চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98354
ডাউনলোড: 8163


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98354 / ডাউনলোড: 8163
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ইসলামের মহীয়সী নারী হযরত খাদীজাহ্

ঐ দিন পর্যন্ত মহানবী (সা.)-এর আর্থিক অবস্থা ভালো ও সুবিন্যস্ত ছিল না। তখনও তিনি চাচা আবু তালিবের আর্থিক সাহায্য ও দানের মুখাপেক্ষী ছিলেন। তাঁর কাজ ও পেশার অবস্থাও বাহ্যত খুব একটা দৃঢ় ছিল না বলেই বিবাহ করে সাংসারিক জীবনযাপন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। শামদেশে তাঁর সর্বশেষ (বাণিজ্যিক) সফর যা তিনি কুরাইশ বংশীয়া একজন ধনাঢ্য মহিলার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে আঞ্জাম দিয়েছিলেন সেই সফরের বদৌলতে তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ কিছুটা সচ্ছল হয়েছিল। যুবক মহানবীর সাহসিকতা ও দক্ষতা খাদীজাকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। তিনি তাঁকে চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়েও বেশি অর্থ পুরস্কারস্বরূপ প্রদান করার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) যে পারিশ্রমিক কাজের শুরুতেই নির্ধারণ করা হয়েছিল কেবল সেটিই গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের গৃহের দিকে রওয়ানা হলেন এবং এ সফরে যা কিছু লাভ করেছিলেন তার পুরোটাই আবু তালিবের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য চাচার হাতে অর্পণ করলেন।

তাঁকে দেখেই অধীর আগ্রহে ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য অপেক্ষমান চাচার চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগল। এই ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিব ও ভ্রাতা আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি। ভ্রাতুষ্পুত্রের ব্যবসায়িক সাফল্য এবং যে প্রচুর লাভ তিনি অর্জন করেছিলেন সে সম্পর্কে যখন তিনি অবগত হলেন তখন তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি দু টি ঘোড়া ও দু টি উট ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে অর্পণ করতে চাইলেন যাতে করে তিনি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

মহানবী এ সফরে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন তার পুরোটাই চাচা আবু তালিবের হাতে তুলে দেন যাতে তিনি তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা ও আয়োজন করতে পারেন।

শামে বাণিজ্যিক সফর থেকে ফেরার পর আর্থিক সচ্ছলতা এলে মহানবী জীবনসঙ্গিনী হিসাবে একজন উপযুক্ত স্ত্রী গ্রহণ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কিভাবে হযরত খাদীজাকে তিনি কাঙ্ক্ষিত স্ত্রী হিসাবে পেলেন,অথচ উকবাহ্ ইবনে আবি মুয়ীত,আবু জাহল ও আবু সুফিয়ানের মতো ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিবাহের প্রস্তাব তিনি ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? কোন্ কোন্ কারণ এ দু জনকে পরস্পরের নিকটবর্তী করেছিল যাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং তাঁদের মধ্যে এমন দৃঢ় সম্পর্ক,মায়া-মমতা,প্রেম-ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার বন্ধন সৃষ্টি করেছিল যার ফলে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর যাবতীয় ঐশ্বর্য ও ধন-সম্পদ স্বামী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেছিলেন যা ইসলাম ধর্ম,কলেমা-ই তাইয়্যেবাহ্ এবং তাওহীদের পতাকা চির উন্নত ও বুলন্দ করার পথে ব্যয় করা হয়েছিল? যে গৃহের চারদিক ও অভ্যন্তরভাগ হাতীর দাঁতনির্মিত ও মুক্তাখচিত অতি মূল্যবান চেয়ার ও আসবাবপত্র দিয়ে পূর্ণ ছিল এবং যা ভারতীয় রেশমী বস্ত্র এবং কারুকাজ করা ইরানী পর্দা দিয়ে সুশোভিত ছিল তা কিভাবে অসহায় মুসলমানদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল?

এ সব ঘটনার উৎস সন্ধান করতে হলে অবশ্যই হযরত খাদীজার জীবনেতিহাস অধ্যয়ন করতে হবে। যে বিষয়টি নিশ্চিত তা হলো,যে ব্যক্তি দৃঢ়,পবিত্র ও আধ্যাত্মিক উৎসমূলের অধিকারী না হবে তার পক্ষে এ ধরনের আত্মত্যাগ করা কখনই সম্ভব হবে না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,এ বিবাহ মহানবীর খোদাভীতি,চরিত্র,সততা এবং বিশ্বস্ততার প্রতি খাদীজার বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। হযরত খাদীজার জীবনচরিত এবং যে সব কাহিনী তাঁর উচ্চ মর্যাদা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো থেকেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

হযরত খাদীজাহ্ ছিলেন সচ্চরিত্রা রমণী। তিনি সব সময় খোদাভীরু ও চরিত্রবান স্বামীর সন্ধান করছিলেন। আর এ কারণেই মহানবী তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, খাদীজাহ্ বেহেশতের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রমণীদের অন্তর্ভুক্ত।” তিনিই প্রথম মহিলা যিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবীর নবুওয়াতের সূচনালগ্নে ইসলাম ধর্মের নিঃসঙ্গতার দিকে ইঙ্গিত করে একটি ভাষণে বলেছেন,

لم يجمع بيت واحد يومئذ في الإسلام غير رسول الله و خديجة و أنا ثالثهما

“সে দিন রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজার গৃহ ব্যতীত ইসলামে বিশ্বাসী আর কোন ঘর ছিল না;আমি ছিলাম তাঁদের পর ইসলামে বিশ্বাসী তৃতীয় ব্যক্তি। 181

ইবনে আসীর লিখেছেন, আফীফ নামের একজন ব্যবসায়ী মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে তিন ব্যক্তির ইবাদাত-বন্দেগীর দৃশ্য অবলোকন করে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। সে দেখতে পেল যে,মহানবী (সা.) খাদীজাহ্ ও আলীর সাথে সেই মহান আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল ঐ এলাকার অধিবাসীরা যার ইবাদাত-বন্দেগী ত্যাগ করে মিথ্যা উপাস্য ও দেব-দেবীর পূজা-অর্চনায় লিপ্ত হয়েছে। ঘটনা যাচাই করার জন্য সে মহানবীর চাচা আব্বাসের সাথে যোগাযোগ করে যা সে দেখেছে তা তাঁর কাছে বর্ণনা করে এবং তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে। মহানবীর চাচা আব্বাস তাঁকে বলেছিলেন : প্রথম ব্যক্তিটি নবুওয়াতের দাবিদার;আর ঐ মহিলা তার স্ত্রী খাদীজাহ্ এবং ঐ তৃতীয় ব্যক্তিটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আলী। এরপর তিনি বললেন :

ما علمت على ظهر الأرض كلّها على هذا الدين غير هؤلاء الثّلاثة

এ তিন ব্যক্তি ব্যতীত পৃথিবীর বুকে এ ধর্মের আর কোন অনুসারী আছে কি না তা আমার জানা নেই। 182

যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতে হযরত খাদীজার মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে আসলে তা বর্ণনা করা আমাদের এ গ্রন্থের সীমিত কলেবরে সম্ভব নয়। তাই এ ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণগুলো এখন ব্যাপকভাবে আলোচনা করাই আমাদের জন্য সমীচীন হবে।

বিবাহের প্রকাশ্য ও গুপ্ত কারণসমূহ

বস্তুবাদীরা যারা সকল বিষয় ও জিনিসকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে তারা হয়তো ভাবতে পারে যে,যেহেতু খাদীজাহ্ ধনাঢ্যা মহিলা ও ব্যবসায়ী ছিলেন সেহেতু তাঁর ব্যবসায়িক কাজ-কর্ম দেখাশোনা করার জন্য অন্য কিছুর চেয়ে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। এ কারণে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিবাহ করেন। আর যেহেতু হযরত মুহাম্মদও খাদীজার মর্যাদাসম্পন্ন জীবন সম্পর্কে অবগত ছিলেন,যদিও তাঁদের মধ্যে বয়সের দিক থেকে কোন মিল ছিল না তারপরও তিনি তাঁর বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে,কুরাইশদের শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে তাঁকে যে সব বিষয় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা ছিল কতগুলো আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিষয়-কতগুলো বস্তুগত দিক ও বিষয় নয়। নিচে আমরা এর সপক্ষে প্রমাণ পেশ করছি :

1. যখন হযরত খাদীজাহ্ মাইসারার কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শাম সফরের বিবরণ জানতে চেয়েছিলেন তখন সে ঐ সফরে যে সব অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল এবং শামের খ্রিষ্টান পাদ্রীর কাছ থেকে যা শুনেছিল সব কিছু খাদীজার কাছে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিল। খাদীজাহ্ তাঁর নিজের মধ্যে যে তীব্র ভালোবাসা,আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন এর উৎস ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ। তাই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে বলেই ফেললেন, মাইসারাহ্! যথেষ্ট,মুহাম্মদের প্রতি আমার টান ও আগ্রহকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছ। যাও আমি তোমাকে ও তোমার স্ত্রীকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দিলাম এবং তোমাকে দু শ দিরহাম,দু টি ঘোড়া এবং কিছু মূল্যবান পোশাক দিয়ে দিলাম।”

এরপর তিনি মাইসারার কাছ থেকে যা কিছু শুনেছিলেন তা আরবের পণ্ডিত ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের কাছে বর্ণনা করলেন। তিনি শোনার পর বললেন, এ সব অলৌকিক ঘটনা সংঘটনকারী ব্যক্তি হচ্ছেন আরবীয় নবী। 183

2. একদিন খাদীজাহ্ তাঁর ঘরে বসেছিলেন। তাঁর চারপাশ ঘিরে রেখেছিল দাস-দাসীরা। একজন ইয়াহুদী পণ্ডিতও উক্ত মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাক্রমে যুবক মহানবী (সা.) এ ঘরের পাশ দিয়ে গমন করলেন। ঐ পণ্ডিতের দৃষ্টি মহানবীর ওপর পড়লে তৎক্ষণাৎ তিনি হযরত খাদীজাকে বলেন,যাতে করে তিনি তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য উক্ত মাহফিলে যোগদান করার জন্য অনুরোধ করেন। মহানবী ইয়াহুদী পণ্ডিতের আবেদনে সাড়া দিলেন এবং মাহফিলে অংশগ্রহণ করলেন। উল্লেখ্য যে,মহানবী (সা.)-এর মধ্যে নবুওয়াতের বিদ্যমান লক্ষণগুলো দেখেই ইয়াহুদী পণ্ডিত তাঁকে মাহফিলে অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। এ সময় হযরত খাদীজাহ্ ঐ ইয়াহুদী পণ্ডিতকে লক্ষ্য করে বললেন, যদি তাঁর চাচারা আপনার আগ্রহ ও অনুসন্ধানের ব্যাপারে অবগত হন তাহলে তাঁরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। কারণ তাঁরা ইয়াহুদীদের অনিষ্ট থেকে তাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্রের ব্যাপারে শঙ্কিত।” এ কথা শুনে ইয়াহুদী পণ্ডিত বললেন, মুহাম্মদের অনিষ্ট সাধন করা কি কারো পক্ষে সম্ভব,অথচ মহান আল্লাহ্ তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি ও মানব জাতির হেদায়েতের জন্য প্রতিপালিত করেছেন? খাদীজাহ্ তখন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে জেনেছেন যে,তিনি এ ধরনের মর্যাদার অধিকারী হবেন? এ প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, আমি তাওরাত গ্রন্থে সর্বশেষ নবীর চি হ্ন ও নিদর্শনসমূহ অধ্যয়ন করেছি। তাঁর নিদর্শনাদির মধ্যে এও যে,তাঁর পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করবেন। তাঁর দাদা ও পিতৃব্য তাঁকে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। তিনি কুরাইশদের মধ্য থেকে এমন এক নারীকে বিবাহ করবেন যিনি কুরাইশদের নেত্রী।” এরপর তিনি খাদীজার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ঐ রমণীকে অভিনন্দন যিনি তাঁর স্ত্রী হবার মর্যাদা ও গৌরব অর্জন করবেন। 184

3. খাদীজার চাচা ওয়ারাকাহ্ ছিলেন আরবের অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি নতুন ও পুরাতন নিয়মের বিভিন্ন গ্রন্থাদি সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান ও তথ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রায়শঃই বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরাইশদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি মানব জাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত ও মনোনীত হবেন এবং কুরাইশ বংশীয়া সর্বশ্রেষ্ঠা ধনাঢ্য রমণীদের মধ্য থেকে একজনকে তিনি বিবাহ করবেন।” আর যেহেতু খাদীজাহ্ ছিলেন কুরাইশ রমণীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনাঢ্য সেহেতু তিনি প্রায়শ হযরত খাদীজাকে বলতেন, এমন একদিন আসবে যে দিন তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের সাথে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবে।”

4. খাদীজাহ্ (আ.) এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন,মক্কা নগরীর ওপর সূর্য ঘুরপাক খেয়ে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে আসল এবং তাঁর ঘরেই উপস্থিত হলো। তিনি তাঁর এ স্বপ্নের কথা ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলকে বললেন। তিনি এ স্বপ্নের বিবরণ শুনে বললেন, তুমি একজন মহান ব্যক্তিকে বিবাহ করবে যার খ্যাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।”

এগুলো হচ্ছে এমন সব ঘটনা যা কোন কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন এবং অনেক ইতিহাস গ্রন্থেও লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ সব ঘটনা থেকে মহানবীর প্রতি হযরত খাদীজার আকর্ষণের কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। এ সব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে,যুবক মহানবীর আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি হযরত খাদীজার বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই প্রধানত মহানবীর প্রতি তাঁর এ আকর্ষণের উৎপত্তি। আর যেহেতু মহানবী (অর্থাৎ কুরাইশদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বাসী ও সত্যবাদী) খাদীজার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা ও পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ছিলেন সেহেতু তা খুব সম্ভবত এ বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রভাবও রাখে নি।

হযরত খাদীজার বিবাহের প্রস্তাব

এটিই সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত বিষয় যে,হযরত খাদীজার পক্ষ থেকেই প্রথমে বিবাহের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল,এমনকি ইবনে হিশামও185 বর্ণনা করেছেন যে,খাদীজাহ্ স্বয়ং এ বিবাহের ব্যাপারে আগ্রহ প্রদর্শন করেন। তিনি মহানবীকে বলেছিলেন, হে পিতৃব্যপুত্র! আমার ও আপনার মধ্যে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে এবং আপনার সম্প্রদায়ের মাঝে আপনার যে উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে এবং আপনার বিশ্বস্ততা এবং সত্যবাদিতার কারণে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে আমি গভীরভাবে আগ্রহী। আপনার সত্যবাদিতা আপনা থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।” তখন মহানবী (সা.) তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, এ বিষয় সম্পর্কে আমার চাচাদেরকে অবগত করা এবং তাঁদের পরামর্শে এ কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন।”

অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে,আলীয়ার কন্যা নাফীসাহ্ খাদীজার প্রস্তাব ঠিক এভাবে মহানবীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন :

“মুহাম্মদ! কেন আপনি আপনার জীবনকে প্রদীপসদৃশ উপযুক্ত স্ত্রী অর্থাৎ জীবনসঙ্গিনীর দ্যুতি দ্বারা আলোকিত করছেন না? আপনাকে যদি রূপসী নারী,ধন-দৌলত,সম্মান ও মর্যাদার দিকে আহবান করি,তাহলে কি আপনি সাড়া দেবেন না? মহানবী বললেন, আপনার আসল উদ্দেশ্য কি? তখন নাফীসাহ্ খাদীজার কথা উত্থাপন করলেন। মহানবী বললেন, খাদীজাহ্ কি এতে সম্মত হবেন? কারণ তাঁর জীবনের সাথে আমার জীবনের অনেক পার্থক্য রয়েছে।” নাফীসাহ্ বললেন, তাঁকে রাজী করার ভার আমার ওপর। আপনি একটি সময় নির্ধারণ করুন। ঠিক সে সময় তাঁর প্রতিনিধি আমর বিন আসাদ186 আপনার ও আপনার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করে বিয়ের আক্দ ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।”

মহানবী (সা.) তাঁর চাচাদের সাথে (বিশেষ করে আবু তালিবের সাথে) বিবাহের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। কুরাইশ বংশীয় শীর্ষস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে একটি গৌরবোজ্জ্বল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথমে হযরত আবু তালিব একটি ভাষণ দেন যার শুরুতে তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করার পর নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রের পরিচিতি সবার সামনে তুলে ধরেন :

“আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহকে যদি সকল কুরাইশ বংশীয় পুরুষের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে তিনি তাদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদিও তিনি সব ধরনের সম্পদ থেকে বঞ্চিত;কিন্তু অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি ছায়া বৈ আর কিছুই নয় যা ক্ষণস্থায়ী। আর উচ্চ বংশমর্যাদা ও কৌলিন্য হচ্ছে এমন এক বিষয় যা স্থায়ী...। 187

হযরত আবু তালিবের ভাষণ শেষ হলে হযরত খাদীজার আত্মীয় ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ভাষণ দিলেন। হযরত আবু তালিবের উক্ত ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশ ও বনি হাশিমের পরিচিতি তুলে ধরা। ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল বললেন, কোন কুরাইশই আপনাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা অস্বীকার করতে অক্ষম। আমরা আন্তরিকতার সাথে আপনাদের সুমহান মর্যাদার রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে চাই। 188

বিবাহের আক্দ সম্পন্ন হলো এবং মোহরানা 400 দীনার নির্ধারণ করা হলো। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন,মোহরানা ছিল 20টি উট।

হযরত খাদীজার বয়স

এটিই প্রসিদ্ধ যে,এ বিয়ের সময় খাদীজার বয়স ছিল 40 বছর। তিনি হস্তি সালেরও 15 বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁর বয়স এর চেয়েও কম ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। মহানবীর সাথে এ বিয়ের আগে আতীক ইবনে আ য়েয এবং আবু হালাহ্ মালেক বিন বান্নাশ আত তামীমী নামক দু ব্যক্তির সাথে খাদীজার বিবাহ হয়েছিল,কিন্তু বৈবাহিক জীবনেই উক্ত স্বামীদ্বয় মৃত্যুমুখে পতিত হন।

দশম অধ্যায়: বিবাহ থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তি পর্যন্ত

মানব জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল মুহূর্ত হচ্ছে তাঁর যৌবনকাল। কারণ এ সময় যৌন প্রবৃত্তি ও চাহিদা পূর্ণতা লাভ করে;প্রবৃত্তির পূজারী যে কোন ধরনের কামনা-বাসনাকে লালন করে;জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ঝড় মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে তিমিরাচ্ছন্ন করে ফেলে;বস্তুগত রিপুসমূহের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য সুদৃঢ় হয় এবং এর ফলে প্রদীপতুল্য বুদ্ধিবৃত্তি নি®প্রভ হয়ে পড়ে। দিবা-রাত্রি সময়-অসময় আকাশকুসুম আকাঙ্ক্ষার এক সুরম্য অট্টালিকার চিত্র যুবকের চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে।

এ সময় যদি মানুষের হাতের মুঠোয় কোন সম্পদ থাকে তাহলে তার জীবন এক ভয়াবহ বিভীষিকায় পরিণত হয়। একদিকে পাশবিক ঝোঁক ও প্রবণতাসমূহ,শারীরিক সুস্থতা,অন্যদিকে বিবিধ বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা,উপায়-উপকরণ এবং মোটা অংকের উপার্জন সম্মিলিতভাবে মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখে। এ সময় মানুষ তার রিপুর তাড়না ও জৈবিক প্রবণতাসমূহ মেটাতেই ব্যস্ত হয়ে যায়।

চিন্তাশীল শিক্ষকগণ এ যুগসন্ধিক্ষণকে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সীমারেখা বলে চি হ্নিত করেছেন। খুব কমসংখ্যক যুবকই তাদের নিজেদের জন্য যুক্তিপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতি,উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী এবং পবিত্র আত্মিক শক্তি অর্জন করার উদ্দেশ্যে এমন এক পথ বেছে নিতে সক্ষম হয় যা তাদেরকে সব ধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে।

আত্মসংযম এ সময় অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এ সময় যদি কোন যুবক পারিবারিক অঙ্গন থেকে সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ না করে তাহলে তার জীবনের জন্য দুর্ভাগ্যের অপেক্ষাই করতে হবে।

মহানবীর যৌবনকাল

যুবক মহানবী যে সাহসী,নির্ভীক,দৈহিকভাবে শক্তিশালী ও সুস্থ-সবল ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ তিনি এমন এক নির্মল পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছিলেন যা ছিল নগর জীবনের কোলাহল ও জটিলতা থেকে মুক্ত। আর তিনি এমন এক বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সাহস ও বীরত্বের দীপ্ত প্রতীক। ধনাঢ্য রমণী খাদীজার বিপুল ধন-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভব তাঁর করায়ত্তে ছিল। এর ফলে যে কোন ধরনের স্ফূর্তি ও আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হওয়ার যাবতীয় উপায়-উপকরণ তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এখন আমাদের দেখা উচিত তিনি এ সব উপায়-উপকরণ কিভাবে ও কোন্ কাজে ব্যবহার করেছেন? তিনি কি স্ফূর্তি ও আমোদ-প্রমোদের দস্তরখান বিছিয়েছিলেন এবং অধিকাংশ যুবকের ন্যায় প্রবৃত্তির তাড়না ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন? অথবা তিনি কি এমন কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন যা থেকে তাঁর সুমহান আধ্যাত্মিক-নৈতিক জীবনের চিত্র স্পষ্ট ও প্রতিফলিত হয়ে যায়? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,তিনি বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ন্যায় জীবনযাপন করতেন। তিনি সর্বদা আমোদ-প্রমোদ ও উদাসীনতা বর্জন করেছেন। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে সর্বদা গভীর মনন ও চিন্তাশীলতার চি হ্ন বিদ্যমান থাকত। সমাজের নৈতিক অধঃপতন থেকে দূরে থাকার জন্য কখনো কখনো তিনি দীর্ঘক্ষণ পাহাড়ের পাদদেশে ও গুহায় নিভৃতে জীবনযাপন এবং অস্তিত্বজগতের সৃষ্টি ও বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার বিদ্যমান শক্তির নিদর্শনাদি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতেন।

যৌবনকালীন আবেগ ও অনুভূতিসমূহ

মক্কার বাজারে একবার এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর সুকুমার মানবীয় আবেগ ও অনুভূতিকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিল। তিনি বাজারে গিয়ে দেখতে পেলেন যে,এক জুয়ারী জুয়া খেলায় মগ্ন। ভাগ্য খারাপ হওয়ায় সে প্রথমে তার উটটি হারালো। এরপর তার নিজ বসত বাড়িটিও হারালো। এরপর খেলাটা এমন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে উপনীত হলো যে,সে তার জীবনের দশ বছরও হারালো (অর্থাৎ যার কাছে জুয়ায় হেরেছে তার কাছে দশ বছর সে ক্রীতদাসের মতো কাজ-কর্ম করবে। এ দশ বছর তার কোন স্বাধীনতাই থাকবে না)। এ দৃশ্য দেখে যুবক মহানবী এতটা ব্যথিত হলেন যে,তিনি ঐ দিন আর মক্কায় থাকতে পারলেন না। তিনি মক্কার পাশের পাহাড়ে চলে গেলেন এবং রাত হওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে ঘরে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি সত্যিই এ ধরনের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে খুব ব্যথিত হতেন। তিনি এ সব পথভ্রষ্টের নির্বুদ্ধিতা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত ও চিন্তিত হতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে হযরত খাদীজার বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেও তাঁর বাড়ি ছিল দুঃস্থ,সহায়-সম্বলহীন জনগণের আশার কাবা ও আশ্রয়স্থল। আর ঠিক তেমনি মহানবীর সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরেও তাঁর গৃহের এ অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি।

দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টির সময় কখনো কখনো তাঁর দুধ মা হযরত হালীমাহ্ মহানবীর কাছে আসতেন। মহানবী মাটিতে নিজ চাদর বিছিয়ে তাঁকে বসতে দিতেন। তখন মহানবীর মানসপটে নিজ মায়ের কথা এবং শৈশবের সেই অনাড়ম্বর জীবনের স্মৃতি ভেসে উঠত। তিনি হযরত হালীমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। চলে যাওয়ার সময় তিনি হযরত হালীমাকে সাধ্যমত সাহায্য করতেন।189