ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) 0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 13314
ডাউনলোড: 3372

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13314 / ডাউনলোড: 3372
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হোসাইনী বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যাবলী

ইমাম হোসাইনের (আ.) এই বিপ্লব সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তাদের মধ্যে একটি হলো এ বিপ্লব কি সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়েছিল নাকি তা ছিল সহসা কোনো বিস্ফোরণ ? অর্থাৎ এ বিপ্লব কি কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হয়ে সংঘটিত হয়েছিল নাকি কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া ছাড়াই সবার অজ্ঞাতে হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ ছিল?

ডায়ালেকটিক তথা দ্বান্দিক বস্তবাদীরা বলেন,যদি কোথাও বিপ্লব ঘটাতে চাও তাহলে সেখানকার জনগণের মধ্যে অভাব-অনটন,অরাজকতা ও নির্যাতন বাড়াতে থাকো,জনগণের মধ্যে যতবেশী সম্ভব অসন্তোষ সৃষ্টি করতে থাকো। তাহলে এক সময় যখন এসব অনটন,নিপীড়ন ও অসন্তোষ তাদের ধৈর্য-সহ্যের বাইরে চলে যাবে তখন তারা নিজেরাই বিস্ফোরণের মতো রোষে ফেটে পড়বে। আর যারা বিপ্লবীর খ্যাতি গলায় পরতে চায় তাদের জন্যে এটাই সুবিধাজনক। এ সুযোগের সদ্বব্যাবহার করতে পারলে শীঘ্রই তারা বিপ্লবী , বিদ্রোহী এসব বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হতে পারবে। ঠিক একটা বেলুন যেমন বাতাস ভরতে ভরতে এক সময় বেলুনের ধারণ ক্ষমতা শেষ হয়ে যায় এবং প্রচণ্ড বাতাসের চাপে বেলুন ফেটে যায়। এ সকল বস্তবাদীর বিপ্লবও ঠিক এ ধরনের একটা ঘটনা।

অনেক সময় দেখা যায় যে,একজন মানুষ কোনো একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এসে এক কথা মুখ থেকে বের করতে চায় না। যতই চাপ সৃষ্টি করা হোক না কেন,কোন ক্রমেই সে তা বলতে রাজী নয়। কিন্তু এক পর্যায়ে যখন অসহ্য হয়ে পড়ে তখন সে বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়ে এবং তখন শুধু একটা কথা নয়,বরং সে এতসব কথা বলতে থাকে যা আদৌ শুনতে চাওয়া হয়নি এবং তাকে তখন চুপ করানোই মুশকিল হয়ে যায়। এ হলো বিস্ফোরণ।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ইসলামী আদর্শকে বস্তুগত কোনো আদর্শ থেকে শ্রেষ্ঠ ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে তার মধ্যে একটা হলো যে,বস্তবাদীরা বিস্ফোরণ আকারের বিপ্লবে বিশ্বাসী,অথচ ইসলাম এ ধরনের কোনো বিপ্লবে বিশ্বাসী নয়,তা মেনেও নেয় না। ইসলামী বিপ্লব একশতভাগ জ্ঞাতসারে পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট পথ ধরেই আসে।

ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লব সম্পর্কেও এ বিষয়টি বহুল আলাচিত। ইমামের এই বিপ্লব কি অজ্ঞাতভাবে এবং বিস্ফোরণ আকারে ঘটেছিল? বনী উমাইয়ারা বিশেষ করে মোয়াবিয়া বিন হাশেমের ওপর যে অপব্যাবহার ও নির্যাতন চালিয়ে এসেছে আর এ কারণে যখন ইয়াযিদের হাতে ক্ষমতা গেল,অমিন ইমাম পরিবারের সহ্যের বাইরে চলে গেল আর তারা বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়লো যে,ভাগ্যে যা আছে তাই হবে,আর সহ্য করা যাবেনা (নাউজুবিল্লাহ)। ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লব কি এভাবেই সংঘটিত হয়েছিল ?

এ প্রশ্নের জবাব আমাদের পূর্বের আলোচনা থেকে সহজেই বোধগম্য । মোয়াবিয়ার সাথে ইমামের যেসব কথা কাটাকাটি ও চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল তা থেকে বোঝা যায় যে,মোয়াবিয়ার আমল থেকেই ইমামের আন্দোলন শুরু হয় এবং এ আন্দোলন সম্পূর্ণ জেনে শুনে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংঘটিত হয়েছিল। বিশেষ করে ইমাম রাসূলুল্লাহর (সা.) বিশিষ্ট্য সাহাবাদেরকে মিনায় সমবেত করে যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ পেশকরেন এবং তোহাফুল উকুল গ্রন্থে যা লিপিবদ্ধ আছে তা থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে,ইমাম সম্পূর্ণ জেনে শুনে পরিকল্পনা মাফিক পদক্ষেপ নিয়ে ধাপে ধাপে এই বিপ্লবকে সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌছিয়েছেন। এ বিপ্লবই,বিস্ফোরণ নয়। ইসলামী বিপ্লব,বিস্ফোরণের বিপ্লব নয়।

ইমাম হোসাইন (আ.) প্রত্যেককেই এ বিপ্লবকে বিস্ফোরণের রূপ দেয়া থেকে বিরত রাখেন। ইমাম কেন প্রতি মুহূর্তে যে কোনো একটা বাহানায় তার সঙ্গীদেরকে অব্যাহতি দিতে চান? বারংবার তিনি তাদেরকে বলেন,‘‘ দেখ,এখানে খাদ্য নেই,পানীয় নেই,বরং বিপদ আছে,আছে মৃত্যু।’’ এমন কি আশুরার রাতেও তিনি আরও কোমলতার সাথে বললেন :‘‘ আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম কোনো সহযোগীর সন্তান পাইনি। তোমাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । এই পাষন্ডরা কেবল আমাকেই চায়। তোমাদের কারও সাথে তাদের কোনো কাজ নেই। তোমরা চাইলে অনায়াসে চলে যেতে পারো। এমন কি ওরা যদি জানে যে,তোমরা চলে যা তাহলে তোমাদের একটুও ক্ষতি করবে না। আমি বরং এখানে একাই থাকি।’’ কেন ইমাম এ ধরনের কথা বললেন? বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে নেতা বিপ্লব করতে চায়,সে তো কখনো এ ধরনের কথা বলবে না। ইমাম যা বলছেন তা শরীয়তের দৃষ্টি কোণ থেকেই বলছেন। অবশ্য শরিয়তী দায়িত্বও ছিল এবং এদিকটিও ও তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন যে,শরিয়তী দায়িত্ব ও যেন সবাই সজ্ঞানে পালন করতে পারে। তাই তিনি বললেন,‘‘ দেখ,দুশমন তোমাদেরকে অবরোধ করেনি। দুশমনদের প থেকেও তোমাদের জন্যে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদি রাতের অন্ধকারে তোমরা চলে যেতে পার তাহলে কেউই তোমাদেরকে বাধা দেবে না। বন্ধুর পক্ষ থেকেও তোমাদের জন্যে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমন কি আমার হাতে যে বাইয়াত করেছিল তাও তুলে নিলাম। যদি বাইয়াতের কারণে তোমরা সমস্যা মনে করো তাহলে এখন আর সে সমস্যাও রইলো না,তোমরা এখন সবাই মুক্ত ও স্বাধীন।’’ অর্থাৎ এখন কেবল জেনে শুনে সজ্ঞানে বেছে নেয়ার পালা। এখন যদি হোসাইনকে সাহায্য করতে চাও তাহলে কোনো বাধ্যবাধকতার অনুভূতি ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সজ্ঞানে এসো। এখানেই ছিল ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লবের শ্রেষ্ঠত্ব।

এ প্রসঙ্গে মুসলমানদের হাতে স্পেনের পতনের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তারিক ইবনে যিয়াদ মুসলিম বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে যখন স্পেনের ভূ-খন্ডে প্রবেশ করলেন তখন আদেশ দিলেন সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে দাও। আর মাত্র 24 ঘন্টার জন্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সমগ্রী রেখে দিয়ে বাকীগুলো পানিতে ফেলে দাও।’’ এরপর তারেক সৈন্যদেরকে ডেকে বললেন,‘‘ দেখা,যদি পালাতে চাও তাহলে যুবে মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ একটাও জাহাজ আর নেই। আর যদি আলসেমি করতে চাও তাহলেও মাত্র একিদন বাচতে পারবে। কেননা আমাদের হাতে এখন মাত্র 24 ঘন্টার খাদ্য সামগ্রী রয়েছে। সুতরাং এখন একটাই মাত্র পথ। তা হলো শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা। তাদেরকে পরাজিত করতে পারলেই কেবল তোমরা বেঁচে থাকার আশা করতে পারবে। মোটকথা,তাদেরকে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হল। এমন একটি পরিস্থিতিতে সৈন্যরা যুদ্ধ না করে কি করতে পারে? অথচ ইমাম হোসাইন (আ.) তার সঙ্গীদের সাথে তারেক ইবনে যিয়াদের সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করলেন। তিনি বললেন না দেখ,আমাদের চারদিকে শত্রু। এদিক দিয়ে গেলও তোমাদেরকে শেষ করবে,ওদিক দিয়ে গেলও শেষ করবে। যেভাবে হোক তোমাদেরকে এখানেই মরতে হবে। আর মরতেই যখন হবে তখন এসো আমার সাথেই মৃত্যুবরণ করো।

ইমাম হোসাইন (আ.) কখনই একথা বলেননি। কারণ এ ধরনের মৃত্যুর তো প্রকৃত কোনো মূল্য নেই। এটি একজন সাধারণ পলিটিশিয়ানকে মানায়। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) যিনি একটি চিরন্তন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে চান তার জন্যে তো এটি মানায় না। বরং ইমাম বললেন,তোমাদের সামনেও শত্রু নেই আর পিছনেও কোনো সমুদ্র নেই। শত্রুও তোমাদেরকে বাধ্য করবে না,বন্ধুও তোমাদেরকে বাধ্য করবে না। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে যেটা পার বেছে নাও।

সুতরাং সবার আগে স্বীকার করতে হবে যে,ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লব ছিল স্বাধীনভাবে সজ্ঞানে এবং নির্দিষ্ট লক্ষে পরিচালিত একটি বিপ্লব। এ অবগতি যেমন ইমামেরও ছিল তেমনি তার প্রত্যেকটি সহযোগীরও ছিল। কিন্তু কোনভাবেই এটি বিস্ফোরণ ছিল না। আর এ কারণেই এ বিপ্লবের অনেকগুলো প্রেক্ষাপট ও বৈশিষ্ট্য থাকাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে ইমামের বিপ্লব প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা থেকেও মার্জিত। কেননা প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঘটনাবলীর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো যে,প্রাকৃতিক বিষয়গুলো শুধু এক নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটে থাকে। একটা ধাতু একই সাথে সোনা ও রূপা হতে পারে না। হয় সোনা হবে,না হয় রূপা। এ হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু একটি সামাজিক বিষয়ে একই সাথে একাধিক প্রেক্ষিতের সমাবেশ সম্ভব।

ঘটনাক্রমে ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লবও এক বহু প্রেক্ষিত ঘটনা। কোনো কোনো বিপ্লব ও বিদ্রোহ কেবল প্রতিক্রিয়াধর্মী হতে পারে। প্রতিক্রিয়া আবার দু ধরনেরঃ ইতিবাচক ও নেতিবাচক। কোনো কোনো বিপ্লব আবার কেবল সূচনাধর্মীও হতে পারে। ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লবে এ বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিটিরই উপস্থিতি দেখা যায়। আর এ কারণেই এ আন্দোলন বহু প্রেক্ষিতের রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন হতে পারেঃ কিভাবে?

জবাবে বলতে হয়,প্রথম যে কারণটি কালক্রমে ইমামের আন্দোলনে অনুঘটক হয়েছিল তা হলো বাইয়াত প্রসঙ্গ । ইমাম (আ.) মদীনায় ছিলেন। মোয়াবিয়া স্বীয় পুত্র ইয়াযিদের খেলাফত সুনিশ্চিত করার জন্যে মদীনায় এসে ইমামের কাছ থেকে ইয়াযিদের জন্যে বাইয়াত চায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। মোয়াবিয়ার মৃত্যু পর ইয়াযিদ পুনরায় বাইয়াত নিতে ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু ইমাম দেখলেন যে,এ বাইয়াত করার অর্থ কেবল মোয়াবিয়ার অনৈসলামী নীতি ও বিচ্যুতিকে মেনে নেয়া নয়,বরং ইসলামে আরেকটি নতুন বিদ আত তথা রাজতন্ত্র রও অনুমোদন করা। এতদিন ইসলামে খলীফা নির্বাচনে দু টো মতবাদ ছিল। একদল বলতো যে,আল্লাহর তরফ থেকে এবং রাসূলুল্লাহর বা ইমামের নিয়োগ ঘোষণার মাধ্যমেই খলীফা নিযুক্ত হবেন। আর কেউ কেউ বলতো যে,সাধারণ মানুষই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের খলীফা নির্বাচন করবে। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) যদি আজ এ বাইয়াত মেনে নেন তাহলে ইসলামের এই দুটো প্রচলিত মতবাদের অবসান হবে এবং খেলাফত এক নতুন ধারায় উত্তরাধিকার সম্পত্তি বা রাজতন্ত্রে রূপ নেবে যা ইসলামের দৃষ্টিতে নির্ঘাত বিদ আত। মোয়াবিয়া প্রণীত এই বিদ আত প্রথা প্রথমবারের মতো ইসলামে সংযোজিত হবে।

তারা ইমাম হোসাইনকে (আ.) বাইয়াত করতে কড়াকিড় আরোপ করে। অর্থাৎ এটা ইমামের জন্যে একটা প্রেক্ষাপট। এ প্রেক্ষাপটে তিনি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।‘‘ তোমরা বাইয়াত চাও? আমি কোন মতেই তোমাদের হাতে বাইয়াত করবো না।’’ ইমামের এ পদক্ষেপ তাকওয়া বা খোদাভীপ্রতিপ্রসূত। এটা সে জাতীয় পদক্ষেপ যা প্রত্যেক মানুষই সমাজে চলার পথে সম্মুখীন হয়। ভোগ-লালসা,খ্যাতির লালসা,পদলোভ,ভয়-ভতি প্রভৃতির রূপে এগুলো মানুষকে আক্রান্ত করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে মানুষের কর্তব্য হল নেতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া। মানুষের কর্তব্য একটি না বলা। অর্থাৎ সে তাকওয়াসম্পন্ন মানুষ।

তারা ইমামকে হত্যার ভয় দেখিয়ে বাইয়াত নিতে চাইল। ইমাম প্রাণ দিতে রাজী কিন্তু বাইয়াত করতে রাজী হলেন না। তিনি এখানে তাকওয়ার ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিলেন।

এ পর্যন্ত ইমামের আন্দোলন এক অবৈধ দাবীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ। অন্যকথায় তিনি লা ইলাহা -এরই আনুকরণ করলেন এবং তাকওয়া রক্ষা করলেন।

কিন্তু ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের কেবল এই একটিই কারণ ছিল না। আরও কারণ রয়েছে যাদের মধ্যে আরেকটির প্রেক্ষাপটেও ইমামের ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু এবার এ প্রতিক্রিয়া হল ইতিবাচক।

মোয়াবিয়া দুনিয়া ত্যাগ করলো। এর 20 বছর আগে হযরত আলী (আ.) কুফায় পাঁচ বছর ধরে শাসন করেন। যদিও দীর্ঘ 20 বছর ধরে মোয়াবিয়া কুফা থেকে হযরত আলীর (আ.) ছাপ মুছে ফেলার জন্যে বহৃ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেছে। আমর রুশাইদ ও সেইছামের মত হযরত আলীর (আ.) বিশিষ্ট্য সাহাবীদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তারপরও মোয়াবিয়ার শূন্যতার অবকাশ নিয়ে কুফাবাসীরা আজ পুনরায় হযরত আলীর (আ.) নামে সমবেত হয়েছে। এ সুযোগে তারা ইমাম হোসাইনের (আ.) যোগ্যতা ও বরকতময় অস্তিত্ব থেকে উপকৃত হবার জন্যে উদ্যোগী হল। তারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমামকে চিঠি লিখল। তারা অন্তত কুফাতে একটি প্রকৃতত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলো। তারপর ক্রমে সব জায়গাকে পুনরায় ইসলামী শাসনের ছায়াতলে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।

ইমামের (আ.) জন্যে এ আবেদনটি হল তাদেরই পক্ষ থেকে, যারা তাদের ভাষায় জান-মাল দিয়ে ইমামকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাদের চিন্তাজগতে পুনরায় বসন্ত এসেছে। তারা প্রকৃত ইসলামী শাসনধারা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছে।

কুফা প্রথম থেকেই মুসলিম সৈন্যদের নিবাস ছিল। হযরত উমরের আমলে কুফা শহরের প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে বেশীর ভাগ সৈন্যই বসত গড়ে তোলে। এ কারণে এ সময় কুফা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী শহরে পরিণত হয়।

এই কুফা শহরের জনগণ ইমামকে (আ.) সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাওয়াত করছে। একজন নয়,দু জন নয়,পাঁচজন,শতজন কিংবা এক হাজার নয়,প্রায় 18 হাজার দাওয়াতী চিঠি ইমামের হাতে আসে। কোনো কোনো চিঠিতে 10 থেকে 100 জনের স্বাক্ষর ছিল। তাই সব মিলিয়ে দাওয়াতকারী লোকের সংখ্যা প্রায় লাখের কাছাকাছি দাঁড়ায়।

এখানে ইমামের করণীয় কি হওয়া উচিৎ? কুফাবাসীদের পক্ষ থেকে যা করার ছিল তারা করেছে। বাকী কাজ ইমামের হাতে। বাইয়াতের প্রসঙ্গে ইমাম শুধু একটি না বললেই তাকওয়া রক্ষা এবং দায়িত্ব শেষ হতো। তারপর ইবনে আব্বাসের প্রস্তাব অনুযায়ী যদি ইয়াযিদী বাহিনীর নাগালের বাইরে গিয়ে ইয়েমেনের এক পাহাড়ী অঞ্চলে বাস করতেন তাহলে তিনি বাইয়াত করার চাপ থেকেও রক্ষা পেতেন।

কিন্তু এবারে একদল প্রভাবশালী মুসলমান রীতিমত বিদ্রোহ করে ইমামকে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছে । এখানে অবশ্যই ইমামকে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে ইতিবাচক,যদিও ইমাম হোসাইন (আ.) প্রথম থেকেই কুফাবাসীদের চপলমতি,দুর্বলচিত্ত,অপ্রস্তুত ও ভীত মানসিকতা দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু তারপরও 18 হাজার চিঠিতে প্রায় এক লক্ষ লোকের আবেদন,তারা এখন ইমামের অপেক্ষায় আছে। এখানে ইমাম (আ.) যদি কুফাবাসীদের আবেদনকে অগ্রাহ্য করতেন তাহলে আজ আমরাই যারা হোসাইন-হোসাইন করি,বলতাম,ইমাম (আ.) কেন এত বড় একটা ভুল করলেন?

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য । আব্বাসীয় খেলাফতকালে আবু সালামাহ খাললাল (যাকে আলে মুহাম্মদের উজীর বলা হতো) খলীফার সাথে যখন তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো তখন ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ও আব্দুল্লাহ মাহয কে দুটো চিঠি লিখে বললো,‘‘ এতদিন আমি ও আবু মোসলেম এদের জন্যে কাজ করেছি,এখন চাই আপনার জন্যে কিছু করতে। সবকিছুই অনুকূল আছে। এখন এসে কেবল আমাদেরকে সহযোগিতা করুন,আমরা এদেরকে হটিয়ে দেব।’’ ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এতে সাড়া দেননি। এখানে তিনটি বিষয় লক্ষণীয় :

এক : আবু সালামাহ মাত্র একজন ছিল।

দুই : যেহেতু দু জনের কাছে একই চিঠি পাঠিয়েছিল সেহেতু বুঝা যায় যে,তার উদ্দেশ্য নিষ্ঠাপূর্ণ ছিল না।

তিন : সে এমন এক সময় এ পদক্ষেপ নিয়েছিল যে,খলীফা বুঝতে পেরেছিল একে দিয়ে আর কোনো ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। তাই কয়দিন যেতে না যেতেই খলীফা তাকে হত্যাও করেছিল।

ইমাম সাদেক (আ.) এসব দিকই ভালভাবেই অবগত ছিলেন। তাই আবু সালামাহর পত্রবাহকের সামনেই তিনি তার চিঠি পুড়িয়ে ফেললেন। পত্র বাহক বললোঃ চিঠির জবাব কি দেব?

ইমাম সাদেক (আ.) বললেন : এটিই হলো আবু সালামাহর চিঠির জবাব।

এই একজনের আবেদন অগ্রাহ্য করায় আজও বহু লোক ইমাম সাদিককে (আ.) দোষারোপ করে বলেন : কেন তিনি ইতিবাচক সাড়া দিলেন না?

আর যেখানে প্রায় লক্ষ লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত 18 হাজার চিঠি -তাও আবার ঐ চরম দুর্দিনে ইমাম হোসাইনের (আ.) হাতে পৌঁছায় তখন তিনি যদি সাড়া না দিতেন তাহলে অনন্তকালের ইতিহাস ইমামকে (আ.) দোষারোপ করে বলতো যে,যদি ইমাম তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে নেতৃত্ব দিতেন তাহলে ইয়াযিদ ও ইয়াযিদীরা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত।

কুফার শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে অতি সহজেই ইমাম বিজয়ী হতে পারতেন। ইতিহাস ইমামকে ভীতু বলেও দোষারোপ করতো। বলতে, ইমাম (আ.) প্রাণ হারাতে হয় কিনা সে ভয়ে ঐরকম একটা সুবর্ণ সুযোগকেও হারালেন (নাউযু বিল্লাহ)। তাই ইমাম হোসাইনের (আ.) মত মহা পুরুষের জন্যে এ মুহুর্তে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। এমন কি তিনি তাদের বিশ্বাসঘাতকতার মানসিকতা জেনেও অন্ততপক্ষে যতক্ষণ তারা বাহ্যিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি ততক্ষণ পর্যন্ত ইমামের (আ.) এটিই করণীয় ছিল। তারা প্রকাশ্যে বিশ্বাসঘাতকতা করার পর ইমামের (আ.)ও আর কোনো করণীয় থাকতো না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন,অনেকে ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনে বাইয়াত ও দাওয়াত প্রসঙ্গের মধ্যে এ গোজামিল দেয়ার প্রচেষ্টা করেন। ইমাম হোসাইন (আ.) আগেই বিদ্রোহের ঘোষণা দেন,নাকি কুফাবাসীরা আগে ইমামকে দাওয়াত করে। ইমাম কি সাহায্য ও সফলতার আশ্বাস পেয়ে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন? এ নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েন। বিশেষ করে যারা হোসাইনী বিপ্লবকে খাটো করে দেখাতে চায় তারা বলে,কুফাবাসীদের দাওয়াত ও আশ্বাস পেয়েই ইমাম বিদ্রোহ করেন।

অথচ আমরা ইতোমধ্যেই অনুধাবন করতে পেরেছি যে,ইমামের আন্দোলন আসলে মোয়াবিয়ার আমলেই শুরু হয়। আর কুফাবাসীদের দাওয়াত কেবল ইমামের আন্দোলনের চুড়ান্ত রূপটি কারবালায় স্থানান্তরে সহায়তা করেছিল। তা না হলে কুফাবাসীরা যদি দাওয়াত নাও করতো তবুও ইমামের আন্দোলন অব্যাহত থাকতো এবং অন্য কোনো স্থানে তা পরিণতি লাভ করতো। ইয়াযিদের প্রচন্ড চাপে ইমাম 60 হিজরীর 27শে রজব মদীনা থেকে মক্কার পথে বের হন। তখনও পর্যন্ত কুফাবাসীরা এসব ঘটনার বিন্দুমাত্র ও জানতো না। ইমাম 3রা শাবান মক্কায় এসে পৌঁছান। মক্কাতে তিনি এক মাসেরও বেশী সময় ধরে ইসলাম প্রচার করেন। এর মধ্যে কুফাবাসীরা ইমামের বিদ্রোহ এবং মক্কায় আগমনের কথা অবগত হয়। এরপর 15ই রমজান তারিখে কুফাবাসীদের প্রথম দাওয়াতী চিঠি মক্কাতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হাতে পৌঁছায়। সুতরাং এখানে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে,কুফাবাসীদের দাওয়াত ইমামের বিপ্লবে একটা সাধারণ উপাদান ছিল এবং তা ইমামের বিদ্রোহ ঘোষণার পরেই সংযোজিত হয়েছিল।

কিন্তু তৃতীয় কারণটিই ছিল ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের মূল স্লোগান। মদীনা থেকে রওয়ানা হবার দিন থেকেই তিনি এই স্লোগান ধ্বনিত করেন। এ সময় তিনি বাইয়াতের কোনো কথাই আনেননি। আর কুফাবাসীদের দাওয়াত প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা তো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কারণ সে ঘটনা ছিল দু মাস পরে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে,চারদিক ফ্যাসাদে ভরে গেছে,ইসলাম হুমকির সম্মুখীন,কোরআন হুমকির সম্মুখীন। তাই অন্য কোনো প্রসঙ্গ না আসলেও আমি কেবল শরিয়তী দায়িত্ব পালনার্থে এবং আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার করার জন্যেই অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে বিদ্রোহে নামতাম।

প্রথম কারণের প্রেক্ষাপটে ইমাম আত্মরক্ষা মূলক ভূমিকা নেন। দ্বিতীয় কারণের প্রেক্ষাপটে ইমাম সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু তৃতীয় কারণটির পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি হুকুমতের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছেন। তাদের অবৈধ কাজ কারবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এ হিসাবে ইমাম হোসাইন (আ.) একজন প্রতিবাদী,বিপ্লবী। তিনি সমাজে সংস্কার করতে চান।

এখান থেকেই প্রতীয়মান হয় যে,ইমাম আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার -কে কত বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ইসলামের এই ভিত্তির ওপর দাড়িয়েই স্বৈরাচারী শাসকের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেন।

কুফার পথে তিনি দু জন পথিককে কুফা থেকে আসতে দেখেন। তিনি তাদের সাথে আলাপ করতে চাইলেন,কিন্তু পথিকদ্বয় ইমাম হোসাইনকে (আ.) চিনতে পেরে নিজের পথে চলতে লাগলো। অতঃপর ইমামের একজন পিছনে পড়া সহযোগীর সাথে ঐ দুই পথিকের সাক্ষাত হয়। তারা ইমামের দূত মুসলিম ইবনে আকীল ও হানীর শাহাদাতের সংবাদ দিয়ে বললো : আমরা এ খবর ইমামের কাছে বলতে লজ্জাবোধ করছিলাম। তারপর ইমামের এই সঙ্গী কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে ইমামের (আ.) কাছে গেল এবং বললোঃ আমার কাছে একটা খবর আছে। যদি চান তো এখানেই বলি আর নইলে ব্যক্তিগতভাবেই বলবো। ইমাম বললেনঃ আমি কোনো সংবাদ আমার সঙ্গী-সাথীদের কাছে গোপন রাখতে চাই না। কি খবর এখানেই বলো। ঐ ব্যক্তি ঘটনা ইমামকে জানালো এবং বললো : গতকাল যে দু জনের সাথে আপনি আলাপ করতে চেয়েছিলেন তারা অন্য পথ দিয়ে চলে গিয়েছিল,তারাই আমাকে বললো যে,কুফার পতন ঘটেছে। মুসলিম ও হানীকে হত্যা করা হয়েছে। একথা শুনেই ইমাম কেঁদে ফেললেন। তারপর কোরআনের এই অমর বাণীটি উচ্চারণ করে বললেনঃ

) مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّـهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا(

‘‘ মুমিনদের মধ্যে যারা আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়েছিল তাদের একদল স্বীয় প্রতিজ্ঞা পালন করেছে। আর যারা এই প্রতিজ্ঞা পালন করেছে তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে এবং বাকীরা তাদের পালার অপেক্ষায় আছে।’’ ( আহযাবঃ 34 )

অর্থাৎ আমরা কেবল কুফার জন্যে আসিনি। কুফার পতন হয়েছে-তো কি হয়েছে? আমাদের দায়িত্ব অনেক উর্ধ্বে,অনেক মহান। মুসলিম ইবনে আকীল সফলতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে চলে গেছেন,তারা শাহাদাতের সুধা পান করেছেন। এখন আমাদের পালা।

ইমাম হোসাইনের (আ.) আক্রমণধর্মী ভূমিকার কারণে তার চিন্তাধারাও ছিল আক্রমণধর্মী । অথচ যে আত্মরক্ষা করতে চায় তার চিন্তা ভিন্ন প্রকৃতির হয়। যেমন ধরুন কারও একটি মূল্যবান জিনিস আছে। ডাকাত চায় এটাকে ছিনতাই করতে। তখন ঐ মালিকের ভূমিকা যদি আত্মরক্ষা মূলক হয় তাহলে ডাকাতের হাত থেকে জিনিসটাকে রক্ষা করা হবে তার লক্ষ্য । সে হয়তো একটু শক্তি প্রয়োগ করলেই ডাকাতকে হটাতে কিংবা আহত করে ফেলতে পারতো। কিন্তু সে এ বিষয়ে একবারও না ভেবে বরং জিনিসটা নিয়ে দৌড়ে পালাতে চায়। এটা হলো তার আত্মরক্ষার মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু একজন আক্রমণধর্মী ভূমিকায় অবতীর্ণ ব্যক্তি কেবল নিজেকে রক্ষাই করে না,প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদও করতে চায়। এ জন্যে যদি নিজের প্রাণও দিতে হয় তবু সে পিছপা হয় না। এটি হলো আক্রমণধর্মী মানসিকতা। আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার ইমামের চিন্তাধারাকে আক্রমণাত্মক করেছে। আর এই আক্রমণধর্মী মানসিকতা শহীদী মানসিকতায় পরিণত হয়েছে এবং শহীদী মানসিকতা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ।

শহীদী মানসিকতার অর্থ হলো,কোনো ব্যক্তি তার সমাজের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চায় এবং তার এ বক্তব্য নিজর রক্ত দিয়ে লিখে যেতে চায়। দুনিয়াতে অনেকেই অনেক কিছু বলতে চায়। মাটির বুক চিরে কত ফলকই বেরিয়ে এসেছে যাতে হয়তো কোনো বাদশা লিখে গেছেঃ আমি অমুক,অমুকের ছেলে,আমি অমুক দেশেকে জয় করেছি,এত বছর জীবন যাপন করেছি,আমার এতগুলো স্ত্রী ছিল,আমি এত জুলুম অত্যাচার করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের এসব কথা যাতে মুছে না যায় সেজন্যে পাথের খোদাই করে রাখে।

অথচ তা কেবল পাথরেই থেকে যায়। মানুষের হৃদয়ে তার কোনো স্থান নেই। এমন কি শত বছর হাজার বছর পর যখন ঐসব ফলক উদ্ধার করা হয় তখন তা কেবল যাদু ঘরের এক কোণে জায়গা পায়,সাধারণ মানুষের কাছে তার কোনো মূল্য নেই।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) যা বলতে চেয়েছিলেন তা কোনো পাথরে খোদাই করে লেখেননি,বরং বাতাসের কাছেই তিনি তার বক্তব্য পেশ করেন। কিন্তু যেহেতু এ বক্তব্য রক্ত মিশ্রিত ছিল এবং রক্তও ছিল টাটকা লাল-তাই তা মানুষের হৃদয়ে এসে জায়গা করে নিয়েছে। এ কারণে আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ সমস্বরে বলে ওঠেঃ

 انی لا اری الموت الا سعادة و الحیاة مع الظالمین

‘‘ যে জালেমদের সাথে বেঁচে থাকতে চায়,যে অপমানের জীবন যাপন করতে চায়,যে জীবনকে শুধু দু মুঠো খাবারের যোগান দিতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকে,তাদের এই জীবনের চেয়ে মৃত্যু হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ।’’ এ হলো শহীদের বাণী।

ইমাম হোসাইন (আ.) যেদিন কারবালার ময়দানে এই বাণী রেখে যেতে চেয়েছিলেন সেদিন কারবালার একমাত্র শুস্ক গরম বাতাস ছাড়া কোনো কাগজও ছিল না,কলমও ছিল না। কিন্তু কেন তার বাণী জীবন্ত ? কারণ অনিতিবিলম্বে তা মানুষের হৃদয়ে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এ বাণী হৃদয়ের কাগজে এমনভাবে লিখিত হয় যা হয়ে ওঠে চিরঅবিনাশী।

প্রতি বছর মুহররম আসে আর ইমাম হোসাইন (আ.) যেন নতুন করে জীবিত হন। তিনি পুনরায় বলে ওঠেনঃ মহান আল্লাহ আদমের (আ.) সন্তানদের ওপর মৃত্যুর দাগ এঁকে দিয়েছেন-যা তাদের জন্য সৌন্দর্য,যেমন যুবতীদের গলায় হারের দাগ (সৌন্দর্য)। আমি আমার পূর্ব পুরুষদের দেখার জন্যে অতি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি যেমন ইউসুফকে দেখার জন্যে ইয়াকুব উদগ্রীব ছিলেন।’’

শেষ মুহুর্তে যখন ইমামের সঙ্গীরা সবাই শহীদ হয়ে গেছেন,আর ওদিকে 30 হাজার তীর-তলোয়ার সজ্জিত শত্রু ঢেউয়ের মতো উথাল-পাতাল করছে তখনও ইমাম হোসাইন (আ.) বলেনঃ তোমাদের আমীর ঐ উবাইদুল্লাহ খবর পাঠিয়েছে যে,হোসাইনকে হয় তলোয়ার ধরতে হবে না হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে-এ দুটোর একটিকে বেছে নিতে হবে। হোসাইন কোথায়,আর এ নতি স্বীকার কোথায়?

هیهات مناّ الذلّة

আল্লাহ আমার নত হওয়াকে পছন্দ করেন না। আমার রাসূল (সা.) আমার নত হওয়া পছন্দ করেন না। অনাগত কালের মুমিনরা চায় না যে,তাদের হোসাইন (আ.) অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করুক।

আর আমি হোসাইন নতি স্বীকার করবো? আমি শেরে খোদা আলীর (আ.) কোলে বড় হয়েছি,আমি রাসূলের (সা.) কন্যা ফাতেমার বুকের দুধ খেয়েছি। আমি নতি স্বীকার করবো?

এই শহীদী চিন্তাধারা এবং বহুমাত্রিক বিপ্লবের মানসিকতা থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন কি করে দেখিয়েছেন যা অন্য কোনো দৃষ্টিকোণ বা চিন্তাধারা থেকে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। কেননা যদি ইমাম (আ.) কেবল আত্মরক্ষার মানসিকতায় থাকতেন তাহলে আশুরার রাতে সঙ্গী সাথীদেরকে সব বুঝিয়ে তাদেরকে চলে যাবার অনুমতি দেয়ার পর তারা যখন কেউই যেতে রাজী হল না,তখন ইমামের বলা উচিত ছিল : তোমরা আমার সাথে থাকতে পারবে না,ওরা শুধু আমাকে চায়,আমি মাথা দেব কিন্তু ওদের হাতে হাত দেব না। এটা কেবল আমারই দায়িত্ব । তোমরা চলে যাও। এখানে থাকলে তোমাদেরও জীবনপাত ঘটবে। জীবন বাচানো ফরয। সুতরাং ধর্মমতে আমার সাথে থাকা তোমাদের জন্যে হারাম হবে।

না,এটা হতে পারে না। কারণ যে বিপ্লবী আক্রমণধর্মী ভূমিকায় নেমেছেন এবং তার বিপ্লবের বাণীকে টাটকা-তাজা রক্ত দিয়ে চির অমর করে লিখে যেতে চান তার জন্যে এ বিপ্লবের পিরিধ যতই উচ্ছল ও বিস্তৃত হবে ততই ভালো। আর এ জন্যেই দেখি যখন স্বাধীনভাবে ও সজ্ঞানে ইমামের (আ.) সঙ্গীরা নিজেদের প্রস্তুতি ঘোষণা করেন তখন ইমাম (আ.) হাত তুলে আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে দোয়া করেন। আশুরার রাতে ইমাম (আ.) কেন হাবিব ইবনে মাযাহিরকে বলে পাঠালেন : দেখ,বনি আসাদের মধ্য থেকে কাউকে সত্য ও ঈমানের পথে আনতে পার কিনা? বনি আসাদীরা কতজনইবা ছিল? ধরুন,হুর গিয়ে একশ জনকে বুঝিয়ে আনলো,তবু এই একশ জন ঐ ত্রিশ হাজার বাহিনীর বিরুদ্ধে কি করতে পারতো? তারা কি পরিস্থিতি বদলে দিতে পারতো?-কখনোই না। তাহলে ইমাম কেন হুরকে এ কাজে পাঠালেন?

এখান থেকে বুঝা যায় যে,ইমামের (আ.) আক্রমণধর্মী শহীদী ও বিপ্লবী চিন্তাধারা এ বিপ্লবকে যথাসম্ভব বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। আর এ কারণেই তিনি স্বীয় পরিবার-পরিজন ও আত্মিয় স্বজনকে সাথে করে নেন। তিনি জানতেন যে,তার এ বিপ্লবের বাণীর কথা তারাই মানুষের কানে পৗঁছে দেবে। তাই,তিনি বিপ্লবই যখন করলেন তখন এমন এক বীজ বপন করে যেতে চাইলেন যা চিরকাল ধরে ফল প্রদান করবে,যা চিরকাল মুক্তি কামী সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে আদর্শ হয়ে জ্বলবে। কারবালার ময়দানে অনেক হৃদয় বিদারক ও বিস্ময়কর দৃশ্যাবলীর অবতারণা হয়। এগুলোই হোসাইনী আদর্শে চিরন্তন ও অমর আত্মা ফুকে দিয়েছে।

সবশেষে আরও একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই আলাচিত হয়েছে‘‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’’ -ইসলামের এই ভিত্তিই ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনকে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন করেছে। পক্ষান্তরে ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনও আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারকে অধিক গুরুত্ববহ ও উন্নীত করেছে। ব্যাপারটি স্বর্ণালংকার ও সুন্দরী নারীর মতোই। সোনার অলংকার নারীদের সৌন্দর্য বাড়ায়। কিন্তু কোনো কোনো সুন্দরী নারী আছে যারা খোদ স্বর্ণালংকারকেই সৌন্দর্য দান করে।

আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার সম মুসলমানের গর্বের বিষয়। পবিত্র কোরআন বলছে‘‘ তোমরাই মানবতার জন্যে সর্বশেষ্ঠ উম্মত। কেননা তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর এবং অসৎ কাজে বাধা দাও।’’

) كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

লক্ষ করুন,কোরআন মুসলমানদেরকে শেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে কি ধরনের বাণী দিয়ে,এসব বাণী থেকে সত্যিই মানুষ আশ্চার্যান্বিত হয়? বলছেঃ

) خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ(

তোমরাই মানবতার জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। কিন্তু কি জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ?

) تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

কেননা তোমরা সৎ কাজের আদেশ করো এবং অসৎ কাজে বাধা দাও। এই আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনীল মুনকার ই আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ ও ধন্য করেছে। তাই বুঝতে হবে,যে সমাজে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার নেই সে সমাজ নামে মুসলমান হলেও শ্রেষ্ঠ উম্মত নয়।

কখনো কখনো একটা খুঁটিনাটি বিষয়কে নিয়ে আমরা আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারকে ই প্রকৃত অর্থে উপহাস করি। কেউ যদি বলে,ভাই,সোনার অলংকার পুরুষদের জন্যে ব্যাবহার করা ঠিক নয়। আপনি ওটা খুলে ফেলুন। এটা তাও মানায়,কিন্তু কখনো কখনো কেবল দাড়ি রাখে না কেন এ নিয়ে রক্তারক্তি করে। এ ধরনের আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার সত্যিই দুঃখজনক।