চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74565
ডাউনলোড: 6139


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74565 / ডাউনলোড: 6139
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

একে একে দুর্গের পতন

দ্বিতীয় দুর্গ দখলের পর মুসলিম সৈন্যরা ওয়াতিহ্’ এবং সুলালিম’ দুর্গ দখলের যুদ্ধে নিয়োজিত হলেন। কিন্তু মুসলমানরা দুর্গের বাইরের ইহুদীদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখোমুখি হলেন। ফলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা সত্বেও প্রতিদিন মুসলমানরা ব্যাপক প্রাণহানির সম্মুখীন হচ্ছিলেন এবং কোনরূপ অগ্রগতি ছাড়াই দশ দিনব্যাপী যুদ্ধ অব্যাহত থাকল। মুসলিম সেনাপতিগণ প্রতিদিন ব্যর্থ হয়ে ছাউনীতে ফিরে আসছিলেন। একদিন মহানবী (সা.) হযরত আবু বকরের হাতে যুদ্ধের পতাকা দিয়ে প্রেরণ করলেন। তিনি সেনাদল নিয়ে দুর্গের সামনে যেতেই ব্যাপক আক্রমণের শিকার হয়ে ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে এলেন। তিনি ও তাঁর অনুগত সৈন্যরা একে অপরকে পরাজয়ের জন্য অভিযুক্ত করতে লাগলেন ও পরস্পরকে পলায়নকারী’ বলে আখ্যায়িত করলেন। পরের দিন হযরত উমরকে অনুরূপ দায়িত্ব দেয়া হলো। তিনিও তাঁর পূর্বসূরি ও বন্ধুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। ঐতিহাসিক তাবারীর245 বর্ণনানুসারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে ইহুদী বীর যোদ্ধা মারহাবের অসাধারণ বীরত্বের বর্ণনা দিয়ে মুসলমান সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছিলেন। এ অবস্থা দেখে মহানবী (সা.) খুবই অসন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর সেনাদলের সকল সেনাপতি ও সৈন্যকে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে এমন এক মূল্যবান বক্তব্য দিলেন যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। তিনি বক্তব্যের শেষে বললেন :

لاعطين الراية غداً رجلاً يحب اللهَ و رسولَه و يحبُه اللهُ و رسولُه يفتح اللهُ علي يديه ليس بفرّار

“আগামীকাল এ পতাকা এমন এক ব্যক্তির হাতে দেব,যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালোবাসেন। আল্লাহ্ তার হাতে দুর্গের পতন ঘটাবেন। সে এমন ব্যক্তি,যে শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে নি এবং কখনোই যুদ্ধ হতে পলায়ন করে নি। 246

আল্লামা তাবারসী এবং ঐতিহাসিক হালাবী উল্লেখ করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন : সে শত্রুর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করবে এবং কখনোই পলায়ন করবে না (كرّار غير فرّار )।”247

মহানবী (সা.)-এর এ বাক্য,যে সেনাপতির হাতে জয় আসবে,তাঁর আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব,সাহসিকতা ও বিশেষ মর্যাদার বর্ণনাকারী। তাই সেনাপতি ও সৈন্যগণের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর এ বাক্য টান টান উত্তেজনা ও শিহরণ সৃষ্টি করল। একই সাথে তাঁদের মধ্যে আনন্দমিশ্রিত বাসনার উদ্রেক ঘটেছিল ও তাঁরা স্নায়ুর চাপ অনুভব করছিলেন। প্রত্যেকেই আশা করছিলেন248 এ পরম সৌভাগ্য তাঁর ভাগ্যে জুটুক।

রাসূলের বক্তব্য শেষ হলো। রাতের অন্ধকার নেমে এলে মুসলিম সেনারা যাঁর যাঁর তাঁবুতে বিশ্রামের জন্য চলে গেলেন। রাতের প্রহরীরা উঁচু স্থানগুলোয় দাঁড়িয়ে শত্রুর উপর নজর রাখছিলেন। রাতের প্রহর কাটলে দিগন্তের বুক চিরে সূর্য উদিত হলো। সূর্যের সোনালী রোদে মরু-প্রান্তর আলোকিত হলো। সেনাপতিগণ মহানবী (সা.)-এর চারপাশে সমবেত হলেন। গত দু দিনের পরাজিত সেনাপতিগণও রাসূলের নির্দেশ শোনার জন্য ঘাড় টান করে রইলেন। এ মহা গর্বের পতাকা কার হাতে দেয়া হবে,তা জানতে তাঁরা উদগ্রীব হয়ে রইলেন।249 উপস্থিত সেনাদলের মধ্যে তখন চরম নীরবতা।

‘আলী কোথায়? -মহানবী (সা.)-এর এ কথায় নীরবতা ভঙ্গ হলো। সবাই বললেন, তিনি চোখের ব্যথায় পীড়িত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন।” তিনি বললেন : তাকে নিয়ে এসো।”

তাবারী বর্ণনা করেছেন,তাঁকে উটের পিঠে চড়িয়ে রাসূলের তাঁবুর সামনে আনা হলো। এ থেকে বোঝা যায়, চোখের ব্যথা এতটা তীব্র ছিল যে,তিনি কাতর হয়ে পড়েছিলেন। রাসূল (সা.) তাঁর হাত আলীর চোখে বুলিয়ে দিয়ে দুআ করলেন। রাসূলের হাতের স্পর্শ ও দুআ তাঁর চোখে এতটা বরকত দান করেছিল,জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি আর চোখের ব্যথায় ভোগেন নি। রাসূল তাঁকে যাত্রার নির্দেশ দিয়ে কিছু করণীয় বিষয় সম্পর্কে বললেন,যেমন যুদ্ধ শুরুর পূর্বে দুর্গের ইহুদীদের উদ্দেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে। যদি তারা তা না মানে,তা হলে আত্মসমর্পণ করে ইসলামী শাসনের অধীনে জিজিয়া দিয়ে স্বাধীনভাবে বাস করার প্রস্তাব দিতে বললেন ও এক্ষেত্রে তাদের নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন।250 যদি এ প্রস্তাবগুলোর কোনটিই তারা না মানে,তা হলে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে বললেন। সবশেষে নিম্নোক্ত কথা বললেন :

لئن يهدى الله بك رجلا واحدا خير من أن يكون لك حمر النعم

“যদি আল্লাহ্ তোমার মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে হেদায়েত করেন,তা হলে তা তোমার জন্য লাল রঙের লোম বিশিষ্ট উটের পাল অপেক্ষা উত্তম। 251

মহানবী (সা.) যুদ্ধের মধ্যেই মানুষের হেদায়েতের চিন্তা করতেন। তাঁর সব যুদ্ধই প্রমাণ করে,তাঁর যুদ্ধ ছিল মানুষের হেদায়েতের জন্য।

খাইবরের মহা বিজয়

পূর্ববর্তী দু জন সমরনায়ক পরাজিত হয়ে ফিরে এসে মুসলিম সৈন্যদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছিলেন। রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে ওয়াতীহ্ ও সুলালিম দুর্গ দু টি দখলের লক্ষ্যে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বর্ম পরে তাঁর তরবারি জুলফিকার’ হাতে নিয়ে মহাবীরের ন্যায় সাহসিকতার সাথে দুর্গের দিকে যাত্রা করলেন। দুর্গের নিকট পৌঁছে মহানবীর দেয়া পতাকা মাটিতে গাঁথলেন। দুর্গের ফটক খুলে ইহুদী যোদ্ধারা বেরিয়ে এল। প্রথমে মারহাবের ভাই হারিস সামনে এসে বিকট শব্দে হঙ্কার ছাড়লো। তার হুঙ্কারে ভীত হয়ে হযরত আলী (আ.)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মুসলিম সৈন্যরা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু আলী পাহাড়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই হারিস গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল এবং সেখানেই মারা গেল।

ভাইয়ের মৃত্যুতে মারহাব অত্যন্ত মর্মাহত হলো। সে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সামনে এগিয়ে এলো। সে সম্পূর্ণ অস্ত্রসজ্জিত ছিল। সে দেহে ইয়েমেনী বর্ম ও মাথায় পাথরের বিশেষ টুপি পরেছিল। ঐ টুপির উপর বসানো ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। সে আরব যোদ্ধাদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করল :

قـد علمت خيبـر انّى مرحب

شاكي السّـلاح بـطـل مـجرب

إن غـلـب الدهـر فانّى اغلب

و القرن عندى بالدماء مـخضب

খাইবরের দ্বার ও দেয়াল জানে,আমি মারহাব,

আমি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুসজ্জিত যোদ্ধা।

যদি কাল জয়ী হয়ে থাকে,আমিও বিজয়ী,

যে যোদ্ধাই আমার মুখোমুখি হবে,নিজেকে রক্তে করবে রঙিন। 252

হযরত আলীও নিজের সামরিক ব্যক্তিত্ব ও শক্তির প্রতি ইশারা করে শত্রুকে তাঁর সম্পর্কে অবহিত করলেন। তিনি বললেন :

انا الذى سـمتنِى امى حيدرة

ضـرغام آجام ولـيـث قسـورة

عبل الذراعين غليـظ القصرة

كلـيث غابات كـريـه المنـظـرة

আমি ঐ ব্যক্তি,আমার মাতা যার নাম হায়দার (সিংহ) রেখেছেন,

আমি সাহসী যোদ্ধা ও ঝোপের সিংহ।

রয়েছে আমার শক্তিশালী বাহু ও অটল গ্রীবা,

সাহসী সিংহের ন্যায় সবসময় ধ্বংসাত্মক দৃশ্যের প্রতীক্ষায়।

উভয় যোদ্ধা কবিতার মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় দান সমাপ্ত করলেন। ইসলাম ও ইহুদী ধর্মের দুই মহাবীরের অস্ত্র ও বর্শার উপর্যুপরি আঘাতের শব্দ দর্শকদের প্রকম্পিত করল। অকস্মাৎ ইসলামের মহা সমরনায়কের বিদ্যুত বেগের প্রচণ্ড আঘাত মারহাবের মস্তক বিদীর্ণ করল। আঘাতটি তার মাথা,পাথর ও লৌহ শিরস্ত্রাণ ভেদ করে দাঁত পর্যন্ত পৌঁছল। এ আঘাত এতটা ভয়াবহ ছিল যে,মারহাবের পেছনে দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইহুদী যোদ্ধারা ভয়ে দুর্গের ভেতর পালিয়ে গেল। যারা না পালিয়ে আলীর সামনে মোকাবেলার জন্য এলো,সবাই নিহত হলো। তিনি তাদের দুর্গের দ্বার পর্যন্ত ধাওয়া করে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এক ইহুদীর বর্শার আঘাতে আলীর ঢাল হাত থেকে পড়ে গেল। সাথে সাথেই তিনি দুর্গের কপাট টান দিয়ে উপড়ে ফেললেন এবং ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলেন। তারা সবাই পালিয়ে গেলে তা মাটিতে নিক্ষেপ করলেন। আটজন শক্তিশালী মুসলিম যোদ্ধা তা উঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। তাঁদের মধ্যে আবু রাফেও ছিলেন।253 আলীর এই অলৌকিক ভূমিকার কারণে যে দুর্গ দখল প্রক্রিয়া দশ দিনে সম্পন্ন হচ্ছিল না,তা এক ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হলো। ঐতিহাসিক ইয়াকুবী বলেছেন,খাইবরের দরজা পাথরের তৈরি ছিল,যার দৈর্ঘ্য চার মিটারের একটু বেশি এবং প্রস্থ দু মিটারের অধিক ছিল।254

শেখ মুফিদ তাঁর ইরশাদ’ গ্রন্থে বিশেষ সূত্রে স্বয়ং হযরত আলী (আ.) হতে খাইবরের দরজা উপড়ে ফেলার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : আমি খাইবরের দরজা উপড়ে ফেলে তা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। যুদ্ধ শেষ হলে দরজাটিকে ইহুদীরা নিজেদের রক্ষার জন্য যে পরিখা খুঁড়েছিল,তার উপর স্থাপন করলাম পুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। অতঃপর (প্রয়োজন শেষ হলে) তা পরিখার মধ্যে নিক্ষেপ করলাম।” তখন এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করলেন : আপনি তার কোন ওজন অনুভব করেন নি?”   তিনি বললেন : আমার ব্যবহারের ঢালের মতোই ওজন অনুভব করেছি। 255

ইতিহাস ও জীবনী লেখকগণ হযরত আলীর খাইবরের দরজা উপড়ানোর আশ্চর্য ঘটনা এবং ঐ দুর্গ দখলে তাঁর বিরল ভূমিকার বর্ণনা দিয়েছেন। এ কাজগুলো কখনোই সাধারণ মানবীয় শক্তির দ্বারা সম্ভব হয় নি। স্বয়ং হযরত আলী (আ.) এ বিষয় ব্যাখ্যা করে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছেন। তিনি এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে বলেন :

ما قلعتها بقوّة بشرية و لكن قلعتها بقوة الهيّة و نفس بلقاء ربها مطمئنة رضية

“আমি কখনোই মানবীয় শক্তিতে তা উপড়াই নি;বরং খোদায়ী শক্তি ও মহান আল্লাহর সাক্ষাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বলে তা করেছি। 256

সত্যের বিকৃতি

যদিও ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত’ গ্রন্থে এবং আবু জাফর তাবারী তাঁর তারিখ’ গ্রন্থে খাইবরে হযরত আলী (আ.)-এর বিস্ময়কর ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের খুঁটিনাটি প্রতিটি দিক উল্লেখ করেছেন,কিন্তু বর্ণনার শেষে দুর্বল সম্ভাবনা দিয়ে মারহাবের হত্যাকারী মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন : কেউ কেউ বলেছেন,মারহাব মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে নিহত হয়েছিল। কারণ তিনি নায়েম’ দুর্গ দখলের যুদ্ধে নিহত ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং এ প্রতিশোধ গ্রহণে তিনি সফল হন। এ সম্ভাবনা এতটা দুর্বল ও ভিত্তিহীন যে,ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত ইতিহাসের পরিপন্থী। তাবারী ও ইবনে হিশাম এ কল্পনাপ্রসূত ইতিহাস বিশিষ্ট সাহাবী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন257 এবং ঘটনার বর্ণনাকারী এ অসত্য বর্ণনা তাঁর উপর আরোপ করেছেন বলা যায়। কারণ হযরত জাবির প্রায় সকল যুদ্ধেই রাসূল (সা.)-এর সঙ্গী হলেও এ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন নি। উপরন্তু এ ঐতিহাসিক কল্পকাহিনীর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে।

1. মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা কখনোই এত বড় বীর যোদ্ধা ছিলেন না যে,খাইবর দখল করবেন। কারণ ইতিহাসে তার বীরত্বসূচক কোন ভূমিকার কথা কোথাও বর্ণিত হয় নি। বরং এর বিপরীতে তার ভীরুতার ইতিহাস সবার জানা। তৃতীয় হিজরীতে মহানবী (সা.) তাকে অন্যতম প্রধান ইহুদী ষড়যন্ত্রকারী কা ব ইবনে আশরাফকে বদর যুদ্ধের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের নতুনভাবে যুদ্ধে জড়াতে উস্কানীমূলক ভূমিকার কারণে হত্যার নির্দেশ দেন। তিনি দায়িত্ব পেয়ে এতটা ভীত হয়েছিলেন যে,তিন দিন খাদ্য ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। মহানবী (সা.) তার আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত্র চেহারা দেখে সমালোচনা করলে তিনি বলেন : আমি এ কাজ করতে সক্ষম হব কি না সে ভয়ে ভীত।” রাসূল (সা.) তার এ দ্বিধা ও আতঙ্ক লক্ষ্য করে চার ব্যক্তিকে তাঁর সঙ্গে দিলেন এ যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনের চেষ্টাকারীদের হত্যা করতে। তাঁরা মধ্যরাতে কৌশলে এ কাজ সম্পাদনে সক্ষম হন। কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা অন্ধকারে এতটা ভীত ছিলেন যে,শত্রুকে আক্রমণের পরিবর্তে তারই এক সঙ্গীকে আহত করে ফেলেন।258 এমন মানসিক শক্তির ব্যক্তির পক্ষে খাইবরের শ্রেষ্ঠ বীর মারহাবকে হত্যা করা অসম্ভব। তাই এরূপ বর্ণনা অলীক ও কল্পনাপ্রসূত এবং রূপকথার সঙ্গেই তা মানায়!

2. খাইবর বিজয়ী যোদ্ধা শুধু মারহাবের সাথেই যুদ্ধ করেন নি ও তাকে হত্যা করে নি,বরং তিনি তাকে হত্যার পরও কয়েক ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করেছেন। মারহাবকে হত্যার পর যে সকল যোদ্ধা আলীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে,তারা হলো যথাক্রমে দাউদ ইবনে কাবুস,রাবি ইবনে আবিল হাকীক,আবুল বায়েত,র্মারা ইবনে মারওয়ান,ইয়াসির খাইবরী এবং দ্বাজিজ খাইবরী।

এ ছয় ব্যক্তি ইহুদীদের শ্রেষ্ঠ বীরদের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা দুর্গ দখলের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল। তারা নিজেদের বীরত্বগাথা পড়ছিল,আর প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের জন্য আহবান জানাচ্ছিল। তাদের সবাই ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর আলীর হাতে নিহত হয়। যদি মারহাবের হত্যাকারী মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা হতেন,তবে তাকে হত্যার পর তার পক্ষে আর মুসলমানদের ছাউনীতে ফিরে আসা সম্ভব হতো না। কারণ এ ছয় যোদ্ধার সাথে অবশ্যই যুদ্ধ করতে হতো ও তাদেরকে হত্যা করতে হতো। সকল ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে আলীই তাদের হত্যাকারী ছিলেন।

3. এ কাল্পনিক বর্ণনা মহানবী (সা.) থেকে বহুল সূত্রে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী। কারণ মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে যুদ্ধের পূর্বেই বলেছিলেন : এমন ব্যক্তির হাতে পতাকা দেব যার হাতে বিজয় আসবে” এবং পরের দিন আলীর হাতে তা অর্পণ করেন। মুসলমানদের বিজয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ছিল মারহাব দ্বাবিরী এবং তার বীরত্ব ও সাহসিকতার কারণেই পূর্বের দু দিনের সেনাপতিদ্বয় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা তাকে হত্যা করে থাকেন,তবে তাঁর ব্যাপারেই মহানবী (সা.) এ কথা বলতেন,আলীর ব্যাপারে নয়।

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক হালাবী বলেছেন : মারহাব যে আলীর হাতে নিহত হয়েছিলেন,এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তেমনি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে আসির বলেছেন : জীবনী লেখকগণ ও হাদীসবেত্তাগণ আলীকে মারহাবের হত্যাকারী বলেছেন এবং মুতাওয়াতির (যে বর্ণনা এত অধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে,তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই) সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। তাবারী ও ইবনে হিশাম খাইবরের ঘটনায় হযরত আলীর পূর্বে দু জন শীর্ষস্থানীয় সেনাপতির পরাজয় ও পলায়নের ঘটনায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তাই এমনভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন যাতে মহানবী (সা.)-এর বিখ্যাত ও স্মরণীয় ঐ বাণী যে আমীরুল মুমিনীন আলীর ব্যাপারে ছিল,তাতে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।

রাসূল (সা.) বলেছিলেন :و ليس بفرّار অর্থাৎ সে (খাইবর বিজয়ী বীর) কখনোই পলায়ন করবে না। এক্ষেত্রে আলী পূর্ববর্তী দুই সেনাপতির মতো নন। কারণ তারা যুদ্ধের ময়দান খালি করে পালিয়েছিলেন। অথচ এ দুই ঐতিহাসিক ঘটনাটি এমনভাবে বর্ণনা করেছেন,যেন ঐ দুই সেনাপতি তাদের দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছিলেন,তবে সফল হন নি।259

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর গলায় শ্রেষ্ঠত্বের তিন পদক

এ আলোচনা খাইবর জয়ী মহাবীরের তিনটি শ্রেষ্ঠত্বের বিবরণ দিয়ে শেষ করব। একদিন মুয়াবিয়া সা দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসকে এজন্য সমালোচনা করলেন,কেন তিনি আলীর নিন্দা করেন না। সা দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস এর জবাবে বললেন : যখনই আমি আলীর মর্যাদাগুলোর মধ্যে তিনটি মর্যাদার কথা স্মরণ করি,তখনই আমার মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে,যদি ঐ তিনটি মর্যাদার অন্তত একটি আমার হতো। এ তিনটি মর্যাদা হলো :

1. যেদিন (তাবুকের যুদ্ধে গমনের সময়) মহানবী (সা.) মদীনায় তাঁকে নিজের স্থলবর্তী ঘোষণা করে তাঁর উদ্দেশে বললেন : তোমার মর্যাদা আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মর্যাদার ন্যায়;তবে এতটুকু পার্থক্য যে,আমার পর কোন নবী নেই।

2. মহানবী (সা.) খাইবরের দিন বললেন : কালকে এমন ব্যক্তির হাতে পতাকা দেব যাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল ভালোবাসেন। ইসলামের সকল সমরনায়কই সেদিন আকাঙ্ক্ষা করছিলেন এ মর্যাদা তার ভাগ্যে জুটুক। কিন্তু পরদিন মহানবী আলীর হাতে পতাকা দিলেন এবং আলীর অতুলনীয় বীরত্বের কারণে সেদিন আমাদের ভাগ্যে বিজয় জুটেছিল।

3. যেদিন মহানবী (সা.) নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে মুবাহালা260 করলেন,সেদিন আলী,ফাতিমা,হাসান ও হুসাইনকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন :اللهم هؤلاء أهلى অর্থাৎ হে আল্লাহ! এরাই আমার পবিবার। 261