ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)0%

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড) লেখক:
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 10753
ডাউনলোড: 3528

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 12 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 10753 / ডাউনলোড: 3528
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব (২য় খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর উপর সর্বশেষ অবিচার

ইতোমধ্যে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে,রাসূলুল্লাহর (সাঃ) উম্মতকে রাসূলের (সাঃ) সীরাতে পৌঁছে দেবার মহান লক্ষ্য নিয়ে ইমাম হোসাইন (আঃ) এক অসামান্য বিপ্লব সাধন করেন এবং অনাগতকালের সত্যান্বেষী মানুষের জন্য একটা বাস্তব আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে,এই ক্ষুরধার চিরন্তন আদর্শকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নানা প্রকার বিকৃতি ও বিভ্রান্তি ঘটানোর পর। ফলে এ আদর্শ এখন অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে এবং তা থেকে আমরা তেমন কোন উপকার পাচ্ছি না। এ মহান আদর্শের অবকাঠামো এবং লক্ষ্য উভয় ক্ষেত্রেই এমন কিছু রদবদল ঘটানো হয়েছে যাতে কারবালার হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র একজন নিরপরাধ ব্যক্তির অহেতুক রক্তপাতের ঘটনা বলেই খাড়া করানো যায়। অবশ্য এ ধরনের বিকৃতি ঘটাতে শত্রু-মিত্র উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। শত্রুরা ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথে বিরোধিতা করবে,তার মহান ব্যক্তিত্বকে ক্ষুন্ন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেননা ইমাম হোসাইনের (আঃ) কারণে তাদের সকল ষড়যন্ত্র এবং কাপুরুষোচিত দুরভিসন্ধি পণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু মিত্রদের পক্ষ থেকে ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথে এহেন আচরণের কথা শুনে অনেকের মনে খটকা লাগতে পারে। এ অধ্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করবো। আশা করি একটু মনোযোগ সহকারে বিষয়টি  হৃদয়ঙ্গম করলে সত্যপ্রিয় ভাই-বোনদের মনের এ খটকা দূর হবে।

কোনো বিষয়কে দু ভাবে বিভ্রান্ত করা যায়ঃ

এক ,বিষয়টির বাহ্যিক অবকাঠামোতে অসংশ্লিষ্ট কিছু যোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে।

দুই ,তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বিকৃত ও ভ্রান্ত অর্থে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে।

দুঃখের সাথে বলতে হয় যে,হোসাইনী মহান আদর্শে এ উভয় ধরনের বিভ্রান্তিই ঘটানো হয়েছে। আমরা প্রথমে কোনো বিষয়ের অবকাঠামোগত এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বিভ্রান্ত করাকে দু টো উদাহরণ সহকারে বোঝাতে চেষ্টা করবো।

পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যেকানো বিষয়ের বাহ্যিক অবকাঠামোতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করার অর্থ এতে অসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর সংযোজন কিংবা তা থেকে অপিরহার্য কোনো কিছুর বিয়োজন ঘটানো। আমাদের দেশে পল্লী অঞ্চলে একটি হাসির কাহিনী সুপরিচিত। এক মহাজন এবং তার চাকরকে নিয়েই এ কাহিনী রচিত। কাহিনীর এক পর্যায়ে এসে এক মজাদার ঘটনার অবতারণা হয়। একদিন মহাজন তার অফিসে বসে চাকরের মাধ্যমে বাড়িতে লিখে পাঠালো যে,আজ দুপুরে আমার জন্য মাছ-মাংস রান্না করা হোক,আর আমার চাকরের জন্য ডাল-ভাত। চাকর এ চিঠি নিয়ে মহাজনের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলো। কিন্তু চিঠিতে কী লেখা আছে তা জানার বড় কৌতুহল জাগলো তার। এদিকে নিজে আবার পড়াশুনা কিছুই জানে না। পথিমধ্যে একজন শিক্ষিত লোকের সাথে তার দেখা। সে ঐ লোককে চিঠিটা একটু পড়ে শোনাবার অনুরোধ করলো। চিঠির বক্তব্য শুনে চাকর এক ফন্দী করলো এবং ঐ লোককে বললোঃ আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে। লোকটি বললোঃ কী ব্যাপার! চাকর বললোঃ ঐ মহাজনের নাম কেটে ওখানে আমার নাম বসিয়ে দিন এবং আমার নামের জায়গায় ওনার নাম । তাই করা হলো। চাকর বাসায় এসে মহাজনের চিঠিটি দিল। বাড়ির লোকেরাও চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী চাকরের জন্য রান্না করলো মাছ-মাংস আর মহাজনের জন্য ডাল-ভাত। এ হলো কোন বিষয়ের অবকাঠামোগত বিভ্রান্তি । এখানে আমরা দেখলাম যে, বিষয়টিকে বিভ্রান্ত করার জন্য অসংশ্লিষ্ট বা অসত্য একটা কার্য সাধন করে এতে যোজন-বিয়োজন ঘটানো হয়েছে।

কিন্তু কোনো বিষয়কে যখন ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করা হয় তখন তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন হয় না। পুরো ঘটনাই অবিকল থেকে যাবে। কিন্তু এর অর্থ করার সময় ভুল অর্থ করা হবে। এ সম্পর্কে এক উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। উদাহরণটি একটি সত্য ঘটনা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এটি ঘটেছিলো।

মদীনার মসিজদ নির্মাণ করার সময় মুসলমানরা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশহণ করে। হযরত আম্মার ইয়াসির সেদিন অত্যধিক পরিশ্রম করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ সময় তাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ

يَاعَمَّارُ ! تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ

‘‘ হে আম্মার! তোমাকে একদল অবাধ্য ও পথভ্রষ্ট লোকজন হত্যা করবে।’’ ( সীরাতু হালাবীঃ 2/77)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মূলত কোরআনের এই আয়াতটির দিকেই ইঙ্গিত করলেনঃ‘‘ মুমিনদের দুই দল দ্বন্দে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেব;অতঃপর তাদের একদল অপর দলকে আক্রমণ করলে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’’ (সূরা হুজুরাতঃ 9)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঐ কথার পর থেকে মুসলমানরা হযরত আম্মার ইয়াসিরকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতো। কারণ,তিনি হক ও বাতিলের  প্যারামিটার। তিনি যে দলে থাকবেন তারাই সঠিক পথের অনুসারী। আর যারা তাকে হত্যা করবেন তারা অবাধ্য ও পথভ্রষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এ ঘটনার প্রয় 35 বছর পর মুসলমানদের দু দলের মধ্যে সিফফিনের ময়দানে বেজ উঠলো যুদ্ধের দামামা। একদলের নেতা হলেন খলিফা হযরত আলী (আঃ) এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলো কাপুরুষ মুয়াবিয়া। এ সময় হযরত আম্মার ইয়াসির দেখে হযরত আলী (আঃ)-এর বাহিনীতে অনেক দুর্বল ঈমানের লোকও সত্যের পথে নিশ্চিন্তে যুদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু অনেকে আবার মোয়াবিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তারা হযরত আম্মার ইয়াসিরের শাহাদাত না দেখা পর্যন্ত হযরত আলীর (আঃ) সঠিক পথে থাকার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলো। মুয়াবিয়ার দ্বারা হযরত আম্মার ইয়াসিরের নিহত হবার ঘটনায় সবাই মোয়াবিয়ার পথভ্রষ্টতা ধরে ফেললো। সাথে সাথে চারদিকে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। এমন কি স্বয়ং মোয়াবিয়ার সৈন্যরাও বললো আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুখে শুনেছি আম্মারকে হত্যা করবে একদল অবাধ্য এবং পথভ্রষ্ট লোকজন। তারাও তখন মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে মনস্থ করলো। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মুয়াবিয়া তার চিরকালের স্বভাব অনুযায়ী এবারও এক ধোকাবাজির আশ্রয় নিলো। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ হাদীস নিজের কানে শোনা বহু মুসলমান তখনও বেঁচে ছিলো তাই মোয়াবিয়া এ হাদীস জাল করার কোনো সাহস পেল না। অর্থাৎ এ হাদীসে হস্তক্ষেপ করে তার অবকাঠামোতে কোনো বিভ্রান্তি ঘটানোর প্রয়াস পেল না।

অগত্যা সে অন্য পথ বেছে নিলো। সে ঘোষণা করলোঃ তোমরা ভুল বুঝেছো। আম্মারকে যারা হত্যা করবে তারা পথভ্রষ্ট এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন ঠিকই,কিন্তু আম্মারকে তো আমরা হত্যা করিনি। এ কথা শুনে সবাই আশ্চার্যান্বিত হয়ে বললোঃ আমরা নিজের হাতেই আম্মারের গলায় তলোয়ার চালালাম আর তুমি বলছো আম্মারকে আমরা হত্যা করিনি! এ কেমন কথা? মোয়াবিয়া বললোঃ হ্যাঁ,আম্মারকে আলীই (আঃ) হত্যা করেছে। আলী (আঃ) যদি আম্মারকে যুদ্ধে না আনতো তাহলে তো আর তিনি নিহত হতেন না। কাজেই আম্মারকে হত্যার জন্য আলীই (আঃ) দায়ী এবং তার দলই পথভ্রষ্ট । গন্ডমূর্খ মুসলমানরা এবারও মুয়াবিয়ার দ্বারা ধোঁকা খেল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীসের এ ধরনের ব্যাখ্যা শুনেও তারা তা মেনে নিলো।

আমর ইবনে আস ছিলো মোয়াবিয়ার সংগীদের একজন। তার ছিলো দুই ছেলে। তাদের একজন বাবার মতোই চাটুকার। কিন্তু অপর ছেলে ছিলো ঈমানদার এবং বিশ্বস্ত। এ কারণে বাবার সাথেও তার কোনো মিল ছিল না। নাম ছিলো আব্দুল্লাহ। একিদন মুয়াবিয়ার এক জলসায় আব্দুল্লাহও উপস্থিত ছিলো। ঐ জলসায় মুয়াবিয়া পুনরায় হযরত আম্মারকে হত্যার জন্য হযরত আলীকেই (আঃ) দোষারোপ করলো এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঐ হাদীসের অপব্যাখ্যা করলো। এ সময় আব্দুল্লাহ প্রতিবাদ করে বলে উঠলোঃ কিসব আবোল-তাবোল বকছেন? আলীর (আঃ) দলে ছিলো বলেই হযরত আম্মারকে হত্যা করেছেন আলী (আঃ)?

মুয়াবিয়া বললোঃ তাছাড়া কী?

আব্দুল্লাহ বললোঃ তাহলে হযরত হামযাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হত্যা করেছেন,তাই তো? (নাউযুবিল্লাহ)। কেননা হযরত হামযাতো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দলে ছিলেন।

মোয়াবিয়া যেন একবারে হাতে-নাতে ধরা পড়লো। উপায়ন্তর না দেখে সে আব্দুল্লাহর বাবাকে ধমক দিয়ে বললোঃ তোমার এ বেয়াদব ছেলেকে চুপ করতে বলো।

যা হোক এ ঘটনায় আমরা দেখলাম যে,মুয়াবিয়া হাদীসটির কোনো রদবদল না করে কেবল এর অর্থ করার সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলো এবং তাতেই একটি জ্বলন্ত সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছিলো।

তবে এ ধরনের বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পন্থাটি অধিকতর মারাত্মক। কারণ এতে করে কোনো বিষয়ের গভীরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।

আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম যে,ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলন ছিলো এক অসাধারন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পবিত্র ও মহান আন্দোলন। ইতিহাসে এর কোনো জুড়ি নেই। আর এ কারণেই তা চিরকালের আদর্শে পরিণত হয়েছে। কেননা এর লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট গোত্র,জাতি,দেশ,মহাপ্রদেশের অনেক উর্ধ্বে ছিলো। সমস্ত মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় এ আন্দোলন। একত্ববাদ,সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা,সমতা,সহমর্মিতা এবং এ ধরনের মনুষ্যত্বের জন্য অপরিহার্য হাজারো উপাদানকে সু প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষেই পরিচালিত হয় এই আন্দোলন।

এ কারণে তিনি সমস্ত মানুষের। সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমনটি বলেছেনঃ

حُسَيْنُ مِنِّي وَ اَنَا مِنْ حُسَيْنٍ

‘‘ হোসাইন আমা হতে এবং আমি হোসাইন হতে।’’ ( কাশফুল গোম্মাহঃ 2/10 , 61 হিল্লিয়াতুল আবরার : 1/560 মুলহাকাতু এহকাকিল হকঃ 11/265-279 এ লামুল ওয়ারাঃ 216 ইরশাদে মুফিদঃ 249)

তেমনি আমরাও সমস্বরে বলিঃ

حُسَيْنُ مِنِّي وَ اَنَا مِنْ حُسَيْنٍ

অর্থাৎ‘‘ হোসাইন আমা হতে এবং আমি হোসাইন হতে।’’

কেননা 1400 বছর আগ তিনি আমাদের জন্য এবং মানবতার জন্য বিপ্লব করে গেছেন। তার বিপ্লব পবিত্র ও মহান ছিলো। কোনরকম ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠিস্বার্থের উর্ধ্বে এ বিপ্লব।

ইমাম হোসাইন (আঃ) দূরদর্শী ছিলেন। তিনি যা দেখতেন সমসাময়িক কালের কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা চিন্তাবিদের মাথায়ও তা আসতো না। তিনি মানুষের পরিত্রাণের উপায় তাদের নিজেদের চেয়ে ভালো বুঝতেন। দশ,কুড়ি,পঞ্চাশ,শত বছর যখন পার হয় তখন মানুষ একটু একটু বুঝতে পারে যে,সত্যিই তো! তিনি তো এক মহাবিপ্লব করে গেছেন। আজ আমরা পরিস্কার বুঝতে পারি যে,ইয়াযিদ কি ছিলো আর মোয়াবিয়া কি ছিলো বা উমাইয়াদের ষড়যন্ত্র কি ছিলো। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আঃ) সেদিনই এর চেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। সেকালে বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মদীনার লোকজন ইমাম হোসাইন (আঃ) কি চান তা অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু ইমাম হোসাইনের (আঃ) নিহত হবার সংবাদ যেদিন তাদের কানে গেলো,অমনি যেন সবার টনক নড়ে উঠলো। সবার একই প্রশ্নঃ হোসাইন ইবনে আলীকে (আঃ) হত্যা করা হলো কেন? এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য মদীনার চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এর প্রধান ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা। তদন্ত কমিটি শামে গিয়ে ইয়াযিদের দরবারে এসে উপস্থিত হলো। মাত্র ক দিন অতিক্রান্ত হতে না হতেই তারা অবস্থাটি ধরে ফেললো। অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তারা শীঘ্রই মদীনায় ফিরে এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো কী দেখে এলেন? জবাবে তারা বললোঃ শুধু এইটুকুই তোমাদের বলি যে,আমরা যে ক দিন শামে ছিলাম সে ক দিন শুধু এ চিন্তায় ছিলাম যে,খোদা এক্ষুণি হয়তো এ জাতিকে পাথর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করবেন! লোকজন বললোঃ কেন,কী হয়েছে? তারা বললোঃ আমরা এমন এক খলিফার সামনে গিয়েছলাম যে প্রকাশ্যে মদ খাচ্ছিলো,জুয়া খেলছিল,কুকুর-বানর নিয়ে খেলা করছিলো,এমন কি বেগানা নারীর সাথে যেনাও করছিলো!

আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার আটজন ছেলে ছিলো। তিনি মদীনার জনগণকে বললেনঃ তোমরা বিদ্রোহ কর আর না করো আমি শুধু আমার আটজন ছেলেকে নিয়ে হলেও বিদ্রোহ করতে যাচ্ছি । কথামতো তিনি তার আটজন ছেলেকে নিয়ে বিদ্রোহ করলেন এবং ইয়াযিদের বিরুদ্ধে‘‘ হাররা বিদ্রোহে’’ প্রথম তার আটজন ছেলের সবাই এবং পরে তিনি নিজেও শহীদ হন। (মুরুজুয যেহাব 3/69)

আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা নিঃসন্দেহে একজন চিন্তাশীল লোক ছিলেন। কিন্তু তিন বছর আগে ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন মদীনা থেকে বেরিয়ে আসনে তখন তিনিও ইমামের (আঃ) কাজকর্ম থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি।

ইমাম হোসাইন (আঃ) বিদ্রোহ করলেন,আন্দোলন করলেন,জানমাল উৎসর্গ করলেন। তিন বছর কেটে গেলো। তারপর আজ এসে আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার মতো ব্যক্তিরও টনক নড়লো। এ হলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার স্বরূপ মাত্র ।

ইমাম হোসাইন (আঃ) এত বড় মহান এক আন্দোলন করে গেলেন। চিরকালীন এক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। সর্বকালের সত্যান্বেষী মানুষ এ আদর্শ থেকে শিক্ষা নেবে,অনুপ্রেরণা এবং নির্দেশনা নিয়ে অন্যায় এবং অসত্যের মূল উপড়ে ফেলবে। তার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ যাতে বিতর্কে না পড়ে এ জন্য সেই প্রথম দিনেই তিনি তা ঘোষণা করে দিলেন। অথচ দুঃখের বিষয় হলো যে,আমাদের কাছে এসে এ আন্দোলনের চেহারা পাল্টে গেছে। এ আন্দোলন সম্পর্কে এমনসব বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে যে,এর তেজ এখন আর নেই। উপরন্তু এসব ব্যাখ্যা আজ যেন মানুষের পাপ বাড়ানোর উসিলা হয়েছে। হয়তো কথাটি একটু খটকা লাগছে। তবুও অপ্রিয় এ সত্য কথা না বলে পারছি না। এখানে হোসাইনী আন্দোলনের আত্মায় বিভ্রান্তিকর অর্থ ঢোকানোর দুটো নমুনা উল্লেখ করা হলোঃ

প্রথমত,বলা হয় যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) শহীদ হলেন যাতে উম্মতের সমস্ত পাপ মাফ হয়ে যায়। এক আজব ব্যাখ্যা!

জানি না মুসলমানরা এ ব্যাখ্যা খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে পেয়েছে কি-না? খ্রীষ্টানরা এ ধরনের ব্যাখ্যায় ওস্তাদ। মুসলমানরা তেমনি খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে অনেক কিছুই ধার করেছে যা ইসলামের পরিপন্থি।

খ্রীষ্টানদের আকীদার একটি মূল অংশ এই যে,তারা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হন খ্রীষ্টানদের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেবার জন্য । অর্থাৎ এখন থেকে খ্রীষ্টানরা যতই পাপ করুক,কোনো ভয় নেই। কেননা হযরত ঈসা (আঃ) আছেন। উম্মতের সব পাপ তার কাঁধেই পড়বে। এ কারণে আজ খ্রীষ্ট সমাজে যত অনাচার,নৈরাজ্য,ব্যভিচার,হত্যা,লুন্ঠন অবাধে চলছে।

জানি না আমরা মুসলমানরা যে বলি ইমাম হোসাইন (আঃ) নিহত হয়েছেন উম্মতের সমস্ত পাপ নিজের কাঁধে তুলে নেবার জন্য,এ বিশ্বাসটাও খ্রীষ্টানদের থেকে আমদানী করা কি-না। এর অর্থ দাঁড়ায় যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) উম্মতের জন্য এক পাপের বীমা খুলেছেন। যে ব্যক্তি এ বীমায় নাম লেখাবে তার আর কোন ভয় নেই। নির্ভয়ে পাপ করে যাক,হত্যা,লুন্ঠন,অত্যাচার,ব্যাভিচার যা পারে করুক। সবকিছুর জন্যই ইমাম হোসাইন (আঃ) আছেন। তিনিই বাঁচাবেন। (নাউযুবিল্লাহ)।

এটি ইমাম হোসাইনের (আঃ) উপর কত বড় এক অবিচার তা আমরা একটুও ভেবে দেখিনি। আমরা হোসাইনী আন্দোলনের এমন এক ব্যাখ্যা করলাম যা ইমাম হোসাইনের (আঃ) লক্ষ্যের যেমন সম্পূর্ণ পরিপন্থি তেমনি তা স্বয়ং ইমাম হোসাইনের (আঃ) মহাত্মার জন্যও অবমাননাকর।

ইমাম হোসাইন (আঃ) চেয়েছেন ইয়াযিদ,শিমার,ইবনে সা দ,ইবনে যিয়াদদের গোড়া কর্তন করতে। আর আমরা বলি,একটা ইয়াযিদ,একটা শিমার,একটা ইবনে যিয়াদ,একটা ইবনে সা দ কম ছিলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) নিজের জানমাল বিসর্জন দিলেন যাতে উম্মত অবাধে পাপ করতে পারে এবং দুনিয়াতে আরও ক জন ইয়াযিদ,আরও ক জন শিমার,আরও ক জন ইবনে সা দের জন্ম হয়! যেন ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেনঃ হে ভাইসকলঃ যা ইচ্ছে তাই করো,আমি তোমাদের পাপের বীমা হলাম। তোমরা চেষ্টা কর যাতে ইয়াযিদ হতে পারো,শিমার হতে পারো,(নাউযুবিল্লাহ)।

এ হলো মিত্রদের হাতে ইমাম হোসাইনের (আঃ) অসহায় হবার এক উদাহরণ। ইমাম হোসাইনের (আঃ) মহান আদর্শের মহান উদ্দেশ্যকে আমরা একেবারে 180 ডিগ্রী বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে এটিকে ভোঁতা করে দিয়েছি,এটিকে পাপী তৈরীর আন্দোলনে পরিণত করেছি।

দ্বিতীয় যে ভ্রষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে হোসাইনী আদর্শকে অসার ও প্রভাবহীন করে দেয়া হয়েছে তা হলোঃ আরেকটি দল মুসলমান বলে থাকে ইমাম হোসাইন (আঃ) বিদ্রোহ করে নিহত হলেন এটি ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ভাগ্য লেখা ছিলো। তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যাস,এ নিয়ে আপনার আমার মাথা ঘামানোর কিছু নেই। অর্থাৎ হোসাইনী আদর্শ অনুকরণ করার কোনো যুক্তি নেই এবং ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথে আমাদের সম্পর্ক থাকতে হবে এরও কোনো আবশ্যকতা নেই। কেননা এটি ইসলামের মূল করণীয় বিষয়গুলোর অন্তর্ভূক্ত নয়।

একবার ভেবে দেখুন যে,হযরত ইমাম হোসাইনের (আঃ) কথার সাথে আমাদের কথার কত ক্রোশ ব্যবধান? ইমাম হোসাইন (আঃ) চিৎকার করে বললেন যে,আমার বিদ্রোহের কারণ ইসলামের মৌলিক ও সার্বিক বিষয়াদির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর আমরা বলছি এটি একটি বিশেষ ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এ নিয়ে মাতামাতি করার কোনো দরকার নেই।

ব্যক্তিগত কর্তব্য তাকেই বলা যায় যার সাথে সার্বজনীন করণীয় কোনো বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। অথচ আমরা সবাই ভালভাবে জানি এবং ইমাম হোসাইন (আঃ) নিজেও বলেছেন যে,ইসলাম কোনো মুমিনকে জুলুম,অত্যাচার,সামাজিক অধঃপত প্রভৃতির প্রেক্ষিতে নাকে তেল ঢেলে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অনুমতি দেয় না। ইমাম হোসাইনের (আঃ) আদর্শ ছিলো ইসলামী আদর্শেরই এক বাস্তব প্রতিফলন। হোসাইনী আদর্শ ইসলাম বহির্ভূত পৃথক কোনো আদর্শ নয়। ইসলাম যা বলেছে ইমাম হোসাইন (আঃ) তার বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু আমরা হোসাইনী আন্দোলনকে এক অনুকরণীয় আদর্শ হবার অনুপযুক্ত করে দিয়েছি। আর যখনই এটি আদর্শ হবার অনুপযুক্ত হয়ে গেলো তখন এর আনুকরণ করারও প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না। অর্থাৎ ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলনে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছুই নেই। এভাবে আমরা হোসাইনী আন্দোলনকে এক অনুকরণীয় আদর্শ হবার অনুপযুক্ত করে দিয়েছি। আর যখনই এ আদর্শ হবার অনুপযুক্ত হয়ে গেলো তখন এর আনুকরণ করারও প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না। অর্থাৎ ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলনে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছুই নেই। এভাবে আমরা হোসাইনী আন্দোলনকে মূল্যহীন এক ঘটনায় পরিণত করেছি। আর এ ছিলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) উপর চালিত সর্বশেষ জুলুম যা মিত্রদের পক্ষ থেকেই তার উপর চালানো হয়।

অনেকে আবার এই বলে চোখের পানি ঝরাতে থাকে যে,নবীর (সাঃ) সন্তান ইমাম হোসাইনকে (আঃ) বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চায় যে ইমাম হোসাইন (আঃ) নির্দোষ ছিলেন তবে দুঃখ হলো যে তাকে মজলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। শুধু এটিই তাদের আফসোস। অনর্থক তার রক্ত ধুলায় মেখেছে। তারা চোখের পানি দিয়ে যেন হযরত ফাতেমাকে (আঃ) সান্তনা দিতে চায়। এর চেয়ে বোকামি আর কী আছে?

পৃথিবীতে যদি কোনো একজন লোক তার রক্তের প্রতিটি ফোটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য দান করে থাকেন তাহলে তা একমাত্র ইমাম হোসাইন (আঃ) পেরেছেন। সেই 61 হিজরী থেকে আজ 1415 হিজরী পর্যন্ত ইমাম হোসাইনের (আঃ) নামে যত টাকা-পয়সা খরচ করা হয়েছে তা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে তার প্রতি ফোটা রক্তের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যে ব্যক্তির নাম সর্বযুগের স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের রাজ প্রাসাদ নড়বড়ে করে দিয়েছে তিনি কি বৃথা নিহত হলেন!

তাই আমরা যারা আফসোস করে বলি যে,মজলুম ইমাম হোসাইন (আঃ) অকারণে নিহত হয়েছেন তাদের জানা উচিত যেঃ

حُسَيْنُ مِنِّي وَ اَنَا مِنْ حُسَيْنٍ

ইমাম হোসাইনের (আঃ) মাকামে একমাত্র শাহাদাতের মাধ্যমেই পৌঁছানো সম্ভব। তিনি শ্রেষ্ঠ মাকামের অধিকারী। তাই আমাদের তার নিহত হওয়ার শোকে মূর্ছিত হবার কোনো যুক্তিই নেই। আফসোসই যদি করতে হয় তাহলে আমাদের নিজেদের জন্য করা উচিত। আমাদের এ উদ্দেশ্যে চোখের পানি ঝরানো উচিত যাতে ইমাম হোসাইনের (আঃ) ঈমান,দৃঢ়তা,সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা,মুক্তি কামিতা,সৎসাহস,বীরত্ব,তাকওয়া প্রভৃতির সাগর থেকে এক বিন্দু হলেও যেন আমাদের ভাগ্যে জোটে।

হোসাইনী আদর্শ হুবহু টিকিয়ে রাখার জন্য এতো তাকিদ করার কারণও হলো এটিই। আমরা যদি হোসাইনী আত্মার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি,ইমাম হোসাইনের (আঃ) ঈমান,একত্ববাদ,মুক্তি কামিতা,তাকওয়া,সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে আমরা যদি সামান্যটুকুও লাভের আশায় চোখের পানি ঝরাতে পারি তাহলে এ চোখের পানির মূল্য অপরিসীম। এ অশ্রু একটি মাছির পাখনার সমান সূক্ষ্ণ হলেও তার মূল্য কেউ দিতে পারবে না। ইমাম হোসাইন (আঃ) আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই আদর্শের খাঁটি অনুসারী হবার আশায় কাঁদলে সে কান্নারও মূল্য আছে।

হোসাইনী আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে উপর্যুপরি তাকিদ করা হয়েছে যাতে মানুষ ইসলামের এই বাস্তব চেহারাকে সরাসরি দেখতে পারে। মানুষ নবী (সাঃ) বংশের এই ঈমান দেখে নবীর (সাঃ) নবুয়্যতকে সত্য বলে বুঝতে পারবে। কেউ যদি অসীম বীরত্ব ও ঈমানের পরিচয় দিয়ে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয় তবুও এটি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) রিসালাতের সত্যতার জন্য তেমন কোনো দলিল হতে পারে না। কিন্তু নবীর (সাঃ) সন্তান হযরত ইমাম হোসাইনকে (আঃ) ঐ অসীম ঈমান,সাহস,বীরত্ব,তৌহিদী অবস্থায় শহীদ হতে দেখে যে কেউই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) রিসালাতের সত্যতা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর কোনো লোক হযরত আলীর (আঃ) চেয়ে বেশী সময় রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সান্নিধ্য পায়নি। রাসূলের (আঃ) ঘরেই তিনি বড় হন। তাকে দেখে মানুষ যেমন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) রেসালাতের সত্যতাকে অনুধাবন করতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাসূলের (সাঃ) সন্তানকেই যখন অসীম ঈমান ও বিশ্বস্ততার সাথে দেখে তখনও মানুষ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) রিসালাতের সত্যতা অনুধাবন করতে পারে। কেননা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) তাজাল্লী ইমাম হোসাইনের (আঃ) মধ্যে দেখা যায়। মুসলমানরা ঈমান শব্দটি কতই শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কমই দেখেছ। ইমাম হোসাইনের (আঃ) দিকে তাকালেই এই ঈমানের প্রতিফলন দেখতে পায়। মানুষ অবাক হয়ে বলতে বাধ্য হয় যে,মানুষ কোথায় পৌঁছতে পারে!! মানুষের আত্মা এত পরিমাণ অভঙ্গুর হতে পারে!! তার দেহকে খণ্ড -বিখণ্ড করা হয়,যুবক পুত্রকে তার চোখের সামনে ছিন্ন-ভিন্ন করা হয়,তৃষ্ণার চোটে আকাশের দিকে চেয়ে যার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে,পরিবার-পরিজনদেরকে একই শিকলে বেঁধে বন্দী করা হয়,সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হন। কিন্তু শুধু মাত্র যে জিনিস অক্ষয় হয়ে রয়ে গেছে তা হলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) আত্মা। এ আত্মার কোনো ধ্বংস নেই।

পৃথিবীতে আর মাত্র একটি ঘটনা খুজে বের করুন যাতে সমস্ত মানিবক গুণাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রক্ষিত ও প্রতিফলিত হয়েছে। কারবালা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো ঘটনায় যদি তা পাওয়া যেত তাহলে আমরা এখন থেকে কারবালার ঘটনাকে রেখে সেটাকেই স্মরণ করবো। কোথাও পাবেন না।

সুতরাং কারবালার মতো ঘটনাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে ঘটনায় আত্মিক ও মানিসক উভয় দিক দিয়ে মাত্র 72 জনের এক বাহিনী ত্রিশ হাজার লোকের বাহিনীকে পরাজিত করেছে। তারা সংখ্যায় মাত্র 72 জন ছিলেন এবং মৃত্যু যে নির্ঘাত এটিও তারা নিশ্চিতভাবে জানতেন। তবুও কিভাবে তারা ত্রিশ হাজারের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেন?

প্রথমত তারা এমন শক্তিতে শক্তিমান ছিলেন যে,শত্রুদের থেকে হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহীর মতো ত্রিশ জনের অধিক লোককে বেঁচে থাকার ঘাঁটি থেকে নির্ঘাত মৃত্যুর ঘাঁটিতে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু মৃত্যু ঘাঁটি থেকে একজন লোকও ইয়াযিদের দুনিয়াবি ঘাঁটিতে যায়নি। তাহলে বুঝতে হবে যে,এ ঘাঁটিতে সংখ্যা কম এবং নিশ্চিত হলেও এখানে শক্তি -সামর্থ অনেক বেশী যা দিয়ে শত্রুদেরকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

দ্বিতীয়ত আরবের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী একজনের মোকাবিলায় অন্য আরেকজন যুদ্ধ করতো। কারবালায় ইবনে সা দ প্রথমে এভাবেই যুদ্ধ করতো রাজি হয়। কিন্তু যখন দেখলো যে,এভাবে যুদ্ধ করলে ইমাম হোসাইনের (আঃ) একজন সৈন্যই তার সমস্ত সৈন্যকে সাবাড় করে দিতে যথেষ্ট তখন সে এ যুদ্ধ বর্জন করে দল বেঁধে আক্রমণ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলো।

আশুরার দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একে একে 71 জন শহীদের লাশকে ইমাম হোসাইন কাঁধে বয়ে তাঁবুতে নিয়ে এসেছেন। তাদের কাছে গিয়ে অভয় বাণী দিয়েছেন,তাঁবুতে এসে সবাইকে শান্ত করেছেন,এছাড়া তিনি নিজেও কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। 57 বছরের একজন বৃদ্ধলোক এত ক্লান্ত,শ্রান্ত অবস্থায় যখন ময়দানে এলেন তখন শত্রুরা ভেবেছিলো হয়তো সহজেই তাকে পরাস্ত করা যাবে। কিন্তু একটু পরেই তাদের সব আশা-ভরসা উড়ে গেলো। ইমাম হোসাইনের (আঃ) সামনে যে-ই এলো এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারলো না। ইবনে সাদ এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলে উঠেঃ

هَذَا ابْنُ قَتَّالِ الْعَرَبِ

‘‘ তোমরা জান এ কার সন্তান? এ তারই সন্তান যে সমস্ত আরবকে নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। এ শেরে খোদা আলীর (আঃ) সন্তান।’’ ( মাকতালু মোকাররমঃ 346 বিহারুল আনওয়ারঃ 45/59 মানাকিবে ইবনে শাহের অশুবঃ 4/110)

 وَاللهِ نَفْسُ اَبِيهِ بَيْنَ جَنْبَيْهِ

তারপর বলে :‘‘ আল্লাহর শপথ করে বলছি,তার দু বাহুতে তার বাবার মতোই শক্তি । আজ যে তার মোকাবিলায় যাবে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।’’ এটি কি ইবনে সা দের পরাজয়ের প্রমাণ নয়? ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে যে একজন ক্লান্তশ্রান্ত,বয়োবৃদ্ধ,অপরিমেয় দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পশ্চাদপসরণ করে ছুটে পালায় এটি কি তাদের পরাজয় নয়? ( ইরশাদে মুফিদঃ 230 বিহারুল আনওয়ারঃ 44/390)

তারা তলোয়ারের মুখে যেমন পরাজয় বরণ করে তেমনি ইমাম হোসাইনের (আঃ) চিন্তাধারার কাছেও তাদের হীন চিন্তাধারা পরাজিত হয়।

আশুরার দিন যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে ইমাম হোসাইন (আঃ) -তিনবার বক্তৃতা দান করেন। এ বক্তৃতাগুলো প্রত্যেকটি বীরত্বপূর্ণ ছিলো। যাদের বক্তৃতা করার অভ্যাস আছে তারা হয়তো জানেন যে বক্তৃতার ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত মানসিকতার দরকার হয়। সাধারণ অবস্থায় মানুষ একটি অসাধারণ বক্তব্য রাখতে পারে না। যে হৃদয় আঘাত পেয়েছে সে ভালো মার্সিয়া পড়তে পারে। যার হৃদয় প্রেমে ভরা সে ভালো গজল গাইেত পারে। তেমনি কেউ যদি বীরত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করতে চায় তাহলে তার অস্তিত্ব বীরের ভাবানুভবে ভরা থাকতে হবে। ইমাম হোসাইন (আঃ) আশুরার দিনে যখন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তখন ইবনে সা দ চিন্তায় পড়ে গেল। সবার কানে যাতে ইমামের কথা পৌঁছায় সে জন্য ইমাম হোসাইন (আঃ) একটি উচু জায়গা হিসাবে উটের পিঠে উঠে দাঁড়ালেন এবং চিৎকার করে বললেনঃ

تَبّاً لَكُمْ اَيَّتُهَا الْجَمَاعَة وَ تَرْحاً حيْنَ اسْتَصْرَخْتُمُونَا وَالِهين فَاَصْرَخْنَاآکمْ مُوجِفِينَ

‘‘ হে জনগোষ্ঠি! তোমাদের জন্য ধ্বংস এ জন্য যে,তোমরা জটিল পরিস্থিতিতে আমার সাহায্য চেয়েছো। আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছি। কিন্তু যে তরবারী আমার সাহায্যে পরিচালনার শপথ তোমরা নিয়েছিলে আজ আমাকে হত্যার জন্য সে তরবারী হাতে নিয়েছো।’’ ( আল-লুহুফঃ 41 তুহফাল উকুলঃ 173 মানাকিবে ইবনে শাহরে অশুবঃ 4/110 মাকতালু মোকাররামঃ 286/6)

সত্যিকার অর্থে হযরত আলীর (আঃ) জ্ঞানগর্ভমূলক বাগ্মিতার পর এ ধরনের বক্তৃতা আর খুজে পাওয়া যায় না। ইমাম হোসাইনের (আঃ) বক্তৃতায় যেন হযরত আলীরই (আঃ) বিচক্ষণতা। যেন সেই জ্ঞান,সেই সাহস,সেই বীরত্ব । ইমাম হোসাইন (আঃ) এ কথা তিনবার চিৎকার করে বললেন। তাতেই ইবনে সাদের মনে ভয় ঢুকে গেলো যে,এভাবে কথা বলতে দিলে এক্ষুণি তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে। তাই ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন চতুর্থ বারের মত কথা বলতে যাবেন এ সময় পরাজিত মনোবৃত্তি নিয়ে কাপুরুষ ইবনে সাদ নির্দেশ দিল যে,সবাই হৈ-হুল্লোড় করে উঠবে যাতে ইমাম হোসাইনের (আঃ) কথা কেউ শুনতে না পারে। এটি কি পরাজয় নয়? এটি কি ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিজয় নয়?

মানুষ যদি ঈমানদার হয়,একত্ববাদী হয়,যদি আল্লাহর সাথে নিগুঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেত পারে এবং পরকালে বিশ্বাসী হয় তাহলে একাই বিশ-ত্রিশ হাজার সুসজ্জিত সৈন্যকে মানসিকভাবে পরাস্ত করতে পারে। এটি কি আমাদের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় নয়? এরূপ উদাহরণ আপনি দ্বিতীয়টি পাবেন কোথায়? পৃথিবীতে একজন লোক কুজে বের করুন,যে ইমাম হোসাইনের (আঃ) মত দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়েও মাত্র দুটো শব্দ ইমাম হোসাইনের (আঃ) মতো বলতে পারে।

হোসাইনী আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার জন্য এত তাকিদ করার কারণ হলো যে আমরা এটিকে সঠিক ভাবে বুঝবো,এর অনাবিস্কৃত রহস্যগুলো উদ্ধার করবো এবং তা থেকে শিক্ষা নেব। আমরা যাতে ইমাম হোসাইনের (আঃ) মহত্বকে অনুধাবন করতে পারি এবং যদি দু ফোটা চোখের পানি ঝরাই তা যেন সম্পূর্ণ মারেফাত সহকারে এবং জেনেশুনে ঝরাতে পারি। ইমাম হোসাইনের (আঃ) পরিচিতি আমাদেরকে উন্নত করে,আমাদেরকে মানুষ করে গড়ে তোলে,আমাদেরকে মুক্তি দান করে। আমাদেরকে সত্য,হকিকত এবং ন্যায়ের শিবিরে নিয়ে যায় এবং একজন খাঁটি মুসলমান তৈরী করে দেয়। হোসাইনী আদর্শ মানুষ গড়ার আদর্শ,পাপী তৈরী করার আদর্শ নয়। হোসাইনের (আঃ) শিবিরি সৎ কর্মীর শিবিরি,পাপীদের এখানে কোন আশ্রয় নেই।

ইতিহাসে আছে,আশুরার দিন ভোর বেলায় ইমাম হোসাইন নামাজ সেরে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললেন,তৈরী হয়ে যাও। মৃত্যু এ দুনিয়া থেকে ঐ দুনিয়ার পার হবার জন্য একটা সাকো বৈ কিছুই নয়। একটা কঠিন দুনিয়া থেকে তামাদেরকে একটা মর্যাদাশালী মহান জগতে পার করে দেব। এ ছিলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) বক্তব্য । এ ঘটনাটি ইমাম হোসাইন (আঃ) বর্ণনা করেননি। কারবালায় যারা উপস্থিত ছিলো তারাই বর্ণনা করেছে। এমন কি ইবনে সা দের বিশিষ্ট রিপোর্টার হেলাল ইবনে নাফেও এ ঘটনা বর্ণনা করেছে যে,আমি হোসাইন ইবনে আলীকে (আঃ) দেখে অবাক হয়ে যাই। তার শেষ মুহূর্ত যতই ঘনিয়ে আসছিলো এবং যতই তার কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠছিলো ততই তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো । যেন দীর্ঘ বিরহের পর কারো তার আপনজনের সাথে মিলনের সময় হয়েছে। আরও বলে যেঃ

 لَقَدْ شَغَلَنِي نُورُ وَجْهِهِ جَمَال هَيْبَتِهِ عَنِ الْفِكْرَةِ فِي قَتْلِهِ

এমনকি যখন অভিশপ্ত শিমার ইমাম হোসাইনের শিরচ্ছেদ করছিলো তখন আমি তার চেহারায় এমন প্রসন্নতা এবং উজ্জ্বলতা দেখেছিলাম যে তাকে হত্যা করার কথা একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। (আল লুহুফঃ 53, বিহারুল আনওয়ারঃ 45/57)