চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98347
ডাউনলোড: 8163


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98347 / ডাউনলোড: 8163
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পবিত্র কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতীর্ণ হওয়া

পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার (নুযূল) অকাট্য ইতিহাস এবং এ গ্রন্থের সূরাসমূহের আয়াতগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে,এ ঐশী গ্রন্থের আয়াত ও সূরাসমূহ ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র মক্কা ও মদীনা নগরীর পরিবেশ-পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যাবলী অধ্যয়ন করলে মাক্কী আয়াতসমূহকে মাদানী আয়াতসমূহ থেকে পৃথক ও শনাক্ত করা সম্ভব। শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম,এক-অদ্বিতীয় মহান আল্লাহ্ এবং কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস স্থাপনের প্রতি জনগণকে আহবান জানানো সংক্রান্ত আয়াতসমূহকে আবশ্যিকভাবে মাক্কী এবং বিধি-বিধান ও জিহাদের আহবান সংক্রান্ত আয়াতসমূহকে অবশ্যই মাদানী বলে গণ্য করতে হবে। কারণ পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী (সা.)-এর বক্তব্য ও আহবানের উপলক্ষ ছিল মূর্তিপূজারী মুশরিকরা যারা মহান আল্লাহর একত্ব এবং কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করত। যে সব আয়াত এ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তা পবিত্র মক্কার পরিবেশে অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ পবিত্র মদীনা নগরীতে ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ,ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা ছিল মহানবী (সা.)-এর আহবান ও সম্বোধনের পাত্র এবং মহান আল্লাহর পথে জিহাদ ছিল মহানবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কারণেই শরীয়তের বিধি-বিধান,ইয়াহুদী-নাসারাদের ধর্ম এবং মহান আল্লাহর পথে জিহাদ ও আত্মোৎসর্গ করার আহবান সম্বলিত আয়াতসমূহই হচ্ছে মাদানী আয়াত।

পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত মহানবী (সা.)-এর সময় যে সব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এ সব ঘটনাই শানে নুযূল’ নামে পরিচিত। এ সব শানে নুযূল সংক্রান্ত জ্ঞান সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যের স্বচ্ছতার কারণ। আর এ সব ঘটনা ঘটার কারণেই পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ ঐ সব প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে।

কিছু কিছু আয়াত প্রশ্নকারীদের প্রশ্নসমূহের উত্তর হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেগুলো জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদা মিটিয়েছে। কিছুসংখ্যক আয়াত স্রষ্টাতত্ত্ব জ্ঞান এবং শরীয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়টি বিবেচনা করে বলা যায় যে,মহানবী (সা.)-এর ওপর পবিত্র কোরআন ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে।

পবিত্র কোরআনও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে :

) و قرآنا فرقناه لتقرأه على النّاس على مكث(

  আমরা এ কোরআনকে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি ধীরস্থিরভাবে জনগণের উদ্দেশে তা পড়ে শোনাতে পারেন। (সূরা ইসরা : 106)

এখন হয়তো এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হতে পারে যে,পুরো কোরআন কেন একসঙ্গে মহানবীর ওপর অবতীর্ণ হয় নি? কেন এ গ্রন্থটি তাওরাত ও ইঞ্জিলের ন্যায় মহানবী (সা.)-এর হাতে সঁপে দেয়া হয় নি? উল্লেখ্য যে,পুরো তাওরাত ও ইঞ্জিল একবারেই অবতীর্ণ হয়েছিল।

বর্তমানেই কেবল এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয় নি,বরং মহানবী (সা.)-এর সমসাময়িক বিরোধী ও শত্রুরাও রিসালাতের যুগে সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তারা বলত,لولا نزّل عليه القرآن جملة واحدة “তার ওপর কেন সম্পূর্ণ কোরআন একত্রে একবারে অবতীর্ণ করা হয় নি?

এদের প্রতিবাদ ও আপত্তিটিকে দু ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় :

1. যদি ইসলাম ধর্ম ঐশী ধর্ম এবং এ গ্রন্থ ঐশী গ্রন্থ হয়ে থাকে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তাহলে অবশ্যই এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হবে। আর মহান আল্লাহ্ অবশ্যই এ ধরনের একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম ওহীর ফেরেশতাদের মাধ্যমে একত্রে একবারে মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ করবেন। তাই কখনো এ গ্রন্থের আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বিরতি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ যে ঐশী ধর্ম সমুদয় মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস (উসূল),খুঁটিনাটি শাখাগত দিক (ফুরু),বিধি-বিধান,ফরয,সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত তা 23 বছরে বিভিন্ন উপলক্ষ ও প্রেক্ষাপটে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হওয়ার কোন কারণই থাকতে পারে না। যেহেতু পবিত্র কোরআন বিক্ষিপ্তভাবে কতগুলো প্রশ্ন এবং বিশেষ কতগুলো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে তাই ধারণা করা যায় যে,এ ধর্মটি মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও খুঁটিনাটি শাখাগত বিধি-বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় নি এবং ধীরে ধীরে তা নিজেকে পূর্ণতার রঙে রাঙ্গিয়েছে। আর এ ধরনের অপূর্ণাঙ্গ ধর্ম যা ধীরে ধীরে পূর্ণতাভিমুখে অগ্রসর হয়েছে তা ঐশী ধর্ম বলে অভিহিত করা সমীচীন ও যুক্তিসংগত নয়।

2. পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ এবং তাওরাত,ইঞ্জিল ও যবুরের অকাট্য ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে,উক্ত ঐশী গ্রন্থত্রয় লিখিত ফলক আকারে নবীদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই পবিত্র কোরআন কেন এভাবে অবতীর্ণ হয় নি? যেমন পবিত্র কোরআন কেন তাওরাতের মতো কতগুলো ফলকে উৎকীর্ণ করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে দেয়া হয় নি?

যেহেতু কুরাইশ বংশীয় মুশরিকগণ এ ধরনের আসমানী গ্রন্থসমূহে বিশ্বাস করত না এবং এ সব গ্রন্থের নুযূল সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞান ও ধারণা ছিল না তাই বলা যায় যে,এ আপত্তির ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সেই প্রথম দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গিটির সারসংক্ষেপ : কেন ওহীর ফেরেশতা কোরআনের সমুদয় আয়াত একত্রে একবারে তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেন নি,বরং এ সব আয়াত সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে?

ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য

এ সব ব্যক্তির আপত্তির জবাবস্বরূপ পবিত্র কোরআন পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে লুক্কায়িত কারণগুলো প্রকাশ্যে বর্ণনা করেছে। এখন আমরা এ অংশটি একটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করব যার প্রতি পবিত্র কোরআন একটি ছোট বাক্যের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছে :

1. মহানবী (সা.)-এর অনেক বড় বড় দায়িত্ব ছিল। রিসালাতের বিবিধ দায়িত্ব পালন করার পথে তাঁকে অনেক ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

আত্মা ও মন (আত্মিক ও মানসিক মনোবল) যত বড়ই হোক না কেন এ ধরনের সমস্যাসমূহ কর্মচাঞ্চল্য ও উদ্দীপনায় ভাটা পড়ার কারণ হয়। তাই এ সময় অতিপ্রাকৃতিক জগতের সাথে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতার ওহীসহ অবতরণের পুনরাবৃত্তি মানুষের আত্মায় শক্তি জোগায় এবং তার চিত্ত ও মনকে কর্মচাঞ্চল্য ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ করে দেয়। আর মহান আল্লাহর বিশেষ সুদৃষ্টি এবং তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা ও দয়াও ওহী অবতরণের পুনরাবৃত্তি ঘটার মাধ্যমে নবায়িত হয়।

পবিত্র কোরআন এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছে :

) كذالك لنثبّت به فؤادك(

আপনার অন্তঃকরণ শক্তিশালী ও দৃঢ় করার জন্য আমরা ধাপে ধাপে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছি।”

2. উক্ত আয়াতটি  উপরিউক্ত দিকটি ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিও লক্ষ্য স্থির করেছে বলে মনে করা যায়;আর তা হলো শিক্ষামূলক কল্যাণ ও উপকারিতার জন্য পবিত্র কোরআনের যে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় তা অবধারিত করে দেয় এবং তা এভাবেই মানব জাতির হেদায়েতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) ছিলেন তাঁর উম্মতের আদর্শ শিক্ষক ও আত্মিক চিকিৎসক। তাই ঐশী সমাধানসহ মানব জাতির শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টের সুষ্ঠু সমাধান করার লক্ষ্যে এ গ্রন্থ ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছে। মহান আল্লাহর বিধি-বিধান বাস্তবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে তাদের রোগ উপশম ও আরোগ্য করার জন্যও তা (এ গ্রন্থটি) মনোনীত হয়েছে।

ঐ শিক্ষাপদ্ধতি হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী যার জ্ঞানগত দিকগুলো ব্যবহারিক দিকগুলোর সাথে মিলেমিশে আছে। শিক্ষক ছাত্রদেরকে যা কিছু শিখান তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তা তাদেরকে হাতে-কলমে (ব্যবহারিকভাবে) দেখিয়েও দেন। তিনি তাঁর তত্ত্বসমূহকে ব্যবহারিক গবেষণায় রূপ দান করেন। তাঁর চিন্তাধারা ও তত্ত্বগুলো যেন নিছক অবাস্তব তত্ত্ব ও প্রকল্পের রঙে রঞ্জিত না হয় সে দিকেও তিনি খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।

চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক যদি কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বজনীন সূত্র এবং মূলনীতিসমূহের ওপর তাত্ত্বিক পাঠ দান করেন তাহলে তা তেমন কোন ফল বয়ে আনবে না। তবে তিনি যদি ছাত্রদের চোখের সামনে একটি রোগীর ক্ষেত্রে ঐ সব নিয়ম,সূত্র ও মূলনীতিসমূহ প্রয়োগ করেন এবং তাঁর বক্তব্যকে ব্যবহারিক শিক্ষায় রূপান্তরিত করেন তাহলে তিনি বেশি ফল লাভ করতে পারবেন।

পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ যদি একত্রে একবারে অবতীর্ণ হতো (যদিও মুসলিম সমাজ তখনও এগুলোর অনেকগুলোর প্রতি মুখাপেক্ষী ছিল না তবুও) এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ঐ ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব বিবর্জিত হতো যা আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। জনগণ যে সব আয়াত শিক্ষা করা অর্থাৎ যেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার ব্যাপারে তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না সে সব আয়াতের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা মানুষের অন্তরে তেমন লক্ষণীয় প্রভাব ফেলত না। তবে ওহীর ফেরেশতা যদি পবিত্র কোরআনের ঐ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেন জনতা যেগুলো শেখা ও যেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তাহলে নিঃসন্দেহে ও তর্কাতীতভাবে এ সব আয়াত জনগণের হৃদয়ে অধিক ইতিবাচক প্রভাব রাখবে এবং মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে এগুলো সুগ্রথিত হয়ে যাবে। আর তারাও ঐ সব আয়াতের শব্দ ও অর্থ শেখার ব্যাপারে অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করবে ও মনোযোগী হবে। এ সব কিছুর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে,তারা এ সব শিক্ষার পরিণতি ও ফলাফলসমূহকে প্রকৃতপ্রস্তাবে মহানবীর শিক্ষা বলেই উপলব্ধি করবে। এখানেই প্রশিক্ষকের বক্তব্য ও বাণী ফলাফলের সাথে একীভূত হয়ে যায়। আর সকল তত্ত্বও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়।

এখানে একটি প্রশ্নের উত্তর এখনও অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে। আর তা হলো পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহের অবতীর্ণ হওয়া যদি ধাপে ধাপে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে আয়াতসমূহের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ সব আয়াতের অন্তর্নিহিত জ্ঞান শিক্ষা ,আয়ত্তকরণ ,মুখস্থকরণ সংরক্ষণের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ প্রদর্শন উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। তবে সম্পূর্ণ পবিত্র কোরআন যদি একত্রে একবারে অবতীর্ণ হয় এবং ওহীর ফেরেশতা যদি কোরআনের সকল আয়াত একত্রে একবারে (মহানবীর কাছে )তেলাওয়াত করেন তাহলে মহান আল্লাহর ওহীর (সাথে সংশ্লিষ্ট )সকল বিষয়ের আন্তঃসম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অটুট সংরক্ষিত থাকবে। আর সব আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ জ্ঞান শেখার ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যকার ঝোঁক ,আগ্রহ উদ্যোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। পবিত্র কোরআন খুব ছোট একটি বাক্যের দ্বারা প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে :কোরআনের আয়াতসমূহ যে ধীরে ধীরে এবং বেশ কিছু উপলক্ষ কারণের পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে তা ঠিক ,তবে ধরনের পর্যায়ক্রমিক অবতরণ গ্রন্থের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বাধাই নয়। মহান আল্লাহ্ গ্রন্থের আয়াতসমূহের মধ্যে এমন এক বিশেষ সামঞ্জস্যতা দান আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন যে ,এর ফলে মানুষের উচ্চাশা সাহস তাকে পবিত্র কোরানের আয়াত শিখতে মুখস্থ করতে সক্ষম করে তোলে। বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতটিতেও উল্লিখিত হয়েছে :( و رتّلناه ترتيلا ) আর আমরা কোরআনের আয়াতসমূহে এক বিশেষ শৃঙ্খলা দান করেছি।

কোরআন ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হওয়ার অন্যান্য কারণ

3. মহানবী (সা.) তাঁর রিসালাত অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠী,যেমন মূর্তিপূজক,ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এ সব গোষ্ঠীর প্রতিটি স্বতন্ত্র মতাদর্শের অনুসারী ছিল এবং প্রতিটি গোষ্ঠী স্রষ্টা,পরকাল এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের ব্যাপারে স্বতন্ত্র আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করত। এ সব সাক্ষাৎ,কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণেই ঐশী বাণী ঐ সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর আকীদা-বিশ্বাস এবং অভিমতের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা ও ব্যাখা-বিশ্লেষণ (করেছে) এবং তাদের ধর্মসমূহ অপনোদন করার যুক্তি ও প্রমাণের অবতারণা করেছে (যদিও বিধর্মীদের পক্ষ থেকে কোন আবেদনও জানানো হয় নি)। এ ধরনের দেখা-সাক্ষাৎ,আলাপ-আলোচনা ও কথোপকথন বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে;এ কারণেই বিভিন্ন সময় ও উপলক্ষে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ ওহীর মাধ্যমে বিধর্মীদের আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিহীনতা বর্ণনা করা এবং ইসলামধর্ম বিরোধীদের উত্থাপিত বিভিন্ন আপত্তি ও সন্দেহ-সংশয়ের সঠিক উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না।

কখনো কখনো এ ধরনের সাক্ষাৎ,আলোচনা এবং কথোপকথনের কারণে বিধর্মীরা মহানবীর কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করত এবং মহানবীও তাদের ঐ সব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতেন। যেহেতু বিভিন্ন সময় ও উপলক্ষে তাদের এ সব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তাই বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে ওহী অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া এর আর কোন বিকল্পও ছিল না।

এ ছাড়াও মহানবীর জীবন ছিল একটি ঘটনাবহুল বিপ্লবী জীবন। তিনি এমন বিপুল সংখ্যক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন যেগুলোর বিধি-বিধান এবং ধর্মীয় দায়িত্ব ঐশী বাণীর মাধ্যমে স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কখনো কখনো সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু ঘটনা প্রবাহের সম্মুখীন হতো যার কারণে মহানবীর শরণাপন্ন হয়ে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বিধান কি হবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করত;আর যেহেতু বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটত ও এ সব প্রশ্ন উত্থাপিত হতো তাই ওহীর মাধ্যমে এ সব প্রশ্নের পর্যায়ক্রমে উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না।

পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এ সব বিষয় ও অন্যান্য বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে:

) و لا يأتونك بمثل إلّا جئناك بالحقّ و أحسن تفسيرا(

“আপনার ওপর তারা কোন খুঁত ধরতে সক্ষম নয়;(তারা যা কিছুই উত্থাপন করুক না কেন) আমরা আপনার কাছে সত্য এনে দিয়েছি এবং সর্বোত্তম পন্থায় (সব বিষয়ের) ব্যাখ্যা প্রদান করেছি। (সূরা ফুরকান : 33)

4. এ সব কিছু ছাড়াও পবিত্র কোরআনের পর্যায়ক্রমিক অবতরণের আরো একটি অন্তর্নিহিত রহস্য বা কারণ আছে,যে বিষয়ে জনগণ ছিল অমনোযোগী। আর তা হলো মানব জাতিকে পবিত্র কোরআনের উৎসের (মহান আল্লাহর) দিকে এবং এ বিষয়ের দিকে পরিচালিত করা যে,এ গ্রন্থটি মহান আল্লাহর ঐশী গ্রন্থ। আর তা কখনই মানবরচিত নয়। কারণ পবিত্র কোরআন দীর্ঘ 22 বছর ধরে বিভিন্নধর্মী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। আর এ সব ঘটনা দুঃখ,যন্ত্রণা,হাসি-আনন্দ ও সফলতামণ্ডিত ছিল (অর্থাৎ কোন কোন ঘটনা ছিল বিষাদময়,আবার কতিপয় ঘটনা ছিল আনন্দঘন ও সাফল্যমণ্ডিত)। নিশ্চিতভাবে এ ধরনের বিভিন্ন অবস্থা এবং পরস্পর বিপরীত আবেগ-অনুভূতি মানুষের আত্মা ও মন-মানসিকতার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এ ধরনের পরস্পর বিপরীত অবস্থায় কোন মানুষের পক্ষেই সব সময় এক ধাঁচে কথা বলা কখনই সম্ভব নয়;কারণ আনন্দ ও প্রফুল্লতার মধ্যে মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত ও লিখনীর মাধ্যমে প্রকাশিত কথা ও বাণী এবং দুঃখ,অবসাদ,ক্লান্তি এবং ব্যথা-বেদনার মধ্যে মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত কথা ও বাণীর মধ্যে ভাষার প্রাঞ্জলতা,সাবলীলতা,শব্দের সৌন্দর্য এবং গভীর অর্থ ও তাৎপর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যদিও পবিত্র কোরআন মহানবীর ওপর বিভিন্ন ঘটনা ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে তবুও এ গ্রন্থের বিভিন্ন আয়াতে শব্দ ও অর্থের দৃষ্টিতে ছোট-খাটো পার্থক্যও বিদ্যমান নেই। আর এ সব আয়াত এমন এক ভাষাগত মান ও পর্যায়ে অধিষ্ঠিত যে,এ গ্রন্থের কোন একটি আয়াত ও সূরার সমমানের অনুরূপ কোন কিছু রচনা করা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। যেন পবিত্র কোরআন এমন এক গলিত রৌপ্যসদৃশ যা একবারেই ছাঁচ থেকে বের করে আনা হয়েছে।

এ গ্রন্থের আয়াতসমূহের মাঝে কোন দুর্বলতা ও পার্থক্য বিদ্যমান নেই বরং এক অনন্য রত্ন ও রাজোচিত মুক্তার ন্যায় যার শেষাংশ প্রথমাংশের ন্যায়।

আর সম্ভবত নিচের আয়াতটি যা পবিত্র কোরআনে যে কোন ধরনের পার্থক্যের অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করে বলে, যদি তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হতো তাহলে এতে অনেক পার্থক্য থাকত’,তা অন্তর্নিহিত এ কারণ বা রহস্যটির দিকেই ইঙ্গিতস্বরূপ। আয়াতটি হলো :

) و لو كان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافا كثيرا(

  আর যদি তা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ হতো তাহলে তারা এতে প্রচুর পার্থক্য ও বৈপরীত্য খুঁজে পেত। (সূরা নিসা : 82)

তাফসীরকারগণ এ আয়াতটিকে কোরআনের আয়াতসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থের পার্থক্য ও বৈপরীত্যের সাথেই সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন,অথচ এ আয়াতটি এ ধরনের কোন পার্থক্য দূরীভূত করে না,বরং পবিত্র কোরআনকে সব ধরনের পার্থক্য ও বৈপরীত্য-যা মানবীয় কাজেরই অনিবার্য পরিণতি তা থেকে পবিত্র ও মুক্ত করে।

 

সপ্তদশ অধ্যায় : হিজরত