শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস16%

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 19030 / ডাউনলোড: 5528
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

৪২। মুসলমানের উপর মুসলমানের অধিকার সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

সকল প্রকার শ্রেণী বৈষম্য ,মর্যাদা ও স্তরের পার্থক্য সত্ত্বেও পবিত্র ধর্ম ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সুন্দরতম আহবান হলো মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব রক্ষা। ফলে আজকের এবং পূর্বেকার সময়ের মুসলমানদের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যাপার ছিল দ্বীনী ভ্রাতৃত্বের দাবীর প্রতি দৃষ্টি না দেয়া এবং এ ব্যাপারে তাদের উদাসীনতা। কারণ এ ভ্রাতৃত্বের ন্যূনতম দাবী হলো ইমাম জাফর সাদিকের (আ.) সেই বক্তব্য যে প্রত্যেক মুসলমানরাই যা নিজের জন্য পছন্দ করবে সে তার ভাইয়ের জন্যও যেন তা পছন্দ করে। আর যা নিজের জন্য পছন্দ করে না তা যেন তার অন্যান্য মুসলমান ভাইয়ের জন্যও পছন্দ না করে।

আমাদেরকে এ সরল আদেশ যা আহলে বাইতের (আ.) নির্দেশ তার উপর চিন্তা করা আবশ্যক। তখন আমরা অনুধাবন করব যে ,প্রকৃতই এ আদেশ পালন করা আজকের যুগের মুসলমানদের জন্য কতটা কঠিন ও সমস্যাসংকুল ;আর মুসলমানরা সত্যিই এ আদেশ থেকে কতটা দূরে! যদি এমন একটি আদেশের আনুগত্যই মুসলমানরা করত তবে কখনোই পরস্পরের উপর জুলুম করত না এবং কখনোই সীমালংঘন ,চুরি ,মিথ্যা ,পরনিন্দা ,ইত্যাদি করত না ,অপবাদ দিত না বা অধিকার লংঘন করত না।

হ্যাঁ ,যদি মুসলমানরা প্রকৃতপক্ষেই ভ্রাতৃত্ব রক্ষার এমন একটি আদেশ পালন করত তবে নিশ্চিতই জুলুম ও শত্রুতার অবসান ঘটত। আর তখন মুসলমানরাও স্বাধীন ও প্রাধান্য সহকারে সমাজে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সৌহার্দ্য বজায় রেখে জীবন যাপন করতে পারত। ফলে বিশ্ব সমাজে যে কল্যাণময় সভ্যতা ,যা প্রাক্তন দার্শনিকদের কাম্য ছিল তা বাস্তব রূপ লাভ করত। আর তখন কোন হুকুমত ,বিচারালয় ,কারাগার ,শাস্তির বিধান কিংবা শাস্তির প্রয়োজন হত না ,অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারীর সম্মুখে মস্তকাবনত করতে হত না। কারণ কেউই তাগুতের হাতের ক্রীড়ানক হত না। ফলে আজকের এ পৃথিবী অন্য এক পৃথিবীতে রূপ নিত যেখানে থাকত ন্যায়পরায়ণতা ,সাম্য ও সততা। স্বর্গের মত পৃথিবী শান্তির নীড়ে পরিণত হত।

এখানে আরেকটি বিষয় আমরা সংযুক্ত করব তা হলো যদি ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের নিয়ম যা ইসলাম মানুষের কাছে কামনা করেছে তা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করত তবে আমাদের জীবনের অভিধানে আদালত ’ কথাটির কোন অস্তিত্ব থাকত না। কারণ তখন আদালত এবং ন্যায়পরায়ণতা বিধানের কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকত না যার ফলে আদালত অভিধানটি ব্যবহারের কোন প্রয়োজন থাকবে। বরং সেই ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের নীতিই কল্যাণ ,নিরাপত্তা ও সুখের জন্য যথেষ্ট হত।

কারণ কোন ব্যক্তি তখনই আদালত বা আইনের আশ্রয় নেয় যখন সমাজে ভালবাসা ও সৌহার্দ্য না থাকে। কারণ আমরা দেখতে পাই যে ,যেখানে পিতা ,পুত্র ও ভাইয়ের মধ্যে ভালবাসা হুকুমত করে সেখানে মানুষ নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াকে ত্যাগ করে এবং সানন্দে ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করে। স্পষ্টতঃই এমতাবস্থায় জীবনের সমস্ত সমস্যা-সংকট ভালবাসার আলোকে সমাধান হয়। ফলে আদালত ও ন্যায়নীতি কার্যকর করার কোন আবশ্যকতা থাকে না।

মানুষের সামাজিক জীবনে ভালবাসার প্রভাবের কারণ হলো প্রত্যেক মানুষই ফেতরাতগতভাবে (সৃষ্টিগত) কেবলমাত্র নিজেকে ভালবাসে। ফলে যা নিজের জন্য যা হৃদয়গ্রাহী সে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অতএব যা কিছু তার নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় সে তা পছন্দ করে না। পুনরায় আমরা দেখতে পাই যে ,কোন মানুষ যদি কোন কিছুকে পছন্দ না করে কিংবা তার দিকে কোন ঝোঁক তার না থাকে ,তার জন্য সে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে না কিংবা এর জন্য তার নিজের চাওয়া পাওয়াকে উৎসর্গ করতে পারে না কেবলমাত্র ঐ ক্ষেত্র ব্যতীত যদি ঐ বস্তুতে সে বিশ্বাসী হয় ,আর তার বিশ্বাস শক্তি তার ইচ্ছা ও ঝোঁকের উপর প্রাধান্য রাখে। যেমন- ভাল ,ন্যায়পরায়ণতা ও দয়ার প্রতি বিশ্বাস। এমতাবস্থায় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রবণতার (ন্যায় ,অন্যের প্রতি দয়া) কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রবণতাকে অগ্রাহ্য করে।

এ বিশ্বাস যখন মানুষের মধ্যে দৃঢ়তর ও প্রভাবশালী হয় অর্থাৎ মানুষ সে সমুন্নত আত্মার অধিকারী হয় যে আত্মা অতিবস্তুগত কারণে বস্তুগত বিষয়কে অগ্রাহ্য করতে পারে ,কেবলমাত্র তখনই সে আদালত ও অপরের প্রতি দয়ার শ্রেষ্ঠকে উপলব্ধি করতে পারে।

মানুষকে কেবল তখনই এ আত্মিক সমঝোতার মুখাপেক্ষী হতে হয় ,যখন নিজের এবং অপরাপর মানুষের মধ্যে প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালবাসা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। নতুবা যেমনটি উপরে আমরা আলোচনা করেছি যে ভালবাসা ’ ন্যায়পরায়ণতার স্থান দখল করে। আর ভালবাসার শাসনতন্ত্রে ন্যায়পরায়ণতার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না।

উপরোক্ত বিষয়বস্তু থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে ,প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরী। সুতরাং তার জন্য সর্বপ্রথমেই আবশ্যক হলো অপরের জন্য নিজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ শক্তিশালী করা। যখন ব্যক্তিগত চাহিদা ও কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হওয়ার কারণে নিজের অভ্যন্তরে এ ভ্রাতৃত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়বে তখন ইসলামের আদেশসমূহ অনুসরণ করে ,আদালত ও অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ়করণ করে প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধ অর্জন করতে হবে। যদি এক্ষেত্রে সে ব্যর্থ হয় তবে তার জন্য কেবল মুসলমান নামটিই অবশিষ্ট থাকবে। বরং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বেলায়াতের পতাকাতল থেকে সে নিজেকে বহিষ্কার করেছে। ফলে ইমামের (আ.) বক্তব্য অনুসারে (যা পরবর্তীতে আলোচনা করব) মহান আল্লাহ এ ধরনের মুসলমানকে কোন প্রকার দয়া প্রদর্শন করেন না।

অধিকাংশ সময়ই মানুষের নফসের চাহিদা ,কামনা তার মনুষত্বের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে ন্যায় কামনার বিশ্বাসকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না। আর তাই ন্যায়-নীতির প্রতি বিশ্বাসকে স্বীয় অস্তিত্বে কেন্দ্রীভূত ও সুসজ্জিত করতে পারে না। ফলে নফসের চাহিদা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই যদি মানুষের মধ্যে সঠিক ভ্রাতৃত্ববোধ বিকাশ লাভ না করে তবে তার জন্য কোন ভাইয়ের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে দ্বীনের শিক্ষার মধ্যে সর্বাধিক কঠিন কাজ।

এ বিষয়টির উপর লক্ষ্য রেখেই ইমাম সাদিক (আ.) তার কোন এক সাহাবী মোয়াল্লা বিন খুনাইসের প্রশ্নের জবাবে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মোয়াল্লাবিন খুনাইস ইমামকে (আ.) ভ্রাতৃত্বের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। ইমাম (আ.) তার অবস্থা বুঝে তাকে তার সহ্য ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দেন নি। কারণ তার ভয় ছিল এ ব্যক্তি এ অধিকার সম্পর্কে জানবে কিন্তু তদানুসারে আমল করতে পারবে না।

মোয়াল্লা বিন খুনাইস বলেন : ইমাম সাদিকের (আ.) নিকট জিজ্ঞাসা করলাম- এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের অধিকার কী ?

ইমাম সাদিক (আ.) : প্রত্যেক মুসলমানই অপর মুসলমানের উপর ৭টি আবশ্যকীয় অধিকার রাখে। এ অধিকারগুলোর প্রত্যেকটিই অপর মুসলমানের জন্যও আবশ্যক। যদি তাদের কেউ এ অধিকার হরণ করে তবে সে আল্লাহর আনুগত্য ও বেলায়াত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য কোন কল্যাণ ও দয়াই থাকবে না।

মোয়াল্লা : আপনার জন্য উৎসর্গ হব ,ঐ অধিকারগুলো কী কী ?

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : হে মোয়াল্লা আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার ভয় হয় তুমি এ অধিকারগুলোর কথা জানবে কিন্তু আমল করবে না। ফলে তখন এগুলোকে অসার করে দিবে।

মোয়াল্লা : আশাকরি আল্লাহর সাহায্যে সফল হব।

ফলে হযরত (আ.) তখন ঐ সাতটি অধিকারের কথা বর্ণনা করলেন। বললেন-

এদের মধ্যে প্রথমটি অন্য সবগুলোর চেয়ে সহজ। আর তা হলো অন্য সকলের জন্য তা পছন্দ কর যা নিজের জন্য পছন্দ কর। আবার অন্য সকলের জন্য তাই অপছন্দ কর যা নিজের জন্য অপছন্দ কর।

ধিক মুসলমানদেরকে! যদি এটি সহজতম অধিকারের কথা হয়। তবে তার মুসলমানিত্বের উপর কালিমা পড়ুক যে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে অথচ এ সহজ হুকুমটিই পালন করে না। অবাক ব্যাপার হলো যে ,মুসলমানদের এ পশ্চাৎপদতার জন্য ইসলামকেই দায়ী করা হয়। অথচ তাদের আমলই এ পশ্চাৎপদতার কারণ।

হ্যাঁ সমস্ত পাপের দায়ভার তাদের উপরই যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করে অথচ দ্বীনের সরলতম আদেশ পালন করতে রাজি না।

আমাদের ঐতিহাসিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে ,নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে এবং নিজের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতে আমরা ইমাম সাদিক (আ.) কর্তৃক বর্ণিত এ সাতটি অধিকারের কথা এ পুস্তিকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।

১) তোমার মুসলমান ভাইয়ের জন্য এমন কিছুকে পছন্দ কর যা নিজের জন্য পছন্দ কর এবং তার জন্য এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা নিজের জন্য অপছন্দ কর।

২) তোমার মুসলমান ভাইকে ক্রোধান্বিত করা থেকে দূরে থাক এবং যাতে সে তুষ্ট হয় তা কর এবং তার হুকুমের আনুগত্য কর (অবশ্য যদি অনৈসলামিক না হয়) ।

৩) তোমার জান ,মাল ,কথা ও হস্তপদ দ্বারা তার সাহায্য কর।

৪) দেখার জন্য তার চোখ হও ,চলার জন্য পথনির্দেশক হও এবং তার আয়না হও।

৫) সে যদি অভূক্ত থাকে তবে তুমি উদরপূর্তি করো না ,যদি তৃষ্ণার্ত থাকে তুমি তৃষ্ণা নিবারণ করো না ,যদি উলঙ্গ থাকে তবে তুমি পোশাকে সজ্জিত হয়ো না।

৬) যদি তোমার খাদেম থাকে এবং তার কোন খাদেম না থাকে ,তবে তোমার জন্য ওয়াজীব হলো তার কাছে তোমার খাদেমকে তার পোষাক ধুতে ,খাবার রান্না করতে এবং দস্তর মেলতে প্রেরণ করো।

৭) যদি তোমার নিকট কোন শপথ করে থাকে তবে তাকে শপথের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত কর ,তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ কর ,তার অসুস্থতার সময় তার সাথে সাক্ষাৎ কর ,তার জানাযায় অংশগ্রহণ কর। যদি জান যে তার কোন অভাব আছে তবে তার বলার আগেই তা সমাধানে উদ্যোগী হও এবং দ্রুত তার অভাব পূরণে সচেষ্ট হও।

অতঃপর ইমাম সাদিক (আ.) এ কথার মাধ্যমে তার বক্তব্য শেষ করেন-

যদি এ অধিকারগুলোকে রক্ষা কর তবে তার ভালবাসার রজ্জুকে তোমার ভালবাসার রজ্জুর সাথে বন্ধন দিলে। ১২

এ বিষয়ের উপর পবিত্র ইমামগণের (আ.) পক্ষ থেকে অনেক বর্ণনা এসেছে। অনেকে ধারণা করেন যে ,ইমামগণের (আ.) হাদীস সমূহে ভ্রাতৃত্ব বলতে শীয়াদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ হাদীসগুলোর বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করলে এ ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে।

তবে ইমামগণ (আ.) অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোরভাবে বিরোধীদের পথের সমালোচনা করেছেন। ইমানগণ (আ.) তাদের বিশ্বাসকে সঠিক বলে মনে করেন না। তথাপি ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে তারা সমস্ত মুসলমানদেরকে সমন্বিত করেছেন। আর এ কথার স্বপক্ষে প্রমাণস্বরূপ মোয়াবিয়াহ ইবনে ওহাবের হাদীসটি পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরাই যথেষ্ট মনে করছি। ১৩

তিনি বলেন : ইমাম সাদিকের (আ.) নিকট সবিনয়ে বললাম ,অন্যান্য মুসলমান যাদের সাথে আমরা জীবনযাপন করি ,কিন্তু তারা শীয়া নয়। তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব ?

ইমাম (আ.) বলেন : তোমাদের ইমামগণ (আ.) তাদের অসুস্থজনকে দেখতে যায় ,তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করে তাদের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষী দেয়। আর তাদের আমানতের খিয়ানত করে না।

তবে শীয়াদের নিকট ইমামগণ (আ.) যে ভ্রাতৃত্ব কামনা করেছেন ,তা এই ভ্রাতৃত্বের চেয়েও উর্ধে। যেমন- শীয়ার সংজ্ঞা অধ্যায়ে ’ এ সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা এ বক্তব্যে সত্যতা প্রমাণ করে। উদাহরণ স্বরূপ ,আবান বিন তুগলাব নামে ইমাম সাদিকের (আ.) এক সাহাবীর সাথে তার কথোপকথন উল্লেখ করাই এখানে যথেষ্ট।

আবান বলেন ইমাম সাদিকের (আ.) সাথে আল্লাহর গৃহের তাওয়াফরত অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় নিজের একজন শীয়া আমার কাছে আসলেন যাতে আমি একটি কাজে তার সাথে যাই। এমতাবস্থায় আমাদেরকে ইমাম সাদিক (আ.) একত্রে দেখলেন এবং বললেন :

তোমার নিকট এ ব্যক্তির কি কোন প্রয়োজন আছে।

আবান : জী - হ্যাঁ।

ইমাম (আ.) : তাওয়াফ রেখে তার সাথে যেয়ে তার প্রয়োজন মিটিয়ে এস।

আবান : তাওয়াফ আমার জন্য ওয়াজীব হলেও কি তা ত্যাগ করব ?

ইমাম (আ.) : হ্যাঁ।

আবান : তার সাথে গেলাম এবং তার কাজ সমাধা করে ইমামের (আ.)নিকট ফিরে এলাম। তার নিকট মূমিনের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম।

ইমাম (আ.) : এ প্রশ্ন ত্যাগ কর ,পুনরাবৃত্তি করো না।

কিন্তু আমি প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করলাম।

তখন ইমাম (আ.) বললেন : হে আবান স্বীয় ধন-সম্পদ কি তার সাথে ভাগাভাগি করবে ?অতঃপর তিনি (আ.) আমার দিকে তাকালেন এবং ইমামের কথা শুনার পর আমার যে অবস্থা হয়েছিল তা আমার চেহারায় লক্ষ্য করে বললেন : হে আবান ,জান কি মহান আল্লাহ ত্যাগকারীদেরকে স্মরণ করেন ? ১৪

আবান : জী-হ্যাঁ জানি।

ইমাম (আ.) : তোমার ধন সম্পদ তার সাথে আধাআধি ভাগ করলেও ত্যাগকারীর স্থানে পৌঁছতে পারনি। কারণ তুমি তাকে তোমার উপরে স্থান দাও নি। তুমি তখনই ত্যাগীর মর্যাদা পাবে যখন তোমার ধন-সম্পদের বাকী অর্ধেকটাও দিবে।

অতএব আমি এখানে বলব যে সত্যিই আমাদের জীবন কতটা লজ্জাকর ;প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকে মুমিন বলাও সমীচীন নয়। কারণ আমরা কোথায় আর আমাদের ইমামগণ (আ.) কোথায়। হ্যাঁ ,মালামাল ভাগ করা সম্পর্কে আবানের যে অবস্থা হয়েছিল ,যারা এ হাদীসটি পাঠ করবো তাদেরও ঠিক একই অবস্থা হবে। আর তখন এ হাদীস থেকে এমনভাবে ফিরে যাবো যেন এ হাদীসের শ্রোতা আমরা নই অন্য কেউ এবং কখনোই নিজেকে একজন দায়িত্বশীল হিসাবরক্ষকের মত বিচার ও বিবেচনাই করব না।

পর্ব -৫

কিয়ামত ( মাআদ )

৪৩। পুনরুত্থান বা মাআদ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান দিবসে নতুন করে জীবিত করবেন এবং সৎকর্মকারীকে পুরস্কৃত করবেন। আর পাপীকে শাস্তি দিবেন।

খুটিনাটি বিষয়াদি বাদ দিলে এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সমস্ত ঐশী দ্বীনসমূহ ও দার্শনিকরা একমত। মুসলমান মাত্রই কোরআনের বিশ্বাস অনুসারে এর প্রতি বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যে কোরআন হযরত মোহাম্মদের (সা.) উপর অবতীর্ণ হয়েছে।

কারণ যে মহান আল্লাহ ও হযরত মোহাম্মদ (সা.) এ রেসালাতের প্রতি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে এবং বিশ্বাস রাখে যে ,মহান আল্লাহ তাকে (সা.) নিজের পক্ষ থেকে মানুষের হেদায়াত ও সত্য দ্বীন প্রচারের জন্য প্রেরণ করেছেন ;তার পক্ষে এ পবিত্র কোরআনে যা কিছু এসেছে তাতেও বিশ্বাস করা ছাড়া গতান্তর নেই। যেমন- পবিত্র কোরআনে পুনরুত্থান দিবস ,সাবাব ও শাস্তি ,বেহেস্ত ও এর নেয়ামতসমূহ এবং দোযখ ও এর অগ্নি সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে। সুতরাং এগুলোতে বিশ্বাস করা আবশ্যক।

পবিত্র কোরআনে প্রায় এক হাজারের মত আয়াতে সুষ্পষ্টরূপে পুনরুত্থান ও মানুষকে দ্বিতীয়বারের মত জীবিত করার ব্যাপারে ইংগিত দেয়া হয়েছে। অতএব যখন কেউ এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকাশ করে তখন এটা সুষ্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে ,প্রকৃতপক্ষে সে রাসূলের (সা.) রেসালাতের প্রতি ,কিংবা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। আরও উপরে উঠে বলা যায় যে ,সে সমস্ত ঐশী দ্বীনের মূলে এবং এগুলোর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে।

8। আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসঃ

আমরা বিশ্বাস করি যে ,আল্লাহর একটি হ্যাঁ-বোধক পূর্ণতাগুণ হলো- তিনি সকল অন্যায়ের মোকাবেলায় ন্যায়পরায়ণ। তিনি ন্যায়পরায়ণতা ব্যতীত তার সৃষ্টিকে লালন করেন না। তিনি ক্রোধভরে শাসন করেন না। তিনি তার অনুগতকে পুরস্কৃত করেন। পাপীদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। তিনি তার বান্দাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে অধিক দায়িত্ব প্রদান করেন না। তাদের পাপের ফলে প্রাপ্ত শাস্তির অধিক কোন শাস্তি তিনি তাদেরকে প্রদান করেন না।

আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ সুকর্ম সাধন থেকে বিরত থাকেন না। তিনি কখনো কুৎসিত কর্ম করেন না। কারণ ,তিনি তার জ্ঞানের কারণে সুকর্ম সাধন করতে সক্ষম ও কুৎসিত কর্ম করা থেকে বিরত থাকতে সক্ষম। অসীম জ্ঞানের আলোকে সুকর্মের সুদিক ও কুৎসিত কর্মের কুদিক তার নিকট স্পষ্ট। তিনি সুকর্ম করতেও সক্ষম আবার কুৎসিত কর্ম করতেও সক্ষম। যেহেতু কোন সুকর্মই তার কাজের কোন ক্ষতি করতে পারে না তাই তার তা ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে কোন কুৎসিত কর্মই তার প্রয়োজন হয় না। তাই তিনি তা করতে বাধ্য হন না। মহান আল্লাহ হলেন প্রজ্ঞাবান ,সুতরাং তার কর্মকাণ্ড কখনোই তার প্রজ্ঞা বহির্ভূত হয় না এবং তা সর্বোত্তম কল্যাণময় পন্থায় সম্পন্ন হয়।

সুতরাং যদি তিনি অন্যায় ও কুৎসিত কর্ম সম্পাদন করেন (প্রকৃতপক্ষে তিনি এগুলো থেকে পবিত্র) তবে তা নিম্নলিখিত চারটি কারণে হবে-

1। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে এর কুৎসিত দিক সম্পর্কে অনবহিত।

2। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু কাজটি করতে বাধ্য এবং তা ত্যাগ করতে অপারগ।

3। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং কাজটি করতে বাধ্য নন কিন্তু কাজটি করা তার প্রয়োজন।

4। তিনি ঐ সম্পর্কে অবগত ,তিনি তা করতে বাধ্য নন এবং তার প্রয়োজনও নেই ,কিন্তু তিনি তার খেয়াল খুশীর জন্য কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাড়াই কাজটি করেছেন।

কিন্তু উপরোল্লিখিত কোনটিই মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় এবং অসম্ভব। কারণ এর অনস্বীকার্য অর্থ দাড়ায় ,তার ঘাটতি রয়েছে। অথচ তিনি চুড়ান্তরূপে পরিপূর্ণ।

সুতরাং আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে ,তিনি সকল প্রকার অন্যায় ও কুৎসিত কর্ম থেকে পবিত্র। মুসলমানদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ মনে করে যে ,আল্লাহ কুৎসিত কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। তারা বলেন যে ,আল্লাহ তার অনুগতদের শাস্তি দিতে পারেন ,আবার পাপীষ্ঠদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাতে পারেন এমনকি কাফেরদেরকেও। তারা আরো বলে যে ,আল্লাহ মানুষকে তার সাধ্যের অধিক দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারেন। আর এমতাবস্থায় তিনি তাদেরকে উক্ত কর্ম সম্পাদন না করার জন্য শাস্তিও দিতে পারেন। তিনি অন্যায় ,অত্যাচার ,প্রতারণা করতে পারেন কিংবা মিথ্যা ও প্রজ্ঞাহীন ,উদ্দেশ্যবিহিন ও কল্যাণবিহীন নিষ্ফল কর্মও সম্পাদন করতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রে দলিল হলো-

  “তিনি তার কর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হবেন না। কিন্তু তারা (মানুষ) জিজ্ঞাসিত হবে। (সুরা আম্বিয়া -23)

তাদের এ নষ্ট বিশ্বাস অনুযায়ী মহান আল্লাহ অন্যায়কারী ,অবিজ্ঞ রং তামাশাকারী ,মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক (মহান আল্লাহ এগুলো থেকে পবিত্র) । আর এ ধরনের বিশ্বাস কুফরী ব্যতীত কিছুই নয়। মহান আল্লাহ তার পবিত্র কোরআনে (যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই) বলেন-

মহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য কোন প্রকার অন্যায় কামনা করেন না। (সুরা আল-মুমীন-31)

মহান আল্লাহ ফেসাদ (অনাচার) পছন্দ করেন না। (সুরা আল-বাকারা- 205)

আমরা আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং এতদ্ভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তাকে খেলার ছলে সৃষ্টি করিনি। (সুরা আম্বিয়া- 16)

আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার এবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সুরা আজ-জারিয়াত-56)

এ ধরনের আরো অনেক আয়াত আছে যে গুলোর মাধ্যমে মহান আল্লাহ সম্পর্কে উল্লেখিত নষ্ট বিশ্বাসগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা যায়।

9। মানুষের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ মানুষকে কোন দায়িত্ব প্রদান করেন না যদি না এ সম্পর্কে চুড়ান্ত দলিল (হুজ্জাত) উপস্থাপন করেন। তিনি মানুষকে তার সাধ্যের অধিক দায়িত্ব প্রদান করেন না। যা কিছু তার বোধগম্য নয় ,যা সে জানেনা তাও তিনি তার উপর অর্পণ করেন না। কারণ অক্ষমকে দায়িত্ব প্রদান করা জুলুম বা অন্যায়। অনুরূপভাবে অন্যায় হলো কাউকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্বেই অবগত না করে দায়ী করা।

তবে আহকাম ও দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত না হওয়ার কারণে মানুষ মহান আল্লাহর নিকট দায়ী হবে এবং তার এ ভুলের জন্য সে শাস্তি পাবে। কারণ প্রত্যেক মানুষের জন্যই তার নিজের প্রয়োজনীয় শরীয়তের হুকুমগুলো জেনে নেয়া আবশ্যক।

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছেন এবং তার সার্বিক ও চির কল্যাণের পথে তাকে পরিচালিত করার জন্য বিধান দিয়েছেন এবং এ গুলোকে তার জন্য বর্ণনা করেছেন। আবার অনাচার ,ক্ষতিকর এবং খারাপ পরিণতির পথ থেকে তাদেরকে বিরত রেখেছেন। এগুলো হলো মহান আল্লাহ কর্তৃক তার বান্দাদের জন্য দয়া ও রহমতের দৃষ্টান্ত। তবে তারা তাদের ইহ ও পরকালীন অনেক কল্যাণ সম্পর্কে অনবগত। আবার এমন অনেক কিছু সম্পর্কে তারা জানে না যেগুলো তাদের জন্য ক্ষতিকারক। মহান আল্লাহ তার স্বভাবগতভাবেই হলেন পরম দয়ালু ও দাতা। তিনি চুড়ান্তভাবে পরিপূর্ণ আর তা হলো স্বয়ং সত্তাগত এবং তার থেকে এগুলোকে পৃথক করা অসম্ভব। এ দয়া ও করুনা এমনকি তার অবাধ্য বান্দার অবাধ্যতার ফলে তাদের নিজের দূর্ভাগ্য ডেকে আনলেও তুলে নেয়া হয় না।

10। ক্বাজা ও ক্বাদর সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

জাবরি নামক একদল মনে করে যে ,মহান আল্লাহ সৃষ্টির সমস্ত কার্যকলাপের কর্তা। তিনিই মানুষকে তার পাপ কাজের জন্য বাধ্য করেন এবং এমতাবস্থায় তিনিই তাদেরকে শাস্তি দেন ;আবার তিনিই সৎকর্মে তাদেরকে বাধ্য করেন ,তথাপি তিনিই ঐ কাজের জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করেন। জাবরিরা বলে যে ,মহান আল্লাহই মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রকৃত সংগঠক। তথাপি এ কাজের জন্য মানুষকে দায়ী করা হয়। জাবরিদের এরূপ ধারণার কারণ হলো তারা বস্তুর মধ্যকার প্রাকৃতিক কারণকে (আস-সাবাবিয়াহ আত্তাবিয়্যাহ) অস্বীকার করে। আর তারা বলে মহান আল্লাহ হলেন প্রকৃত কারণ (আস্-সাবাবুল হাকীকী) ,তিনি ব্যতীত অন্য কোন কারণ নেই।

তারা বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান প্রাকৃতিক কারণকে অস্বীকার করার কারণ হলো ,তাদের ধারণামতে মহান আল্লাহ যে শরীক বিহিন সৃষ্টিকর্তা- এ কথার দ্বারা তা ব্যহত হয়। কিন্তু এরূপ কথা দ্বারা আল্লাহর উপর জুলুম আরোপ করা হয়। অথচ মহান আল্লাহ কখনোই জুলুম করেন না।

আবার অন্য একদল হলো পূর্ণ স্বাধীনতাবাদী (মাফবিজাহ) । তাদের মতে মহান আল্লাহ তার সৃষ্টিকে তাদের কর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ রূপে স্বাধীন করে দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহর শক্তির ’ পালনীয় কোন ভূমিকা থাকে না। তাদের এরূপ বিশ্বাসের যুক্তি হলো- মানুষের কর্মকাণ্ডকে আল্লাহর উপর আরোপ করার অর্থ হলো তার উপর ঘাটতি আরোপ করা। অথচ প্রত্যেক অস্তিত্বময় জিনিসেরই এক নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং প্রত্যেক কারণই ফিরে যায় প্রথম কারণের দিকে ,আর তিনিই হলেন মহান আল্লাহ। যাহোক যদি কেউ এরূপ (তাফবীজ) মতবাদ ব্যক্ত করে ,তবে সে মহান আল্লাহকে তার রাজত্বের বাইরে চিন্তা বা ধারণা করেছে এবং সৃজনের ক্ষেত্রে তার সাথে অন্যকে শরীক করেছে।

আর এক্ষেত্রে পবিত্র ইমামগণের (আ.) শিক্ষা থেকে আমাদের বিশ্বাস হলো মধ্যপন্থী- প্রাগুক্ত দুটি মতামতের মাঝামাঝি। এটি কালাম শাস্ত্রের এমন এক বিষয় যে ,বিবাদরত কোন পক্ষই এর প্রকৃত তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে পারে না। সুতরাং একদল একদিকে প্রান্তিক ধারণা পোষণ করে আবার অন্যদল অন্যদিকে শত শত বছর পর্যন্ত জ্ঞান ও দর্শন এর নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে পারিনি।

এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ,আমাদের ইমামগণের (আ.) প্রজ্ঞা ও বক্তব্যের সাথে পরিচিত নয় এমন কেউ ধারণা করবে যে ,আমাদের এ বক্তব্য (আমরু বাইনাল আমরাইন) হলো আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জন্মজ। অথচ আমাদের ইমামগন (আ.) দশ শতাব্দীকাল পূর্বে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন।

ইমাম সাদিক (আ.) এ বিষয়টিকে তার বিখ্যাত মধ্যপন্থী বক্তব্য দ্বারা পরিষ্কার করেছেন-

  “ কোন জাবর নয় ,কোন তাফবীজ নয় বরং এ দু 'য়ের মাঝামাঝি বিষয়।

সত্যিই কত সুন্দর দিকনির্দেশনা লুকিয়ে আছে এ বক্তব্যের মাঝে ,কত সূক্ষ্ম এবং বাস্তব অর্থ এখানে সজ্জিত আছে। সংক্ষেপে আমাদের কর্মগুলো একদিক থেকে সত্যিই আমাদের নিজেদের কাজ (আফআলীনা হাকীকী) এবং আমরা এর প্রাকৃতিক কারণ (সাবাবুত তাবিয়াত) । তা আমাদের ইচ্ছা ও ক্ষমতাধীন। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে তা মহান আল্লাহ কর্তৃক আদেশিত এবং তার ক্ষমতাধীন। কারণ তিনিই হলেন অস্তিত্ব দানকারী। তিনি আমাদেরকে আমাদের কাজে বাধ্য করেননি যে পাপ করলে শাস্তি দিলে তার অন্যায় হবে। কারণ কাজটি করার ক্ষেত্রে আমাদের ঐচ্ছিক স্বাধীনতা (এখতিয়ার) ও শক্তি ছিল। অপরদিকে আমাদের কর্মকে অস্তিত্ব দিতে তিনি আমাদেরকে অধিকার দেননি কারণ তা তার রাজত্বে সংগঠিত হয়। কারণ সৃষ্টির মালিক ,হুকুম ও আদেশের মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান এবং তিনি তার সমস্ত বান্দার উপর ক্ষমতাবান।

যাহোক আমরা বিশ্বাস করি যে ,ক্বাজা ও ক্বাদর হলো আল্লাহর আওতাধীন একটি নিগূঢ় রহস্য। সুতরাং যদি কেউ কোন প্রকার প্রান্তিক ধারণা ব্যতীত এ বিষয়টিকে অনুধাবন করার সামর্থ্য রাখে তবে সে এ বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে পারে। নতুবা এ বিষয়টি জোর পূর্বক সূক্ষ্ম অনুধাবনের কোন প্রয়োজন নেই ,কারণ তা তাকে অন্ধকারের পথে পরিচালিত করতে পারে এবং তার বিশ্বাস নষ্ট করে দিতে পারে। এটি একটি অতি সূক্ষ্ম বিষয়। এমনকি দর্শনের জটিলতম বিষয় সমূহের একটি যা কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক অনুধাবন করতে পারে। এর কারণেই অনেক কালামবিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এটা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের উর্ধে। তাদের জন্য আমাদের পবিত্র ইমামগনের (আ.) বাণী অনুসারে এ সামগ্রিক ধারণা রাখাই যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো ঐ দু টিবিষয়-জাবরি (অক্ষম বা বাধ্য) ও তাফবীজ (পূর্ন স্বাধীন)- এর মাঝামাঝি (আমরু বাইনাল আমরাইন) । আর এটি মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত এমন কোন বিষয় নয় যে ,সূক্ষ্মভাবে বা সম্যকভাবে একে অনুধাবন করতে হবে।

11। বাদা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

মানুষের ক্ষেত্রে বাদা হলো- কোন ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া বা পরিবর্তন করা যা পূর্বে ছিল না (পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া) । তার এ সিদ্ধান্ত পবির্তনের কারণ হলো এমন কিছু বিষয়ের অবতারনা যা তার জ্ঞান ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনে। সুতরাং কাজটি করার আগেই সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে এবং পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের কারণে অনুশোচনা করে। তার জন্য কোনটি কল্যাণকর সে সম্পর্কে তার অজ্ঞতার ফলেই এমনটি ঘটে।

বাদার প্রাগুক্ত অর্থ মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এটি হলো অজ্ঞতা ও ঘাটতির ফল। আর এগুলো মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব। ইমামীয়ারা উল্লেখিত অর্থে (যা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) বিশ্বাসী নয়। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন-

যারা মনে করে যে ,কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক বাদা সংগঠিত হয় এবং এ জন্য আল্লাহকে অনুশোচনা করতে হয় ,আমাদের দৃষ্টিতে তারা অবিশ্বাসী বা কাফের।

তিনি আরো বলেন-

আমি তাদের নিকট থেকে দূরত্ব বজায় রাখি যারা মনে করে যে ,এমন কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক বাদা সংগঠিত হয় যেগুলো সম্পর্কে তিনি ইতিপূর্বে জানতেন না।

আমাদের পবিত্র ইমামগণের (আ.) কিছু বাণীও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট যার ফলে লোকজন মনে করে আমরা বর্ণিত অর্থে বাদায় বিশ্বাস করি। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন-

মহান আল্লাহর এমন কোন বাদা নেই যা আমার পুত্র ইসমাইলের ক্ষেত্রে হয়েছে।

এ ধরনের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম লেখক ইমামীয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে যে ,ইমামীয়ারা বর্ণিতার্থে বাদায় বিশ্বাস করে। আর এভাবে তারা শীয়া মাযহাবের ও আহলে বাইতের (আ.) পথের বদনাম ও নিন্দা করে। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ যা বলেন তা-ই সঠিক। তিনি বলেন-

তিনি বিনাশ করেন ও প্রতিষ্ঠিত করেন যা তিনি চান ,আর তার নিকটই রয়েছে মূল কিতাব (উম্মুল কিতাব) । (সুরা রাদ-39)

আর এর অর্থ হলো- মহান আল্লাহ কখনো কখনো কোন কল্যাণময়ী কারণবশতঃ তার নবী ও ওয়ালীদের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে কোন কিছুর প্রকাশ ঘটান। অতঃপর তা অপনোদন করেন এবং প্রথমোক্ত ক্ষেত্রের পরিবর্তে অন্য কিছু ঘটান যদিও এ সম্পর্কে তার জ্ঞান রয়েছে। যেমন- হযরত ইসমাইলের (আ.) কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করতে। আর এটাই হলো ইমাম জাফর সাদিকের (আ.) কথার অর্থ যে মহান আল্লাহ ইতিপূর্বে এমন কোন কিছু প্রকাশ করেন না যা তার পুত্র ইসমাইলের ব্যাপারে করেছেন। তার পূর্বেই তার পুত্রের জীবন নিয়ে নিয়েছেন। কারণ যাতে মানুষ জানতে পারে যে ,তিনি (ইসমাইল) ইমাম নয়। যদিও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের নিকট মনে হয়েছিল যে তিনি ইমাম হবেন কারণ তিনি (ইসমাইল) ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তান।

বাদার এ অর্থটি হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর শরীয়তের পূর্বেকার শরীয়তসমূহের রদ করণের অর্থ প্রকাশ করে ,এমনকি মোহাম্মদ (সা.) এর কিছু শরীয়তকে রদ করা হয়েছিল তার কাছাকাছি অর্থ প্রকাশ করে।

12। দ্বীনের আহকাম সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,বান্দারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাতে নিজেদের কল্যাণ সাধন করতে পারে তদানুসারেই মহান আল্লাহ শরীয়তের ওয়াজীব ,হারাম ও অন্যান্য বিধানসমূহ প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং যা কিছু একান্তই আমাদের জন্য কল্যাণকর তাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেছেন। আর যার সিংহভাগ আমাদের জন্য অকল্যাণকর তাকে নিষিদ্ধ করেছেন। আর অনুরূপভাবে অন্যান্য বিধান। এটা হলো বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহর করুণা ও ন্যায়পরায়ণতা। স্পষ্টতঃই তাকে সর্বক্ষেত্রে কোন না কোন হুকুম প্রদান করতে হয়েছে (ঐ দয়া বা ন্যায়ের কারণে) । এমন কোন কিছু নেই যে সম্পর্কে তিনি বিধান দেননি যদিও আমাদের নিকট তার জ্ঞান লাভের পন্থা জানা নেই।

আমরা আরও বলি যে ,যাতে অকল্যাণ রয়েছে তা করার আদেশ প্রদান এবং যাতে কল্যাণ রয়েছে তা নিষিদ্ধ করা অবাঞ্ছিত কাজ। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যেই কোন কোন মাযহাব মনে করে যে ,কুৎসিত বা অবাঞ্ছিত হলো তা যা মহান আল্লাহ নিষেধ করেন। আর সুন্দর বা বাঞ্চিত হলো তা যা মহান আল্লাহ পালন করতে আদেশ করেন। সুতরাং কল্যাণ ও অকল্যাণ স্বয়ং বা সত্তাগতভাবে যথাক্রমে সুন্দর ও অসুন্দর নয়। এমনকি সুন্দর এবং অসুন্দরও সত্তাগতভাবে সুন্দর ও অসুন্দর নয়। এ ধরনের বক্তব্য স্পষ্টতঃই বুদ্ধিবৃত্তি পরিপন্থী। এরাই বলে যে ,আল্লাহ কুৎসিত ও অবাঞ্ছিত কাজও করতে পারেন। যেমন- যা অসুন্দর তিনি তা করতে আদেশ দিতে পারেন। আবার যা সুন্দর তা করতে নিষেধ করতে পারেন। ইতিপূর্বে আমরা প্রমাণ করেছি যে এটি একটি মহাভ্রান্ত ধারণা। কারণ এর অর্থ হলো আল্লাহ অজ্ঞ ও অক্ষম (মহান আল্লাহ এগুলোর উর্ধে) ।

সংক্ষেপে এ প্রসংগে সঠিক ভাবে বলা যায় যে ,আমাদের কর্মকান্ডের আবশ্যকতায় ও নিষেধে মহান আল্লাহর কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ নেই ,বরং সমস্ত কর্মকান্ডের কল্যাণ বা অকল্যাণ আমাদের দিকেই ফিরে আসে। সুতরাং আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের কল্যাণ ও অকল্যাণকে অস্বীকার করার কোন অর্থই থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ অহেতুক ও লক্ষ্যহীন কোন কিছু আদেশ বা নিষেধ করেন না। তিনি তার বান্দাদের মুখাপেক্ষী নন।

পর্ব-2

নবুওয়াত

13। নবুওয়াত সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,নবুওয়াত হলো একটি ঐশী দায়িত্ব এবং আল্লাহর মিশন। তিনি একাজে তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন যাঁদেরকে তিনি তার যোগ্য ও পরিপূর্ণ মানবতার মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে অন্যান্য মানুষের নিকট প্রেরণ করেছেন যাতে মানুষের ইহ ও পরকালীন লাভ ও কল্যাণ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারেন ,যাতে চারিত্রিক কলুষতা ,শয়তানী কর্মকাণ্ড ও ক্ষতিকর আচরণ থেকে মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন। মহান আল্লাহ তার নির্বাচিত বান্দাদেরকে প্রেরণ করেছেন যাতে তারা মানুষকে জ্ঞান দিতে পারেন এবং কল্যাণ ও সফলতার পথ দেখাতে পারে ,মানুষকে সে স্থানে পৌছে দিতে পারেন যার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এভাবে দুনিয়া এবং আখেরাতের সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে তাদেরকে অধিষ্ঠিত করাতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি যে ,দয়া-নীতির (কায়েদাতুললুতফ যার অর্থ পরে বর্ণনা করা হবে) দাবী হলো যে ,দয়াময় সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের হেদায়াতের জন্য ,পূর্ণগঠনের জন্য এবং তার ও তার সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রাসুল প্রেরণ করবেন।

অনুরূপ আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ তার বান্দাদেরকে নবীর মনোনয়ন ,নির্ধারণ ও নির্বাচনের অধিকার দেননি। কেবলমাত্র মহান আল্লাহই নবী হিসেবে কাউকে মনোনয়ন ও নির্বাচন করতে পারেন। কারণ-আল্লাহই ভাল জানেন যে কোথায় তার বাণী রাখবেন। সুতরাং পথ প্রদর্শক ,সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে মহান আল্লাহ যাঁদেরকে পাঠিয়েছেন তাদের সাথে বিতর্ক করার অধিকার কারো নাই। সেরূপ কারো অধিকার নেই যে বিধান ,সুন্নত ও শরীয়ত হিসেবে তারা যা এনেছেন ঐ ব্যাপারে সে সন্দেহ করবে।

14। নবুওয়াত হলো মহান আল্লাহর ঐশ্বরিক দান (লুত্ফ্) :

মানুষ হলো এক অপূর্ব সৃষ্টি। তার অস্তিত্ব ,প্রকৃতি ,আত্মা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে রয়েছে এক জটিল সমন্বয়। এমনকি মানব জাতির প্রত্যেক সদস্যের ব্যক্তিত্বের মধ্যেই বিদ্যমান জটিল প্রকৃতির সমন্বয়। একদিকে রয়েছে অনাচারের প্রবণতা আর অপরদিকে রয়েছে কল্যাণ ও উত্তমের কারণসমূহ। একদিকে আত্মপ্রীতি ,কামনা-বাসনার মত আবেগ ও প্রবণতা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে সে তার কামনার বশবর্তী হয়ে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। সম্পদ সংগ্রহ করতে চায় এবং অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায় এবং অপরিনামদর্শী হয়ে পার্থিব রূপ জৌলুসের দিকে ধাবিত হতে চায়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন -

নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছ্ । (সুরা আসর -2)

নিশ্চয়ই মানুষ ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছে ,কারণ সে নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করছে। ’’ (সুরা আলাক -6-7)

তিনি আরও বলেন-

নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা ( লোভাতুর মন ) মানুষকে অসৎ কাজের দিকে পরিচালিত করে। (সুরা ইউসুফ - 54 )

এছাড়া এমন আরো অনেক আয়াত আছে যাতে দেখা যায় যে ,মানুষের আত্মা হলো কামনা বাসনা ও আবেগ অনুভূতিতে পূর্ণ।

অপরদিকে মহান আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) দিয়েছেন যাতে সে স্বীয় কল্যাণ ও উন্নতির পথকে সনাক্ত করতে পারে। তিনি তাকে বিবেকও দিয়েছেন যা তাকে অন্যায় ও অপছন্দনীয় পথে যেতে বাধা প্রদান করে।

মানুষের অভ্যন্তরে তার কামনা ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে বিরাজমান রয়েছে অবিরত সংঘর্ষ। যখন তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কামনার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে তখন সে সুউচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় এবং মানবতার সমুন্নত উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু যখন তার কামনা তার বুদ্ধিবৃত্তিকে পরাস্ত করে তখন সে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নিকৃষ্ঠতম মানবে পরিণত হয় সে যাকে পশুর সাথে তুলনা করা যায়।

বিবাদরত (আকল এবং কামনা) এ দুয়ের মধ্যে কামনা ও তার সৈন্যরা অপেক্ষাকৃত বেশী শক্তিশালী। আর এ কারণেই অধিকাংশ মানুষ ধ্বংসের পথে পতিত হয় এবং মুক্তির পথ থেকে দূরে সরে যায় ,তাদের কামনাকে অনুসরণ করে ও বাসনার ডাকে সাড়া দেয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

হে নবী ! তুমি যতই চেষ্টা কর না কেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই ঈমান আনবে না। (সুরা ইউসুফ- 103)

তাছাড়া সে পৃথিবীর সকল সত্য সম্পর্কে এবং তার নিজের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন ও অজ্ঞ। এমনকি সে নিজের সম্পর্কেও অজ্ঞ। কিসে তার লাভ ,কিসে তার ক্ষতি ,কিসে তার কল্যাণ ,কিসে অকল্যাণ কেমন করে সে তা জানবে ?আর নিজের কল্যাণের বা সামগ্রিকভাবে মানবতার কল্যাণের যাবতীয় বিষয় কিভাবে সে জানতে পারবে ?যখনই সে নতুন কোন আবিস্কার নিয়ে অগ্রসর হয় তখনই সে অজ্ঞতাকে দেখতে পায় আর উপলব্ধি করে যে সে আসলে কিছুই জানেনা। আর এ কারণে একান্তভাবেই মানুষের জন্য এমন কারো প্রয়োজন যে তাকে কল্যাণ ও সুখের পথ দেখাবে তখন যখন তার কামনা তাকে প্রতারিত করে ,সুকর্মকে কুকর্মের দ্বারা আচ্ছাদিত করে কিংবা কু-কর্মকে সুকর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে যার ফলে তার বুদ্ধিবৃত্তি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পতিত হয় ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে না কিংবা প্রকৃত ভাল ও মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। বুদ্ধিবৃত্তি ও কামনার এ যুদ্ধে সচেতনভাবে হোক বা অবচেতনভাবে হোক আমরা সকলেই বশীভূত কেবলমাত্র তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ রক্ষা করেন। একজন সুশিক্ষিত ও সভ্য ব্যক্তির পক্ষেও যেখানে ভাল মন্দের পার্থক্য করা কঠিন সেখানে কি করে তা একজন অজ্ঞ ও অশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হবে ?

সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের ভাল-মন্দ সম্পর্কে আলোচনা করলেও কিসে তাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ তা তারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। তাই মহান আল্লাহ মানুষের উপর করুণা প্রদর্শন করে নবী প্রেরণ করেন। যেমন- পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে যিনি তাদের জন্য আয়াত বর্ণনা করবেন ,তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দিবেন। (সুরা জুমআহ-2)

আর তিনি (নবী) তাদেরকে ভাল ও মন্দ সম্পর্কে সতর্ক করবেন এবং কল্যাণ ও সুখের সুসংবাদ দিবেন।

এধরনের দয়া করা মহান আল্লাহর কর্তব্য। কারণ তার বান্দাদের উপর এ দয়া করা তার নিরঙ্কুশ পূর্ণতারই বহিঃপ্রকাশ। আর তিনি তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু ও উদার হস্ত। যখন কেউ তার দয়া ও উদারতা লাভের যোগ্য হয় তখন তিনি অবশ্যই সেখানে তা দান করেন। কারণ ,রহমতের ব্যাপারে আল্লাহর কোন কৃপণতা নেই। আর এখানে কর্তব্য অর্থ এ নয় যে ,কেউ তাকে হুকুম করেন বা বাধ্য করেন যার ফলে তিনি তা তামিল করেন। বরং এখানে আবশ্যকতা বা কর্তব্যের অর্থ হলো ,আমাদের কথায় আমরা যাকে বলি আবশ্যকীয় অস্তিত্ব (বা ওয়াজীবুল ওজুদ) । অর্থাৎ তিনি আবশ্যকীয়রূপে বিদ্যমান। তার অস্তিত্ব তিনিই এবং তার অস্তিত্ব থেকে তাকে পৃথক করা যায় না।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12