ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) 0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 13316
ডাউনলোড: 3372

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13316 / ডাউনলোড: 3372
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

আন্দোলনের উপাদানগুলোর গুরুত্ব বিশ্লেষণ

ইতি পূর্বে আমরা হোসাইনী আন্দোলনের অবকাঠামোতে যে তিনটি মূল উপাদান ছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি। মোয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযিদের ক্ষমতা লাভ এবং ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছ থেকে বাইয়াত নিতে কঠোর নীতি অবলম্বন হলো সে উপাদানগুলোর একটি । কোনমতেই সে ইমাম হোসাইনকে (আ.) ছেড়ে দিতে রাজী নয়। পক্ষান্তরে,ইমাম হোসাইনও (আ.) ইয়াযিদের মত অযোগ্য লোকেক স্বীকৃতি দিতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। ফলে এই বিপরীতমুখী নীতি শীঘ্রই সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করে।

দ্বিতীয় উপাদান ছিল কুফাবাসীদের সাহায্যের আশ্বাস। এখানে এসে সবাই একটা জিনিস ভুল করে বসে। কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে এর সদ্বব্যাবহার করার জন্যেই নাকি ইমাম (আ.) বিদ্রোহ করেছিলেন। আসলে ঘটনা ছিল অন্যরকম। ইমাম হোসাইন (আ.) আন্দোলন শুরু করার দু মাস পরে কুফাবাসীরা নিজেদের নেতৃত্বের আসন পুরণের জন্যে ইমামকে (আ.) আহবান করে। তৃতীয় উপাদান ছিল‘‘ আব্দুর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’’ অর্থাৎ‘‘ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’’ ইসলামের এই রোকনটি বাস্তবায়ন করা। তিনি একাধিকবার তার এ উদ্দেশ্যটি ঘোষণা করেছেন স্বীয় বিভিন্ন ভাষ্যে । আর এ উদ্যেশ্য বয়ান করার সময় তিনি উপরোক্ত দুটি কারণের কোনটাকেই উদ্ধৃত করেননি,বরং‘‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’’ বাস্তবায়নকেই তার আন্দোলনের মূল ভিত্তি এবং কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একজন সংস্কারক এবং তার ভূমিকা সম্পূর্ণ আক্রমণাত্মক।

এই তিন উপাদানের সবগুলো গুরুত্বের দিক থেকে সমান নয়। প্রতিটি উপাদানই তার নির্দিষ্ট সীমায় গুরুত্ববহ ছিল এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকেই ভূমিকা রেখেছে। কুফাবাসীদের দাওয়াত ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এর ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) শুধু একটা শক্তিশালী প্রদেশের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে পারতেন এবং এ যুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা বড়জোর 61 শতাংশ ছিল। কেননা বিশ্বাসঘাতকতা না করে কুফার সব লোকও যদি ইমাম হোসাইনের (আ.) পাশে দাঁড়াতো তবুও শামের বাহিনীর মোকাবলো করা একবারে সহজ কথা ছিল না। শামের বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। এ কারণে তারা হযরত আলীর (আ.) বাহিনীর সাথে সিফফিনের যুদ্ধে 18 মাস যাবত অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তাই দেখা যায় যে,কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি হোসাইনী আন্দোলনে একটা সাধারণ উপাদান ছিল। পক্ষান্তরে,তাদের এ আহবানে সাড়া দেয়াও সাধারণ ব্যাপার। কারণ ঐ ধরনের তীব্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এরকম সাহায্যের আশ্বাস পেলে যে কেউই তা গ্রহণ করবে।

অথচ বাইয়াত করতে ইমামের অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনা ঘটে আরও নিঃসঙ্গ দিনে। এদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে,দাওয়াত প্রসঙ্গের চেয়ে এ উপাদান ই অধিকতর গুরুত্বের দাবীদার। কেননা ইমাম হোসাইন (আ.) যেদিন বাইয়াত করতে অস্বীকার করেছিলেন সেদিন কেউ ইমামের পাশে ছিল না-আর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেউ তাকে আহবানও করেনি। বরং এক অত্যাচারী শাসকমহল ক্ষমতাসীন। সুদীর্ঘ বিশবছর ধরে তাদের গোড়াপত্তন হয়েছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে সমাজে শাসকগোষ্ঠীর হিংসাত্মক চেহারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোয়াবিয়া বিশেষ করে তার শাসনামলের শেষার্ধে কি ধরনের হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপ চালায়-ইতিহাস তার জলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে। সে এমন কি জুমআর নামাজের খুতবায় হযরত আলীকে (আ.) অভিসম্পাত করা আবশ্যিক ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে সর্বত্র এ রীতি চালু হয়ে যায়,এমন কি মক্কা-মদীনায়ও এ ধরনের অভিসম্পাত করা ইবাদত বলে গণ্য হতে থাকে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে সাথে সাথে তার গর্দান যেত। শেষ পর্যন্ত এমন হল যে,হযরত আলীর (আ.) নাম মুখে উচ্চারণ করাও অপরাধ বলে বিবেচিত হত। মোহাদ্দিসগণ হযরত আলীর (আ.) ফযীলত সম্বলিত কোনো হাদীস বর্ণনা করতে সাহস পেতেন না। যদি একান্তই তারা হাদীস বলতে চাইেতন তাহলে তারা নিজেরাই কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে পদা টাঙিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে আগে সবাই কসম খেয়ে নিতেন এ হাদীস ফাস করবেন না। এভাবে একশত ভাগ নিশ্চিত হয়ে তারপর তারা কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন।

এরকম একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে তাও আবার ইয়াযিদের মতো পাষণ্ডের সামনে না বলা কম বীরত্বের কথা নয়। ইয়াযিদ তার বাইয়াত না নেয়া পর্যন্ত নিরস্ত্র হতে রাজী না;ওদিকে ইমাম হোসাইন (আ.) বলছেন আমাকে খণ্ড বিখন্ড করে ফেললেও তোমাদের কাছে আমি নতি স্বীকার করবো না। তাই তুলনামূলক বিচারে দাওয়াত প্রসঙ্গের চেয়ে বাইয়াত না করার প্রসঙ্গ অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বের দাবীদার। কেননা ইমাম হোসাইন (আ.) দুনিয়ার জন্যে ঈমান-আকীদা ও ঐশী দায়িত্ব কে কোন ক্রমেই বিকিয়ে দিতে পারেন না। আর এ চেতনা নিয়েই তিনি তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। উমাইয়ারা টাকা দিয়ে ইতিহাস রচনা করতো। এমন কি বাইতুলমালের টাকা খরচ করে দরবারী আলমদের ভাড়া করে রাসূলের (সা.) অসংখ্য হাদীস জাল করতেও পিছপা হয়নি। ইসলামের ইতিহাসকে তারা মনগড়া ইতিহাসে পরিণত করে। যেটুকু অক্ষত রয়ে গেছে সেটুকু কেবল ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। কেননা ইমাম হোসাইনও (আ.) যদি সেদিন ইয়াযিদের হতে বাইয়াত করে চুপচাপ সবকিছু সহ্য করে যেতেন তাহলে ইসলামকে বাতিল থেকে পৃথক করাই অসম্ভব হয়ে পড়তো। সুতরাং বাইয়াত না করার প্রসঙ্গ হোসাইনী আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এবার তৃতীয় উপাদান অর্থাৎ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার নিয়ে আমরা একটু সবিস্তার আলোচনা করবো। ইমাম হোসাইন (আ.) কোরআন ও হাদীসের একাধিক উদ্ধৃতি সহকারে অন্য কোনো প্রসঙ্গকে না জড়িয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবেই তার এ লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন।

এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার বলোয় ইমাম হোসাইন (আ.) তার পূর্বেকার আত্মরক্ষামূলক নীতি ছেড়ে আক্রমণাত্মক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এখানে এসে তিনি একজন ইতিবাচক বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব । এখানে বাইয়াত প্রসঙ্গের কোনো অনুগমন নেই কিংবা দাওয়াত প্রসঙ্গেরও কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ যদি তার কাছে বাইয়াত না-ও চাওয়া হতো অথবা কুফাবাসীদের সাহায্যের আশ্বাস তিনি না-ও পেতেন,তবুও তিনি একাকী এই অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। সমাজ পঙ্কিলতায় ভরে গেছে,খোদার হারামকে হালাল এবং হালালকে হারামে পরিবর্তন করা হয়েছে। মুসলমানদের বাইতুলমাল আল্লাহর পথে খরচ না করে তা লুটে পুটে খাওয়া হচ্ছে । এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা.) উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বললেনঃ .

فلم یغیّر بفعل او قول کان حقا علی الله ان یدخله مدخله

‘‘ এ ধরনের অবনতি দেখেও যারা এর উৎখাত করতে পা বাড়ায় না,কথা কিংবা কাজের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করে না সেক্ষেত্রে নাস্তিক-তাগুতীদের সাথে সে সব লোককেও জাহান্নামে পাঠানো আল্লাহর বিধানের অন্তর্গত।’’ এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) হাদীসের উদ্ধৃতি টেনে ইমাম হোসাইন (আ.) প্রমাণ করলেন যে,এটাই সেই বিদ্রোহের সময়-এই সেই প্রতিবাদের সময়। সুতরাং আজ যদি কেউ চুপ করে বসে থাকে তাহলে তার পরিণতি অবশ্যই ঐ সমস্ত পাপিষ্টদের মতোই হবে। এ ধরনের একাধিক হাদীস থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) তার আন্দোলনের ধারা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন।

ইমাম রেযা (আ.) থেকে এক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :

اذا تواکلت الناس الامر بالمعروف و النهی عن المنکر فلیأذنوا بوقاع من الله

যখন লোকেরা অন্যের কাধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার করা থেকে বিরত থাকে এবং পরিণামে কেউই যদি এ কাজে অগ্রসর না হয়-তাহলে তারা যেন আল্লাহর আযাবের অপেক্ষায় থাকে। ( দ্রঃ ফুরুয়ে কাফী 5 / 59 )

প্রশ্ন হতে পারেঃ এ আযাব কি ধরনের? তাদের কি আকাশ থেকে পাথর নিক্ষেপ করে মারা হবে?

জবাব হলঃ না। স্বয়ং আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে আযাবের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

) قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَىٰ أَن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ(

‘‘ বল,তিনি তোমাদের ওপর থেকে অথবা পায়ের নীচ থেকে শাস্তি প্রেরণ করতে অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে এবং একদলকে অপর দলের সংঘর্ষের আস্বাদ গ্রহণ করাতে তিনিই সক্ষম।’’ ( দ্রঃ সূরা আনআমঃ 65 )

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ তোমাদের ওপর থেকে অর্থাৎ তোমাদের চেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী মহল থেকে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে,আর পায়ের নীচ থেকে বলতে বোঝানো হয়েছে,তোমাদের চেয়ে দুর্বল মহল থেকেও তোমরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ যারা আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার করা থেকে বিরত থাকে তারা যেন আল্লাহর নিশ্চিত শাস্তির অপেক্ষায় থাকে।

অন্য আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

لتآمرون بالمعروف و لتنهنّ عن المنکر او یسلطنّ الله علیکم شرار کم فیدعوا خیارکم فلا یستجاب لهم

‘‘ অবশ্যই সৎ কাজের উপদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দান করবে নতুবা অধমরাই তোমাদের কাধে চেপে বসবে। এটা যদি বর্জন করা হয় তাহলে তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন তোমরা যতই অনুনয়-বিনয় করো না কেন-তা গ্রাহ করা হবে না।’’ ( দ্রঃ ফুরুয়ে কাফীঃ 4/56)

ইমাম গাযযালীও (রহঃ) তার বিখ্যাত এহইয়াউল উলুম গ্রন্থে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি ব্যাখ্যা করার সময় অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারই বলে থাকেন যে,অধমদের ক্ষমতাসীন হবার সুযোগ দিলে উত্তমরা আল্লাহর দরবারে যতই অনুনয়-বিনয় করুক না কেন তা গ্রাহ্য হবে না। অর্থাৎ যে সমাজে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার বর্জিত হয় সে সমাজ আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত হয়। তখন কেদে বুক ভাসালেও আল্লাহ তাদের প্রতি সহায় হবেন না। অথচ ইমাম গাযযালী (রহঃ) এ হাদীসটির একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যা সত্যিই চমৎকার। তিনি বলেন :

فیدعوا خیارکم فلا یستجاب لهم

এই অংশটুকুর অর্থ যে,তারা আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করে প্রত্যাখ্যাত হবে তা নয়,বরং এর অর্থ হল :‘‘ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’’ পরিত্যাগ করলে অধমরা এতটাই দুর্দান্ত,পাষণ্ড বেশরম ও প্রতাপশালী হয়ে উঠবে যে,ভাল লোকরা নিরূপায় হয়ে তাদের কাছে কোনো প্রত্যাশা করলে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান ও লাঞ্ছিত করা হবে। তাই এ হাদীসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা.) উম্মতকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন : তোমরা যদি মাথা উচু করে বাচতে চাও তাহলে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার করো নতুবা তোমরা হীন-দুর্বল ও অপমানিত হবে। নিকৃষ্টতম লোকও তখন তোমাদেরকে আর গুরুত্ব দেবে না। এমন কি দাস-দাসীদের মতোও যদি তখন তোমরা তাদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াও তবুও তোমাদেরকে গ্রহণ করা হবে না।

হাদীসটির এই ব্যাখ্যাটা অত্যধিক গুরুত্ববহ। ইসলামে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রোকন রয়েছে বলেই ইমাম হোসাইন (আ.) এটাকে তার স্লোগান হিসেব বেছে নেন। তিনি ইসলামের এই সূক্ষ্ণ দর্শন সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন বলেই তার বিভিন্ন ভাষ্যে বোঝাতে চেয়েছেনঃ ইয়াযিদ যদি বাইয়াত নেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি না-ও করতো কিংবা কুফাবাসীরা যদি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না-ও দিতে,তবুও আমি কেবল অধমদের হাত থেকে মানবতাকে বাচানোর জন্যেই বিদ্রোহ করতাম।

ইসলামের বিভিন্ন ভিত্তির মধ্যে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার ও একটি । এই ভিত্তি সম্বন্ধে আমাদের বিস্তারিতভাবে পরিচিত হবার অবকাশ রয়ে গেছে। কেননা রাসূলুল্লাহর (সা.) একাধিক হাদীসে এ বিষয় বেশ গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া ইসলামের ফেকাহ শাস্ত্রে এ বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচিত হয়েছে। উপরন্তু খোদ কোরআন মজীদেও এ বিষয়টি বিস্তর গুরুত্ব সহকারে বারংবার উল্লিখিত হয়েছে এবং এ রোকনটি থেকে গাফেল থাকার কারণে অতীতের কত জাতিই যে সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেটাও কুরআনে আলোচিত হয়েছেঃ

) فَلَوْلَا كَانَ مِنَ الْقُرُونِ مِن قَبْلِكُمْ أُولُو بَقِيَّةٍ يَنْهَوْنَ عَنِ الْفَسَادِ(

‘‘ তোমাদের পূর্ববর্তী বংশধরদের মধ্যে কোনো একদল সজ্জন ছিল না যারা ফ্যাসাদের সাথে সংগ্রাম করে তাদের সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাচাতো?( সূরা হুদ - 116 )

‘‘ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’’ পরিত্যাগ করার দায়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত আরেকটি জাতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন বলছেঃ

) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ(

‘‘ তারা যেসব গর্হিত কাজ করতো তা থেকে তারা একেঅপরকে বাধা দিত না। তারা যা করতো তা কতই না নিকৃষ্ট !’’ ( মায়িদা : 79 )

আর মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে পবিত্র কোরআন বলছেঃ

) وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ(

‘‘ তোমাদের সেই উম্মত হওয়া চাই যারা সৎ কাজে আদেশ করে এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়। যে উম্মতের মধ্যে এই গুণ আছে তারাই তো সফলকাম।’’ ( আল - ইমরান : 104 )

সূরা আলে ইমরানে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার সংক্রান্ত অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। উপরোক্ত আয়াতটির আগে বলা হয়েছেঃ

) وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে যেও না।’’ ( আল - ইমরান : 103 )

এ আয়াতে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহবান জানানো হয়েছে। কারণ মুসলমানরা যদি ভিন্ন ভিন্ন ফেরকা নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হয় তাহলে এ থেকে সবচেয়ে বেশী ফায়দা লুটবে ইসলামের শত্রুরা। তাই বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানদের মধ্যকার ভেদাভেদগুলো ভুলে গিয়ে আল্লাহর রজ্জুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। এই ঐক্যের আহবান জানানোর পরের আয়াতেই কোরআন বলছেঃ

) وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ(

তোমাদের মধ্যে এমন কারো থাকা চাই যারা সৎ কাজের প্রতি আহবান করবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সৎ কাজ বলতে এখানে ঐক্য রক্ষার কথাই বলা হয়েছে অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে একদল সজ্জন থাকা চাই যারা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে,মুসলমানদের ঐক্য কে অটুট রাখবে। পরবর্তী আয়াতে কোরআন বলেছে :

) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا.(

‘‘ তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা নিজেদের মধ্যে বিভেদ করে দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে।’’ ( আল ইমরান : 105 )

এখানে যে বিষয় অতীব লক্ষ্যণীয় তা হলো যে,যেখানে পর পর দুটি আয়াতে ঐক্যের আহবান জানাতে বলা হয়েছে এবং বিভেদ করতে নিষেধ করা হয়েছে সে দুটি আয়াতের মাঝখানে বলা হচ্ছেঃ

) وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ(

‘‘ তোমরা এমন উম্মত হও যারা সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়-এ গুণ সমৃদ্ধ জাতিই হল ধন্য জাতি’’ আয়াতের এ ধরনের বিন্যাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য রক্ষাকেই কোরআন অন্যতম সৎ কাজ বলে মনে করে এবং-বিভেদ এবং হানাহানিকে ন্যাক্কারজনক কাজ বলে বিবেচনা করে-এ বিভেদের কারণ যেটাই হোক না কেন।

আরও একধাপ পরে এসে কোরআন বলছেঃ

) كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ(

‘‘ হে মুসলমানগণ! তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত,তোমরাই মানব জাতির জন্যে নি:সারিত হয়েছো অর্থাৎ মানবতার স্বার্থরক্ষায় তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উম্মত আর কেউ এ পৃথিবীতে আসেনি।’’

এখন প্রশ্ন হল,কোরআনের অনুসারীদের এই শ্রেষ্ঠত্বের জবাবে এবার কোরআন বলছেঃ

) تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ(

‘‘ তোমাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হল তোমরা সৎ কাজে আদেশ দান কর এবং অসৎ কাজে বাধা দাও।’’ ( আল - ইমরানঃ 110 )

কোরআনের এই বিধান অনুযায়ী বলা যায় যে,আজ আমাদের যে মুসলিম সমাজে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার নেই সে মুসলিম সমাজ নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে দাবি করতে পারে না। শুধু তাই নয়,যেহেতু ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিটি তাদের জীবনে প্রচলিত নয়,তাই তাদের ইসলামও অসম্পূর্ণ। আমরা যদি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এ বিষয় বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো যে,অসংখ্য আয়াত ও হাদিস মূলতঃ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকার -এর অসামান্য গুরুত্বের কথাই তুলে ধরেছে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের ফেকাহশাস্ত্রে এটাকে সবচেয়ে ছোট অধ্যায়ে সংকলিত করা হয়েছে। ফলে আজকের মুসলিম সমাজে এর গুরুত্ব লোপ পেতে বসেছে। প্রকৃতপক্ষে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার এমন কোনো বিষয় নয় যা কালক্রমে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। কেননা জুলুম অত্যাচার বরাবরই ছিল,আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর কোরআনের কথামতো শ্রেষ্ঠ উম্মত তারাই যারা এসব জুলুম ও ফ্যাসাদের সাথে সংগ্রাম করবে। এজন্যে সব কিছুর অগ্রে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে সব সময়।

পাশ্চাত্যের ORIENTALIST-দের অনেকেই ইসলামকে রীতিমত এই বলে অপবাদ দিয়ে থাকে যে,ইসলাম সম্পূর্ণ একটা ভাগ্যনির্ভর দীন। এতে মানুষের সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং মানুষকে বলা হয়েছেঃ তোমরা হাত-পা গুটিয়ে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকো। দেখ আল্লাহ কি করে। তারা আরও অপবাদ দেয় যে,ইসলাম মানুষকে কর্মক্ষমতা ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে,অর্থাৎ ইসলামে মানুষের কোনো কিছু করার নেই। যা কিছু করার সবই আল্লাহ করবেন। এ ব্যাপারে মানুষের কোনো দায়িত্ব ও নেই।

এটা স্রেফ একটি অপবাদ। ঘটনাক্রমে কোরআন স্বয়ং ইহুদীদেরকেই এই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। যখন হযরত মূসা (আ.) তাদেরকে বলেন :

) يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّـهُ لَكُمْ(

 ‘‘ হে আমার উম্মত,আল্লাহ তোমাদের জন্যে যে ভুখণ্ড নির্দিষ্ট করেছেন সেখানে চলো।’’

তখন তারা মূসাকে (আ.) বললো :

) فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلَا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ(

‘‘ হে মূসা (আ.)! আমরা এখানেই বসে থাকি,আপনি ও আপনার খোদা গিয়ে যুদ্ধ করুন এবং শত্রুকে তাড়িয়ে দিয়ে ভূখণ্ড খালি করে ফেলুন। তারপর আমরা আসছি।’’

বদেরের যুদ্ধের সময় (যখন কাফেলা পালিয়ে গিয়েছিল) রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন ও সবার মতামত জানতে চান। তিনি বলেন,তোমরা বলো দেখি,এখন আমরা শত্রুদের খোজে বের হবো নাকি মদীনায় ফিরে যাব? সবাই যার যার মত পেশ করলেন,কিন্তু আবুজর কিংবা মেকদাদ এই দু জনের একজন বললেনঃ হে রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমরা তো আর বনী ইসরাইলের মতো বলবো না,আমাদের কোনো কিছু করার নেই;আপনি আর আপনার খোদা গিয়ে যুদ্ধ করুন। বরং আপনি যা বলবেন আমরা তাই শুনবো। তাছাড়া একমাত্র পবিত্র কোরআনই পরিস্কারভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে ফরিয়াদ করে বলছেঃ

) إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا(

‘‘ আমরা তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন তাদের ইচ্ছা হয় শোকর গুজার হবে আর নতুবা কুফরী করবে’’( দাহরঃ 3 )

) وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ(

 ‘‘ আমি কি তাকে দু টি পথই দেখাই নি?’’

) وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَـٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا(

‘‘ যারা মুমিন হয়ে পরকাল কামনা করে এবং তজ্জন্যে যথাযথ প্রচেষ্টা চালায় তাদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে।’’ ( ইসরাঃ 19 )

এছাড়া কুরআনে বহু আয়াতে বলা হয়েছেঃ

) فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ(

‘‘ তোমরা নিজের হাতে যা অর্জন করেছো।’’ ( শুরাঃ 30 )

যাতে আমরা অন্যায় ও অবৈধ কাজকর্মকে আল্লাহর কাধে না চাপাই। যদি কোনো সমাজ,কোনো জাতি হতভাগ্য,অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে তা তাদের নিজের দোষেই হয়েছে। কোরআন বলছেঃ

) مَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَـٰكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ(

‘‘ আমরা কখনোই তাদের ওপর জুলুম করিনি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করতো।’’ ( নাহলঃ 118 )

আর একটি বিষয় যা পশ্চিমাদের এই অপবাদকে খণ্ডন করে এবং যা কেবল ইসলামেই রয়েছে ও অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত,তা হলো যে,ইসলাম মানুষকে কেবল আল্লাহর সম্মুখেই দায়িত্বশীল করে ক্ষান্ত হয়নি,মানুষের নিজেদের মধ্যেও একজনকে অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যভার অর্পণ করেছে। আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকার হল এটাই : হে মানুষ,তুমি কেবল আল্লাহর সম্মুখেই দায়িত্বশীল নও,সমাজের সামনেও তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলঃ এরকম একটা দীন কি কখনো নিছক ভাগ্য নির্ভর দীন হতে পারে? বরং ভাগ্য (কাযা ও কাদার) নির্ভর দীন বলতে ওরা যে অর্থ বুঝিয়েছে অর্থাৎ ইসলাম মানুষকে কোনো রকম স্বাধীনতা,কর্তৃত্ব এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে বঞ্চিত করেছে’’ -ইসলাম এই ধরনের‘‘ কাযা কাদার’’ কে খণ্ডন করেছে। ইসলাম মানুষকে যে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব দিয়েছে,তার দলিল হিসেবে এই ছোট আয়াতটিই যথেষ্ট । পবিত্র কোরআন সূরা রা দের 11 নং আয়াতে বলছেঃ

) إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ(

 ‘‘ আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে অগ্রসর হয়।’’ এর চেয়ে বেশী স্বাধীনতা,কর্তৃত্ব আর কি হতে পারে?

পক্ষান্তরে,মুসলমানদের মধ্যেও যারা সবকিছু আল্লাহ করবে এই আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে,এই আয়াতের চপেটাঘাত তাদের মুখেও লাগে। তাদেরকে ধমক দিয়ে এই আয়াতটি বলেঃ অনর্থক বসে থেকো না,আল্লাহ অনিবার্যভাবে কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করবেন না।

 حتی یغیّروا ما بانفسهم যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসবে , তাদের যা করার তা ভালভাবে সম্পাদন করবে। তাদের চরিত্র , মানসিকতা , লক্ষ্য এবং সর্বোপরি তারা নিজেরা শুদ্ধ হবে। এর চেয়ে গুরুদায়িত্ব আর কি হতে পারে ? তাও আবার একটা সমাজ তথা গোটা জাতির ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

আরেকটি আয়াতে পবিত্র কোরআন একটা কলূষিত জাতির পরিণতি তুলে ধরে বলছেঃ

) ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّـهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ(

আল্লাহ কোনো জাতির জন্যে যে নেয়ামত দান করেছেন তা তিনি ফিরিয়ে নেন না যতক্ষণ তারা নিজেরাই তা বর্জন করে।’’ ( আনফালঃ 53 )

অর্থাৎ যখন কোনো জাতি কলূষতায় নিমজ্জিত হয়,ফেতনা-ফ্যাসাদে ভরে যায়,তাদের সমাজ এভাবে তাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়,তখনই আল্লাহও তাদেরকে নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন।

এরপর কি বুঝতে বাকী থাকে যে,আমরা যারা সব কাজ আল্লাহ করবেন শুধু এই আশায় বসে আছি তাদের এ আশা একবারেই অনর্থক ও ভিত্তিহীন।

যতক্ষণ কোনো জাতি নিজেরাই নিজেদের দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে এগিয়ে আসবে না,যতক্ষণ কোনো জাতি পরিশ্রমী ও ত্যাগী হবে না,যতক্ষণ কোনো মুক্ত -স্বাধীন চিন্তার পথ ধরবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সে জাতি উন্নত হবে না,মুক্তি পাবে না।

পক্ষান্তরে যখন কোনো জাতি তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লাগবে,পরিশ্রম করবে,কল্যাণের রাস্তা বেছে নিতে পারবে একমাত্র সে জাতিই আল্লাহর সমর্থন লাভ করবে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় তারা আল্লাহর ফায়েজ,রহমত ও সহযোগিতার অধিকারী হবে। যদি অন্যের ওপর ভরসা করে নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে থাকলে সমস্যার সমাধান হতো তাহলে ঐ পরিস্থিতিতে হযরত ইমাম হোসাইনও (আ.) সবার আগে তাই করতেন। কিন্তু কেন তা তিনি করেননি? কারণ তিনি নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি সমাজকে কলূষমুক্ত করতে চেয়েছিলেন যে কলূষতায় একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) কিভাবে সমাজকে কলুষতা মুক্ত করবেন? কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন? সোজা কাজতো আমরাও করতে পারি। সাধারণ পর্যায়ের সমস্যা সমাধান করা সবার পক্ষে সম্ভব। ইসলাম বলেছেঃ কেউ মারা গেলে তার জানাযায় শরীক হও,কোরআন খানিতে অংশ নাও। সবাই এসব কাজ করেও থাকে। কিন্তু ইসলাম সব সময় এ ধরনের সাধারণ কাজ চায় না। কখনো কখনো ইমাম হোসাইনের (আ.) মত পদক্ষেপ নিতে হয়,বিদ্রোহ করতে হয়। এমন কিছু করতে হয় যা কেবল ঐ সময়ের মুসলিম সমাজকেই ঝাকুনি দেবে না,বরং এক বছর পর তা এক রকমভাবে,পাঁচ বছর পর আরেকটি রকমভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এমন কি 50 বছর-100 বছর,শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা সত্যের পথে সংগ্রামকারীদের জন্যে এক আদর্শ হিসেবেই চিরজাগরুক থাকবে। আর এটিই হলো নিজেদের ভাগ্যে নিজেরাই পরিবর্তন আনা।