চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74564
ডাউনলোড: 6139


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74564 / ডাউনলোড: 6139
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

যাতুস্ সালাসিলের গায্ওয়া

যেদিন মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরত করেন এবং মদীনাকে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং মুসলমানদের সমাবেশস্থল হিসেবে মনোনীত করেন, সেদিন থেকে তিনি সবসময় শত্রুদের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং তাদের গতিবিধি ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি মুশরিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথার্থ তথ্য লাভ করার ব্যাপারে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ কারণেই তিনি শক্তিশালী, দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণকে বিভিন্ন ছদ্মনামে পবিত্র মক্কার চারপাশে এবং বিভিন্ন গোত্রের মাঝে প্রেরণ করতেন, যাতে করে তাঁরা তাঁকে যথাসময়ে বিরোধী ও ষড়যন্ত্রকারীদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে সতর্ক ও অবহিত করতে পারেন।

এ সব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার ভিত্তিতে তিনি অনেক চক্রান্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতেন এবং শত্রুরা নিজেদের জায়গা থেকে অগ্রসর হওয়ার আগেই স্বয়ং মহানবী বা কোন ঊর্ধ্বতন মুসলিম সেনাপতির নেতৃত্বে ইসলামের মুজাহিদরা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। এর ফলে ইসলাম শত্রুর হুমকি ও বিপদ থেকে নিরাপদ হয়েছে এবং প্রচুর রক্তপাত ও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

আজ শত্রুপক্ষের শক্তি, প্রস্তুতির মাত্রা এবং গোপন নীলনক্শা ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত (গোয়েন্দা) তথ্য বিজয় ও সাফল্যের অন্যতম কার্যকর কারণ বলে গণ্য হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রেরই গুপ্তচর প্রশিক্ষণ, নিয়োগ, (গোয়েন্দা তৎপরতা আঞ্জাম দেয়ার জন্য) প্রেরণ এবং তাদেরকে কাজে লাগানোর বিশাল সংস্থা ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আছে। এ ব্যবস্থার উদ্ভাবক ছিলেন স্বয়ং মহানবী (সা.) এবং তাঁর পরে খলীফাগণ, বিশেষ করে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বিভিন্ন কাজের জন্য বহু গোয়েন্দা নিয়োগ করতেন। তিনি কোন এলাকায় কোন শাসনকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করলে কতিপয় ব্যক্তিকে এ শাসনকর্তার জীবন-যাত্রা এবং সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাঁর আচরণ এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর কাছে গোপনে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দান করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে তিরস্কার করে ইমাম আলী (আ.) যে সব পত্র লিখেছেন321 সেসব এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে।

মহানবী (সা.) হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে আশি জন মুহাজিরকে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহ্শের নেতৃত্বে একটি স্থানে গিয়ে তাঁকে কুরাইশদের গতিবিধি ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করানোর আদেশ দিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) যে উহুদ যুদ্ধে অতর্কিত হামলার শিকার হন নি এবং শক্রদের আগমনের আগেই তিনি মদীনার বাইরে সেনা মোতায়েন করেছিলেন অথবা আহযাবের যুদ্ধে আরব বাহিনীর আগমনের আগে শত্রুদের আগমন পথে পরিখা খনন করিয়েছিলেন- এ সব কিছুই আসলে কতকগুলো নির্ভুল তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এ সব তথ্য মহানবীর সচেতন ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ তাঁর হাতে অর্পণ করতেন এবং এভাবে তাঁরা পতনের হুমকি থেকে তাওহীদী আদর্শ রক্ষা করার ক্ষেত্রে নিজেদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতেন। মহানবী (সা.)-এর বিজ্ঞজনোচিত এ কর্মপদ্ধতি মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। এ মূলনীতির আলোকে ইসলাম ধর্মের মহান নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই ইসলামী বিশ্বের আনাচে-কানাচে যে সব ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত হতে হবে এবং প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবার আগেই (ফিতনার) অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলো নির্বাপিত করতে হবে। যে পথ অবলম্বন করে মহানবী (সা.) উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, তাঁদেরকেও সে পথ অবলম্বন করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে হবে। আর এ কাজ এ কালে পর্যাপ্ত উপায়-উপকরণ ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না।

যাতুস্ সালাসিলের গাযওয়ায় শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথার্থ তথ্যাবলী প্রাপ্তির মাধ্যমে ব্যাপক ফিতনার আগুন নির্বাপিত হয়েছিল। মহানবী (সা.) এ পথ রুদ্ধ করে দিলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতেন।

এ যুদ্ধে মহানবীর গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ গোপনে রিপোর্ট দেন, ওয়াদী ইয়াবিস নামক এক অঞ্চলে হাজার হাজার লোক পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মকে গুঁড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নিজেদের সমুদয় শক্তি ব্যাবহার করে হয় নিজেরা সবাই এ পথে নিহত হবে অথবা মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সাহসী ও বিজয়ী সমরাধিনায়ক আলীকে ধরাশায়ী করবে।

আলী ইবনে ইবরাহীম কুম্মী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেন : ওহীর ফেরেশতা মহানবী (সা.)-কে তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করেন।322 কিন্তু শিয়া বিশ্বের গবেষক আলেম মরহুম শেখ আল মুফীদ বলেন : একজন মুসলমান মহানবী (সা.)-কে এ ধরনের সংবাদ প্রদান করে এবং ওয়াদী আর রামলকে323 এ ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র বলে অভিহিত করে। আর সে আরো জানায় যে, এ গোত্রগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা রাতের বেলা অতর্কিতে মদীনা আক্রমণ করে এ কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করবে।”324

মহানবী (সা.) মুসলমানদের এ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানানো অত্যাবশ্যক মনে করেছিলেন। ঐ সময় নামাযের জন্য জনগণের সমবেত হওয়া বা অতি প্রয়োজনীয় বিষয় শোনার সংকেত ছিলالصّلاة جامعة - এ বাক্য। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে একজন আহবানকারী একটি উঁচু স্থানে উঠে উচ্চকণ্ঠে এ বাক্য উচ্চারণ করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে জনগণ মসজিদে নববীতে সমবেত হন। মহানবী মিম্বারে আরোহণ করে ভাষণে বলেন : আল্লাহর শত্রুরা তোমাদের জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাদেরকে রাতের বেলা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। এ ফিতনা প্রতিহত করার জন্য একদল লোককে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে।” এ সময় একদল লোক এ কাজের জন্য মনোনীত হলেন এবং আবু বকরের ওপর সেনাদলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি সেনাদল নিয়ে বনী সালেম গোত্রের আবাসস্থলের দিকে রওয়ানা হলেন। মুসলিম বাহিনী যে পথ অতিক্রম করল, তা ছিল দুর্গম এবং এ গোত্র এক বিশাল উপত্যকার মাঝে বসবাস করত। মুসলিম সেনাবাহিনী যখন ঐ উপত্যকায় নেমে যেতে চাচ্ছিল, ঠিক তখন তারা বনী সালেম গোত্রের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং সেনাদলের অধিনায়ক যে পথে এসেছিলেন, সে পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেলেন না।325

আলী ইবনে ইবরাহীম লিখেছেন : ঐ সম্প্রদায়ের নেতারা হযরত আবু বকরকে এ সামরিক অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন : আমি মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে ইসলাম ধর্ম উপস্থাপন করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি; যদি আপনারা তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, তা হলে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” ঐ সময় গোত্রের সর্দাররা তাঁর সামনে তাদের অগণিত লোক প্রদর্শন করে তাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে। তিনি ইসলামের মুজাহিদদের যুদ্ধ করার উদ্যম ও স্পৃহা থাকা সত্বেও ফিরে যাবার নির্দেশ দেন এবং সবাই তখন মদীনায় ফিরে যান।

ঐ অবস্থায় মুসলিম সেনাবাহিনীর (মদীনায়) প্রত্যাবর্তন মহানবী (সা.)-কে অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ করেছিল। এবার মহানবী সেনাদলটির নেতৃত্ব হযরত উমরের হাতে অর্পণ করেন। এ সময় শত্রুরা প্রথম বারের চেয়ে আরো বেশি সচেতন ছিল এবং তারা উপত্যকার প্রবেশমুখে পাথর ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। মুসলিম সেনাদল সেখানে প্রবেশ করা মাত্রই তারা তাদের গুপ্ত স্থানগুলো থেকে বের হয়ে এসে বীরত্বের সাথে লড়াই করতে লাগল। তখন সেনাদলটির অধিনায়ক তাঁর সৈন্যদের পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দিলে তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী আরবের ধূর্ত রাজনীতিজ্ঞ আমর ইবনে আস মহানবীর কাছে গিয়ে বলেছিলেন :الحرب خدعة যুদ্ধ হচ্ছে প্রতারণা”; যুদ্ধে বিজয় কেবল বীরত্ব, সাহস ও বাহুবলের মধ্যেই নিহিত নয়; বরং এর একটি অংশ পরিকল্পনা, কৌশল ও পরিচালনা করার দক্ষতার ওপরও নির্ভরশীল। আমি যদি এবার ইসলামের যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিই ও পরিচালনা করি, তা হলে আমি সমস্যার জট খুলতে পারব।” মহানবী (সা.) যদিও কতিপয় কারণে তাঁর অভিমতের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন, তবুও (তাঁকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে) পূর্ববর্তী সেনাপতিদ্বয়ের মতো তিনিও একই ভাগ্য বরণ করতেন।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) সেনা অধিনায়ক মনোনীত

একের পর এক পরাজয় ও বিফলতা মুসলমানদের নিদারুণ যন্ত্রণার সম্মুখীন করেছিল। মহানবী (সা.) শেষ বারের মতো একটি সেনাদল গঠন করে হযরত আলী (আ.)-কে এ বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর হাতে পতাকা দিলেন। আলী (আ.) নিজ ঘরে প্রবেশ করে অত্যন্ত কঠিন মুহূর্তগুলোতে তিনি যে কাপড় মাথায় বাঁধতেন, তা মাথায় বাঁধলেন এবং স্ত্রী হযরত ফাতিমা (আ.)-কে তাঁর মাথায় তা বেঁধে দেয়ার অনুরোধ করলেন। মহানবী (সা.)-এর কন্যা তাঁর প্রিয় স্বামী অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ঙ্কর এক অভিযানে গমন করছেন দেখে খুব কাঁদলেন। মহানবী তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন এবং তাঁর চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিলেন। অতঃপর হযরত আলী (আ.)-এর সাথে আহযাবের মসজিদ পর্যন্ত গিয়ে বিদায় দিলেন। একটি সাদা-কালো বর্ণের ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে দু টি ইয়েমেনী বস্ত্র পরিধান করে এবং ভারতে নির্মিত বর্শা হাতে নিয়ে হযরত আলী (আ.) যাত্রা শুরু করলেন। তিনি তাঁর চলার পথ সম্পূর্ণ পরিবর্তন করলেন যাতে সৈন্যরা মনে করে যে, তিনি ইরাক অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন।أرسلته كرّارا غير فرّار আমি তাকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে যুদ্ধে প্রেরণ করলাম এ কারণে যে, সে হচ্ছে প্রচণ্ড আক্রমণকারী; সে কখনোই যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না’- এ কথা বলে মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বিদায় দিলেন। হযরত আলীর ব্যাপারে মহানবীর এ উক্তি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, পূর্ববর্তী অধিনায়কদ্বয় কেবল পরাজিত হন নি, বরং ইসলামের সামরিক নীতিমালার বিপরীতে তাঁরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন।

এ যুদ্ধে আমীরুল মুমিনীনের বিজয় ও সাফল্যের অন্তর্নিহিত কারণ

হযরত আলী (আ.)-এর বিজয় লাভের মূল কারণকে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে ব্যক্ত করা যায় :

1. তিনি শত্রুপক্ষকে তাঁর যাত্রার ব্যাপারে জানতে দেন নি। কারণ তিনি তাঁর যাত্রাপথ পরিবর্তন করেছিলেন যাতে মরুচারী বেদুইন এবং আশ-পাশের গোত্রগুলো শত্রুদের কাছে তাঁর অগ্রযাত্রার খবর পৌঁছাতে সক্ষম না হয়।

2. তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশল অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষার মূলনীতি পূর্ণরূপে পালন করেছিলেন। তিনি রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনের বেলা কোন স্থানে লুকিয়ে থাকতেন এবং বিশ্রাম নিতেন। উপত্যকার প্রবেশমুখে পৌঁছার আগেই তিনি তাঁর সকল সৈন্যকে বিশ্রাম নেয়ার নির্দেশ দেন। যাতে শত্রুপক্ষ উপত্যকার নিকটে তাঁদের আগমনের কথা জানতে না পারে, সেজন্য তিনি নির্দেশ দেন, সৈন্যরা যেন তাদের ঘোড়াগুলোর মুখ বেঁধে রাখে। এর ফলে শত্রুপক্ষ হ্রেষাধ্বনি শুনতে পারবে না। হযরত আলী (আ.) সাথীদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন এবং সৈন্যদের পাহাড়ের পেছন থেকে পাহাড়ের চূড়ায় এবং সেখান থেকে উপত্যকার ভেতরের দিকে পরিচালনা করেন। শক্তিশালী ও সাহসী মুসলিম সৈনিকগণ একজন সাহসী ও বীর সেনাধিনায়কের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ গতিতে ঘুমন্ত ও নিদ্রালু শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একদলকে বন্দী করেন; আরেকটি দল প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে।

3. আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর অসাধারণ ও অতুলনীয় বীরত্ব : যে সাত জন শত্রুপক্ষীয় বীর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তিনি তাদেরকে ধরাশায়ী করেছিলেন। তিনি শত্রুদের এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন যে, তারা তাদের প্রতিরোধ-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং প্রচুর গনীমত রেখে পলায়ন করেছিল।326

ইসলামের অমিত বীর সেনাপতি অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে পবিত্র মদীনায় ফিরে এলেন। মহানবী (সা.) একদল সাহাবীকে সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মহানবীকে দেখে তৎক্ষণাৎ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। তিনি হযরত আলীর পিঠ চাপড়ে বললেন : তুমি তোমার অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ কর; মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।” এ সময় আলীর দু চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে গিয়েছিল এবং মহানবী হযরত আলীর ব্যাপারে তাঁর ঐতিহাসিক এ উক্তি করেছিলেন :

يا علىّ لولا أنّنِى أشفق أن تقول فيك طوائف من أمّتِى ما قالت النّصاري فِى المسيح لقلت فيك اليوم مقالا لا تمرّ بملاء من النّاس إلّا أخذوا التّراب من تحت قدميك

হে আলী! হযরত ঈসা মসীহের ব্যাপারে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যা বলেছে, আমি যদি আমার উম্মতের মধ্য থেকে কিছু লোক কর্তৃক তোমার ব্যাপারে সেই একই কথা বলার আশংকা না করতাম, তা হলে আমি আজ তোমার ব্যাপারে এমন কথা বলতাম যে, এর ফলে তুমি যেখান দিয়ে যেতে, লোকেরা সেখানে তোমার পায়ের তলা থেকে (বরকত লাভের জন্য) মাটি তুলে নিত।

এ ধরনের আত্মত্যাগ এতটা গুরুত্ববহ ছিল যে, এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা আল আদিয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। এ সূরার অভিনব ও আবেগময় শপথসমূহ এ ঘটনার কুরবানীকারী সৈনিকগণের সামরিক মনোবল ও বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেই উল্লিখিত হয়েছে :

) و العاديات ضبحاً فالموريات قدحاً فالمغيرات صبحاً فأثرن به نقعاً فوسطن به جمعاً(

“ঐসব ধাবমান অশ্বের শপথ! যেগুলো নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হয় এবং পাথরের উপর যেগুলোর খুরাঘাতে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বের হয় ; ভোরের বেলা যেগুলো বিদ্যুৎ চমকানির মতো শত্রুর ওপর আক্রমণ চালায়, দ্রুত গতিতে ধাবমান হওয়ার জন্য বাতাসে ধূলো-মাটি উড়িয়ে দেয় এবং শত্রুদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।”

একটি জিজ্ঞাসার জবাব

তেল শিল্প জাতীয়করণের বছরগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের চরেরা মার্ক্সবাদ ও নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণা প্রচারের জন্য ময়দান যে কোন ধরনের প্রতিন্ধকতা থেকে মুক্ত দেখতে পেয়ে কখনো কখনো ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আপত্তি করার জন্য মুখ খুলত এবং সমালোচনা করত। একদিন তাদের এক সদস্য আমাকে (লেখক) সূরা আল আদিয়াতের আয়াতসমূহে যে সব শপথ (কসম) রয়েছে, সেসবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। তার প্রশ্ন করার বাচনভঙ্গি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, তার দৃষ্টিতে এসব শপথ গুরুত্বহীন। এ কারণেই সে এ প্রশ্ন করার সময় ঠোঁট বাঁকা করে মাথা নাড়িয়ে বলছিল : যে সব অশ্ব হাঁপাচ্ছে, টানা টানা শ্বাস নিচ্ছে এবং পাথরের ওপর যেগুলোর খুরাঘাতে বিদ্যুৎ¯ফুলিঙ্গ ঠিকরে বের হচ্ছে, সেগুলোর নামে শপথ করার কী অর্থ থাকতে পারে? আমি তার এ প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম :“‘ যুদ্ধরত যোদ্ধাদের অশ্বসমূহের শপথ’ অথবা অশ্বসমূহের খুর ও পাথরের মাঝখান থেকে ঠিকরে বের হওয়া বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের শপথ’ আসলে যালেমদের বিরুদ্ধে জিহাদের গুরুত্বকে চিত্রায়িত করে। এই সংগ্রামরত সেনাবাহিনী কেবল কল্যাণপ্রসূ ও মূল্যবানই নয়, বরং তাদের অশ্বগুলো এবং সেগুলোর খুরের তল থেকে ঠিকরে বের হওয়া বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গও পবিত্র; এসব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে মুজাহিদগণ কর্তৃক যালেমদের কোমর ভেঙে দেয়া এবং মানব জাতিকে আগ্রাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার চেয়ে আর কোন্ মূল্যবোধ অধিকতর মহান হবে?

পবিত্র কুরআন এভাবে অর্থাৎ মুজাহিদগণের ঘোড়াগুলো, এগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এবং এগুলোর খুর থেকে নির্গত অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহকে পবিত্র গণ্য করার মাধ্যমে মুমিনদেরকে যে সব লৌহপ্রাচীরের ভেতর জাতিসমূহ বন্দী হয়ে আছে, সেগুলো গুঁড়িয়ে ফেলার জন্য শক্তি সঞ্চয় করার আহবান জানিয়েছে।

মুক্তিদানকারী গোষ্ঠী কেবল নিজেরাই পবিত্র নয়; বরং তাদের অশ্বগুলো, সেগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এবং সেগুলোর খুর থেকে নির্গত অগ্নিস্ফুলিঙ্গও মর্যাদার অধিকারী এবং আজ ঐ অশ্বগুলো দ্রুতগামী মোটরযান এবং অশ্বগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যুদ্ধবিমানের গর্জনকারী শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে এবং মহানবী (সা.)-এর রিসালাতের যুগের হাতিয়ার ও উপায়-উপকরণসমূহের ন্যায় সেগুলোকে পবিত্র ও মর্যাদার আলোকবর্তিকা আচ্ছাদিত করে রেখেছে।327

এটি ছিল সংক্ষেপে যাতুস্ সালাসিলের গাযওয়ার ঘটনা যা শিয়া মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ সহীহ সনদ ও সূত্রে সংরক্ষণ করেছেন। তবে আহলে সুন্নাতের ঐতিহাসিকগণ, যেমন তাবারী328 যাতুস্ সালাসিলের ঘটনা ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন এবং আমরা যা এখানে বর্ণনা করেছি, তার সাথে এ ঘটনার বেশ পার্থক্য আছে। যাতুস্ সালাসিল দু টি যুদ্ধেরও নাম হতে পারে, যেগুলোর প্রতিটি শিয়া-সুন্নী মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক স্বতন্ত্রভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে উভয় পক্ষ একটি ঘটনাই বর্ণনা করেছেন এবং অপর ঘটনা বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছেন।

ঊনপঞ্চাশতম অধ্যায় : অষ্টম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ