চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98271
ডাউনলোড: 8160


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98271 / ডাউনলোড: 8160
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

সফরের কর্মসূচীতে পরিবর্তন

তখনও মহানবী (সা.)-এর জীবনের 12টি বসন্ত গত হয় নি,ঠিক ঐ সময় হযরত আবু তালিব (রা.) কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার সাথে শাম দেশ গমন করেছিলেন। যে মুহূর্তে মালপত্র উটের পিঠে বেঁধে উটগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হলো এবং যাত্রা করার ঘণ্টা বেজে উঠল ঠিক তখনই মহানবী (সা.) হঠাৎ হযরত আবু তালিবের উটের দড়ি হাতে নিয়ে নিলেন;আর সেই মুহূর্তে তাঁর (মহানবীর) নয়ন যুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং ছল ছল করতে লাগল। তিনি বললেন, হে চাচা! আপনার সাথে আমিও অবশ্যই যাব। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চোখে অশ্রু দেখতে পেয়ে হযরত আবু তালিবেরও দু নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

হযরত আবু তালিবও এ ধরনের অতি সংবেদনশীল মুহূর্তে অত্যাবশ্যকীয় পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিজের সাথে সফরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। যদিও ঐ কাফেলায় তাঁর জন্য কোন স্থান আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা হয় নি তবুও তিনি (আবু তালিব) তাঁর (মহানবীর) সফরের যাবতীয় চাপ ও ঝামেলা নিজেই সামাল দিয়েছিলেন। তিনি মহানবীকে নিজের উটের পিঠেই সওয়ার করলেন। আর সফরে তিনি সব সময় তাঁর জন্য চিন্তা করতেন। এই সফরে তিনি মহানবী (সা.)-এর বেশ কিছু মু’জিযা প্রত্যক্ষ করে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন যেগুলো আবু তালিবের কাব্য সমগ্র অর্থাৎ দিওয়ানে সংকলিত হয়েছে।329

বিশ্বাসের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা

ঈমানী শক্তির মতো আর কোন শক্তিই হতে পারে না যা দৃঢ়তা,স্থিরতা ও অবিচলতা দানকারী। জীবনে মানুষের প্রগতি ও উন্নতির শক্তিশালী কারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি তার শক্তিশালী আস্থা ও বিশ্বাস যা সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে বিলীন করে দেয় এবং মানুষকে তার পবিত্র ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মৃত্যুরও মুখোমুখি করে।

ঈমানী শক্তিবলে বলীয়ান সৈনিক শতকরা একশ’ ভাগ বিজয়ী হবেই। যে যোদ্ধা বিশ্বাস করে যে,আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পথে হত্যা করা ও নিহত হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত সৌভাগ্য,আসলে বিজয় ও সাফল্য তার হবেই। যুগোপযোগী অস্ত্র ও হাতিয়ারে সজ্জিত হবার আগেই যোদ্ধার হৃদয় অবশ্যই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা দ্বারা পরিপূর্ণ হতে হবে;তার অন্তঃকরণ সত্যের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার আলোকবর্তিকা দ্বারা অবশ্যই আলোকিত হতে হবে। তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড,স্থিতি,যুদ্ধ ও সন্ধি অবশ্যই ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে হবে;তার যুদ্ধ,সংগ্রাম ও সন্ধি সবকিছুই অবশ্যই ঈমান ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

চিন্তা-চেতনা ও আকীদা-বিশ্বাস আমাদের আত্মা থেকেই উদ্ভূত। আর প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিন্তা-ভাবনার উৎপত্তিও তার বিবেক-বুদ্ধি থেকেই। মানুষ যেমন তার ঔরসজাত সন্তানকে ভালোবাসে ঠিক তেমনি সে তার চিন্তা-ভাবনার প্রতিও ভালোবাসা প্রদর্শন করে যা তার বিবেক-বুদ্ধি ও আত্মা হতে উদ্ভূত। বরং নিজ আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি মানুষের টান ও ভালোবাসা নিজের ঔরসজাত সন্তানের প্রতি টান ও ভালোবাসার চেয়েও বেশি। এ কারণেই মানুষ তার নিজ আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষণ করার জন্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজ আকীদা-বিশ্বাসের বেদীমূলে তার সব কিছু উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অথচ সে তার সন্তান-সন্ততি ও আপনজনদেরকে রক্ষা করার জন্য এতটা আত্মত্যাগ করে না।

অর্থ,ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার প্রতি মানুষের টান ও আগ্রহ সীমিত। যে পর্যন্ত না নিশ্চিত মৃত্যু তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সে পর্যন্ত সে অর্থ,সম্পদ ও পদমর্যাদা প্রাপ্তির চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সে-ই আবার আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং এ পথে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে। এভাবে সে মুজাহিদ বীর পুরুষদের বদনমণ্ডলে প্রকৃত জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করে। তাইإنّما الحياةَ عقيدةٌ وَجِهادٌ নিশ্চয়ই জীবনই হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস ও জিহাদ’-এ বাক্যটি তার জপমালায় পরিণত হয়।330

(প্রিয় পাঠকবর্গ!) আমাদের কাহিনীর মহানায়কের (পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ও সংরক্ষণকারী) জীবনীর দিকে একটু দৃষ্টি দিন;এ পথে কোন্ জিনিসটি তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে এবং কোন্ কারণের বশবর্তী হয়ে তিনি মৃত্যু ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে গিয়েছেন,নিজের জীবন,ধন-সম্পদ,সম্মান,পদমর্যাদা ও গোত্রের মায়াও ত্যাগ করেছেন এবং মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁর সবকিছু উৎসর্গ করেছেন? নিশ্চিত করে বলা যায় যে,তাঁর (আবু তালিব) কোন বস্তুবাদী কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল না এবং তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে ব্যবহার করে দুনিয়াবী কোন স্বার্থ উদ্ধার অর্থাৎ কোন পার্থিব সম্পদ অর্জন করতে চান নি। কারণ ঐ সময় মহানবী রিক্ত হস্ত ছিলেন এবং তাঁর কোন ক্ষমতা ও বিত্ত-বিভব ছিল না। আর আবু তালিবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (মহানবীকে ব্যবহার করে) সামাজিক প্রতিপত্তি,পদ ও মর্যাদা অর্জনও ছিল না। কারণ তখনকার সমাজে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদ ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন পবিত্র মক্কা ও বাতহা অঞ্চলের প্রধান। বরং মহানবীকে সাহায্য ও সমর্থন করার কারণে তিনি তাঁর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদা প্রায় হারাতে বসেছিলেন। কারণ মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে গিয়েই তো মক্কার গোত্রপতিগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তারা তাঁর ও বনি হাশিম গোত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

বাতিল ও অমূলক চিন্তা

সম্ভবত কোন কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী ব্যক্তি চিন্তা করতে পারে যে,হযরত আবু তালিবের আত্মত্যাগের কারণই হচ্ছে আত্মীয়তা ও রক্তসম্পর্ক। অর্থাৎ আরেকভাবে বলা যায় যে,অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও গোত্রীয় গোঁড়ামি তাঁকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বংশীয় গোঁড়ামি ও গোত্রীয় বন্ধনের কারণেই তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে নিজ অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

কিন্তু এ ধরনের ধারণা ও কল্পনা এতটা বৃথা ও ভিত্তিহীন যে সামান্য একটু অনুসন্ধান ও গবেষণা করলেই এর ভিত্তিহীনতা দিব্য পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ নিছক আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন কখনই মানুষকে তার পুরো অস্তিত্ব তারই এক আত্মীয়ের জন্য বিসর্জন দিতে,নিজ পুত্র আলীকে ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে উৎসর্গ করতে এবং ভ্রাতুষ্পুত্রের পথে নিজ সন্তানকে টুকরো টুকরো করতে মোটেও উদ্বুদ্ধ করবে না।

যদিও কখনো কখনো বংশীয় গোঁড়ামি মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় তবুও বিশেষভাবে কোন একজন নির্দিষ্ট আত্মীয়ের প্রতি এত তীব্র মাত্রায় বংশীয় গোঁড়ামি পোষণ করার কোন অর্থই থাকতে পারে না। অথচ হযরত আবু তালিব (রা.) একজন নির্দিষ্ট আত্মীয়ের জন্যই কেবল এতটা আত্মত্যাগ করেছিলেন যা তিনি আবদুল মুত্তালিব ও হাশিমের আর কোন বংশধরের জন্য কখনই করেন নি।

আবু তালিবকে উদ্বুদ্ধ করার প্রকৃত কারণ

এ মূলনীতির ভিত্তিতে (সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে) যে কারণ আবু তালিব (রা.)-কে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নিছক কোন বস্তুগত বিষয়,পদমর্যাদার লোভ বা গোত্রীয় সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি ছিল না। বরং কোন একটি আধ্যাত্মিক কারণ বা বিষয় তাঁকে আত্মোৎসর্গ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আর শত্রুদের চাপ ও ক্ষমতা তাঁকে সব ধরনের আত্মত্যাগ করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত রাখত। সেই কারণ যা তাঁকে আত্মোৎসর্গ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে তা ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। কারণ তিনি মহানবীকে মহৎ গুণাবলী ও মানবতার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ও নিদর্শন বলে বিশ্বাস করতেন। যেহেতু তিনি সত্যের প্রেমিক ছিলেন সেহেতু তিনি স্বভাবতই সত্যকে সমর্থন ও পক্ষাবলম্বন করবেন।

হযরত আবু তালিবের কবিতাসমূহ থেকে এ সত্যটি স্পষ্ট বোধগম্য হয়। তিনি প্রকাশ্যে মহানবীকে হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ.)-এর মতো নবী মনে করতেন। এখানে তাঁর কয়েকটি কবিতার বঙ্গানুবাদ পেশ করা হলো যেগুলো দ্বারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তাঁর ঈমান প্রমাণিত হয়ে যায় :

ليعلمْ خيارُ النّاسِ أنّ محمّداً

نبيٌّ كموسى والمسيح بن مريم

اتانا بهدىً مثل ما أتيا به

فكل بأمر الله يهدي ويعصم

সকল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি জেনে নিক যে,নিশ্চয়ই মুহাম্মদ

মূসা ও ঈসা ইবনে মরিয়মের মতো একজন নবী

তাঁরা দু জন যে হেদায়েত আনয়ন করেছিলেন,সেরূপ হেদায়েত তিনিও আমাদের জন্য এনেছেন

তাই তাঁদের প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর নির্দেশে হেদায়েত করেন এবং পাপ থেকে মুক্ত।”

وإنّكم تتْلونه في كتابكم

بصدقِ حديثٍ لا حديث المرجم

আর তোমরা তোমাদের গ্রন্থে তাঁর সত্যবাদিতার কথা

অবশ্যই পাঠ কর তিনি না জেনে শুনে কথা বলেন না।

আরেকটি কাসীদায় হযরত আবু তালিব নিজ ভাতিজার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস এভাবে ব্যাক্ত করেছেন :

ألم تعلموا أنّا وجدنا محمّداً

رسولاً كموسى خطَّ في أوّل الكتبِ

“তোমাদের কি জানা নেই যে,আমরা মুহাম্মদকে মূসা ইবনে ইমরানের মতো একজন রাসূল হিসাবে পেয়েছি। আর তাঁর নবুওয়াত সংক্রান্ত বিবরণ পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। 331

পূর্বোল্লিখিত কবিতাসমূহ এবং অন্যান্য কবিতা যেগুলো দিওয়ানে আবু তালিব তা ইতিহাসের পাতায় পাতায় এবং হাদীস ও তাফসীরের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। সেগুলো থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে,যে লক্ষ্য ও কারণ মহানবী (সা.) ও ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছে তা ছিল আসলে তাঁর বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর প্রকৃত আত্মসমর্পণ। কেবল তাঁর আকীদা ও ঈমান ব্যতীত আর কোন কারণ ও লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল না। আমরা মহানবী ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর আত্মত্যাগ,অকুণ্ঠ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের গুটিকতক নিদর্শন তুলে ধরব এবং আপনারা এ ধরনের আত্মোৎসর্গ ও ত্যাগের ব্যাপারে নিজেরাই গভীর ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা ও গবেষণা করবেন তাহলে তখন আপনারা নিজেরাই বিচার করতে পারবেন যে,এ ধরনের আত্মোৎসর্গ ও ত্যাগের উৎস মূল খাঁটি আকীদা-বিশ্বাস ও ঈমান ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না।

আবু তালিব (রা.)-এর ত্যাগের কতিপয় নমুনা

কুরাইশ নেতৃবর্গ মহানবী (সা.)-এর উপস্থিতিতে হযরত আবু তালিবের ঘরে একটি সভার আয়োজন করে। তাদের মধ্যে সেখানে বাক্য বিনিময় ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবার পর কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তাদের আলোচনার ফলাফলের অপেক্ষা না করেই সেখান থেকে উঠে গেল। ঐ অবস্থায় উকবা ইবনে আবি মুঈত উচ্চৈঃস্বরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল : তাকে (মহানবী) তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। তাকে সদুপদেশ দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাকে অবশ্যই হত্যা করা উচিত

(لا نعود إليه أبداً وما خير من ان نقتال محمّداً )।”

হযরত আবু তালিব (রা.) এ কথা শুনে খুবই মর্মাহত হলেন। তবে তিনি কিইবা করতে পারতেন। তারা (কুরাইশ সর্দারগণ) তাঁর ঘরে অতিথি হিসাবে এসেছিল। ঘটনাক্রমে মহানবী সেদিন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং আর ঘরে ফিরলেন না। সন্ধ্যার দিকে মহানবী (সা.)-এর চাচারা তাঁর ঘরে যান কিন্তু তাঁরা তাঁকে সেখানে দেখতে পেলেন না। হঠাৎ উকবার কথা হযরত আবু তালিবের মনে পড়ে গেল। তখন তিনি মনে মনে বললেন, অবশ্যই আমার ভাতিজাকে তারা হত্যা করে ফেলেছে।”

তখন তিনি চিন্তা করলেন যে,যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন অবশ্যই মক্কার ফিরআউনদের কাছ থেকে মুহাম্মদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। তাই তিনি পুরো বনি হাশিম গোত্র এবং আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের তাঁর নিজ গৃহে ডেকে প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র তাঁদের পোশাকের নিচে লুকিয়ে রেখে একত্রে মসজিদুল হারামে গমন করার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁদেরকে বললেন তাঁরা যেন প্রত্যেকেই প্রতি একজন করে কুরাইশ নেতার পাশে বসে। আর যখনই আবু তালিবের স্বর উচ্চকিত হবে এবং তিনি বলতে থাকবেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি মুহাম্মদকে চাচ্ছি (يا معشر قريش أبغي محمّداً ) তখন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা তাঁদের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াবেন এবং প্রত্যেকে যে ব্যক্তির কাছে বসেছেন তাকে হত্যা করে ফেলবেন;আর এভাবে সকল কুরাইশ নেতৃবৃন্দ একত্রে এক দফায় নিহত হবে।

হযরত আবু তালিব (রা.) যখন মসজিদুল হারামে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন ঠিক তখন অকস্মাৎ যায়েদ ইবনে হারেসা সেখানে উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি এতটা আশ্চর্যান্বিত হলেন যে,তাঁর বাকশক্তি যেন রহিত হয়ে গেল এবং বললেন, মহানবী (সা.)-এর কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি এক মুসলমানের ঘরে ধর্ম প্রচার কার্যে মশগুল আছেন। এ কথা বলেই তিনি মহানবীর কাছে দৌড়ে চলে গেলেন এবং তাঁকে হযরত আবু তালিবের অত্যন্ত বিপজ্জনক এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত করলেন। মহানবীও অতি দ্রূতগতিতে ঘরে পৌঁছলেন। হযরত আবু তালিব (রা.)-এর দৃষ্টি ভ্রাতুষ্পুত্র মহানবীর পবিত্র সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার ওপর পড়লে তাঁর দু চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে লাগল। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আমার ভাতিজা! তুমি কোথায় ছিলে? তুমি ভাল ছিলে তো? মহানবী চাচার প্রশ্নের জবাব দিলেন এবং বললেন যে,কেউ তাঁর কোন ক্ষতি করে নি।

হযরত আবু তালিব (রা.) পুরো ঐ রাতটা চিন্তামগ্ন ছিলেন। তিনি চিন্তা করছিলেন, আজ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র শত্রুর আক্রমণের শিকার হয় নি। তবে কুরাইশরা তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্থির ও শান্ত হতে পারবে না। তিনি এ উদ্যোগের মাঝে কল্যাণ ও মঙ্গল দেখতে পেলেন যে,তিনি পরের দিন প্রভাতে সূর্যোদয়ের পর যখন কুরাইশদের সভা ও জমায়েতগুলো জমজমাট হতে থাকবে তখন তিনি বনি হাশিম ও আবদুল মুত্তালিবের বংশধর যুবকদের সাথে মসজিদুল হারামে যাবেন এবং আগের দিন তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করবেন। আশা করা যায় যে,তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হবে এবং এরপর থেকে তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা ত্যাগ করবে। সূর্য কিছুটা উঁচুতে উঠলে কুরাইশদের ঘরবাড়ি থেকে বের হয়ে সভা ও সমবেত হওয়ার স্থানগুলোতে যাওয়ার সময় হলো। তারা তখনও কথাবার্তায় রত হয় নি ঠিক ঐ মুহূর্তে হযরত আবু তালিবকে দূর থেকে দেখা গেল। কুরাইশগণ দেখতে পেল যে,তাঁর পেছনে বেশ কিছু সাহসী যুবক আসছে। তারা হাত-পা গুটিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল যে,আবু তালিব (রা.) কি বলতে চান এবং কোন্ উদ্দেশ্যে তিনি লোকজন নিয়ে মসজিদুল হারামে এসেছেন?

হযরত আবু তালিব (রা.) কুরাইশদের সভার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, গতকাল মুহাম্মদ বেশ কয়েক ঘণ্টা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। আমি ভেবেছিলাম,তোমরা উকবার কথানুযায়ী তাকে হত্যা করে ফেলেছ। এ কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে,এ সব যুবককে সাথে নিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করব। এদের প্রত্যেককে আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম যে,তারা তোমাদের প্রত্যেকের পাশে বসে পড়বে এবং যখনই আমার কণ্ঠ উচ্চকিত হবে ঠিক তখনই বিলম্ব না করে তারা নিজেদের স্থান থেকে উঠে দাঁড়াবে এবং লুক্কায়িত অস্ত্র বের করে তোমাদেরকে হত্যা করবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত মুহাম্মদকে আমি জীবিত এবং তোমাদের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ পেয়েছি। এরপর তিনি তাঁর সাহসী যুবকদেরকে তাঁদের লুকানো অস্ত্র বের করে আনার নির্দেশ দিলেন। তিনি এ কথা বলার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, মহান আল্লাহর শপথ,যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে তাহলে আমি তোমাদের কাউকে আর জীবিত রাখতাম না এবং সর্বশক্তি নিয়োগ করে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম এবং...। 332

শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ! আপনারা যদি হযরত আবু তালিবের জীবনী অধ্যয়ন করেন তাহলে আপনারা দেখতে পাবেন যে,তিনি পুরো 42 বছর মহানবী হযরত মুহাম্মদকে সাহায্য করেছেন এবং বিশেষ করে তাঁর জীবনের সর্বশেষ দশ বছর (অর্থাৎ যা ছিল ঐ সময় পর্যন্ত মহানবীর নবুওয়াত ও ধর্ম প্রচার সময়কালের সমান) তিনি মহানবীর জন্য মাত্রাতিরিক্ত আত্মত্যাগ ও কোরবানী করেছিলেন। একমাত্র যে কারণটি তাঁকে এতটা দৃঢ়,স্থির ও অবিচল রেখেছিল তা ছিল তাঁর ঈমানী শক্তি ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস। আর আপনারা যদি তাঁর প্রিয় পুত্র আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ পিতার খেদমত ও অবদানের সাথে যোগ করেন তাহলে নিম্নোক্ত কবিতাসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য ও অর্থ আপনাদের কাছে স্পষ্ট হযে যাবে যা ইবনে আবীল হাদীদ এতদ্প্রসঙ্গে রচনা করেছিলেন। এখানে ঐ কবিতাগুলোর কিয়দংশের অনুবাদ  উল্লেখ করা হলো :

و لولا أبو طالب و ابنه

لما مثل الدّين شخصا و قاما

فذاك بمكة آوى و حامى

و هذا بيثرب جس الحماما

যদি আবু তালিব ও তাঁর সন্তান না থাকতেন,

তাহলে দীন কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না।

তিনি পবিত্র মক্কায় (মহানবীকে) আশ্রয় এবং সমর্থন দিয়েছেন

আর তাঁর সন্তান ইয়াসরিবে মৃত্যুর ভয়াল ঘূর্ণাবর্তের গভীরে প্রবেশ করেছেন। 333

আলোচনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

এতে কোন সন্দেহ নেই যে,আবু তালিবের ঈমান ও মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান সেগুলোর এক দশমাংশও যদি রাজনীতি,ঘৃণা ও শত্রুতা থেকে মুক্ত অন্য কোন ব্যক্তির ব্যাপারে বিদ্যমান থাকত তাহলে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকলেই সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর ঈমান ও মুসলিম হবার বিষয়টি মেনে নিত;অথচ হযরত আবু তালিবের ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সংক্রান্ত অগণিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে একটি গোষ্ঠী তাঁকে কাফির বলতে পেরেছে? এমনকি কেউ কেউ বলেছে যে,আযাব সংক্রান্ত আয়াতসমূহের মধ্য থেকে গুটিকতক আয়াতও তাঁর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে;আবার আরেকটি গোষ্ঠী এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। আর অত্যন্ত মুষ্টিমেয় সুন্নী আলেমও তাঁর ঈমান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের অন্যতম আল্লামা যায়নী দাহলান যিনি পবিত্র মক্কা নগরীর মুফতী ছিলেন (মৃত্যু 1304 হি.)। তবে অবশ্যই ইনসাফ করতে হবে যে,এ ধরনের আলোচনা উত্থাপন করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হযরত আবু তালিবের সন্তানগণ,বিশেষ করে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর প্রতি বক্র ও কটাক্ষ উক্তি ও মন্তব্য করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কতিপয় সুন্নী আলেম হযরত আবু তালিবকে যাতে করে ভালোভাবে কাফির বলে অভিহিত করতে পারেন সেজন্য মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধতন পূর্বপুরুষগণ পর্যন্ত এ আলোচনা সম্প্রসারিত করেছেন এবং তাঁর (মহানবীর) পিতা-মাতাকেও তাঁরা অবিশ্বাসী বলে অভিহিত করেছেন।

মহানবী (সা.)-এর পিতা-মাতাকে অবিশ্বাসী অভিহিত করার বিষয়টি ইমামীয়াহ্,যায়দীয়াহ্ এবং কতিপয় গবেষক সুন্নী আলেমের অভিমতের পরিপন্থী। কিন্তু কথা হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে যাঁরা সহজেই মহানবী (সা.)-এর একমাত্র সমর্থক,পৃষ্ঠপোষক,সাহায্যকারী এবং রক্ষককে কাফির বলে সাব্যস্ত করেছেন।

আবু তালিবের ঈমানের প্রমাণ

যে কোন ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে জানা ও শনাক্ত করা যায়:

1. তার থেকে যে সব তত্ত্বমূলক রচনা ও সাহিত্যকর্ম বিদ্যমান সেগুলো অধ্যয়ন করা,

2. সমাজে তার আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড এবং

3. তার ব্যাপারে তার নিরপেক্ষ বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের আকীদা-বিশ্বাস।

আমরা উপরিউক্ত তিনটি পদ্ধতিতে হযরত আবু তালিবের ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাস প্রমাণ করতে পারব।

হযরত আবু তালিবের কবিতাসমূহ পুরোপুরি তাঁর ঈমান ও নিষ্ঠার সাক্ষ্য দেয়। ঠিক একইভাবে তাঁর জীবনের সর্বশেষ দশ বছরে তিনি যে সব মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন সেগুলোও তাঁর অসাধারণ ঈমান ও বিশ্বাসের শক্তিশালী সাক্ষী। তাঁর নিরপেক্ষ নিকটবর্তী ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজনদের আকীদা ও বিশ্বাস হচ্ছে এই যে,তিনি একজন বিশ্বাসী মুসলমান ছিলেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিই তাঁর ঈমান ও ইখলাসের স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া আর কিছুই বলেন নি। এখন আমরা উপরিউক্ত তিন পদ্ধতিতে এ বিষয়টি পূর্ণরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করব :