ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) 0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 13319
ডাউনলোড: 3373

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13319 / ডাউনলোড: 3373
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (১ম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

কারবালা ঘটনার দুই পিঠ

দেশও জাতির সেবায় যারা বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নামকে‘‘ বীর পুরুষ’’ হিসাবে অংকিত করে গেছেন,তারা নিজ দেশও জাতির কাছে শ্রদ্ধার পাত্র । এ ধরনের ব্যক্তিদের খ্যাতি এক নির্দিষ্ট গোত্র বা নির্দিষ্ট দেশের মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ । তাদের অবদানও যেমন নির্দিষ্ট জেনগোষ্ঠির মাঝে,তেমনি ঐ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিই তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। আবার বিশ্ব মঞ্চে যখন কোনো সম্মান লাভের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় তখন প্রত্যেকটি লোক চায় তার দেশের জন্যে সম্মান বয়ে আনতে। অপরদিকে তার দেশবাসীও একমাত্র তারই বিজয় কামনা করে। এই যে বীরত্বের আকাঙ্ক্ষা,এই যে নিজের দেশ বা জাতির জন্যে কিছু করা-এটা প্রত্যেক মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি । কিন্তু এসবই এক নির্দিষ্ট ভুখণ্ড এবং এক নির্দিষ্ট জনসমষ্টির মাঝে সীমাবদ্ধ ।

কখনো কখনো মানুষ দেশও জাতির সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বকে কিছু দিতে চায়। তখন সে শুধু নিজের দেশ কিংবা নিজের জাতিকে নয়,সমগ্র বিশ্বমানবতাকে সেবা করতে অসীম বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে যায়। এ ধরনের ব্যাক্তিত্বকে কেবল তার নিজের জাতিই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে না,বিশ্বের সকল মানুষই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। মানবতা তাকে নিয়ে গর্ব করে। অবশ্য এ ধরনের ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে কমই খুজে পাওয়া যায়। ক জনই বা এ কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছে?

এই ভুমিকাটুকু সেরে নিয়ে আমরা এখন ইমাম হোসাইনের (আ.) ব্যাক্তিত্ব ও হোসাইনী আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করে দেখবো। ইমাম হোসাইনের (আ.) স্মরণে আমরা পতি বছর অজস্র অর্থ ও বহু সময় ব্যয় করি,অফিস আদালত বন্ধ ঘোষণা করি। তিনি কি কোনো বীরত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ছিলেন নাকি ট্রাজেডি পূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ? তিনি কি কোনো নির্দিষ্ট ভুখণ্ড ও জেনগোষ্ঠির,নাকি সমগ্র বিশ্ব ও বিশ্বমানবতার? বিশ্বমানবতা কি ইমাম হোসাইনকে (আ.) নিয়ে গর্ববোধ করে? সর্বোপরি বিশ্বমানবতা কিন্তু ইমাম হোসাইনকে (আ.) স্মরণ করে বীরত্ব অনুভব করে?

ইমাম হোসাইনের (আ.) ব্যাক্তিত্ব ও হোসাইনী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ-সব প্রশ্নের জবাবই ইতিবাচক। ইমাম হোসাইন (আ.) একজন বীরপুরুষ ছিলেন। কিন্তু তা রূপকথার বীর রুস্তমের মতো নয়। ইমাম হোসাইনের (আ.) কথা,কাজ ঘটনাপ্রবাহ,তার বিপ্লবী সত্তা সব কিছুই মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়। মানুষের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে। এ-সব কিছুই মানুষের জন্যে শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়। কিন্তু এগুলোর কোনটাই নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা গোত্র বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রাচ্য -পাশ্চাত্য,আরব-অনারব নির্বিশেষে সমগ্র মানবতার জন্যে ইমাম হোসাইন (আ.) বীরত্ব ও গৌরবের।

আসলে ইমাম হোসাইনের (আ.) অস্তিত্বে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে না। আর এই ব্যাপকতার কারণেই বিশ্ব আজও ইমাম হোসাইনকে (আ.) পুরোপুরি চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু তার বীরত্ব সাধারণের অনেক উর্ধ্বে ছিল তাই স্বল্প সংখ্যক লোকই তা অনুধাবন করতে পারে।

ইমাম হোসাইনের (আ.) মতো দেশও জাতির উর্ধ্বে একজন মহাবীর দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া যাবে না। ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন মানবতার বিজয় সংগীত। এ জন্যেই তিনি নজীরিবহীন,বিরল ব্যাক্তিত্ব একথা সাহসের সাথে বলা যায়। অদম্য শক্তি ও অসীম উদ্যমের কথাই হোক আর মহত্ব ও মানবতার কথাই আসুক-ইমাম হোসাইনের (আ.) মতো এরূপ আর দ্বিতীয় কেউ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় যে আমরা তা চিনতে পারিনি।

প্রকৃতপক্ষে আশুরার ঘটনার দুটো পিঠ রয়েছে। এর এক পিঠ উজ্বল ও জ্যোতির্ময় এবং অন্য পিঠ কালো অন্ধকারে ভরা। এ উভয় পিঠই হয় দুর্লভ না হয় একবারেই বিরল। এ ঘটনার অন্ধকার পিঠ এ কারণেই বলা হয় যে,এ পিঠে কেবল জুলুম,অত্যাচার,অমানুষিকতা ও নির্মমতা ছিল,পৃথিবীতে যার জুড়ি মেলা ভার।

হিসাব করলে দেখা যায় যে,ঐ ইয়াযিদী অপকর্মে প্রায় 21 ধরনের নিষ্ঠুরতা ও জঘন্যতা ছিল। দুনিয়াতে এমন আর কোনো ঘটনা আছে বলে মনে হয় না যাতে এত ধরনের জঘন্যতার সমাবেশ থাকতে পারে। ইতিহাস ক্রুসেডেরর পাশবিকতা,আন্দালুসিয়ার নির্মমতার মতো ঘটনাবলীকেও নিজের বুকে খোদাই করে রেখেছে। এসব ক্ষেত্রে ইউেরোপীয়দের অমানুষিক নিষ্ঠুরতা প্রত্যেকটি মানুষকেই হতবাক করে দেয়। মরহুম আয়াতীর ইতিহাসে‘‘ আন্দালুসিয়া নামক বইটি একটি বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ যা খুবই শিক্ষণীয়। এ বইতে আছে-ইউরোপীয়রা আন্দালুসিয়ার লক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলে। হয়তো এটি তাদের এক যড়যন্ত্র ছিল কিংবা হয়তো তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে তারা অনুতপ্ত হয়েছিল। তাই আন্দালুসিয়ার লক্ষাধিক মুসলমান যখন দেশ ছেড়ে রওনা হলো তখন ইউরোপীয়রা এদের সবাইকে জবাই করে হত্যা করলো। অবশ্য প্রাচ্যের কোনো অপরাধই পাশ্চাত্যের অপরাধকে ছাড়িয়ে যায়নি। যদি প্রাচ্যের ইতিহাসকে তন্ন তন্ন করে খোজা হয় তাহলে পাশ্চাত্যের অপরাধকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন কোনো অপরাধের সন্ধান মিলবে না। এমন কি উমাইয়া শাসকবর্গ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে নিজেদের হাতকে কলূষিত করলেও অন্তত এ দুটো অপরাধ তারা করেনি। তার মধ্যে একটা হলো জীবন্ত পুড়িয়ে মারা এবং অপরটি পাইকারীভাবে নারী ও শিশু হত্যা। কিন্তু ইউরোপীয়রা এ দুটো অপরাধ করতেও দ্বিধা বোধ করেনি। নির্বিচারে নারী হত্যা করা ইউরোপে এক অতি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। আজও এরা যে মানবাত্মার অধিকারী এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। ভিয়েতনামে যে পাশবিকতা চালানো হয় তা ইউরোপীয়দের ক্রসেড ও আন্দালুসিয়ার মানসিকতারই আর একটি স্বরূপ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে আগুনের কুপে পুড়িয়ে মারা (তাদের কোনো দোষ থাকলেও) একমাত্র বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমাদের পক্ষেই সম্ভব। পাচ্যের কোনো মানুষের পক্ষে এ ধরনের কাজ একবারে অসম্ভব।

খাদ্য ও পানীয় দেবার ভয়ে সিনা মরুভূমিতে হাজার হাজার সেনাকে অনাহারে মেরে ফেলার ঘটনা একমাত্র পশ্চিমাদের দ্বারাই সম্ভব। প্রাচ্যবাসীরা এ ধরনের অপরাধ কখনোই করতে পারে না। ফিলিস্তিনী ইহুদীরা পশ্চিমা ইহুদীদের চেয়ে শত গুণে ভাল। যদি ফিলিস্তিনের ইহুদীরা মূল ফিলিস্তিনী হতো তাহলে কোনো রকম-সংঘাতই থাকতো না। আজকে ফিলিস্তিনে যে পাশবিকতা চলেছ তা ঐ পশ্চিমা ইহুদীদের হাতেই ঘটছে।

এ কারণে জোর করে বলা যায় না যে,কারবালার নিষ্ঠুরতার মতো দ্বিতীয় আর নেই। তবে প্রাচ্যের ইতিহাসে যে এ ধরনের ঘটনা বিরল একথা সাহসের সাথে বলা যায়।

এ দৃষ্টি কোণ থেকে বিচার করলে কারবালার ঘটনা একটি ঘটনা। ট্রাজেডি পূর্ণ হৃদয় বিদারক ঘটনা।

ঘটনার এ পিঠে আমরা নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা,যুবক হত্যা,দুগ্ধ পোষ্য শিশু-হত্যা,লাশের ওপর ঘোড়া চালানো,তৃষ্ণার্তকে পানি বঞ্চিত করা,নারী ও শিশুকে চাবুক মারা,বন্দীকে খালি উটের পিঠে চড়ানো ইত্যাদি নির্দয়তা দেখতে পাই। এখানে ঘটনার বীর নায়ক কে? এটি সর্বজন নিবেদিত যে,জুলুম অত্যাচারের দিক থেকে বিচার করলে যে অত্যাচারিত হয় সে তো বীর নয়,বরং সে মজলুম অসহায়। এ দৃষ্টিতে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়াই হলো ঘটনার বিজয়ী বীর। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ,শিমার,এরাই হলো ঘটনার নায়ক। তাই কারবালার ঘটনার এ পিঠে কেবল মানবতার মুখে কালিমার ছাপ ছাড়া অন্য কিছুই আমাদের দৃষ্টি গোচর হয় না। এ পিঠে তাকালে শান্তি কামী মানুষ মাত্রই শোকে মুর্ছা যায়।

প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইনের (আ.) আশুরার কি এই একটিই রূপ? এর কি আরেকটি দিক নেই?

হোসাইন (আ.) মানে কি কেবলই শোক,আফসোস আর দুর্দশা ?

আমাদের ভূল এখানেই। এ ঘটনার আরেকটি পিঠ আছে যেখানে ইয়াযিদ আর বিজয়ী নয়;ইবনে যিয়াদ,শিমার,ইবনে সা দ সেখানে আর নায়ক নয়।

ওপিঠের নায়ক হলেন হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)। ওপিঠে আর কোন নিষ্ঠুরতা-পাশবিকতা নেই,বরং সেখানে কেবল বীরত্ব,গৌরব আর আলোর ছাড়াছড়ি। মনুষ্যত্ব,মানবতা,সত্য ও ন্যায়ের উজ্জ্বল আলোকে কারবালা ঘটনার সে পিঠ উদ্ভাসিত। সে পিঠে তাকালে বলতে হয় যে,সত্যিই মানবতা গর্ব করার অধিকার রাখে। কিন্তু অন্ধকার পিঠে তাকালে মানবতাকে পাশবিকতার হাতে পরাভূত হতে দেখা যায়। তখন কোরআনের এই আয়াতের বাস্তবতা খুজে পাওয়া যায়-আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন ফেরেশতারা অভিযোগ করে বলে উঠলোঃ

) قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ(

‘‘ আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতি ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।’’ ( সূরা বাকারাঃ 30 )

উত্তরে মহান আল্লাহ বলেছিলেনঃ‘‘ আমি এমন কিছু জানি যা তোমরা জান না।’’

আসলে কারবালার ঐ পিঠ এমন যা দেখে ফেরশতারাও আল্লাহর কাছে আপত্তি তোলে,ঐ পিঠে মানুষ কলূষিত-মানবতা অপমানিত। কিন্তু ঘটনাটির এ পিঠ উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময়। এ পিঠ দেখে মানবতা গর্ববোধ করে। আমরা কেন সব সময় কারবালা ঘটনার কলুষময় পিঠের দিকে তাকাবো? কেন সব সময় ইমাম হোসাইনের (আ.) নিদারুণ অসহায়তার দিককেই স্মরণ করবো? আর কেনই-বা ইমাম হোসাইনের (আ.) বীরত্বকে উপেক্ষা করে তার অসহায়ত্বকে বড় করে তুলবো?

কারবালার ঘটনার উজ্জ্বল দিকটি এর কলুষময় দিকের চেয়ে শত-সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। তাই আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে এ ঘটনার শুধু এক দিকের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আমরা ইমাম হোসাইনের (আ.) মজলুমতাকে আরও বাড়িয়েছি। আজকে যারা ইমাম হোসাইনের (আ.) মহান লক্ষ্যকে ভালভাবে উপস্থাপন করে,তারাও সেদিনের ইয়াযিদের মতো ইমাম হোসাইনের (আ.) ওপর জুলুম করে।

একিদন ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করা হয়,তার শিরচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু হোসাইন (আ.) তো কেবল ঐ দেহ কিংবা ঐ মাথা-ই নন,তিনি তো আপনার-আমার মতো নন যে,দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হলেই সব শেষ হয়ে যাবে।

হোসাইন (আ.) একটি আদর্শের নাম যিনি মৃত্যুর পরে আরও বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠেন। বনি উমাইয়ারা ইমাম হোসাইন (আ.) কে হত্যা করে ভেবেছিল সবকিছু চুকে গেল। কিন্তু শীঘ্রই বুঝলো যে,জীবিত হোসাইনের (আ.) চেয়ে মৃত হোসাইন (আ.) তাদের পথে বেশী অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। অনুভূতিসম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় ইমাম হোসাইন (আ.) বেঁচে রইলেন এবং তাদেরকে সৎ কাজে উদ্যমী ও অসৎ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার চিরন্তন অনুপ্রেরণা যোগালেন। হযরত জয়নাবও (আ.) ইয়াজিদকে একথা স্পষ্ট করে বলে দেন। তিনি বলেন,তোমরা ভুল করলে।

کد کیدک و اسع سعیک، ناصب جهدک فواالله لا تمحوا ذکرنا و لا تمیت و حینا

তোমার যে মতলব বা ফন্দী আছে তা সবই করে যাও,তবে জেনে রেখো যে,আমার ভাইকে তোমরা কখনো মারতে পারবে না। আমার ভাইয়ের জীবন অন্য ধরনের। সে মরেনি,বরং আরও জীবন্ত হয়েছে। সে জীবনের নতুন মাত্রা পেয়েছে।( বিহারুল আনওয়ার 45 / 135 ; লুহুফ - 77 )

হযরত জয়নাবের (আ.) একথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। স্বৈরাচারী শাসকমহল দেখলো যে,একজন ইমাম হোসাইনের (আ.) রওজা থেকে এখন হাজার হাজার হোসাইন জন্ম নিচ্ছে । বিপদ বুঝতে পেরে এবার তারা ইমাম হোসাইনের কবরকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যোগী হল। তারা কবরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে পানির স্লোত চালিয়ে দিল যাতে কেউ তা আর খুজে না পায়। কিন্তু তারা কি সত্যকে ঢেকে রাখতে পারলো ? বরঞ্চ তা মানুষকে বেশি বেশি আকর্ষণ করতে লাগলো।

ইমাম হোসাইন (আ.) মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যদি তার মজলুম অবস্থাকে স্মরণ করার সময় তার মহান লক্ষ্য ও বীরত্বের কথাকে ভুলে যাই তাহলে এটি ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতি এক ধরনের জুলুম করা হবে। তাই,ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদত দিবসে শোক পালনের পাশাপাশি তার অসীম বীরত্বকেও একবার স্মরণ করা উচিত যাতে আমরাও তার পথে চলতে পারি। আমরা মিথ্যা প্রলোভনের তোয়াক্কা না করে সত্যকে নিয়েই বাচতে পারি,সত্যকে নিয়েই মরতে পারি। আমরাও যেন কোন প্রকার অন্যায় ও অত্যাচারের সাথে আপোস না করে প্রাণ দিয়ে হলেও অত্যাচারীকে উৎখাত করতে পারি। আমরাও যেন মনুষ্যত্বের মর্যাদা,মানবিক মূল্যবোধ,সততা,সাহস,দয়া,মায়া,ইজ্জত ইত্যাদি গুণগুলোর প্রতি যথার্থ মর্যাদা দিতে পারি এবং এগুলো দিয়ে আমাদের আত্মাকে পরিপূর্ণ সত্তায় রুপান্তরিত করতে পারি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কারবালা-ঘটনার উজ্জ্বল পিঠটির দিকে তাকাবো ততক্ষণ আমরা এগুলো উদঘাটন করতে পারবো না।

জনৈক লেখক ইমাম হোসাইন (আ.) ও হযরত ঈসা মসীহর মধ্যে তুলনা দিয়ে লেখেন,‘‘ মুসলমানদের কার্যকলাপের চেয়ে খ্রীষ্টানদের কার্যকলাপ অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কেননা খ্রীষ্টানরা ঈসা মসীহর শাহাদাতের দিনে আনন্দ উৎসব পালন করে,অথচ মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের দিনে শোক মিছিল ও কান্নাকাটি করে থাকে। খ্রীষ্টানরা ঈসা মসীহর শাহাদাতকে বিজয় মনে করে-পরাজয় নয়। তাই তারা বিজয় উৎসব পালন করে। কিন্তু মুসলমানরা শাহাদাতকে পরাজয় মনে করে,তাই ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাত দিবসে ব্যর্থতা ও পরাজয়ের শোকে কান্নাকাটি করে ও মার্সিয়া পড়ে। ধন্য হোক সেই জাতি যাদের কাছে শাহাদাত বিজয় খ্যাতি লাভ করেছে আর কত নীচু সেই জাতি যাদের কাছে শাহাদাত পরাজয় ও ব্যর্থতা বলে বিবেচিত।’’

এ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয়ঃ

প্রথমত খ্রীষ্টানরা ঈসা মসীহ নিহত হয়েছেন-এই ভুল বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই তার মৃত্যুর দিনে আনন্দ উৎসব পালন করে। তারা মনে করে হযরত ঈসা (আ.) নিহত হয়েছেন তাদের পাপের বোঝা নিজের কাধে তুলে নেয়ার জন্যে । আর যেহেতু হযরত ঈসা (আ.) তাদের সমস্ত পাপের জামিন হয়ে তাদের মাথার বোঝা খালি করে দিয়েছেন-(এখন থেকে তারা যত ইচ্ছা পাপ করবে কোনো ভয় নেই,হযরত ঈসা তাদেরকে বাচাবে) এই কু-ধারণাবশতই খ্রীষ্টানরা হযরত ঈসার প্রতি খুশি হয়ে তার মৃত্যু দিবসে আনন্দ উৎসব করে। অথচ তাদের এ ধারণা অবশ্যই একটা ভ্রষ্ট ও বিচ্যুত ধারণা।

দ্বিতীয়ত এটি ইসলাম ধর্ম এবং‘‘ মানুষের হাতে বিকৃত’’ খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে একটি পার্থক্যের বহিঃপ্রকাশও বটে। ইসলাম এক সামাজিক ধর্ম,অথচ বর্তমানে বিভ্রান্ত খ্রীষ্ট ধর্ম মাত্র কয়েকটি নৈতিক উপদেশ। এর বেশি কিছু নয়।

তাছাড়া কোনো ঘটনাকে এক সময় ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়,আবার কখনও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করা যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আ.) ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই বিজয়ী ও সফল হয়েছিলেন। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) নিজেও সেই প্রথমদিনই নিজের সফলতা ঘোষণা করে বলেনঃ

‘‘ মহান আল্লাহ আদমের (আ.) সন্তানদের ওপর মৃত্যুর দাগ একে দিয়েছেন যা তাদের জন্য সৌন্দর্য,যেমন যুবতীদের গলায় হারের দাগ।’’ ( দ্রঃ বিহারুল আনওয়ার 44 / 366 আল - লুহুফঃ 25 , মাকতালুল হোসাইনঃ খারাযমীঃ 2 / 5 কাশফুল গোম্মাহঃ 2 / 29 )

خط الموت علی ولد آدم مخط القادة علی جید الفتاة، و ما اولهنی الی اسلافی اشتیاق یعقوب الی یوسف

মানুষের দৃষ্টিতে এবং স্বয়ং শহীদের দৃষ্টিতেও শাহাদাত এক বিজয়। একথা খ্রীষ্টানদের বলে দিতে হবে না। ইসলামের নেতারা আজ থেকে 1400 বছর আগেই তা ঘোষণা করে গেছেন। তবে এ হলো ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ। ইসলামের আরও এক দৃষ্টিকোণ রয়েছে। ইসলাম কোনো ঘটনাকে কেবল ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করে না,বরং সামাজিক ও সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করে দেখে। সামাজিক ও সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে যারা কারবালা ঘটনায় অপরাধী,তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে এক জাতির অধঃপতনের কথাই ধরিয়ে দেয়। এজন্যে সব সময় এ স্মৃতিকে স্মরণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়। আজ মুসলমানরা যে শোকানুষ্ঠান করে তা তাদের অতীতের মুর্খতা ও ভুলের থেকে উৎসারিত আফসোস বৈ কিছুই নয়। মুসলমানরা বলতে চায়,হায়! তারা এমন নৃশংসতা করেছে? যারা একাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিক।

দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে মুসলমানদের ইসলামী তথা মানিবক অনুভূতি ও মূল্যবোধকে কোমলতর ও প্রগতিশীল করা যায়। আমরা আমাদের ধর্ধীয় চেতনাবোধেকে সব সময় জাগ্রত রাখতে পারি। এমন কি আমাদের ব্যক্তিগত কর্মজীবনেও সত্য ও সঠিক পথ ধরে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা লাভ করি। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে সাহস পাই। নিজেদের ভুল-ত্রুটি শুধরে নেবার সুযোগ পাই।

তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে,কারবালা ঘটনার দু টি পিঠ রয়েছে। এক পিঠে জুলুম,অত্যাচার,মানবতার অবমাননা যা দেখে ফেরেশতাকুল আল্লাহর কাছে আপত্তি তোলে। কিন্তু আরেকটি পিঠ আছে যেখানে আছে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব,সৎ সাহস,একত্ববাদ,দৃঢ় ঈমান,ত্যাগের শিক্ষা,ধৈর্য,সহিষ্ণু,আরও একাধিক শংসনীয় গুণের সমারোহ। ওদিক থেকে দেখলে হযরত ইমাম হোসাইনই বীরশ্যেষ্ঠ,শহীদ শ্যেষ্ঠ । তিনি একটি‘‘ হোসাইনী আদর্শ’’ মানুষের সামনে রেখে গেছেন যে আদর্শে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যে শিক্ষা রয়েছে। যে পিঠ দেখে আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বলেন-তোমরা সবকিছু জান না। তোমরা কেবল মানুষের অধঃপতনের দিক দেখতে পাচ্ছ । কিন্তু আমি যা জানি তা তোমরা জান না। আমি জানি মানুষ সত্য ও ঈমানের জন্যে কত বড় আত্মত্যাগ করতে পারে। নিজের জান-মাল সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে সত্যকে রক্ষা করতে পারে। এখানে এসে মানুষ আত্মত্যাগী,মহাবীর। এখানেই তারা আমার উপযুক্ত প্রতিনিধি। আর আমাদের উচিত ইমাম হোসাইনের (আ.) ওপর ইয়াযিদীদের অবর্ণনীয়-অত্যাচারের পাশাপাশি হযরত ইমাম হোসাইনের ঈমান,বীরত্ব,সৎ সাহস,ত্যাগ,সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়গুলোও স্মরণ করা। ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্যে চোখের অশ্রু এজন্যে ঝরাবো যাতে আমরাও তার মতো ঈমানদার ও সত্যের অনুসারী হতে পারি। আমরাও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই নিজেদের জান-মাল সবকিছুকে উৎসর্গ করে দিতে পারি। আমাদের কান্না শুনে হযরত ফাতেমার (আ.) সন্তান হারানোর শোক কমে যাবে-এ ধরনের বিশ্বাস নিয়ে কেউ যদি শুধু আশুরার দিনে দু মিনিট কেদে পার করে দেয় তাহলে অবশ্যই ভুল করবে। কেননা ইমাম হোসাইন (আ.),হযরত ফাতেমা (আ.),মহানবী (আ.) আমাদের এই পাপিষ্ট চোখের দু ফোটা পানির প্রতি কোনো মুখাপেক্ষী নন। তারা এসবের অনেক উর্ধ্বে ছিলেন। তাদের দায়িত্ব সফলতার সাথে এবং যথার্থভাবে পালন করে চলে গেছেন। এখন আমাদের পালা। হোসাইনী আদর্শ থেকে আমরা নিজেরাই উপকৃত হবো। আমাদের ঈমানেক দৃঢ় করবো। তাহলেই মহানবী (সা.) ও ইমাম হোসাইনের (আ.) উদ্দেশ্যও যথাযথ বাস্তবায়িত হবে। কেবল তখনই আমরা ইমাম হোসাইনের (আ.) শহীদী রক্তের উপযুক্ত মূল্য দিতে সক্ষম হবো।