চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98313
ডাউনলোড: 8161


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98313 / ডাউনলোড: 8161
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হিজরতের ঘটনা368

কুরাইশ গোত্রপ্রধানরা দারুন নাদওয়া য় জটিল এক সমস্যার সমাধানে পরস্পর মত বিনিময়ের মাধ্যমে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রচেষ্টায় রত হলো।

মক্কার মুশরিকরা নবুওয়াতের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ বর্ষে বিপদের অশনি সংকেত শুনতে পেয়েছিল। মুসলমানদের মদীনায় ঘাঁটি স্থাপন এবং মহানবীকে সর্ববিধ সহযোগিতা প্রদানে মদীনাবাসীদের সম্মতির বিষয়টি এ বিপদের স্পষ্ট আলামত।

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরের রবিউল আউয়াল মাসে মহানবীর হিজরতের অব্যবহিত পূর্বে তিনি,হযরত আলী,হযরত আবু বকর এবং অসুস্থ ও বৃদ্ধ কিছুসংখ্যক মুসলমানই কেবল মক্কায় অবস্থান করছিলেন এবং এঁরা সকলেই মক্কা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময়ই কুরাইশরা মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।

দারুন নাদওয়ায় কুরাইশ প্রধানদের পরামর্শ সভা বসলে সভার উদ্যোক্তারা মদীনায় মুসলমানদের সমবেত হওয়া এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের বিপদ ও এর ভয়াবহতা তুলে ধরে আলোচনা শুরু করল। তারা বলল, আমরা পবিত্র হারাম-এর অধিবাসীরা সকল গোত্রের নিকটই সম্মানিত ছিলাম,কিন্তু মুহাম্মদ আমাদের মাঝে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে বিপদ সৃষ্টি করেছে। আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। আমাদের এখন মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে,আমাদের মধ্য হতে সাহসী কেউ গোপনে মুহাম্মদকে হত্যা করবে। যদি এতে বনি হাশিম রক্তপণ চায় তাহলে আমরা সকলে তা পরিশোধ করব।

একজন অপরিচিত ব্যক্তি নিজেকে নাজদের অধিবাসী বলে পরিচয় দান করে বলল, তোমাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কারণ বনি হাশিম মুহাম্মদের হত্যাকারীকে হত্যা করবে এবং কোন অবস্থায়ই তারা মুহাম্মদের রক্তপণ নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তাই যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে হত্যা করতে চায় সে যেন নিজ জীবনের আশা ত্যাগ করে। আমার মনে হয় তোমাদের মাঝে এমন কোন ব্যক্তি নেই।

আবুল বাখতারী নামের অপর এক গোত্রপতি বলল, আমার মনে হয় মুহাম্মদকে বন্দী করাই অধিকতর যুক্তিসংগত। আমরা তাকে বন্দী করে খুবই কম খাদ্য ও পানীয় দিয়ে কোনরকমে বাঁচিয়ে রাখব এবং এভাবে তার দীনের প্রচারকে বন্ধ করব। নাজদের অধিবাসী পরিচয়দানকারী বৃদ্ধ ব্যক্তিটি পুনরায় বলল, পূর্বের পরামর্শের ন্যায় এটিও অগ্রহণীয়। কারণ এ ক্ষেত্রে বনি হাশিম তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে এবং অবশেষে তারা তাকে মুক্ত করে ছাড়বে। যদি তারা নিজেরা এ কাজে সক্ষম না হয় তবে হজ্বের সময় অন্য গোত্রসমূহের সাহায্য নিয়ে তারা তা করবে।

তৃতীয় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের উচিত হবে মুহাম্মদকে একটি ক্ষিপ্ত উটের ওপর উঠিয়ে শক্ত করে বেঁধে উটটিকে ক্ষেপিয়ে দেয়া। ফলে উট তাকে পাথরের সঙ্গে আছড়ে ছিন্নভিন্ন করে মেরে ফেলবে। যদি সে বেঁচেও যায় ও অপরিচিত কোন গোত্রের আশ্রয় পায় সেখানে তার দীন প্রচার করুক। সে গোত্রও মূর্তিপূজক হয়ে থাকলে তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে।

নাজদের বৃদ্ধ ব্যক্তিটি তৃতীয় বারের মতো এ মতটিকেও যুক্তিসংগত নয় বলে মন্তব্য করে বলল, মুহাম্মদের সুন্দর বক্তব্য ও আকর্ষণীয় কথার বিষয়ে তোমরা অবহিত। সে তার বাগ্মিতা ও যাদুকরী কথার মাধ্যমে অন্য গোত্রকে প্রভাবিত করে তার অনুসারী বানিয়ে ফেলবে ও তাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে।

এ সময় সমগ্র সভায় পিনপতন নীরবতা লক্ষ্য করা গেল। অকস্মাৎ নাজদের বৃদ্ধ ব্যক্তিটি আবু জাহলের কানে ফিসফিস করে কিছু বলল। তখন আবু জাহল বলল, একমাত্র নির্ভুল পথ হলো আমরা প্রতিটি গোত্র থেকে এক ব্যক্তিকে মনোনীত করব। তারা সম্মিলিতভাবে রাত্রিতে মুহাম্মদের গৃহে আক্রমণ করবে এবং তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। এতে করে মুহাম্মদের খুনের দায়দায়িত্ব সকল গোত্রের ওপরই বর্তাবে এবং বনি হাশিম সকলের সঙ্গে যুদ্ধে সক্ষম হবে না। এ মতটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। তখন প্রতিটি গোত্র হতে একেক ব্যক্তিকে মনোনীত করা হলো। তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হলো পরের রাত্রিতে সম্মিলিতভাবে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত

বাস্তবায়ন করার জন্য।369

গায়েবী সাহায্য

এ হঠকারী ও অবিবেচক গোত্রপ্রধানরা ভেবেছিল তাদের এ পরিকল্পনার মাধ্যমে আল্লাহ্পাকের মদদপুষ্ট নবী (সা.)-এর নবুওয়াতের মিশনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবে। তারা এ চিন্তা করে নি যে,মহানবীও পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীর ন্যায় ঐশী সাহায্যপ্রাপ্ত এবং যে অদৃশ্য হাত বিগত তের বছর ইসলামের প্রোজ্জ্বল মশালকে তীব্র বাতাসের মোকাবিলায় দীপ্তমান রেখেছে তা তাদের এ পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।

মুফাসসিরগণ বর্ণনা করেছেন,মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণের মাধ্যমে রাসূলকে মুশরিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাদের ষড়যন্ত্রের নিষ্ফলতা সম্পর্কে আশ্বাস

দেন :

) و إذ يمكربك الّذين كفروا ليثبتوك أو يقتلوك أو يخرجوك و يمكرون و يمكر الله و الله خير الماكرين(

এবং যখন কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে অথবা তোমাকে নির্বাসিত করবে। তারা যেমন ষড়যন্ত্র করে মহান আল্লাহ্ও তেমনি পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন করেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বোত্তম কৌশলী 370

মহানবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে মদীনার উদ্দেশে যাত্রার জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হলেন। কিন্তু মূর্তিপূজকদের নিয়োজিত কঠোর হৃদয়ের ব্যক্তিদের চোখ এড়িয়ে মক্কা হতে বের হওয়া সহজ কাজ নয়। বিশেষত মক্কা হতে মদীনার দূরত্ব খুব বেশি হওয়ার কারণে। যদি রাসূল সঠিক পরিকল্পনা ও মানচিত্র সহকারে মদীনার দিকে যাত্রা না করতেন তবে সম্ভাবনা ছিল মক্কার মুশরিকদের তাঁকে অনুসরণ করে বন্দী ও হত্যা করার।

ঐতিহাসিকগণ মহানবীর হিজরতের ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। এ সকল বর্ণনার মধ্যে এতটা পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়েছে যা প্রায় বিরল। সীরাতে হালাবী গ্রন্থের লেখক মোটামুটিভাবে এ পার্থক্যপূর্ণ বর্ণনাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করলেও এ সকল বর্ণনার বৈপরীত্য অবসানে সক্ষম হন নি।

যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো শিয়া ও সুন্নী উভয় হাদীসবেত্তাগণই হিজরতের ঘটনাটি এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যাতে করে এটি মুজিযা হিসাবে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু হিজরতের ঘটনার পটভূমি যদি কেউ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন মুশরিকদের হাত থেকে মহানবী (সা.)-এর মুক্তি তাঁর বিশেষ পরিকল্পনা ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে ঘটেছিল এবং আল্লাহ্ চেয়েছিলেন প্রাকৃতিক নিয়মে ও পরিকল্পনার মাধ্যমেই তাঁর নবী মুক্তি লাভ করুক- মুজিযার মাধ্যমে বা অলৌকিকভাবে নয়। এর প্রমাণ হলো নবীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রাকৃতিক উপায়সমূহের আশ্রয় গ্রহণ,যেমন আলী (আ.)-কে নিজ শয্যায় শায়িত হতে নির্দেশ দান,গুহায় আশ্রয় গ্রহণ প্রভৃতি পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে কুরাইশদের কব্জা থেকে মুক্ত করেন।

ওহীবাহী ফেরেশতা কর্তৃক মহানবীকে মুশরিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করা

ওহীবাহী ফেরেশতা মহানবীকে মুশরিকদের কপট ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন ও তাঁকে হিজরতের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন। মুশরিকদের বিভ্রান্ত করতে ও রাসূলের পশ্চাদ্ধাবন রোধে নবীকে তাঁর শয্যায় অন্য কাউকে শায়িত করার পরামর্শ দেয়া হয়। এতে করে তারা ভাববে নবী গৃহ হতে বাইরে কোথাও যান নি,বরং গৃহেই অবস্থান করছেন। তাই তারা তাঁর গৃহই শুধু অবরোধ করে রাখবে এবং মক্কার ভিতরের ও আশেপাশের পথগুলো স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

এ কারণেই মহানবী (সা.) তাদের চোখকে এড়িয়ে বিশেষ স্থানে পৌঁছতে ও আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এখন দেখা যাক কোন্ ব্যক্তি নবীর শয্যাস্থানে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে শুয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়,তিনি সে ব্যক্তিই হবেন যিনি রাসূলের ওপর প্রথম ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর মোমবাতিরূপ অস্তিত্বের চারিদিকে সব সময় প্রজাপতির মতো ঘুরতেন। অবশ্যই এ ব্যক্তিটি আলী ছাড়া অন্য কেউ নন। তাই মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, আজ রাতে তুমি আমার শয্যায় ঘুমাবে এবং যে সবুজ রঙের চাদরটি দিয়ে আমি নিজেকে ঢাকি তা দিয়ে নিজেকে আচ্ছাদিত করবে। শত্রুরা আমাকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাই আমি মদীনায় হিজরত করছি।

হযরত আলী (আ.) নবীর শয্যায় ঘুমালেন। কিছুটা রাত্রি হয়ে আসলে চল্লিশ জন সন্ত্রাসী নবীর গৃহকে ঘিরে ফেলল। তারা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে গৃহের অভ্যন্তরে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করে ভাবল শয্যায় যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনিই স্বয়ং নবী। মহানবী এ সময় সিদ্ধান্ত নিলেন গৃহ থেকে বেরিয়ে আসবেন। শত্রুরা গৃহের চারিদিক অবরোধ করে রেখেছিল এবং সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। অপর দিকে মহাশক্তির অধিকারী আল্লাহর ইচ্ছা হলো ইসলামের সম্মানিত নেতাকে তাঁর শত্রুদের কবল থেকে মুক্তি দেবেন। মহানবী (সা.) সূরা ইয়াসীনের প্রথম কয়েকটি আয়াত (فهم لا يبصرون পর্যন্ত)- যা এ ঘটনার সঙ্গে সংগতিশীল ছিল তেলাওয়াত করলেন ও গৃহ হতে বেরিয়ে এসে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলেন। নবী কিরূপে অবরোধকারীদের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে এলেন তা স্পষ্ট নয়। প্রসিদ্ধ শিয়া মুফাসসির আলী ইবনে ইবরাহীম কুমীو إذ يمكربك الّذين كفروا আয়াতটির তাফসীরে বর্ণনা করেছেন,নবী (সা.) যখন গৃহ হতে বেরিয়ে আসেন তখন অবরোধকারীরা সকলেই ঘুমিয়ে ছিল এবং ভোর হলে গৃহে প্রবেশের চিন্তা করেছিল। তারা ভাবেনি যে,রাসূল তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত আছেন।

অন্য ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন371 তারা নবীর গৃহ অবরোধ করার সময় থেকে জেগেই ছিল,কিন্তু নবী অলৌকিকভাবে তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গৃহ থেকে বের হয়ে আসেন।

যদিও এ ধরনের মুজিযা সংঘটিত হওয়ার বিষয়টিতে সন্দেহ পোষণ করা যায় না। কিন্তু প্রকৃতই এরূপ মুজিযা প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল কি? হিজরতের পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করলে স্পষ্টরূপে বলা যায় যে,মহানবী (সা.) তাঁর গৃহ অবরোধের পূর্বেই শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। তাই নিজের মুক্তির জন্য তিনি যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তা সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ছিল,এর মধ্যে কোন অলৌকিকত্বের প্রয়োজন ছিল না। তাই তিনি মুজিযার পথ অবলম্বন না করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শত্রুকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে নিজ শয্যায় আলীকে শুইয়ে দিয়ে গৃহ হতে বেরিয়ে এসেছিলেন,এমনকি তাঁর গৃহ অবরোধের পূর্বেই তিনি গৃহ হতে চলে যেতে পারতেন। তাই মুজিযা প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল না।

অবশ্য সম্ভাবনা রয়েছে মহানবী (সা.) কোন বিশেষ কারণে অবরোধ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন,তবে কারণটি আমাদের জানা নেই। তিনি রাত্রিতে গৃহ হতে বেরিয়ে আসেন-এ বিষয়টি সর্বসম্মত ও অকাট্য নয়। কারণ কারো কারো মতে তিনি সন্ধ্যার পূর্বেই গৃহ ত্যাগ করেছিলেন।372

নবুওয়াতের গৃহে শত্রুদের আক্রমণ

কুফরী শক্তি নবুওয়াতের গৃহ অবরোধ করে রেখেছিল এবং নবীকে তাঁর শয্যায় হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ চেয়েছিল মধ্যরাতেই গৃহে প্রবেশ করে তাঁকে হত্যা করতে। কিন্তু আবু লাহাব প্রতিবাদ করে বলেছিল,বনি হাশিমের নারী ও শিশুরা গৃহে রয়েছে,তাদের ক্ষতির আশংকা রয়েছে। কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন তাদের দেরী করার কারণ ছিল তারা দিবালোকে বনি হাশিমের সামনে তাঁকে হত্যা করবে যাতে করে বনি হাশিম বুঝতে পারে তাঁর হত্যাকারী এক ব্যক্তি নয়। তাই তারা ভোরের আলোয় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইচ্ছা পোষণ করেছিল।373

অন্ধকারের আচ্ছাদন একের পর এক উন্মোচিত হয়ে সুবহে সাদিকের আলো দিগন্তের বুকে প্রতিভাত হয়ে উঠল। অবরোধকারী মুশরিকদের অন্তর আশ্চর্যরকম আলোড়িত হতে শুরু করল। তারা আশান্বিত ছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। তারা চরম উত্তেজনা নিয়ে রাসূলের কক্ষে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে প্রবেশ করল। তখন আলী শয্যা হতে জাগরিত হয়ে যে চাদরে নিজেকে আবৃত করেছিলেন তা সরিয়ে সম্পূর্ণ প্রশান্ত চিত্তে তাদের প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি চাও? তারা বলল, মুহাম্মদকে চাই। সে কোথায়? আলী (আ.) বললেন, তোমরা কি তাঁকে আমার নিকট আমানত রেখে গিয়েছিলে,তাই এখন আমাকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছ? তিনি এখন গৃহে নেই।

প্রচণ্ড ক্ষোভ তাদের চেহারায় প্রকাশিত হলো এবং ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করায় চরমভাবে অনুতপ্ত হলো। এ পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার দায়িত্ব তারা আবু লাহাবের কাঁধে আরোপ করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। কারণ সে-ই রাত্রিতে আক্রমণে বাদ সেধেছিল।

কুরাইশরা তাদের ষড়যন্ত্রের নিষ্ফলতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলল,এত স্বল্প সময়ে মুহাম্মদ মক্কা হতে বেরিয়ে যেতে পারে নি;হয় সে মক্কারই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে,নতুবা মদীনার পথে রয়েছে। তাই তারা পশ্চাদ্ধাবনের প্রস্তুতি নিল।

সওর পর্বতের গুহায় মহানবী

এটি ঐতিহাসিক সত্য যে,মহানবী (সা.) হিজরতের প্রথম ও পরবর্তী দু রাত্রি মক্কার দক্ষিণে (মক্কা হতে মদীনার পথের ঠিক বিপরীত দিকে) অবস্থিত সওর পর্বতের গুহায় হযরত আবু বকরের সঙ্গে একত্রে অবস্থান করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে,কিরূপে হযরত আবু বকর রাসূলের সহগামী হলেন। কারো কারো মতে আকস্মিকভাবে তা ঘটেছিল এবং রাসূল তাঁকে পথে দেখে সঙ্গে নিয়েছিলেন। কোন কোন বর্ণনামতে নবী নিজ গৃহ হতে বেরিয়ে সরাসরি হযরত আবু বকরের গৃহে যান এবং তাঁকে নিয়েই সওর পর্বতের দিকে রওয়ানা হন। কেউ কেউ বলেছেন,আবু বকর রাসূলের সন্ধানে এলে আলী তাঁকে পথ দেখিয়ে দেন।374 অনেক ঐতিহাসিক হিজরতে নবীর সহগামী হওয়ার বিষয়টিকে প্রথম খলীফার বিশেষত্ব বলে মনে করে তাঁর ফজিলত হিসাবে বর্ণনা করে থাকেন।

মহানবীর সন্ধানে কুরাইশ গোত্র

কুরাইশদের পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে তারা রাসূলকে হাতে পেতে নতুন পরিকল্পনা নিল। তারা মদীনা গমনের সকল পথ বন্ধ করে দিল এবং এ সব পথে প্রহরী নিয়োগ করল। পায়ের চি‎‎ হ্ন দেখে অবস্থান শনাক্ত করতে পারদর্শী ব্যক্তিদের ডেকে আনা হলো। যে ব্যক্তি মহানবীর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারবে তার জন্য একশ উট পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। কুরাইশদের একদল মক্কার উত্তর দিকে মদীনার পথে এ কর্মে নিয়োজিত হলো। অথচ নবী (সা.) তাদের বিভ্রান্ত করতে মদীনার পথের ঠিক বিপরীতে মক্কার দক্ষিণের সওর পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। মক্কার প্রসিদ্ধ পদচি হ্ন ও চেহারা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আবু কারাস রাসূলের পদচি েহ্নর সঙ্গে পরিচিত ছিল। সে তাঁর পদচি‎‎ হ্ন লক্ষ্য করে এগিয়ে সওর পর্বত পর্যন্ত এসে পৌঁছল এবং কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলল, মুহাম্মদের গমন পথ এ পর্যন্ত স্পষ্ট। সম্ভবত সে এ পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেছে। এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয়া হলো গুহার অভ্যন্তরে লক্ষ্য করার। সে গুহার মুখে এসে দেখতে পেল গুহার মুখ মাকড়সার ঘন জালে আবৃত এবং এক বুনো কবুতর সেখানে বসে ডিমে তা দিচ্ছে।375 সে গুহায় প্রবেশ না করেই ফিরে এসে বলল, গুহার মুখে মাকড়সার ঘন জাল রয়েছে,তাতে বোঝা যাচ্ছে সেখানে কেউ নেই। তিনদিন ধরে মহানবীকে ধরার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হলো। অতঃপর তারা হতাশ হয়ে এ কাজ হতে বিরত হলো।

সত্যের পথে জীবন বাজি রাখা

ইতিহাসের এ অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো সত্যের পথে আলী (আ.)-এর জীবন বাজি রাখা। নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে এমন উৎসর্গপ্রেমিক ব্যক্তিরাই সত্যের পথে জীবন বাজি রাখতে পারে। যারা জান,মাল ও ব্যক্তিত্বকে বিলিয়ে দিয়ে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সকল শক্তিকে সত্যের পথে নিয়োজিত করতে পারে তারাই সত্যপ্রেমিকের খাতায় নাম লেখাতে পারে। তারা তাদের লক্ষ্যে যে পূর্ণতা ও সৌভাগ্য অবলোকন করে তা তাদের এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে তুচ্ছ করে স্থায়ী জীবনে সংযুক্ত হতে উৎসাহিত করে।

সেদিন নবীর শয্যায় আলী (আ.)-এর ঘুমানোর বিষয়টি সত্যের প্রতি তাঁর অসীম প্রেমের একটি নমুনা। ইসলামের টিকে থাকার বিষয়টি মানব জাতির সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা- এ বিশ্বাসই তাঁকে এরূপ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে উৎসাহিত করেছিল।

আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগের এ নমুনা এতটা মূল্যবান ছিল যে,আল্লাহ্ তাঁর প্রশংসা করে এটি যে তাঁর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই সম্পাদিত হয়েছিল তা কোরআনে উল্লেখ করেছেন :

) و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد(

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র। (সূরা বাকারা : 207)

অনেক মুফাসসিরই এ আয়াতটি এ পটভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন। হযরত আলীর এ কর্মটি এতটা গুরুত্বের দাবি রাখে যে,ইসলামের অনেক বড় বড় মনীষী তাঁর এ ভূমিকাকে তাঁর অন্যতম বড় ফজিলত বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাঁকে একজন আত্মত্যাগী প্রবাদপুরুষ বলেছেন। ঐতিহাসিকগণ হিজরতের ঘটনা বর্ণনা করলেই এ আয়াতটি তাঁর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে বলেছেন।376

এ সত্যটি কখনই হারিয়ে যাবার নয়। সত্যকে হয়তো কিছুদিন গোপন রাখা যায়,কিন্তু অবশেষে তা মেঘের আড়ালে গুপ্ত সূর্যের ন্যায় তার উজ্জ্বলতা নিয়ে বেরিয়ে আসবেই।

নবী পরিবারের সঙ্গে,বিশেষত হযরত আলীর সঙ্গে মুয়াবিয়ার শত্রুতার বিষয়টি কারো অজানা নয়। তিনি নবীর অনেক সাহাবীকে প্ররোচিত করে ইসলামের ইতিহাসের অনেক উজ্জ্বল ঘটনাকে ভিন্নভাবে বর্ণনা ও জাল করার মাধ্যমে মুছে ফেলতে চেয়েছেন,কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি তেমন সফল হন নি।

সামারাত ইবনে জুনদুব নামে এক ব্যক্তি রাসূলের জীবদ্দশায় জন্মগ্রহণ করে। সে তার শেষ জীবনে মুয়াবিয়ার দলে যোগ দেয় এবং মুয়াবিয়ার নিকট থেকে অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে সে সত্যকে বিকৃত করত। একবার মুয়াবিয়া তাকে নির্দেশ দেন মসজিদের মিম্বারে গিয়ে উপরিউক্ত আয়াতটি আলীর শানে অবতীর্ণ হয় নি বলে প্রচার করার এবং আয়াতটি আলীর হত্যাকারী আবদুর রহমান ইবনে মুলজিমের শানে অবতীর্ণ বলে হাদীস জাল করার। মুয়াবিয়া সামারাতের ঈমান ধ্বংসকারী এ কর্মের জন্য এক লক্ষ দিরহাম দিতে সম্মত হলেন। কিন্তু সামারাত তাতে রাজী না হলে মুয়াবিয়া চার লক্ষ্য দিরহাম দিতে চাইলেন এবং সামারাত এ অর্থের বিনিময়ে তার দীন বিক্রি করতে সম্মত হলো। এ লোভী বৃদ্ধ যার সমগ্র জীবন পাপে পূর্ণ ছিল,এ কর্মের মাধ্যমে তার আমলনামাকে আরো অন্ধকার করে তুলল। সে এক জনসমাবেশে ঘোষণা করল যে,এ আয়াতটি কখনই আলীর শানে নয়,বরং তাঁর হত্যাকারী আবদুর রহমান ইবনে মুলজিমের শানে অবতীর্ণ হয়েছে।

সরল চিন্তার অনেকেই তার এ কথা গ্রহণ করল। তারা ভেবেও দেখল না এ আয়াতটি অবতীর্ণের সময় আবদুর রহমান ইয়েমেনী হিজাযেই ছিল না,হয়তোবা আদৌ জন্মগ্রহণই করে নি। কিন্তু তার এ অপচেষ্টায় সত্য চাপা পড়ে যায় নি। এক সময় ইতিহাসের পরিক্রমায় তাঁর (মুয়াবিয়ার) শাসনক্ষমতার পরিসমাপ্তি ঘটল,মিথ্যা প্রচারের যুগের অবসানের মাধ্যমে মিথ্যা ও অজ্ঞতার পর্দা অপসারিত হলো এবং সত্য তার স্বকীয়তায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো। প্রথম সারির মুফাসসির377 ও মুহাদ্দিসগণ সকল যুগ ও সময়েই এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন যে,উপরিউক্ত আয়াতটি লাইলাতুল মাবিত নামে খ্যাত- যা হিজরতের উদ্দেশে নবীর গৃহ ত্যাগের রাত্রিতে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগের প্রশংসায় অবতীর্ণ হয়েছে।378