চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98288
ডাউনলোড: 8160


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98288 / ডাউনলোড: 8160
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মদীনা আল মুনাওয়ারাহ্

পবিত্র মক্কা নগরীর উত্তরে এ নগরী অবস্থিত। মক্কা থেকে এ নগরীর দূরত্ব 90 ফারসাখ (540 কি.মি.)। এ নগরীর চারপাশে খেজুর ও অন্যান্য ফলের বাগান আছে। মদীনার ভূমি বনায়ন ও চাষাবাদের জন্য অধিকতর উপযোগী।

প্রাক ইসলামী যুগে এ নগরী ইয়াসরিব’(يثرب ) নামে পরিচিত ছিল। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর এ নগরীর নামকরণ করা হয় মদীনাতুর রাসূল’(مدينة الرّسول ) অর্থাৎ রাসূলের নগরী;পরে সংক্ষেপ করার জন্য এর নামের শেষাংশ বাদ দেয়া হলে এ নগরী মদীনা’নামে অভিহিত হয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে,প্রথম যারা এ নগরীতে বসতি স্থাপন করেছিল তারা আমালিকাহ্ (عمالقة ) গোত্রীয় ছিল। এদের পর এখানে ইয়াহুদী,আওস (أوس ) ও খাযরাজ (خزرج ) গোত্র বসতি স্থাপন করে। আওস ও খাযরাজ গোত্র মুসলমানদের কাছে আনসার’(أنصار ) নামে পরিচিত।

একমাত্র হিজায এলাকাই অন্য সকল এলাকার বিপরীতে বহিরাগত বিজেতাদের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের দু পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সভ্যতার নিদর্শন হিজাযে দেখা যায় না। কারণ হিজাযের অনুর্বর ও বসবাসের অযোগ্য ভূমিসমূহ বিজেতাদের কাছে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় তারা সেখানে কোন সেনা অভিযান পরিচালনা করে নি। আর অত্র এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে যে,হাজারো সমস্যা ও প্রতিকূলতা দেখা দেয়ার পর তাদেরকে অবশ্যই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে।

এতৎসংক্রান্ত একটি গল্প প্রচলিত আছে। এ গল্পটি ডিওডোরাস (ديودور ) বর্ণনা করেছেন : গ্রীক সেনাপতি ডিমিত্রিউস্ যখন আরব উপদ্বীপ দখল করার জন্য পেট্রা নগরীতে (হিজাযের একটি প্রাচীন নগরী) প্রবেশ করেন তখন সেখানকার অধিবাসীরা তাঁকে বলেছিল, হে গ্রীক সেনাপতি! আপনি কেন আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চান? আমরা বালুকাময় অঞ্চলের অধিবাসী যা জীবনযাপনের সব ধরনের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত। যেহেতু আমরা কারো বশ্যতা স্বীকার করতে রাজী নই সেহেতু আমরা জীবনযাপনের জন্য এ ধরনের শুষ্ক এবং পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুভূমিকেই বেছে নিয়েছি। অতএব,আমাদের যৎসামান্য উপঢৌকন গ্রহণ করে আমাদের দেশ জয়ের চিন্তা ত্যাগ করুন। আর আপনি যদি আপনার পূর্ব ইচ্ছার ওপর বহাল থাকেন তাহলে আমরা আপনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই যে,অচিরেই আপনাকে হাজারো সমস্যা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আপনার জানা থাকা প্রয়োজন যে, নাবতী রা কখনই তাদের জীবনযাত্রা ত্যাগ করবে না। কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করার পর আপনি কতিপয় নাবতীকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে যদি নিজের সাথে নিয়ে যান এরপরও তারা (বন্দীরা) আপনার কোন উপকারে আসবে না। কারণ তারা কুচিন্তা ও কর্কশ আচরণের অধিকারী এবং তারা তাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে মোটেও ইচ্ছুক নয়।”

গ্রীক সেনাপতি তাদের শান্তিকামী আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরব উপদ্বীপে সেনা অভিযান এবং আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন।2

2.আরব উপদ্বীপের মধ্য পূর্বাঞ্চলীয় অংশ : এ অংশটি আরব মরুভূমি (صحراء العرب ) নামে পরিচিত। নজদ’(النّجد ) এলাকা এ অংশেরই অন্তর্গত এবং তা উচ্চভূমি। এখানে লোকবসতি খুবই কম। আরব উপদ্বীপে সৌদী রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তাদের রাজধানী রিয়াদ নগরী আরব উপদ্বীপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

3. আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ- পশ্চিমাংশ : যা ইয়েমেন নামে প্রসিদ্ধ। এ ভূখণ্ডের দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে 750 কি.মি. এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রায় 400 কি.মি.। বর্তমানে এ দেশের আয়তন 60,000 বর্গমাইল। কিন্তু অতীতে এর আয়তন এর চেয়েও বেশি ছিল। এ ভূখণ্ডের একটি অংশ বিগত 50 বছর ধরে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। এ কারণে ইয়েমেনের উত্তর সীমান্ত নজদ এবং দক্ষিণ সীমান্ত এডেন,পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং পূর্বে আর রুবুল খালী মরুভূমি।3

ঐতিহাসিক সানা (صنعاء ) নগরী ইয়েমেনের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী। আর আল হাদীদাহ্ (الحديدة ) বন্দর হচ্ছে ইয়েমেনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বন্দর যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত।

ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। এর রয়েছে অত্যুজ্জ্বল সভ্যতা। ইয়েমেন তুব্বা’রাজাদের কেন্দ্রস্থল ছিল। এ তুব্বা রাজবংশ দীর্ঘকাল ইয়েমেন শাসন করেছিল। এ দেশটি ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়েমেনকে আরব ভূখণ্ডের চৌরাস্তার মোড়’বলে গণ্য করা হতো। ইয়েমেনে অনেক আশ্চর্যজনক স্বর্ণের খনি ছিল। ইয়েমেনের স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর বিদেশে রফতানী করা হতো।

ইয়েমেনের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। যে যুগে মানব জাতির হাতে ভারী কাজ করার যন্ত্রপাতি ছিল না তখন ইয়েমেনের বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠী সাহস করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

ইয়েমেনের সুলতানদের শাসনকর্তৃত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু তাঁরা জ্ঞানী-গুণী ও সুধীজন কর্তৃক প্রণয়নকৃত ও গৃহীত সংবিধান বা শাসনকার্য পরিচালনা করার বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতেন না। তারা কৃষি ও উদ্যান ব্যবস্থাপনায় অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিল। তারা জমি চাষাবাদ এবং ক্ষেত-খামার ও বাগানসমূহে সেচ দেয়া সংক্রান্ত সূক্ষ্ম বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করেছিল। এ কারণে তাদের দেশ ঐ সময় অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গণ্য হতো।

প্রসিদ্ধ ফরাসী ইতিহাসবিদ গোস্তাব লোবোঁ ইয়েমেন সম্পর্কে লিখেছেন : সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে ইয়েমেন অপেক্ষা আর কোন উর্বর ও মনোরম অঞ্চল নেই।”

দ্বাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ইদ্রিসী সানা নগরী সম্পর্কে লিখেছেন : সেখানে আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেনের রাজধানী অবস্থিত। এ নগরীর প্রাসাদ ও অট্টালিকাসমূহ বিশ্বখ্যাত। শহরের সাধারণ বাড়ি-ঘরও মসৃণ ও কারুকার্যময় পাথর দ্বারা নির্মিত।”

যে সব আশ্চর্যজনক ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রাচ্যবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সর্বশেষ অনুসন্ধান ও খনন কার্যের দ্বারা আবিস্কৃত হয়েছে তা ইয়েমেনের বিভিন্ন এলাকা,যেমন মারাব,সানা ও বিলকীসে ইয়েমেনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বিস্ময়কর সভ্যতাকেই প্রমাণ করে।

মারাব শহরে (প্রসিদ্ধ সাবা নগরী) গগনচুম্বী প্রাসাদসমূহের ফটকসমূহ এবং ঐগুলোর খিলান ও তাক স্বর্ণের কারুকার্য দ্বারা সুশোভিত ছিল। এ শহরে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত পাত্র এবং ধাতুনির্মিত খাট ও বিছানা ছিল।4

মারাবের ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম হচ্ছে মারাবের প্রসিদ্ধ বাঁধ যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। এ শহরটি জলোচ্ছ্বাসের দ্বারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ জলোচ্ছ্বাসের নাম পবিত্র কোরআনে র্আম’(عرم ) বলা হয়েছে।5

দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক ইসলামী যুগে আরব জাতি

ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা জানার জন্য নিম্নোক্ত সূত্রসমূহ ব্যবহার করা যেতে পারে :

1. তাওরাত যদিও এতে সকল ধরনের বিকৃতি রয়েছে;

2. মধ্যযুগীয় গ্রীক ও রোমান সাহিত্য ও বিবরণাদি;

3. মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রণীত ইসলামের ইতিহাস;

4. প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খনন কার্য এবং প্রাচ্যবিদগণের গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি। আর এগুলো সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কিছু অজানা বিষয়ের ওপর থেকে রহস্যের জট খুলেছে।

এ সব সূত্র থাকা সত্ত্বেও আরব জাতির ইতিহাসের অনেক দিক ও বিষয় এখনো অস্পষ্ট থেকে গেছে এবং এমন এক ঐতিহাসিক ধাঁধার রূপ পরিগ্রহ করেছে যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল তা অধ্যয়ন আমাদের অত্র গ্রন্থের ভূমিকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর জীবনী বিশ্লেষণ,সেহেতু ইসলামপূর্ব আরব জাতির জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলো খুব সংক্ষেপে আমরা এখানে বর্ণনা করব।

নিঃসন্দেহে আরব উপদ্বীপে সুদূর অতীতকাল থেকেই বহু গোত্র বসতি স্থাপন করেছে। এ সব গোত্রের মধ্য থেকে কতিপয় গোত্র বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে কেবল তিনটি প্রধান গোত্র অন্য সকল গোত্রের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ তিন গোত্র থেকে বহু শাখাগোত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। এ গোত্র তিনটি হলো :

1. বায়েদাহ্ (بائدة ) : বায়েদাহ্ শব্দের অর্থ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কারণ এ গোত্র অবাধ্যতা ও পাপাচারের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে নিশ্চি‎‎‎ হ্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত গোত্রগুলো আদ ও সামুদ জাতি হয়ে থাকবে-যাদের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে বহুবার এসেছে।

2. কাহ্তানিগণ (القحطانيون ) : এরা ইয়া রব বিন কাহ্তানের বংশধর। এরা আরব ভূখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ইয়েমেনে বসবাস করত। এদেরকেই খাঁটি আরব বলা হয়। আজকের ইয়েমেনের অধিবাসীরা এবং আওস ও খাযরাজ গোত্র যারা ইসলামের আবির্ভাবের শুরুতে মদীনায় বসবাস করত তারা কাহ্তানেরই বংশধর। কাহ্তানিগণ অনেক সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ইয়েমেনকে সমৃদ্ধশালী ও আবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছে। তারা বহু সভ্যতারও গোড়াপত্তন করেছিল এবং সেগুলোর নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। তাদের রেখে যাওয়া প্রাচীন শিলালিপিসমূহ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার ভিত্তিতে পাঠোদ্ধার করা হচ্ছে। এর ফলে কাহ্তানীদের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির সভ্যতা সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা করা হয় আসলে তার সবই এ কাহ্তানীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং এ সভ্যতার বিকাশস্থল হচ্ছে ইয়েমেন।

3. আদনানিগণ (العدنانيّون ) : এরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। ইসমাঈল (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র। এ গোত্রের উৎসমূল আমরা পরবর্তী আলোচনাসমূহে স্পষ্ট করে দেব। তবে উক্ত আলোচনাসমূহের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর মা হাজেরাসহ পবিত্র মক্কায় পুনর্বাসন করার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম (আ.) আদিষ্ট হন। তিনি ইসমাঈল ও তাঁর মা হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে একটি গভীর উপত্যকায় নিয়ে আসলেন যা মক্কা নামে অভিহিত। এ উপত্যকা ছিল পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুপ্রান্তর। মহান আল্লাহ্ তাঁদের ওপর করুণা ও রহমতস্বরূপ সেখানে যমযম’ঝরনা সৃষ্টি করে তাঁদের হাতে অর্পণ করেন। ইসমাঈল (আ.) মক্কার অদূরে বসতি স্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি অনেক সন্তান-সন্ততি লাভ করেছিলেন। হযরত ইসমাঈলের এ সব বংশধরের একজন ছিলেন আদনান। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের মাধ্যমে আদনানের বংশ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়।

আদনানের সন্তান ও বংশধরগণ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সব গোত্রের মধ্যে যে গোত্রটি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিল তা হলো কুরাইশ গোত্র। আর বনি হাশিম ছিল কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপ

আরবদের সাধারণ চরিত্র

আরবদের ঐ সকল স্বভাব-চরিত্র এবং সামাজিক রীতি-নীতি তুলে ধরাই এখানে লক্ষ্য যা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এ সব রীতি-নীতির মধ্যে বেশ কিছু রীতি গোটা আরব জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সার্বিকভাবে আরবদের সাধারণ এবং প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে :

জাহেলীয়াতের যুগে আরবগণ,বিশেষ করে আদনানের বংশধরগণ স্বভাবতঃই দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিল। তারা কদাচিৎ আমানতের খিয়ানত করত। তারা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাকে ক্ষমার অযোগ্য পাপ বলে গণ্য করত। তারা আকীদা-বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। তারা স্পষ্টভাষী ছিল। তাদের মাঝে শক্তিশালী ধী ও স্মরণশক্তিসম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ ছিল যারা আরবের কবিতা এবং বক্তৃতাসমূহ কণ্ঠস্থ করে রেখেছিল। আরবগণ কাব্যচর্চা এবং বক্তৃতায় সে যুগে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। তাদের সাহস প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তারা অশ্বচালনা এবং তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত ছিল। পলায়ন এবং শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকে তারা মন্দ ও গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করত।

এ সব গুণের পাশাপাশি অনেক চারিত্রিক দোষ তাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছিল যে,তাদের সব ধরনের মানবীয় পূর্ণতার দীপ্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর অদৃশ্যলোক থেকে যদি তাদের ওপর করুণা ও দয়ার বাতায়ন উন্মুক্ত করা না হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হতো। আপনারা বর্তমানে কোন আদনানী আরবের অস্তিত্বই খুঁজে পেতেন না এবং অতীতের বিলুপ্ত আরব গোত্রসমূহের কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হতো।

একদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও সঠিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে চরিত্রহীনতা ও কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসারের কারণে আরব জাতির জীবন মানবেতর জীবনে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতা আরবদের পঞ্চাশ বছর ও একশ’বছর স্থায়ী যুদ্ধের কাহিনী ও বিবরণে পূর্ণ। এ সব যুদ্ধ তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে সক্ষম কোন শক্তিশালী সরকার ও প্রশাসন না থাকার কারণে আরব জাতি যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে তারা প্রতি বছর তাদের পশু ও অশ্বসমেত মরুভূমিতে এমন সব এলাকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াত যেখানে প্রচুর পানি ও লতাগুল্মের অস্তিত্ব আছে। এ কারণে যেখানেই তারা পানি ও বসতির নিদর্শন দেখতে পেত সেখানেই অবতরণ করে তাঁবু স্থাপন করত। আর যখনই অধিকতর উত্তম কোন স্থানের সন্ধান পেত তখনই সেখানে যাওয়ার জন্য মরুপ্রান্তর পাড়ি দিত।

তাদের এ যাযাবর জীবনের পেছনে দু টি কারণ রয়েছে : 1. পানি,জলবায়ু-আবহাওয়া এবং চারণভূমির দিক থেকে আরবের খারাপ ও প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা এবং 2. প্রচুর রক্তপাত ও হানাহানি যা তাদেরকে ভ্রমণ ও এক জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করতে বাধ্য করত।