চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 98309
ডাউনলোড: 8161


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 98309 / ডাউনলোড: 8161
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

সাসানী সম্রাটদের ব্যাপারে ইতিহাসের ফয়সালা

সাসানী সম্রাটগণ প্রধানত এবং বিশেষ করে প্রশাসনের ক্ষেত্রে অতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরা জনগণকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিজেদের অনুগত রাখতে চাইতেন।

তাঁরা জনগণ থেকে বিপুল পরিমাণ কর বলপূর্বক আদায় করতেন যা তাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল। আর এ কারণে ইরানের জনগণ সার্বিকভাবে অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু প্রাণের ভয়ে তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে পারত না,এমনকি সচেতন জনতা,সাসানী দরবারের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গেরও কোন মূল্য ছিল না।

সাসানী শাসকগণ এতটা একগুঁয়ে ও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন যে,(তাঁদের সামনে) কোন ব্যক্তিরই কোন কাজে নিজ মতামত ব্যক্ত করার অধিকার ছিল না।

প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করা সত্ত্বেও অন্যায় অত্যাচারের পরিধি এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে,ইতিহাসের পাতায় পাতায় অত্যাচারীদের অন্যায়-অত্যাচার সংক্রান্ত ঘটনা ও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

সম্রাট খসরু পারভেজ এতটা নিষ্ঠুর ছিলেন যে,ঐতিহাসিক সা লিবী লিখেছেন, সম্রাট খসরুকে একবার বলা হলো যে,অমুক শাসনকর্তাকে দরবারে আহবান করা হলে তিনি দরবারে উপস্থিত না হওয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করছেন ও অজুহাত দেখাচ্ছেন। সম্রাট খসরু তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন : আমাদের কাছে তার সশরীরে আসা যদি কষ্টসাধ্য হয় তাহলে তার দেহের একটি ক্ষুদ্র অংশই আমাদের জন্য যথেষ্ট যার ফলে তার কাজও তার জন্য সহজসাধ্য হয়ে যাবে। বলে দাও,কেবল তার মাথাটা যেন আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।”74

সাসানী প্রশাসন ও সরকারের মধ্যে উত্তেজনা

সাসানী যুগের শেষভাগে যে বিষয়টি অবশ্যই উল্লেখ না করে পারা যায় না তা ছিল সাসানী প্রশাসনে গোলযোগ ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রসার,ষড়যন্ত্র এবং রাজ্যজুড়ে বিশৃঙ্খলা। রাজপুত্রগণ,অভিজাতশ্রেণী এবং সেনাপতিগণ পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। যে দলই একজন রাজপুত্রকে মনোনীত করত আরেকটি দল তাকে হত্যা করত এবং তদস্থলে অন্য কোন রাজপুত্রকে সম্রাট মনোনীত করত। যখন মুসলমানরা ইরান জয় করার চিন্তা করছিল তখন সাসানী রাজকীয় পরিবার চরম দুর্বলতা ও কপটতা কবলিত হয়ে পড়েছিল।

সম্রাট খসরু পারভেজের নিহত হবার পর থেকে চার বছরের মধ্যে অর্থাৎ শীরাভেই-এর সিংহাসনে আরোহণ করার সময় থেকে সর্বশেষ সাসানী সম্রাট ইয়ায্দগারদের সিংহাসনে আরোহণ পর্যন্ত যাঁরা ইরানের শাহী তখ্তে আরোহণ করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা 6 থেকে 14 জন পর্যন্ত (ইতিহাসে) উল্লেখ করা হয়েছে।

এভাবেই 4 বছরের মধ্যে 14 বার অথবা তার চেয়ে কিছু কমসংখ্যকবার ইরানের রাজকীয় ক্ষমতা হাতবদল হয়েছে। এটি খুবই স্পষ্ট,যে রাষ্ট্রে 4 বছরের মধ্যে 14 বার ক্যূদেঁতা সংঘটিত হয় এবং প্রতিবারই যদি একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে তদস্থলে অন্য এক ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসানো হয় তাহলে ঐ রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পরিণতি কি হতে পারে!

প্রত্যেক শাসনকর্তা ক্ষমতাগ্রহণ করার পর যারা রাজসিংহাসনের দাবিদার ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করত। তারা নিজেদের রাজত্ব স্থায়ীভাবে নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্য কত জঘন্য কাজই না করেছে! পিতা পুত্রকে,পুত্র পিতাকে হত্যা করত। ভাই ভাইদের হত্যা করত।

শীরাভেই রাজকর্তৃত্ব হস্তগত করার জন্য নিজ পিতাকে হত্যা করেছিলেন।75 আর একই সাথে তিনি খসরু পারভেজের 40 পুত্রসন্তানকেও বধ করেছিলেন।76

‘শাহর বারায’কাউকে বিশ্বাস করতে না পারলেই তাকে হত্যা করতেন। পরিশেষে যারা রাজত্ব লাভ করেছিল তারা সবাই কি পুরুষ,কি মহিলা,কি বড় ও কি ছোট,সকল নিকটাত্মীয় অর্থাৎ সাসানী রাজপুত্রদেরকে (ঠাণ্ডা মাথায়) হত্যা করত যাতে করে সাম্রাজ্যে রাজসিংহাসনের কোন দাবিদার বিদ্যমান না থাকে।

সংক্ষেপে,সাসানী যুগে বিশৃঙ্খলা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে,শিশু ও নারীদেরকে রাজসিংহাসনে বসানো হতো এবং কয়েক সপ্তাহ পরে তাদেরকে হত্যা করে অন্য কাউকে তার স্থলে বসানো হতো।

এভাবেই সাসানী সাম্রাজ্য বাহ্যিক শানশওকত ও জৌলুস থাকা সত্ত্বেও দিন দিন পতন ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাসানীয় ইরানের দুরবস্থা

সাসানী যুগে ইরানের দুর্দশা ও দুরবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণই ছিল ধর্মীয় মতভেদ।

সাসানী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আরদশীর বাবাকান’যেহেতু নিজেই পুরোহিতসন্তান ছিলেন এবং যারদোশতী ধর্মযাজকদের সহায়তায় রাজকর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন সেহেতু তিনি সম্ভাব্য সকল পন্থায় ইরানে নিজ পূর্বপুরুষদের ধর্মের প্রচার ও প্রসার করেছিলেন।

সাসানী যুগে ইরানের জনগণের আনুষ্ঠানিক ধর্ম ছিল যারদোশত কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম। যেহেতু সাসানী সালতানাত ধর্মযাজকদের সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাই যারদোশতী ধর্মযাজকগণ সাসানী প্রশাসন কর্তৃক পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। পরিণতিতে সাসানী যুগে যারদোশতী ধর্মযাজকগণ তদানীন্তন ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিলেন।

সাসানী শাসকগণ সর্বদা যারদোশতী ধর্মযাজকদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন। তাই কোন শাসক যদি ধর্মযাজকদের আনুগত্য না করতেন তাহলে তিনি তাঁদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন। এ কারণেই সাসানী বাদশাগণ সমাজের অন্য সকল শ্রেণীর চেয়ে ধর্মযাজকদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতেন। আর সাসানীদের পৃষ্ঠপোষকতা,সমর্থন ও সাহায্যের কারণে পুরোহিতদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

সাসানীরা নিজেদের রাজত্ব ও সাম্রাজ্য সুসংহত করার জন্য ধর্মযাজকদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছিলেন। আর ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিরাট বিরাট অগ্নি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করতেন। প্রতিটি অগ্নি উপাসনালয়ে প্রচুর ধর্মযাজক অবস্থান করতেন।

ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে : খসরু পারভেজ এমন একটি অগ্নি উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখানে 12000 ধর্মযাজক নিযুক্ত করেছিলেন যাঁরা ধর্মীয় সংগীত ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।77

এভাবেই যারদোশতী ধর্ম আনুষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত হয়েছিল। ধর্মযাজকগণ তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে সমাজের বঞ্চিত ও কষ্টসহিষ্ণু শ্রেণীগুলোকে শান্ত ও তৃপ্ত করার চেষ্টা করতেন। তাঁরা এমনভাবে চেষ্টা করতেন যাতে করে সাধারণ জনতা নিজেদের দুরবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয়।

ধর্মযাজকদের অসীম চাপ ও ক্ষমতা জনগণকে যারদোশতী ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তাই সাধারণ জনগণ অভিজাতশ্রেণীর ধর্মমত বর্জন করে অন্য ধর্মের সন্ধান করতে থাকে।

‘ইরানের সামাজিক ইতিহাস’গ্রন্থের রচয়িতা লিখেছেন : বাধ্য হয়েই ইরানের জনগণ সম্ভ্রান্তশ্রেণী ও যাজক সম্প্রদায়ের চাপের কারণে এ সব অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে নিজেদেরকে বের করে আনার চেষ্টা করছিল। এ কারণেই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ধর্ম মাযদা ইয়াসতী যারতুশতী’

(مزديستى زرتشتي ) -যা বেহ্দীন’হিসাবে পরিচিত ছিল তার বিপরীতে যারদোশতী ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দু টি পৃথক মতের আবির্ভাব হয়েছিল।”78

হ্যাঁ,অভিজাতশ্রেণী ও ধর্মযাজকদের চাপ ও কড়াকড়ির কারণেই সাসানী ইরানে একের পর এক বিভিন্ন মাযহাবের (ধর্মমত ও সম্প্রদায়) উদ্ভব হয়েছিল। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অবস্থাসমূহের মধ্যে সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন করার জন্য মাযদাক (مزدك ) ও তাঁর পূর্বে মনী’প্রভূত চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা কেউ সফল হন নি।79

497 খ্রিষ্টাব্দে মাযদাক বিদ্রোহ করেছিলেন। একচেটিয়া মালিকানার বিলুপ্তি,বহু বিবাহ এবং হেরেম নিষিদ্ধকরণ তাঁর সংস্কারমূলক কর্মসূচীর শীর্ষে স্থান পেয়েছিল। যখন বঞ্চিত শ্রেণীগুলো এ ধরনের কর্মসূচী সম্পর্কে অবগত হলো তখন তারা পঙ্গপালের মতো তাঁর চারপাশে সমবেত হয়েছিল এবং তাঁর নেতৃত্বে একটি ব্যাপক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। জনগণ যাতে করে তাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত অধিকারসমূহ পেতে পারে সেজন্য এ বিপ্লব পরিচালিত হয়েছিল। অবশেষে মাযদাকের আন্দোলন যাজকশ্রেণীর প্রতিরোধ ও রাজকীয় সেনাবাহিনীর বিরোধিতার সম্মুখীন হয় এবং ইরানে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি করে।

আর ঠিক একইভাবে সাসানী যুগের শেষে যারদোশতী ধর্মমত সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব বাস্তব রূপ হারিয়ে ফেলেছিল। অগ্নি’কে পবিত্র মনে করার বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে,গলিত লোহা যা আগুনের সংস্পর্শে থাকার কারণে আগুনের প্রকৃতি গ্রহণ করত তাতে হাতুড়ি মারা অবৈধ বলে গণ্য করা হতো। যারদোশতী ধর্মমতের আকীদা-বিশ্বাসসমূহ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পৌরাণিক। এ যুগে এ ধর্মের যাবতীয় বাস্তবতার স্থান কতগুলো নিস্প্রাণ,অনর্থক স্লোগান ও আচার-প্রথা দখল করে নিয়েছিল। ধর্মযাজকগণ সর্বদা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য এ সব স্লোগান ও রীতিনীতির আনুষ্ঠানিকতা বৃদ্ধি করেছিলেন। অযৌক্তিক কল্পকাহিনী ও কুসংস্কারসমূহ এত পরিমাণে ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছিল যে,এমনকি ধর্মযাজকগণ পর্যন্তও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ধর্মযাজকদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তিও ছিলেন যাঁরা প্রথম থেকেই যারদোশতী ধর্মমতের আকীদা-বিশ্বাস,রীতিনীতি এবং আচার-প্রথার অসারত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এবং এগুলো থেকে বের হয়ে এসেছিলেন।

অন্যদিকে আনুশীরওয়ানের শাসনামলের পর থেকেই ইরানে গভীরভাবে চিন্তা করার পথ উন্মুক্ত হয়েছিল;গ্রীক ও ভারতীয় কৃষ্টির অনুপ্রবেশ এবং একইভাবে খ্রিষ্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মমতের সাথে যারদোশতী ধর্মমত আসার কারণে এ বিষয়টি (অর্থাৎ গভীর চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা) আগের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছিল এবং এ কারণে ইরানী জাতির মধ্যে জাগরণ এসেছিল। আর এ জন্যই তারা যারদোশতী ধর্মমতের ভিত্তিহীন বিষয় ও কুসংস্কারসমূহের কারণে অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি কষ্ট পেতে থাকে।

অবশেষে যারদোশতী সমাজ ও ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে দুর্নীতির উদ্ভব হয়েছিল এবং এ ধর্মে যে সব অযৌক্তিক কল্পকাহিনী অনুপ্রবেশ করেছিল তা ইরানী জাতির আকীদা-বিশ্বাসে মতবিরোধ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের মতবিরোধ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভবের ফলে চিন্তাশীল শ্রেণীর মধ্যে সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ রোপিত হয়। আর তা তাদের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে ইরানী জাতি পূর্বের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে।

এভাবেই বিশৃঙ্খলা ও অধার্মিকতা সমগ্র ইরানে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ,সাসানী যুগের প্রসিদ্ধ চিকিৎসাবিজ্ঞানী বারযাওয়াইহ্ কালীলাহ্ ওয়া দিমনাহ্’গ্রন্থের প্রারম্ভিকায় সাসানী ইরানের শোচনীয় অবস্থা এবং তীব্র ধর্মীয় মতবিরোধের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

ইরান ও রোম সাম্রাজের মধ্যকার যুদ্ধসমূহ

বুযুর্গমেহের যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন এবং আনুশীরওয়ানের প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন তিনি তাঁর বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করে অনেক সময় ইরানকে বড় বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু কখনো কখনো ষড়যন্ত্রকারীরা সম্রাট আনুশীরওয়ানের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটাত এবং তাঁকে (আনুশীরওয়ানকে) তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে তাঁকে গ্রেফতার করার ফরমান জারি করাত।

এ সব বিবাদপ্রিয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী রোম সম্রাট সম্পর্কে সম্রাট আনুশীরওয়ানকে ক্ষেপিয়ে তুলত। তারা দেশের সীমানা প্রসারিত করা এবং ইরানের বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার জন্য চিরস্থায়ী শান্তি ও অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে রোমানদের ওপর হামলা করার জন্য সম্রাট আনুশীরওয়ানকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে যুদ্ধের শিখা প্রজ্বলিত হলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইরানী সেনাবাহিনী সিরিয়া দখল করল এবং আনতাকীয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়ে সমগ্র এশিয়া মাইনরে লুটতরাজ করল। 20 বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইরান ও রোম শক্তি ও সম্পদ নিঃশেষ করে ফেলেছিল। প্রচুর রক্তপাতের পর দু দেশের মধ্যে পুনরায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ইরান সরকারের কাছে রোমান প্রশাসনের প্রতি বছর 20,000 দীনার প্রদান করার শর্তে পূর্বেকার মতো দু দেশের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে,এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ,তা-ও আবার রাজধানী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে-একটি জাতির সম্পদ ও শিল্পের ওপর কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারে! সে সময়ের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনাকরতঃ দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার করা অসম্ভব। এ যুদ্ধ ও লুণ্ঠন ইরান সরকারের অবশ্যম্ভাবী পতনের কারণ হয়েছিল।

উপরিউক্ত 20 বছরব্যাপী যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হতে না হতেই রোমান সম্রাট তি-বারিয়োস্ সিংহাসনে আরোহণ করার পর প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তীব্র আক্রমণের দ্বারা ইরানের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন করেন। উভয় সেনাদলের অবস্থা স্পষ্ট হতে না হতেই সম্রাট আনুশীরওয়ান মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং তাঁর পুত্র খসরু পারভেজ শাসনভার গ্রহণ করেন। 614 সালে তিনিও কতিপয় অজুহাত দাঁড় করিয়ে পুনরায় রোমানদের ওপর আক্রমণ করেন। প্রথম আক্রমণেই তিনি শাম,ফিলিস্তিন ও আফ্রিকা দখল করে নেন;জেরুজালেম লুণ্ঠন,কিয়ামত (পুনরুত্থান) গির্জা ও হযরত ঈসা মসীহর মাযার ধ্বংস করেন। পুরো শহরকে বিজয়ী ইরানী বাহিনী ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে এবং 90,000 খ্রিষ্টানকে হত্যা করার মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।

এ সময় যখন তদানীন্তন সভ্যজগৎ যুদ্ধ ও অন্যায়ের বহ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল ঠিক তখন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) 610 খ্রিষ্টাব্দে রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি বিশ্ববাসীর কর্ণে তাওহীদের অমিয় বাণী পৌঁছে দেন এবং মানব জাতিকে শান্তি,সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলার দিকে আহবান জানান।

অগ্নিপূজকদের হাতে আল্লাহ্পূজারী রোমানদের পরাজয়বরণকে মক্কার পৌত্তলিকগণ শুভ লক্ষণ হিসাবে গ্রহণ করে এবং তারা একে অপরকে বলতেও থাকে যে,আমরাও অচিরেই আল্লাহর পূজারীদেরকে (মুসলমানদেরকে) দমন করতে সক্ষম হব। মুসলমানগণ এ কথা শুনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয় :

) ألم غلبت الرُّوم في أدنى الأرضِ و لهم مِنْ بعدِ غلبهم سيغلبون(

“রোম আরবের নিকটবর্তী এক স্থানে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তারা তাদের পরাজয়ের কয়েক বছর পরেই পুনরায় বিজয়ী হবে।” (সূরা রূম : 1)

রোমানদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী 627 সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল। রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে নেইনাভা (نينوا ) দখল করে নেন। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিদ্বয় (পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য) সর্বশেষ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছিল এবং নিজেদের সামরিক শক্তি ও সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে রত হয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এ দু সাম্রাজ্য ইসলামের প্রাণসঞ্জীবনী সমীরণের প্রভাবে জীবন্ত হয়ে উঠবে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে খসরু পারভেজ নিজ সন্তান শীরাভেইয়ের হাতে নিহত হন। আর শীরাভেইও খসরু পারভেজের মৃত্যুর 8 মাস পরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ সময় ইরানে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা এতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে,শীরাভেইয়ের মৃত্যুর পরে চার বছরের মধ্যে বহু শাসনকর্তা ইরানের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন যাঁদের মধ্যে 4 জন নারীও ছিলেন। অবশেষে ইসলামী সেনাদলের আক্রমণের মাধ্যমে এ অবস্থার অবসান হয়। সাসানী ইরানের 50 বছরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের পথ সুগম করে দেয়।

চতুর্থ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর পূর্বপুরুষগণ