চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98270
ডাউনলোড: 8160


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98270 / ডাউনলোড: 8160
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

আরব জাতির মাঝে নারীর সামাজিক অবস্থান

আরব সমাজে নারীদেরকে পণ্যের মতো কেনা-বেচা করা হতো। তারা সব ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার,এমনকি উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। আরব বুদ্ধিজীবীরা নারীদেরকে পশু বলে মনে করত। আর এ কারণেই তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের পণ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্রের মধ্যে গণ্য করা হতো। এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েইو إنّما أمّهات النّاس أوعية মায়েরা ঘটি-বাটি ও থালা-বাসনের মতো’-এ প্রবাদ বাক্যটি আরবদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল।

প্রধানত দুর্ভিক্ষের ভয়ে এবং কখনো কখনো কলুষতা ও অশূচিতার ভয়ে আরবরা মেয়েদেরকে জন্মগ্রহণের পর পরই হত্যা করে ফেলত। কখনো পাহাড়ের ওপরে তুলে সেখান থেকে নিচে ফেলে দিত এবং কখনো কখনো পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করত। আমাদের মহান ঐশী গ্রন্থ যা অমুসলিম প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিতে ন্যূনপক্ষে একটি অবিকৃত ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক গ্রন্থ যা এতৎসংক্রান্ত একটি অভিনব কাহিনী বর্ণনা করেছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন তাদের কোন এক ব্যক্তিকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হতো তখন তার বর্ণ কালো হয়ে যেত এবং বাহ্যত সে যেন তার ক্রোধকে চাপা দিত। আর এই জঘন্য সংবাদ শোনার কারণে সে (লজ্জায়) তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াত। আর সে জানত না যে,সে কি অপমান ও লাঞ্ছনা সহকারে তার এ নবজাতক কন্যাসন্তান প্রতিপালন করবে,নাকি তাকে মাটির নিচে জীবন্ত পুঁতে ফেলবে? সত্যিই তাদের ফয়সালা কতই না জঘন্য! 27

সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল আরবদের বৈবাহিক ব্যবস্থা। পৃথিবীতে এর কোন নজির বিদ্যমান নেই। যেমন আরবদের কাছে স্ত্রীর কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। স্ত্রীর মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা স্ত্রীদেরকে নির্যাতন ও উৎপীড়ন করত। কোন মহিলা চারিত্রিক সততার পরিপন্থী কোন কাজ করলেই তার মোহরানা সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে যেত। কখনো কখনো আরবরা এনিয়মের অপব্যবহার করত। মোহরানা যাতে আদায় করতে না হয় সেজন্য তারা নিজেদের স্ত্রীদের ওপর অপবাদ আরোপ করত। পুত্রসন্তানগণ পিতার মৃত্যুর পর বা পিতা তালাক দিলে পিতার স্ত্রীদেরকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারত এবং এতে কোন অসুবিধা ছিল না। যখন মহিলা তার স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হতো তখন প্রাক্তন তথা প্রথম স্বামীর অনুমতির ওপর তার পুনর্বিবাহ নির্ভর করত। আর কেবল অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই প্রথম স্বামীর অনুমতি পাওয়া যেত। উত্তরাধিকারিগণ ঘরের আসবাবপত্রের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে মহিলাদের ( পিতার স্ত্রীদের ) মালিক হতো এবং তাদের মাথার ওপর রোসারী ( Scarf) নিক্ষেপ করে উত্তরাধিকারিগণ তাদের নিজ নিজ স্বত্বাধিকার ঘোষণা করত।

ছোট একটি তুলনা

সম্মানিত পাঠকবর্গ যদি ইসলামে নারীর অধিকার লক্ষ্য করেন তাহলে তাঁরা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে,নারীর অধিকার সংক্রান্ত এত সব বিধান প্রবর্তন এবং এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত উদ্যোগ যা মহানবী (সা.) কর্তৃক গৃহীত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে,মহানবী (সা.) সত্যনবী এবং ঐশী জগতের সাথে তাঁর যোগসূত্র ছিল। কারণ পবিত্র কোরআনের বহু আয়াত এবং মহানবী (সা.)-এর অগণিত হাদীসে নারীর অধিকারসমূহের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তিনিও তাঁর অনুসারীদেরকে নারীদের প্রতি সদাচরণ ও দয়া প্রদর্শন করার আহবান জানিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে নারীদের ব্যাপারে পুরুষদেরকে নিম্নোক্ত যে উপদেশ দিয়েছেন তার চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন,

أيّها النّاس فإنّ لكم على نسائكم حقّا و لهنّ عليكم حقّا و استوصوا بالنّساء خيرا فإنّهنّ عندكم عوان... أطعموهنّ ممّا تأكلون و ألبسوهنّ ممّا تلبسون

“হে লোকসকল! নারীদের ওপর যেমন তোমাদেরকে অধিকার দেয়া হয়েছে,ঠিক তদ্রূপ তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের ব্যাপারে তোমরা একে অপরের প্রতি সদাচরণ করার আদেশ দেবে। কারণ তারা (নারীরা) তোমাদের কাজকর্মে তোমাদের সাহায্যকারী। ...তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। আর তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তা-ই পরিধান করতে দেবে।”28

আরবদের সাহস ও বীরত্ব

বলা যেতে পারে যে,মানসিকভাবে জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ লোভী মানুষের পূর্ণাঙ্গ উপমা ছিল। পার্থিব বস্তুসামগ্রীর প্রতি ছিল তাদের দুর্বার আকর্ষণ। তারা প্রতিটি বস্তু বা বিষয়কেই তার অন্তর্নিহিত লাভ ও উপকারের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করত (অর্থাৎ যে জিনিসে যত বেশি লাভ ও উপকার পাওয়া যেত সেটিই তাদের কাছে প্রিয় ও কাম্য হতো)। তারা সর্বদা অন্যদের চেয়ে নিজেদের এক ধরনের উচ্চমর্যাদা,সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলে বিশ্বাস করত। তারা সীমাহীনভাবে স্বাধীন থাকতে ভালবাসত। তাই যে সব বিষয় তাদের স্বাধীনতাকে সীমিত করে দিত তা তারা মোটেও পছন্দ করত না।29

ইবনে খালদুন আরবদের অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, স্বভাবপ্রকৃতির দিক থেকে এ জাতিটি অসভ্য,বর্বর এবং লুটতরাজপ্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে অসভ্যতা ও বর্বরতার কারণগুলো এতটা গভীরে প্রোথিত ছিল যে সেগুলো যেন তাদের স্বভাব-চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের এ ধরনের অসভ্য স্বভাব-চরিত্রকে বেশ মজা করে উপভোগ করত। কারণ তাদের এই চারিত্রিক বর্বরতা ও অসভ্যতার কারণেই তারা কোন শাসকের শাসন বা আইন-কানুনের আনুগত্য ও সকল ধরনের বাধ্যতামূলক বন্ধন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারত এবং রাজ্যশাসন নীতির বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এটি স্পষ্ট প্রমাণিত যে,এ ধরনের স্বভাব-চরিত্র সভ্যতা ও কৃষ্টির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।...

এরপর তিনি আরো বলেছেন, তাদের স্বভাবে ছিল লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তি। তারা অন্যদের কাছে যা পেত তা ছিনিয়ে নিত। বর্শা ও তরবারির মাধ্যমেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো। অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রে তারা কোন সীমারেখার ধার ধারত না,বরং যে কোন সম্পদ ও জীবনযাপনের উপকরণের ওপর দৃষ্টি পড়লেই তারা তা লুণ্ঠন করত।”30

আসলে লুটতরাজ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ আরবদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। কথিত আছে,মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠে বেহেশতের সুখ-শান্তির কথা শোনার পর এক আরব বেহেশতে যুদ্ধ-বিগ্রহের অস্তিত্ব আছে কিনা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল। যখন তাকে এর উত্তরে বলা হলো : না সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের কোন অস্তিত্ব নেই,তখন সে বলেছিল, তাহলে বেহেশত থাকলেই বা লাভ কি? আরব জাতির ইতিহাসে 1700-এর বেশি যুদ্ধের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোন কোন যুদ্ধ 100 বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চলেছে। অর্থাৎ কয়েকটি প্রজন্ম পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করেই কালাতিপাত করেছে। কখনো কখনো অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ,রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।31 ইসলামপূর্ব আরব জাতির অন্যতম ঘটনা হচ্ছে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ যা ইতিহাসে হারবু দাহিস ওয়া গাবরা’নামে প্রসিদ্ধ। দাহিস ও গাবরা দু গোত্রপতির দু টি ঘোড়ার নাম ছিল। দাহিস বনি আবেস গোত্রের প্রধান কাইস বিন যুহাইরের ঘোড়ার নাম এবং গাবরা ছিল বনি ফিরাযাহ্ গোত্রপতি হুযাইফার ঘোড়ার নাম। উক্ত গোত্রপতিদ্বয়ের প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ঘোড়াকে অন্যের ঘোড়া অপেক্ষা অধিকতর দ্রুতগতিসম্পন্ন বলে মনে করত। অবশেষে তাদের মধ্যে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়;কিন্তু প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার দাবি করল। এই ত্চ্ছু বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। নিহতের গোত্রও হত্যাকারী গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করল। কিন্তু ঘটনাটি এখানেই শেষ হলো না,বরং এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দু বৃহৎ গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা  হলো যা 568 খ্রিষ্টাব্দ থেকে 608 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এর ফলে উভয় পক্ষের অগণিত লোক নিহত হয়।32

জাহেলী যুগের আরবরা বিশ্বাস করত যে,রক্ত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে রক্তকে ধুয়ে সাফ করা যায় না। শানফারা-এর ঘটনা যা একটি উপাখ্যানসদৃশ তা জাহেলী গোত্রপ্রীতির মাত্রার নির্দেশক হতে পারে। সে (শানফারাহ্) বনি সালমান গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে লাঞ্ছিত হলে এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উক্ত গোত্রের 100 জনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘকাল দিগ্বিদিক ঘোরাঘুরি ও চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অপমানকারী গোত্রের 99 জনকে হত্যা করে। এরপর একদল দস্যু একটি কূপের কাছে তাকেও হত্যা করে। বহু বছর পর নিহত শানফারা-এর হাড় ও মাথার খুলি অপমানকারী গোত্রের শততম ব্যক্তির হত্যার কারণে পর্যবসিত হয়। কাহিনীটি এরূপ : বনি সালমান গোত্রের এক পথিক সেখান দিয়ে অতিক্রম করছিল। হঠাৎ মরুঝড় মাথার খুলি উড়িয়ে এনে ঐ পথিকটির পায়ে কঠিনভাবে আঘাত করে। ফলে সে পায়ের তীব্র ব্যথায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়।33

আরব বেদুইনরা রক্তপাত,খুন-খারাবি,লুটতরাজ ও দস্যুবৃত্তিতে এতটা অভ্যস্ত ছিল যে,পরস্পর গর্ব-অহংকার করার সময় তারা অন্যদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকে তাদের অন্যতম গর্ব ও অহংকারের বিষয় বলে গণ্য করত। এক জাহেলী আরব কবি লুটতরাজ করার ক্ষেত্রে নিজ গোত্রের অপারগতা দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আকাঙ্ক্ষা করেছিল :

“হায় যদি সে এ গোত্রের না হয়ে অন্য কোন গোত্রের হতো যারা অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে লুটতরাজ করত।”34

এ জাতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এ রকম বলা হয়েছে :

) و كنتم على شفا حفرة من النّار فأنقذكم منها(

“আর তোমরা,হে আরব জাতি! অগ্নিকুণ্ডের ধারে ছিলে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন।”35

জাহেলিয়াত যুগের আরবদের সাধারণ চরিত্র

যা হোক অজ্ঞতা,মূর্খতা,সংকীর্ণ জীবনযাত্রা,জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থা না থাকা,হিংস্রতা,পাশবিকতা,অলসতা,বেহাল অবস্থা এবং আরো অন্যান্য চারিত্রিক দোষ-ত্রুটির ন্যায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান আরব উপদ্বীপের সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে লজ্জাজনক বিষয়াদি স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে যায়।

লুণ্ঠন,দস্যুবৃত্তি,জুয়া,সুদ ও মানুষকে বন্দী করা জাহেলী আরবীয় জীবনে বহুল প্রচলিত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তাদের আরেকটি জঘন্য কুঅভ্যাস ছিল মদ্যপান। এ ঘৃণ্য অভ্যাসটি জাহেলী আরব সমাজে এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে,তা তাদের ভাগ্য ও জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। আরবের কবিরা মদের গুণ এবং মদ্যপান বর্ণনায় তাদের অধিকাংশ কাব্যপ্রতিভা ব্যবহার করত। পানশালা রাতদিন 24 ঘণ্টাই উন্মুক্ত থাকত। এগুলোর ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের পতাকা উড়ত। ইসলামপূর্ব আরব সমাজে মদের কেনা-বেচার ব্যাপক প্রচলনের কারণে তাদের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য মদ বিক্রির সমার্থক ছিল।

আরবগণ চারিত্রিক নীতিমালাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করত। যেমন মহানুভবতা,সাহস ও তীব্র আত্মসম্ভ্রমবোধ আরবদের কাছে প্রশংসনীয় ছিল। তবে তাদের দৃষ্টিতে সাহসের অর্থ ছিল যুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত ঘটানো। আত্মসম্ভ্রমবোধ তাদের দৃষ্টিতে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হতো যার ফলে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মসম্ভ্রমবোধ বলে গণ্য হতো। আরবদের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা ও সংহতি ছিল নিজ গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ মিত্র গোত্রগুলোকে সমর্থন করা-তা সত্যই হোক,আর অন্যায়ই হোক।36 তারা মদ,নারী ও যুদ্ধের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত ছিল।

জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ কুসংস্কার পূজারী ছিল

পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নাতিদীর্ঘ বাক্যসমূহের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে (যদিও বাক্যগুলো ছোট,কিন্তু গভীর অর্থ ও তাৎপর্যমণ্ডিত)। ঐ সকল আয়াত যা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য তন্মধ্যে এ আয়াতটি এখানে উল্লেখ করা হলো :

) و يضع عنهم إصرهم و الأغلال الّتى كانت عليهم(

“তিনি (মহানবী) তাদের থেকে তাদের বোঝা এবং শিকল ও বেড়ী থেকে মুক্ত করেন যা তাদের ওপর (বাঁধা) রয়েছে।” (সূরা আরাফ : 157)

এখানে অবশ্যই দেখতে হবে যে,যে শিকল ও বেড়ীতে ইসলাম ধর্মের শুভ সূচনালগ্নে জাহেলিয়াতের যুগের আরব জাতির হাত ও পা বাঁধা ছিল তা কি? নিঃসন্দেহে এই শিকল ও বেড়ী লৌহ নির্মিত ছিল না,বরং এ সব শিকল ও বেড়ী বলতে কুসংস্কার,অলীক কল্পনা এবং ধ্যান-ধারণাকে বোঝানো হয়েছে যা মানুষের চিন্তাশক্তি ও বিবেকবুদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এ ধরনের বাঁধন যদি মানুষের চিন্তাশক্তির পাখার সাথে বেঁধে দেয়া হয় তাহলে তা লোহার বেড়ী ও শিকল হতে বেশি ক্ষতিকর হবে। কারণ লৌহনির্মিত শিকল কিছুদিন অতিবাহিত হলে বন্দীর হাত ও পা থেকে খুলে নেয়া হয়। আর জেলে বন্দী ব্যক্তিটি সুস্থ চিন্তাধারাসহকারে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু অমূলক চিন্তা,ধারণা এবং ভ্রান্ত কল্পনার শিকলে যদি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি,আবেগ-অনুভূতি এবং অনুধাবন শক্তি বাঁধা হয়ে যায় তাহলে তা আমৃত্যু তার সাথে থেকেই যেতে পারে এবং তাকে যে কোন ধরনের তৎপরতা ও প্রচেষ্টা,এমনকি তা এ ধরনের বাঁধন খোলার জন্যও যদি হয়ে থাকে তা থেকে তাকে বিরত রাখে। মানুষ সুস্থ চিন্তাধারা এবং বিবেক ও জ্ঞানের ছত্রছায়ায় যে কোন ধরনের কঠিন বাঁধন ও শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে সক্ষম। তবে সুস্থ চিন্তাধারা ছাড়া এবং সব ধরনের অলীক ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত না হলে মানুষের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম গৌরব ও কৃতিত্ব হচ্ছে,তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার,অমূলক চিন্তাভাবনা ও অলীক কল্প-কাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি মানব জাতির বিবেক-বুদ্ধিকে কুসংস্কারের মরিচা ও ধুলোবালি থেকে ধৌত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের চিন্তাশৈলীকে শক্তিশালী করতে এবং সব ধরনের কুসংস্কার,এমনকি যে কুসংস্কার আমার লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক সেটিরও বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই আমি এসেছি।”

বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,জনগণের ওপর শাসনকর্তৃত্ব চালানো ছাড়া যাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নেই তারা সব সময় যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে;এমনকি প্রাচীন কল্পকাহিনী এবং জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস যদি নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় তাহলে তারা তা প্রসার ও প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর তারা যদি চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদীও হয় তাহলেও তারা সাধারণ জনতার ধ্যান-ধারণা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী ঐ সকল অমূলক কল্প-কাহিনী ও ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করতে থাকে।

তবে মহানবী (সা.) যে সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস তাঁর ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কেবল সেগুলোর বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেন নি,বরং যে কোন ধরনের আঞ্চলিক কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যান অথবা ভিত্তিহীন চিন্তা ও বিশ্বাস যা তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সহায়ক সেটির বিরুদ্ধেও তাঁর সকল শক্তি ও ক্ষমতা নিয়োগ করে সংগ্রাম করেছেন। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন মানুষ যেন সত্যপূজারী হয়। ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনী,উপাখ্যান ও কুসংস্কারের পূজারীতে যেন পরিণত না হয়। এখন উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত কাহিনীটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন :

মহানবী (সা.)-এর এক পুত্রসন্তান মারা গেলেন যাঁর নাম ছিল ইবরাহীম। তিনি পুত্রবিয়োগে শোকাহত ও দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র নয়নযুগল থেকে অশ্রু ঝরছিল। ইবরাহীমের মৃত্যুর দিনে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আরবের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অলীক কল্প-কাহিনীর পূজারী জাতি সূর্যগ্রহণকে মহানবী (সা.)-এর ওপর আপতিত বিপদের চরম ও বিরাট হওয়ার প্রমাণ বলে মনে করল এবং বলতে লাগল : মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। মহানবী (সা.) তাদের এ কথা শুনে বললেন, চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার দু টি বড় নিদর্শন এবং তারা সর্বদা আদেশ পালনকারী। কারো জীবন ও মৃত্যু উপলক্ষে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। যখনই চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হবে তখন তোমরা সবাই নিদর্শনসমূহের নামায আদায় করবে।” এ কথা বলে তিনি মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে আয়াতের নামায পড়লেন।37

মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে চিন্তা করা যদিও মহানবী (সা.)-এর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করত এবং পরিণতিতে তাঁর ধর্মের অগ্রগতি ও প্রসারের ক্ষেত্রে সহায়কও হতো,কিন্তু তিনি চান নি এবং সন্তুষ্ট হতে পারেন নি যে,অলীক কল্প-কাহিনীর দ্বারা জনগণের অন্তরে তাঁর স্থান দৃঢ় ও শক্তিশালী হোক। অলীক কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে মূর্তিপূজা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তার উপাস্য হওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তা কেবল তাঁর রিসালাতের পদ্ধতি ছিল না,বরং তিনি তাঁর জীবনের সব ক টি পর্বেই,এমনকি তাঁর শৈশবকালেও কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

যে সময় মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল চার বছর এবং মরুভূমিতে দুধ মা হালিমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন তখন তিনি তাঁর দুধ মা হালিমার কাছে তাঁর দু ভাইয়ের সাথে মরুভূমিতে যাওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। হালিমা এ ব্যাপার বলেন, পরের দিন মুহাম্মদকে গোসল দিলাম। তার চুলে তেল ও চোখে সুরমা দিলাম। যাতে করে মরুর শয়তানগুলো তার অনিষ্ট সাধন করতে না পারে সেজন্য একটি ইয়েমেনী পাথর সুতায় ভরে তাকে রক্ষা করার জন্য তার গলায় পরিয়ে দিলাম।” মহানবী (সা.) ঐ পাথরটি গলা থেকে খুলে এনে দুধ মা হালিমাকে বললেন,مهلا يا إمّاه، فإنّ معي من يحفظني মা,শান্ত হোন,আমার আল্লাহ্ সর্বদা আমার সাথে আছেন। তিনি আমার রক্ষাকারী।”38