শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস0%

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

লেখক: আল্লামা মুহাম্মাদ রেজা আল -মুজাফফর
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 16547
ডাউনলোড: 3514

পাঠকের মতামত:

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16547 / ডাউনলোড: 3514
সাইজ সাইজ সাইজ
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

35। সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার দোয়াসমূহের মূল বিষয়বস্তু :

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পর বনি উমাইয়্যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে কুক্ষিগত করেছিল। ফলে তাদের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড আরও ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পেল। ব্যাপক রক্তপাত করা ছাড়াও তারা ধর্মীয় শিক্ষাকে তিরস্কার করল। ফলে সিজদাকারীদের সরদার ইমাম যয়নূল আবেদীন (আ.) স্বীয় গৃহে ব্যাথাতুর ও শোকাতুর হৃদয়ে দিন যাপন করতে লাগলেন। ইমামের (আ.) গৃহে শত্রুদের ভয়ে কেউ নিকটবর্তী পর্যন্ত হতে পারত না। এমনটি শত্রুদের কঠোর নজরদারীর কারণে ইমামও যথার্থরূপে মানুষের জন্যে কল্যাণকর্ম সম্পাদন করতে পারতেন না এবং ইসলামের প্রকৃত আহকাম মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিতে পারতেন না।

অতএব ,কোন উপায় না পেয়ে তিনি দোয়ার মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য হলেন। দোয়ার সেই পদ্ধতি যা প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ফলপ্রসূ- ইতিপূর্বে আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি- কোরআনের শিক্ষা ,ইসলামী আদব ও আহলে বাইতের (আ.) পথের প্রসারে সর্বোত্তম পন্থা এবং ধর্মীয় মনমানসিকতা ,সংযম ও খোদাভীরুতার ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর বলে পরিচিত। এগুলোর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উৎকর্ষের উপায়সমূহ মানুষকে শিক্ষা দেয়া যায়। দোয়ার এ পদ্ধতি ছিল চতুর্থ ইমামের (আ.) এক বিশেষ ও অভিনব পন্থা যে ,এ ক্ষেত্রে নিন্দুকদের কোন প্রকার অপপ্রচারের সুযোগ ছিল না। এটি এমন এক পদ্ধতি যাকে তার শত্রুরা তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনি। আর এ কারণেই অত্যাধিক সাহিত্যমান ও সমুন্নত বাগ্মীতাপূর্ণ বাক্য সংশ্লিষ্ট ইমামের (আ.) অনেক দোয়া আছে। এগুলোর কিছু কিছু সহীফায়ে সাজ্জাদিয়া নামক পুস্তিকায় স্থান পেয়েছে যাকে ইসলামের ইতিহাসে মোহাম্মদের (সা.) বংশধরদের যবুর বলে নামকরণ করা হয়। ঐ দোয়াগুলোর প্রকাশ পদ্ধতি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে আরবী ভাষার সর্বোচ্চ পদ্ধতির সমাহার ঘটেছে। সত্য ধর্ম ইসলামের নিয়ম ,তাওহীদ ও নবুওয়াতের সূক্ষ্ম রহস্য ,মোহাম্মদী শিষ্টাচারের সঠিকতম পদ্ধতি ও ইসলামী আদব সমুন্নত স্তরে বর্ণিত হয়েছে। দ্বীনী প্রশিক্ষণের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এগুলোতে আলোকপাত করা হয়েছে। সুতরাং ঐ দোয়াগুলো প্রকৃতপক্ষে দ্বীন ও আখলাক সম্পর্কিত শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যা দোয়ার মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে কিংবা এমন দোয়া যা দ্বীনী ও আখলাকের শিক্ষারূপে প্রকাশ লাভ করেছে।

হযরত ইমাম যয়নূল আবেদীনের (আ.) দোয়াগুলো নিশ্চিতরূপে কোরআন ও নাহ্জুল বালাগার পর আরবী ভাষার সর্বোত্তম বাচনভঙ্গি এবং ইলাহিয়্যাত ও আখলাকের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম দার্শনিক পন্থা বলে পরিগণিত হয়। এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি শিখায় কিরূপে মহান আল্লাহকে তার মহিমা সহকারে স্মরণ করতে হবে ,কিরূপে তার পবিত্র সত্তার পবিত্রতা জ্ঞাপন করতে হবে ,কিরূপে তার প্রশংসা ও তার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে এবং কিরূপে স্বীয় গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। কিছু কিছু দোয়া আছে যেগুলোতে শিক্ষা দেয় কিরূপে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার নিকট মিনতি করতে হবে। কোন কোন দোয়ায় আবার আল্লাহর নবীর (সা.) উপর দুরুদ পাঠের অর্থ আখলাকের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং তদ্রূপ তা সম্পাদন করার প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। এ দোয়াগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আমাদেরকে শিখায় কিরূপে মোনাজাত করতে হবে ,কিরূপে একাগ্রে নির্জনে খোদাকে ডাকতে হবে। কোন কোনটি আবার শিখায় কিরূপে পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করতে হবে। কোন কোনটি আমাদেরকে জানায় সন্তানের প্রতি পিতার কী অধিকার কিংবা পিতার প্রতি সন্তানের কী অধিকার অথবা প্রতিবেশী ,আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনের কী অধিকার। এ দোয়াগুলোতে আমরা আরও পাই সমস্ত মুসলমানের অধিকার ,ধনীদের নিকট দরিদ্রজনের অধিকার কিংবা দরিদ্রের নিকট ধনীদের অধিকার সম্পর্কে জানতে।

অপর কিছু দোয়া আছে যা আমাদেরকে লেনদেনের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জীবনে যে সমস্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করে চলতে হবে সে সম্পর্কে আমাদেরকে জ্ঞান দান করে। আমাদেরকে শিখায় কিরূপে নিকটজন ,বন্ধুবান্ধব এমনকি সকল মানুষের সাথে আচরণ করতে হবে।

এ দোয়াগুলোর মধ্যে সমস্ত সুন্দর আখলাকের (যা সকল মানুষেরই থাকা উচিৎ) সমাহার ঘটেছে। এমনকি তা আখলাক শিক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব বিধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এ দোয়াগুলোর কোন কোনটি আমাদেরকে শিখায় কিরূপে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা ,সংকট ,দুষ্টঘটনায় স্থির ও অবিচল থাকা যায় কিংবা সুস্থ ও অসুস্থ অবস্থায় কিরূপ আচরণ করতে হয়।

এ দোয়াগুলোর কোন কোনটি ইসলামী সৈন্য ও সেনাবাহিনীর কর্তব্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করে। তদ্রূপ কোন কোনটিতে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের কর্তব্য সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে ,যা কিছু মোহাম্মদী আখলাক ও ঐশী শরীয়তের দাবী তাই কেবলমাত্র দোয়ার আকৃতি ও পোশাকে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর দোয়াগুলোর দৃষ্টান্ত নিম্নরূপে সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়।

প্রথমত : মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ পরিচিতি ,তার মাহাত্ম ও ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান ,তার একত্ববাদের বর্ণনা এবং সকল প্রকার ঘাটতি থেকে তার পবিত্রতা সম্পর্কে সূক্ষ্ম ও পারিভাষিক বর্ণনা এসেছে। এ বিষয়গুলো গভীর ও বৈচিত্রময় বর্ণনায় এ দোয়াগুলোতে স্থান পেয়েছে। যেমন- আমরা সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার প্রথম দোয়ায় পড়ি-

প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপযুক্ত একমাত্র তিনিই যিনি সমস্ত সৃষ্টির প্রারম্ভে যাঁর পূর্বে কোন শুরু নেই এবং তিনি সবকিছুর শেষে যাঁর শেষে কোন শেষ নেই। (প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা একমাত্র তারই প্রাপ্য) ;যাঁর সত্তাকে কোন বান্দাই দেখতে সক্ষম নয়। সমস্ত প্রশংসাকারীর প্রজ্ঞাই তার পূর্ণতাগুণের বর্ণনা দিতে অক্ষম ও অপারগ। কারণ ,সৃষ্টিকুলের সমস্ত সৃষ্টির চিন্তাই তার সত্তার পরিচিতি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। তিনি হলেন সেই সৃষ্টিকর্তা যিনি সমস্ত সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন এবং স্বীয় ইচ্ছা ও প্রত্যয়ে যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনভাবে সৃষ্টি করেছেন।

প্রথম ও শেষ শব্দগুলোর অর্থের দিকে গভীরভাবে মনযোগ দিলে আমরা জানতে পারব যে কিরূপে মহান আল্লাহকে এগুলো থেকে পবিত্র মনে করা যায়। যেমন- চর্মচক্ষুতে দর্শন ,মস্তিষ্কে ধারণা ধারণ করা। পুনরায় সৃষ্টি ও অস্তিত্ব জগতের অর্থের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে ,কিরূপে মহান আল্লাহর প্রত্যয় ঐ গুলোকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন।

সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার ষষ্ঠ দোয়ায় অন্য এক পদ্ধতিতে সৃষ্টি জগতের সৃষ্টি ও পরিচালনার ক্ষমতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে-

তিনি সেগুলোকে স্বীয় ক্ষমতাবলে পরস্পর থেকে পৃথক করেছেন এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

মহান আল্লাহই এদের একের মাঝে অপরকে প্রবেশ ও লুকিয়ে রাখেন। অর্থাৎ রাত্রির আগমনে দিবস আড়ালে চলে যায় কিংবা দিবসের আগমনে রাত্রি। কারণ ,এদের সকলকেই বান্দাদের জীবন যাপনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এদের পর্যায়ক্রমিক আগমনের ফলেই বান্দাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। কারণ ,দিন ও ঋতু সমূহের গমনাগমনের ফলেই মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান আসে। ফলে মানুষ দিন-রাত্রির গমনাগমনে জীবন নির্বাহ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং রাত্রিকে এ জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যে ,এর আগমনে সকল কর্ম ও প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়ে বিশ্রামে মশগুল হবে। মহান আল্লাহ রাত্রিকে তার বান্দাদের নিদ্রা ও বিশ্রামের পোশাকরূপে নির্ধারণ করেছেন যাতে এ আরাম ও নিদ্রার ফলে তাদের দেহে শক্তি সঞ্চয় হয়। অনুরূপ ,এ রাত্রির ছায়ায় মানুষ পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হওয়ার ও জীবনের স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ পায়। আর সহনিদ্রার ফলে স্বীয় স্ত্রীর সাথে মধুর মিলনের অবকাশ পায়। দিবসকে বান্দাদের দর্শন ও কর্মতৎপরতার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পায় এবং জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যোগান দিতে পারে। আর সেই সাথে পৃথিবীতে বিচরণ করে তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়-আশয় আহরণ করতে পারে। অনুরূপ দান ,দয়া ,মসজিদ নির্মাণ এবং জিহাদ ইত্যাদির মাধ্যমে স্বীয় আখেরাতের পথ সচ্ছল করে নিতে পারে।

এ দোয়ায় কিরূপে দিবা-রাত্রির সৃষ্টিকে অতি সহজ ও সরল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে ,আর সেই সাথে এ সমুদয় নেয়ামতের জন্য মানুষকে যে শুকুর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। পুনরায় অন্যভাবে আমরা সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার সপ্তম দোয়ায় পাঠ করি যে ,সমস্ত কিছুর ক্ষমতা মহান আল্লাহরই হাতে-

হে তিনি! যাঁর হাতে সমস্ত সমস্যার সমাধান ,হে যাঁর মাধ্যমে কষ্ট দূর হয় ,হে যাঁর কাছে আত্মিক মুক্তি ও প্রশস্ততা কামনা করা হয় ,একমাত্র তোমার পরাক্রমেই সমস্যার সমাধান হয়। আর তোমার দয়ায়ই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছার কারণসমূহ সৃষ্টি হয়। তোমার ক্ষমতাই সমস্ত বস্তু ও অস্তিত্বশীলের উপর কার্যকর রয়েছে। সমস্ত কিছু কেবলমাত্র তোমার ইচ্ছায় কোনপ্রকার বাক্য ব্যয় ব্যতিরেকেই অস্তিত্বে আসে। অনুরূপ কোন নিষেধাত্মক বাক্যব্যয় ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র তোমার ইচ্ছায়ই বস্তুসমূহ অস্তিত্বহীন হয়।

দ্বিতীয়ত : সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার দোয়াগুলোর মধ্যে কিছু কিছু দোয়া আছে সেগুলোতে বান্দাদের উপর মহান আল্লাহর ফযল ও রহমতের কথা এবং উক্ত ফযল ও রহমতের হক আদায় করতে তাদের অপারগতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এমন একটি দোয়ায় মহান আল্লাহর আনুগত্য ও এবাদত এবং মহান আল্লাহর জন্য অন্য সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখার ব্যাপারে বর্ণনা এসেছে। যেমন- আমরা 37নং দোয়ায় পাঠ করি-

কেউই তোমার শোকর ও প্রশংসার প্রান্তসীমায় পৌঁছাতে পারে না ,যদি না তোমার দয়া ও করুণায় সে সকল বিষয়গুলো অর্জন করে যেগুলো অর্জন করা তোমার শোকরের জন্য আবশ্যক। কেউ শত চেষ্টা করলেও তোমার আনুগত্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না যদি না কেবল একথা স্বীকার করে যে ,তোমার অধিকারানুযায়ী এবাদত করতে অপারগ। সুতরাং সর্বাধিক কৃতজ্ঞ ব্যক্তিও তোমার প্রতি পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অক্ষম এবং সর্বাধিক এবাদতকারীও তোমার পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশে অক্ষম।

মহান আল্লাহর নেয়ামতের মাহাত্ম ও অসীমত্বের কারণে তার পূর্ণ শোকর করতে অপারগ। সুতরাং তার কী অবস্থা যেখানে বান্দা তার শুকর করে শেষ করতে পারে না ,সেখানে সে সীমালংঘন করে ও পাপকর্মে লিপ্ত হয়। কারণ এমন এক পাপকর্মের পর যা-ই করুক না কেন ঐ পাপকর্মকে ধ্বংস করা যায় না। (কারণ এর প্রভাব নষ্ট করার জন্য যে কোন ভাল কর্মই খোদার দয়ায় করবে ,তার জন্য শোকর এবং কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে হবে) ।

এটি হলো তাই যা আমরা পরবর্তীতের 16তম দোয়ায় পাঠ করি-

হে আমার প্রভু! যদি আমি তোমার নিকট এমনভাবে ক্রন্দন করি যে আমার চোখের অঞ্জনগুলো ঝরে যায় ;যদি এমন সুউচ্চ স্বরে বিলাপ করি যার ফলে আমার কন্ঠ রোধ হয়ে যায় ;যদি তোমার নিকট মোনাজাত ও তোমার এবাদতে এমনভাবে দাঁড়াই যে আমার পদযুগল অবশ হয়ে আসে ;যদি তোমার প্রতি এমনভাবে রুকু করি যে আমার অস্থিগুলো স্থানান্তরিত হয়ে যায় এবং এমনভাবে সেজদা করি যে ,আমার চক্ষুগুলো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসে ;কিংবা আমার সমস্ত জীবনে খাদ্যের পরিবর্তে মাটি খেয়ে যাই ,পরিষ্কার পানির পরিবর্তে ঘোলা পানি পান করে যাই ;আর এগুলোর মোকাবিলায় যদি তোমার যিকির এমনভাবে করে যাই যার ফলে আমার জিহ্বায় জড়তা এসে যায় ;তবুও লজ্জা ও শরমের কারণে চক্ষু তুলে আকাশের পানে দেখতে পারব না যে ঐ কর্মগুলো আমার কোন একটি গুনাহ মোচনের কারণ হবে।

তৃতীয়ত : কিছু কিছু দোয়ায় সাবাব ,শাস্তি ,বেহেশত ও জাহান্নাম সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- সাবাব হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ ও দয়া। মানুষ মাত্রই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের মাধ্যমে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির যোগ্য হয়। কারণ তিনি গুনাহ সম্পর্কে মানুষের নিকট চূড়ান্ত দলিল উপস্থাপন করেছেন। হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর সমস্ত দোয়াই এ সুন্দর সুর মাধুর্যে অন্তরাত্মার উপর প্রভাব ফেলে এবং তাকে মহান আল্লাহর শাস্তির ভয় ও সাবাবের আশা করতে প্রশিক্ষণ দেয়। এ দোয়াগুলোর সবই ভয় ও আশার কথা বলে অপূর্ব পদ্ধতিতে ও বৈচিত্র্যময় বাচন ভঙ্গিতে। ফলে এ কথাগুলো কোন ব্যক্তির হৃদয়ে পাপের পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞান ,চিন্তা ,ভয়-ভীতি জাগিয়ে তোলে। যেমনটি আমরা 46তম দোয়ায় পাঠ করি-

তোমার পক্ষ থেকে সকলের জন্য চুড়ান্তরূপে দলিল উপস্থাপিত হয়েছে। তোমার ক্ষমতা ও রাজত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। অতএব ,চিরন্তন হতভাগ্য তার যে তোমাকে ত্যাগ করে। মহাক্ষতি তার জন্য যে তোমার থেকে নিরাশ হয়। সর্বাধিক দ্বিধাগ্রস্থ সে যে তোমা হতে গাফেল। তার উপর তোমার আযাব কঠোর। সে তোমার কতই না আযাব ও শাস্তিতে থাকবে! ঐ ব্যক্তি তোমার সৎপথ থেকে কতদূরে চলে গেছে ,তার কর্ম সহজে তাকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করেছে। এর সবই হলো তার কর্মফল। কারণ তুমি বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ ,এক্ষেত্রে তুমি বান্দাদের সাথে অন্যায় আচরণ কর না। প্রজ্ঞাক্ষেত্রে তুমি সঠিক কর্ম সম্পাদনকারী। তুমি ঐ ব্যক্তির সাথে অন্যায় আচরণ কর নি কারণ তুমি ইতিপূর্বে স্বীয় দলিল উপস্থাপন করেছ এবং সমস্ত অজুহাতের পথ বন্ধ করে দিয়েছো।

31তম দোয়ায় আমরা যেমনটি পাঠ করি-

যদি আমাকে আমার উপর ছেড়ে দাও আমি ধ্বংস হয়ে যাব আর যদি আমাকে স্বীয় রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত না কর তবে আমাকে অস্তিত্বহীন করলে। তোমার নিকট আমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তোমার সাহায্য কামনা করছি। ঐ সকল কুৎসিত কর্ম যেগুলো অসন্তষ্ট করে ,সেগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও। সুতরাং মোহাম্মদ (সা.) ও তার আহলে বাইতের (আ.) উপর দুরুদ বর্ষণ কর এবং যে জুলুমসমূহ নিজের উপর করেছি তা ক্ষমা করে দাও। আর স্বীয় রহমতের দ্বারা পাপের যে বোঝা আমার উপর চেপে বসেছে তা ক্ষমা করে দাও।

চতুর্থতঃ দোয়া পাঠকারী এ ধরনের দোয়া পাঠ করার মাধ্যমে নিজেকে অশ্লীল ,অপছন্দনীয় কাজগুলো থেকে এবং ঘৃণিত বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে রাখতে পারে ফলে নিজ অভ্যন্তরকে ও কালবকে পরিষ্কার ও পবিত্র রাখতে পারে। যেমন-সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার দ্বিতীয় দোয়ায় আমরা পাঠ করি-

প্রভু হে! আমার কল্যাণমূলক নিয়্যাতকে বাড়িয়ে দাও। আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসকে পরিপূর্ণ কর এবং স্বীয় ক্ষমতায় আমার বিশ্বাস ও জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ কর। প্রভু হে! মোহাম্মদ (সা.) ও তার আহলে বাইতের (আ.) উপর দূরুদ প্রেরণ কর এবং সঠিক পথে হেদায়াতের স্বাদ আমাকে আচ্ছাদন করাও যাতে ঐ পথ পরিবর্তন না করি এবং তদ্রূপ সৎপথের স্বাদ আমাকে আস্বাদন করাও যাতে কখনোই ঐ পথ থেকে বিচ্যুত না হই। আর পরিপক্ক নিয়্যাতের স্বাদ আমাকে আস্বাদন করাও যাতে কোন সন্দেহ না থাকে। প্রভু হে! সমস্ত বৈশিষ্ট্য যা আমার ত্রুটি বলে পরিগণিত হয় সংস্কার করে দাও। আর আমার সমস্ত ত্রুটি যার জন্যে আমি অবাঞ্চিত হই সেগুলোকে সৎগুণে পরিবর্তন করে দাও এবং সমস্ত সুগুণ যেগুলো আমার মধ্যে অপূর্ণ অবস্থায় আছে সেগুলোকে পরিপূর্ণ করে দাও।

পঞ্চমত : কিছু দোয়া আছে যেগুলো মানুষের প্রতি দূর্বলতা পরিহার করার আবশ্যকতা এবং মানুষের নিকট অপমানিত না হওয়ার আবশ্যকতা সম্পর্কে দোয়া পাঠকারীকে শিক্ষা দান করে। আর তাকে শিক্ষা দান করে যে ,স্বীয় বাসনার কথা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নিকট বর্ণনা না করতে। অনুরূপ শিক্ষা দান করে যে ,মানুষের বিষয় আশয়ের প্রতি লোভ করা হলো মানবতার জন্য নিকৃষ্টতার বৈশিষ্ট্য। যেমনটি আমরা সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার 20তম দোয়ায় পাঠ করি-

প্রভু হে! সংকটময় মুহুর্তে তুমি ভিন্ন অন্য কারো দারস্থ কর না। অনুরূপ প্রয়োজনীয় মুহুর্তে তুমি ভিন্ন অপর কারো নিকট আমাকে অবনত করো না। আমি যখন ভীতসন্ত্রস্ত হই তখনও আমাকে তোমা ভিন্ন অন্য কারো নিকট অবনত হতে বাধ্য করো না যাতে করে ঐ কাজগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার উপযুক্ত না হয়ে যাই এবং তোমা হতে দূরে সরে যাওয়ার কারণে আমার থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিও না।

এছাড়া আমরা সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার 28তম দোয়ায় পাঠ করি-

প্রভু হে! আমি পরিষ্কার ও নির্মলভাবে অন্যান্যদের থেকে দূরে সরে গিয়েছি এবং তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি ও সমস্ত অন্তরাত্মা নিয়ে তোমার দিকে এসেছি। আর তোমার করুণা যাদের জন্য দরকারী তাদের থেকে তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি। কারণ দেখলাম যে ,অভাবী ও নির্ভরশীল কারো উপর নির্ভর করা বিবেক বুদ্ধি প্রসূত নয়।

অনুরূপ আমরা প্রাগুক্ত কিতাবেই 13তম দোয়ায় পাঠ করি-

সুতরাং যদি কেউ তার প্রয়োজন তোমার নিকট থেকে পূরণ করার জন্য আবেদন করে এবং তোমার সাহায্যেই নিজেদের দারিদ্র দূর করে ,তবে সে সঠিক কাজই করেছে এবং নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা উপযুক্ত স্থানেই বলেছে। কিন্তু যদি কেউ নিজের প্রয়োজন মিটানোর জন্য তোমার সৃষ্টি কোন কিছুর দ্বারস্থ হয় এবং ঐ বস্তুকে নিজের মুক্তির কারণ হিসেবে ধরে নেয় তবে সে নিজেকে হতাশায় পতিত করেছে এবং নিজেকে তোমার করুণার অনুপযুক্ত করেছে।

ষষ্টত : কিছু দোয়া আছে যেগুলো মানুষকে অন্যদের অধিকার সংরক্ষণ ও মানুষকে সহযোগিতা করার বিষয়ে জ্ঞান দান করে। অনুরূপ অপরের প্রতি বন্ধুত্ব ও দয়া প্রকাশ করতে শিখায়। অপরের প্রতি ত্যাগ তিতিক্ষা দেখানোর মাধ্যমে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের অর্থ বাস্তব রূপ লাভ করে। যেমনটি আমরা দোয়ায় পাঠ করি-

প্রভু হে! আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এজন্য যে আমার উপস্থিতিতে অন্যে অত্যাচারিত হয়েছে কিন্তু আমি তাকে সাহায্য করিনি। অনুরূপভাবে ক্ষমা চাইব যে আমাকে দয়া করা হয়েছে কিন্তু তার বিনিময়ে আমি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। ক্ষমা চাইব তার সম্পর্কে যে আমার নিকট স্বীয় দূর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করিনি। ক্ষমা চাইব সে জন্য যে ,আমার নিকট অভাবের পরে এসেছে কিন্তু আমি তার জন্য কোন কিছু ত্যাগ করিনি এবং তার প্রয়োজন মিটাইনি। অনুরূপভাবে ক্ষমা চাইব সেই মুমিন সম্পর্কে আমার উপর যার অধিকার আছে কিন্তু আমি তার অধিকার রক্ষা করিনি ;আর সে মুমিন সম্পর্কে যার ত্রুটি আমি জেনে গিয়েছি কিন্তু আমি তা গোপন রাখিনি।

এখন আমরা বেশ ভাল করেই জানি যে ,ক্ষমা চাওয়ার এ পদ্ধতি সর্বাধিক স্বতঃসিদ্ধ যা অন্তরাত্মাকেও দায়িত্বগুলো সম্পাদন করার বিষয়ে অবহিত করে। আর তাকে শিক্ষা প্রদান করে যে ,প্রত্যেক মানুষকেই এহেন সমুন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে।

অনুরূপ 39তম দোয়ায় এ সমুন্নত চারিত্রিক গুণের পাঠ দান করে পাশাপাশি কিরূপে এমন কাউকে ক্ষমা করার জন্য তোমার নিজেকে বাধ্য করতে হবে যে তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করেছে এবং ক্ষমা চেয়েছে। দোয়ায় বলা হয়-

প্রভু হে! যে সকল মানুষ আমার সাথে দূর্ব্যবহার করেছে এবং আমাকে পীড়া দিয়েছে কিংবা অসম্মান করেছে ,আর ঐ অত্যাচার যা আমার উপর করা হয়েছে তার পাপ নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছে অথবা জীবিত আছে ,সুতরাং আমাকে অসম্মান ও পীড়া দেয়ার কারণে যে পাপ হয়েছে সে পাপের ফলে তার ভোগান্তি হচ্ছে ,তাকে ক্ষমা করে দাও। অনুরূপভাবে ঐ সকল গুনাহ যেগুলো আমার প্রতি অত্যাচার করার ফলে হয়েছে তা থেকেও তাকে ক্ষমা করে দাও। আর আমার সাথে যে যা করেছে সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করো না এবং তাকে শাস্তি দিও না। অনুরূপভাবে আমার সম্পর্কে কৃত তার কুকর্মগুলো মানুষের জন্য প্রকাশ করে দিও না। আর আমার এ ত্যাগ ও সদকাকে (যা ক্ষমা ও ধৈর্য্যরে মাধ্যমে) সর্বোত্তম ও পবিত্রতম সদকার অন্তর্ভূক্ত কর এবং সেই সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ বলে গণনা কর যার মাধ্যমে কেউ তোমার দরবারের নৈকট্য কামনা করে। আর আমার ঐ ক্ষমার বিনিময়ে তুমিও আমার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দাও এবং তাদের সম্পর্কে আমার দোয়ার বিনিময়ে তোমার রহমত আমার উপর বর্ষণ কর যাতে করে আমরা সকলেই তোমার করুণা ও রহমতে সফল ও কৃতকার্য হতে পারি।

এ শেষোক্ত দোয়াটির বিষয়বস্তু কত সুন্দর ও কত মধূর যা সকল ভাল ও মন্দ সম্পর্কে মানুষকে পাঠদান করে। আর সেই সাথে আমাদেরকে শিখায় সকলের জন্য পরিশুদ্ধ নিয়্যাত করতে ও সকলের জন্য কল্যাণ কামনা করতে। এমনকি যারা আমাদের উপর জুলুম ও অত্যাচার করেছে তাদের জন্য আমাদের সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ায় এ ধরনের বিষয়স্তু অনেক বর্ণিত হয়েছে। এ ধরনের ঐশী শিক্ষা যা মানবাত্মাকে কুপ্রবৃত্তি ও কলুষতা থেকে পবিত্র করে তা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। সুতরাং যদি মানুষ হেদায়াত পেতে চায় তবে যেন ঐ দোয়াগুলো পাঠ করে।