চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74549
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74549 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পারস্য-সম্রাটের দরবারে মহানবী (সা.)-এর দূত

মহানবী (সা.)-এর দূত ইরানের শাহী দরবারের উদ্দেশে রওয়ানা হবার সময়ে ইরান অর্থাৎ পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন খসরু পারভেজ। তিনি আনুশীরওয়ানের (নওশেরওয়ান) পর ইরানের দ্বিতীয় নৃপতি ছিলেন,যিনি মহানবী (সা.)-এর হিজরতেরও 32 বছর আগে পারস্যের রাজসিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এ দীর্ঘ 32 বছরে তাঁর সরকার ও প্রশাসন অসংখ্য তিক্ত ও মধুর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। তাঁর শাসনামলে ইরানের শক্তি সম্পূর্ণরূপে দোদুল্যমান ছিল। ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি একদিন এশিয়া মাইনরের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা কন্সটান্টিনোপল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

হযরত ঈসা (আ.)-এর ক্রস,যার চেয়ে অধিকতর পবিত্র আর কিছুই খ্রিষ্টানদের কাছে ছিল না,তা তীসকূন্ অর্থাৎ মাদায়েনে আনা হলো এবং রোমের সম্রাট সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার জন্য একজন দূতকে পারস্যের রাজদরবারে প্রেরণ করলেন। ইরানের সীমান্ত,হাখামানেশী যুগে পারস্যসাম্রাজ্য যতখানি বিস্তৃতি লাভ করেছিল,সম্রাট খসরু পারভেজের রাজত্বকালে ততখানি বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু পরে তদানীন্তন পারস্য সম্রাটের অদক্ষতা,অব্যবস্থাপনা,মাত্রাতিরিক্ত অহংকার এবং ভোগ-বিলাসের কারণে ইরান অধঃপতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। বিজিত অঞ্চলসমূহ একের পর এক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল এবং শত্রুবাহিনী পারস্য সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ তীসফূনের কাছে দাস্তগার্দ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে গেল যে,স্বয়ং সম্রাট খসরু পারভেজ রোমানদের ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্রাটের এ গর্হিত কাজ (পলায়ন) ইরানী জাতিকে অতিশয় ক্রুদ্ধ করেছিল এবং অবশেষে তিনি (সম্রাট) নিজ সন্তান শীরাভেইয়ের হাতেই নিহত হয়েছিলেন।

ইতিহাস বিশ্লেষণকারী জ্ঞানীগুণীগণ সম্রাট খসরু পারভেজের গর্ব-অহংকার,স্বার্থপরতা,স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিলাসিতা ও আমোদ-প্রমোদকে পারস্য সাম্রাজ্যের দক্ষতা ও শক্তিতে ভাটা পড়ার কারণ বলে গণ্য করেন। সম্রাট যদি সন্ধি প্রস্তাব আনয়নকারী দূতের বার্তা গ্রহণ করতেন,তা হলে সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ছত্রছায়ায় ইরানের গৌরব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকত।

মহানবীর প্রেরিত পত্র খসরু পারভেজের মন-মানসিকতার উপর ভালো প্রভাব রেখে না থাকলে তা এ পত্র বা পত্রবাহকের দোষ-ত্রুটির কারণে ছিল না,বরং তাঁর বিশেষ ধরনের মানসিকতা এবং সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা তাঁকে মহানবীর আহবান সম্পর্কে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা-ভাবনা করারও সুযোগ দেয় নি। দোভাষী মহানবীর পত্র অনুবাদ করে শেষ করতে পারে নি,এমন মুহূর্তে সম্রাট খসরু পারভেজ উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে মহানবীর পত্রখানি ছিঁড়ে ফেলেন।

হিজরতের সপ্তম বর্ষের শুরুতে207 মহানবী তাঁর অন্যতম সাহসী সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ্ ইবনে হাযাফাহ্ কারাশীকে ইরানের রাজদরবারে সম্রাট খসরু পারভেজের কাছে একটি পত্র হস্তান্তর করে তাঁকে ইসলাম ধর্ম ও তাওহীদী আদর্শ গ্রহণ করার আহবান জানানোর দায়িত্ব প্রদান করেন। মহানবী (সা.)-এর পত্র ছিল নিম্নরূপ :

بسم الله الرّحمان الرّحيم من محمّد رسول الله الى كسري عظيم فارس، سلام علي من اتّبع الهدي و آمن بالله و رسوله و أشهد ان لا اله الّا الله  وحده لا شريك له و أن محمّدا عبده و رسوله، أدعوك بدعاية الله، فانّى أنا رسول النّاس كافة لأنذر من كان حيّا و يحقّ القول علي الكافرين، أسلم تسلم، فان أبيت فعليك اثم المجوس

“পরম করুণাময় ও চির দয়ালু মহান আল্লাহর নামে। মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট খসরুর প্রতি। যে সত্যান্বেষণ করে,মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং সাক্ষ্য দেয়,-কেবল তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই,তাঁর কোন শরীক ও সমকক্ষ নেই,আর বিশ্বাস করে,মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল,তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি মহান আল্লাহর নির্দেশে আপনাকে মহান আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। তিনি সমগ্র মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন যাতে আমি তাদেরকে তাঁর ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন এবং অবিশ্বাসীদের ওপর মহান আল্লাহর যুক্তি পরিপূর্ণ করি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুন,তা হলে আপনিও নিরাপত্তা লাভ করবেন। আর যদি আপনি ঈমান ও ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন,তা হলে মাজুস্ জাতির (সকল যারথুস্ত্র ধর্মাবলম্বীর) পাপের বোঝা আপনার কাঁধে বর্তাবে। 208

ইরানের মিষ্টভাষী কবি হাকীম নিযামী এ ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা কবিতায় বর্ণনা করেছেন :

হে দুর্বল অক্ষম নৃপতি! তোমার নাম খসরু

এমনকি যদি তুমি হও শত পানপাত্রের অধিকারী কায়খসরু209

হয়ো না অংহকারী,কারণ অহংকারী যে,নেই তার অন্তর্দৃষ্টি,

হও স্রষ্টাদ্রষ্টা;কারণ আত্মম্ভরিতায় নেই কোন গুণ ও নিপুণতা;

সাক্ষ্য দাও,এ বিশ্ব-জগতের রয়েছেন এমন স্রষ্টা

যিনি নেই কোন স্থানে আবদ্ধ,আর না যিনি কোন স্থানের মুখাপেক্ষী

এমন স্রষ্টা,যিনি মানুষকে দিয়েছেন নেতৃত্ব

আর তিনিই দিয়েছেন আমাকে মানুষের ওপর পয়গম্বরী।

মহানবীর দূত রাজদরবারে প্রবেশ করলেন। খসরু পারভেজ তাঁর হাত থেকে পত্র নেয়ার আদেশ দিলেন। দূত বললেন : আমি অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতে মহানবীর পত্র অর্পণ করব।” খসরু পারভেজ দোভাষীকে তলব করলেন। দোভাষী পত্র খুলে অনুবাদ করল :

এটা মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্যের সম্রাট খসরুর প্রতি। তখনও অনুবাদক পত্র পড়ে শেষ করতে পারে নি,অমনি ইরানের অধিপতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে অনুবাদকের হাত থেকে পত্রখানা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন এবং চিৎকার করে বললেন : এ লোকটির স্পর্ধা দেখ! সে আমার নামের আগে নিজের নাম লিখেছে!”   তৎক্ষণাৎ পারস্য সম্রাট আবদুল্লাহকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন। আবদুল্লাহ্ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এলেন এবং নিজের সওয়ারী পশুর উপর আরোহণ করে মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি মহানবীর নিকট পুরো ঘটনা বিস্তারিত বললেন এবং মহানবীও সম্রাট খসরুর অবমাননাকর আচরণে খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর মুখমণ্ডলে তীব্র ক্রোধের চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠল। মহানবী (সা.) সম্রাট খসরু সম্পর্কে বললেন :اللهمّ مزّق ملكه হে আল্লাহ্! তার রাজত্বকে টুকরো টুকরো করে দিন। 210

ইরানের প্রসিদ্ধ কবি ও সুবক্তা সাহিত্যিক হাকীম নিযামী এ প্রসঙ্গে কবিতা রচনা করেছেন :

যখন দূত পেশ করলেন ঐ নতুন পত্র

তখন শাস্তিদানের অভিপ্রায়ে টগবগিয়ে উঠলো খসরুর রুধির

দেখল সে ভাবগাম্ভীর্যে উদ্দীপ্ত কালো রেখা211

যা মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারভেজের প্রতি লেখা

কার আছে এত পিত্ত-বুকের পাটা

আমার এত মর্যাদা সত্বেও সে কি না

আমার নামের উপর লিখে নিজের নাম!

গর্দান গুঁড়িয়ে দেয়ার পত্রখানা212 সে ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো

আসলে পত্র নয়;বরং সে নিজেকেই ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো

ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর মত

ইয়াকুবীর প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে ওয়াজেহ একটি বর্ণনায় এমন কিছু বলেছেন যা সকল ঐতিহাসিকের মতের বিপরীত। তিনি লিখেছেন,খসরু পারভেজ (পারস্য সম্রাট) মহানবী (সা.)-এর পত্র পড়ে তাঁর সম্মানে এক খণ্ড রেশমী বস্ত্র ও সুগন্ধী উপহার হিসেবে পাঠান। মহানবী সুগন্ধিটি গ্রহণ করে সাহাবীগণের মধ্যে বিলিয়ে দেন। কিন্তু রেশমী বস্ত্র সম্পর্কে বলেন,তা পুরুষদের জন্য হারাম। অতঃপর বলেন : ইসলাম তার ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে। 213

এক্ষেত্রে একমাত্র আহমদ ইবনে হাম্বল ছাড়া অন্য কোন ঐতিহাসিকের মতই ইয়াকুবীর অনুরূপ নয়। তিনি অনুরূপ মত ব্যক্ত করে বলেছেন,মহানবীর জন্য খসরু পারভেজ কিছু উপহার পাঠান।214

ইয়েমেনের শাসনকর্তার প্রতি খসরু পারভেজের নির্দেশ

ইয়েমেন মক্কার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি অঞ্চল। সেখানে সবসময়ই পারস্যের সাসানী সম্রাটের নিযুক্ত প্রতিনিধি শাসনকাজ পরিচালনা করত। তখন সেখানকার শাসনকর্তা ছিল বজান। খসরু পারভেজ অহংকারবশত ইয়েমেনের শাসনকর্তাকে পত্র লিখলেন :

“আমার নিকট খবর পৌঁছেছে,মক্কার কুরাইশ বংশের এক ব্যক্তি নবুওয়াত দাবী করেছে। তোমার সেনাদলের দু জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তাকে গ্রেফতারের জন্য প্রেরণ কর,যাতে তারা তাকে গ্রেফতার করে আমার কাছে নিয়ে আসে। 215

ইবনে হাজার তাঁর আল ইসাবাহ্’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,খসরু তার এই সেনাপতিকে নির্দেশ দেন রাসূলকে তাঁর পূর্বসূরিদের ধর্মে বিশ্বাস আনয়নে বাধ্য করতে এবং যদি তিনি তা করতে অস্বীকার করেন,তবে তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তার নিকট প্রেরণ করতে। পারস্য সম্রাটের এ পত্র তার অজ্ঞতার পরিচায়ক। কারণ তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে এতটা অনবগত ছিলেন যে,তিনি জানতেন না এই নবুওয়াতের দাবীদার ছয় বছরের অধিক সময় হলো মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন এবং তাঁর প্রভাব সেখানে এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে,বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্রাটদের উদ্দেশে পত্র দিচ্ছেন। এমন ব্যক্তিত্বকে বন্দী করার জন্য দু জন সেনাপতি প্রেরণ সত্যিই হাস্যকর!

ইয়েমেনের শাসনকর্তা কেন্দ্রীয় নির্দেশে দুই শাক্তিশালী সেনাপতি ফিরুয ও খার খাসরাহকে হিজাযের উদ্দেশে প্রেরণ করল। এ দু জন মক্কার নিকটবর্তী তায়েফে গিয়ে এক কুরাইশ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করল। সে তাদেরকে বলল,আপনাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি মদীনায় বসবাস করছে। তারা মদীনায় মহানবী (সা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বজানের পত্র তাঁর হাতে দিয়ে বললেন : আমরা ইয়েমেনের শাসকের পক্ষ থেকে আপনাকে বন্দী করে ইয়েমেনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছি। সম্ভবত আপনি ইয়েমেনে গেলে বজান আপনার পক্ষে খসরু পারভেজের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। অন্যথায় আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং সেক্ষেত্রে সাসানী শাসকদের ক্ষমতার মোকাবেলায় আপনারা পর্যুদস্ত হবেন,আপনাদের ঘরগুলো ধ্বংস হবে ও পুরুষরা নিহত হবে...।”

মহানবী (সা.) শান্তভাবে তাদের কথা শুনলেন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তাদের দীর্ঘ গোঁফ দেখে তা যে তাঁর অপছন্দ হয়েছে তা বোঝাতে মহানবী বললেন : আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন শ্মশ্রু দীর্ঘ করার এবং গোঁফ ছোট রাখার। 216

মহানবী (সা.)-এর শান্ত ও আকর্ষণীয় সৌম্য চেহারা মুবারক এবং ব্যক্তিত্বময় রূপ তাদের ওপর এতটা প্রভাব ফেলেছিল যে,যখন তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন,তাদের দেহ শিহরিত হচ্ছিল।

মহানবী তাদের বললেন : আজকে আপনারা যান। আগামীকাল আপনাদের আমার মত জানাব।”   ঐ দিনই মহানবী ওহী মারফত জানতে পারলেন,খসরু পারভেজ নিহত হয়েছে। পরের দিন ওই সেনাপতি রাসূলের নিকট উপস্থিত হলে তিনি বললেন : আমার মহান পালনকর্তা আমাকে জানিয়েছেন,খসরু পারভেজকে তার পুত্র শিরাভেই হত্যা করেছে এবং সে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছে।” যে রাতে খসরু নিহত হয়েছে বলে মহানবী ঘোষণা দিয়েছিলেন,তা ছিল জমাদিউল আউয়াল মাসের দশম দিন।217

বজানের প্রেরিত সেনাপতিদ্বয় এ খবর শুনে চমকে উঠে বললেন : আপনার নবুওয়াতের দাবী অপেক্ষা এ কথা সাসানী সম্রাটকে অধিকতর ক্রোধান্বিত করবে। আমরা এ খবর বজানের নিকট পৌঁছিয়ে এ ব্যাপারে খসরু পারভেজকে জানাতে বলব।

মহানবী বললেন : আমি আরো খুশী হব যদি এ কথাটিও তাকে বলেন যে,আমি বলেছি :

إنّ دينِى و سلطانِى سيبلغ إلى منتهي الخفّ و الحافر

“আমার ধর্ম ও প্রভাব ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে,যেখানে অত্যন্ত দ্রুতগামী বাহনগুলো পৌঁছায়।”

অতঃপর মহানবী (সা.) তাঁকে প্রদত্ত এক আরব গোত্রপতির উপহার স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত একটি মূল্যবান কোমরবন্ধ ঐ দুই দূতকে উপহার দিলেন। উভয়ে এতে সন্তুষ্ট হয়ে ইয়েমেনে ফিরে গেল এবং বজানকে মহানবীর বক্তব্য সম্পর্কে জানালো।

বজান বলল : যদি এ খবর সত্য হয়,তবে নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর নবী এবং আমাদের উচিত তাঁকে অনুসরণ করা।” কিছু সময় অতিক্রান্ত না হতেই শিরাভেইয়ের দূত বজানের জন্য পত্র নিয়ে গেল। তাতে লেখা ছিল :

“তোমরা জেনে রাখ,আমি খসরু পারভেজকে হত্যা করেছি। জাতির ক্ষোভের কারণে আমি তাকে হত্যা করেছি। কারণ সে পারস্যের অভিজাত ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল,সম্মানিতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। আমার পত্র পৌঁছা মাত্র জনগণ থেকে আমার পক্ষে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ কর। নবুওয়াতের দাবীকারী ব্যক্তিকে তাঁর নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও। আমার পিতার নির্দেশের অনুবর্তী হয়ে তাঁর সঙ্গে কঠোর আচরণ করো না;বরং আমার পরবর্তী নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”

শিরাভেইয়ের পত্র বজানসহ ইয়েমেনে নিযুক্ত ইরানী বংশোদ্ভূত সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করল। ফলে বজান সহ তার কর্মচারীরা রাসূলের নিকট পত্র দিয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানাল।

মিশরে ইসলামের দূত

মিশর প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি,ফিরআউন বংশের শাসকদের রাজধানী এবং কিবতীদের বাসভূমি ছিল। হেজাযের আকাশে ইসলামের সূর্য উদয় কালে মিশর তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। কারণ মুকুকেস রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল এ শর্তে যে,বছরে ঊনিশ মিলিয়ন দিনার কর শোধ করবে।

হাতেব ইবনে আবি বালতায়াহ্ একজন দক্ষ ও সাহসী অশ্বারোহী ছিলেন। মক্কা বিজয়ের ঘটনার সাথে তাঁর নামে বিখ্যাত এক ইতিহাস জড়িত আছে,যা আমরা অষ্টম হিজরীর ঘটনা প্রবাহের আলোচনায় উল্লেখ করব।

তিনি রাসূলের প্রেরিত ছয় দূতের একজন ছিলেন,যাঁরা তাঁর ইসলামের দাওয়াত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্রাটদের নিকট পৌঁছানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে মিশর শাসনকর্তা মুকুকেসের নিকট পত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিলেন। মহানবীর পত্রের বাণী ছিল নিম্নরূপ :

بسم الله الرّحمان الرّحيم من محمّد بن عبد الله الى المقوقس عظيم القبط، سلام علي من اتّبع الهدي. امّا بعد، فانّى أدعوك بدعاية الاسلام، أسلم تسلم و اسلم يؤتك الله اجرك مرّتين. فان توليت فانما عليك اثم القبط <و يا أهل الكتاب تعالوا الى كلمة سواء بيننا و بينكم ان لا نعبد الّا الله و لا نُشرك به شيئا و لا يتخذ بعضنا بعضاً اربابا من دون الله فان تولّوا فقولوا اشهدوا بأنا مسلمون

“পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ পত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে কিবতী সম্রাট মুকুকেসের প্রতি। সত্যপন্থীদের ওপর মহান আল্লাহ্ শান্তি বর্ষণ করুন। আমি আপনাকে ইসলামের প্রতি আহবান করছি। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন,যাতে (মহান আল্লাহর শাস্তি হতে) নিরাপত্তা লাভ করতে পারেন। যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন,তবে আল্লাহ্ আপনাকে দু টি পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন,তবে মিশরবাসীদের গুনাহও আপনার ওপর বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! আমরা আপনাদের এমন এক মৌলনীতির দিকে আহবান করছি,যে বিষয়ে আমরা ও আপনারা সমান। আর তা হলো : আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করব না। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না। আল্লাহকে ছেড়ে আমরা নিজেদের মধ্যকার কাউকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে,তবে বলে দিন,সাক্ষী থাকুন,আমরা তো (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণকারী। 218

মহানবীর দূত মিশরে প্রবেশ করে জানতে পারলেন মিশর সম্রাট সমূদ্র তীরবর্তী আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটি সুউচ্চ প্রাসাদে বাস করেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে দ্বীপের ন্যায় ভূখণ্ডের উপর অবস্থিত সম্রাটের প্রাসাদে নৌকায় পৌঁছলেন। সম্রাট তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। অতঃপর মহানবীর পত্র পড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। চিন্তার পর মাথা উঠিয়ে মহানবীর দূতকে বললেন : যদি মুহাম্মদ আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন,কিভাবে তাঁর শক্ররা তাঁকে তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারল এবং তিনি বাধ্য হয়ে মদীনায় গিয়ে বাস করতে লাগলেন? কেন তিনি তাদেরকে অভিশাপ দিলেন না,যাতে তারা তাঁর অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যায়?

মহানবীর প্রশিক্ষিত দূত বললেন : হযরত ঈসাও আল্লাহর নবী ছিলেন এবং আপনারা তাঁকে নবী বলে মানেন। বনী ইসরাঈল জাতি তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করলে কেন তিনি তাদের অভিশাপ দিলেন না,যাতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়?

মিশর সম্রাট এমন দাঁতভাঙ্গা জবাবের প্রতীক্ষায় ছিলেন না। তাই দূতের এই যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে নীরব হলেন। অতঃপর তাঁর প্রশংসা করে বললেন :

أحسنت أنت حكيم جئت من عند حكيم

“চমৎকার! নিশ্চয়ই আপনি জ্ঞানী এবং একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের নিকট হতে এসেছেন। 219

মিশরের শাসনকর্তার অভ্যর্থনায় দূত তাঁর সামনে ইসলাম প্রচারের সাহস পেলেন। তাই বললেন : আপনার পূর্বে এ ভূখণ্ডে অন্য কেউ (ফিরআউন) শাসন করত। সে মানুষের নিকট নিজেকে খোদা বলে পরিচয় দিত। কিন্তু পরিণতিতে আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ তা করেছেন এ জন্য যে,তা আপনাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের কারণ হবে এবং আপনারা তার পথ অনুসরণ করে যেন অন্যদের জন্য শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ না হন। আমাদের নবী মানুষকে পবিত্র এক ধর্মের প্রতি আহবান জানান। কুরাইশ মুশরিকরা তাঁর সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ করেছে,বিদ্বেষপরায়ণ ইহুদীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে,কিন্তু খ্রিষ্টানরা তাঁর সবচেয়ে নিকটবর্তী। মহান আল্লাহর শপথ! যেমনভাবে হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আ.) হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন,ঠিক তেমনিভাবে হযরত ঈসাও আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করেছেন।

তাই আপনাদের ইসলাম ও আল্লাহর কিতাব আল কুরআন’ -এর প্রতি আহবান করছি,যেমনভাবে আপনারা তাওরাতের অনুসারীদের ইনযীলের প্রতি আহবান জানান। যে কেউ কোন নবীর আহবান শুনবে,তার উচিত হবে তাঁর অনুসরণ করা। আমি এক নবীর আহবান আপনাদের নিকট পৌঁছালাম। আপনার উচিত হবে নিজে ইসলাম গ্রহণ করে স্বজাতিকে এ ধর্ম অনুসরণের আহবান জানানো। আমি কখনোই আপনাদের হযরত ঈসার ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে বলছি না;বরং বলছি তাঁর অনুসৃত রীতি গ্রহণ করুন। তবে জেনে রাখুন,হযরত ঈসার ধর্মের পূর্ণ রূপই হলো ইসলাম। 220

মিশর সম্রাটের সাথে রাসূল (সা.)-এর দূতের সংলাপ শেষ হলো। কিন্তু মুকুকেস তখনও চূড়ান্ত কোন উত্তর প্রদান করেন নি। তাই হাতিব তাঁর জবাব ও পত্র গ্রহণের জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করলেন। একদিন মুকুকেস হাতিবকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে নিয়ে একান্ত সংলাপে বসলেন। মহানবীর ধর্মবিশ্বাস ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সা.)-এর দূত তাঁকে বললেন : তিনি মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি আহবান করে থাকেন,তাঁর অনুসারীদের প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার,রমজান মাসে রোজা রাখার,আল্লাহর গৃহে হজ্বে যাওয়ার,নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার নির্দেশ দেন। মৃত প্রাণী ও রক্ত ভক্ষণ হতে নিষেধ করেন;অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাতে বারণ করেন...।”

হাতিব রাসূল (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করলেন এবং তাঁর চরিত্র-বৈশিষ্ট বর্ণনা করে বক্তব্য শেষ করলেন। মিশরের শাসনকর্তা তাঁকে বললেন : নিশ্চয়ই এসব তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ। আমার ধারণা ছিল,শেষ নবী এখনো আসেন নি। আমি মনে করতাম,তিনি নবিগণের আবির্ভাবের কেন্দ্র সিরিয়ায় আবির্ভূত হবেন,হিজাযে নয়। হে মুহাম্মদের দূত! আপনি জেনে রাখুন,আমি যদি তাঁর ধর্ম মেনেও নিই,কিবতীরা (মিশরের অধিবাসীরা) তা গ্রহণ করবে না। আশা করি,আপনাদের নবীর ক্ষমতার বলয় মিশর পর্যন্ত প্রসারিত হোক এবং তাঁর সঙ্গীগণ এ দেশে অবস্থান গ্রহণ করুন। এভাবে স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের পরাস্ত করে তাদের বাতিল বিশ্বাসের ওপর জয়ী হোন। আমি আপনার নিকট চাই এ কথোপকথনের বিষয় গোপন রাখুন,যাতে কিবতীরা কেউ এ সম্পর্কে জানতে না পারে। 221