চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74546
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74546 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

দ্বিতীয় বদর

উহুদ যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ান মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিল : পরের বদরে ঠিক এ সময়েই বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে আমাদের দেখা হবে এবং আরো বড় প্রতিশোধ নেব।

মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক এ জিহাদে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন। সেই তারিখের পর থেকে দীর্ঘ একটি বছর পার হয়ে যায়। এর মধ্যে কুরাইশদের সর্দার নানা ধরনের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিল।

ইতোমধ্যে নুআইম ইবনে মাসউদ নামক এক ব্যক্তি মক্কায় গমন করে। মক্কার কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানদের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আবু সুফিয়ান তাঁর কাছে একটি অনুরোধ জানায় যাতে সে মদীনায় গিয়ে রাসূলকে মদীনা থেকে বের হতে বারণ করে। আবু সুফিয়ান আরো বলে : এ বছর মক্কা ত্যাগ করে বাইরের কোথাও যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আরবদের কমন মার্কেটতুল্য বদর এলাকায় এসে যদি মুহাম্মদ শক্তির মহড়া দেখায়,তা হলে তা আমাদের জন্য পরাজয়ের গ্লানি সৃষ্টি করবে।

নুআইম যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন,মদীনায় যায়,কিন্তু তার কথাবার্তা মহানবীর মনোবলে সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারে নি। মহানবী (সা.) দেড় হাজার সৈন্য,কয়েকটি ঘোড়া ও কিছু বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে চতুর্থ হিজরীর যিলকদ মাসে (যা হারাম বা নিষিদ্ধ মাস) বদর ভূখণ্ডে উপনীত হন। তিনি সেখানে দীর্ঘ আট দিন অবস্থান করেন এবং সে সময়টা ছিল বদরে আরবদের সাধারণ বাণিজ্যমেলার মৌসুম। মুসলমানরা তাদের পণ্য-সামগ্রী বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এরপর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে আসা লোকেরা চলে গেলেও ইসলামী বাহিনী সেখানে কুরাইশ বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে।

বদর প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর আগমনের খবর মক্কায় পৌঁছলে কেবল নিজেদের মান-সম্মান রক্ষার খাতিরে হলেও বদরের উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করা ছাড়া কুরাইশ নেতৃবর্গের আর কোন উপায় ছিল না। তাই আবু সুফিয়ান প্রচুর সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে মররুয যাহরান পর্যন্ত যায়। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ও রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার বাহানা দেখিয়ে মাঝপথ থেকে সে ফিরে যায়।

মুশরিক বাহিনীর পশ্চাদপসরণ এতই লজ্জাজনক ছিল যে,সাফওয়ান আবু সুফিয়ানকে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে : আমরা এ পশ্চাদপসরণের কারণে এ পর্যন্ত অর্জিত সকল গৌরব হাতছাড়া করে ফেলেছি। তুমি যদি গত বছর এ যুদ্ধ হবার কথা না দিতে,তা হলে আমরা এতখানি লজ্জিত হতাম না। 99

হিজরী চতুর্থ সালের 3 শাবান মহানবী (সা.)-এর দ্বিতীয় দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।100 আর একই বছর হযরত আলী (আ.)-এর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ ইন্তেকাল করেন।101 এ বছরই মহানবী (সা.) যাইদ ইবনে সাবিতকে ইহুদীদের কাছে সুরিয়ানী ভাষা শেখার নির্দেশ দেন।102

ছত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ103

ভ্রান্ত কুসংস্কার মূলোচ্ছেদের প্রয়োজনে

হিজরী পঞ্চম সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে পরিখার যুদ্ধ (আহযাবের যুদ্ধ),বনী কুরাইযার পরিণতি ও যায়নাব বিনতে জাহাশের সাথে মহানবী (সা.)-এর বিয়ে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী এসব ঘটনার সূচনায় রয়েছে উল্লিখিত মহিয়সী মহিলার সাথে মহানবীর বিয়ে।

পবিত্র কুরআন সূরা আহযাবের 4,6 এবং 36 থেকে 40 তম আয়াতের মাধ্যমে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে। তাতে প্রাচ্যবিদদের মিথ্যার বেসাতি এবং কল্পনাবিলাসের কোন অবকাশ রাখে নি।

আমরা ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ সূত্র অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবলম্বনে ঘটনাটির বিবরণ পেশ করব। এরপর প্রাচ্যবিদদের উক্তিগুলোও পর্যালোচনা করব।

যাইদ ইবনে হারিসা কে?

যাইদ এক যুবকের নাম। শৈশবে আরব বেদুইন ডাকাতদল তাঁকে একটি কাফেলা থেকে অপহরণ করে উকায মেলায় ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করেছিল। হাকীম ইবনে হিযাম তাঁকে আপন ফুফু খাদীজাহর জন্য কিনে নিয়েছিলেন। বিয়ের পর হযরত খাদীজাহ্ ক্রীতদাসটিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে অর্পণ করেছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর মনের পবিত্রতা,স্বচ্ছতা এবং তাঁর উত্তম চরিত্রের কারণে ছেলেটি তাঁর প্রতি অনুরাগী ও ভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি যাইদের পিতা যখন ছেলের খোঁজে মক্কায় আসেন এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে তাঁকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য আবেদন জানান,যাতে করে তাঁকে মায়ের কাছে ও পরিবারের মাঝে নিয়ে যেতে পারেন,তখন তিনি পিতার সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানান। বরং মহানবীর কাছে থাকাকে নিজের মাতৃভূমি এবং আত্মীয়-স্বজনের মাঝে থাকার ওপর অগ্রাধিকার দেন। রাসূল (সা.) তাঁর নিকটে থাকা বা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি যাইদের ওপর ছেড়ে দেন। এটি ছিল উভয় পক্ষের আত্মিক আকর্ষণ ও মমতার নিদর্শন। যাইদ যেমন অন্তস্তল থেকে মহানবী (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন,মহানবীও তেমনি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসা এতটা প্রগাঢ় ছিল যে,তাঁকে তিনি আপন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে সাহাবীগণ তাঁকে যাইদ ইবনে মুহাম্মদ’ বলতেন। মহানবী (সা.) ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিক হবার জন্য একদিন যাইদের হাত ধরে কুরাইশদের উদ্দেশে বলেছিলেন : এ হচ্ছে আমার সন্তান। আমরা একে অপরের উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করব।”

এই আত্মিক টান ও মমত্ববোধ ততদিন বলবৎ ছিল যতদিন না মুতার যুদ্ধে যাইদ শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর ইন্তেকালে মহানবী ঔরসজাত সন্তান মারা যাবার মতোই শোকাহত হন।104

মহানবী (সা.)-এর ফুপাতো বোনকে যাইদ-এর বিয়ে

(শ্রেণীগত) ব্যবধান ও দূরত্ব কমিয়ে আনা,সমগ্র মানব জাতিকে মানবতার ও খোদাভীরুতার পতাকাতলে একত্রিত করা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি হিসেবে চারিত্রিক গুণাবলী ও মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতিকে পরিচিত করানোই ছিল মহানবী (সা.)-এর অন্যতম পবিত্র লক্ষ্য। অতএব,যত শীঘ্র সম্ভব আরবদের প্রাচীন ঘৃণ্য প্রথা (অভিজাত শ্রেণীর মেয়ের দরিদ্র শ্রেণীর পাত্রকে বিয়ে করা অনুচিত-এরূপ ধ্যান-ধারণা) বিলুপ্ত করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। আর এ কর্মসূচী তাঁর নিজ বংশ থেকে শুরু করা এবং হযরত আবদুল মুত্তালিবের পৌত্রী তাঁর নিজ ফুপাতো বোন যায়নাবকে নিজের পূর্বেকার দাস এবং দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত যাইদ ইবনে হারেসার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করাটা ছিল কতই না উত্তম,যাতে করে সবাই উপলব্ধি করে যে,এসব কল্পিত ব্যবধান যত দ্রুত সম্ভব বিলুপ্ত করতে হবে এবং যখনই মহানবী (সা.) তাদেরকে বলবেন, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া-পরহেযগারী (খোদাভীরুতা) এবং মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষের সমমর্যাদাসম্পন্ন’ ,তখন স্বয়ং তিনিই হবেন এ আদর্শ ও আইনের প্রথম বাস্তবায়নকারী এবং তাঁকেই তা সর্বপ্রথম কার্যকর করতে হবে।

এ ধরনের ভুল ও অন্যায় প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য মহানবী (সা.) যায়নাবের ঘরে গমন করে যাইদের সাথে তাঁর বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। যায়নাব এবং তাঁর ভাই প্রথমে এ প্রস্তাবে ততটা আগ্রহ দেখান নি। কারণ,তখনও তাঁদের অন্তর থেকে জাহিলী যুগের ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। অন্যদিকে,যেহেতু মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করা তাঁদের জন্য অপ্রীতিকর ছিল,তাই তাঁরা যাইদের দাস হওয়ার বিষয়টি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে মহানবীর প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

অবিলম্বে ওহীর ফেরেশতা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসহ অবতরণ করে যায়নাব ও তাঁর ভাইয়ের এহেন আচরণের নিন্দা করেন। এ আয়াত হলো :

) و ما كان لمؤمن و لا مؤمنة إذا قضي الله و رسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم و من يعص الله و رسوله فقد ضلّ ضلالا مبينا(

“যখন মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন,তখন মুমিন নর-নারীদের সেই বিষয়ে (ফয়সালার বিপরীতে) কোন এখতিয়ার থাকবে না;আর যে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সিদ্ধান্তের) বিরুদ্ধাচরণ করবে,সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে।” (সূরা আহযাব : 36)

মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ তাঁদের কাছে এ আয়াত পাঠ করে শুনান। মহানবীর প্রতি এবং তাঁর মহান লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি যায়নাব ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহর ঈমান এ বিয়ের ব্যাপারে যায়নাবের সম্মতি প্রদানের কারণ হয়েছিল। পরিণামে,অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত রমণী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বেকার দাস যাইদের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। আর এভাবে ইসলাম ধর্ম ও শরীয়তের প্রাণ সঞ্জীবনী কর্মসূচীর একাংশ বাস্তবায়িত হলো এবং সে সাথে (জাহিলী যুগের) একটি ভুল প্রথা কার্যত বিলুপ্ত হলো।

স্ত্রীর সাথে যাইদ-এর বিয়ে-বিচ্ছেদ

অবশেষে এ বিয়ে বিশেষ কিছু কারণে স্থায়ী হয় নি এবং শেষ পর্যন্ত তালাক (বিচ্ছেদ) পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন,বিয়ে-বিচ্ছেদের কারণ ছিল যায়নাবের মন-মানসিকতা। তিনি স্বামীর বংশ-মর্যাদা ও পরিচয় নীচু হওয়ার বিষয়টি তাঁর সামনে প্রায়ই উত্থাপন করতেন। এভাবে তিনি স্বামী যাইদের জীবনকে তিক্ত করে ফেলেছিলেন।

তবে যাইদের কারণেও বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়ে থাকতে পারে। কারণ তাঁর জীবনী থেকে প্রমাণিত হয় যে,তাঁর মধ্যে সমাজের সাথে সংশ্রবহীনতা ও খাপ না খাওয়ার মনোবৃত্তি বিরাজ করত। তিনি জীবনে বহু বিয়ে করেছিলেন এবং সর্বশেষ স্ত্রী ছাড়া সবাইকে তিনি তালাক দিয়েছিলেন (উল্লেখ্য,মুতার যুদ্ধে তাঁর শাহাদাত লাভ পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ স্ত্রী তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন)। একের পর এক তালাক দান থেকে যাইদের মধ্যে খাপ না খাওয়ানোর প্রবণতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যাইদও যে এ ঘটনায় সমান অংশীদার ছিলেন,তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর প্রতি মহানবীর কড়া উক্তি। কারণ তিনি যখন জানতে পারলেন,তাঁর পালিত পুত্র সহধর্মিনীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে (যাইদকে) বলেছিলেন :

) أمسك عليك زوجك و اتّق الله(

“তুমি তোমার স্ত্রীকে ধরে রেখ (তালাক দিও না) এবং মহান আল্লাহকে ভয় করো।” (সূরা আহযাব : 37)

যদি যাইদের স্ত্রী যায়নাবই বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হতেন,তা হলে স্ত্রীর সাথে যাইদের সম্পর্কচ্ছেদ তাকওয়া তথা পরহেযগারীর পরিপন্থী বলে গণ্য হতো না। তবে,অবশেষে যাইদ তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন এবং যায়নাবের সাথে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটান।

আরেক ভুল প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য বিয়ে

এ বিয়ের মূল কারণ অধ্যয়ন করার আগে বংশ পরিচিতি-যা একটি সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ উপাদান বলে বিবেচিত,অগত্যা তা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আরেকভাবে বলতে হয় যে,প্রকৃত (ঔরসজাত) পুত্র ও পালিত পুত্রের মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্যও আমাদের জানতে হবে। পিতার সাথে ঔরসজাত সন্তানের অস্তিত্বগত সম্পর্ক রয়েছে। আসলে পিতা হচ্ছেন সন্তানের জন্মগ্রহণ ও অস্তিত্ব লাভের বস্তুগত কারণ। আর সন্তান হচ্ছে পিতা-মাতার শারীরিক এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্যাবলীর উত্তরাধিকারী। এ ধরনের একত্ব ও রক্তসম্পর্কের কারণেই পিতা ও সন্তান একে অপরের ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন এবং বিয়ে ও তালাক সংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় (অর্থাৎ পিতা তার ঔরসজাত সন্তানের বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবেন না এবং পুত্রও পিতার বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে না)।

সুতরাং এ ধরনের বিষয়বস্তু,যার অস্তিত্বগত ভিত্তি রয়েছে,তা কেবল ভাষার মাধ্যমে বা কথা দিয়ে কখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। (সূরা আহযাবের 4 ও 5 নং আয়াতসমূহের সারাংশ) উত্তরাধিকার,বিয়ে এবং তালাকের মতো কতকগুলো বিধানের ক্ষেত্রে প্রকৃত সন্তানের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা,পালিত পুত্র (দত্তক সন্তান) কখনোই মানুষের প্রকৃত সন্তান হয় না। যেমন প্রকৃত সন্তান যদি পিতার উত্তরাধিকারী বা পিতা তার ঔরসজাত সন্তানের উত্তরাধিকারী হন বা ঔরসজাত সন্তানের পত্নী,সন্তান কর্তৃক তালাক প্রদানের পর সন্তানের পিতার জন্য হারাম হয়,তা হলে কখনোই এ কথা বলা সম্ভব নয় যে,পালিত পুত্রও এসব বিধানের ক্ষেত্রে প্রকৃত সন্তানের সাথে সমান অংশীদার হবে।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের অংশীদারিত্ব সঠিক উৎসমূলবিশিষ্ট নয়। এছাড়াও এটি বংশ পরিচিতি নিয়ে এক ধরনের হাস্য-কৌতুক ও ছিনিমিনি খেলা মাত্র।

সুতরাং দত্তক সন্তান গ্রহণ যদি আবেগ-অনুভূতি,মমত্ববোধ ও ভালবাসা প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে,তা হলে তা খুবই পছন্দনীয় ও যথাযথ হবে। তবে তা যদি কতকগুলো সামাজিক বিধানের ক্ষেত্রে অংশীদার করানোর নিমিত্ত হয়ে থাকে,তা হলে তা হবে বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত হিসাব-নিকাশ থেকে বহু দূরে। এখানে উল্লেখ্য,এসব সামাজিক বিধান একান্তভাবেই প্রকৃত সন্তানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত।

জাহিলী আরব সমাজ দত্তক (পালিত) পুত্রকে প্রকৃত সন্তানের মতো মনে করত। মহানবী (সা.) পূর্বে তাঁর পালিত পুত্র যাইদের স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করার মাধ্যমে এ ভুল প্রথা কার্যত অর্থাৎ বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে আরব জাতির মধ্য থেকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মুখে বলা এবং আইন প্রবর্তন করার চেয়েও দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে দেখানোর প্রভাব অনেক বেশি। যেহেতু তদানীন্তন আরব সমাজে পালিত পুত্রের তালাক প্রাপ্তা বা বিধবা পত্নীকে বিয়ে করা-যা আরবদের কাছে অস্বাভাবিক ধরনের জঘন্য বিষয় বলে বিবেচিত হতো-বাস্তবে কার্যকর করার সৎ সাহস কারো ছিল না,সেহেতু মহান আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে এ কাজের জন্য সরাসরি আহবান করেছিলেন। তাই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন :

) فلمّا قضي زيد منها وطرا زوّجناكها لكى لا يكون علي المؤمنين حرج فِى أزواج أدعيائهم إذا قضوا منهنّ وطرا و كان أمر الله مفعولا(

“অতঃপর যখন যাইদ যায়নাবকে তালাক দিল,তখন আমরা তাকে আপনার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলাম,যাতে ঈমানদারদের দত্তক পুত্ররা যখন তাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে,তখন সেসব রমণীকে বিয়ে করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়;আর মহান আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।” (সূরা আহযাব : 37-38)

এ বিয়ে একটি ভুল প্রথা বিলোপ করা ছাড়াও সাম্যের সর্ববৃহৎ নিদর্শন হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ,ইসলাম ধর্মের মহান নেতা এমন এক নারীকে বিয়ে করেন,যিনি এর আগে তাঁর আযাদকৃত দাসের সহধর্মিনী ছিলেন। আর ঐ সময় এ ধরনের বিয়ে সমাজে মর্যাদার পরিপন্থী বলে গণ্য হতো।

এ সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ মুনাফিকচক্র ও সংকীর্ণ চিন্তাধারার অধিকারী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এটাকে এক ঘৃণ্য ব্যাপার হিসেবে তারা সর্বত্র বলে বেড়াতে লাগল যে,মুহাম্মদ তাঁর পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন।

মহান আল্লাহ্ এ ধরনের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা মূলোৎপাটন করার জন্য নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

) ما كان محمّد أبا أحد من رجالكم و لكن رسول الله و خاتم النّبيّين و كان الله بكلّ شىء عليما(

“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন,বরং তিনি মহান আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী;আর মহান আল্লাহ্ সব ব্যাপারে অবগত আছেন।” (সূরা আহযাব : 40)

পবিত্র কুরআন এ বিষয় বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করে নি;বরং মহানবী (সা.),যিনি মহান আল্লাহর বিধি-নির্দেশ কার্যকর করার ব্যাপারে নির্ভীক ছিলেন,সূরা আহযাবের 38 ও 39তম আয়াতে তাঁর ভূয়সী প্রশংসাও করেছে। এ দুই আয়াতের সারাংশ হচ্ছে : মুহাম্মদ (সা.) অন্য সকল নবীর মতো,যাঁরা মহান আল্লাহর বাণীসমূহ মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেন এবং মহান আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে কাউকেই ভয় করেন না।105

এটাই হচ্ছে যায়নাবের সাথে মহানবী (সা.)-এর শুভ পরিণয়ের মূল দর্শন বা হিকমত। এখন আমরা প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করব।