চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98336
ডাউনলোড: 8163


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98336 / ডাউনলোড: 8163
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

আমরা এখানে নবীর প্রতি মদীনার আনসারদের ভালোবাসার কিছু ক্ষুদ্র নমুনা তুলো ধরছি :

আমর ইবনে জুমুহ বনি সালমা গোত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিল। তার গৃহে একটি বিশেষ মূর্তি ছিল। মদীনার যুবকরা এ মূর্তির অক্ষমতা প্রমাণের জন্য তার গৃহ থেকে সেটি চুরি করে নিয়ে আসে ও তার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত পায়খানার গর্তে তা ফেলে দেয়। সে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মূর্তিটি সেখানে পায় এবং সেটি ধুয়ে-মুছে স্বস্থানে পুনঃস্থাপন করে। কিন্তু যুবকরা আবার তা চুরি করে ঐ গর্তে ফেলে দেয়। এভাবে তিন বার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে সে মূর্তিটির ঘাড়ে একটি তরবারি ঝুলিয়ে মূর্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে যদি এ বিশ্বে তোমার কোন ক্ষমতা থাকে তবে নিজেকে এর মাধ্যমে রক্ষা কর। কিন্তু তার এ কর্ম কোন ফল দেয় নি। যুবকরা পুনরায় তা চুরি করে একটি কুকুরের মৃতদেহের সঙ্গে বেঁধে অন্য একটি গর্তে ফেলে দেয়। সে অনেক খোঁজার পর ঐ গর্তে মূর্তিটিকে তরবারিহীন অবস্থায় পায়। এ ঘটনা থেকে সে বুঝতে পারে,মানুষ মাটি ও পাথরের মূর্তির সামনে অবনত হওয়া হতে ঊর্ধ্বের এক অস্তিত্ব। অতঃপর সে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করে :

تالله لو كنت إلها لم تكن

أنت و كلب وسط بئر في قرن

فالحمد لله العلى ذي المنن

ألواهب الرزاق و ديان الدين

هو الذي انقذنى من قبل أن

أكون في ظلمة قبر مرتهن

যদি তুমি উপাস্য হতে তবে কখনই মৃত কুকুরের সঙ্গে একত্রে এক গর্তে পড়ে থাকতে না। সে আল্লাহর প্রশংসা যিনি নেয়ামতের অধিকারী,রিযিকদাতা ও পুরস্কারদাতা। তিনিই আমাকে কবরের অন্ধকার হতে মুক্তি দিয়েছেন। 410

রাসূল (সা.) মদীনার দিকে যাত্রা করে মদীনার সন্নিকটে অবস্থিত সানিয়াতুল বিদা নামক স্থানে পৌঁছলে মুসলমানগণ ও মদীনার যুবকরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসল। তারা স্বাগতসূচক গান গেয়ে মদীনার অকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল। তাদের পঠিত গজলটি ছিল নিম্নরূপ :

طلع البدر علينا

من ثنيات الوداع

وجب الشّكر علينا

ما دعا لله داع

أيّها المبعوث فينا

جئت بالأمر المطاع

সানিয়াতুল বিদা হতে চন্দ্র উদিত হয়েছে,আমাদের ওপর এ নেয়ামতের শোকর করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। হে সেই মহান যাঁকে আল্লাহ্ আমাদের হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছেন এবং যাঁর নির্দেশ আমাদের নিকট অবশ্য পালনীয়।

আমর ইবনে আওফ গোত্র নবীর প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়ে বলল, আমরা অত্যন্ত পরিশ্রমী,যোদ্ধা ও সংগ্রামী জাতি। আপনি আমাদের মাঝেই থেকে যান। রাসূল (সা.) তাঁর অসম্মতির কথা তাদেরকে বুঝিয়ে বললেন। রাসূল মদীনার নিকটবর্তী হয়েছেন জানতে পেরে আওস ও খাজরাজ গোত্র তরবারী হাতে গজল গেয়ে তাঁর অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে এল। তারা তাঁর উটের চারিদিক ঘিরে ধরল। তিনি যখনই যে গোত্রের এলাকা অতিক্রম করছিলেন ঐ গোত্রের লোকেরা তাঁর উটের রশি ধরে টেনে আহবান জানাচ্ছিল তাদের গোত্রের মেহমান হওয়ার জন্য। নবী (সা.) তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,خلوا سبيلها فانها مامورة উটের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত কর,সে-ই দায়িত্বপ্রাপ্ত (অর্থাৎ উট যেখানে বসে পড়বে সেখানেই আমি নামব)। অবশেষে উটটি আসআদ ইবনে জুরারাহ্411 নামক এক ব্যক্তির অভিভাবকত্বে থাকা সাহল ও সুহাইল নামক দু ইয়াতীমের অধিকৃত স্থানে বসে পড়ে। স্থানটি খেজুর ও অন্যান্য ফসল শুকানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর গৃহ এর সন্নিকটেই ছিল। তাঁর মাতা চতুরতার সাথে গোপনে রাসূলের আসবাবপত্র তাঁর গৃহে নিয়ে উঠালেন। এদিকে সকলে নবীকে নিজ গৃহে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। মহানবী তাদের থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,أين الرحل (আমার) আসবাবপত্র কোথায়? সকলে বলল, আবু আইয়ুবের মাতা তা নিয়ে গেছেন। মহানবী বললেন,المرء مع رحله লোকেরা সেখানেই ওঠে যেখানে তার আসবাবপত্র থাকে। অতঃপর আসআদ ইবনে জুরারাহ্ উটের রশি ধরে নবীকে সেখানে পৌঁছে দেন।

নিফাকের উৎপত্তি

আওস ও খাজরাজ গোত্র মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে (মুনাফিক নেতা বলে প্রসিদ্ধ) মদীনার সর্বময় নেতা বলে গ্রহণ করার। কিন্তু নবীর সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় ঐ সিদ্ধান্ত কার্যত বাতিল হয়ে পড়েছিল। ফলে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহর অন্তরে ইসলামের মহান নেতা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠে এবং শেষ জীবন পর্যন্ত সে অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে নি। সে যখন রাসূলের প্রতি আওস ও খাজরাজ গোত্রের হৃদয় নিংড়ানো অভ্যর্থনা লক্ষ্য করল তখন তার অন্তরে বিদ্যমান হিংসা ও শত্রুতা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

يا هذا إذهب إلى الذين غرّوك و أتوابك فانزل عليهم و لا تغشنا في ديارنا

হে অনাহুত! যারা তোমাকে প্রতারিত করেছে তাদের নিকট ফিরে যাও,আমাদের প্রতারিত করতে এখানে এসো না। 412

মহানবী যেন তার কথায় সকলের প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ না হন এজন্য সা দ ইবনে উবাদা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে বললেন, এ ব্যক্তি আপনার প্রতি বিদ্বেষবশত এ কথা বলেছে। যেহেতু সে আওস ও খাজরাজের একচ্ছত্র নেতা হতে যাচ্ছিল এবং আপনার আগমনের মাধ্যমে তা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে মহানবী (সা.) শুক্রবার মদীনায় প্রবেশ করেন এবং বনি সালিম গোত্রের আবাসস্থলের নিকট সাহাবীদের নিয়ে জুমআর নামায পড়েন। তিনি নামাযের পূর্বে একটি অনলবর্ষী খুতবা দেন যা তারা পূর্বে কখনই শোনে নি এবং এ ধরনের শব্দ ও বাক্যের সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিল না। এ খুতবা তাদের অন্তরে গভীর ও চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে। ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে এবং আল্লামা মাজলিসী তাঁর বিহার গ্রন্থে খুতবাটি বর্ণনা করেছেন।413 অবশ্য আল্লামা মাজলিসীর বক্তব্যের সঙ্গে ইবনে হিশামের বর্ণনার পার্থক্য রয়েছে।

ছাব্বিশতম অধ্যায় : হিজরতের প্রথম বর্ষের ঘটনাপ্রবাহ

হিজরতের প্রথম বর্ষের414 ঘটনাপ্রবাহ

মহানবীর প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহ

মসজিদ : ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র

আনসার যুবক এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের অধিকাংশ ব্যক্তির উষ্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা মহানবীকে ঐক্যবদ্ধ সুন্দর সমাজ গঠনের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি জ্ঞানচর্চা,প্রশিক্ষণ,রাজনীতি ও বিচারকার্য সম্পাদনের কেন্দ্র হিসাবে মসজিদকে বেছে নিয়েছিলেন। যেহেতু তাওহীদ বা একত্ববাদের বিষয়টি ইসলামী কর্মসূচীর প্রথম ধাপ সেহেতু তিনি সব কিছুর পূর্বে এক আল্লাহর ইবাদাত ও স্মরণের লক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য মসজিদ তৈরি করেন।

ইসলামের সৈনিকগণ যেন প্রতি সপ্তাহের বিশেষ দিনে সেখানে সমবেত হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণের বিষয়ে পরামর্শ করতে পারে সে লক্ষ্যেও নবী (সা.) এ কেন্দ্রটি স্থাপন করেছিলেন। মুসলমানগণ সেখানে প্রত্যহ সমবেত হতেন এবং বছরে দু বার ঈদের জামায়াতে সকল প্রান্ত হতে মুসলমানগণ সেখানে আসতেন।

মসজিদ শুধু ইবাদাতের কেন্দ্রই ছিল না,বরং সে সাথে ইসলামী বিধিবিধান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কার্যক্রমও সেখানে সম্পাদিত হতো। ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা ছাড়াও লিখন ও পঠন শিক্ষা দান করা হতো। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত মসজিদ পাঞ্জেগানা নামাযের বাইরের সময়গুলোতে মাদ্রাসা বা দীনী শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।415 পরবর্তীতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ রূপে আবির্ভূত হয়। ইসলামের অনেক মনীষীই মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ও পাঠচক্রের ফসল।

কখনো কখনো মদীনার মসজিদ সাহিত্য চর্চা কেন্দ্রের রূপ নিত। আরবের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ তাঁদের রচিত যে সব কবিতা ইসলামী নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণপদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল ছিল তা মসজিদে নববীর সামনে পাঠ করে শুনাতেন। আরবের বিশিষ্ট কবি কা ব ইবনে যুহাইর মহানবী (সা.)-এর প্রশংসায় রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ বানাত সুয়াদ কাসীদাটি এ মসজিদেই মহানবীর সামনে পাঠ করে শুনান এবং তাঁর নিকট থেকে মূল্যবান পুরস্কার লাভ করেন। অপর এক প্রসিদ্ধ কবি হাসসান ইবনে সাবিত,যিনি ইসলাম ও নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসায় অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি এ মসজিদেই তাঁর কবিতাসমূহ পাঠ করে শুনাতেন।

মহানবী (সা.)-এর সময় মদীনার মসজিদে শিক্ষার আসরগুলো এতটা আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত ছিল যে,বনি সাকিফের সফরকারী প্রতিনিধিরা তা দর্শনে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় বিধিবিধান ও জ্ঞান শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ লক্ষ্য করে তারা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল।

অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের কার্যটিও মসজিদে সম্পাদিত হতো। সে সময় মসজিদ প্রকৃত অর্থেই একটি বিচারালয় ছিল। এ ছাড়া কাফির ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জিহাদের আহবান জানিয়ে অনলবর্ষী বক্তৃতাসমূহ রাসূল (সা.) মসজিদেই দিতেন। সম্ভবত ধর্ম ও জ্ঞানকে মসজিদে সমন্বিত করার যে প্রয়াস মহানবী নিয়েছিলেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই যে,তিনি দেখিয়ে যেতে চেয়েছেন জ্ঞান ও ঈমান (বিশ্বাস) পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই যেখানেই ঈমানের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন একই সঙ্গে তা জ্ঞানকেন্দ্রও হতে হবে। বিচারকার্য,সামাজিক সেবাদান ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ঘোষণা প্রদানের কার্যসমূহ মসজিদে এ লক্ষ্যেই সম্পাদিত হতো যে,নবী (সা.) বুঝাতে চেয়েছেন তাঁর প্রতি অবতীর্ণ শরীয়ত শুধু আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়,বরং মানুষের বৈষয়িক কার্যসমূহও তার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এ ধর্ম মানুষকে ঈমান ও তাকওয়ার দিকেই শুধু দাওয়াত দেয় না,সে সাথে সমাজ সংস্কার ও পরিচালনার বিষয়ের প্রতিও দৃষ্টি দেয় এবং এ দিকগুলোর প্রতি অসচেতন নয়।

জ্ঞান ও ঈমানের সমন্বয়ের বিষয়টি এখনও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান। এ কারণেই মহানবীর যুগের পরবর্তী সময়ে যখন শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ বিশেষ রূপধারণ করে তখনও দেখা গেছে মসজিদকে কেন্দ্র করেই শিক্ষাঙ্গন ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা (মুসলমানগণ) বিশ্ববাসীর নিকট প্রমাণ করতে চেয়েছে যে,মানুষের সৌভাগ্যের নিয়ামক এ দু টি উপকরণ (জ্ঞান ও ঈমান) পরস্পর অবিচ্ছেদ্য।