ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 10750
ডাউনলোড: 3526

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 12 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 10750 / ডাউনলোড: 3526
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হোসাইনী আন্দোলন মুসলিম সমাজের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আন্দোলন

সব মুসলমানই বিশ্বাস করে যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) স্বীয় প্রাণকে কোরবানি করে ইসলামের প্রণকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তার বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামের চারাগাছকে পুষ্ট ও সজীব করে তুলেছেন। আমরা এ সত্য বিশ্বাস করি বলেই ইমাম হোসাইনের (আঃ) যিয়ারত পড়ার সময় আমরা বলিঃ

اَشْهَدُ اَنَّكَ قَدْ اَقَمْتَ الصَّلَاةَ وَآتَيْتَ الزَّکاةَ وَ اَمَرْتَ بِالْمَعْرُوفِ وَ نَهَيْتَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ جَاهَدْتَ فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আপনি নামায কায়েম করেছেন,যাকাত প্রদান করেছেন,সৎকাজের আদেশ দিয়েছেন,অসৎকাজে বাধা দিয়েছেন এবং সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন। (মাফাতিহুল জিনান)

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে ইমাম হোসাইনের (আঃ) প্রাণ হারানোর সাথে ইসলামের প্রাণ ফিরে পাবার মধ্যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? কেননা রক্তপাত ঘটলেই যে ইসলাম শক্তি লাভ করবে-এমনতো কোনো কথা নেই। ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাত ও ইসলামের পুনরুজ্জীবনের মধ্যকার যে নিগুঢ় সম্পর্ক আছে বলে আমরা দাবি করে এসেছি এবং ইতিহাসও যে সম্পর্ককে সাক্ষ্য দেয় সেটা আসলে কতদুর সত্য -সে সম্পর্কে এ অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই বলে রাখি যে,আমরা যদি পূর্বালোচিত অধ্যায়গুলো ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তাহলে এই সম্পর্কের নিগুঢ়তত্ত্ব উদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে।

যদি ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাত স্রেফ একটি দুঃখজনক ঘটনা কিংবা একজন নিরপরাধ মানুষের অনর্থক হত্যার ঘটনা হতো তাহলে তিনি হয়তো বড় জোর একজন সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হতেন। কিন্তু তার এ আত্মদানের সূত্র ধরে মুসলিম বিশ্বে যে আমূল পরিবর্তন এবং সুদূর প্রসারী ও সাড়া জাগানো প্রভাব পড়েছিল-তা কখনোই হত না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হোসাইনী আন্দোলন মুসলিম বিশ্বকে যেভাবে‘‘ মুক্তি সোপান’’ হিসেবে পথ দেখিয়ে এসেছ তার কারণ হলো,এ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে ইসলামী ও ঐশী আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি আন্দোলন। তদুপরি এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন এমন একজন কালজয়ী মহান বীরপুরুষ যিনি তলোয়ারের উপরে রক্তের বিজয় এনে সত্যের পতাকাকে উন্নীত করেছেন। তিনি মুসলিম সমাজের শিরায় শিরায় নতুন প্রাণস্পন্দন জাগিয়েছেন।

আগই বলা হয়েছে যে,কোনো মহান ও বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য হলো যে,তা মানুষের অন্তরের গভীরে বীরত্বের সাড়া জাগায়। রক্তের কণায় কণায় মুক্তিকামী স্পৃহা সঞ্চার করে দেয় এবং সকল গাফলতি ও অচৈতন্যের কালো অমানিশার অবসান ঘটিয়ে সমাজে জাগরণের ঢেউ সৃষ্টি করে।

অনেক সময় দেখা যায় কোনো রক্তাক্ত ঘটনা মানুষকে সজাগ ও প্রাণবন্ত না করে বরং তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও হতাশার বীজ ছড়ায়। তাদের রক্তে জোয়ার না এনে তাকে জমাটবদ্ধ করে দেয়। তার কারণ হলো এসব ঘটনায় কেবল অনর্থক রক্তপাত,প্রাণহানি এবং নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি হয়। আবার এমন অনেক ঘটনা আছে যা রক্তাক্ত বটে কিন্তু এ সমস্ত ঘটনা সমাজকে মুক্তিকামী এবং শূচি-শুভ্র করে তোলে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ও দেখা যায় কোনো কোনো কাজ আমাদের অন্তরকে কালিমায় লিপ্ত করে দেয়। পক্ষান্তরে,কিছু কিছু কাজ আছে যা করলে আমাদের অন্তর নির্মল এবং শুভ্র হয়ে ওঠে। সমাজের বেলায়ও একথা প্রযোজ্য । কোনো কোনো ঘটনা সমাজের প্রাণসত্তাকে কলুষময় করে দেয়,হতাশা-নিরাশা আর ভয়-ভীতি সঞ্চারণের মাধ্যমে সমাজকে হীনবল ও দাসত্ব করার মনোবৃত্তি সম্পন্ন করে তোলে। অথচ এমন কিছু ঘটনা আছে যা সমাজকে দাসত্বের থেকে মুক্ত করে,দুর্বার সাহসী ও সকল পঙ্কিলতা দূর করে তাকে স্বচ্ছ করে তোলে।

ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাতের পরে মুসলিম সমাজও এভাবে সমস্ত দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ পেল। সমাজের সকল পঙ্কিলতা দূর হয়ে সেখানে প্রবেশ করলো শান্তির মুক্ত -শীতল বায়ু । তিনি চরম বীরত্বের সাথে শক্তহাতে মুসলিম সমাজের হারানো ব্যক্তিত্বকে পুনরায় ফিরিয়ে দিলেন। তিনি সেই কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানলেন যার ফলশ্রুতিতে সেখান থেকে প্রতিটি মুসলমান একেকজন মুমীন,সাহসী,সত্যান্বেষী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে পুনর্জন্ম লাভ করলো।

ব্যক্তিত্বের অনুভূতি অমূল্য সম্পদ। সমাজের জন্যে এ সম্পদ অনেক বড় জিনিস। যে সমাজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান,যে সমাজ একটি স্বাধীন আদর্শ ও স্বতন্ত্র জীবনদর্শন অনুসরণ করে বেঁচে থাকে,যে সমাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সর্বোপরি যে সমাজের ব্যক্তিত্বের অহংকার আছে-তার চেয়ে ধন্য ও সমৃদ্ধ সমাজ কি হতে পারে?

যে সামজ স্বীয় ব্যক্তিত্বকে বিকিয়ে দিয়ে পরের দাসত্বকে মেনে নেয় তার চেয়ে জঘন্য সমাজ দ্বিতীয়টি নেই। ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা সমাজের জন্যে দূরারোগ্য ব্যাধির সমতুল্য । এতে সমাজ উন্নত ও মহান না হয়ে অধঃপতনের অন্ধ কুয়ায় বিলীন হয়ে যায়।

স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবনদর্শনকে বিকিয়ে দিলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু কোনো জাতি যদি সব কিছুকে হারিয়েও তার স্বীয় স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিত্বকে অটুট রাখতে পারে তাহলে অচিরেই সে পুনরায় সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ একমাত্র যে জিনিস কোন সমাজ কিংবা ব্যক্তিত্বকে অন্য কোনো সমাজের বা ব্যক্তির হাতে বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে তা হলো ঐ সমাজের বা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা চরমভাবে পরাজিত হয় এবং অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারপরও তারা বলেছিলঃ আমরা হয়তো সবকিছুই হারালাম কিন্তু আমাদের কাছ থেকে একটি জিনিস কেউ কেড়ে নিতে পারেনি,তাহলো আমাদের স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তিত্ব । আর এই ব্যক্তিত্বের অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল বলেই অচিরেই জার্মানরা তাদের হারানো স্থান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু কোনো জাতি যদি সব কিছুর মালিক হয়েও তার স্বাতন্ত্র্যবোধকে বিকিয়ে দিয়ে বসে তাহলে তাদের ধ্বংস অত্যাসন্ন । নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব হারিয়ে সে অন্য জাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়,আজ আমাদের মুসলিম দেশগুলোর অনেকেই প্রকৃতির দেয়া অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক এবং অতীতের সুদীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের পাশ্চাত্যের দাসত্ব করতে লজ্জাও করে না।

প্রখ্যাত চিন্তাবিদ আল্লামা ইকবাল লাহোরী বলেন,মুসোলিনীর মতেঃ মানুষ যদি রুটি চায় তাহলে তার অস্ত্র থাকতে হবে। অর্থাৎ খাবার হাতে আনতে হলে বাহুর জোর থাকা চাই। মুসোলিনীর এই মতকে খণ্ডন করে আল্লামা ইকবাল বলেনঃ যদি রুটি পেতে চাও তাহলে তুমি নিজেই অস্ত্র হও। অর্থাৎ,তুমি দৃঢ় হও,তোমার ব্যক্তিত্ব,তোমার স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করো। তিনি বলেন,কেন শক্তির আশ্রয় নিতে চাও? তুমি শক্ত হও। তুমি নিজে লৌহমানব হও,তোমার ব্যক্তিত্বকে অটুট রাখো তাহলেই তুমি যা চাইবে তা পাবে।

যদি কোনো হতভাগা জাতি তার স্বীয় জীবন-দর্শন থেকে গৃহীত ঈমানকে বিসর্জন দিয়ে অন্য কোনো জাতির মধ্যে মিলে যায় তাহলে সবক্ষেত্রে সে তাদের মতোই চিন্তা করতে থাকে,তাদের মতোই চলতে থাকে। কোনো ব্যাপারেই সে আর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না,তখন যেকানো অশ্লীলতাকে সেও মেনে নেয়। তাদের চাটুকারিতা করতেই তখন তার ভাল লাগে।

এ প্রসঙ্গে কয়েক বছরের আগের একটি ঘটনা উল্লেখ্য। মস্কোতে নিযুক্ত ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাষ্টদূতের এক মেয়ে জৈনক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলের প্রেমে পড়ে। রাষ্টদূত স্বাভাবিকভাবেই একজন তথাকথিত নামিদামি ভদ্র লোক ছিলেন। যখন তার মেয়ে এক নিগ্রো ছেলের সাথে বিয়ে করে তখন ইংল্যান্ডে বেশ হৈ চৈ পড়ে যায় কিভাবে একজন নামি দামি লোকের সাদা চামড়ার মেয়ে একজন কালো চামড়ার ছেলেকে বিয়ে করলো? সারা দেশ জুড়ে বেশকিছু দিন হৈ-হুল্লোড় চললো,পত্র -পত্রিকাও দাপটে ব্যবসা চালালো। তারপর একটি পত্রিকায় লেখা হল যে,এ তো কোনো অদ্ভুত ঘটনা নয়। পৃথিবী এখন উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। সাদা-কালো আজ কোনো ব্যাপারই নয়। ইসলাম একটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে 1400 বছর আগেই সাদা-কালোর ব্যবধান বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।

এ পত্রিকার বক্তব্য নিয়ে কয়েকজন ব্রিটিশ এক মিটিং করে। সেখানে কয়েকজন মুসলমান যুবকও ছিল। আলোচনায় বলা হল যে,ওমুক পত্রিকা ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে যে,ইসলাম কালোদেরকেও সম্মান দিয়েছে ও তাদেরকে সাদাদের সমান বলেই ঘোষণা করেছে। এর জবাবে আরেকজন বলে ওঠে যে,ইসলাম এক নোংরা ধর্ম বলেই নোংরাদেরকে সমর্থন করেছে। এ কথা শুনে মুসলমান যুবক দু টি ও বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তারা ভাবলো যে,আমরা এমন এক দীনের অনুসারী যা প্রকৃতই নোংরা তা না হলে কালো এবং সাদার মধ্যে যে পার্থক্য আছে এটি কেন ইসলাম স্বীকার করে না। একই বলে ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে দেয়া। এই দু জন যুবক মুসলমান বটে। কিন্তু তাদের মুসলিম ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দিয়ে এমন এক পরিবেশে বিলীন হয়ে গেছে যে,তাদের আর স্বাধীনভাবে চিন্তা করার  ক্ষমতা নেই। অন্য লোকের ভ্রান্ত চিন্তার ছাঁচেই সেও তার চিন্তাকে বেঁধে নিয়েছে। তাদের ঐ ভ্রান্ত চিন্তার একটি দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেবার বদলে নিজেরাই শিকারে পরিণত হয়েছে। তারা মনে করে যেহেতু ইউরোপীয়রা এরকম মনে করে সেহেতু এটিই ঠিক।

সত্যকে পাওয়া মাত্র গ্রহণ করার অভ্যাস অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু সত্য ও সততাকে বিকিয়ে দেয়া সবচেয়ে কু-অভ্যাসগুলোর অন্তর্গত। গান্ধী কিংবা নেহেরু ঐ নিজস্ব পোশাক নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন তাতে তো তাদের কোনো অসম্মান হয়নি। বরং তার ভারতীয় সত্তার পরিচয়টিই বিদেশে ফুটে উঠে। যারা দেশীয় সংস্কৃতির বদলে বিদেশী ভাষা-সাংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় তারা কাপুরুষ ছাড়া কিছু নয়। এরা প্রদেশের,সমাজের ও জাতির কুলাঙ্গার।

আরবী হরেফ লেখা তুর্কী ভাষা আতাতুর্কের পছন্দ হল না। তাই সে ল্যাটিন হরফে তুর্কী ভাষার প্রবর্তন ঘটালো। (খোদা না করুক) হয়তো দেখা যাবে একিদন পশ্চিমাভক্ত আরব রাজা-বাদশাহদেরও আরবী অক্ষরে আরবী ভাষা পছন্দ হবে না। তারাও দেখা যাবে ল্যাটিন অক্ষরে আরবী ভাষার চলন করবে। পরিণতিতে মহাপবিত্র খোদায়ী আল কোরআনের আর সহজভাবে অর্থ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো ইসলাম ধর্মই থাকবে না। মুসলিম ব্যক্তিত্ব ও মুসলিম ঐতিহ্যকে হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে বসতে হবে।

মহানবী (সাঃ) এসে আরবেদেরকে কি দিয়েছিলেন? বস্তুত একজন গরীব ও অনাথ ব্যক্তি যেখানে সমস্ত গোত্র এবং সমাজ তার বিরোধিতায় নেমেছে তাদেরকে কি-ই বা দিতে পারতেন। কিন্তু তবুও কিভাবে তিনি তাদেরকে ঐ নরকালয় থেকে বের করে সম্মানের চুড়ায় এনে বসাতে পরলেন?

তিনি সমাজে এমন এক ঈমানী শক্তি প্রবাহিত করে দিলেন যা তাদেরকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। ফলে যে আরবরা গতকাল উটের দুধ খেয়ে জীবন যাপন করতো,হিংস্র জন্তু খেত,দস্যুতা যাদের পেশা ছিল,যে মূর্খ পাষণ্ড আরবরা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, তারাই আজ হঠাৎ করে হুশ ফিরে পেল। ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তারা বলে উঠলো যে,আমাকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাস করা থেকে বিরত হতে হবে। অতীতে কি করতো না করতো তা আর ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না,বরং গর্ব করে বলতে লাগলো;দেখা,আমি গতকাল এরকম অধম ছিলাম,এরকম বঞ্চিত চিন্তা-ভাবনা করতাম কিন্তু আজকে আমি সোনার মানুষ। আমি তোমাদের চেয়েও উন্নত চিন্তা করার শক্তি অর্জন করেছি। একেই বলে ব্যক্তিত্ব । পৃথিবীতে‘‘ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু র চেয়ে ভাল কোনো কালেমা খুজে পাওয়া যাবে কি যা মানুষের অন্তরকে অধিকতর ব্যক্তিত্ব এবং বীরত্ব দান করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এসব গ্রহ-তারা,পশু-পাখী,মাটি-পাথর,গাছ-গাছালি কোথায় আর মানুষের মাথা অবনত করা কোথায়? আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে মাথা নত করতে পারবো না। আমি সত্য,ন্যায় এবং মান-সম্মানের পক্ষপাতী। এগুলো হলো ব্যক্তিত্ব থেকে উদ্ভূত মনোবৃত্তি ।

কিন্তু উমাইয়ারা এসে এমন কিছু করলো যাতে মুসলমানদের ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যায়। কুফা মুসলিম বাহিনীর কেন্দ্রভূমি ছিল। ইমাম হোসাইন (আঃ) যদি সেদিন কুফার লোকদের দাওয়াত অনুযায়ী কুফায় না আসতেন তাহলে অনাদিকালের ঐতিহাসিকরা তাকে দোষারোপ করে বলতো,হাজার হাজার লোক আপনার প্রতিনিধির সাথে বাইয়াত করেছে,তারা আপনাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে 18 হাজার চিঠি পাঠিয়েছে,কিন্তু আপনি কেন তাদের দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে এত বড় ভূল করলেন? কুফার চেয়ে অনুকূল কোনো জায়গা আর ছিল কি?

ইমাম হোসাইন (আঃ) সবকিছু বুঝে সবচেয়ে উত্তম পথেই পা বাড়ালেন। কিন্তু হাজার হাজার মুসলিম সেনারা যারা ইমাম হোসাইনের (আঃ) জন্যে বাইয়াত করে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাওয়াত করলো;ইবনে যিয়াদের লেজ দেখেই তারা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল কেন? কারণ ইবনে যিয়াদের বাবাকে সবাই চিনতো। সে দীর্ঘদিন ধরে কুফায় শাসন করে কত মায়ের অশ্রু ঝরিয়েছে,কত লোকের হাত-পা কেটে পঙ্গু করে দিয়েছে,কত মানুষের পেট চিরে কলিজা বের করে এনেছে,কত মানুষকে বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে-এসবই কুফাবাসীদের ভালমতো মনে ছিল। তাই ইবনে যিয়াদকে দেখে কুফাবাসীদের মনে তার বাবার নৃশংসতার কথা স্মরণ হয় এবং তাতেই তাদের সমস্ত বীরত্ব ও ব্যক্তিত্ব পানি হয়ে যায়। তাই ইবনে যিয়াদের কুফায় আগমনের সংবাদ শোনা মাত্র মা সন্তানের হাত ধরে,স্বামী স্ত্রীর হাত ধরে,ভাই বোনের হাত ধরে মুসলিম ইবনে আকিলের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। কুফায় হযরত আলী (আঃ)-এর অনুসারীরাও ছিল প্রচুর। কিন্তু তারা এমন দিশেহারা হয়ে পড়ে যে,শেষ পর্যন্ত নিজের হাতেই ইমাম হোসাইনকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সে সময় বলা হলোঃ

قُلُوبُهُمْ مَعَهُ وَسُيُوفُهُمْ عَلَيْهِ

‘‘ তাদের অন্তরগুলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথেই ছিল কিন্তু তাদের তলোয়ারগুলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিরুদ্ধে উত্তোলিত হয়।

(মাকতালুল মোকাররামঃ 230, তারিখে তাবারীঃ 6/217 , কামেলে ইবনে আছীরঃ 6/15 ,ইরশাদে মুফীদঃ 218, মানাকিবে ইবনে শাহের আশুবঃ 4/195 , কাশফুল গোম্মাহঃ 2/32)

এর কারণ হলো উমাইয়ারা মুসলিম সমাজের ব্যক্তিত্বকে ভূ-লুন্ঠিত করে দেয়,মুসলমানদের ঐতিহ্যকে পদদলিত করে। ফলে আর কেউই নিজেদের মধ্যে ইসলামী অনুভূতি খুজে পায়নি। সবাই যেন ইবনে যিয়াদের মধ্যে হারিয়ে গেল।

কিন্তু এই কুফাবাসীরাই এ ঘটনার মাত্র তিন বছর পরেই বিপ্লব করে। পাঁচ হাজার‘‘ তাওয়াব’’ বা অনুতপ্ত ব্যক্তি ইমাম হোসাইনের (আঃ) রওজায় গিয়ে আহাজারি করে অশ্রু ঝরায়। তারা নিজেদের পাপের জন্যে তওবা করে ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে যতক্ষণ ইমাম হোসাইনের (আঃ) রক্তের প্রতিশোধ না নিতে পারবে ততক্ষণ শান্ত হবে না। হয় নিহত হবে না হয় এর প্রতিশোধ নেবে। যেমন কথা তেমন কাজ। 12ই মহররম অর্থাৎ,আশুরার মাত্র দু দিন পর শুরু হল তাদের অভিযান এবং শেষ পর্যন্ত এরাই কারবালায় নবীর (সাঃ) সন্তানদের হত্যাকারীদেরকে ধ্বংস করলো।

তাদের এ অনুভূতিকে কে ফিরিয়ে দিল? অবশ্যই ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলন। কোনো জাতিকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করার অর্থ হলো সে জাতিকে দেশ প্রেমিক ও শ্রদ্ধাবান করে তোলা। যে জাতির মধ্যে এগুলো ধুলোর আবরণে ঢাকা পড়েছে তাকে ঝেড়ে-মুছে পুনরায় প্রাণবন্ত করা। ইমাম হোসাইন (আঃ) যেখানেই আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন সেখানেই বলেছেনঃ

وَ عَلَي الْاِسْلَامِ السَّلَامُ اِذْ قَدْ بُلِيَتِ الْاُمَّةُ بِرَاعٍ مِثْلِ يَزِيدٍ

‘‘ যদি ইয়াযিদের মতো কাপুরুষ উম্মতের অভিভাবক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের সমাপ্তি ঘটবে।’’ তিনি আরও বলেনঃ

اِنِّي لَمْ اَخْرُجْ اَشِراً وَلَا بَطِراً وَ لَا مُفْسِداً وَ لَا ظَالِماً وَ اِنَّمَا خَرَجْتُ لِطَلَبِ الْاِصْلَاحِ فِي اُمَّةِ جَدِّي.

‘‘ আমি কোনো ক্ষমতা বা পদের লোভে নয় বরং আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করার জন্যেই বিদ্রোহে নেমেছি।’’ 23 বছর ধরে যেসব কথা মরে গিয়েছিল সেসব কথাকে পুনর্জাগরুক করার জন্যে তিনি একজন সংস্কারক হিসেবে বিদ্রোহ করলেন। নানার উম্মত আজ নানার পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই ইমাম হোসাইন (আঃ) উম্মতকে নানার পথে আনতে চান। তিনি বিদ্রোহ করে উম্মতকে পুনরায় সত্য প্রেমিক ও আদর্শবান করে তুললেন। কোনো জাতির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করার পথও এই একটি । সেই জাতিই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যার মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্বনির্ভরতার অনুভূতি রয়েছে। এসবগুলোই হোসাইনী আন্দোলনের শিক্ষা যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তিনি মুসলিম সমাজকে স্বনির্ভর হওয়ার মনোবৃত্তি দান করেন। যেদিন ইমাম হোসাইন (আঃ) মদীনা থেকে রওয়ানা হন সেদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভরভাবেই পদক্ষেপ শুরু করেন। তিনি বলেনঃ 

‘‘ আল্লাহ চাহেন তো আমি আগামীকাল সকালেই রওয়ানা হচ্ছি । তোমাদের মধ্যে যে জীবনকে সত্যের পথে উৎসর্গ করতে পারবে এবং আল্লাহর দিদার পেতে প্রস্তুত সে আমার সঙ্গী হতে পারো। আমার মতো আমি চললাম। এর বেশী কোন কথা নেই। ( মুলহাকাতু এহকাকুল হকঃ 11/598 ,নাফাসুল মাহমুমঃ 100, কাশফুল গোম্মাহঃ 2/29 আল লুহুফঃ25 , মাকতালুল খারাযমিঃ 285, বিহারুল আনোয়ারঃ 44/366)

এতটুকু আত্মনির্ভরতা ও অভাব মুক্তির নজীর পৃথিবীতে নেই। এর চেয়েও বড় আত্মনির্ভরতার পরিচয় তিনি দেন আশুরার রাত্রে । তিনি তার মুষ্টিমেয় সাহায্যকারীদের থেকেও বাইয়াত তুলে নিয়ে তাদেরকে বিপদমুক্তির সমস্ত পথ দেখিয়ে দিয়ে বললেনঃ তোমরা যদি চলে যেতে চাও অনায়াসে যেতে পার। এমন কি কেউ ইমাম হোসাইনের (আঃ) মুখের দিকে চেয়ে মায়ায় পড়ে চলে যেতে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে কিনা এ কারণে ইমাম হোসাইন (আঃ) আলো নিভিয়ে দিলেন। তিনি একবারও বললেন না যে,আমি একাকী হয়ে পড়বো,অসহায় হয়ে যাব। কত বড় আত্মবিশ্বাস ও নির্ভরতার শিক্ষা ইমাম হোসাইন (আঃ) শেখালেন।

এই আত্মনির্ভরতার শিক্ষা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এই আত্মনির্ভরতাই মুসলমানদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে ও এ সূত্র ধরে কত শত শত বিপ্লব এবং বিদ্রোহ পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে। ইমাম হোসাইন (আঃ) মুসলমানদেরকে ধৈর্য,অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমী হতে শিক্ষা দিয়েছেন। এসবই মুসলমানদের মূলধন হিসেবে কাজে লাগে। সুতরাং যদি কেউ বলে যে,ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাতের সাথে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হবার মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে;তাহলে জবাবে বলতে হবে যে,ইমাম হোসাইন মুসলমানদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন,রক্তের মধ্যে জোয়ারের বান তোলেন,মুসলমানদের স্বীয় ব্যক্তিত্ব এবং হিম্মতকে ফিরিয়ে দিলেন। তাদেরকে সত্যপ্রিয় এবং আদর্শবান করে তোলেন,আত্মনির্ভর ও স্বয়ম্ভর হতে শেখান। তাদেরকে বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিবেশে ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হতে শেখান,ভয়-ভীতির অবসান ঘটিয়ে দৃঢ়ভাবে দাড়াতে শেখান, ভয় ভীতির অবসান ঘটিয়ে দৃঢ়ভাবে দাড়াতে শেখান। যে লোকগুলো ঐ পরিমাণ ভীতসন্ত্রস্ত ছিল তাদের সবাইকে একেকজন সাহসী বীরপুরুষ করে গড়ে তোলেন।

ইমাম হোসাইনের (আঃ) জন্যে শোক-পালন করা,মার্সিয়া পড়া-এসবের কেউ বিরোধিতা করে না। তবে এগুলো এমনভাবে পালন করা উচিত যাতে হোসাইনী বীরত্ব আমাদের প্রতিটি রক্তকণায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। ইমাম হোসাইন (আঃ) সর্বকালের জন্যে একটি সামাজিক আদর্শ। সেদিনও এ আদর্শ মুসলিম সমাজকে আলোড়িত করেছিল। যারাই অন্যায়ের গলা চেপে ধরতে এবং সৎকাজের উপদেশ কিংবা অসৎকাজে বাধা দিতে অগ্রণী হতো তাদের সবার স্লোগান ছিলঃ

یا لثارات الحسین

হে হোসাইনের রক্ত ( মুসনাদে ইমাম রেযাঃ 1/148 উয়ুনুল আখবার আর রেযাঃ 1/299)

তাই,আজকেও অন্যায়ের পথ রুখতে,নামায কায়েম করতে,ইসলামকে পুনর্জাগরিত করতে ও মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের মহান ঐতিহ্য এবং অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হলে ইমাম হোসাইনের (আঃ) আদর্শে আদর্শবান হতে হবে। এ বিষয়ে আরও অনেক কিছু লেখার ছিল। তবুও আর দীর্ঘ না করে এবার পবিত্র কোরআনের এক আয়াত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই। পবিত্র কোরআনের সুরা আনফালের 24 নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

) يَا اَيُّهَا الَّذِينَ اَمَنُوا اسْتَجِيبُوا للهِ وَلِلرَّسُولِ اِذَا دَعَاکمْ لِمَايُحْيِيكُمْ(

‘‘ হে মুমিনগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহবান করেন যা তোমাদেরকে জীবন্ত করে,তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিবে।’’

অধিক ধন-সম্পত্তিই এক জাতির প্রকৃত জীবন নয়। এমন কি শুধু জ্ঞানের ভান্ডার নিয়েও কোনো জাতি বেঁচে থাকতে পারে না। কোনো জাতির প্রাণ হলো তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য । পৃথিবীতে অনেক জাতি হয়তো খুবই জ্ঞানী অথচ তাদের ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু নেই। পক্ষান্তরে,হয়তো কতো মূর্খ জাতিও রয়েছে কিন্তু তারা তাদের ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যকে ঠিক ঠিকভাবে বজায় রেখেছে। দেড়শ বছর ধরে সংগ্রাম করে আলজেরিয়ার জনগণ যদি সম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সকে নাকানি চুকানি খাইয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবে তা কেবল তাদের ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য অনুভূতি দিয়েই সম্ভব হয়েছিল। দারিদ্র ও স্বল্প জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনাম যদি শক্তিধর বড় শয়তান আমিরকার পিঠ ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয় তাহলেও তা কেবল ভিয়েতনামীদের ব্যক্তিত্বের বলেই সম্ভবপর হয়েছিল। তাদের জনসংখ্যা কিংবা শক্তি কোনটিই বেশী ছিল না। শুধু যে জিনিসটি পুঁজি করে তারা সংগ্রাম করে তাহলো তাদের ব্যক্তিত্বের জোর। তাদের স্লোগান ছিল একটিইঃ আমরা অন্য কারো মুরব্বীয়ানা মানি না। যদি বাচতেই হয় তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়াবো তা না হলে মরবো। কিন্তু অন্যের কথায় উঠা-বসা আমাদের মানায় না।

ইমাম হোসাইনের এই বীরত্বের প্রভারশ্মি সবচেয়ে বেশি যার উপর প্রতিফলিত হয়েছিল তিনি হলেন তার সুযোগ্য বোন হযরত যয়নাব। হযরত যয়নাব বিশ্বজননী হযরত ফাতেমার কোলে বড় হন। প্রথম থেকেই তিনি একজন মহতী নারী ছিলেন। তারপরও কারবালার পরের যয়নাবের সাথে কারবালার আগের যয়নাবের ঢের তফাত পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ কারবালার পর হযরত যয়নাব (আঃ) আরও বেশী ব্যক্তিত্বসম্পন্নও মহতী হয়ে ওঠেন।

আশুরার রাতের দুর্বিষহ অবস্থা দেখে হযরত যয়নাব দু একবার কেঁদেও ফেলেন। একবার ইমাম হোসাইনের (আঃ) কোলে মাথা রেখে তিনি এতোই কাঁদলেন যে,বেহুশ প্রায় হয়ে পড়েন। ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিভিন্ন ভাবে তাকে শান্ত করেন। তারপর বলেন,

لَا يُذْهِبَنَّ حِلْمَكَ الشَّيْطَانُ

‘‘ বোন আমার! শয়তান যেন তোমার ধৈর্যচ্যুতি না ঘটায়।’’ (এ লামুল ওরাঃ 236, ইরশাদে মুফীদঃ 232 বিহারুল আনওয়ারঃ 45/2)

তিনি হযরত যয়নাবকে (আঃ) বলেনঃ আমাদের নানাইতো এপথ দেখিয়ে গেছেন। বাবা-মা-ভাই সবাইতো এপথে শাহাদাত বরণ করেছেন। এতে তো গৌরব ছাড়া কাঁদার কিছুই নেই।

হযরত যয়নাব (আঃ) নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলেনঃ আমি কোনো কষ্টের জন্যে কাঁদছি না। আমার দুঃখ হলো এ কারণে যে,নানাকে হারিয়েছি,বাবাকে হারিয়েছি,মাকে হারিয়েছি,বড় ভাই হাসানকে (আঃ) হারিয়েছি। তারপরও এতদিন আপনার দিকে চেয়ে আমি সব দুঃখ ভুলেছিলাম। কিন্তু আজ তোমাকেও হারাতে হবে তাই আমার কষ্ট হচ্ছে ।

অথচ কারবালার ঘটনার পরমুহূর্ত থেকে হযরত যয়নাব আর আগের যয়নাব রইলেন না। ইমাম হোসাইনের শৌয-বীর্য এবং ধৈর্য দেখে তিনি এমন মানসিকতা অর্জন করলেন যে,যতবড় ব্যক্তিত্বই হোক না কেন,যয়নাবের (আঃ) সামনে সে তুচ্ছ । ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ) বলেনঃ আমরা বারজন ছিলাম। সবাইকে এক শিকলে বেঁধে শিকলের একমাথা আমার বাহুতে এবং অন্য মাথা আমার ফুফুর বাহুতে বেঁধে দেয়া হয়।

বলা হয় যে,নবী পরিবারকে 2রা সফর তারিখে বন্দী অবস্থায় সিরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। এ হিসাব অনুযায়ী কারবালার ঘটনা থেকে যখন বাইশদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তখন বন্দীদেরকে ইয়াযিদের সবুজ প্রাসাদে নেয়া হল। সবুজ প্রাসাদ মুয়াবিয়ার তৈরী।

এই প্রাসাদ ঝলমলে,রাজকীয় সাজে সজ্জিত,আয়া-খানসামাদের ভিড় প্রভৃতিতে ভরা ছিল এবং কেউ এর মধ্যে ঢ়ুকলে হতবাক হয়ে পড়তো। বলা হয় যে,সাত সাতটা বড় বড় হল ঘর পার হলে তারপর ইয়াযিদের মনিমাণিক্য খচিত দরবারে আসা যেত। সেখানে ইয়াযিদ দাস-দাসী,উযির -নাযির সবাইকে নিয়ে বসে আছে। এমনি অবস্থায় বন্দী নবী পরিবারকে দরবারে আনা হল। কিন্তু হযরত যয়নাব (আঃ) এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পরও ইয়াযিদের দরবারে এমন সাহসী ভূমিকা নিলেন যে,সমস্ত দরবার কেঁপে উঠলো এবং উপস্থিত সভাসদরা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। এমন কি বাকপটু ইয়াযিদও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে গেল। ইয়াযিদ প্রথমে গর্বভরে তার বিজয় উল্লাস করছিল। সাথে সাথে হযরত যয়নাব (আঃ) বাঘের মতো গর্জে উঠে বললেনঃ

اَظَنَنْتَ يَا يَزِيدُ حَيْثُ اَخَذْتَ عَلَيْنَا اَقْطَارَ الْاَرْضِ وَ آفَاقَ السَّمَاءِ فَاَصْبَحْنَا نُسَاقُ آکمَا تُسَاقُ الْاُسَارَي اَنَّ بِنَا عَلَي اللهِ هَوَاناً وَ بِكَ عَلَيْهِ کرَامَة ؟

হে ইয়াযিদ খুব যে ফুর্তি করছো! আমাদেরকে এই হালে ফেলে ও নিজের হাতের মুঠোয় পেয়ে বোধ হয় মনে করছো যে,পৃথিবীর সব কিছু থেকে আমাদের বঞ্চিত করে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নেয়ামত লাভ করেছ। আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,আমার দৃষ্টিতে তোমার মতো কাপুরুষ আর কেউ নেই। আমার দৃষ্টিতে তোমার এক কানাকিড়ও মূল্য নেই। (আল লুহুফঃ 76, মাকতালুল মোকাররামঃ 462 বিহারুল আনওয়ারঃ 45/133)

একবার লক্ষ্য করুন যে,কেবল ঈমান ও ব্যক্তিত্ব ছাড়া সবকিছু হারিয়েছেন এবং বর্তমানে বন্দী অবস্থায় সবচেয়ে জঘন্য লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন-এরকম একজন মহিলার কাছ থেকে কী আশা করা যেতে পারে? কিন্তু দেখুন হযরত যয়নাব (আঃ) এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন যে,অতি শীঘ্রই শামে বিপ্লবের ঘনঘটা শুরু হয়।

ঐ দরবারে বসেই ইয়াযিদ তার কৌশল বদলাতে বাধ্য হয়। বন্দীদেরকে সসম্মানে মদীনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তারপর নিজে অনুতাপ প্রকাশ করে ও ইবনে যিয়াদকে অভিসম্পাত করে বলে আমি ওকে এ কাজ করতে আদেশ দেইনি। সে নিজেই একাজ করেছে। এই বিপ্লব কে ঘটালেন? ইসলামের মহীয়সী নারী হযরত যয়নাবই (আঃ) এরকম বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করে যান। তারপর তার বক্তব্যের শেষাংশে যে ইয়াজিদকে হাজার হাজার মানুষ জাঁহাপনা বলে ডাকতো সেই ইয়াজিদকে ব্যঙ্গ করে হযরত যয়নাব বললেনঃ

يَا يَزِيدُ آِدْ کِيْدَكَ وَاسْعَ سَعْيَكَ نَاصِبْ جَهْدَكَ فَوَاللهِ لَا تَمْحُوا ذِکرَنَا وَ لَا تَمِيتَ وَحْيَنَا

‘‘ হে ইয়াযিদ! তোমাদের যে জল্পনা-কল্পনা আর ষড়যন্ত্র আছে সবই করো। তবে জেনে রেখো যে আমাদের স্মরণকে মানুষের অন্তর থেকে কোনিদন মুছে ফলেতে পারবে না। আমাদের এ বাণী চিরন্তন। আর যারা নিশ্চিহ্ন হবে সে হলো তুমি এবং তোমার চাটুকাররা’’ (আল লুহুফঃ 77, বিহারুল আনওয়ারঃ 45/235)

একথা শুনে ইয়াজিদ প্রথম চুপ রইলো তারপর পাপিষ্ট ইয়াযিদ ভিতরে জ্বলে উঠলো এবং হযরত যয়নাবকে (আঃ) আরও কষ্ট দেয়ার জন্যে তার হাতের লাঠি দিয়ে ইমাম হোসাইনের (আঃ) ছিন্ন মস্তকে খোঁচা মারলো।

লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিয়িল আযিম।