চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98340
ডাউনলোড: 8163


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98340 / ডাউনলোড: 8163
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1. হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)

খলীলুর রাহমান (মহান আল্লাহর বন্ধু) হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনচরিত বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্য হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও পরিচিতি লাভ করা। কারণ মহানবীর সম্ভ্রান্ত বংশধারা ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট। আর যেহেতু এ দু জন এবং মহানবীর কতিপয় মহান পূর্বপুরুষ আরব জাতি ও ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সেজন্য আমরা সংক্ষেপে তাঁদের বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করা সংগত বলেই মনে করছি। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ঘটনাসমূহ এ ধর্মের শুভ অভ্যুদয়ের সমকালীন ঘটনা অথবা ইসলামপূর্ব অতীত ঘটনাবলীর সাথে শিকলের গ্রথিত আংটা বা কড়াসমূহের ন্যায় পরস্পর সংযুক্ত ও গ্রথিত।

উদাহরণস্বরূপ পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিব কর্তৃক শৈশবে মহানবী (সা.)-এর লালন-পালন,পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের অশেষ কষ্ট বরণ এবং মহানবীর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দান ও পৃষ্ঠপোষকতা,বনি হাশিমের উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা এবং বনি উমাইয়্যার শত্রুতার মূল উৎস ও কারণ ইসলামের ইতিহাসের ঘটনাবলীর মৌলিক ভিত্তিমূল হিসাবে গণ্য। এ কারণেই এ ধরনের আলোচনাসমূহের জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করা হয়েছে।

তাওহীদের মহানায়ক হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনের অনেক সমুজ্জ্বল অধ্যায় ও দিক রয়েছে। তাওহীদের প্রসার এবং শিরক ও মূর্তিপূজার মূলোৎপাটনের পথে তাঁর অক্লান্ত সাধনা,সংগ্রাম ও শ্রম,তারকা পূজারীদের সাথে তাঁর তাত্ত্বিক,তাৎপর্যমণ্ডিত ও ক্ষুরধার আলোচনাসমূহ সত্যান্বেষীদের জন্য তাওহীদের সর্বোচ্চ পাঠ ও শিক্ষা বলে গণ্য যা আমাদের জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্মভূমি

হযরত ইবরাহীম (আ.) এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা পুরোপুরি মূর্তিপূজা,শিরক ও মানবপূজায় লিপ্ত ছিল। মানুষ নিজ হাতে নির্মিত মূর্তি ও তারকারাজির কাছে মাথা নোয়াত।

বাবিল বা ব্যাবিলন নগরী ছিল তাওহীদের মহান পতাকাবাহী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্মভূমি। ঐতিহাসিকগণ এ নগরীকে পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি বলে গণ্য করেছেন। আর এ নগরীর উন্নত কৃষ্টি ও সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে বিশদ আলোচনা হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোট লিখেছেন : ব্যাবিলন নগরী বর্গাকৃতিতে তৈরি করা হয়েছিল যার (চতুর্দিকের) প্রতিটি পাশের দৈর্ঘ্য 120 ফারসাখ এবং পরিধি 480 ফারসাখ ছিল।80 যদিও এ বর্ণনাটি অতিশয়োক্তির দোষে দুষ্ট তারপরও একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা (এতৎসংক্রান্ত লিখিত অন্যান্য তথ্য ও গ্রন্থ বিবেচনায় আনলে) এ বর্ণনা থেকে ভালোভাবে উন্মোচিত হয়। কিন্তু আজ দজলা ও ফোরাতের মাঝখানে ছোট-খাটো একটি মাটির টিলা ব্যতীত ঐ সময়ের চিত্তাকর্ষক দৃশ্যাবলী,উঁচু উঁচু সুরম্য প্রাসাদ ও ভবনের আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। এখন ঐ জায়গার সর্বত্র মৃত্যুপুরীর নীরবতা বিরাজমান। তবে কখনো কখনো প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বাবিল নগরী ও রাজ্যের জনগণের সভ্যতার স্বরূপ জানা ও বোঝার জন্য খননকার্য চালানোর ফলে সেখানকার এ নীরবতার জাল ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলেন।

নমরুদ বিন কিনআন-এর রাজত্বকালে তাওহীদের মহানায়ক হযরত ইবরাহীম (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও নমরুদ মূর্তিপূজক ছিল,তথাপি সে জনগণের কাছে নিজেকে খোদা’বলে দাবি করত। সম্ভবত আশ্চর্যই লাগতে পারে যে,কিভাবে একই ব্যক্তি মূর্তিপূজক,আবার একই সাথে সে জনগণের কাছে নিজেকে খোদা’বলে দাবি করে? আর ঠিক মিশরের ফিরআউনের ব্যাপারেও আমরা পবিত্র কোরআন থেকে এ ধরনের বিষয়ই জেনেছি (অর্থাৎ ফিরআউন মূর্তিপূজক হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে খোদা’বলে দাবি করেছিল)। যখন মূসা ইবনে ইমরান (আ.) শক্তিশালী যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ফিরআউনের প্রশাসন ও সরকারের ভিত টলিয়ে দিয়েছিলেন তখন ফিরআউনের সমর্থকগণ প্রতিবাদী কণ্ঠে তাকে (ফিরআউনকে) সম্বোধন করে বলেছিল,

) أ تذر موسى و قومه ليفسدوا في الأرض و يذرك و آلهتك(

“আপনি কি মূসা ও তার কওমকে পৃথিবীর বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবেন? সে আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।” (সূরা আরাফ : 127)

এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে,ফিরআউন নিজেকে খোদা বলে দাবি করত এবং

) أنا ربّكم الأعلى(

আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রভু 81   ও

 ) ما علمت لكم من إله غيري(

আমি ব্যতীত তোমাদের যে আর কোন উপাস্য আছে তা আমি জানি না 82

-এ কথাগুলো বলত,অথচ সে ঐ একই সময় মূর্তিপূজকও ছিল। কিন্তু মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের যুক্তিতে এতে কোন অসুবিধা নেই যে,কোন ব্যক্তি কোন এক গোষ্ঠীর খোদা ও উপাস্য হবে,অথচ ঐ একই সময় উক্ত উপাস্যও তার চেয়ে বড় খোদার পূজা করবে। কারণ খোদা ও উপাস্য শব্দের অর্থ বিশ্বব্র‏‏ হ্মাণ্ডের স্রষ্টা নয়,বরং এমন সত্তা যার অন্যদের ওপর কোন এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে এবং তাদের জীবনের সর্বময় কর্তৃত্ব তার হাতেই ন্যস্ত। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে : রোমে কোন এক বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণকে বংশের অন্যান্য সদস্য পূজা করত,অথচ ঐ একই সময় ঐ সব পূজিত বয়োজ্যেষ্ঠগণেরও নিজস্ব উপাস্য ছিল যার পূজা তারা করত।

সবচেয়ে বড় যে দুর্গ নমরুদ নিজ হাতের মুঠোয় এনেছিল তা ছিল (তার প্রতি) একদল জ্যোতির্বিদ ও ভবিষ্যদ্বক্তার সমর্থন,মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ। এ সব জ্যোতির্বিদ ও ভবিষ্যদ্বক্তা সে যুগের জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতো। তাদের নমরুদের প্রতি ভক্তি ও বিনয় সমাজের নিম্ন ও অজ্ঞ শ্রেণীকে দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অধিকন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আযরের মতো ব্যক্তিবর্গও ছিল। আযর ছিল মূর্তিনির্মাতা এবং সে তারকারাজির অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত। সে নমরুদের একজন সভাসদও হয়েছিল। আর এ বিষয়টিও হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জন্য এক বিরাট অন্তরায় ছিল। কারণ জনগণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছাড়াও তিনি তাঁর নিজ আত্মীয়-স্বজনদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

যখন নমরুদ স্বপ্নিল জীবনের মধ্যে বুঁদ ছিল ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে জ্যোতির্বিদগণ বিপদের প্রথম ঘণ্টা বাজিয়ে বলল, তোমার হুকুমত এমন এক ব্যক্তির হাতে ধ্বংস হবে যে এ জনপদেরই সন্তান।” নমরুদের সুপ্ত চিন্তাধারা জাগ্রত হলো এবং সে জিজ্ঞেস করল, সে কি জন্মগ্রহণ করেছে না করে নি? তারা বলল, সে এখনও জন্মগ্রহণ করে নি।” রাজা নমরুদ জ্যোতির্বিদদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যে রাতে তার উক্ত ভয়ঙ্কর শত্রুর ভ্রুণ মাতৃগর্ভে স্থিতি লাভ করবে সে রাতে সক্ষম নারী-পুরুষদের বিচ্ছিন্ন রাখার আদেশ দিয়েছিল। বর্ণনা অনুসারে নমরুদের জল্লাদরা ছেলে শিশুদের হত্যা করত। ধাত্রীদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারা যেন নবজাতক শিশুদের মুখ নমরুদের বিশেষ দফতরে পাঠিয়ে দেয়।

ঘটনাক্রমে যে রাতে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সে রাতেই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পবিত্র ভ্রুণ মাতৃগর্ভে স্থিতি লাভ করে। ইবরাহীম (আ.)-এর মা গর্ভধারণ করলেন এবং মূসা ইবনে ইমরানের মায়ের মতোই তাঁর গর্ভধারণকাল গোপনে সমাপ্ত হলো। প্রসব করার পর প্রাণপ্রিয় সন্তান নবজাতক ইবরাহীমকে নিয়ে তাঁর মা শহরের পাশে অবস্থিত এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাঁকে সেখানেই রেখেছিলেন। দিন-রাত যতবার সম্ভব ততবার তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে দেখতে ঐ গুহায় যেতেন। সময় গত হওয়ার সাথে সাথে এ ধরনের অত্যাচার নমরুদকে নিশ্চিত ও নিরুদ্বিগ্ন করে এবং তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে,সে তার রাজত্ব ও রাজসিংহাসনের শত্রুকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে।

ইবরাহীম (আ.) পুরো 13 বছর ঐ গুহায় কাটিয়েছিলেন। স্মর্তব্য যে,ঐ গুহাটির একটি সরু প্রবেশপথ ছিল। 13 বছর পর ইবরাহীম (আ.)-এর মা তাঁকে গুহার বাইরে নিয়ে আসেন। ইবরাহীম (আ.) জনপদে পদার্পণ করলেন। নমরুদপন্থীদের জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়লে তাঁর মা বললেন, এ আমার সন্তান;জ্যোতির্বিদদের ভবিষ্যদ্বাণী করার আগেই সে জন্মগ্রহণ করেছিল।”83

ইবরাহীম (আ.) গুহা থেকে বের হয়ে এসে ভূপৃষ্ঠ,আকাশ,উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ও তারকারাজি এবং বৃক্ষসমূহের সবুজ-শ্যামল হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তাঁর ফিতরাতগত তাওহীদী (توحيد فطري ) আকীদা-বিশ্বাসকে পূর্ণতর করেন।84 সমাজ ও জনপদে পদার্পণ করেই হযরত ইবরাহীম (আ.) কতিপয় ব্যক্তিকে তারকারাজির ঔজ্জ্বল্যের সামনে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি বিকিয়ে দিতে দেখলেন। তিনি আরেক দলকে দেখতে পেলেন যে,তাদের চিন্তাধারার পর্যায় পূর্বোক্ত গোষ্ঠীর চেয়েও নিকৃষ্ট এ কারণে যে,তারা কাঠ বা পাথর নির্মিত প্রতিমার পূজায় রত। আর এ সব কিছুর চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যাপার যা তিনি দেখতে পেলেন তা ছিল এই যে,এক ব্যক্তি (নমরুদ) জনগণের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে খোদা বলে দাবি করছে।

হযরত ইবরাহীম (আ.) তাই এ তিন রণাঙ্গনে সংগ্রাম করার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে হযরত ইবরাহীম যে এ তিনটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম করেছিলেন তা বর্ণিত হয়েছে।

মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সংগ্রাম

মূর্তিপূজার নিকষ কালো আঁধার সমগ্র ব্যাবিলন রাজ্যকে গ্রাস করেছিল। পার্থিব ও স্বর্গীয় অগণিত মিথ্যা খোদা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বিবেক-বুদ্ধি কেড়ে নিয়েছিল। তারা কতিপয় মিথ্যা খোদাকে মহাশক্তির এবং আরো কিছু মিথ্যা খোদাকে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে বিশ্বাস করত।

মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে মহান নবী-রাসূলদের পথ ও রীতিনীতি যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ মানুষের হৃদয়ের সাথে তাঁদের সম্পর্ক। আর তাঁরা চান এমন এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যা ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থা বাহুবল ও তরবারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মহান নবীদের শাসনব্যবস্থা এবং নমরুদ ও ফিরআউনদের শাসনব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনভাবে তাদের শাসনকর্তৃত্ব  ও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা,যদিও তাদের প্রশাসন তাদের মৃত্যুর পর ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ (মহান নবিগণ ও তাঁদের অনুসারিগণ) এমন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান যা প্রকাশ্যে ও গোপনে,শাসকের ক্ষমতা-অক্ষমতার সময়,তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরবর্তীকালে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম। অর্থাৎ তাঁরা মানব জাতির হৃদয়ে কর্তৃত্ব করেন-দেহের ওপর নয়। আর এ মহান লক্ষ্যটি কখনই জোর করে বাস্তবায়িত হবে না।

হযরত ইবরাহীম (আ.) শুরুতেই নিজ আত্মীয়-স্বজনদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। আযর তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নেতৃত্ব দিত। এ সংগ্রামে পুরোপুরি সাফল্য আসতে না আসতেই85 ইবরাহীম (আ.) সংগ্রামের আরেকটি ক্ষেত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ দলটির চিন্তাধারার পর্যায় পূর্বোক্ত প্রথম দলটির চিন্তাধারা থেকে কিছুটা উন্নত ছিল। কারণ তারা হযরত ইবরাহীমের জ্ঞাতি-গোত্রের অনুসৃত রীতিনীতি ও ধর্মমতের বিপরীতে ভূলোকের নীচ ও হীন অস্তিত্ববান সত্তাসমূহকে পরিত্যাগ করে নভোমণ্ডলীয় গ্রহ,জ্যোতিষ্ক ও তারকারাজির পূজা করত। ইবরাহীম (আ.) মহাজাগতিক নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের পূজা-অর্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে কতগুলো ধারাবাহিক দার্শনিক ও তাত্ত্বিক সত্য যা সে সময়ের মানুষের চিন্তা-চেতনায় উদিতই হয় নি তা অত্যন্ত সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ ও যুক্তিসমূহ আজও জ্ঞানী-গুণী,দার্শনিক,তাত্ত্বিক ও কালামশাস্ত্রবিদদের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে যে,পবিত্র কোরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এ কারণেই আমি একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ এ কয়েক পৃষ্ঠায় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বক্তব্য উল্লেখ করব।

ইবরাহীম (আ.) জনগণকে হেদায়েত করার জন্য এক রাতে সূর্যাস্তের শুরু থেকে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত জেগে থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণ করলেন। এ 24 ঘণ্টায় তিনি পূর্বোক্ত তিন দলের সাথে আলোচনা এবং উপরিউক্ত গোষ্ঠীত্রয়ের আকীদা-বিশ্বাস মজবুত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের আলোকে খণ্ডন করেছেন।

রাতের কালো আঁধার ছেয়ে গেল এবং অস্তিত্বজগতের নিদর্শনগুলো সেই কালো আঁধারের মাঝে ঢাকা পড়ে গেল। নভোমণ্ডলীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শুক্রগ্রহ দিকচক্রবাল রেখার কোণে আবির্ভূত হলো। ইবরাহীম (আ.) শুক্রগ্রহের পূজারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বাহ্যত তাদেরই রীতিনীতি অনুসরণ করে বললেন, এ আমার প্রভু।” যখন তা অস্ত গেল এবং এক কোণে আত্মগোপন করল তখন তিনি বললেন, যে খোদা অস্ত যায় তাকে আমি পছন্দ করি না।” তিনি তাঁর বলিষ্ঠ এ যুক্তির আলোকে শুক্রগ্রহের পূজারীদের আকীদা-বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান এবং এর অসারত্ব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেন।

পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টি চাঁদের উজ্জ্বল গোলকের ওপর নিবদ্ধ হয় যার ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য সবাইকে আকৃষ্ট করছিল। তিনি চন্দ্রপূজারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চাঁদকে উপাস্য বলে বাহ্যত স্বীকার করলেন এবং এর পরেই তিনি দৃঢ় শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে এ বিশ্বাসের তীব্র সমালোচনা করলেন। ঘটনাক্রমে মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতা চাঁদকে দিকচক্রবাল রেখায় অদৃশ্য করে ফেলল। আর সে সাথে চাঁদের সকল আলো ও ঔজ্জ্বল্যও হারিয়ে গেল। উপত্যকা ও প্রান্তর কালো আঁধারে ছেয়ে গেল। ইবরাহীম (আ.) সত্যান্বেষীদের মনোবৃত্তি নিয়ে চন্দ্রপূজারীদের অন্তরে ব্যথা না দিয়ে বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আমি নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হয়ে যাব। কারণ তারকাসমূহের ন্যায় চাঁদেরও উদয়-অস্ত আছে। আর তা নিজেই এমন এক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থার অধীন যা স্থায়ী এবং যাতে বিঘ্ন ঘটানো সম্ভব নয়।”

রাতের আঁধার কেটে গেলে পূর্ব দিকের দিকচক্রবাল রেখার বক্ষভেদ করে সূর্যোদয় হলো। সূর্যের সোনালী আলো মরুপ্রান্তর,উপত্যকা ও পাহাড়ের পাদদেশ আলোকোদ্ভাসিত করল। সূর্যপূজারীরা তাদের উপাস্যের দিকে নিজেদেরকে রুজু করল। ইবরাহীম (আ.) বিতর্কের মূলনীতি সংরক্ষণ করার ছলে বাহ্যিকভাবে সূর্যকে নিজ প্রতিপালক বলে স্বীকার করলেন। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে তিনি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করলেন যে,সূর্যও এ অস্তিত্বজগতের অমোঘ নিয়মের অধীন। এরপর তিনি সূর্যের উপাস্য হওয়ার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বর্জন করেন।

তখন তিনি উপরিউক্ত গোষ্ঠীত্রয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,

...) إنّي وجّهت وجهي للّذي فطر السّموات و الأرض حنيفا و ما أنا من المشركين(

“নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল (তথা সমগ্র অস্তিত্বকে) একনিষ্ঠ চিত্তে এমন এক সত্তার দিকে নিবদ্ধ করলাম যিনি যমীন ও আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।” (সূরা আনআম: 75-79)

ইবরাহীম (আ.)-এর বক্তব্যের উপলক্ষ ছিল ঐ সব ব্যক্তি যারা চিন্তা করত যে,পার্থিবজগতের যাবতীয় অস্তিত্ববান সত্তার প্রতিপালন ও পরিচালনা,যেমন তন্মধ্যে মানব জাতির অস্তিত্ব ও সৃষ্টির বিষয়টি নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও বস্তুসমূহের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার চাপ অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর ছিল না। যথা : 1. স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ,2. মহান আল্লাহর সত্তার একত্ব ও তিনি যে এক ও অদ্বিতীয় এবং একাধিক খোদার অস্তিত্ব নেই-এ বিষয়টি প্রমাণ করা,3. স্রষ্টার একত্ব (মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন স্রষ্টা নেই অর্থাৎ নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মাত্র একজন)-এ বিষয়টি প্রমাণ,বরং ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রভুত্ব,প্রতিপালন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তাওহীদ বা একত্ববাদ। মহান আল্লাহ্ ব্যতীত সকল অস্তিত্ববান সত্তার প্রভু,পরিচালক ও প্রতিপালক অন্য কোন সত্তা নয়-এ বিষয়টির ওপর তিনি তাঁর আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ কারণেই তিনি নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও পদার্থসমূহের প্রভুত্ব খণ্ডন করার দলিল উপস্থাপন করার পর তৎক্ষণাৎ বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল মহান আল্লাহর দিকেই নিবদ্ধ করেছি যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা।” অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশসমূহের স্রষ্টাই এগুলোর প্রভু,প্রতিপালক ও পরিচালক। কখনই এ নিখিল বিশ্বের একাংশের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কতিপয় নভোমণ্ডলীয় জ্যোতিষ্ক ও তারকার হাতে অর্পণ করা হয় নি। আর তাই স্রষ্টা এবং পালনকর্তা ও পরিচালক এক ও অদ্বিতীয়। ব্যাপারটি এমন নয় যে,মহান আল্লাহ্ স্রষ্টা আর পালনকর্তা তিনি ব্যতীত অন্য সত্তা।

মুফাসসির ও কালামশাস্ত্রবিদগণ যাঁরা পবিত্র কোরআনের তত্ত্বজ্ঞানে গভীরভাবে চিন্তা ও আলোচনা করেছেন তাঁরা ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিরাট ভুল করেছেন। তাঁরা ভেবেছেন যে,ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনা ও কথোপকথনের লক্ষ্য এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের খোদায়ী অস্বীকার করা। অর্থাৎ যে খোদার প্রতি পৃথিবীর সকল জাতি বিশ্বাস রাখে এবং সমগ্র অস্তিত্বজগতই যার অস্তিত্বের নিদর্শন সেই খোদার অস্তিত্ব প্রমাণ। আবার কেউ কেউ ভেবেছেন যে,ইবরাহীম (আ.)-এর উপরিউক্ত আলোচনার আসল উদ্দেশ্য এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের সৃষ্টিক্ষমতা (خالقيّة ) রদ করা। কারণ অনেকেই এমন ধারণা করতে পারে যে,নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ্ এক পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্ববান সত্তাকে সৃষ্টি করার পর কতিপয় অস্তিত্বময় সত্তার কাছে সৃষ্টিকর্তার পদ হস্তান্তর করে থাকতে পারেন। যদি উপরিউক্ত ব্যাখ্যাদ্বয় সঠিক না হয় এবং অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ববান সত্তা (واجب الوجود ) এবং তাঁর তাওহীদ (একত্ব) এবং স্রষ্টার একত্বের শিরোনামে কতিপয় বিষয় মেনে নেয়ার পর তাওহীদে রুবূবী’(প্রভুত্বের ক্ষেত্রে একত্ব) নামের অন্য এক ধরনের তাওহীদ প্রসঙ্গে এবং নিখিল বিশ্বের যে একজন স্রষ্টা ও পালনকর্তা আছেন-এ ব্যাপারে আলোচনা করাই ছিল ইবরাহীম (আ.)-এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডলকে নিবদ্ধ করলাম... -এ আয়াতটি বর্ণিত ব্যাখ্যার সর্বোত্তম দলিল ও সাক্ষ্যপ্রমাণ। এ কারণেই প্রতিপালক এবং তারকা,চন্দ্র ও সূর্যের মতো নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের প্রভুত্বের মধ্যেই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আলোচনার সমগ্র চাপ ও দৃষ্টি নিহিত ছিল।86

আলোচনা পূর্ণ করার জন্য ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণকে আমরা আরেকভাবে ব্যাখ্যা করব :

হযরত ইবরাহীম (আ.) তিন ক্ষেত্রেই এ সব নভোমণ্ডলীয় পদার্থের উদয়-অস্তকে এ বিষয়ের ওপর সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন যে,এ সকল নভোমণ্ডলীয় বস্তু পৃথিবীর প্রপঞ্চ ও ঘটনাবলী,বিশেষ করে মানুষ’নামের প্রপঞ্চটির প্রতিপালন ও পরিচালনা করার কোন যোগ্যতাই রাখে না। এখন প্রশ্ন করা যায় যে,এ সব বস্তুর উদয়-অস্ত কেন এগুলোর প্রতিপালক ও পরিচালক না হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলস্বরূপ?

এ বিষয়টি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা সম্ভব। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা কোন না কোন গোষ্ঠীর জন্য উপকারী। নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের প্রতিপালক ও পরিচালক হওয়ার বিষয়টি অপনোদন করা সংক্রান্ত হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রদত্ত যুক্তিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে,পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন দিক,মাত্রা ও পর্যায় রয়েছে;আর এর প্রতিটি দিক ও পর্যায় কোন না কোন গোষ্ঠীর জন্য উপস্থাপন করা যায়।

ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রদত্ত যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিচে দেয়া হলো :

ক. প্রভু ও প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করার লক্ষ্য হচ্ছে এই যে,দুর্বল অস্তিত্ববান সত্তা তার শক্তি ও সামর্থ্যরে আলোকে পূর্ণতার পর্যায়ে উপনীত হয়। আর এ ধরনের প্রতিপালক ও প্রশিক্ষকের অবশ্যই প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্তিত্ববান সত্তাদের সাথে এমন গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে যে,প্রতিপালক ও প্রশিক্ষক সর্বদা প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সত্তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকবে,তার থেকে কখনই পৃথক হবে না এবং তার সামনে উপস্থিত থাকবে।

যে অস্তিত্ববান সত্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রতিপালিত সত্তার কাছ থেকে অনুপস্থিত থাকে,সম্পূর্ণরূপে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার থেকে সরাসরি আলো ও কল্যাণ উঠিয়ে নেয়,সে কিভাবে ভূলোকের অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের প্রশিক্ষক ও প্রতিপালক হবে? এ কারণেই তারকার উদয়-অস্ত যা মর্ত্যলোকের ঘটনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নিদর্শন তা সাক্ষ্য দেয় যে,মর্ত্যলোকের অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের অন্য কোন প্রশিক্ষক ও প্রতিপালক আছেন যিনি এ ত্রুটি থেকে মুক্ত।

খ. নভোমণ্ডলীয় বস্তুসমূহের উদয়-অস্ত এবং এগুলোর সুশৃঙ্খল গতি সাক্ষ্য দেয় যে,এগুলো সবই আজ্ঞাধীন এবং এমন সব নিয়মের অধীন যা ঐ সব বস্তুর ওপর কর্তৃত্বকারী ও ক্রিয়াশীল। আর এ সব বস্তুর সুশৃঙ্খল নিয়মসমূহ মেনে চলাই এগুলোর দুর্বলতা ও অক্ষমতার দলিলস্বরূপ। এ ধরনের দুর্বল অস্তিত্ববান সত্তাসমূহ অস্তিত্বজগৎ এবং বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা ও প্রপঞ্চের ওপর কর্তৃত্বশীল হতে পারে না। আর পৃথিবীর অস্তিত্ববান সত্তাসমূহ যদি এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুর আলো থেকে উপকৃত হয় তাহলে তা এ সব বস্তুর প্রভুত্বের দলিল বলে গণ্য হবে না,বরং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে,ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এ সব বস্তু এ পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনা ও প্রপঞ্চের বরাবরে দায়িত্ব পালন করে মাত্র;অন্যভাবে বলা যায় যে,এ বিষয়টি নিখিল বিশ্বের যাবতীয় অস্তিত্ববান সত্তার মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক,সামঞ্জস্য,নির্ভরশীলতা ও প্রভাব বিদ্যমান আছে তা প্রমাণ করে।

গ. এ সব (নভোমণ্ডলীয়) বস্তুসমূহের গতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কি হতে পারে? লক্ষ্য কি এটিই যে,এগুলো অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে অথবা এর উল্টোটি? দ্বিতীয়টি মোটেও ভাবা যায় না। আর দ্বিতীয়টি যদি কল্পনা করা হয় তাহলে অস্তিত্ববান সত্তাসমূহের প্রতিপালক ও পরিচালক এ সব নভোমণ্ডলীয় বস্তুর পূর্ণতার পর্যায় থেকে অপূর্ণতা,অস্তিত্বহীনতা ও ধ্বংসের দিকে ধাবমান হওয়ার কোন অর্থই হয় না। আর স্বয়ং এ বিষয়টি (পূর্ণতা থেকে অপূর্ণতার পর্যায়ে অবনতি) থেকে প্রমাণিত হয় যে,অন্য এক প্রতিপালক আছেন যিনি এ সব বাহ্যত শক্তিশালী অস্তিত্ববান সত্তাকে এক পর্যায় থেকে পূর্ণতর পর্যায়ে উন্নীত করেন এবং আসলে তিনিই প্রভু ও প্রতিপালক। আর তিনিই এ সব বস্তু এবং এগুলোর অধীনে যা কিছু আছে সেগুলোকেও পূর্ণতার দিকে পৌঁছে দেন।