চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98291
ডাউনলোড: 8160


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98291 / ডাউনলোড: 8160
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সনদ (চুক্তিনামা)

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

এ চুক্তিনামা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানগণ এবং তাদের অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পাদন করেন।

ধারা : 1

উপধারা 1 : এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষরকারিগণ এক জাতি হিসাবে পরিগণিত হবে। কুরাইশ মুহাজিরগণ তাদের ইসলামপূর্ব নিয়মানুযায়ী রক্তপণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। যদি তাদের কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে অথবা তাদের কেউ বন্দী হয় তবে এ ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমবেতভাবে ঐ রক্তপণ আদায় করবে ও বন্দীকে মুক্ত করতে হবে।

উপধারা 2 : বনি আওফ কুরাইশ মুহাজিরদের ন্যায় এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী আইন অনুসরণ করবে এবং তাদের গোত্রের বন্দীদেরকে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে। তেমনিভাবে আনসারদের মধ্যে যে সব গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে,যেমন বনি সায়েদা,বনি হারিস,বনি জুশাম,বনি নাজ্জার,বনি আমর ইবনে আওফ,বনি নাবিত ও বনি আওস,তারাও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তির রক্তপণ সমবেতভাবে প্রদান করবে এবং তাদের বন্দীদেরকে গোত্রের সকলে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে।

উপধারা 3 : আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে মুসলমানগণ সমবেতভাবে সাহায্য করবে। কোন মুসলমান যদি রক্তপণ অথবা মুক্তিপণ প্রদানের কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তবে সকলে মিলে তাকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা 4 : পরহেজগার মুমিনগণ তাদের কোন ব্যক্তি অবাধ্য হলে এবং অনাচার করলে তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে,যদিও সে ব্যক্তি তাদের কারো সন্তান হয়।

উপধারা 5 : কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানের সন্তান অথবা দাসের সঙ্গে তার পিতা ও মনিবের অনুমতি ব্যতিরেকে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না।

উপধারা 6 : কোন কাফিরকে হত্যা করার দায়ে কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করার অধিকার কোন মুমিনের নেই। কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সহযোগিতা করা যাবে না।

উপধারা 7 : চুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মুসলমান সমান। এ দৃষ্টিতে উচ্চ-নিচ সকল মুসলমানই সমানভাবে কাফেরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে।

উপধারা 8 : মুসলমানগণ একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী।

উপধারা 9 : ইয়াহুদীদের মধ্য হতে যে আমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণ করে সে আমাদের সহযোগিতা পাবে। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য মুসলমানের কোনই পার্থক্য নেই এবং তার প্রতি অবিচার করার অধিকার করো নেই। তার বিরুদ্ধে কাউকে ক্ষেপিয়ে তোলা ও তার শত্রুকে সাহায্য করা যাবে না।

উপধারা 10 : সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অপর মুসলমানের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিদান না করে সন্ধি চুক্তি করা যাবে না।

উপধারা 11 : মুসলমানদের বিভিন্ন দল পালাক্রমে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহণ করবে যাতে আল্লাহর পথে তাদের রক্ত সমভাবে উৎসর্গীকৃত হয়।

উপধারা 12 : মুসলমানদের অনুসৃত পথ সর্বোত্তম পথ।

উপধারা 13 : কুরাইশ মুশরিকদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সহযোগিতা করার কোন অধিকার মদীনার মুশরিকদের নেই এবং তাদের সঙ্গে তারা কোনরূপ চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। তাদেরকে মুসলমানদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

উপধারা 14 : যদি কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং তার এ অপরাধ শরীয়তগতভাবে প্রমাণিত হয়,তাহলে হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। তবে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তবে তাকে প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এ উভয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব হলো হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ।

উপধারা 15 : যে ব্যক্তিই এ চুক্তিনামার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করবে তার এ চুক্তিনামা লঙ্ঘনের ও কোন অপরাধীকে সহযোগিতা ও আশ্রয় দানের কোন অধিকার নেই। যে কেউই অপরাধীকে সহযোগিতা করলে কিংবা আশ্রয় দিলে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে সকল ক্ষতির দায়-দায়িত্ব তার।

উপধারা 16 : যে কোন বিভেদের ফায়সালার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল।

ধারা : 2

উপধারা 17 : মদীনাকে রক্ষার জন্য মুসলমানরা যুদ্ধ করলে ইয়াহুদীদেরকে অবশ্যই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে হবে।

উপধারা 18 : বনি আওফের ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে এক জাতি হিসাবে পরিগণিত এবং মুসলমান ও ইয়াহুদীরা তাদের ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। তাদের দাসরা এ বিধানের অন্তর্গত অর্থাৎ তারাও এ ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে যে সকল অন্যায়কারী তার নিজ ও পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তারা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ব্যতিক্রমের ফলে ঐক্য কেবল শান্তিপ্রিয় মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়েছে।

উপধারা 19 : বনি নাজ্জার,বনি হারিস,বনি সায়েদা,বনি জুশাম,বনি আওস,বনি সায়ালাবা ও বনি শাতিবার ইয়াহুদীরাও বনি আওফ গোত্রের ইয়াহুদীদের ন্যায় উপরিউক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সায়ালাবা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত জাফনা গোত্র এবং বনি শাতিবার অন্তর্ভুক্ত সকল উপগোত্রও বনি আওফের ন্যায় অধিকার ভোগ করবে।

উপধারা 20 : এ চুক্তির অধীন সকলকেই তাদের মন্দের ওপর ভালো বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিজয়ী করতে হবে।

উপধারা 21 : বনি সায়ালাবার অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহ বনি সায়ালাবার জন্য প্রযোজ্য বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা 22 : ইয়াহুদীদের উপরিউক্ত গোত্রসমূহের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গ এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা 23 : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউই এ চুক্তিবদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

উপধারা 24 : এ চুক্তির অধীন প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত সম্মানিত (অর্থাৎ আহত ও নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির রক্তের মর্যাদার বিধান রয়েছে)। যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তবে তার ওপর কিসাসের বিধান কার্যকরী হবে। এর (হত্যার) মাধ্যমে সে যেন নিজ ও স্বীয় পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। কিন্তু হত্যাকারী যদি অত্যাচারিত হয় তবে তার বিধান ভিন্ন।

উপধারা 25 : যদি মুসলমান ও ইয়াহুদীরা সমবেতভাবে যুদ্ধ করে তবে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে যুদ্ধের খরচ বহন করবে। যদি কেউ চুক্তিবদ্ধ জোটের কোন এক অংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে জোটের অন্তর্ভুক্ত সকল পক্ষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

উপধারা 26 : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহ কল্যাণের ভিত্তিতে পরস্পরের সহযোগী- অকল্যাণের ভিত্তিতে নয়।

উপধারা 27 : চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষই অন্য কোন পক্ষের ওপর অবিচার করার অধিকার রাখে না। কেউ এরূপ করলে সকলকে অবশ্যই অত্যাচারিত পক্ষকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা 28 : চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষের জন্য মদীনা নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হলো।

উপধারা 29 : চুক্তিবদ্ধ পক্ষের কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রতিবেশীকে আশ্রয় দান করে তবে তার জীবন অন্য সকলের জীবনের ন্যায় সম্মানার্হ এবং কোনক্রমেই তার ক্ষতি করা যাবে না।

উপধারা 30 : কোন নারীকেই তার নিকটাত্মীয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

উপধারা 31 : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহের সকল ব্যক্তি ও গোত্র মুমিন হোক বা কাফের তাদের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির সঙ্গে রয়েছেন যে ব্যক্তি এ চুক্তিনামার প্রতি সর্বাধিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

উপধারা 32 : কুরাইশ ও তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি ও গোত্রকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

ধারা : 3

উপধারা 33 : এ চুক্তি স্বাক্ষরকারী সকল পক্ষ সমবেতভাবে মদীনাকে রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

উপধারা 34 : যদি মুসলমানরা ইয়াহুদীদেরকে কোন শত্রুর সঙ্গে সন্ধির আহবান জানায় তবে তাদেরকে তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপ ইয়াহুদীরা যদি মুসলমানদের কোন শত্রুপক্ষের সঙ্গে সন্ধির আহবান জানায় তবে মুসলমানগণ তা গ্রহণে বাধ্য। তবে যদি ঐ শত্রুপক্ষ ইসলামের শত্রু ও ইসলাম প্রচারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে তবে তা গ্রহণীয় নয়।

উপধারা 35 : আওস গোত্রের গোলাম-মনিব নির্বিশেষে সকল ইয়াহুদী এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।

ধারা : 4

উপধারা 36 : এ চুক্তিনামা অত্যাচারী ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না।

উপধারা 37 : মদীনায় অবস্থানকারী যে কোন ব্যক্তি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী এবং মদীনা থেকে যারা বাইরে যাবে তারাও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী,তবে এ বিধান অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

এ চুক্তিনামার শেষ বাক্যটি ছিল :إنّ الله جار لمن برّ واتّقى و محمد رسول الله সৎকর্মপরায়ণ এবং পরহেজগার ব্যক্তির নিরাপত্তা দানকারী স্বয়ং আল্লাহ্ এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। 429

এ রাজনৈতিক চুক্তিপত্রটির কিছু অংশ আমরা অনুবাদ করেছি। ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতা,সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজের প্রয়োজনে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি এতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। সর্বোপরি এ চুক্তিপত্রে নেতার দায়িত্ব ও ইখতিয়ার এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী সর্বসাধারণের দায়িত্বের বিষয়টি পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে।

যদিও এ চুক্তিনামায় শুধু আওস ও খাজরাজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ইয়াহুদীরা স্বাক্ষর করেছিল এবং ইয়াহুদীদের বড় তিন গোত্র বনি কুরাইযাহ্,বনি নাদির ও বনি কাইনুকা অংশগ্রহণ করে নি,কিন্তু পরবর্তীতে তারাও মুসলমানদের নেতা মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে স্বতন্ত্র চুক্তি করেছিল। এ চুক্তিনামার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নিম্নরূপ :

এ তিন গোত্র স্বতন্ত্রভাবে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে,তারা রাসূল ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালাবে না। তারা তাদের মুখ ও হাতের দ্বারা নবী (সা.)-এর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না এবং মুসলমানদের শত্রুদের অস্ত্র ও যুদ্ধবাহন সরবরাহ করবে না। যদি কখনও তারা এ চুক্তিপত্রের বিরোধী কিছু করে তবে তাদের রক্ত ঝরানো মহানবীর জন্য বৈধ হয়ে যাবে এবং তাদের সম্পদ ক্রোক এবং নারী ও সন্তানদের বন্দী করা হবে। এ চুক্তিপত্রে বনি নাদিরের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব,বনি কুরাইযার পক্ষে কায়াব ইবনে আসাদ এবং বনি কাইনুকার পক্ষে মুখাইরিক স্বাক্ষর করে।430

এ চুক্তিনামার ফলশ্রুতিতে মদীনা নিষিদ্ধ (হারাম) ও নিরাপদ এলাকায় পরিণত হলো। এখন মহানবী (সা.) প্রথম সমস্যা অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা শুরু করলেন। কারণ যতক্ষণ তাঁর দীনের প্রচারের প্রতিবন্ধক এ শত্রু বিদ্যমান রয়েছে ততক্ষণ তাঁর দীনের প্রচার কার্যক্রম সফলতা লাভ করতে পারবে না।

ইয়াহুদীদের অপচেষ্টাসমূহ

ইসলামের মহান শিক্ষা ও মহানবী (সা.)-এর উন্নত নৈতিক চরিত্র ও আচরণের প্রভাবে দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগল ও সে সাথে তাদের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিও সুসংহত হলো। মুসলমানদের এ অগ্রগতি মদীনার ইয়াহুদীদের মধ্যে ভীতি ও অস্থিরতার সৃষ্টি করল। কারণ তারা ভেবেছিল ইসলামের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা মহানবীকে নিজেদের দিকে টানতে পারবে। তারা কখনই ভাবতে পারে নি যে,একদিন মহানবীর শক্তি ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের ছাড়িয়ে যাবে। এ কারণেই তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা সাধারণ মুসলমানদের নিকট ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিল প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে মহানবীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টির দ্বারা তাঁর প্রতি তাদের বিশ্বাসকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালাত। কিন্তু তাদের এ ষড়যন্ত্র প্রকৃত মুসলমানদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় নি। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা ও সূরা নিসায় তাদের উপস্থাপিত এরূপ বিতর্কিত কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্মানিত পাঠকগণ এ দু টি সূরা পাঠ করলে ইয়াহুদীদের একগুঁয়েমি ও শত্রুতামূলক মনোভাবের পরিচয় পাবেন। যদিও তারা যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করত তার স্পষ্ট উত্তর দেয়া হতো তদুপরি তারা ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য অজুহাত দেখাত এবং নবীর আহবানের উত্তরে বলত :قلوبنا غلف আমাদের অন্তর পর্দাবৃত,আমরা আপনার কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারছি না431

আবদুল্লাহ্ ইবনে সালামের ঈমান আনয়ন

এ সকল বিতর্ক যদিও ইয়াহুদীদের গোয়ার্তুমি আরো বাড়িয়ে দিত তবুও কখনো কখনো দেখা যেত কেউ কেউ এর ফলে ঈমান আনত। আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যিনি ইয়াহুদী ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার432 পর ঈমান আনয়ন করেন। এর কিছুদনি পর অপর ইয়াহুদী ধর্মযাজক মুখাইরিকও ঈমান আনেন। আবদুল্লাহর ঈমান আনার বিষয়টি যদি তাঁর গোত্র জানতে পারে তবে তাঁর নামে কুৎসা রটনা করবে এ আশংকায় তিনি মহানবীকে প্রথমেই তাঁর ঈমান আনয়নের বিষয়টি প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানালেন। মহানবী (সা.) তদনুযায়ী প্রথমে তাঁর ঈমান আনয়নের ঘটনা প্রকাশ না করে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিরূপ- এ সম্পর্কে ইয়াহুদীদের প্রশ্ন করলেন। তারা সমবেতভাবে তাঁকে জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে তাদের অন্যতম পুরোধা বলে ঘোষণা করল। এ সময় আবদুল্লাহ্ তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজ ঈমান গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। এ কথা শোনামাত্র তারা আবদুল্লাহর ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হলো ও তাকে ফাসেক ও নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া শুরু করল,অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও তারা তাঁকে নিজেদের ধর্মীয় পুরোধা ও জ্ঞানী ব্যক্তি বলে স্বীকার করেছিল।

ইসলামী হুকুমতকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র

ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের বিতর্কসমূহ ও জটিল প্রশ্নসমূহ উত্থাপনের বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাসকে শুধু বাড়িয়েই দেয় নি,সেই সাথে তাঁর উচ্চমর্যাদা ও গায়েবী জ্ঞান সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণাকে আরো স্পষ্ট ও দৃঢ় করেছিল। এ সকল বিতর্কের ফলশ্রুতিতেই আরো কিছু মূর্তিপূজক ও ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইয়াহুদীরা এ পন্থায় ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রের অন্য পন্থা গ্রহণ করেছিল;তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা আঁটছিল। তাই তারা আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে শতাধিক বছরের যে দ্বন্দ্ব ছিল এবং ইসলাম ও ঈমানের ছায়াতলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে যা চাপা পড়ে গিয়েছিল তা পুনরুজ্জীবিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করার ষড়যন্ত্র করল যাতে মুসলমানরা সকলেই এর শিকারে পরিণত হয়।

একদিন আওস ও খাজরাজ গোত্রের সকলে এক জায়গায় সৌহার্দপূর্ণ এক সমাবেশে মিলিত হয়েছিল। বিগত দিনের পরস্পর চরম শত্রু এ দু গোত্রের একক এ সমাবেশ ইয়াহুদীদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মধ্যকার শাস নামক এক খলনায়ক পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপর এক ইয়াহুদী যুবকের প্রতি ইশারা করে এ দু গোত্রের পূর্ব শত্রুতার বিষয়টি উপস্থাপন করতে বলল। সেই যুবক আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের তিক্ত ঘটনাগুলো বর্ণনা শুরু করল,বিশেষত বুয়া নামক যুদ্ধের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করল যাতে আওস গোত্র খাজরাজ গোত্রের ওপর বিজয়ী হয়েছিল। এ দু গোত্রের বীরত্বের কাহিনী সে এমনভাবে বর্ণনা করা শুরু করল যাতে ইসলাম গ্রহণকারী এ দু গোত্রের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়।

ঘটনাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে,উভয় গোত্র আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে অপর পক্ষকে আক্রমণ শুরু করল ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখা দিল। এ খবরটি মহানবী (সা.)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ কয়েকজন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং ইসলামের মহান লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ইসলাম তোমাদেরকে পরস্পরের ভাই বানিয়ে দিয়েছে এবং তোমাদের মধ্যকার সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যেতে বলেছে। অতঃপর তাদেরকে কিছু উপদেশ দিলেন এবং বিভেদের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করলেন। মহানবীর মর্মস্পর্শী বক্তব্যে তারা এতটা প্রভাবিত হলো যে,তারা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করল এবং পরস্পরের ভ্রাতৃত্বকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শপথ গ্রহণ করল। তারা তাদের অজ্ঞতাজনিত কর্মের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল।433

ইয়াহুদীদের অপচেষ্টা এখানেই শেষ হয় নি,বরং ধীরে ধীরে তারা চুক্তি ভঙ্গের ন্যায় বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের দিকে অগ্রসর হলো। তারা আওস ও খাজরাজের কিছু মুশরিক ও মুনাফিক ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করল। তারা মুসলমানদের সাথে কুরাইশদের যুদ্ধে প্রকাশ্য ভূমিকা নিয়ে মূর্তিপূজকদের সপক্ষে জোরেশোরে কাজ করতে লাগল।

কুরাইশ মুশরিকদের সঙ্গে ইয়াহুদীদের প্রকাশ্য ও গোপন যোগসাজশের বিষয়টি মুসলমান ও ইয়াহুদীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয়। ফলশ্রুতিতে মদীনায় ইয়াহুদীদের স্থায়ী অবস্থানের অবসান ঘটে। এ ঘটনাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী সালের ঘটনাপ্রবাহে প্রদান করব। সে সম্পর্কিত আলোচনায় পাঠকবৃন্দ স্পষ্টরূপে দেখবেন ইয়াহুদীরা কিরূপে পূর্বোল্লিখিত দু টি চুক্তি যা নবীর উদারপন্থী ও সৌহার্দপূর্ণ নীতির পরিচায়ক তা ভঙ্গ করেছে এবং ইসলাম,মুসলমানগণ ও স্বয়ং মহানবীর বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ইসলামের শত্রুদের সহযোগিতা করেছে! তারা রাসূলকে উপরিউক্ত দু টি চুক্তিনামা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য করেছিল।

রাসূল (সা.) হিজরী প্রথম বর্ষের রবিউল আউয়াল মাস হতে দ্বিতীয় হিজরী বর্ষের সফর মাস পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এ সময়েই মসজিদ ও মসজিদকে কেন্দ্র করে গৃহসমূহ নির্মিত হয় এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহের প্রায় সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। এ দু গোত্রের খুব কম সংখ্যক লোকই তখনও ইসলাম গ্রহণ করে নি। বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে।434

 

সাতাশতম অধ্যায় : দ্বিতীয় হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

যুদ্ধ ও সামরিক মহড়া

যুদ্ধের প্রস্তুতির লক্ষ্যেই এ ধরনের সামরিক মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ সামরিক মহড়াসমূহ প্রথম হিজরীর অষ্টম মাস হতে শুরু হয় এবং দ্বিতীয় হিজরীর রামযান মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এটি মুসলমানদের প্রথম সামরিক মহড়া। এ ধরনের সামরিক মহড়ার সঠিক ব্যাখ্যা ও রহস্য উদ্ঘাটন আমাদের জন্য তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা এ ঘটনাপ্রবাহের সঠিক তথ্য ইতিহাস গ্রন্থসমূহ435 থেকে কোনরূপ কম-বেশি ছাড়াই অনুবাদ করব এবং বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকদের অকাট্য মতসমূহ পাঠকদের সমীপে উপস্থাপন করব।

সামরিক অভিযানসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

1. মদীনায় মহানবী (সা.)-এর হিজরতের অষ্টম মাসে তিনি ইসলামের বীর সৈনিক হযরত হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে ত্রিশজন মুহাজিরের একটি দলকে লোহিত সাগরের তীরবর্তী পথ অবরোধের উদ্দেশ্যে পাঠান। এ পথে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করত। হযরত হামযার নেতৃত্বাধীন দল আইস (عيص ) নামক স্থানে কুরাইশদের তিনশ ব্যক্তির একটি কাফেলার মুখোমুখি হয়। কুরাইশ কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু জাহল। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন সংঘর্ষ হয় নি। কারণ মাজদী ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে উভয় দলের সুসম্পর্ক ছিল এবং সে এ দু দলের মধ্যে সমঝোতা করে। ফলে প্রেরিত সেনাদল মদীনায় ফিরে আসে।