চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74554
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74554 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পবিত্র এক ব্যক্তি বা নারীর নামে মুনাফিকদের অপবাদ

‘ইফ্ক’ বা ব্যভিচারের অপবাদ’ আরোপ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায়,মুনাফিকরা,অপরাধী নন এমন এক ব্যক্তি বা নারীর ওপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করেছিল এবং সেই ব্যক্তি বা নারী ইসলামী সমাজে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। মুনাফিকরা এ অপবাদের অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে চেয়েছিল ইসলামী সমাজের ক্ষতি করতে এবং তা থেকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে। পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ তাদের ওপর সরাসরি ও ব্যতিক্রমীভাবে কঠোর আঘাত হেনেছে ও তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।

কিন্তু ঐ আলোচিত ব্যক্তি বা নারী কে,তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসিরের বর্ণনা মতে আলোচিত নারী রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী হযরত আয়েশা ছিলেন;অপর একদল মুফাসসির বলেছেন যে,ঐ আলোচিত নারী মারিয়া কিবতী ছিলেন (রাসূলের সন্তান ইবরাহীমের মাতা)। উভয় ক্ষেত্রে বর্ণিত শানে নুযূল প্রসঙ্গে সমস্যা রয়েছে। এখন আমরা ইফকের আয়াত হযরত আয়েশা সম্পর্কে ছিল,এর সপক্ষে বর্ণিত হাদীসসমূহ আলোচনা করব এবং তার বিভিন্ন দিকের সঠিকত্ব যাচাই করব।

প্রথম শানে নুযূল

আহলে সুন্নাতের তাফসীরকারক ও হাদীসবিশারদগণ ইফকের আয়াতসমূহ হযরত আয়েশা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে বলে দাবী করে থাকেন। এর সপক্ষে তাঁরা দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন যার কিছু অংশ মহানবী (সা.)-এর নিষ্পাপত্বের পরিপন্থী। তাই এই হাদীস কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

এখন আমরা এ হাদীসের বর্ণিত যে অংশ রাসূল (সা.)-এর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল,তা উল্লেখ করব। অতঃপর ইফকের আয়াত ও তার অনুবাদ আপনাদের কাছে পেশ করব। সবশেষে বর্ণিত হাদীসের যে অংশ রাসূল (সা.)-এর নিষ্পাপত্ব ও মর্যাদার সাথে সংগতিশীল নয়,তার উল্লেখ করব।

ইফকের শানে নুযূলের হাদীস স্বয়ং হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন : মহানবী (সা.) কোন স্থানে ভ্রমণের জন্য গেলে লটারীর মাধ্যমে স্ত্রীগণের মধ্য হতে একজনকে সফরসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতেন। বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে যাত্রার সময় লটারীতে আমার নাম আসলো। এ সফরে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য ঘটেছিল। শত্রুর পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলে আমরা মদীনার দিকে ফিরে আসছিলাম। মদীনার নিকটবর্তী এক স্থানে রাত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য অবতরণ করা হলো। বিশ্রামের সময় হঠাৎ করে চারদিক থেকে কয়েক জন আহবান জানাতে লাগল : যাত্রার জন্য প্রস্তুত হও। এখন যাত্রা করব। আমি উটের পিঠের হাওদা166 থেকে নেমে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দূরবর্তী এক স্থানে গেলাম। যখন হাওদার নিকট ফিরে আসলাম,তখন গলায় হাত দিয়ে দেখলাম,আমার ইয়েমেনী পুঁতির মূল্যবান হারটি কোথায় যেন পড়ে গেছে! আমি তার খোঁজে এদিক-ওদিক গেলাম এবং এজন্য দেরী হয়ে গেল। যখন হার খুঁজে পেয়ে ফিরে এলাম,দেখলাম,সবাই চলে গেছে। আমি হাওদার মধ্যে আছি মনে করে তারা তা উটের পিঠে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমি একাকী সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম,আর ভাবলাম পরবর্তী কোন স্থানে তারা থামলে আমাকে না পেয়ে ফিরে আসবে।

ঘটনাক্রমে মুসলমানদের একজন সৈনিক তাদের থেকে পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি হলেন সাফওয়ান। সকাল বেলা ঐ স্থান দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে দেখে কাছে এসে আমাকে চিনতে পারলেন। আমাকে কিছু না বলে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়লেন। এই বলে নিজ উটকে মাটিতে বসালেন যাতে আমি তাতে আরোহণ করতে পারি। অতঃপর উটের দড়ি ধরে টেনে নিয়ে চললেন। আমরা মুসলমানদের কাফেলার নিকট পৌঁছলাম। যখন মুনাফিকরা,বিশেষত তাদের নেতা এ ঘটনা জানতে পারল,তখন সে গুজব ছড়াতে লাগল এবং তা বিভিন্ন বৈঠকে আলোচিত হতে লাগল।

পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়ে পড়ল যে,মুসলমানদের কেউ কেউ আমার ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করা শুরু করল। এর কিছুদিন পরই ইফ্ক’ -এর আয়াত অবতীর্ণ হলো এবং আল্লাহ্ আমাকে মুনাফিকদের মিথ্যা অপবাদ থেকে পবিত্র ঘোষণা করলেন।”

এ বর্ণনা আমরা হাদীস থেকে সংক্ষিপ্ত করে উল্লেখ করেছি। হাদীসের এ অংশ কুরআনের আয়াতের সাথে সংগতিশীল এবং রাসূল (সা.)-এর নিষ্পাপত্বের সাথে অসামঞ্জস্যশীল নয়।

এখন আমরা ইফ্ক’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ (সূরা নূর : 11-16) অনুবাদসহ উল্লেখ করব।

) إنّ الّذين جائوا بالإفك عُصبة منكم لا تحسبوه شرّا لكم بل هو خير لكم لكلّ امرئ منهم ما اكتسب من الإثم و الّذى تولّي كبره منهم له عذاب عظيم(

“যারা অপবাদ রচনা করেছে,তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না;বরং এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্য ততটুকু আসে,যতটুকু সে গুনাহ্ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে,তার জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি।

) لولا إذ سمعتموه ظنّ المؤمنون و المؤمنات بأنفسهم خيرا و قالوا هذا إفك مبين(

“যখন তোমরা এ কথা শুনলে,তখন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীরা কেন নিজেদের সম্পর্কে উত্তম ধারণা করল না এবং বলল না যে,এটা তো নির্জলা অপবাদ।”

) لولا جائوا عليه بأربعة شهداء فإذ لم يأتوا بالشّهداء فأولئك عند الله هم الكاذبون(

“তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে নি? অতঃপর যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করে নি,তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী।”

) و لولا فضل الله عليكم و رحمته فِى الدّنيا و الآخرة لمسّكم في ما أفضتم فيه عذاب عظيم(

“যদি ইহকালে ও পরকালে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত,তবে তোমরা যা চর্চা করছিলে,তার জন্য তোমাদের গুরুতর আযাব স্পর্শ করত।”

) إذ تلقونه بألسنتكم و تقولون بأفواهكم ما ليس لكم به علم و تحسبونه هيّنا و هو عند الله عظيم(

“যখন তোমরা একে মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং মুখে এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে,যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছ মনে করছিলে;অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর ব্যাপার ছিল।”

) و لولا إذ سمعتموه قلتم ما يكون لنا أن نتكلّم بهذا سبحانك هذا بهتان عظيم(

“এবং যখন তোমরা এ কথা শুনলে,তখন কেন বললে না : এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা উচিত নয়। আল্লাহ্ পবিত্র ও মহান। এটি তো এক গুরুতর অপবাদ।”

আয়াতে নির্দেশিত কিছু বিষয়

আয়াতের ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়,মুনাফিকরা এ অপবাদ দিয়েছিল ও ছড়াচ্ছিল। ইঙ্গিতগুলো হলো :

1. আয়াতে উল্লিখিত হয়েছেوالّذى تولّي كبره অর্থাৎ তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে’ অর্থাৎ মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই।

2. এগারোতম আয়াতে অপবাদ আরোপকারীদের ব্যাপারেعصبة শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা থেকে বোঝা যায়,তারা একতাবদ্ধ,পরস্পর সহযোগী ও সমচিন্তার অধিকারী একটি দল ছিল অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। আর মুসলমানদের মধ্যে মুনাফিকরা ছাড়া অন্য কেউ এতটা সুসংগঠিত ছিল না। তাই প্রমাণিত হয়,মুনাফিকরা এ কাজ করেছিল।

3. ঘটনাটি বনী মুস্তালিক গোত্রের সাথে যুদ্ধের পর ঘটে থাকলে তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ হতে জানা যায় আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই যেহেতু মদীনায় প্রবেশে বাধা পেয়েছিল,তাই মদীনার বাইরে সে-ই অপেক্ষা করছিল এবং সেই রাসূল (সা.)-এর স্ত্রীকে সাফওয়ানের সাথে আসতে দেখেছে। তাই মদীনা প্রবেশ করেই সে প্রচার করতে থাকে যে,রাসূলের স্ত্রী বেগানা (স্বামী,পিতা,ভাই ও এরূপ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ) ব্যক্তির সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন। তাঁরা উভয়ে গুনাহ্ হতে বাঁচতে পারেন নি।

4. এগারোতম আয়াতে বলা হয়েছে :

) لا تحسبوه شرّا لكم بل هو خير لكم(

“এ ঘটনাকে তোমাদের নিজেদের জন্য অকল্যাণকর মনে করো না;বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।”

এখন আমাদের দেখতে হবে,একজন মুমিন পুরুষ বা নারীকে ব্যভিচারের ন্যায় অপবাদ আরোপ অমঙ্গল না হয়ে মঙ্গলজনক হতে পারে। এর কারণ এটাই যে,এ ঘটনার ফলে মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে ও তারা সবার সামনে লাঞ্ছিত হয়েছে। উপরন্তু মুসলমানরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু শিখেছে।

বর্ণিত হাদীসে অতিরঞ্জিত বিষয়

যে অংশটুকু আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি,হাদীসের সে অংশ পবিত্র কুরআনের আয়াতের সঙ্গে সংগতিশীল এবং মহানবী (সা.)-এর পবিত্রতা ও নিষ্পাপত্বেরও পরিপন্থী নয়। কিন্তু সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীস যা অন্যরা তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন,তাতে দু টি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে,যা আমরা এখানে উল্লেখ করব :

1. প্রথমত হাদীসের একটি অংশ রাসূল (সা.)-এর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। বুখারী হযরত আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন : আমি সফর থেকে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। রাসূল (সা.) আমাকে দেখতে এলেন,কিন্তু তাঁর মধ্যে পূর্বের সেই ভালবাসা ও সহানুভূতি ছিল না। আমি ঘটনাটি সম্পর্কে জানতাম না। ধীরে ধীরে আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলে মুনাফিকদের গুজব সম্পর্কে জানতে পারলাম। ফলে দ্বিতীয় বারের মতো অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার অসুস্থতা তীব্রতা লাভ করল। রাসূল (সা.)-এর কাছে অনুমতি চাইলাম,পিতৃগৃহে বিশ্রাম নিতে যাব। তিনি অনুমতি দিলে পিতৃগৃহে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,লোকেরা আমার সম্পর্কে কি বলাবলি করে? তিনি বললেন : যে নারীর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে,লোকজন তার পশ্চাতে অনেক কিছুই বলে থাকে।

রাসূল (সা.) এ বিষয়ে উসামা ইবনে যাইদের সাথে পরামর্শ করেন। উসামা আমার পবিত্রতার বিষয়ে সাক্ষ্য দান করেন। রাসূল এ বিষয়ে আলীর পরামর্শ চাইলে তিনি আমার দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন। তখন তিনি বলেন : সেই আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমি তাঁর মধ্যে কোন অপবিত্রতার ছাপ দেখি নি। 167

বর্ণনার এ অংশ রাসূল (সা.)-এর মর্যাদা ও নিষ্পাপত্বের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কারণ এ অংশ হতে বোঝা যায়,রাসূল (সা.) নিজেও এই গুজবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। এতে তাঁর আচরণ এতটা পরিবর্তিত হয়েছিল যে,তিনি আয়েশার সঙ্গে ভিন্নরূপ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমনকি বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সন্দেহ অপনোদনের জন্য পরামর্শও করেন। কোন অপ্রমাণিত অভিযুক্তের সঙ্গে এরূপ আচরণ মহানবী (সা.) তো দূরের কথা,একজন সাধারণ মুমিনের জন্যও শোভনীয় নয়। কারণ কোন মুমিনেরই কোন গুজবে কান দিয়ে একজন মুসলমানের সাথে আচরণ পরিবর্তন করা উচিত নয়। এমনকি তার মনে সন্দেহের উদ্রেকও হলেও তার আচরণ পরিবর্তিত হওয়া উচিত নয়।

পবিত্র কুরআন সূরা নূরের 12 ও 14তম আয়াতে এ অপপ্রচারে প্রভাবিত লোকদের তীব্র সমালোচনা করে বলেছে : কেন তারা এ অপবাদের কথা শুনল। তাদের মুমিন পুরুষ ও নারীরা কেন ঐ ব্যক্তি (অভিযুক্তের) সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করল না এবং কেন বলল না যে,এটি স্পষ্ট মিথ্যা;এবং যদি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ইহ ও পরকালে তোমাদের প্রতি না থাকত,তবে তোমরা যা চর্চা করছিলে,সে কারণে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে।”

যদি উল্লিখিত বর্ণনার এ অংশ সঠিক হয়,তবে বলতে হয় স্বয়ং রাসূলও (নাউযুবিল্লাহ্) এ শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। অথচ নবুওয়াতের মহান মর্যাদার সঙ্গে নিষ্পাপত্বের বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব এবং মহানবী (সা.)-এর নিষ্পাপত্ব তাঁকে কখনোই এরূপ আয়াতের মুখোমুখি হতে অনুমতি দেয় না। তাই রাসূল (সা.)-এর নিষ্পাপত্ব ও মর্যাদার সাথে অসংগতিশীল অংশ থাকার কারণে এ হাদীস সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত হবে অথবা যে অংশ তাঁর নিষ্পাপত্বের সাথে সংগতিশীল নয়,সে অংশ বর্জন করে সংগতিশীল অংশ গ্রহণ করা যেতে পারে।

2. ইফকের ঘটনার পূর্বেই সা দ ইবনে মায়ায মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বুখারী তাঁর সহীহ’ -এ হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত শানে নুযূলে উল্লেখ করেছেন : মহানবী (সা.) আমার দাসী বুরাইরাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর মসজিদের মিম্বারে গিয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : আমার স্ত্রীর বিষয়ে আমাকে অসন্তুষ্টকারী লোককে শাস্তি দান থেকে কে আমাকে বিরত রাখতে (অধিকারহীন প্রমাণ করতে) চায়? অথচ আমি আমার যে স্ত্রীর মধ্যে ভাল বৈ মন্দ দেখি নি এবং ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে,যার থেকে কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ পাই নি,তাদেরকে অশালীন অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে?”   এ সময় সা দ ইবনে মায়ায168 দাঁড়িয়ে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার অধিকার রয়েছে বলে মনে করি। যদি ঐ লোক আউস গোত্রের হয়ে থাকে,তবে আমরা তার শিরচ্ছেদ করব। আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হয়ে থাকে,তবে তার ক্ষেত্রেও আপনার নির্দেশ পালন করব।”

সা দ ইবনে মায়াযের এ কথা খাযরাজ গোত্রপতি সা দ ইবনে উবাদার কাছে অসম্মানজনক ঠেকলো। সে দাঁড়িয়ে ক্রোধের সাথে বললো : আল্লাহর শপথ! তুমি তাকে হত্যার ক্ষমতা রাখ না।

সা দ ইবনে মায়াযের চাচাতো ভাই উসাইদ ইবনে হুযাইর169 সা দ ইবনে উবাদার কথার প্রতিবাদ করে বললেন : আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে হত্যা করব। তুমি মুনাফিক বলে মুনাফিকের পক্ষপাতিত্ব করছ।” রাসূল (সা.) মিম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই দুই গোত্রের লোকেরা একে অপরকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। রাসূলের নির্দেশে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ স্থানে বসল।170 ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থের 2য় খণ্ডের 300 পৃষ্ঠায় সা দ ইবনে মায়াযের নাম উল্লেখ করেন নি;কিন্তু সা দ ইবনে উবাদার সঙ্গে উসাইদ ইবনে হুযাইরের বাক-বিতণ্ডার কথা উল্লেখ করেছেন।

শানে নুযূলের এ অংশ ঘটনার সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিশীল নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে সা দ ইবনে মায়ায আহযাবের যুদ্ধে গুরুতর আহত হন এবং বনী কুরাইযার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দান ও বিচারকাজ পরিচালনার পরপরই মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনা খন্দকের (আহযাবের) যুদ্ধ ও বনী কুরাইযাহ্ সম্পর্কিত আলোচনায় বুখারী তাঁর সহীহ’ গ্রন্থের 5ম খণ্ডের 113 পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। তাই যে ব্যক্তি বনী কুরাইযার ঘটনার পর মৃত্যুবরণ করেছেন কিভাবে তার পাঁচ মাস পর সংঘটিত ইফ্ক’ -এর ঘটনায় জীবিত হয়ে রাসূলের মিম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সা দ ইবনে উবাদার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে পারেন! ঐতিহাসিকগণ বলেছেন,খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার (পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে) পর বনী কুরাইযার ঘটনা ঘটেছে। বনী কুরাইয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি পঞ্চম হিজরীর 19 যিলহজ্ব ঘটে। সা দ ইবনে মায়ায এ যুদ্ধের পরপরই গুরুতর আঘাতজনিত কারণে ব্যাপক রক্তপাত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।171 আর বনী মুস্তালিকের সঙ্গে যুদ্ধ ষষ্ঠ হিজরীর শা বান মাসে ঘটেছিল।

ইফকের ঘটনায় যে বিষয়টি জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,তা হলো,মুনাফিকরা ইসলামী সমাজের একজন বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের ওপর অপবাদ আরোপের মাধ্যমে মুসলমানদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে চেয়েছিল।

পবিত্র কুরআনের সূরা নূরের 11তম আয়াতেরالّذى تولّي كبره -এ অংশের লক্ষ্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ছিল বলে শানে নুযূলে উল্লিখিত হয়েছে অর্থাৎ সে-ই ছিল গুজব রটনার হোতা।

দ্বিতীয় শানে নুযূল

এ শানে নুযূলে বলা হয়েছে,উপরিউক্ত আয়াতসমূহ রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী মারীয়া কিবতীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূলের পুত্র ইবরাহীমের ইন্তেকালে রাসূল (সা.) খুবই শোকাহত হন। শোক লক্ষ্য করে তাঁর কোন এক স্ত্রী তাঁকে বলেন : কেন আপনি শোকাহত হয়েছেন;অথচ সে আপনার সন্তান নয়,বরং ইবনে জারিহের সন্তান।” রাসূল (সা.) তা শোনার পর ইবনে জারিহকে হত্যার জন্য আলী (আ.)-কে নির্দেশ দেন। হযরত আলী তাকে হত্যার জন্য যে বাগানে ইবনে জারিহ্ কাজ করছিল,মুক্ত তরবারি হাতে সেখানে যান। আলীকে ক্রোধান্বিত দেখে সে দৌড়ে একটি খেজুর গাছে উঠে পড়ে। আলীও তাকে ধরতে গাছে উঠলে গাছ থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে তার পরনের কাপড় খুলে যায়। আলী লক্ষ্য করেন,সে একজন খোজা পুরুষ। তখন তিনি ফিরে এসে রাসূল (সা.)-কে তা জানান।

এ বর্ণনা মুহাদ্দিস বাহরাইনী তাঁর তাফসীরে বুরহান’ গ্রন্থের 2য় খণ্ডের 126-127 পৃষ্ঠায় এবং হুয়াইজী তাঁর তাফসীরে নুরুস সাকালাইন’ গ্রন্থের 3য় খণ্ডের 581-582 পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ঘটনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত দুর্বল ও এর ভিত্তিহীনতার প্রমাণ থাকায় তা আলাদাভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন মনে করছি না। আমরা এ শানে নুযূলকে এ কারণে গ্রহণ করতে পারি না। সুতরাং ইফকের ঘটনায় যিনি-ই অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়ে থাকুন না কেন,মূল ঘটনাই আমাদের প্রতিপাদ্য।

বিয়াল্লিশতম অধ্যায় : ষষ্ঠ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ