চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98355
ডাউনলোড: 8163


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98355 / ডাউনলোড: 8163
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ওহীর শ্রেণীবিভাগ

আত্মার যে সব পূর্ণতা আছে সেগুলোর কারণে বিভিন্ন পথে ও ভাবে আধ্যাত্মিক জগৎসমূহের সাথে সে (আত্মা) যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। আমরা এখানে এ সব পথ ও পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করব। আর ইসলাম ধর্মের পবিত্র ইমামদের রেওয়ায়েত ও হাদীসসমূহে আধ্যাত্মিক জগৎসমূহের সাথে যোগসূত্র এবং সম্পর্ক স্থাপনের পথ ও পদ্ধতিসমূহ বর্ণিত হয়েছে।210

এ পথ ও পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ :

1. আত্মা কখনো কখনো ঐশ্বরিক বাস্তবতা ও তাৎপর্যসমূহ ইলহাম আকারে গ্রহণ করে এবং যা কিছু তার হৃদয়ের ওপর প্রক্ষিপ্ত হয় তা স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানের রূপ পরিগ্রহ করে যে,এগুলোতে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের লেশ থাকে না।

2. মানুষ কোন বস্তু (যেমন পাহাড়-পর্বত ও গাছ) থেকে বিভিন্ন বাক্য ও শব্দ শুনতে পায়;যেমন হযরত মূসা (আ.) মহান আল্লাহর বাণী বৃক্ষ থেকে শুনেছিলেন।

3. রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসের ন্যায় নিগুঢ় সত্য ও তাৎপর্যসমূহ স্বপ্নে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়।

4. মহান আল্লাহর কাছ থেকে একজন ফেরেশতা বিশেষ বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পবিত্র কোরআন এ পদ্ধতিতেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনের সূরা শুআরায় স্পষ্ট এরশাদ হচ্ছে : রুহুল আমীন (জিবরাইল) এ কোরআন পরিচ্ছন্ন আরবী ভাষায় আপনার অন্তঃকরণের ওপর অবতীর্ণ করেছে যাতে করে আপনি ভয় প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন। 211

মিথ্যা কল্প-কাহিনীসমূহ

যে সব ব্যক্তি ও মনীষীর ব্যক্তিত্ব বিশ্বজনীন,ঐতিহাসিক ও জীবনী রচয়িতাগণ যতদূর সম্ভব তাঁদের জীবনী গ্রন্থাকারে লিখে সংরক্ষণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এমনকি তাঁদের রচনা পূর্ণাঙ্গ করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন স্থান সফর করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোন ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে না ইতিহাসে যার জীবনের যাবতীয় বিশেষত্ব ও খুঁটিনাটি দিক তাঁর মতো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে;উল্লেখ্য যে,তাঁর সাহাবিগণ তাঁর জীবনের সমুদয় খুঁটিনাটি দিক ও ঘটনা যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করেছেন।

এই অনুরাগ,আকর্ষণ ও ভালোবাসা যেমনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটি দিক ও ঘটনা লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে ঠিক তদ্রূপ তা কখনো কখনো মহানবীর জীবনী গ্রন্থে বাড়তি অলংকার ও সজ্জা (যা ভিত্তিহীন) সংযোজনের কারণও হয়েছে। অবশ্য এ সব কাজ (ভিত্তিহীন কাহিনী ও বানোয়াট ঘটনাসমূহ) যেখানে অজ্ঞ বন্ধুদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব নয় সেখানে জ্ঞানী শত্রুদের দ্বারা তা সম্পন্ন হওয়া মোটেও অসম্ভব নয়। এ কারণেই কোন মনীষী বা ব্যক্তিত্বের জীবনী রচয়িতার ওপর অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব হচ্ছে ঐ মনীষী বা ব্যক্তিত্বের জীবনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দৃঢ়তা ও সতর্কতা অবলম্বন এবং সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক মানদণ্ডে তার জীবনের ঘটনাসমূহ যাচাই বাছাই ও বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও অমনোযোগিতা পরিহার। এখন আমরা ওহী নাযিল হবার পরবর্তী ঘটনাসমূহের প্রতি দৃকপাত করছি।

মহানবী (সা.)-এর মহান আত্মা ওহীর আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। ওহীর ফেরেশতা যা কিছু তাঁকে শিখিয়েছিলেন তা তাঁর হৃদয়ে সুগ্রথিত হয়ে যায়। এ ঘটনার পর ঐ ফেরেশতাই তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, হে মুহাম্মদ! আপনি মহান আল্লাহর রাসূল (প্রেরিত দূত)। আর আমি জিবরাইল। কখনো কখনো বলা হয় যে,তিনি এ আহবানটি ঐ সময় শুনতে পেয়েছিলেন যখন তিনি হিরা পর্বত থেকে নিচে নেমে এসেছিলেন। এ দু টি ঘটনা তাঁকে তীব্র ভয়ভীতি ও অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। তিনি এক মহাদায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বিধায় তাঁর মধ্যে এ ভীতি ও অস্থিরতার উদ্ভব হয়েছিল।

অবশ্য এ অস্থিরতা ও বিচলিত ভাব একটা মাত্রা ও পর্যায় পর্যন্ত ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। যা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার মোটেও পরিপন্থী ছিল না। নিশ্চয়ই যা কিছু তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়েছে তা তাঁর ছিল না। কারণ আত্মা,তা যতই সক্ষম হোক না কেন,অদৃশ্য আধ্যাত্মিক জগৎসমূহের সাথে আত্মার যতই যোগসূত্র ও সম্পর্ক থাকুক না কেন,কাজের সূচনালগ্নে যে ফেরেশতার সাথে তাঁর অদ্যাবধি সাক্ষাৎ হয় নি তিনি যদি তাঁর মুখোমুখি হন তাও আবার পাহাড়ের ওপর তখন তাঁর মধ্যে এ ধরনের অস্থিরতা ও ভয়-বিহ্বলতার উদ্ভব হবেই। আর তাই পরে এ অস্থিরতা তাঁর থেকে দূর হয়ে যায়।

অস্বাভাবিক ধরনের এ অস্থিরতা ও ক্লান্তি মহানবীকে হযরত খাদীজাহ্ (আ.)-এর গৃহাভিমুখে নিয়ে যায়। তিনি যখন ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর সহধর্মিনী অস্থিরতা ও গভীর চিন্তার ছাপ তাঁর পবিত্র বদনমণ্ডলে প্রত্যক্ষ করলেন। তাই তিনি মহানবীর কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হিরা পর্বতের গুহায় যা ঘটেছিল মহানবী তা হযরত খাদীজার কাছে বর্ণনা করলেন। হযরত খাদীজাহ্ও গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে তাঁর দিকে তাকালেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করে বললেন, মহান আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করুন।”

এরপর মহানবী (সা.) ক্লান্তি অনুভব করে খাদীজাহ্ (আ.)-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,دثّريني আমাকে ঢেকে দাও। হযরত খাদীজাহ্ তাঁকে ঢেকে দিলেন এবং তিনি কিছুক্ষণ ঘুমালেন।

হযরত খাদীজাহ্ ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। এর আগের পৃষ্ঠাগুলোতে আমরা ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের পরিচিতি তুলে ধরেছিলাম এবং বলেছিলাম,তিনি আরবের অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইঞ্জিল পড়ার পর বেশ দীর্ঘদিন ধরে তিনি খ্রিষ্টধর্ম পালন করছিলেন। তিনি হযরত খাদীজার চাচাতো ভাই ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী হযরত খাদীজাহ্ মহানবীর কাছ থেকে যা শুনেছিলেন তা বলার জন্য ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন এবং মহানবী তাঁকে যা বলেছিলেন তিনি তা হুবহু বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকাহ্ চাচাতো বোনের কথা শোনার পর বলেছিলেন,

إنّ ابن عمّك لصادق و إنّ هذا لبدء النّبوّة و إنّه ليأتيه النّاموس الأكبر

“তোমার চাচার ছেলে (মহানবী) সত্য বলেছেন। যা তাঁর ক্ষেত্রে ঘটেছে আসলে তা নবুওয়াতের শুভ সূচনা মাত্র। আর ঐ মহান ঐশী পদ ও দায়িত্ব তাঁর ওপর অবতীর্ণ হচ্ছে...।”

যা কিছু এখন আপনাদের কাছে বর্ণনা করা হলো তা মুতাওয়াতির (অকাট্য সূত্রে বর্ণিত) ঐতিহাসিক বিবরণসমূহেরই সার সংক্ষেপ যা সকল গ্রন্থেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে এ বর্ণনাটির ফাঁকে ফাঁকে এমন সব বিষয় দৃষ্টিগোচর হয় যা মহান নবীদের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান ও পরিচিতির সাথে মোটেও খাপ খায় না। এছাড়াও এতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর জীবনী থেকে যা কিছু আমরা পাঠ করেছি তার সাথেও এ সব বিষয়ের ব্যাপক ব্যবধান ও অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। এখন আমরা আপনাদের সামনে যা বর্ণনা করব তা আসলে অলীক কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয় অথবা অন্ততঃপক্ষে এর একটি মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে হবে।

আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় সাহিত্যিক ও লেখক ড. হাইকালের লেখা থেকে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। কারণ তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় যে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে বলেছেন যে,একদল লোক শত্রুতা বা বন্ধুত্ববশত মহানবীর জীবনচরিত রচনা ও বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অনেক মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে,কিন্তু তিনি নিজেই এ স্থলে এসে এমন সব বিষয় বর্ণনা করেছেন যা নিশ্চিতভাবে ভিত্তিহীন,অথচ মরহুম আল্লামা তাবারসীর মতো কতিপয় শিয়া আলেম এ ব্যাপারে বেশ কিছু উপকারী বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।212 এখন সেই সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনীর কিয়দংশ উল্লেখ করা হলো : (অবশ্য উদাসীন মিত্র এবং জ্ঞানী শত্রুগণ যদি এগুলো তাঁদের গ্রন্থসমূহে উল্লেখ না করতেন তাহলে আমরা এগুলো কখনই উল্লেখ করতাম না।)

1. মহানবী (সা.) যখন হযরত খাদীজার ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি চিন্তা করছিলেন যে,তিনি যা দেখেছেন সে ব্যাপারে কি তিনি ভুল করেছেন অথবা তিনি কি যাদুগ্রস্ত হয়ে গিয়েছেন! আপনি সব সময় অনাথদের আদর-যত্ন করতেন এবং নিজ আত্মীয়-স্বজন ও জ্ঞাতি-গোত্রের সাথে সদাচরণ করতেন’-এ কথা বলার মাধ্যমে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর অন্তর থেকে সব ধরনের সন্দেহ ও সংশয় দূর করে দিলেন। তাই মহানবী তাঁর দিকে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় তাকিয়ে একটি কম্বল এনে তাঁকে ঢেকে দিতে বললেন।213

2. তাবারী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক লিখেছেন, মহানবী (সা.) যখনإنّك لرسول الله নিশ্চয়ই আপনি মহান আল্লাহর রাসূল’-এ আহবান শুনতে পেলেন তখন তাঁর সমস্ত দেহ কাঁপতে লাগল। তিনি পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন। অতঃপর ফেরেশতা তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে এ কাজ করা থেকে বিরত রাখলেন। 214

3. ঐ দিবসের পরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র কাবা তাওয়াফ করতে গেলেন। ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলকে দেখে তাঁর কাছে তিনি নিজের এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকাহ্ তা শুনে বলেছিলেন, মহান আল্লাহর শপথ,আপনি এ জাতির নবী। আর প্রধান ফেরেশতা যিনি হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে আসতেন তিনিই আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছেন। কতিপয় লোক আপনাকে প্রত্যাখ্যান করবে,আপনাকে অনেক কষ্ট ও যাতনা দেবে,আপনাকে আপনার শহর (মক্কা) থেকে বহিষ্কার করবে এবং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) অনুভব করলেন যে,ওয়ারাকাহ্ সত্য কথা বলছেন।215

বর্ণনার অসারত্ব ও ভিত্তিহীনতা

আমরা বিশ্বাস করি যে,এ সব ঘটনা যা ইতিহাস ও তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে তার সবই ভিত্তিহীন,বানোয়াট ও মিথ্যা ।

প্রথমত এ সব বক্তব্য মূল্যায়ন করার জন্য আমাদের উচিত অতীতের মহান নবী-রাসূলদের জীবনেতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেয়া। পবিত্র কোরআনে তাঁদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং তাঁদের পবিত্র জীবনের বর্ণনাসমেত প্রচুর বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্য থেকে কোন একজনের জীবনেও এ ধরনের অমর্যাদাকর ঘটনা দেখতে পাই না। পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা সংক্রান্ত পূর্ণ বিবরণ এসেছে এবং তাঁর জীবনেতিহাসের সকল বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর কখনই ঐ ধরনের ভয়-ভীতি ও অস্থিরতার কথা উল্লেখ করা হয় নি যার ফলে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেবেন। অথচ মূসা (আ.)-এর জন্য ভয় পাওয়ার প্রেক্ষাপট ঢের বেশি ছিল। কারণ আঁধার রাতে নির্জন মরু-প্রান্তরে তিনি একটি বৃক্ষ থেকে আহবান শুনতে পেয়েছিলেন এবং এভাবেই তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত মূসা (আ.) এ সময় তাঁর শান্তি ও স্বস্তি বজায় রেখেছিলেন। তাই মহান আল্লাহ্ যখন তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, হে মূসা! তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর”,তিনি তৎক্ষণাৎ তা নিক্ষেপ করেছিলেন। মূসা (আ.)-এর ভয় ছিল লাঠিটির দিক থেকে যা একটি বিপজ্জনক প্রাণীতে পরিণত হয়েছিল। তাহলে কি বলা যায় যে,ওহী অবতরণের শুভ সূচনালগ্নে মূসা (আ.) শান্ত ও ধীরস্থির ছিলেন,অথচ যে ব্যক্তি সকল নবী ও রাসূলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তিনি ওহীর ফেরেশতার বাণী শুনে এতটা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যে,পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন? এ কথা কি যুক্তিসংগত?

নিঃসন্দেহে যতক্ষণ পর্যন্ত নবীর আত্মা যে কোন দিক থেকে মহান আল্লাহর ঐশী রহস্য গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্ তাঁকে নবুওয়াতের মাকামে অধিষ্ঠিত করবেন না। কারণ মহান নবীদের প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে সুপথ প্রদর্শন। যে ব্যক্তির আত্মিক (আধ্যাত্মিক) শক্তি এতটুকু যে,ওহী শোনামাত্রই আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত হয়ে যান তাহলে তিনি কিভাবে জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবেন?

দ্বিতীয়ত এটি কিভাবে সম্ভব হলো যে,মূসা (আ.) মহান আল্লাহর ঐশী আহবান শুনে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে,তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তৎক্ষণাৎ তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি যেন তাঁর ভাই হারুনকে তাঁর সহকারী নিযুক্ত করেন? কারণ হারুন (আ.) তাঁর চেয়ে অধিকতর প্রাঞ্জলভাষী ও বাকপটু ;216 অথচ নবীদের নেতা দীর্ঘক্ষণ সন্দেহ ও সংশয়ের মধ্যেই থেকে যান। যখন ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল তাঁর অন্তঃকরণ থেকে সন্দেহ-সংশয়ের ধুলো দূর করে দেন তখন তা দূরীভূত হয়ে যায়।

তৃতীয়ত নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে,ওয়ারাকাহ্ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। যখন তিনি মহানবীর অস্থিরতা ও সন্দেহ-সংশয় দূর করতে চাইলেন তখন তিনি কেবল মূসা (আ.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেছিলেন, এটি এমনই এক পদ যা হযরত মূসাকে দেয়া হয়েছিল। 217

তাহলে এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে,জালকারী ইয়াহুদী চক্র এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল এবং তারা গল্পের নায়ক ওয়ারাকার ধর্ম সম্পর্কে অমনোযোগী থেকে গিয়েছে এবং এমতাবস্থায় তারা এ ধরনের গল্প ও উপাখ্যান তৈরি (জাল) করেছে?

এ ছাড়াও মহানবীর যে মহত্ত্ব ও উচ্চ মর্যাদার কথা আমরা জানি এ ধরনের কার্যকলাপ তার সাথে মোটেও খাপ খায় না। হায়াতু মুহাম্মদ’ গ্রন্থের রচয়িতা একটি পর্যায় পর্যন্ত এ সব গল্প ও উপাখ্যানের বানোয়াট ও মিথ্যা হবার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। তাই তিনি কখনো কখনো পূর্বোক্ত বিষয়াদি যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনি’-এ বাক্যসহকারে উদ্ধৃত করেছেন।

এ সব গল্প ও উপাখ্যানের বিপক্ষে শিয়া ধর্মীয় নেতৃবর্গ সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রতিরোধ করেছেন এবং সব কিছু বাতিল প্রমাণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ যুরারাহ্ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যখন হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন তখন তিনি কেন ভয় পান নি এবং ওহীকে শয়তানের ওয়াসওয়াসাহ্ (প্ররোচনা) বলে মনে করেন নি? তখন  ইমাম সাদিক (আ.) বলেছিলেন, মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীর ওপর প্রশান্তি ও স্বস্তি অবতীর্ণ করেছিলেন এবং যা কিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে পৌঁছত তা এমনই ছিল যেন তিনি তা প্রত্যক্ষ করছেন। 218

শিয়া মাজহাবের প্রখ্যাত ও বড় আলেম মরহুম আল্লামা তাবারসী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে219 এ অংশে বলেছেন, উজ্জ্বল দলিল-প্রমাণ প্রেরণ করা ব্যতীত মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীর ওপর কোন ওহী অবতীর্ণ করতেন না। তিনি উজ্জ্বল দলিল-প্রমাণ এজন্য প্রেরণ করতেন যাতে করে মহানবী (সা.) নিশ্চিত হন যে,তাঁর কাছে যা কিছু ওহী হয় তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়।”

দ্বাদশ অধ্যায়: প্রথম ওহী