শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস25%

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 18570 / ডাউনলোড: 5281
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

১৫। নবীগণের মোজেযা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,মহান আল্লাহ যখন কাউকে তার সৃষ্টির জন্য পথ প্রদর্শক ও সংবাদ বাহক রূপে প্রেরণ করেন তখন তিনি তাকে সুষ্পষ্ঠরূপে মানুষের নিকট পরিচয় করিয়ে দেন। আর এর একমাত্র উপায় হলো তার রেসালাতের স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা যাতে করে মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা মানুষের জন্য পরিপূর্ণরূপে সম্পাদিত হয়। আর সে দলিল এমন হতে হবে যে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো পক্ষে তা সম্ভব নয় এবং তা বাস্তবায়িত হবে হেদায়াতকারী রাসূলের হাতে যা হবে তার পরিচায়ক ও তার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ। আর এ দলিল বা প্রমাণ হলো তা-ই যাকে আমরা মোজেযা (অপরকে অপারগ করা) বা মোজেযা নামকরণ করে থাকি। কারণ তা আনয়ন করতে মানুষ অক্ষম ও অপারগ।

একজন নবীও যখন নিজেকে নবী হিসেবে পরিচয় দেন তখন তার দলিল রূপে মোজেযার পন্থা অবলম্বন করা ব্যতীত কোন উপায় থাকে না। আর এ মোজেযা এমন হয় যে সমসাময়িককালের জ্ঞানী ও গুণীরাও যেখানে তা প্রদর্শন করতে অক্ষম সেখানে অন্যান্য সাধারণ মানুষের কথাতো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া এ মোজেযা নবুওয়াতের দাবীর সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে যা তার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপিত হবে। যখন তা আনয়ন করতে নবী ব্যতীত অন্য কেউ অপারগ হবে তখন সে জানতে পারবে যে ,এটি মানুষের ক্ষমতার উর্ধে এবং অলৌকিক বিষয়। আর এভাবে তারা জানতে পারে যে ,এ মোজেযা আনয়নকারী হলেন একজন অতিমানব যার সাথে সমগ্র জগতের পরিচালকের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। অনুরূপভাবে যখন এমন কোন নবী যিনি মোজেযা প্রদর্শন করেছেন এবং মানুষকে তার নবুওয়াত ও রেসালাতের প্রতি আহবান জানান ,তখন সহজেই মানুষের নিকট তার কথার সত্যতা গ্রহণযোগ্য হয় এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ও তার আদেশ পালন করা প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। আরও আবশ্যক তিনি যাতে বিশ্বাস করেন তাতে বিশ্বাস করা এবং তিনি যাতে অবিশ্বাস করেন তাতে অবিশ্বাস করা।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,প্রত্যেক নবীর মোজেযা তার সমসাময়িককালের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ,কলা ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের উপর প্রদর্শিত হয়ে থাকে। আর এজন্য আমরা দেখতে পাই যে ,হযরত মুসার (আ.) মোজেযা হলো লাঠি যা যাদুকরদের সমস্ত মিথ্যাচারকে বিনাশ করেছিল। কারণ হযরত মুসার (আ.) সমসাময়িককালে যাদুবিদ্যা ছিল জনপ্রিয় কলা। তার এ লাঠি সমস্ত মিথ্যাকে অসার করে দিলে সকলের জানা হয়ে গেল যে এটি তাদের ক্ষমতা বর্হিভূত এবং তাদের কলা-কৌশলের উর্ধে। আর কোন মানুষের পক্ষে এমনটি প্রদর্শন করা অসম্ভব। সুতরাং তাদের সকল বিজ্ঞান ও কলা এর সম্মুখে মূল্যহীন ও অকার্যকর।

অনুরূপ হযরত ঈসার (আ.) মোজেযা ছিল জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য প্রদান করা আর মৃতকে জীবিত করা। কারণ তিনি এমন এক সময় এসেছিলেন যখন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা সমাজে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত হত। কিন্তু তাদের কোন জ্ঞানই ঈসার (আ.) প্রদর্শিত বিষয়ের মত নয়।

আর আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর রয়েছে চিরন্তন মোজেযা। আর তা হলো অভূতপূর্ব সাহিত্যমান সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বাগ্মীতা সম্বলিত পবিত্র কোরআন (যাকে আরবী পরিভাষায় বলে ফাসাহাত ও বালাগাত) । কারণ তদানীন্তনকালে সাহিত্য ও বাগ্মীতা এর চূড়ান্ত শীর্ষে আরোহণ করেছিল। তখন সাহিত্যিকরা ছিল সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি ,তাদের সুন্দর বাচনভঙ্গি ও শ্রুতিমধুরতার কারণে। সুতরাং কোরআন বজ্রপাতের মত এসে তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞাপন করল ও বিস্মিত করল এবং বুঝিয়ে দিল যে ,তারা এমন কিছু করতে অক্ষম। তারা এর সম্মুখে পরাস্ত ও অবনত হলো। আর তাদের অপরাগতার প্রমাণ মেলে তখনই যখন পবিত্র কোরআন তাদেরকে এর দশটি সুরার মত সূরা আনয়নের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহবান করল এবং তারা অক্ষমতা প্রকাশ করল। অতঃপর বলা হলো মাত্র একটি সূরা আনতে। তাতেও তারা অপারগ হলো। আমরা জানি যে ,তারা একটি সূরা আনয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে তারা বাকযুদ্ধের পরিবর্তে তরবারির যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছিল।

অতএব আমরা দেখতে পাই যে ,কোরআন হলো একটি মোজেযা যা হযরত মোহাম্মদ (সা.) তার নবুওয়াতের দাবীর সপক্ষে আনয়ন করেছেন। সুতরাং আমরা জানি যে ,তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল(সা.) ,আর এ সত্য (পবিত্র কোরআন) তিনি নিয়ে এসেছেন।

১৬। নবীগণের পবিত্রতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,নবীগণ হলেন সব দিক থেকে পবিত্র। তাদের মত ইমামগণও (আ.) পবিত্র। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ নবীগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করে না ,ইমামগণের (আ.) পবিত্রতা তো দূরের কথা।

এসমাত বা পবিত্রতা হলো যে কোন প্রকার গুনাহ (হোক সে ছোট বা বড়) বা ভুল ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা যদিও তাদের দ্বারা এগুলো সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় না। কিন্তু তাদের এগুলো থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক। এমনকি শিষ্টাচারগতভাবে যেগুলো দৃষ্টিকটু ও অপছন্দনীয় তা থেকেও মুক্ত থাকা আবশ্যক। যেমন- মানুষের সাথে অশিষ্ট আচরণ ,রাস্তায় দাড়িয়ে খাওয়া ,উচ্চস্বরে হাসা ,কিংবা এমন কিছু করা যা মানুষের নিকট অসুন্দর ও অপছন্দনীয়।

নবীগণের পবিত্র হওয়ার আবশ্যকীয়তার দলিল : যদি নবী কর্তৃক পাপ ও ভুল-ত্রুটি ইত্যাদি এ জাতীয় কাজগুলো সংগঠিত হয় ,তাহলে তা পালন করা (পাপ হোক বা ভুল-ত্রুটি) হয় আমাদের জন্য আবশ্যক হবে ,না হয় আবশ্যক হবে না। যদি তাদেরকে অনুসরণ করা আবশ্যক হয় ,তবে পাপ কাজ করা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বৈধ হবে ,এমনকি তা করা আমাদের জন্য ওয়াজীব হবে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ও দ্বীনের সুষ্পষ্ট দলিলের উপস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার যদি তাদের অনুসরণ করা আমাদের জন্য আবশ্যক না হয় তবে নবুওয়াতই অস্বীকৃত হয়। কারণ একান্ত বাধ্যগতভাবেই নবীকে অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং কথায় ও কাজে তিনি যা করবেন তাতে যদি পাপ ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তাকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য অসম্ভব। ফলে তার নবুওয়াতের উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। এমনকি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই হয়ে যাবেন নবী যার কথা বা কাজের সে সমুন্নত মূল্য থাকবে না যা আমরা সর্বদা আশাকরি। ফলে তার কোন কথা ও কাজ এবং আদেশই অনুসরণীয় হবে না এবং বিশ্বাসযোগ্য থাকবে না।

আর এ দলিল ইমামগণের পবিত্রতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ আমরা মনে করি যে ,ইমামগণও (আ.) মহান আল্লাহ কর্তৃক মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী (সা.) এর প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগকৃত হবেন। (ইমামত অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে)

১৭। নবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,যেমনি করে তার পবিত্র হওয়া আবশ্যক তেমনি আবশ্যক সকল মানবীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ থাকা। যেমন- বীরত্ব ,রাজনীতি ,প্রশাসন ,ধৈর্য ,বুদ্ধিবৃত্তি ,প্রত্যুৎপন্নমতিতা ইত্যাদি। অর্থাৎ কেউই এ সকল বৈশিষ্ট্যে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কারণ যদি তা না হয় তবে সকল সৃষ্টির উপর তার সার্বজনীন প্রাধান্য থাকতে পারে না এবং সামগ্রিকভাবে জগতকে পরিচালনা করার মত সামর্থ্য তার থাকবে না।

অনুরূপ তাকে হতে হবে জন্মগতভাবে পবিত্র বংশদ্ভূত ,সৎ ,সত্যবাদী। এমনকি নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বেও তাকে সমস্ত প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যাতে মানুষ তাকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করতে পারে ,তার নিকট আশ্রয় পেতে পারে এবং সংগত কারণেই তিনি এ মহান ঐশী মর্যাদার (পবিত্রতা) উপযুক্ত।

১৮। পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাদের ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

সামগ্রিকভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে ,সমস্ত নবী ও রাসুল হলেন সত্য। তেমনি তাদের এসমাত বা পবিত্রতায়ও আমরা বিশ্বাস করি। আর তাদের নবুওয়াতকে অস্বীকার করা ,তাদের কুৎসা করা ,বিদ্রূপ করা হলো কুফরি ও নাস্তিকতা। আর এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদকেই (সা.) অস্বীকার করা হয়। কারণ তিনিই তার পূর্ববর্তী নবীদের ব্যাপারে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছিলেন এবং সত্যায়িত করেছিলেন।

হযরত আদম (আ.) ,নূহ (আ.) ,ইব্রাহিম (আ.) ,দাউদ (আ.) ,সোলায়মান (আ.) এবং অন্যান্য যাঁদের নাম পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ যাঁদের নাম এবং শরীয়ত প্রসিদ্ধ ,বিশেষকরে তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। আর যদি কেউ তাদের একজনকে অস্বীকার করে তবে সে যেন সকলকে অস্বীকার করল। বিশেষ করে আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) নবুওয়াতকে অস্বীকার করল।

অনুরূপভাবে তাদের গ্রন্থসমূহ এবং তাদের উপর যা নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনাও আবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে যে ইঞ্জিল ও তৌরাত মানুষের নিকট আছে তা যেরূপ নাযিল হয়েছিল সেরূপ আর নেই। বর্তমানে এতদ্ভয়ের মধ্যে বিকৃতি ও পরিবর্তন ,সংযোজন ও বিয়োজনের প্রমাণ মিলে যা হযরত মুসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর সংগঠিত হয়েছে। এক ধরনের লোভী ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিদের দ্বারা এ বিকৃতি সাধিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যা আছে তার অধিকাংশই হযরত মূসা (আ.) ও ঈসার (আ.) পর তাদের অনুসারীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে।

১৯। ইসলাম ধর্মে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামই হলো মহান আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। এটি সত্য ঐশী বিধান ,সর্বশেষ শরীয়ত ,পূর্ববর্তী সকল শরীয়তের রহিতকারী শরীয়ত ,পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিধান যাতে সন্নিবেশিত আছে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সমস্ত কল্যাণ ও সফলতার উপায়। এ বিধান সমস্ত সময় ও কালের জন্য অবশিষ্ট থাকার উপযুক্ত এবং কখনো পরিবর্তন হবে না। মানুষের ব্যক্তিগত ,সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল চাহিদার জবাবের সমাহার ঘটেছে এ বিধানে। এটি হলো সর্বশেষ শরীয়ত ,এরপর আর কোন শরীয়ত আসবে না। জুলুম ও ফেসাদে মুহ্যমান মানবতাকে এ শরীয়ত পরিশুদ্ধ করে। আর তাই এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন ইসলাম ধর্ম আরো শক্তিশালী হবে এবং এর ন্যায়-নীতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।

যখন এ বিশ্বে সমগ্র মানুষ পরিপূর্ণরূপে ইসলামের বিধান মেনে চলবে ,তখন মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। জন কল্যাণ ,মান-সম্মান ,ঐশ্বর্য ,মানবীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যের শীর্ষে আরোহন করবে। অপরদিকে জুলুম-অত্যাচার ,দারিদ্র ইত্যাদি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ দ্বারা পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করবে। বর্তমানে আমরা কিছু মুসলমান নামধারী মানুষের মাঝে যে লজ্জাকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি তার কারণ হলো ,প্রথম থেকেই তাদের আচার ব্যবহার প্রকৃতার্থে ইসলামী বিধান মোতাবেক ছিল না। আর এ অবস্থা চলতে চলতে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মুসলমানদের লজ্জাকর পশ্চাৎপদতার কারণ ইসলামকে গ্রহণ করা নয়। বরং এর কারণ হলো ইসলামের শিক্ষাকে অমান্য করা ,ইসলামী নিয়ম-নীতিকে অগ্রাহ্য করা ,তাদের শাসকবর্গ কর্তৃক অন্যায় এবং শত্রুতাকে দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। আর এগুলোর কারণে তাদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে করেছে দুর্বল ,তাদের মনুষ্যত্বকে করেছে ধ্বংস। পরিশেষে তারা পতিত হয়েছে দুঃখ দূর্দশায়। আল্লাহ তাদেরকে তাদের পাপ দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

এটা এ কারণে যে ,আল্লাহ কোন জাতির উপর তার কর্তৃক বর্ষিত নেয়ামত পরিবর্তন করেন না ,যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মধ্যে যা কিছু আছে তার পরিবর্তন করে। (সুরা আনফাল -৫৩)

আর আল্লাহর সৃষ্টির জন্য এটাই তার বিধান। কোরআন আরও বলে-

অন্যায়কারীরা কখনোই সফল হবে না। (সুরা ইউনুস -১৭)

অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে-

নিশ্চয়ই তোমার প্রভু কোন জাতিকে তাদের অন্যায়ের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। (সূরা হুদ - ১১৭)

পুনরায় বর্ণিত হয়েছে-

আর এরকমই হলো শহরের জালিম নাগরিকদের জন্য তোমার প্রভুর শাস্তি। তোমার প্রভুর শাস্তি সত্যিই কঠোর। (সূরা হুদ - ১০২)

আমরা এমন এক দ্বীন থেকে কি করে আশা করতে পারি যে ,ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যাওয়া তার অনুসারীদেরকে রক্ষা করবে যেখানে এর শিক্ষা শুধুমাত্র কাগজে কলমে শোভা পাচ্ছে এবং বিন্দুমাত্র এর শিক্ষার অনুশীলন নেই ?

ইসলামের ভিত্তিমূল হলো- বিশ্বাস ,সততা ,সত্যবাদিতা ,শিষ্টতা ,শালীনতা ও ত্যাগ। একজন মুসলমান তার ভাইয়ের জন্য তা-ই আশা করে যা সে নিজের জন্য করে। কিন্ত মুসলমানরা সুদীর্ঘ কাল পূর্বেই এগুলোকে পশ্চাতে ফেলে এসেছে।

সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন দল ও উপদলে। পার্থিব বিষয় আশয়ের জন্য করছে তারা প্রতিযোগিতা। অনর্থক কোন বিষয়বস্তুর জন্য আপন খেয়ালে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করছে কিংবা কাফের বলে আখ্যায়িত করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে ইসলামকে এবং তাদের নিজেদের ও সমাজের কল্যাণকে। যে বিষয়গুলোর উপর তারা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সেগুলোর উদাহরণ হলো নিম্নরূপ- কোরআন কি সৃষ্টি না সৃষ্টি নয় ;বেহেশত ও দোযখ কি তৈরী করা হয়েছে না ভবিষ্যতে হবে ইত্যাদি। আর এগুলোর উপর ভিত্তি করেই তারা পরস্পরকে কাফের বলছে।

তাদের এ মতবিরোধের ধরন দেখে অনুধাবন করা যায় যে তারা প্রকৃত প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কালের প্রবাহে তাদের এ বিচ্যুতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অজ্ঞতা ও বিপথগামিতা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তারা অকার্যকর তুচ্ছ কুসংস্কার ও কল্পিত বিষয়বস্তু নিয়ে বসে আছে। পারস্পরিক সংঘাত ,সংঘর্ষ ও আত্মম্ভরিতা তাদেরকে দিন দিন হতাশার অতল গহীনে নিমজ্জিত করছে। অপরদিকে ইসলামের চিরশত্রু পাশ্চাত্য উত্তর উত্তর শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুসলমানরা যখন ঘুমে ,অর্ধঘুমে তখন তারা ইসলামী দেশগুলোকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে চলেছে। এ দূর্ভাগ্যের শেষ কোথায় তা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন।

নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ঐ শহরের অধিবাসদেরকে তাদের পাপের জন্য ধ্বংস করেন না যারা নিজেদেরকে সংশোধন করে। (সুরা হুদ- ১১৭)

আজ অথবা কাল যেদিনই হোক না কেন সুখ সমৃদ্ধির জন্য মুসলমাদেরকে তাদের নিজেদের কর্মকান্ডের পর্যালোচনা করতেই হবে এবং তা ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। তাদেরকে এবং তাদের বংশধরদেরকে সঠিক ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে ও পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করতে হবে। আর এ রূপেই তারা নিজেদেরকে এ ভয়ংকর দুঃখ দুর্দশা থেকে পবিত্রাণ করাতে পারবে। আর এরকমটি করলে ন্যায়-নীতিতে বিশ্ব সেরূপ পরিপূর্ণ হতে বাধ্য যেরূপ অন্যায় ও অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মহান আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) প্রতিশ্রুতি এমনটিই। কারণ এ দ্বীনই (ইসলাম) হলো সর্বশেষ ধর্ম যার অনুসরণ ব্যতীত পৃথিবীতে কল্যাণ ও শান্তি ফিরে আসবে না। এটা সত্য যে ,ইসলামকে কুসংস্কার ,বিকৃতি ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করার জন্য একজন ইমামের আবশ্যকতা রয়েছে। তিনি মানবতাকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে পূর্ণ কলুষতা ,অব্যাহত অন্যায় অত্যাচার যা মানুষের আত্মা ও চারিত্রিক মূল্যবোধের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত তা থেকে রক্ষা করবেন। মহান আল্লাহ সে ইমামের আবির্ভাব ত্বরান্বিত ও সহজ করুন।

২০। ইসলামের মহানবী (সা.) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইসলামের বাণী বাহক হলেন মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.) যিনি সর্বশেষ নবী ,প্রেরিত পুরুষদের সর্দার এবং নিঃশর্তভাবে তাদের শ্রেষ্টতম। তেমনি তিনি সকল মানুষের শীর্ষে। তার (সা.) শ্রেষ্টত্বের সাথে কাউকে তুলনা করা যায় না। বদান্যতার দিক থেকে কেউ তাকে ছুতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে কেউই তার নিকটবর্তী নয়। সৃষ্টিকুলে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তিনিই হলেন সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কেউই তার সমকক্ষ নয়।

২১। পবিত্র কোরআন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :

আমরা বিশ্বাস করি যে ,পবিত্র কোরআন হলো আল্লাহর বানী যা তিনি মহানবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) উপর নাযিল করেছেন। এতে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে। এটি হলো একটি চিরন্তন মোজেযা। মানুষের পক্ষে এরূপ সাহিত্যমান ও বাগ্মীতাসম্পন্ন কিছু রচনা করা অসম্ভব । এতে রয়েছে উচ্চতর জ্ঞান ও সত্য। কখনোই এতে পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ও বিকৃতি সাধিত হবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে ,যে কোরআন এখন আমাদের নিকট আছে এবং যা আমরা এখন পাঠ করি তা সেই কোরআন যা মহানবীর (সা.) উপর নাযিল হয়েছিল। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম দাবী করে তবে সে হয় দুষ্ট প্রকৃতির লোক অথবা কুচক্রী কিংবা পথভ্রষ্ট। আর এ ধরনের লোকেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত নয়। মহান আল্লাহ বলেন-

অগ্র ও পশ্চাৎ (কোন দিক থেকেই) মিথ্যা এতে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা হামীম সেজদাহ -৪২)

কোরআনের অলৌকিকত্বের (মোজেযা) স্বপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো এই যে ,সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ,বিজ্ঞান ও কলা ততই অগ্রসরমান হচ্ছে ,তথাপি কোরআন সমুন্নত চিন্তা-চেতনায় চির ভাস্বর ও মধুময়। এমন কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদ এতে নেই যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুনিশ্চিত দার্শনিক কোন সত্যের সাথেই কোরআন সাংঘর্ষিক নয়। অপরদিকে অনেক সনামধন্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রয়েছেন যারা চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছেন অথচ তাদের গ্রন্থেও অন্ততঃপক্ষে কিঞ্চিত স্ববিরোধিতা কিংবা ন্যূনতম ভুল হলেও পাওয়া যায়। অধিকন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি ও আধুনিক তথ্যের ফলে এমনকি সক্রেটিস ,প্লেটো এবং এ্যারিষ্টটলের মত প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিকদের যাদেরকে পরবর্তীরা বিজ্ঞানের জনক ও শিক্ষক হিসেবে স্বীকার করেছেন তাদের গ্রন্থেও কিছু ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা আরও বিশ্বাস করি যে ,কথায় ও কাজে কোরআনের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। সুতরাং কোরআনের কোন শব্দকে কিংবা শব্দাংশকে (অক্ষরকে) অপবিত্র করা অবৈধ। অনুরূপ অবৈধ হলো অপবিত্র অবস্থায় এর কোন শব্দ বা অক্ষর স্পর্শ করা। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-

পবিত্রতা ব্যতীত কেউই একে স্পর্শ করতে পারে না। (সুরা ওয়াকিয়া - ৭৯)

আর এ আদেশ বড় ধরনের অপবিত্রতা যেমন- জানাবাত ,হায়েজ ,নেফাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য তেমনি ছোট ধরনের অপবিত্রতা যেমন- ঘুম ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসবের জন্য ফিকাহ শাস্ত্রে বর্ণিত ব্যাখ্যা মোতাবেক গোসল বা অজু করলে কোরআন স্পর্শ করা বৈধ হবে।

অনুরূপভাবে কোরআনকে অগ্নিদগ্ধ করা বৈধ নয়। সেরূপ বৈধ নয় অপমান করা তা যে কোন ভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ সাধারনের মধ্যে যেটা অপমান বলে পরিগনিত হয় তা করা যাবে না। যেমন- নিক্ষেপ করা ,অপরিস্কার করা ,পা দিয়ে ঠেলে দেয়া কিংবা অসম্মান জনক জায়গায় রাখা। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে উপরোল্লিখিত যে কোন একটি কাজ অথবা এ ধরনের কোন কাজ করে তবে সে ইসলাম ও এর পবিত্রতাকে অস্বীকারকারীদের মধ্যে পরিগণিত হবে। সে দ্বীনে অবিশ্বাসী। প্রকারান্তরে সে বিশ্বাধিপতি আল্লাহকে অস্বীকার করেছে।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব কালের সার্বিক চিত্র

যদিও পবিত্র কোরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন মুজিযা এবং সব যুগে সকল প্রজন্মের জন্য তা নতুন ,এতদসত্ত্বেও ইসলাম ধর্মের চির জীবন্ত মুজিযাসমূহের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মহানবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ঐ সব হাদীস ও রেওয়ায়েত (বর্ণনা) যা ইসলাম ধর্মের (প্রতিশ্রুত) পুনর্জাগরণ পর্যন্ত মানব জাতির ভবিষ্যৎ জীবন এবং ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যৎ গতিধারা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে । আর এটি হবে ঐ সময় যখন মহান আল্লাহ্ তাঁর ধর্মকে সকল কাফির ও মুশরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পৃথিবীর সকল ধর্ম ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী করবেন ।

ইসলাম ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের এ যুগই হচ্ছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ যা এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় । আর সাহাবী ,তাবেয়ী ও সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহের রচয়িতাগণের মাধ্যমে মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত সুসংবাদ প্রদানকারী শত শত রেওয়ায়েতেও এ দুই যুগ ও মহাঘটনা (ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব) সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে । আসলে এ দু মহাঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যদিও এ সব রেওয়ায়েতে (বর্ণনার ক্ষেত্রে) পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান । যদি আহলে বাইতের ইমামদের রেওয়ায়েতসমূহ এ সব রেওয়ায়েতের সাথে যোগ করা হয় ,তাহলে এতৎসংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের সংখ্যা 1000-এরও অধিক হবে । যদিও ইমামগণ তাঁদের হাদীসগুলো সবসময় মহানবী (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করেন নি ,তবে তাঁরা অসংখ্যবার তাগীদ দিয়ে বলেছেন যে ,তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন তা তাদের পবিত্র পূর্বপুরুষগণ এবং তাঁদের শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ মহানবী (সা.) থেকেই তাঁরা লাভ করেছেন ।

এ সব রেওয়ায়েতে আবির্ভাবের যুগে পৃথিবী ,বিশেষ করে যে অঞ্চলে ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন সেই অঞ্চল ,যেমন ইয়েমেন ,হিজায ,ইরান ,ইরাক ,শাম (সিরিয়া ,লেবানন ও জর্দান) ,ফিলিস্তিন ,মিশর ও মাগরিবের (মরক্কো ,আলজেরিয়া ,তিউনিসিয়া ও লিবিয়া) যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা ছোট-বড় অনেক ঘটনা এবং বহু ব্যক্তি ও স্থানের নামকে শামিল করে ।

আমি অগণিত রেওয়ায়েত ও হাদীসের মধ্য থেকে এ সব রেওয়ায়েত ও হাদীস বাছাই করে যতটা সম্ভব সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট করে এবং ধারাবাহিকতা সহকারে সাধারণ মুসলিম পাঠকবর্গের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি ।

এ সব রেওয়ায়েত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে এ অধ্যায়ে এগুলোর একটি সার সংক্ষেপ উল্লেখ করব যাতে করে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালের একটি সাধারণ চিত্র বা ধারণা আমরা পেতে পারি । বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ,আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপ্লব ও আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে ।

এ সব রেওয়ায়েত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোমানদের (পাশ্চাত্য) সাথে তুর্কী এবং তাদের সমর্থকদের (রুশ) বাহ্যত একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হবে -যা বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে ।

কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক দু টি সরকার ও প্রশাসন ইরান ও ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হবে । মাহ্দী (আ.)-এর ইরানী সঙ্গী-সাথীরা তাঁর আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে নিজেদের একটি সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে । অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্যে দু ব্যক্তি (একজন খোরাসানী সাইয়্যেদ যিনি হবেন রাজনৈতিক নেতা এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন সামরিক নেতা) আবির্ভূত হবেন এবং এ দু ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানী জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ।

কিন্তু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কয়েক মাস আগে তাঁর ইয়েমেনী সঙ্গী-সাথিগণের বিপ্লব ও অভ্যুত্থান বিজয় লাভ করবে এবং তারা বাহ্যত হিজাযে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার জন্য তাঁকে সাহায্য করবে ।

হিজাযের এ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হচ্ছে হিজাযের কোন এক বংশের এক নির্বোধ ব্যক্তি যার নাম হলো আবদুল্লাহ্ ,সে দেশের সর্বশেষ বাদশাহ্ হিসেবে নিহত হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে -এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন এক মতবিরোধের সৃষ্টি হবে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে ।

যখন আবদুল্লাহর মৃত্যু হবে ,তখন জনগণ কোন্ ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে -এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না । আর এ অবস্থা যুগের অধিপতি র (ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে । বহু বছর রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে কয়েক মাস বা কয়েক দিনের রাজত্ব করার অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী শাসনের পালা চলে আসবে ।

আবু বসীর বলেন : আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এ অবস্থা কি দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে ?তিনি বললেন : কখনই না । বাদশাহর (আবদুল্লাহ্) হত্যাকাণ্ডের পরে এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হিজাযের গোত্রসমূহের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে পর্যবসিত হবে ।

(ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে ঐ ঘটনা যা দু হারামের (মক্কা ও মদীনা) মাঝখানে সংঘটিত হবে । আমি বললাম : কোন্ ঘটনা ঘটবে ?তিনি বললেন : দু হারামের মাঝে গোত্রীয় গোঁড়ামির উদ্ভব হবে এবং অমুকের বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বিরোধী গোত্রের 15 জন নেতা ও ব্যক্তিত্বকে অথবা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে ।

এ সময়ই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আসমানী আহবান বা ধ্বনি যা তাঁর নামে 23 রমযানে শ্রুত হবে ।

সাইফ ইবনে উমাইরাহ্ বলেছেন : আমি আবু জাফর আল মনসূরের (দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলীফা) নিকটে ছিলাম । তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন : হে সাইফ ইবনে উমাইরাহ্! নিঃসন্দেহে আকাশ থেকে একজন আহবানকারী আবু তালিবের বংশধরগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করবে । আমি বললাম : আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত ,হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ কথা বর্ণনা করেছেন ?তিনি বললেন : হ্যাঁ ,যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ ,এ কথা আমি আমার নিজ কানে শুনেছি । আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এখন পর্যন্ত এ ধরনের হাদীস কারো কাছ থেকে শুনি নি । তিনি বললেন : হে সাইফ! এ কথা সত্য । যখন ঐ ঘটনা ঘটবে তখন আমরাই সর্বপ্রথম এ আহবানে সাড়া দেব । তবে ঐ ধ্বনি আমাদের একজন পিতৃব্যপুত্রের প্রতি নয় কি ?আমি বললাম : সে কি ফাতিমার বংশধর হবে ?তিনি বললেন : হ্যাঁ ,হে সাইফ! অনন্তর যদি আমি এ রেওয়ায়েতটি আবু জাফার মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-বাকির থেকে না শুনতাম তাহলে সমগ্র জগৎবাসী আমাকে বললেও আমি তা মেনে নিতাম না । কিন্তু এর বর্ণনাকারী তো ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ।

এ সব রেওয়ায়েত অনুসারে এই আসমানী আহবান শোনার পরই ইমাম মাহ্দী (আ.) গোপনে তাঁর কতিপয় সঙ্গী ও সমর্থকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন । তখন তাঁর ব্যাপারে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আলোচনা হতে থাকবে এবং তাঁর নাম সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে । তাঁর প্রতি ভালোবাসা সবার হৃদয়ে আসন লাভ করবে ।

তাঁর শত্রুরা তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে খুব ভীত হয়ে পড়বে এবং এ কারণে তারা তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে । জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে যে ,তিনি মদীনায় অবস্থান করছেন ।

বিদেশী সামরিক বাহিনী অথবা হিজায সরকার সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনয়ন এবং সরকারের সাথে গোত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করার জন্য সিরিয়াস্থ সুফিয়ানী সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইবে ।

এ সেনাবাহিনী মদীনায় প্রবেশ করে হাশেমী বংশীয় যাকে পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে । তাদের অনেককে এবং তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে এবং অবশিষ্টদেরকে জেলখানায় বন্দী করে রাখবে ।

সুফিয়ানী তার একদল সৈন্যকে মদীনায় প্রেরণ করবে এবং তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে । মাহ্দী ও মানসূর সেখান থেকে পলায়ন করবেন । তারা মহানবীর সকল বংশধরকে গ্রেফতার করবে । আর এর ফলে কোন ব্যক্তিই মুক্ত থাকবে না । সুফিয়ানী বাহিনী ঐ দু ব্যক্তিকে ধরার জন্য মদীনা নগরীর বাইরে যাবে এবং ইমাম মাহ্দী (ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে) হযরত মূসা (আ.)-এর মতো ভীত ও চিন্তিত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে মক্কাভিমুখে চলে যাবেন ।

অতঃপর ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরীতে তাঁর কতিপয় সঙ্গী-সাথীর সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে করে তিনি পবিত্র হারাম থেকে এশার নামাযের পরে মুহররম মাসের দশম রাতে (আশুরার রাতে) তাঁর আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন । তখন তিনি মক্কার জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করবেন । এর ফলে তাঁর শত্রুরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করবে । কিন্তু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে এবং শত্রুদেরকে বিতাড়িত করে প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর পবিত্র মক্কানগরীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে ।

মুহররম মাসের দশম দিবসের (আশুরার দিবস) প্রভাতে ইমাম মাহ্দী সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বাণী প্রদান করে বিশ্বের জাতিসমূহকে আহবান জানাবেন যাতে করে তারা তাঁকে সাহায্য করে । তিনি ঘোষণা করবেন যে ,যে মুজিযার প্রতিশ্রুতি তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তা ঘটা পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করবেন । আর উক্ত মুজিযা হবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আন্দোলন দমন করার জন্য পবিত্র মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া ।

অল্প কিছুক্ষণ পরেই প্রতিশ্রুত মুজিযা বাস্তবায়িত হবে এবং যে সুফিয়ানী বাহিনী পবিত্র মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল তা ধ্বংস হয়ে যাবে ।

যখন তারা (সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনী) মদীনার মরুপ্রান্তরে পৌঁছবে তখন মহান আল্লাহ্ তাদেরকে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করবেন । আর এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণীর বাস্তব রূপ । তিনি বলেছেন , আর যদি আপনি হে নবী! যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত তাদের কঠিন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তখন আপনি ভীত হয়ে যাবেন ;আর তাদের শাস্তি বিন্দুমাত্র কম করা হবে না এবং তারা নিকটবর্তী স্থানে (মহান আল্লাহর শাস্তির) শিকার হবে । যখনই তারা মরুপ্রান্তরে পৌঁছে যাবে ঠিক তখনই তাদেরকে ভূমি গ্রাস করবে এবং যারা সামনে থাকবে তারা ঐ দল কি করছে তা দেখার জন্য পিছনে ফিরে আসবে অথচ তারাও ঐ একই ভাগ্য বরণ করবে ;আর যারা পিছনে থাকবে তারা তাদের (যারা ভূমিধ্বসের কারণে ভূ-গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে) সাথে মিলিত হবে অর্থাৎ তাদের স্থানে (ভূমি ধ্বসের স্থানে) পৌঁছে তাদের খুঁজতে থাকবে তখন তারাও ঐ একই বিপদে পতিত হবে ।

এ মুজিযার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) 10000-এরও অধিক সৈন্য নিয়ে মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং শত্রুবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর সেখানে অবস্থান গ্রহণ এবং মদীনা শত্রুমুক্ত করবেন । এরপর তিনি দুই হারাম (মক্কা ও মদীনা) মুক্ত করার মাধ্যমে হিজায বিজয় এবং সমগ্র অঞ্চলের (আরব উপদ্বীপ) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন ।

কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) হিজায বিজয়ের পর দক্ষিণ ইরান অভিমুখে রওয়ানা এবং সেখানে খোরাসানী ও শুআইব ইবনে সালিহের নেতৃত্বাধীন ইরানী সেনাবাহিনী ও সেদেশের জনগণের সাথে মিলিত হবেন । তারা তাঁর হাতে বাইআত করবে । তিনি তাদের সহায়তায় বসরায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন যার ফলে তিনি এক সুস্পষ্ট ও বিরাট বিজয় লাভ করবেন ।

এরপর তিনি ইরাকে প্রবেশ করবেন এবং সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করবেন । তিনি সেদেশে সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে পরাভূত ও হত্যা করবেন ।

এরপর তিনি ইরাককে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র এবং কুফা নগরীকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করবেন । আর এভাবে ইয়েমেন ,হিজায ,ইরাক এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ সর্বতোভাবে তাঁর শাসনাধীনে চলে আসবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে ,ইরাক বিজয়ের পর ইমাম মাহ্দী (আ.) সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের উদ্যোগ নেবেন তা হবে তুর্কীদের সাথে তাঁর যুদ্ধ । হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

أول لواء يعقده يبعثه إلى التّرك فيهزمهم

প্রথম যে সেনাদল তিনি গঠন করবেন তা তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন । অতঃপর তা তাদেরকে পরাজিত করবে ।

বাহ্যত তুর্কী বলতে রুশদেরকেও বোঝানো হতে পারে যারা রোমানদের (পাশ্চাত্যের) সাথে যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়বে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) সেনাদল গঠন করার পর তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে কুদসে (জেরুজালেম) প্রেরণ করবেন । এ সময় তাঁর সেনাবাহিনী দামেশকের কাছে মারজ আযরা এলাকায় আগমন করা পর্যন্ত সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করতে থাকবে এবং তাঁর ও সুফিয়ানীর মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে । তবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর সামনে সুফিয়ানীর অবস্থান এতটা দুর্বল হয়ে পড়বে যে ,রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় সুফিয়ানী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইবে । কিন্তু এ কাজের জন্য তার ইহুদী-রোমান মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে ।

তারা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) ও তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হবে । এ যুদ্ধের উপকূলীয় অক্ষরেখাসমূহ ফিলিস্তিনের আক্কা ( عكّا ) থেকে তুরস্কের আনতাকিয়াহ্ ( انطاكية ) পর্যন্ত এবং ভিতরের দিকে তাবারীয়াহ্ 1 থেকে দামেশক ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে ।

এ সময় সুফিয়ানী ,ইহুদী এবং রোমান সেনাবাহিনী মহান আল্লাহর (ঐশী) ক্রোধে পতিত হবে এবং তারা মুসলমানদের হাতে এমনভাবে নিহত হতে থাকবে যে ,তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রস্তরখণ্ডের পিছনেও লুকায় তখন ঐ প্রস্তরখণ্ড চিৎকার করে বলে উঠবে : হে মুসলমান! এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে । তাকে হত্যা করো ।

এ সময় মহান আল্লাহর সাহায্য ইমাম মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানদের কাছে আসবে এবং তাঁরা বিজয়ী বেশে আল কুদসে প্রবেশ করবেন ।

খ্রিস্টান পাশ্চাত্য আকস্মিকভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে ইহুদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহের পরাজয় বরণের কথা জানতে পারবে । তাদের ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হবে এবং তারা ইমাম মাহ্দীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে ।

কিন্তু আকস্মিকভাবে হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে পবিত্র কুদসের ওপর অবতরণ করবেন এবং তিনি সমগ্র বিশ্ববাসী ,বিশেষ করে খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন ।

হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর অবতরণ বিশ্ববাসীর জন্য এমন এক নিদর্শন হবে যা হবে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য আনন্দের কারণ ।

সম্ভবত হযরত ঈসা (আ.) ,ইমাম মাহ্দী ও পাশ্চাত্যের মাঝে মধ্যস্থতা করবেন এবং এ কারণে দু পক্ষের মধ্যে সাত বছর মেয়াদী একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে ।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

তোমাদের ও রোমানদের (পাশ্চাত্য) মধ্যে চারটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হবে । এগুলোর মধ্যে চতুর্থটি হিরাক্লিয়াসের এক বংশধরের সাথে সম্পাদিত হবে এবং তা সাত বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে ।

মাস্তূর বিন গাইলান নামীয় আবদুল কাইস গোত্রের এক ব্যক্তি তখন জিজ্ঞাসা করেছিল : হে রাসূলাল্লাহ্! ঐ দিন জনগণের নেতা (মুসলমানদের নেতা) কে হবেন ? তিনি বলেছিলেন : আমার বংশধর মাহ্দী । যাকে দেখে মনে হবে তার বয়স 40 বছর । তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল তারকার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকবে । তার ডান গালের ওপর একটি তিল থাকবে । ঐ সময়ে সে দু টি কাতাওয়ানী 2 কাবা 3 পরিহিত থাকবে এবং তাকে দেখতে ইসরাইল বংশীয় পুরুষদের মতো লাগবে । সে ভূগর্ভস্থ সম্পদরাজি উত্তোলন করবে এবং শিরক ও পৌত্তলিকতায় পূর্ণ একটি নগরীকে মুক্ত ও পবিত্র করবে ।

কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে পাশ্চাত্য দু বছর পরে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করবে । সম্ভবত এ চুক্তি ভঙ্গ করার কারণ হচ্ছে ঐ ভয়-ভীতি যা ঈসা (আ.) কর্তৃক পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের মাঝে গণজাগরণ ও সংহতির জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভূত হবে । বহু পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)- কে সাহায্য ও সমর্থন দান করবে ।

এ কারণেই রোমানরা দশ লক্ষ সৈন্য সহকারে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অকস্মাৎ আক্রমণ চালাবে ।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

তখন পাশ্চাত্য তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে 80টি সেনাদল নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে । প্রতিটি সেনাদলে 12000 সৈন্য থাকবে ।

আর মুসলিম বাহিনী তাদের মোকাবিলা করবে এবং হযরত ঈসা (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নীতি অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তাঁর নীতি ঘোষণা করবেন এবং ইমাম মাহ্দীর পেছনে বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় করবেন ।

রোমানদের (পাশ্চাত্য) বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ যে সব স্থান বা অক্ষ বরাবর আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সে সব স্থানে অর্থাৎ আক্কা থেকে আনতাকিয়া ,দামেশক থেকে আল কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম) এবং মারজ দাবিক 4 পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হবে । এ মহাযুদ্ধে রোমীয়গণ শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে এবং (ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে) মুসলমানগণ স্পষ্ট ও বৃহৎ এক বিজয় লাভ করবে ।

এ যুদ্ধের পর ইমাম মাহ্দীর সামনে খ্রিস্টান ইউরোপ ও পাশ্চাত্য বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে । আর দৃশ্যত অনেক জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে ইমাম মাহ্দী ও হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরোধী সরকারসমূহের পতন ঘটাবে এবং ইমাম মাহ্দীর সমর্থক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র পাশ্চাত্য বিজয় এবং তা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসার পর অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে । এ সময় হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করবেন । মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানগণ তাঁর জানাযার নামায পড়বেন । হাদীসের বর্ণনানুসারে ইমাম মাহ্দী হযরত ঈসা (আ.)-এর জানাযার নামায ও দাফন অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে জনতার উপস্থিতিতে সম্পন্ন করবেন যাতে অতীতের মতো তাঁর ব্যাপারে কেউ পুনরায় অগ্রহণীয় উক্তি করতে না পারে । অতঃপর ইমাম মাহ্দী তাঁকে তাঁর মা হযরত মরিয়ম সিদ্দীকা (আ.) নিজ হাতে যে বস্ত্রটি বয়ন করেছিলেন তা কাফন হিসাবে পরিধান করাবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করবেন ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র বিশ্ব বিজয় এবং বিশ্বের সকল দেশ ,রাষ্ট্র ও প্রশাসন একটি একক ইসলামী প্রশাসনের আওতায় একীভূত হওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে ঐশী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন । তিনি পার্থিব জীবনের উন্নতি ও বিকাশ এবং মানব জাতির সচ্ছলতা ,কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন কল্পে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করবেন । তিনি সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এবং মানব জাতির ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানের পর্যায়কে উন্নীত করার চেষ্টা চালাবেন ।

কতিপয় হাদীস অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.) মানব জাতির জ্ঞানের সাথে আরও যে জ্ঞান যোগ করবেন তার প্রবৃদ্ধির হার হবে 25 : 2 অনুপাতে । অর্থাৎ মানব জাতি এর আগে জ্ঞানের যে দু ভাগের অধিকারী ছিল তার সাথে আরো 25 ভাগ যুক্ত করবেন এবং সার্বিকভাবে মানুষের জ্ঞান তখন 27 ভাগ হবে ।

ঠিক একইভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে অন্যান্য গ্রহ ও নভোমণ্ডলের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীবাসীদের যোগাযোগের দ্বার উন্মুক্ত হবে । বরং আমাদের পার্থিব এ জগতের সামনে গায়েবী (আধ্যাত্মিক ও অবস্তুগত) জগতের দ্বারসমূহ খুলে যাওয়া শুরু হবে । এর ফলে বেহেশত থেকে মানুষ এ পৃথিবীতে আগমন করবে যা হবে পৃথিবীবাসীদের কাছে অলৌকিক বিষয় ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে এবং তাঁর পরেও বেশ কিছু সংখ্যক নবী ও ইমাম এ পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং যতদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ চাইবেন ততদিন তাঁরা বিশ্ব শাসন করবেন । আর এটি হবে কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন ।

সম্ভবত অভিশপ্ত দাজ্জালের অভ্যুত্থান ও ফিতনা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে মানব জাতি যে ব্যাপক ও অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক ,প্রযুক্তিগত ও বৈষয়িক উন্নতি সাধন করবে তার ফলশ্রুতিতে ঘটবে অর্থাৎ দাজ্জাল এসবের অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি বিচ্যুত ধারা সৃষ্টি করবে । সে মূলত যুবক ও নারীদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য চোখ ধাঁধানো উন্নত মাধ্যম ও পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করবে এবং এ শ্রেণীই তার অনুসারী হবে ।

দাজ্জাল সমগ্র বিশ্বব্যাপী ফিতনা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে । তার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার দ্বারা অনেকেই প্রতারিত হবে । অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করবে । কিন্তু ইমাম মাহ্দী দাজ্জালের ধোঁকাবাজি প্রকাশ্যে ধরিয়ে দেবেন এবং তাকে ও তার অনুসারীদেরকে হত্যা করবেন ।

যা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো তা হচ্ছে প্রতিশ্রুত হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন আন্দোলন ও বিপ্লবের একটি সার্বিক চিত্র ও পটভূমি । কিন্তু যে যুগে এ সব ঘটনা ঘটবে সে যুগের সবচেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন ও ঘটনাবলী রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে ।

প্রথমে যে ফিতনা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর আপতিত হবে এবং রেওয়ায়েতসমূহে যা সর্বশেষ ও সবচেয়ে কঠিন ফিতনা বলে অভিহিত হয়েছে তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যাবে ।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে ,এ বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের যাবতীয় সাধারণ ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য এ শতাব্দীর (বিংশ শতক) শুরুতে পাশ্চাত্য এবং তাদের মিত্র প্রাচ্য দেশসমূহের সৃষ্ট ফিতনার সাথে মিলে যায় । কারণ এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সকল মুসলিম দেশ ও এ দেশগুলোর সকল পরিবারকে আক্রান্ত করবে ।

এমন কোন ঘর বিদ্যমান থাকবে না যেখানে এ ফিতনা প্রবেশ করবে না এবং এমন কোন মুসলমান থাকবে না যে এ ফিতনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না ।

যেভাবে লোভাতুর ক্ষুধার্ত হরেক রকমের সুস্বাদু খাবাবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে ঠিক সেভাবে কাফির জাতিসমূহ মুসলিম দেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে ।

ঐ ফিতনার সময় পাশ্চাত্য থেকে একদল এবং প্রাচ্য থেকে আরেকদল আমার উম্মতের ওপর শাসন চালাবে ।

উল্লেখ্য যে ,আমাদের শত্রুরা তাদের কালো সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের এ প্রক্রিয়া (ফিতনা) শামদেশ (সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) থেকে শুরু করবে এবং সে দেশকে তারা সভ্যতার আলো বিকিরণের উৎস বলে অভিহিত করবে । এর ফলে এমন একটি ফিতনার উদ্ভব হবে যা রেওয়ায়েতসমূহে ফিলিস্তিনের ফিতনা নামে উল্লিখিত হয়েছে । মশকের ভিতরে পানি যেমন আন্দোলিত হয়ে থাকে ঠিক তেমনি এ ফিতনার কারণে শামদেশ তীব্রভাবে আন্দোলিত হবে এবং লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে ।

যখন ফিলিস্তিনের ফিতনার উদ্ভব হবে তখন মশকের ভিতর পানি যেভাবে উদ্বেলিত হয় ঠিক সেভাবে শামদেশ বিশৃঙ্খলা ,গোলযোগ ও অস্বাভাবিক অবস্থার শিকার হবে । আর যখন এ ফিতনার পরিসমাপ্তির সময় এসে যাবে তখন তার যবনিকাপাত হবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় লোকই অনুতপ্ত হবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ (সে যুগের) মুসলমানদের সন্তান ও প্রজন্মসমূহকে এভাবে বর্ণনা করেছে যে ,তারা এমনভাবে এ ফিতনা ও বিশৃঙ্খলাময় সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠবে যে ,তারা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একেবারেই অনবগত থেকে যাবে । সে সব অত্যাচারী শাসনকর্তা অনৈসলামিক বিধি-বিধান এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ভিত্তিতে মুসলমানদের ওপর শাসন করবে এবং তাদের ওপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পন্থায় নির্যাতন চালাবে ।

হাদীসসমূহে উল্লিখিত হয়েছে যে ,এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার উদ্গাতা হবে রোমান এবং তুর্কীরা । তুর্কীরা বাহ্যত রুশ জাতি হতে পারে । আর যখন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে কতিপয় বড় ঘটনা ঘটবে তখন তারা তাদের সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনের রামাল্লা ,আনতাকিয়া এবং তুরস্ক-সিরীয় উপকূলে এবং সিরিয়া-ইরাক-তুরস্ক সীমান্তে অবস্থিত জাযীরায় (দ্বীপে) মোতয়েন করবে ।

যখন রোমান ও তুর্কীরা (রুশজাতি) তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে তখন তারা নিজেরাও পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘর্ষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে । তখন তুর্কীদের সমর্থকবৃন্দ জাযীরাহ্ এলাকায় এবং রোমের বিদ্রোহীরা রামাল্লায় অবস্থান গ্রহণের জন্য রওয়ানা হয়ে যাবে ।

রেওয়ায়েতসমূহে আরো বর্ণিত হয়েছে যে ,ইরান থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সূত্রপাত হবে ।

তাঁর আবির্ভাব ও প্রকাশের সূত্রপাত প্রাচ্য থেকে হবে এবং যখন ঐ সময় উপস্থিত হবে তখন সুফিয়ানী আবির্ভূত হবে ।

অর্থাৎ সালমান ফারসী (রা.)-এর জাতি ও কালো পতাকাবাহীদের হাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশের পটভূমি রচিত এবং কোম নগরী থেকে এক ব্যক্তির হাতে তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত হবে ।

কোম থেকে এক ব্যক্তি উত্থিত হবে এবং জনগণকে (ইরানী জাতি) সত্যের দিকে আহবান করবে । যে দলটি তার চারপাশে জড়ো হবে তাদের হৃদয় ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় হবে এবং তারা এতটা অক্লান্ত ও অকুতোভয় হবে যে ,যুদ্ধের প্রচণ্ড চাপও তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে না এবং তারা যুদ্ধে ক্লান্ত হবে না । তারা সব সময় মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে । আর শুভ পরিণতি কেবল মুত্তাকী-পরহেজগারদের জন্যই নির্ধারিত ।

তারা (ইরানী জাতি) তাদের অভ্যুত্থান এবং বিপ্লব সফল করার পর তাদের শত্রুদের (পরাশক্তিসমূহের) কাছে অনুরোধ করবে যে ,তারা যেন তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করে । কিন্তু তারা এ ব্যাপারে জবরদস্তি করবে ।

তারা তাদের অধিকার দাবি করবে কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না । তারা পুনরায় তা চাইবে । আবারও তাদের অধিকার প্রদান করা হবে না । তারা এ অবস্থা দর্শন করতঃ কাঁধে অস্ত্র  তুলে নেবে এবং তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে । (অবশেষে তাদের অধিকার প্রদান করা হবে) কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ করবে না । অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং তোমাদের অধিপতির (অর্থাৎ ইমাম মাহ্দীর) হাতে বিপ্লবের পতাকা অর্পণ করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে । তাদের নিহত ব্যক্তিরা হবে সত্যের পথে শহীদ ।

বিভিন্ন রেওয়ায়েত অনুসারে অবশেষে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং যে দু ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তারা তাদের মাঝে আবির্ভূত হবেন । এ দু জনের একজন খোরাসানী যিনি ফকীহ্ ও মারজা অথবা রাজনৈতিক নেতা হিসাবে এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন শ্যামলা বর্ণের চেহারা ও স্বল্প দাঁড়িবিশিষ্ট এবং রাই অঞ্চলের অধিবাসী তিনি প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কাছে এ দু ব্যক্তি ইসলামের পতাকা অর্পণ করে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন । আর শুআইব ইবনে সালিহ্ ইমামের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হবেন ।

ঠিক একইভাবে বেশ কিছু রেওয়ায়েতে এমন একটি অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে যা সিরিয়ায় উসমান সুফিয়ানীর নেতৃত্বে সংঘটিত হবে । এই উসমান সুফিয়ানী হবে পাশ্চাত্যপন্থী ও ইহুদীদের সমর্থক । সে সিরিয়া ও জর্দানকে একত্রিত করে নিজ শাসনাধীনে নিয়ে আসবে ।

সুফিয়ানীর আবির্ভাব একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয় -যার শুরু থেকে সমাপ্তিকাল পনের মাস স্থায়ী হবে । প্রথম ছয় মাস সে যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত থাকবে এবং পাঁচটি অঞ্চল নিজ দখলে আনার মাধ্যমে পূর্ণ নয় মাস সে ঐ সব অঞ্চলের ওপর শাসনকার্য পরিচালনা করবে ।

অনেক রেওয়ায়েত অনুসারে সিরিয়া ও জর্দান ছাড়াও সম্ভবত লেবাননও ঐ পাঁচ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হবে ।

এ হচ্ছে এক ধরনের অশুভ ঐক্য যা সুফিয়ানীর মাধ্যমে শামদেশে বাস্তবায়িত হবে । কারণ এর উদ্দেশ্য হবে ইসরাইলের পক্ষে একটি (আরব) প্রতিরক্ষা ব্যূহ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের (সরকার ও প্রশাসনের) ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইরানীদের প্রতিরোধ করার জন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ও ফরন্ট লাইন গড়ে তোলা ।

এ কারণেই সুফিয়ানী ইরাক দখল করার পদক্ষেপ নেবে এবং তার সেনাবাহিনী ইরাকে প্রবেশ করবে ।

সে (সুফিয়ানী) 130000 সৈন্য কুফার দিকে প্রেরণ করবে এবং তারা রাওহা ও ফারুক নামক একটি স্থানে অবতরণ করবে । তাদের মধ্য থেকে 60000 সৈন্যকে কুফার দিকে প্রেরণ করা হবে এবং তারা নুখাইলায় হযরত হুদ (আ.)-এর সমাধিস্থলে অবস্থান গ্রহণ করবে । আর আমি যেন সুফিয়ানীকে (অথবা তার সহযোগী ও সঙ্গীকে) দেখতে পাচ্ছি যে ,সে কুফা ও তোমাদের সুবিস্তৃত ও চিরসবুজ জমিগুলোতে অবস্থান নিচ্ছে । তার পক্ষ থেকে একজন আহবানকারী উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকবে যে ,যে ব্যক্তি আলীর অনুসারীদের (কর্তিত) মাথা আনবে তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে । আর এ সময় প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বলবে যে ,এ ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত ।

তখন হিজাযে উদ্ভূত রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য সুফিয়ানীকে উদ্বুদ্ধ করা হবে । ইমাম মাহ্দীর সরকার -যার কথা সবার মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে এবং মক্কা নগরী থেকে যার শুভ সূচনা হবে তা ধ্বংস করার জন্য সুফিয়ানী সরকারকে শক্তিশালী করা হবে ।

এতদুদ্দেশ্যে সুফিয়ানী হিজাযে তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করবে । তার সেনাবাহিনী মদীনা নগরীতে প্রবেশ করেই সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে । এরপর তারা পবিত্র মক্কাভিমুখে রওয়ানা হবে । ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরী থেকেই তাঁর আন্দোলন শুরু করবেন । এরপর পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছানোর আগেই সুফিয়ানী বাহিনীকে কেন্দ্র করে যে মহা অলৌকিক ঘটনা (মুজিযা) ঘটার প্রতিশ্রুতি মহানবী (সা.) দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হবে অর্থাৎ সুফিয়ানী বাহিনী ভূগর্ভে প্রোথিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ।

একজন আশ্রয় গ্রহণকারী মহান আল্লাহর গৃহে (বায়তুল্লায়) আশ্রয় নেবে । তখন একটি সেনাবাহিনী তার পিছনে প্রেরণ করা হবে । যখনই তারা মদীনার মরুভূমিতে (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে) পৌঁছবে তখন তারা ভূগর্ভে প্রোথিত হবে ।

ইরাকে ইরানী ও ইয়েমেনীদের হাতে পরাজয় বরণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে হিজাযে ভূগর্ভে দেবে যাওয়ার মুজিযা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর পরাজয় বরণ করার পর সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করবে । আর ইমাম মাহ্দী সেনাবাহিনী নিয়ে দামেশক ও বাইতুল মুকাদ্দাস (আল কুদ্স) অভিমুখে রওয়ানা হবেন । সুফিয়ানী ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে মোকাবিলা করার জন্য শামদেশে তার সেনা বাহিনী সংগ্রহ ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকবে ।

রেওয়ায়েতসমূহে এ যুদ্ধকে এক মহা বীরত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা উপকূলীয় এলাকায় আক্কা থেকে সূর ( سور ) ও আনতাকিয়াহ্ পর্যন্ত এবং শামের অভ্যন্তরে দামেশক থেকে তাবারীয়াহ্ ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে ।

ঠিক একইভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে অপর একটি আন্দোলনের কথা উল্লিখিত হয়েছে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী এবং ইয়েমেনে সংঘটিত হবে । এ আন্দোলন ও বিপ্লবের নেতা ইয়েমেনীকে এ সব রেওয়ায়েতে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁকে সাহায্য করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য করা হয়েছে ।

পতাকাসমূহের মধ্যে ইয়ামানীদের পতাকার চেয়ে হিদায়েতকারী আর কোন পতাকা নেই । ইয়ামানীর আবির্ভাব ও উত্থানের পর জনগণের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হারাম হয়ে যাবে । আর যখন সে আবির্ভূত হবে এবং আন্দোলন করবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ছুটে যাবে । কারণ তার পতাকা হবে হিদায়েতের পতাকা । তার বিরোধিতা করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েয হবে না । যদি কোন ব্যক্তি এ কাজ করে তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে । কারণ ইয়ামানী জনগণকে সত্য ও সৎ পথের দিকে আহবান জানাবে ।

যেমন করে আমরা রেওয়ায়েতসমূহ থেকে সুফিয়ানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইরানীদের সাহায্য করার জন্য ইরাকে ইয়ামানী বাহিনী প্রবেশ করার বিষয়টি জানতে পারি ঠিক তেমনি হিজাযে মাহ্দী (আ.)-কে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইয়ামানী ও তাঁর সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথাও জানতে পারি ।

অনুরূপভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে ইয়ামানী ও সুফিয়ানী বাহিনীর আবির্ভাবের আগে একজন মিশরীয় ব্যক্তির আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে । আবার মিশরীয় সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটি আন্দোলন এবং মিশরের আশপাশের কিবতীদের পরিচালিত তৎপরতার কথাও ঐ সব রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে । এরপর ঐ সব রেওয়ায়েত মিশরে পাশ্চাত্য অথবা মাগরিবী (মরক্কো ,আলজেরিয়া ,তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট) সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং এর পরপরই শামদেশে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও উত্থানের কথা আমাদেরকে অবহিত করে ।

তখন তারা (ইমাম মাহ্দী ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা) মিশরে প্রবেশ করবে এবং সে সেখানে মিম্বারে আরোহণ করে সে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে । পৃথিবী ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ফলে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে যাবে । আকাশ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে । বৃক্ষরাজি ফলদান করবে । ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ জন্মাবে এবং তা পৃথিবীবাসীদের জন্য শোভাবর্ধক হবে । বুনো জীব-জন্তু নিরাপদে বসবাস করবে ,সেগুলো গৃহপালিত পশুর মতো নিরুপদ্রবে সর্বত্র চড়ে বেড়াবে । মুমিনদের অন্তরে জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটা স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসবে যে ,কোন মুমিনই জ্ঞানার্জনের জন্য তার দীনী ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হবে না । ঐ দিন মহান আল্লাহ্ সবাইকে তাঁর অসীম সম্পদের মাধ্যমে ধনাঢ্য করে দেবেন ( يغني الله كلّا من سعته ) -পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটির বাস্তব নমুনা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে ।

তবে অনেক রেওয়ায়েত অনুযায়ী মুসলিম দেশ মাগরিবের (মরক্কো ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ) সেনাবাহিনী শাম ও মিশরে প্রবেশ করবে । এদের একটি অংশ ইরাকেও প্রবেশ করবে । তাদের ভূমিকা হবে বাঁধাদানকারী আরব অথবা আন্তর্জাতিক বাহিনীর ভূমিকার ন্যায় । তাই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী হবে না । বরং এ বাহিনী শামে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের এবং ইরানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে । এরপর তারা জর্দানের দিকে পশ্চাদপসরণ করবে এবং তাদের অবশিষ্টাংশ সুফিয়ানীর অভ্যুত্থানের পর পশ্চাদপসরণ করবে অথবা তার সাথে যোগ দেবে । অতঃপর তারা মিশরীয়দের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন মিশর সরকারের সাহায্যার্থে অথবা শামে সুফিয়ানীর উত্থানের সামান্য প্রাক্কালে যে পাশ্চাত্যবাহিনী মিশরে প্রবেশ করবে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য মিশরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ,শেষ যামানায় ইহুদীরা পৃথিবীর বুকে ফিতনা সৃষ্টি এবং দম্ভ প্রকাশ করবে । তারা নিজেদেরকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করবে । মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে তাদের এ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন । তাদের দম্ভ এবং শ্রেষ্ঠত্ব অন্বেষী মনোবৃত্তি ঐ সব পতাকাবাহীর হাতে চূর্ণ হয়ে যাবে যারা খোরাসান (ইরান) থেকে বের হবে ।

ইসলামের ঝাণ্ডাসমূহ আল কুদসে পত্পত্ করে ওড়া পর্যন্ত তাদেরকে (খোরাসানীদেরকে) তাদের সিদ্ধান্ত থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না ।

ইরানীরা এমন এক জাতি যাদেরকে মহান আল্লাহ্ শীঘ্রই ইহুদীদের ওপর বিজয়ী করবেন । কোরআনের ভাষায় :

আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষ থেকে অতি শক্তিশালী বান্দাদেরকে প্রেরণ করব ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এবং পরে এক দফায় অথবা কয়েক দফায় ইহুদীদের যে প্রতিশ্রুত ধ্বংস সংঘটিত হবে তা রেওয়ায়েতসমূহে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি । তবে এ সব রেওয়ায়েতে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্তির সর্বশেষ পর্যায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং তাঁর সেনাবাহিনী -যার অধিকাংশ সদস্যই হবে ইরানী তাঁদের হাতে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে ।

এ ঘটনাটি বিরাট এক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে । এ যুদ্ধে শামের শাসনকর্তা উসমান সুফিয়ানী ইহুদী জাতি ও রোমীয়দের (পাশ্চাত্য) পাশে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রথম কাতারে অবস্থান করবে ।

কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে ইমাম মাহ্দী (আ.) আনতাকিয়ার একটি গুহা ,ফিলিস্তিনের একটি পাহাড় এবং তাবারীয়ার হ্রদ থেকে তাওরাতের আসল কপিগুলো বের করে আনবেন । তিনি তাওরাতের সেই সব কপির ভিত্তিতে ইহুদীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবেন এবং তাদের কাছে নিদর্শন ও মুজিযাসমূহ স্পষ্ট করে প্রকাশ করবেন ।

আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধের পর যে কিছু সংখ্যক ইহুদী বেঁচে যাবে তারা ইমাম মাহ্দীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদেরকে আরব দেশগুলো থেকে বিতাড়িত করা হবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছু আগে রোমান ও তুর্কীদের মধ্যে অর্থাৎ পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে যার সূত্রপাত হবে পূর্ব দিক হতে । আরো কিছু রেওয়ায়েত থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ,উপরিউক্ত যুদ্ধ আসলে একাধিক আঞ্চলিক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হবে যেগুলোর দ্বারা পাশ্চাত্যজগৎ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।

জ্বালানি কাঠে যেভাবে আগুন ধরে ঠিক তদ্রূপ পাশ্চাত্যে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হবে । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসীদের মধ্যে ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেবে । আর মানব জাতি নিরাপত্তাহীনতার ভীতির কারণে কঠিন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হবে ।

ঠিক একইভাবে আরো কিছু হাদীস থেকে জানা যায় যে ,এ যুদ্ধের ফলে সংঘটিত জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও তার আগে ও পরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্লেগ বা মহামারী দেখা দেবে তাতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হবে । তবে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত মুসলমানগণ সরাসরি এ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না ।

বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব) ঘটবে না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম : যখন পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আর কোন্ ব্যক্তি অক্ষত থাকবে ? ইমাম বললেন , তোমরা কি অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে থাকতে চাও না ?

কিছু কিছু রেওয়ায়েতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ,এ যুদ্ধ বেশ কয়েকটি ধাপে সংঘটিত হবে । আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ,তাঁর হিজায মুক্তকরণ এবং ইরাকে তাঁর প্রবেশ করার পরই এ যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় এসে যাবে ।

তবে হিজায মুক্ত হওয়া সে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও শূন্যাবস্থা এবং সেখানকার প্রশাসনিক সংকটের সাথে জড়িত । আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এতৎসংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করব ।

 

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব কালের সার্বিক চিত্র

যদিও পবিত্র কোরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন মুজিযা এবং সব যুগে সকল প্রজন্মের জন্য তা নতুন ,এতদসত্ত্বেও ইসলাম ধর্মের চির জীবন্ত মুজিযাসমূহের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মহানবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ঐ সব হাদীস ও রেওয়ায়েত (বর্ণনা) যা ইসলাম ধর্মের (প্রতিশ্রুত) পুনর্জাগরণ পর্যন্ত মানব জাতির ভবিষ্যৎ জীবন এবং ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যৎ গতিধারা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে । আর এটি হবে ঐ সময় যখন মহান আল্লাহ্ তাঁর ধর্মকে সকল কাফির ও মুশরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পৃথিবীর সকল ধর্ম ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী করবেন ।

ইসলাম ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের এ যুগই হচ্ছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ যা এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় । আর সাহাবী ,তাবেয়ী ও সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহের রচয়িতাগণের মাধ্যমে মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত সুসংবাদ প্রদানকারী শত শত রেওয়ায়েতেও এ দুই যুগ ও মহাঘটনা (ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব) সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে । আসলে এ দু মহাঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যদিও এ সব রেওয়ায়েতে (বর্ণনার ক্ষেত্রে) পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান । যদি আহলে বাইতের ইমামদের রেওয়ায়েতসমূহ এ সব রেওয়ায়েতের সাথে যোগ করা হয় ,তাহলে এতৎসংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের সংখ্যা 1000-এরও অধিক হবে । যদিও ইমামগণ তাঁদের হাদীসগুলো সবসময় মহানবী (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করেন নি ,তবে তাঁরা অসংখ্যবার তাগীদ দিয়ে বলেছেন যে ,তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন তা তাদের পবিত্র পূর্বপুরুষগণ এবং তাঁদের শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ মহানবী (সা.) থেকেই তাঁরা লাভ করেছেন ।

এ সব রেওয়ায়েতে আবির্ভাবের যুগে পৃথিবী ,বিশেষ করে যে অঞ্চলে ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন সেই অঞ্চল ,যেমন ইয়েমেন ,হিজায ,ইরান ,ইরাক ,শাম (সিরিয়া ,লেবানন ও জর্দান) ,ফিলিস্তিন ,মিশর ও মাগরিবের (মরক্কো ,আলজেরিয়া ,তিউনিসিয়া ও লিবিয়া) যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা ছোট-বড় অনেক ঘটনা এবং বহু ব্যক্তি ও স্থানের নামকে শামিল করে ।

আমি অগণিত রেওয়ায়েত ও হাদীসের মধ্য থেকে এ সব রেওয়ায়েত ও হাদীস বাছাই করে যতটা সম্ভব সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট করে এবং ধারাবাহিকতা সহকারে সাধারণ মুসলিম পাঠকবর্গের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি ।

এ সব রেওয়ায়েত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে এ অধ্যায়ে এগুলোর একটি সার সংক্ষেপ উল্লেখ করব যাতে করে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালের একটি সাধারণ চিত্র বা ধারণা আমরা পেতে পারি । বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ,আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপ্লব ও আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে ।

এ সব রেওয়ায়েত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোমানদের (পাশ্চাত্য) সাথে তুর্কী এবং তাদের সমর্থকদের (রুশ) বাহ্যত একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হবে -যা বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে ।

কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক দু টি সরকার ও প্রশাসন ইরান ও ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হবে । মাহ্দী (আ.)-এর ইরানী সঙ্গী-সাথীরা তাঁর আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে নিজেদের একটি সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে । অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্যে দু ব্যক্তি (একজন খোরাসানী সাইয়্যেদ যিনি হবেন রাজনৈতিক নেতা এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন সামরিক নেতা) আবির্ভূত হবেন এবং এ দু ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানী জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ।

কিন্তু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কয়েক মাস আগে তাঁর ইয়েমেনী সঙ্গী-সাথিগণের বিপ্লব ও অভ্যুত্থান বিজয় লাভ করবে এবং তারা বাহ্যত হিজাযে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার জন্য তাঁকে সাহায্য করবে ।

হিজাযের এ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হচ্ছে হিজাযের কোন এক বংশের এক নির্বোধ ব্যক্তি যার নাম হলো আবদুল্লাহ্ ,সে দেশের সর্বশেষ বাদশাহ্ হিসেবে নিহত হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে -এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন এক মতবিরোধের সৃষ্টি হবে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে ।

যখন আবদুল্লাহর মৃত্যু হবে ,তখন জনগণ কোন্ ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে -এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না । আর এ অবস্থা যুগের অধিপতি র (ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে । বহু বছর রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে কয়েক মাস বা কয়েক দিনের রাজত্ব করার অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী শাসনের পালা চলে আসবে ।

আবু বসীর বলেন : আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এ অবস্থা কি দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে ?তিনি বললেন : কখনই না । বাদশাহর (আবদুল্লাহ্) হত্যাকাণ্ডের পরে এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হিজাযের গোত্রসমূহের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে পর্যবসিত হবে ।

(ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে ঐ ঘটনা যা দু হারামের (মক্কা ও মদীনা) মাঝখানে সংঘটিত হবে । আমি বললাম : কোন্ ঘটনা ঘটবে ?তিনি বললেন : দু হারামের মাঝে গোত্রীয় গোঁড়ামির উদ্ভব হবে এবং অমুকের বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বিরোধী গোত্রের 15 জন নেতা ও ব্যক্তিত্বকে অথবা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে ।

এ সময়ই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আসমানী আহবান বা ধ্বনি যা তাঁর নামে 23 রমযানে শ্রুত হবে ।

সাইফ ইবনে উমাইরাহ্ বলেছেন : আমি আবু জাফর আল মনসূরের (দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলীফা) নিকটে ছিলাম । তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন : হে সাইফ ইবনে উমাইরাহ্! নিঃসন্দেহে আকাশ থেকে একজন আহবানকারী আবু তালিবের বংশধরগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করবে । আমি বললাম : আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত ,হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ কথা বর্ণনা করেছেন ?তিনি বললেন : হ্যাঁ ,যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ ,এ কথা আমি আমার নিজ কানে শুনেছি । আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এখন পর্যন্ত এ ধরনের হাদীস কারো কাছ থেকে শুনি নি । তিনি বললেন : হে সাইফ! এ কথা সত্য । যখন ঐ ঘটনা ঘটবে তখন আমরাই সর্বপ্রথম এ আহবানে সাড়া দেব । তবে ঐ ধ্বনি আমাদের একজন পিতৃব্যপুত্রের প্রতি নয় কি ?আমি বললাম : সে কি ফাতিমার বংশধর হবে ?তিনি বললেন : হ্যাঁ ,হে সাইফ! অনন্তর যদি আমি এ রেওয়ায়েতটি আবু জাফার মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-বাকির থেকে না শুনতাম তাহলে সমগ্র জগৎবাসী আমাকে বললেও আমি তা মেনে নিতাম না । কিন্তু এর বর্ণনাকারী তো ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ।

এ সব রেওয়ায়েত অনুসারে এই আসমানী আহবান শোনার পরই ইমাম মাহ্দী (আ.) গোপনে তাঁর কতিপয় সঙ্গী ও সমর্থকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন । তখন তাঁর ব্যাপারে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আলোচনা হতে থাকবে এবং তাঁর নাম সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে । তাঁর প্রতি ভালোবাসা সবার হৃদয়ে আসন লাভ করবে ।

তাঁর শত্রুরা তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে খুব ভীত হয়ে পড়বে এবং এ কারণে তারা তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে । জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে যে ,তিনি মদীনায় অবস্থান করছেন ।

বিদেশী সামরিক বাহিনী অথবা হিজায সরকার সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনয়ন এবং সরকারের সাথে গোত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করার জন্য সিরিয়াস্থ সুফিয়ানী সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইবে ।

এ সেনাবাহিনী মদীনায় প্রবেশ করে হাশেমী বংশীয় যাকে পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে । তাদের অনেককে এবং তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে এবং অবশিষ্টদেরকে জেলখানায় বন্দী করে রাখবে ।

সুফিয়ানী তার একদল সৈন্যকে মদীনায় প্রেরণ করবে এবং তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে । মাহ্দী ও মানসূর সেখান থেকে পলায়ন করবেন । তারা মহানবীর সকল বংশধরকে গ্রেফতার করবে । আর এর ফলে কোন ব্যক্তিই মুক্ত থাকবে না । সুফিয়ানী বাহিনী ঐ দু ব্যক্তিকে ধরার জন্য মদীনা নগরীর বাইরে যাবে এবং ইমাম মাহ্দী (ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে) হযরত মূসা (আ.)-এর মতো ভীত ও চিন্তিত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে মক্কাভিমুখে চলে যাবেন ।

অতঃপর ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরীতে তাঁর কতিপয় সঙ্গী-সাথীর সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে করে তিনি পবিত্র হারাম থেকে এশার নামাযের পরে মুহররম মাসের দশম রাতে (আশুরার রাতে) তাঁর আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন । তখন তিনি মক্কার জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করবেন । এর ফলে তাঁর শত্রুরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করবে । কিন্তু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে এবং শত্রুদেরকে বিতাড়িত করে প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর পবিত্র মক্কানগরীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে ।

মুহররম মাসের দশম দিবসের (আশুরার দিবস) প্রভাতে ইমাম মাহ্দী সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বাণী প্রদান করে বিশ্বের জাতিসমূহকে আহবান জানাবেন যাতে করে তারা তাঁকে সাহায্য করে । তিনি ঘোষণা করবেন যে ,যে মুজিযার প্রতিশ্রুতি তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তা ঘটা পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করবেন । আর উক্ত মুজিযা হবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আন্দোলন দমন করার জন্য পবিত্র মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া ।

অল্প কিছুক্ষণ পরেই প্রতিশ্রুত মুজিযা বাস্তবায়িত হবে এবং যে সুফিয়ানী বাহিনী পবিত্র মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল তা ধ্বংস হয়ে যাবে ।

যখন তারা (সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনী) মদীনার মরুপ্রান্তরে পৌঁছবে তখন মহান আল্লাহ্ তাদেরকে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করবেন । আর এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণীর বাস্তব রূপ । তিনি বলেছেন , আর যদি আপনি হে নবী! যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত তাদের কঠিন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তখন আপনি ভীত হয়ে যাবেন ;আর তাদের শাস্তি বিন্দুমাত্র কম করা হবে না এবং তারা নিকটবর্তী স্থানে (মহান আল্লাহর শাস্তির) শিকার হবে । যখনই তারা মরুপ্রান্তরে পৌঁছে যাবে ঠিক তখনই তাদেরকে ভূমি গ্রাস করবে এবং যারা সামনে থাকবে তারা ঐ দল কি করছে তা দেখার জন্য পিছনে ফিরে আসবে অথচ তারাও ঐ একই ভাগ্য বরণ করবে ;আর যারা পিছনে থাকবে তারা তাদের (যারা ভূমিধ্বসের কারণে ভূ-গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে) সাথে মিলিত হবে অর্থাৎ তাদের স্থানে (ভূমি ধ্বসের স্থানে) পৌঁছে তাদের খুঁজতে থাকবে তখন তারাও ঐ একই বিপদে পতিত হবে ।

এ মুজিযার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) 10000-এরও অধিক সৈন্য নিয়ে মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং শত্রুবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর সেখানে অবস্থান গ্রহণ এবং মদীনা শত্রুমুক্ত করবেন । এরপর তিনি দুই হারাম (মক্কা ও মদীনা) মুক্ত করার মাধ্যমে হিজায বিজয় এবং সমগ্র অঞ্চলের (আরব উপদ্বীপ) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন ।

কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) হিজায বিজয়ের পর দক্ষিণ ইরান অভিমুখে রওয়ানা এবং সেখানে খোরাসানী ও শুআইব ইবনে সালিহের নেতৃত্বাধীন ইরানী সেনাবাহিনী ও সেদেশের জনগণের সাথে মিলিত হবেন । তারা তাঁর হাতে বাইআত করবে । তিনি তাদের সহায়তায় বসরায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন যার ফলে তিনি এক সুস্পষ্ট ও বিরাট বিজয় লাভ করবেন ।

এরপর তিনি ইরাকে প্রবেশ করবেন এবং সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করবেন । তিনি সেদেশে সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে পরাভূত ও হত্যা করবেন ।

এরপর তিনি ইরাককে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র এবং কুফা নগরীকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করবেন । আর এভাবে ইয়েমেন ,হিজায ,ইরাক এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ সর্বতোভাবে তাঁর শাসনাধীনে চলে আসবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে ,ইরাক বিজয়ের পর ইমাম মাহ্দী (আ.) সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের উদ্যোগ নেবেন তা হবে তুর্কীদের সাথে তাঁর যুদ্ধ । হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

أول لواء يعقده يبعثه إلى التّرك فيهزمهم

প্রথম যে সেনাদল তিনি গঠন করবেন তা তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন । অতঃপর তা তাদেরকে পরাজিত করবে ।

বাহ্যত তুর্কী বলতে রুশদেরকেও বোঝানো হতে পারে যারা রোমানদের (পাশ্চাত্যের) সাথে যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়বে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) সেনাদল গঠন করার পর তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে কুদসে (জেরুজালেম) প্রেরণ করবেন । এ সময় তাঁর সেনাবাহিনী দামেশকের কাছে মারজ আযরা এলাকায় আগমন করা পর্যন্ত সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করতে থাকবে এবং তাঁর ও সুফিয়ানীর মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে । তবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর সামনে সুফিয়ানীর অবস্থান এতটা দুর্বল হয়ে পড়বে যে ,রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় সুফিয়ানী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইবে । কিন্তু এ কাজের জন্য তার ইহুদী-রোমান মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে ।

তারা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) ও তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হবে । এ যুদ্ধের উপকূলীয় অক্ষরেখাসমূহ ফিলিস্তিনের আক্কা ( عكّا ) থেকে তুরস্কের আনতাকিয়াহ্ ( انطاكية ) পর্যন্ত এবং ভিতরের দিকে তাবারীয়াহ্ 1 থেকে দামেশক ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে ।

এ সময় সুফিয়ানী ,ইহুদী এবং রোমান সেনাবাহিনী মহান আল্লাহর (ঐশী) ক্রোধে পতিত হবে এবং তারা মুসলমানদের হাতে এমনভাবে নিহত হতে থাকবে যে ,তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রস্তরখণ্ডের পিছনেও লুকায় তখন ঐ প্রস্তরখণ্ড চিৎকার করে বলে উঠবে : হে মুসলমান! এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে । তাকে হত্যা করো ।

এ সময় মহান আল্লাহর সাহায্য ইমাম মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানদের কাছে আসবে এবং তাঁরা বিজয়ী বেশে আল কুদসে প্রবেশ করবেন ।

খ্রিস্টান পাশ্চাত্য আকস্মিকভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে ইহুদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহের পরাজয় বরণের কথা জানতে পারবে । তাদের ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হবে এবং তারা ইমাম মাহ্দীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে ।

কিন্তু আকস্মিকভাবে হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে পবিত্র কুদসের ওপর অবতরণ করবেন এবং তিনি সমগ্র বিশ্ববাসী ,বিশেষ করে খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন ।

হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর অবতরণ বিশ্ববাসীর জন্য এমন এক নিদর্শন হবে যা হবে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য আনন্দের কারণ ।

সম্ভবত হযরত ঈসা (আ.) ,ইমাম মাহ্দী ও পাশ্চাত্যের মাঝে মধ্যস্থতা করবেন এবং এ কারণে দু পক্ষের মধ্যে সাত বছর মেয়াদী একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে ।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

তোমাদের ও রোমানদের (পাশ্চাত্য) মধ্যে চারটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হবে । এগুলোর মধ্যে চতুর্থটি হিরাক্লিয়াসের এক বংশধরের সাথে সম্পাদিত হবে এবং তা সাত বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে ।

মাস্তূর বিন গাইলান নামীয় আবদুল কাইস গোত্রের এক ব্যক্তি তখন জিজ্ঞাসা করেছিল : হে রাসূলাল্লাহ্! ঐ দিন জনগণের নেতা (মুসলমানদের নেতা) কে হবেন ? তিনি বলেছিলেন : আমার বংশধর মাহ্দী । যাকে দেখে মনে হবে তার বয়স 40 বছর । তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল তারকার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকবে । তার ডান গালের ওপর একটি তিল থাকবে । ঐ সময়ে সে দু টি কাতাওয়ানী 2 কাবা 3 পরিহিত থাকবে এবং তাকে দেখতে ইসরাইল বংশীয় পুরুষদের মতো লাগবে । সে ভূগর্ভস্থ সম্পদরাজি উত্তোলন করবে এবং শিরক ও পৌত্তলিকতায় পূর্ণ একটি নগরীকে মুক্ত ও পবিত্র করবে ।

কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে পাশ্চাত্য দু বছর পরে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করবে । সম্ভবত এ চুক্তি ভঙ্গ করার কারণ হচ্ছে ঐ ভয়-ভীতি যা ঈসা (আ.) কর্তৃক পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের মাঝে গণজাগরণ ও সংহতির জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভূত হবে । বহু পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)- কে সাহায্য ও সমর্থন দান করবে ।

এ কারণেই রোমানরা দশ লক্ষ সৈন্য সহকারে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অকস্মাৎ আক্রমণ চালাবে ।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

তখন পাশ্চাত্য তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে 80টি সেনাদল নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে । প্রতিটি সেনাদলে 12000 সৈন্য থাকবে ।

আর মুসলিম বাহিনী তাদের মোকাবিলা করবে এবং হযরত ঈসা (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নীতি অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তাঁর নীতি ঘোষণা করবেন এবং ইমাম মাহ্দীর পেছনে বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় করবেন ।

রোমানদের (পাশ্চাত্য) বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ যে সব স্থান বা অক্ষ বরাবর আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সে সব স্থানে অর্থাৎ আক্কা থেকে আনতাকিয়া ,দামেশক থেকে আল কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম) এবং মারজ দাবিক 4 পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হবে । এ মহাযুদ্ধে রোমীয়গণ শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে এবং (ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে) মুসলমানগণ স্পষ্ট ও বৃহৎ এক বিজয় লাভ করবে ।

এ যুদ্ধের পর ইমাম মাহ্দীর সামনে খ্রিস্টান ইউরোপ ও পাশ্চাত্য বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে । আর দৃশ্যত অনেক জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে ইমাম মাহ্দী ও হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরোধী সরকারসমূহের পতন ঘটাবে এবং ইমাম মাহ্দীর সমর্থক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র পাশ্চাত্য বিজয় এবং তা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসার পর অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে । এ সময় হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করবেন । মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানগণ তাঁর জানাযার নামায পড়বেন । হাদীসের বর্ণনানুসারে ইমাম মাহ্দী হযরত ঈসা (আ.)-এর জানাযার নামায ও দাফন অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে জনতার উপস্থিতিতে সম্পন্ন করবেন যাতে অতীতের মতো তাঁর ব্যাপারে কেউ পুনরায় অগ্রহণীয় উক্তি করতে না পারে । অতঃপর ইমাম মাহ্দী তাঁকে তাঁর মা হযরত মরিয়ম সিদ্দীকা (আ.) নিজ হাতে যে বস্ত্রটি বয়ন করেছিলেন তা কাফন হিসাবে পরিধান করাবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করবেন ।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র বিশ্ব বিজয় এবং বিশ্বের সকল দেশ ,রাষ্ট্র ও প্রশাসন একটি একক ইসলামী প্রশাসনের আওতায় একীভূত হওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে ঐশী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন । তিনি পার্থিব জীবনের উন্নতি ও বিকাশ এবং মানব জাতির সচ্ছলতা ,কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন কল্পে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করবেন । তিনি সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এবং মানব জাতির ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানের পর্যায়কে উন্নীত করার চেষ্টা চালাবেন ।

কতিপয় হাদীস অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.) মানব জাতির জ্ঞানের সাথে আরও যে জ্ঞান যোগ করবেন তার প্রবৃদ্ধির হার হবে 25 : 2 অনুপাতে । অর্থাৎ মানব জাতি এর আগে জ্ঞানের যে দু ভাগের অধিকারী ছিল তার সাথে আরো 25 ভাগ যুক্ত করবেন এবং সার্বিকভাবে মানুষের জ্ঞান তখন 27 ভাগ হবে ।

ঠিক একইভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে অন্যান্য গ্রহ ও নভোমণ্ডলের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীবাসীদের যোগাযোগের দ্বার উন্মুক্ত হবে । বরং আমাদের পার্থিব এ জগতের সামনে গায়েবী (আধ্যাত্মিক ও অবস্তুগত) জগতের দ্বারসমূহ খুলে যাওয়া শুরু হবে । এর ফলে বেহেশত থেকে মানুষ এ পৃথিবীতে আগমন করবে যা হবে পৃথিবীবাসীদের কাছে অলৌকিক বিষয় ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে এবং তাঁর পরেও বেশ কিছু সংখ্যক নবী ও ইমাম এ পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তন করবেন এবং যতদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ চাইবেন ততদিন তাঁরা বিশ্ব শাসন করবেন । আর এটি হবে কিয়ামতের অন্যতম নিদর্শন ।

সম্ভবত অভিশপ্ত দাজ্জালের অভ্যুত্থান ও ফিতনা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে মানব জাতি যে ব্যাপক ও অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক ,প্রযুক্তিগত ও বৈষয়িক উন্নতি সাধন করবে তার ফলশ্রুতিতে ঘটবে অর্থাৎ দাজ্জাল এসবের অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি বিচ্যুত ধারা সৃষ্টি করবে । সে মূলত যুবক ও নারীদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য চোখ ধাঁধানো উন্নত মাধ্যম ও পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করবে এবং এ শ্রেণীই তার অনুসারী হবে ।

দাজ্জাল সমগ্র বিশ্বব্যাপী ফিতনা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে । তার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার দ্বারা অনেকেই প্রতারিত হবে । অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করবে । কিন্তু ইমাম মাহ্দী দাজ্জালের ধোঁকাবাজি প্রকাশ্যে ধরিয়ে দেবেন এবং তাকে ও তার অনুসারীদেরকে হত্যা করবেন ।

যা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো তা হচ্ছে প্রতিশ্রুত হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন আন্দোলন ও বিপ্লবের একটি সার্বিক চিত্র ও পটভূমি । কিন্তু যে যুগে এ সব ঘটনা ঘটবে সে যুগের সবচেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন ও ঘটনাবলী রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে ।

প্রথমে যে ফিতনা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর আপতিত হবে এবং রেওয়ায়েতসমূহে যা সর্বশেষ ও সবচেয়ে কঠিন ফিতনা বলে অভিহিত হয়েছে তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যাবে ।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে ,এ বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের যাবতীয় সাধারণ ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য এ শতাব্দীর (বিংশ শতক) শুরুতে পাশ্চাত্য এবং তাদের মিত্র প্রাচ্য দেশসমূহের সৃষ্ট ফিতনার সাথে মিলে যায় । কারণ এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সকল মুসলিম দেশ ও এ দেশগুলোর সকল পরিবারকে আক্রান্ত করবে ।

এমন কোন ঘর বিদ্যমান থাকবে না যেখানে এ ফিতনা প্রবেশ করবে না এবং এমন কোন মুসলমান থাকবে না যে এ ফিতনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না ।

যেভাবে লোভাতুর ক্ষুধার্ত হরেক রকমের সুস্বাদু খাবাবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে ঠিক সেভাবে কাফির জাতিসমূহ মুসলিম দেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে ।

ঐ ফিতনার সময় পাশ্চাত্য থেকে একদল এবং প্রাচ্য থেকে আরেকদল আমার উম্মতের ওপর শাসন চালাবে ।

উল্লেখ্য যে ,আমাদের শত্রুরা তাদের কালো সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের এ প্রক্রিয়া (ফিতনা) শামদেশ (সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) থেকে শুরু করবে এবং সে দেশকে তারা সভ্যতার আলো বিকিরণের উৎস বলে অভিহিত করবে । এর ফলে এমন একটি ফিতনার উদ্ভব হবে যা রেওয়ায়েতসমূহে ফিলিস্তিনের ফিতনা নামে উল্লিখিত হয়েছে । মশকের ভিতরে পানি যেমন আন্দোলিত হয়ে থাকে ঠিক তেমনি এ ফিতনার কারণে শামদেশ তীব্রভাবে আন্দোলিত হবে এবং লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে ।

যখন ফিলিস্তিনের ফিতনার উদ্ভব হবে তখন মশকের ভিতর পানি যেভাবে উদ্বেলিত হয় ঠিক সেভাবে শামদেশ বিশৃঙ্খলা ,গোলযোগ ও অস্বাভাবিক অবস্থার শিকার হবে । আর যখন এ ফিতনার পরিসমাপ্তির সময় এসে যাবে তখন তার যবনিকাপাত হবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় লোকই অনুতপ্ত হবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ (সে যুগের) মুসলমানদের সন্তান ও প্রজন্মসমূহকে এভাবে বর্ণনা করেছে যে ,তারা এমনভাবে এ ফিতনা ও বিশৃঙ্খলাময় সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠবে যে ,তারা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একেবারেই অনবগত থেকে যাবে । সে সব অত্যাচারী শাসনকর্তা অনৈসলামিক বিধি-বিধান এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ভিত্তিতে মুসলমানদের ওপর শাসন করবে এবং তাদের ওপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পন্থায় নির্যাতন চালাবে ।

হাদীসসমূহে উল্লিখিত হয়েছে যে ,এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার উদ্গাতা হবে রোমান এবং তুর্কীরা । তুর্কীরা বাহ্যত রুশ জাতি হতে পারে । আর যখন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে কতিপয় বড় ঘটনা ঘটবে তখন তারা তাদের সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনের রামাল্লা ,আনতাকিয়া এবং তুরস্ক-সিরীয় উপকূলে এবং সিরিয়া-ইরাক-তুরস্ক সীমান্তে অবস্থিত জাযীরায় (দ্বীপে) মোতয়েন করবে ।

যখন রোমান ও তুর্কীরা (রুশজাতি) তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে তখন তারা নিজেরাও পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘর্ষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে । তখন তুর্কীদের সমর্থকবৃন্দ জাযীরাহ্ এলাকায় এবং রোমের বিদ্রোহীরা রামাল্লায় অবস্থান গ্রহণের জন্য রওয়ানা হয়ে যাবে ।

রেওয়ায়েতসমূহে আরো বর্ণিত হয়েছে যে ,ইরান থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সূত্রপাত হবে ।

তাঁর আবির্ভাব ও প্রকাশের সূত্রপাত প্রাচ্য থেকে হবে এবং যখন ঐ সময় উপস্থিত হবে তখন সুফিয়ানী আবির্ভূত হবে ।

অর্থাৎ সালমান ফারসী (রা.)-এর জাতি ও কালো পতাকাবাহীদের হাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশের পটভূমি রচিত এবং কোম নগরী থেকে এক ব্যক্তির হাতে তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত হবে ।

কোম থেকে এক ব্যক্তি উত্থিত হবে এবং জনগণকে (ইরানী জাতি) সত্যের দিকে আহবান করবে । যে দলটি তার চারপাশে জড়ো হবে তাদের হৃদয় ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় হবে এবং তারা এতটা অক্লান্ত ও অকুতোভয় হবে যে ,যুদ্ধের প্রচণ্ড চাপও তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে না এবং তারা যুদ্ধে ক্লান্ত হবে না । তারা সব সময় মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে । আর শুভ পরিণতি কেবল মুত্তাকী-পরহেজগারদের জন্যই নির্ধারিত ।

তারা (ইরানী জাতি) তাদের অভ্যুত্থান এবং বিপ্লব সফল করার পর তাদের শত্রুদের (পরাশক্তিসমূহের) কাছে অনুরোধ করবে যে ,তারা যেন তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করে । কিন্তু তারা এ ব্যাপারে জবরদস্তি করবে ।

তারা তাদের অধিকার দাবি করবে কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না । তারা পুনরায় তা চাইবে । আবারও তাদের অধিকার প্রদান করা হবে না । তারা এ অবস্থা দর্শন করতঃ কাঁধে অস্ত্র  তুলে নেবে এবং তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে । (অবশেষে তাদের অধিকার প্রদান করা হবে) কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ করবে না । অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং তোমাদের অধিপতির (অর্থাৎ ইমাম মাহ্দীর) হাতে বিপ্লবের পতাকা অর্পণ করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে । তাদের নিহত ব্যক্তিরা হবে সত্যের পথে শহীদ ।

বিভিন্ন রেওয়ায়েত অনুসারে অবশেষে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং যে দু ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তারা তাদের মাঝে আবির্ভূত হবেন । এ দু জনের একজন খোরাসানী যিনি ফকীহ্ ও মারজা অথবা রাজনৈতিক নেতা হিসাবে এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন শ্যামলা বর্ণের চেহারা ও স্বল্প দাঁড়িবিশিষ্ট এবং রাই অঞ্চলের অধিবাসী তিনি প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কাছে এ দু ব্যক্তি ইসলামের পতাকা অর্পণ করে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন । আর শুআইব ইবনে সালিহ্ ইমামের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হবেন ।

ঠিক একইভাবে বেশ কিছু রেওয়ায়েতে এমন একটি অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে যা সিরিয়ায় উসমান সুফিয়ানীর নেতৃত্বে সংঘটিত হবে । এই উসমান সুফিয়ানী হবে পাশ্চাত্যপন্থী ও ইহুদীদের সমর্থক । সে সিরিয়া ও জর্দানকে একত্রিত করে নিজ শাসনাধীনে নিয়ে আসবে ।

সুফিয়ানীর আবির্ভাব একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয় -যার শুরু থেকে সমাপ্তিকাল পনের মাস স্থায়ী হবে । প্রথম ছয় মাস সে যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত থাকবে এবং পাঁচটি অঞ্চল নিজ দখলে আনার মাধ্যমে পূর্ণ নয় মাস সে ঐ সব অঞ্চলের ওপর শাসনকার্য পরিচালনা করবে ।

অনেক রেওয়ায়েত অনুসারে সিরিয়া ও জর্দান ছাড়াও সম্ভবত লেবাননও ঐ পাঁচ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হবে ।

এ হচ্ছে এক ধরনের অশুভ ঐক্য যা সুফিয়ানীর মাধ্যমে শামদেশে বাস্তবায়িত হবে । কারণ এর উদ্দেশ্য হবে ইসরাইলের পক্ষে একটি (আরব) প্রতিরক্ষা ব্যূহ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের (সরকার ও প্রশাসনের) ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইরানীদের প্রতিরোধ করার জন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ও ফরন্ট লাইন গড়ে তোলা ।

এ কারণেই সুফিয়ানী ইরাক দখল করার পদক্ষেপ নেবে এবং তার সেনাবাহিনী ইরাকে প্রবেশ করবে ।

সে (সুফিয়ানী) 130000 সৈন্য কুফার দিকে প্রেরণ করবে এবং তারা রাওহা ও ফারুক নামক একটি স্থানে অবতরণ করবে । তাদের মধ্য থেকে 60000 সৈন্যকে কুফার দিকে প্রেরণ করা হবে এবং তারা নুখাইলায় হযরত হুদ (আ.)-এর সমাধিস্থলে অবস্থান গ্রহণ করবে । আর আমি যেন সুফিয়ানীকে (অথবা তার সহযোগী ও সঙ্গীকে) দেখতে পাচ্ছি যে ,সে কুফা ও তোমাদের সুবিস্তৃত ও চিরসবুজ জমিগুলোতে অবস্থান নিচ্ছে । তার পক্ষ থেকে একজন আহবানকারী উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকবে যে ,যে ব্যক্তি আলীর অনুসারীদের (কর্তিত) মাথা আনবে তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে । আর এ সময় প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বলবে যে ,এ ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত ।

তখন হিজাযে উদ্ভূত রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য সুফিয়ানীকে উদ্বুদ্ধ করা হবে । ইমাম মাহ্দীর সরকার -যার কথা সবার মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে এবং মক্কা নগরী থেকে যার শুভ সূচনা হবে তা ধ্বংস করার জন্য সুফিয়ানী সরকারকে শক্তিশালী করা হবে ।

এতদুদ্দেশ্যে সুফিয়ানী হিজাযে তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করবে । তার সেনাবাহিনী মদীনা নগরীতে প্রবেশ করেই সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে । এরপর তারা পবিত্র মক্কাভিমুখে রওয়ানা হবে । ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরী থেকেই তাঁর আন্দোলন শুরু করবেন । এরপর পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছানোর আগেই সুফিয়ানী বাহিনীকে কেন্দ্র করে যে মহা অলৌকিক ঘটনা (মুজিযা) ঘটার প্রতিশ্রুতি মহানবী (সা.) দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হবে অর্থাৎ সুফিয়ানী বাহিনী ভূগর্ভে প্রোথিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ।

একজন আশ্রয় গ্রহণকারী মহান আল্লাহর গৃহে (বায়তুল্লায়) আশ্রয় নেবে । তখন একটি সেনাবাহিনী তার পিছনে প্রেরণ করা হবে । যখনই তারা মদীনার মরুভূমিতে (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে) পৌঁছবে তখন তারা ভূগর্ভে প্রোথিত হবে ।

ইরাকে ইরানী ও ইয়েমেনীদের হাতে পরাজয় বরণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে হিজাযে ভূগর্ভে দেবে যাওয়ার মুজিযা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর পরাজয় বরণ করার পর সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করবে । আর ইমাম মাহ্দী সেনাবাহিনী নিয়ে দামেশক ও বাইতুল মুকাদ্দাস (আল কুদ্স) অভিমুখে রওয়ানা হবেন । সুফিয়ানী ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে মোকাবিলা করার জন্য শামদেশে তার সেনা বাহিনী সংগ্রহ ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকবে ।

রেওয়ায়েতসমূহে এ যুদ্ধকে এক মহা বীরত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা উপকূলীয় এলাকায় আক্কা থেকে সূর ( سور ) ও আনতাকিয়াহ্ পর্যন্ত এবং শামের অভ্যন্তরে দামেশক থেকে তাবারীয়াহ্ ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে ।

ঠিক একইভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে অপর একটি আন্দোলনের কথা উল্লিখিত হয়েছে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী এবং ইয়েমেনে সংঘটিত হবে । এ আন্দোলন ও বিপ্লবের নেতা ইয়েমেনীকে এ সব রেওয়ায়েতে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁকে সাহায্য করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য করা হয়েছে ।

পতাকাসমূহের মধ্যে ইয়ামানীদের পতাকার চেয়ে হিদায়েতকারী আর কোন পতাকা নেই । ইয়ামানীর আবির্ভাব ও উত্থানের পর জনগণের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হারাম হয়ে যাবে । আর যখন সে আবির্ভূত হবে এবং আন্দোলন করবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ছুটে যাবে । কারণ তার পতাকা হবে হিদায়েতের পতাকা । তার বিরোধিতা করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েয হবে না । যদি কোন ব্যক্তি এ কাজ করে তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে । কারণ ইয়ামানী জনগণকে সত্য ও সৎ পথের দিকে আহবান জানাবে ।

যেমন করে আমরা রেওয়ায়েতসমূহ থেকে সুফিয়ানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইরানীদের সাহায্য করার জন্য ইরাকে ইয়ামানী বাহিনী প্রবেশ করার বিষয়টি জানতে পারি ঠিক তেমনি হিজাযে মাহ্দী (আ.)-কে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইয়ামানী ও তাঁর সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথাও জানতে পারি ।

অনুরূপভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে ইয়ামানী ও সুফিয়ানী বাহিনীর আবির্ভাবের আগে একজন মিশরীয় ব্যক্তির আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে । আবার মিশরীয় সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটি আন্দোলন এবং মিশরের আশপাশের কিবতীদের পরিচালিত তৎপরতার কথাও ঐ সব রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে । এরপর ঐ সব রেওয়ায়েত মিশরে পাশ্চাত্য অথবা মাগরিবী (মরক্কো ,আলজেরিয়া ,তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট) সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং এর পরপরই শামদেশে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও উত্থানের কথা আমাদেরকে অবহিত করে ।

তখন তারা (ইমাম মাহ্দী ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা) মিশরে প্রবেশ করবে এবং সে সেখানে মিম্বারে আরোহণ করে সে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে । পৃথিবী ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ফলে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে যাবে । আকাশ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে । বৃক্ষরাজি ফলদান করবে । ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ জন্মাবে এবং তা পৃথিবীবাসীদের জন্য শোভাবর্ধক হবে । বুনো জীব-জন্তু নিরাপদে বসবাস করবে ,সেগুলো গৃহপালিত পশুর মতো নিরুপদ্রবে সর্বত্র চড়ে বেড়াবে । মুমিনদের অন্তরে জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটা স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসবে যে ,কোন মুমিনই জ্ঞানার্জনের জন্য তার দীনী ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হবে না । ঐ দিন মহান আল্লাহ্ সবাইকে তাঁর অসীম সম্পদের মাধ্যমে ধনাঢ্য করে দেবেন ( يغني الله كلّا من سعته ) -পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটির বাস্তব নমুনা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে ।

তবে অনেক রেওয়ায়েত অনুযায়ী মুসলিম দেশ মাগরিবের (মরক্কো ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ) সেনাবাহিনী শাম ও মিশরে প্রবেশ করবে । এদের একটি অংশ ইরাকেও প্রবেশ করবে । তাদের ভূমিকা হবে বাঁধাদানকারী আরব অথবা আন্তর্জাতিক বাহিনীর ভূমিকার ন্যায় । তাই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী হবে না । বরং এ বাহিনী শামে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের এবং ইরানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে । এরপর তারা জর্দানের দিকে পশ্চাদপসরণ করবে এবং তাদের অবশিষ্টাংশ সুফিয়ানীর অভ্যুত্থানের পর পশ্চাদপসরণ করবে অথবা তার সাথে যোগ দেবে । অতঃপর তারা মিশরীয়দের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন মিশর সরকারের সাহায্যার্থে অথবা শামে সুফিয়ানীর উত্থানের সামান্য প্রাক্কালে যে পাশ্চাত্যবাহিনী মিশরে প্রবেশ করবে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য মিশরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ,শেষ যামানায় ইহুদীরা পৃথিবীর বুকে ফিতনা সৃষ্টি এবং দম্ভ প্রকাশ করবে । তারা নিজেদেরকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করবে । মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে তাদের এ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন । তাদের দম্ভ এবং শ্রেষ্ঠত্ব অন্বেষী মনোবৃত্তি ঐ সব পতাকাবাহীর হাতে চূর্ণ হয়ে যাবে যারা খোরাসান (ইরান) থেকে বের হবে ।

ইসলামের ঝাণ্ডাসমূহ আল কুদসে পত্পত্ করে ওড়া পর্যন্ত তাদেরকে (খোরাসানীদেরকে) তাদের সিদ্ধান্ত থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না ।

ইরানীরা এমন এক জাতি যাদেরকে মহান আল্লাহ্ শীঘ্রই ইহুদীদের ওপর বিজয়ী করবেন । কোরআনের ভাষায় :

আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষ থেকে অতি শক্তিশালী বান্দাদেরকে প্রেরণ করব ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এবং পরে এক দফায় অথবা কয়েক দফায় ইহুদীদের যে প্রতিশ্রুত ধ্বংস সংঘটিত হবে তা রেওয়ায়েতসমূহে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি । তবে এ সব রেওয়ায়েতে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্তির সর্বশেষ পর্যায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং তাঁর সেনাবাহিনী -যার অধিকাংশ সদস্যই হবে ইরানী তাঁদের হাতে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে ।

এ ঘটনাটি বিরাট এক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে । এ যুদ্ধে শামের শাসনকর্তা উসমান সুফিয়ানী ইহুদী জাতি ও রোমীয়দের (পাশ্চাত্য) পাশে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রথম কাতারে অবস্থান করবে ।

কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে ইমাম মাহ্দী (আ.) আনতাকিয়ার একটি গুহা ,ফিলিস্তিনের একটি পাহাড় এবং তাবারীয়ার হ্রদ থেকে তাওরাতের আসল কপিগুলো বের করে আনবেন । তিনি তাওরাতের সেই সব কপির ভিত্তিতে ইহুদীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবেন এবং তাদের কাছে নিদর্শন ও মুজিযাসমূহ স্পষ্ট করে প্রকাশ করবেন ।

আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধের পর যে কিছু সংখ্যক ইহুদী বেঁচে যাবে তারা ইমাম মাহ্দীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদেরকে আরব দেশগুলো থেকে বিতাড়িত করা হবে ।

রেওয়ায়েতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছু আগে রোমান ও তুর্কীদের মধ্যে অর্থাৎ পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে যার সূত্রপাত হবে পূর্ব দিক হতে । আরো কিছু রেওয়ায়েত থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ,উপরিউক্ত যুদ্ধ আসলে একাধিক আঞ্চলিক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে ।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হবে যেগুলোর দ্বারা পাশ্চাত্যজগৎ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।

জ্বালানি কাঠে যেভাবে আগুন ধরে ঠিক তদ্রূপ পাশ্চাত্যে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হবে । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসীদের মধ্যে ,এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেবে । আর মানব জাতি নিরাপত্তাহীনতার ভীতির কারণে কঠিন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হবে ।

ঠিক একইভাবে আরো কিছু হাদীস থেকে জানা যায় যে ,এ যুদ্ধের ফলে সংঘটিত জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও তার আগে ও পরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্লেগ বা মহামারী দেখা দেবে তাতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হবে । তবে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত মুসলমানগণ সরাসরি এ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না ।

বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব) ঘটবে না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম : যখন পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আর কোন্ ব্যক্তি অক্ষত থাকবে ? ইমাম বললেন , তোমরা কি অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে থাকতে চাও না ?

কিছু কিছু রেওয়ায়েতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ,এ যুদ্ধ বেশ কয়েকটি ধাপে সংঘটিত হবে । আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ,তাঁর হিজায মুক্তকরণ এবং ইরাকে তাঁর প্রবেশ করার পরই এ যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় এসে যাবে ।

তবে হিজায মুক্ত হওয়া সে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও শূন্যাবস্থা এবং সেখানকার প্রশাসনিক সংকটের সাথে জড়িত । আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এতৎসংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করব ।

 


4

5

6

7

8

9

10

11

12