেরকে পাঠাই।

ইমাম : ওহে সাফবান! তোমার ভাড়া পরিশোধের শর্ত কি তার ফিরে আসার শর্তসাপেক্ষ ?

সাফবান : আপনার জন্য উৎসর্গ হব। জী হ্যাঁ।

ইমাম : তুমি কি পছন্দ কর না সে জীবিত ফিরে আসুক ,যাতে তোমার ভাড়ার টাকা তোমার নিকট পৌছে ?

সাফবান : জী- হ্যাঁ।

ইমাম : যদি কেউ তাদের জীবিত থাকা পছন্দ করে ,সে তাদের দলভূক্ত এবং জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে।

সাফবান : আমি ফিরে গিয়ে আমার সব উটগুলোকে একবারে বিক্রি করে দিলাম।

হ্যাঁ ,যেখানে কেবলমাত্র অত্যাচারীর জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছা পোষণ করা পর্যন্ত গুনাহ বলে পরিগণিত হয় ,সেখানে এটা পরিষ্কার যে ,যারা নিয়মিত জালিমদেরকে সাহায্য করে ,তাদের জুলুম ও অত্যাচারকে স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের অবস্থা কী হবে ?সেখানে যারা তাদের কর্মকান্ডের অংশীদার তাদের কথাতো বলাই বাহুল্য।

৪০। অত্যাচারী শাসকদের শাসনতন্ত্রে কাজ না নেয়ার ব্যাপারে আমাদের কর্তব্য :

যেমনটি আমরা পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আলোচনা করেছিলাম যে ,যখন অত্যাচারীকে খোরমার অংশবিশেষ পরিমাণ সহযোগিতা করা এবং এমনকি তাদের জীবিত থাকাটা পছন্দ করা ও পবিত্র ইমামগণ (আ.) কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছে। তখন এ ধরনের শাসনতন্ত্রে অংশ গ্রহণকারী এবং বিভিন্ন মর্যাদা ও পদ গ্রহণকারীর অবস্থাতো বলাই বাহুল্য।

তদুপরি যারা এ ধরনের হুকুমত গড়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে এবং উক্ত হুকুমতকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে তাদের অবস্থাও সুষ্পষ্টতর। কারণ যেমনটি ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন-

জালিমদের শাসনতন্ত্র সকল সত্য বিধান ধ্বংস হওয়ার কারণ এবং বাতিলকে জীবিত করা আর অত্যাচার ও অশ্লীলতা প্রকাশের কারণ।

তবে কোন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে ইমামগণ (আ.) এ ধরনের পদ গ্রহণ করাকে জায়েয মনে করেছেন। যে সকল ক্ষেত্রে অত্যাচারী শাসকের শাসনতন্ত্র পদ নেয়ার ফলে ন্যায়পরায়ণতা এবং বিচার প্রতিষ্ঠা ও মূমিনদের কল্যাণ করা যায় ,আর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার পথ সুগম হয় সে ক্ষেত্রে তা জায়েয।

এ প্রসংগে পবিত্র ইমামগণ (আ.) থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেখানে এধরনের হুকুমতের পদাধিকারীদের জন্য সঠিক পথের সুষ্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। যেমন- আহবাযের শাসক আব্দুল্লাহ নাজ্জাশীর নিকট ইমাম সাদিকের চিঠি ওয়াসায়েলুশশিয়া নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। মরহুম হোররি আমলীর উক্ত গ্রন্থের কিতাবুল বেঈ এ ৭৭ নং অধ্যায়ে এ চিঠিটি বর্ণিত হয়েছে। ১০

৪১। ইসলামী ঐক্যের আহবান সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

ইসলামের মাহাত্ত্ব ও একে অক্ষত রাখার ব্যাপারে কঠোর ইচ্ছার ক্ষেত্রে আহলে বাইতগণ (আ.) বিখ্যাত ছিলেন। তারা মানুষকে ইসলামের সম্মান ,মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করতে এবং নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার শত্রুতা ও হিংসা বিদ্বেষ অন্তর থেকে দূর করতে আহবান করতেন।

আমীরুল মূমিনীন হযরত ইমাম আলীর (আ.) সাথে পূর্ববর্তী খলিফাদের আচরণ ভুলে যাওয়ার মত নয়। যদিও ঐ মহাত্মা নিজেকে খেলাফতের অধিকারী মনে করতেন এবং তাদেরকে খেলাফত হরণকারী বলে জানতেন। তথাপি ইসলামী ঐক্য রক্ষার জন্য তাদের সাথে তিনি সম্পর্ক রক্ষা করতেন। এমনকি তিনি যে রাসূল (সা.) কর্তৃক খেলাফতের নিযুক্ত হয়েছিলেন তা তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রকাশ ও বর্ণনা করেননি। কেবলমাত্র যখন হুকুমত তার কাছে এসেছে তখন বর্ণনা করেছেন। আর রাহবাহ নামে খ্যাত দিবসে যেদিন রাসূল (সা.) এর ঐ সকল জীবিত সাহাবীদের নিকট সাক্ষী চেয়েছিলেন যারা গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) কর্তৃক তার নিযুক্তির ঘটনা দেখেছেন এবং শুনেছেন যাতে তারা তার নিযুক্তির বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন।

হযরত আলী (আ.) যা কিছু ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য লাভজনক ও কল্যাণকর ,তা তার পূর্ববর্তী খলিফাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করতেন না। যেমনটি তিনি তার এক খোতবায় তার সময়কালের পূর্বের হুকুমত সম্পর্কে ইশারা করেছেন। তিনি বলেন-

যদি ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সাহায্য না করি তবে আমার ভয় হচ্ছিল যে ইসলামে ফাঁটল ধরবে ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে।

যেমন হযরত আলীর (আ.) পূর্ববর্তী খলিফাদের খেলাফতের সময়কালে তার (আ.) পক্ষ থেকে কথায় ও কর্মে কখনোই এটা পরিদৃষ্ট হয়নি যে ,তিনি তাদের খেলাফতকে দুর্বল করতে চেয়েছেন কিংবা ক্ষতি করতে চেয়েছেন। যদিও তিনি খলিফাদের কর্মকান্ডের প্রতি নজর রাখতেন তথাপি স্বীয় অন্তরাত্মার উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে গৃহকোণে আসন গ্রহণ করেছিলেন। তার এ সকল নিরবতা ও নিয়ন্ত্রণ একমাত্র এ জন্যই ছিল যে ,বিশ্বজনীন ইসলাম রক্ষা পায় কিংবা এজন্য যে ,ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্যের প্রাসাদের কোন ক্ষতি না হয় বা তা বিনষ্ট না হয়। হযরতের (আ.) এ বিবেচনার ব্যাপারটি সকলেই বুঝত। আর তাই ওমর ইবনে খাত্তাব প্রায় বলতেন-

এমন কোন সমস্যায় পড়িনি যেখানে আবুল হাসান (আ.) (আলী) ছিলেন না এবং সমাধান দেননি।

কিংবা বলতেন-

যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।

ইমাম হাসান (আ.) এর অনুসৃত পদ্ধতি ভুলে যাওয়ার মত নয় যে কিরূপে তিনি ইসলামকে রক্ষা করার জন্য মোয়াবিয়ার সাথে চুক্তি করেছিলেন। কারণ তিনি দেখলেন যে যুদ্ধের পীড়াপিড়ি মহান আল্লাহর অতি ভারী বস্তু কোরআন ও ইসলামী হুকুমত অর্থাৎ সত্যিকারের ইসলাম বিলুপ্ত হত ,এমনকি চিরতরে ইসলামের নাম পর্যন্ত মুছে যেত। আর তাই তিনি ইসলামের ইমারত ও নাম রক্ষাকে যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যদিও দ্বীন ও মুসলমানদের কুখ্যাত শত্রু এবং হযরতের (আ.) প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী শত্রু মোয়াবিয়ার সাথে এ চুক্তির ফলে বনি হাশেমও ইমামের (আ.) অনুসারীরা উন্মুক্ত তরবারী নিয়ে খিমা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং অধিকার না নিয়ে খিমায় ফিরতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষাই ছিল ইমাম হাসান (আ.) এর নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেয়।

কিন্তু ইমাম হুসাইনের (আ.) পদ্ধতি ছিল ইমাম হাসানের (আ.) ব্যতিক্রম। তিনি আন্দোলন করেছিলেন। কারণ তিনি দেখলেন যে ,বনি উমাইয়্যার হুকুমত এমন পথে যাচ্ছে যদি এভাবে এগুতে থাকে এবং কেউ যদি তাদের কুকর্মগুলো প্রকাশ না করে দেয় ,তবে তারা ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলবে এবং ইসলামের মাহাত্ত্বকে নষ্ট করে ফেলবে। আর এ কারণেই বনি উমাইয়্যার জুলুম-অত্যাচারকে ও শত্রুতাকে ইতিহাসের পাতায় লেপন করে দিয়েছেন। আর তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন যার ফলে নিশ্চিতরূপেই ঘটনা প্রবাহ সেদিকেই প্রবাহিত হয়েছিল যেদিকে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) চেয়েছিলেন।

যদি তার পবিত্র সংগ্রাম ও আন্দোলন না থাকত তবে ইসলাম এমনভাবে মুছে যেত যে ইতিহাস এ দ্বীনকে বাতিল ধর্ম বলে বিবেচনা করত।

ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় শীয়ারা যে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার বিপ্লবের কথা প্রতিবছর বিভিন্নভাবে স্মরণ করতে আগ্রহী হয় তার কারণও এটাই। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা চায় একদিকে জুলুম ও অত্যাচারকে নির্মূল করতে ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জাগ্রত করতে ,অপরদিকে হুসাইনী আশুরাকে স্মরণ করার ব্যাপারে ইমাম হুসাইনের (আ.) পরের ইমামগণের (আ.) আদেশের আনুগত্য করতে।

বিশ্বে ইসলামের মাহাত্ত্বকে অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে আহলে বাইতগণের (আ.) আগ্রহ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর জীবনালেখ্য সুষ্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যদিও তিনি তাদের ঘোরতর দুশমনদের রাজত্বে বসবাস করতেন। কারণ হযরত সাজ্জাদ (আ.) তার পরিবারবর্গের উপর সীমাহীন লাঞ্ছনা ,গঞ্ছনা সত্বেও কারবালার বেদনা বিধূর ঘটনা এবং তার বংশধর ও পিতার সাথে কৃত বনি উমাইয়্যার স্বেচ্ছাচারী আচরণের ব্যাপারে শোক প্রকাশ করতেন। তদুপরি তিনি নিরবে নির্জনে এবাদত করতেন ও মুসলিম সেনাদের বিজয় ,ইসলামের সম্মান ,নিরাপত্তা ও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। ইতিপূর্বেও আমরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে ,ইসলামের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইমাম সাজ্জাদের (আ.) একমাত্র অস্ত্র ছিল দোয়া। কারণ হযরত সাজ্জাদ (আ.) দোয়ার মাধ্যমেই তার অনুসারীদেরকে শিখিয়েছিলেন যে ,কিরূপে ইসলামী সেনা ও মুসলমানদের জন্য দোয়া করতে হবে।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার সাতাশ নম্বর দোয়ায় সীমান্তরক্ষীদের দোয়া ’ নামে একটি দোয়ায় এরূপ বলেন-

প্রভু হে! মোহাম্মদ (সা.) ও তার আহলের (আ.) প্রতি দূরুদ প্রেরণ কর এবং তাদেরকে (সীমান্ত রক্ষীদেরকে) সংখ্যায় অধিক কর। অস্ত্রের (মোকাবেলায়) তাদেরকে বিজয় দান কর। তাদের রক্ষিত প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা কর। শত্রুদের অনিষ্ঠ থেকে তাদের ভূখণ্ডকে রক্ষা কর। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব দান কর। তাদের বিষয় আশয়কে স্বীয় করুণায় পূর্ণ কর। তাদের সহায়ক শক্তিকে অবিরামভাবে প্রেরণ কর। একমাত্র তুমিই তাদের খরচাদির দায়িত্ব নাও। আর তোমার সাহায্য দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী কর। ধৈর্য ও স্থৈর্য দান করার মাধ্যমে কৌশলের শিক্ষা দিয়ে তাদেরকে দয়া কর।

অতঃপর কাফেরদেরকে অভিশাপ দিয়ে এরূপ বলতে থাকেন-

হে আল্লাহ! হে প্রভু! তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী কর (অর্থাৎ মুসলমানদের শহরগুলোকে ইসলামের সৈন্যদের মাধ্যমে রক্ষা কর) ,আর তাদের ধন সম্পদ উত্তর উত্তর বৃদ্ধি কর ,তোমার বন্দেগী ও এবাদতের ফলে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে তাদেরকে মুখাপেক্ষীহীন কর ,শত্রুদের সাথে লড়াই করা থেকে তাদেরকে মুক্তি দাও যাতে শান্তিমত তোমার এবাদতে মশগুল হতে পারে ,যাতে করে পৃথিবীতে তোমার এবাদত ব্যতীত তাদের আর কোন কাজ না থাকে এবং তাদের মস্তক তোমা ব্যতীত আর কারো জন্য যেন মাটিতে রাখতে না হয়।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তার এ সুদীর্ঘ ও সাহিত্যমান সমৃদ্ধ শ্রুতিমধুর দোয়ায় ইসলামের সৈন্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করেছেন যাতে তারা চারিত্রিক মূল্যবোধের অধিকারী হবে এবং তারা পরিপূর্ণ দৃঢ়তার সাথে শত্রুদের মোকাবিলা করে। হযরত (আ.) এ দোয়ার বিষয়বস্তুতে ইসলামের সমর শিক্ষা এবং এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। আর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের সময় রণকৌশল ও সমর নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেন যে ,যুদ্ধের সকল পর্যায়ে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। আর তারা একমাত্র আল্লাহর জন্যই যুদ্ধ করবে। একথা যেন কখনোই ভুলে না যায়। অন্যান্য ইমামগণের (আ.) নীতি তাদের সময়কালের শাসকদের মোকাবেলায় এরূপই ছিল যদিও তাদেরকে সর্বদা শত্রুদের অত্যাচার এবং নিষ্ঠুর ও চরম দূর্ব্যবহার মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারলেন সত্যিকারের শাসন ভার তাদের নিকট ফিরে আসবে না তখন ধর্মীয় শিক্ষা ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণদানে আত্ম নিয়োগ করেছেন এবং তাদের অনুসারীদেরকে সমুন্নত প্রতিষ্ঠান ও মাযহাব সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন।

কিন্ত এখানে একটি বিষয় স্মরণ করতে হবে যে ,ইমামগণের (আ.) সমসাময়িক আলাভী ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে যে আন্দোলন ও বিপ্লবের প্রচেষ্টা হয়েছিল তা তাদের (আ.) ইচ্ছা বা অনুমতি মোতাবেক হয়নি। বরং স্পষ্ঠতঃ এগুলো তাদের আদেশ ও ইচ্ছার পরিপন্থী ছিল। কারণ ইমামগণ (আ.) ইসলামী হুকুমতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে অন্য সকলের চেয়েও অধিক এমনকি বনি আব্বাস থেকেও বেশী সচেষ্ট ছিলেন।

আমাদের এ বক্তব্যের স্বপক্ষে শিয়াদের প্রতি ইমাম মূসা ইবনে জাফরের (আ.) ওসীয়ত তুলে ধরব যেখানে তিনি বলেন-

বাদশাহদের আনুগত্য পরিহার করে নিজেদেরকে হীন করো না। যদি ঐ বাদশারা ন্যায়পরায়ণ হয় তবে তাদের টিকে থাকাটা কামনা করো ;আর যদি অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী হয় তবে আল্লাহর কাছে তার জন্য সংশোধন কামনা করো। কারণ তোমাদের কল্যাণ ,তোমাদের বাদশাদের কল্যাণের সাথে জড়িত। আর ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ দয়ালু পিতার মত। সুতরাং তোমরা তোমাদের জন্য যা পছন্দ কর তাদের জন্য তা পছন্দ কর। আর তোমাদের জন্য তোমরা যা পছন্দ কর না তা তার জন্যও পছন্দ কর না। ১১

আর এটিই ছিল দেশ রক্ষার জন্য বাদশাহদের সুস্থতা কামনার জন্য আদেশ দেয়ার কারণ। কিন্তু ইদানিং কালের কোন কোন লেখক বড় ধরনের খিয়ানত করে চলেছে। তারা তাদের লেখায় শিয়াদেরকে এক গোপন ধ্বংসাত্মক দল বলে উল্লেখ করেছে। কত বড় খেয়ানত এ ধরনের লেখকরা করছে ?

এটাই সঠিক যে ,মুসলমান মাত্রই যারা নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে আহলে বাইতের (আ.) অনুসরণ করে তারা অত্যাচারী শত্রুদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। স্বেচ্ছাচারী ,অন্যায়কারী ,পাপচারীর সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল না ;তারা অত্যাচারীদেরকে (কিছু কিছু ভাল কর্মে) সহযোগিতা করলেও তাদের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দার দৃষ্টিতে তাকায় ;আর বংশপরম্পরায় সর্বদা এ কৌশল অবলম্বন করে চলে। কিন্তু এ ধরনের আচরণের অর্থ এ নয় যে ,শিয়াদেরকে ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতারক বলে জানতে হবে। কারণ কখনোই শিয়াদের কৌশল এ নয় যে ,ইসলামের নামে যে হুকুমত মানুষের উপর রাজত্ব করে চলছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে কিংবা তার বদনাম করবে। গোপনে বা প্রকাশ্যে শিয়ারা কোনভাবেই মুসলিম জনগণকে গাফেল করাটা সমীচীন মনে করে না। ঐ মুসলমানদের মাযহাব বা পথ যা-ই হোক না কেন তা শিয়াদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তারা এ পন্থা স্বীয় ইমামগণ (আ.) থেকেই শিখেছে।

তাদের দৃষ্টিতে সকল মুসলমানের যারা আল্লাহর কিতাবসমূহ ও ইসলামের নবীর (সা.) নবুওয়াতকে স্বীকার করে তাদের ধন সম্পদ ,মালিকানা ,রক্ত ,ইজ্জত সবকিছু জবরদখলের হাত থেকে নিরাপদ। কোন মুসলমানের সম্পদ ভোগ করাই শীয়াদের দৃষ্টিতে বৈধ নয় তার অনুমতি ব্যতীত। কারণ মুসলমানরা ইসলামের দৃষ্টিতে পরস্পরের ভাই। সুতরাং তারা তাদের ভাইয়ের অধিকার সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করবে যার আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে।

8। আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসঃ

আমরা বিশ্বাস করি যে ,আল্লাহর একটি হ্যাঁ-বোধক পূর্ণতাগুণ হলো- তিনি সকল অন্যায়ের মোকাবেলায় ন্যায়পরায়ণ। তিনি ন্যায়পরায়ণতা ব্যতীত তার সৃষ্টিকে লালন করেন না। তিনি ক্রোধভরে শাসন করেন না। তিনি তার অনুগতকে পুরস্কৃত করেন। পাপীদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। তিনি তার বান্দাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে অধিক দায়িত্ব প্রদান করেন না। তাদের পাপের ফলে প্রাপ্ত শাস্তির অধিক কোন শাস্তি তিনি তাদেরকে প্রদান করেন না।

আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ সুকর্ম সাধন থেকে বিরত থাকেন না। তিনি কখনো কুৎসিত কর্ম করেন না। কারণ ,তিনি তার জ্ঞানের কারণে সুকর্ম সাধন করতে সক্ষম ও কুৎসিত কর্ম করা থেকে বিরত থাকতে সক্ষম। অসীম জ্ঞানের আলোকে সুকর্মের সুদিক ও কুৎসিত কর্মের কুদিক তার নিকট স্পষ্ট। তিনি সুকর্ম করতেও সক্ষম আবার কুৎসিত কর্ম করতেও সক্ষম। যেহেতু কোন সুকর্মই তার কাজের কোন ক্ষতি করতে পারে না তাই তার তা ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে কোন কুৎসিত কর্মই তার প্রয়োজন হয় না। তাই তিনি তা করতে বাধ্য হন না। মহান আল্লাহ হলেন প্রজ্ঞাবান ,সুতরাং তার কর্মকাণ্ড কখনোই তার প্রজ্ঞা বহির্ভূত হয় না এবং তা সর্বোত্তম কল্যাণময় পন্থায় সম্পন্ন হয়।

সুতরাং যদি তিনি অন্যায় ও কুৎসিত কর্ম সম্পাদন করেন (প্রকৃতপক্ষে তিনি এগুলো থেকে পবিত্র) তবে তা নিম্নলিখিত চারটি কারণে হবে-

1। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে এর কুৎসিত দিক সম্পর্কে অনবহিত।

2। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু কাজটি করতে বাধ্য এবং তা ত্যাগ করতে অপারগ।

3। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং কাজটি করতে বাধ্য নন কিন্তু কাজটি করা তার প্রয়োজন।

4। তিনি ঐ সম্পর্কে অবগত ,তিনি তা করতে বাধ্য নন এবং তার প্রয়োজনও নেই ,কিন্তু তিনি তার খেয়াল খুশীর জন্য কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাড়াই কাজটি করেছেন।

কিন্তু উপরোল্লিখিত কোনটিই মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় এবং অসম্ভব। কারণ এর অনস্বীকার্য অর্থ দাড়ায় ,তার ঘাটতি রয়েছে। অথচ তিনি চুড়ান্তরূপে পরিপূর্ণ।

সুতরাং আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে ,তিনি সকল প্রকার অন্যায় ও কুৎসিত কর্ম থেকে পবিত্র। মুসলমানদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ মনে করে যে ,আল্লাহ কুৎসিত কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। তারা বলেন যে ,আল্লাহ তার অনুগতদের শাস্তি দিতে পারেন ,আবার পাপীষ্ঠদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাতে পারেন এমনকি কাফেরদেরকেও। তারা আরো বলে যে ,আল্লাহ মানুষকে তার সাধ্যের অধিক দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন। আর এমতাবস্থায় তিনি তাদেরকে উক্ত কর্ম সম্পাদন না করার জন্য শাস্তিও দিতে পারেন। তিনি অন্যায় ,অত্যাচার ,প্রতারণা করতে পারেন কিংবা মিথ্যা ও প্রজ্ঞাহীন ,উদ্দেশ্যবিহিন ও কল্যাণবিহীন নিষ্ফল কর্মও সম্পাদন করতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রে দলিল হলো-

  “তিনি তার কর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হবেন না। কিন্তু তারা (মানুষ) জিজ্ঞাসিত হবে। (সুরা আম্বিয়া -23)

তাদের এ নষ্ট বিশ্বাস অনুযায়ী মহান আল্লাহ অন্যায়কারী ,অবিজ্ঞ রং তামাশাকারী ,মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক (মহান আল্লাহ এগুলো থেকে পবিত্র) । আর এ ধরনের বিশ্বাস কুফরী ব্যতীত কিছুই নয়। মহান আল্লাহ তার পবিত্র কোরআনে (যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই) বলেন-

মহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য কোন প্রকার অন্যায় কামনা করেন না। (সুরা আল-মুমীন-31)

মহান আল্লাহ ফেসাদ (অনাচার) পছন্দ করেন না। (সুরা আল-বাকারা- 205)

আমরা আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং এতদ্ভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তাকে খেলার ছলে সৃষ্টি করিনি। (সুরা আম্বিয়া- 16)

আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার এবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সুরা আজ-জারিয়াত-56)

এ ধরনের আরো অনেক আয়াত আছে যে গুলোর মাধ্যমে মহান আল্লাহ সম্পর্কে উল্লেখিত নষ্ট বিশ্বাসগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা যায়।

9। মানুষের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ মানুষকে কোন দায়িত্ব প্রদান করেন না যদি না এ সম্পর্কে চুড়ান্ত দলিল (হুজ্জাত) উপস্থাপন করেন। তিনি মানুষকে তার সাধ্যের অধিক দায়িত্ব প্রদান করেন না। যা কিছু তার বোধগম্য নয় ,যা সে জানেনা তাও তিনি তার উপর অর্পণ করেন না। কারণ অক্ষমকে দায়িত্ব প্রদান করা জুলুম বা অন্যায়। অনুরূপভাবে অন্যায় হলো কাউকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্বেই অবগত না করে দায়ী করা।

তবে আহকাম ও দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত না হওয়ার কারণে মানুষ মহান আল্লাহর নিকট দায়ী হবে এবং তার এ ভুলের জন্য সে শাস্তি পাবে। কারণ প্রত্যেক মানুষের জন্যই তার নিজের প্রয়োজনীয় শরীয়তের হুকুমগুলো জেনে নেয়া আবশ্যক।

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছেন এবং তার সার্বিক ও চির কল্যাণের পথে তাকে পরিচালিত করার জন্য বিধান দিয়েছেন এবং এ গুলোকে তার জন্য বর্ণনা করেছেন। আবার অনাচার ,ক্ষতিকর এবং খারাপ পরিণতির পথ থেকে তাদেরকে বিরত রেখেছেন। এগুলো হলো মহান আল্লাহ কর্তৃক তার বান্দাদের জন্য দয়া ও রহমতের দৃষ্টান্ত। তবে তারা তাদের ইহ ও পরকালীন অনেক কল্যাণ সম্পর্কে অনবগত। আবার এমন অনেক কিছু সম্পর্কে তারা জানে না যেগুলো তাদের জন্য ক্ষতিকারক। মহান আল্লাহ তার স্বভাবগতভাবেই হলেন পরম দয়ালু ও দাতা। তিনি চুড়ান্তভাবে পরিপূর্ণ আর তা হলো স্বয়ং সত্তাগত এবং তার থেকে এগুলোকে পৃথক করা অসম্ভব। এ দয়া ও করুনা এমনকি তার অবাধ্য বান্দার অবাধ্যতার ফলে তাদের নিজের দূর্ভাগ্য ডেকে আনলেও তুলে নেয়া হয় না।

10। ক্বাজা ও ক্বাদর সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

জাবরি নামক একদল মনে করে যে ,মহান আল্লাহ সৃষ্টির সমস্ত কার্যকলাপের কর্তা। তিনিই মানুষকে তার পাপ কাজের জন্য বাধ্য করেন এবং এমতাবস্থায় তিনিই তাদেরকে শাস্তি দেন ;আবার তিনিই সৎকর্মে তাদেরকে বাধ্য করেন ,তথাপি তিনিই ঐ কাজের জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করেন। জাবরিরা বলে যে ,মহান আল্লাহই মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রকৃত সংগঠক। তথাপি এ কাজের জন্য মানুষকে দায়ী করা হয়। জাবরিদের এরূপ ধারণার কারণ হলো তারা বস্তুর মধ্যকার প্রাকৃতিক কারণকে (আস-সাবাবিয়াহ আত্তাবিয়্যাহ) অস্বীকার করে। আর তারা বলে মহান আল্লাহ হলেন প্রকৃত কারণ (আস্-সাবাবুল হাকীকী) ,তিনি ব্যতীত অন্য কোন কারণ নেই।

তারা বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান প্রাকৃতিক কারণকে অস্বীকার করার কারণ হলো ,তাদের ধারণামতে মহান আল্লাহ যে শরীক বিহিন সৃষ্টিকর্তা- এ কথার দ্বারা তা ব্যহত হয়। কিন্তু এরূপ কথা দ্বারা আল্লাহর উপর জুলুম আরোপ করা হয়। অথচ মহান আল্লাহ কখনোই জুলুম করেন না।

আবার অন্য একদল হলো পূর্ণ স্বাধীনতাবাদী (মাফবিজাহ) । তাদের মতে মহান আল্লাহ তার সৃষ্টিকে তাদের কর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ রূপে স্বাধীন করে দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহর শক্তির ’ পালনীয় কোন ভূমিকা থাকে না। তাদের এরূপ বিশ্বাসের যুক্তি হলো- মানুষের কর্মকাণ্ডকে আল্লাহর উপর আরোপ করার অর্থ হলো তার উপর ঘাটতি আরোপ করা। অথচ প্রত্যেক অস্তিত্বময় জিনিসেরই এক নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং প্রত্যেক কারণই ফিরে যায় প্রথম কারণের দিকে ,আর তিনিই হলেন মহান আল্লাহ। যাহোক যদি কেউ এরূপ (তাফবীজ) মতবাদ ব্যক্ত করে ,তবে সে মহান আল্লাহকে তার রাজত্বের বাইরে চিন্তা বা ধারণা করেছে এবং সৃজনের ক্ষেত্রে তার সাথে অন্যকে শরীক করেছে।

আর এক্ষেত্রে পবিত্র ইমামগণের (আ.) শিক্ষা থেকে আমাদের বিশ্বাস হলো মধ্যপন্থী- প্রাগুক্ত দুটি মতামতের মাঝামাঝি। এটি কালাম শাস্ত্রের এমন এক বিষয় যে ,বিবাদরত কোন পক্ষই এর প্রকৃত তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে পারে না। সুতরাং একদল একদিকে প্রান্তিক ধারণা পোষণ করে আবার অন্যদল অন্যদিকে শত শত বছর পর্যন্ত জ্ঞান ও দর্শন এর নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে পারিনি।

এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ,আমাদের ইমামগণের (আ.) প্রজ্ঞা ও বক্তব্যের সাথে পরিচিত নয় এমন কেউ ধারণা করবে যে ,আমাদের এ বক্তব্য (আমরু বাইনাল আমরাইন) হলো আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জন্মজ। অথচ আমাদের ইমামগন (আ.) দশ শতাব্দীকাল পূর্বে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন।

ইমাম সাদিক (আ.) এ বিষয়টিকে তার বিখ্যাত মধ্যপন্থী বক্তব্য দ্বারা পরিষ্কার করেছেন-

  “ কোন জাবর নয় ,কোন তাফবীজ নয় বরং এ দু 'য়ের মাঝামাঝি বিষয়।

সত্যিই কত সুন্দর দিকনির্দেশনা লুকিয়ে আছে এ বক্তব্যের মাঝে ,কত সূক্ষ্ম এবং বাস্তব অর্থ এখানে সজ্জিত আছে। সংক্ষেপে আমাদের কর্মগুলো একদিক থেকে সত্যিই আমাদের নিজেদের কাজ (আফআলীনা হাকীকী) এবং আমরা এর প্রাকৃতিক কারণ (সাবাবুত তাবিয়াত) । তা আমাদের ইচ্ছা ও ক্ষমতাধীন। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তা মহান আল্লাহ কর্তৃক আদেশিত এবং তার ক্ষমতাধীন। কারণ তিনিই হলেন অস্তিত্ব দানকারী। তিনি আমাদেরকে আমাদের কাজে বাধ্য করেননি যে পাপ করলে শাস্তি দিলে তার অন্যায় হবে। কারণ কাজটি করার ক্ষেত্রে আমাদের ঐচ্ছিক স্বাধীনতা (এখতিয়ার) ও শক্তি ছিল। অপরদিকে আমাদের কর্মকে অস্তিত্ব দিতে তিনি আমাদেরকে অধিকার দেননি কারণ তা তার রাজত্বে সংগঠিত হয়। কারণ সৃষ্টির মালিক ,হুকুম ও আদেশের মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান এবং তিনি তার সমস্ত বান্দার উপর ক্ষমতাবান।

যাহোক আমরা বিশ্বাস করি যে ,ক্বাজা ও ক্বাদর হলো আল্লাহর আওতাধীন একটি নিগূঢ় রহস্য। সুতরাং যদি কেউ কোন প্রকার প্রান্তিক ধারণা ব্যতীত এ বিষয়টিকে অনুধাবন করার সামর্থ্য রাখে তবে সে এ বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে পারে। নতুবা এ বিষয়টি জোর পূর্বক সূক্ষ্ম অনুধাবনের কোন প্রয়োজন নেই ,কারণ তা তাকে অন্ধকারের পথে পরিচালিত করতে পারে এবং তার বিশ্বাস নষ্ট করে দিতে পারে। এটি একটি অতি সূক্ষ্ম বিষয়। এমনকি দর্শনের জটিলতম বিষয় সমূহের একটি যা কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক অনুধাবন করতে পারে। এর কারণেই অনেক কালামবিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এটা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের উর্ধে। তাদের জন্য আমাদের পবিত্র ইমামগনের (আ.) বাণী অনুসারে এ সামগ্রিক ধারণা রাখাই যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো ঐ দু টিবিষয়-জাবরি (অক্ষম বা বাধ্য) ও তাফবীজ (পূর্ন স্বাধীন)- এর মাঝামাঝি (আমরু বাইনাল আমরাইন) । আর এটি মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত এমন কোন বিষয় নয় যে ,সূক্ষ্মভাবে বা সম্যকভাবে একে অনুধাবন করতে হবে।

11। বাদা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

মানুষের ক্ষেত্রে বাদা হলো- কোন ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া বা পরিবর্তন করা যা পূর্বে ছিল না (পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া) । তার এ সিদ্ধান্ত পবির্তনের কারণ হলো এমন কিছু বিষয়ের অবতারনা যা তার জ্ঞান ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনে। সুতরাং কাজটি করার আগেই সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে এবং পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের কারণে অনুশোচনা করে। তার জন্য কোনটি কল্যাণকর সে সম্পর্কে তার অজ্ঞতার ফলেই এমনটি ঘটে।

বাদার প্রাগুক্ত অর্থ মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এটি হলো অজ্ঞতা ও ঘাটতির ফল। আর এগুলো মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব। ইমামীয়ারা উল্লেখিত অর্থে (যা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) বিশ্বাসী নয়। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন-

যারা মনে করে যে ,কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক বাদা সংগঠিত হয় এবং এ জন্য আল্লাহকে অনুশোচনা করতে হয় ,আমাদের দৃষ্টিতে তারা অবিশ্বাসী বা কাফের।

তিনি আরো বলেন-

আমি তাদের নিকট থেকে দূরত্ব বজায় রাখি যারা মনে করে যে ,এমন কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক বাদা সংগঠিত হয় যেগুলো সম্পর্কে তিনি ইতিপূর্বে জানতেন না।

আমাদের পবিত্র ইমামগণের (আ.) কিছু বাণীও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট যার ফলে লোকজন মনে করে আমরা বর্ণিত অর্থে বাদায় বিশ্বাস করি। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন-

মহান আল্লাহর এমন কোন বাদা নেই যা আমার পুত্র ইসমাইলের ক্ষেত্রে হয়েছে।

এ ধরনের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম লেখক ইমামীয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে যে ,ইমামীয়ারা বর্ণিতার্থে বাদায় বিশ্বাস করে। আর এভাবে তারা শীয়া মাযহাবের ও আহলে বাইতের (আ.) পথের বদনাম ও নিন্দা করে। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ যা বলেন তা-ই সঠিক। তিনি বলেন-

তিনি বিনাশ করেন ও প্রতিষ্ঠিত করেন যা তিনি চান ,আর তার নিকটই রয়েছে মূল কিতাব (উম্মুল কিতাব) । (সুরা রাদ-39)

আর এর অর্থ হলো- মহান আল্লাহ কখনো কখনো কোন কল্যাণময়ী কারণবশতঃ তার নবী ও ওয়ালীদের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে কোন কিছুর প্রকাশ ঘটান। অতঃপর তা অপনোদন করেন এবং প্রথমোক্ত ক্ষেত্রের পরিবর্তে অন্য কিছু ঘটান যদিও এ সম্পর্কে তার জ্ঞান রয়েছে। যেমন- হযরত ইসমাইলের (আ.) কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করতে। আর এটাই হলো ইমাম জাফর সাদিকের (আ.) কথার অর্থ যে মহান আল্লাহ ইতিপূর্বে এমন কোন কিছু প্রকাশ করেন না যা তার পুত্র ইসমাইলের ব্যাপারে করেছেন। তার পূর্বেই তার পুত্রের জীবন নিয়ে নিয়েছেন। কারণ যাতে মানুষ জানতে পারে যে ,তিনি (ইসমাইল) ইমাম নয়। যদিও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের নিকট মনে হয়েছিল যে তিনি ইমাম হবেন কারণ তিনি (ইসমাইল) ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তান।

বাদার এ অর্থটি হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর শরীয়তের পূর্বেকার শরীয়তসমূহের রদ করণের অর্থ প্রকাশ করে ,এমনকি মোহাম্মদ (সা.) এর কিছু শরীয়তকে রদ করা হয়েছিল তার কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করে।

12। দ্বীনের আহকাম সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,বান্দারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাতে নিজেদের কল্যাণ সাধন করতে পারে তদানুসারেই মহান আল্লাহ শরীয়তের ওয়াজীব ,হারাম ও অন্যান্য বিধানসমূহ প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং যা কিছু একান্তই আমাদের জন্য কল্যাণকর তাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেছেন। আর যার সিংহভাগ আমাদের জন্য অকল্যাণকর তাকে নিষিদ্ধ করেছেন। আর অনুরূপভাবে অন্যান্য বিধান। এটা হলো বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহর করুণা ও ন্যায়পরায়ণতা। স্পষ্টতঃই তাকে সর্বক্ষেত্রে কোন না কোন হুকুম প্রদান করতে হয়েছে (ঐ দয়া বা ন্যায়ের কারণে) । এমন কোন কিছু নেই যে সম্পর্কে তিনি বিধান দেননি যদিও আমাদের নিকট তার জ্ঞান লাভের পন্থা জানা নেই।

আমরা আরও বলি যে ,যাতে অকল্যাণ রয়েছে তা করার আদেশ প্রদান এবং যাতে কল্যাণ রয়েছে তা নিষিদ্ধ করা অবাঞ্ছিত কাজ। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যেই কোন কোন মাযহাব মনে করে যে ,কুৎসিত বা অবাঞ্ছিত হলো তা যা মহান আল্লাহ নিষেধ করেন। আর সুন্দর বা বাঞ্চিত হলো তা যা মহান আল্লাহ পালন করতে আদেশ করেন। সুতরাং কল্যাণ ও অকল্যাণ স্বয়ং বা সত্তাগতভাবে যথাক্রমে সুন্দর ও অসুন্দর নয়। এমনকি সুন্দর এবং অসুন্দরও সত্তাগতভাবে সুন্দর ও অসুন্দর নয়। এ ধরনের বক্তব্য স্পষ্টতঃই বুদ্ধিবৃত্তি পরিপন্থী। এরাই বলে যে ,আল্লাহ কুৎসিত ও অবাঞ্ছিত কাজও করতে পারেন। যেমন- যা অসুন্দর তিনি তা করতে আদেশ দিতে পারেন। আবার যা সুন্দর তা করতে নিষেধ করতে পারেন। ইতিপূর্বে আমরা প্রমাণ করেছি যে এটি একটি মহাভ্রান্ত ধারণা। কারণ এর অর্থ হলো আল্লাহ অজ্ঞ ও অক্ষম (মহান আল্লাহ এগুলোর উর্ধে) ।

সংক্ষেপে এ প্রসংগে সঠিক ভাবে বলা যায় যে ,আমাদের কর্মকান্ডের আবশ্যকতায় ও নিষেধে মহান আল্লাহর কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ নেই ,বরং সমস্ত কর্মকান্ডের কল্যাণ বা অকল্যাণ আমাদের দিকেই ফিরে আসে। সুতরাং আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের কল্যাণ ও অকল্যাণকে অস্বীকার করার কোন অর্থই থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ অহেতুক ও লক্ষ্যহীন কোন কিছু আদেশ বা নিষেধ করেন না। তিনি তার বান্দাদের মুখাপেক্ষী নন।

পর্ব-2

নবুওয়াত

13। নবুওয়াত সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,নবুওয়াত হলো একটি ঐশী দায়িত্ব এবং আল্লাহর মিশন। তিনি একাজে তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন যাঁদেরকে তিনি তার যোগ্য ও পরিপূর্ণ মানবতার মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে অন্যান্য মানুষের নিকট প্রেরণ করেছেন যাতে মানুষের ইহ ও পরকালীন লাভ ও কল্যাণ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারেন ,যাতে চারিত্রিক কলুষতা ,শয়তানী কর্মকাণ্ড ও ক্ষতিকর আচরণ থেকে মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন। মহান আল্লাহ তার নির্বাচিত বান্দাদেরকে প্রেরণ করেছেন যাতে তারা মানুষকে জ্ঞান দিতে পারেন এবং কল্যাণ ও সফলতার পথ দেখাতে পারে ,মানুষকে সে স্থানে পৌছে দিতে পারেন যার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এভাবে দুনিয়া এবং আখেরাতের সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে তাদেরকে অধিষ্ঠিত করাতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি যে ,দয়া-নীতির (কায়েদাতুললুতফ যার অর্থ পরে বর্ণনা করা হবে) দাবী হলো যে ,দয়াময় সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের হেদায়াতের জন্য ,পূর্ণগঠনের জন্য এবং তার ও তার সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রাসুল প্রেরণ করবেন।

অনুরূপ আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ তার বান্দাদেরকে নবীর মনোনয়ন ,নির্ধারণ ও নির্বাচনের অধিকার দেননি। কেবলমাত্র মহান আল্লাহই নবী হিসেবে কাউকে মনোনয়ন ও নির্বাচন করতে পারেন। কারণ-আল্লাহই ভাল জানেন যে কোথায় তার বাণী রাখবেন। সুতরাং পথ প্রদর্শক ,সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে মহান আল্লাহ যাঁদেরকে পাঠিয়েছেন তাদের সাথে বিতর্ক করার অধিকার কারো নাই। সেরূপ কারো অধিকার নেই যে বিধান ,সুন্নত ও শরীয়ত হিসেবে তারা যা এনেছেন ঐ ব্যাপারে সে সন্দেহ করবে।

14। নবুওয়াত হলো মহান আল্লাহর ঐশ্বরিক দান (লুত্ফ্) :

মানুষ হলো এক অপূর্ব সৃষ্টি। তার অস্তিত্ব ,প্রকৃতি ,আত্মা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে রয়েছে এক জটিল সমন্বয়। এমনকি মানব জাতির প্রত্যেক সদস্যের ব্যক্তিত্বের মধ্যেই বিদ্যমান জটিল প্রকৃতির সমন্বয়। একদিকে রয়েছে অনাচারের প্রবণতা আর অপরদিকে রয়েছে কল্যাণ ও উত্তমের কারণসমূহ। একদিকে আত্মপ্রীতি ,কামনা-বাসনার মত আবেগ ও প্রবণতা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে সে তার কামনার বশবর্তী হয়ে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। সম্পদ সংগ্রহ করতে চায় এবং অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায় এবং অপরিনামদর্শী হয়ে পার্থিব রূপ জৌলুসের দিকে ধাবিত হতে চায়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন -

নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছ্ । (সুরা আসর -2)

নিশ্চয়ই মানুষ ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছে ,কারণ সে নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করছে। ’’ (সুরা আলাক -6-7)

তিনি আরও বলেন-

নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা ( লোভাতুর মন ) মানুষকে অসৎ কাজের দিকে পরিচালিত করে। (সুরা ইউসুফ - 54 )

এছাড়া এমন আরো অনেক আয়াত আছে যাতে দেখা যায় যে ,মানুষের আত্মা হলো কামনা বাসনা ও আবেগ অনুভূতিতে পূর্ণ।

অপরদিকে মহান আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) দিয়েছেন যাতে সে স্বীয় কল্যাণ ও উন্নতির পথকে সনাক্ত করতে পারে। তিনি তাকে বিবেকও দিয়েছেন যা তাকে অন্যায় ও অপছন্দনীয় পথে যেতে বাধা প্রদান করে।

মানুষের অভ্যন্তরে তার কামনা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে বিরাজমান রয়েছে অবিরত সংঘর্ষ। যখন তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কামনার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে তখন সে সুউচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় এবং মানবতার সমুন্নত উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু যখন তার কামনা তার বুদ্ধিবৃত্তিকে পরাস্ত করে তখন সে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নিকৃষ্ঠতম মানবে পরিণত হয় সে যাকে পশুর সাথে তুলনা করা যায়।

বিবাদরত (আকল এবং কামনা) এ দুয়ের মধ্যে কামনা ও তার সৈন্যরা অপেক্ষাকৃত বেশী শক্তিশালী। আর এ কারণেই অধিকাংশ মানুষ ধ্বংসের পথে পতিত হয় এবং মুক্তির পথ থেকে দূরে সরে যায় ,তাদের কামনাকে অনুসরণ করে ও বাসনার ডাকে সাড়া দেয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

হে নবী ! তুমি যতই চেষ্টা কর না কেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই ঈমান আনবে না। (সুরা ইউসুফ- 103)

তাছাড়া সে পৃথিবীর সকল সত্য সম্পর্কে এবং তার নিজের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন ও অজ্ঞ। এমনকি সে নিজের সম্পর্কেও অজ্ঞ। কিসে তার লাভ ,কিসে তার ক্ষতি ,কিসে তার কল্যাণ ,কিসে অকল্যাণ কেমন করে সে তা জানবে ?আর নিজের কল্যাণের বা সামগ্রিকভাবে মানবতার কল্যাণের যাবতীয় বিষয় কিভাবে সে জানতে পারবে ?যখনই সে নতুন কোন আবিস্কার নিয়ে অগ্রসর হয় তখনই সে অজ্ঞতাকে দেখতে পায় আর উপলব্ধি করে যে সে আসলে কিছুই জানেনা। আর এ কারণে একান্তভাবেই মানুষের জন্য এমন কারো প্রয়োজন যে তাকে কল্যাণ ও সুখের পথ দেখাবে তখন যখন তার কামনা তাকে প্রতারিত করে ,সুকর্মকে কুকর্মের দ্বারা আচ্ছাদিত করে কিংবা কু-কর্মকে সুকর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে যার ফলে তার বুদ্ধিবৃত্তি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পতিত হয় ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে না কিংবা প্রকৃত ভাল ও মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। বুদ্ধিবৃত্তি ও কামনার এ যুদ্ধে সচেতনভাবে হোক বা অবচেতনভাবে হোক আমরা সকলেই বশীভূত কেবলমাত্র তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ রক্ষা করেন। একজন সুশিক্ষিত ও সভ্য ব্যক্তির পক্ষেও যেখানে ভাল মন্দের পার্থক্য করা কঠিন সেখানে কি করে তা একজন অজ্ঞ ও অশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হবে ?

সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের ভাল-মন্দ সম্পর্কে আলোচনা করলেও কিসে তাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ তা তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। তাই মহান আল্লাহ মানুষের উপর করুণা প্রদর্শন করে নবী প্রেরণ করেন। যেমন- পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে যিনি তাদের জন্য আয়াত বর্ণনা করবেন ,তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দিবেন। (সুরা জুমআহ-2)

আর তিনি (নবী) তাদেরকে ভাল ও মন্দ সম্পর্কে সতর্ক করবেন এবং কল্যাণ ও সুখের সুসংবাদ দিবেন।

এধরনের দয়া করা মহান আল্লাহর কর্তব্য। কারণ তার বান্দাদের উপর এ দয়া করা তার নিরঙ্কুশ পূর্ণতারই বহিঃপ্রকাশ। আর তিনি তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু ও উদার হস্ত। যখন কেউ তার দয়া ও উদারতা লাভের যোগ্য হয় তখন তিনি অবশ্যই সেখানে তা দান করেন। কারণ ,রহমতের ব্যাপারে আল্লাহর কোন কৃপণতা নেই। আর এখানে কর্তব্য অর্থ এ নয় যে ,কেউ তাকে হুকুম করেন বা বাধ্য করেন যার ফলে তিনি তা তামিল করেন। বরং এখানে আবশ্যকতা বা কর্তব্যের অর্থ হলো ,আমাদের কথায় আমরা যাকে বলি আবশ্যকীয় অস্তিত্ব (বা ওয়াজীবুল ওজুদ) । অর্থাৎ তিনি আবশ্যকীয়রূপে বিদ্যমান। তার অস্তিত্ব তিনিই এবং তার অস্তিত্ব থেকে তাকে পৃথক করা যায় না।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12