চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74555
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74555 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পবিত্র মক্কার রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ

মুসলিম সেনাবাহিনী পবিত্র মক্কার কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে পৌঁছে গেল। মহানবী (সা) প্রতিরোধ ও রক্তপাতের ঘটনা ছাড়াই মক্কা নগরী জয় করতে এবং শত্রুপক্ষকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন।

গোপনীয়তা সংরক্ষণ ও শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার মূলনীতি ছাড়াও এ মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের ব্যাপারে যেসব কারণ সাহায্য করেছিল এবং অনুকূলে কাজ করছিল, সেসবের মধ্যে এটাও ছিল যে, মহানবীর চাচা আব্বাস একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কুরাইশদের কাছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে (কৌশলে) মুসলিম সেনাশিবিরে নিয়ে আসেন। আর আবু সুফিয়ানকে ছাড়া কুরাইশ নেতারা কোন জোরালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারত না।

আবু সুফিয়ান যখন মহানবী (সা.)-এর অভূতপূর্ব মর্যাদা ও গৌরবের সামনে মাথা নত করল এবং ঈমান আনার ঘোষণা দিল, তখন মহানবী মুশরিকদের আরো হতাশাগ্রস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করার ব্যাপারে এ অবস্থার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে চাইলেন। তাই তিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁর চাচা আব্বাস যেন আবু সুফিয়ানকে একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আটকে রাখেন যাতে করে ইসলামের নবগঠিত সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ নিজেদের বড় বড় অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি সহ তার সামনে দিয়ে প্যারেড করে যেতে পারে। এভাবে সে ইসলামের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাবে এবং পবিত্র মক্কায় ফিরে গিয়ে সেখানকার জনগণকে ইসলামের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভয় দেখাবে এবং তাদের মাথা থেকে প্রতিরোধের সকল চিন্তা দূর করে দেবে।

এখন ইসলামী সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের বর্ণনা নিম্নে দেয়া হলো :

1. খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে বনী সালীম গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার দল। তাঁদের দু টি পতাকা ছিল এবং এর একটি ছিল আব্বাস ইবনে মিরদাসের হাতে এবং অন্যটি মিকদাদের হাতে।

2. যুবাইর ইবনে আওয়ামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দু টি ব্রিগেড। তাঁর হাতে একটি কালো পতাকা ছিল। এ দু টি ব্রিগেডের অধিকাংশ যোদ্ধাই মুহাজির ছিলেন।

3. আবু যার গিফারীর নেতৃত্বাধীন বনী গিফার গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত সেনাদল। আবু যারের হাতে এ দলটির পতাকা ছিল।

4. ইয়াযীদ ইবনে খুসাইবের নেতৃত্বে বনী আসলাম গোত্রের চার শ’ যোদ্ধা দ্বারা গঠিত সেনাদল। এ দলের পতাকা ইয়াযীদ ইবনে খুসাইবের হাতে ছিল।

5. বাশার বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন বনী কা ব গোত্রের পাঁচ শ’ যোদ্ধার দল। এ দলের পতাকা বাশার বিন সুফিয়ান বহন করছিলেন।

6. মুযাইনা গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দল। এর তিনটি পতাকা ছিল। এ সব পতাকা নুমান ইবনে মাকরা, বিলাল ইবনুল হারিস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর বহন করছিলেন।

7. জুহাইনাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দল। এর চারটি পতাকা যথাক্রমে মা’বাদ ইবনে খালিদ, নুওয়াইদ ইবনে সাখরা, রা ফে ইবনে মালীস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে বাদর বহন করছিলেন।

8. আবু ওয়াকিদ লাইসীর নেতৃত্বে বনী কিনানাহ্, বনী লাইস ও যামরাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দু টি দল এবং তাদের পতাকা আবু ওয়াকিদ লাইসীর হাতে ছিল।

9. বনী আশজা’ গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার দল, যার দু টি পতাকার একটি মাকাল ইবনে সিনান ও অপরটি নাঈম ইবনে মাসউদের হাতে ছিল।346

এ সেনা ইউনিটগুলো আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে সাথে সাথে হযরত আব্বাসকে সেনা ইউনিটগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করছিল এবং তিনিও বেশ উত্তর দিচ্ছিলেন।

যে বিষয়টি এ সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করেছিল, তা ছিল এই, যখনই আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের সামনে সেনা ইউনিটসমূহের অধিনায়কগণ প্যারেড করে উপস্থিত হচ্ছিলেন, তখনই তাঁরা তিন বার উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিচ্ছিলেন এবং ইউনিটসমূহের সৈনিকরাও অধিনায়কদের তাকবীর দেবার পরপরই সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী স্লোগান হিসেবে তিন বার উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিতে থাকেন। এ তাকবীর পবিত্র মক্কা নগরীর উপত্যকাসমূহে এতটা প্রতিধ্বনিত হয় যে, তা মিত্রদের ইসলাম ধর্মের প্রতি আরো অনুরাগী করে তুলে এবং শত্রুদের অন্তর বিদীর্ণ করে ও তাদেরকে ভয়-ভীতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে।

আবু সুফিয়ান একেবারে ধৈর্যহারা হয়ে এমন এক সেনা ইউনিটকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল যার মাঝে মহানবী (সা.) থাকবেন। তাই তার সামনে দিয়ে প্রতিটি ইউনিট কুচকাওয়াজ করে অতিক্রম করার সময় হযরত আব্বাসকে জিজ্ঞেস করছিল : মুহাম্মদ কি এ ইউনিটের মধ্যে আছেন? তিনি জবাবে বলছিলেন : না।” অবশেষে এক বিশাল সেনাদল যার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার, আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উল্লেখ্য, এ সেনাদলে বর্ম পরিহিত দু হাজার সৈন্য ছিল এবং এক নির্দিষ্ট দূরত্বে অসংখ্য পতাকা সেনাদলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের অধিনায়কদের হাতে ছিল। এ সেনা ইউনিটটির নাম ছিল আল কাতীবাতুল খাদরা’ অর্থাৎ সবুজ ব্রিগেড’ যা আপাদমস্তক সশস্ত্র ও যুদ্ধের উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। এ সেনাদলের সৈন্যদের পুরো দেহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। কেবল তাদের উজ্জ্বল চোখগুলো ছাড়া দেহের আর কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এ সেনাদলের মধ্যে দ্রুতগামী আরবী ঘোড়া ও লাল পশমের উট বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।

মহানবী (সা.) এ সেনাদলের মাঝখানে তাঁর বিশেষ উটের উপর সওয়ার হয়ে পথ চলছিলেন এবং বড় বড় আনসার ও মুহাজির সাহাবী তাঁর চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবী তখন তাঁদের সাথে কথোপকথন করছিলেন।

এ সেনাদলের মর্যাদা ও গৌরব আবু সুফিয়ানকে এতটা ভীত করেছিল যে, সে নিজের অজান্তেই আব্বাসের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল : এ সেনাবাহিনীর সামনে কোন শক্তিই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। আব্বাস! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্রের রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।”

আব্বাস এ কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিরস্কার করে বললেন : আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নবুওয়াত ও রিসালাত; আর পার্থিব শক্তিগুলোর সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই।”

মক্কার পথে আবু সুফিয়ান

এ পর্যন্ত আব্বাস তাঁর ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন এবং আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামরিক শক্তি সম্পর্কে সন্ত্রস্ত করে তোলেন। এ সময় মহানবী আবু সুফিয়ানকে মুক্ত করে দেয়ার মধ্যেই কল্যাণ দেখতে পেলেন। কারণ পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনী প্রবেশ করার আগেই সে সেখানে পৌঁছে সেখানকার অধিবাসীদের মুসলমানদের অস্বাভাবিক শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করবে এবং তাদেরকে সম্ভাব্য মুক্তির পথও দেখাবে। মুক্তির পথ দেখানো ছাড়া কেবল জনগণকে ভয় দেখানোর মাধ্যমে মহানবীর লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না।

আবু সুফিয়ান মক্কা নগরীতে ফিরে গেল। জনগণ- যারা আগের রাত থেকেই তীব্র অস্থিরতা ও ভীতির মধ্যে ছিল এবং তার সাথে পরামর্শ না করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না- তার চারপাশে জড়ো হলো। সে ফ্যাকাসে মুখে কাঁপতে কাঁপতে মদীনার দিকে ইশারা করে জনগণের দিকে তাকিয়ে বলল :

“দুর্নিবার ইসলামী সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ পুরো শহর ঘিরে ফেলেছে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই শহরে প্রবেশ করবে। তাদের অধিনায়ক ও নেতা মুহাম্মদ আমাকে কথা দিয়েছেন, যে কেউ মসজিদ ও পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেবে বা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে অথবা আমার বা হাকীম ইবনে হিযামের ঘরে প্রবেশ করবে, তার জান-মাল সম্মানিত বলে গণ্য হবে এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।”

মহানবী (সা.) শুধু এটুকুকেও পর্যাপ্ত মনে করেন নি। পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করার পর এ তিন ধরনের আশ্রয়স্থল ছাড়াও আবদুল্লাহ্ ইবনে খাসআমীর হাতে একটি পতাকা দিয়ে নির্দেশ দিলেন, যেন তিনি উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন যে, যে কেউ তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবে সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।347

আবু সুফিয়ান এ বাণী ঘোষণা করার মাধ্যমে পবিত্র মক্কার অধিবাসীদের মনোবল এতটা দুর্বল করে দেয় যে, কোন দলের মধ্যে প্রতিরোধ মনোবৃত্তি অবশিষ্ট থাকলেও সার্বিকভাবে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিগত রাত থেকে হযরত আব্বাসের মাধ্যমে যে সব পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়। আর বস্তুবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কুরাইশদের বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজয় একটা সন্দেহাতীত বিষয় হয়ে যায়। জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যে যেখানে পারল সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং পুরো শহর জুড়ে ছুটোছুটি, পলায়ন ও আশ্রয় গ্রহণ চলতে লাগল। এভাবে মহানবী (সা.)-এর প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে ইসলাম ধর্মের প্রধান শত্রু ইসলামী সেনাবাহিনীর অনুকূলে সবচেয়ে বড় সেবাটি আনজাম দিয়েছিল।

ইত্যবসরে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ মক্কাবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছিল এবং তার স্বামীর প্রতি অত্যন্ত অশোভন উক্তি করছিল। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় নি। সব ধরনের চিৎকার আসলে কামারের নেহাইয়ের ওপর মুষ্টিবদ্ধ আঘাতস্বরূপ ছিল। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা, ইকারামাহ্ ইবনে আবী জাহল এবং সুহাইল ইবনে আমরের (হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কুরাইশদের বিশেষ প্রতিনিধি) মতো কতিপয় উগ্রবাদী কুরাইশ নেতা শপথ করল, তারা পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী বাহিনীর প্রবেশে বাধা দেবে। আর একদল মক্কাবাসীও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খোলা তলোয়ার হাতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রথম ইউনিটের প্রবেশের পথে বাধা দেয়।

পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রবেশ

পবিত্র মক্কা নগরীর সড়কসমূহে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করার আগেই মহানবী (সা.) সকল সেনাপতিকে উপস্থিত করে বলেছিলেন : বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের জন্যই হচ্ছে আমার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা। তাই নিরীহ জনগণকে হত্যা থেকে তোমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। তবে ইকরামাহ্ ইবনে আবী জাহল, হাব্বার ইবনে আসওয়াদ, আবদুল্লাহ্ ইবনে সা দ ইবনে আবী সারাহ্, মিকয়াস্ হুবাবাহ্ লাইসী, হুয়াইরিস ইবনে নুকাইয, আবদুল্লাহ্ ইবনে খাতাল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ্, হযরত হামযার ঘাতক ওয়াহ্শী ইবনে হারব, আবদুল্লাহ্ ইবনুয্ যুবাইরী এবং হারিস ইবনে তালাতিলাহ্ নামের দশ জন পুরুষ এবং চার মহিলাকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের হত্যা করতে হবে। উল্লেখ্য, এ দশ ব্যক্তির প্রত্যেকেই হত্যা ও অপরাধ করেছিল বা (ইসলামের বিরুদ্ধে) অতীত যুদ্ধগুলোর আগুন জ্বালিয়েছিল।

এ নির্দেশ সেনাপতি ও সামরিক অধিনায়কগণ তাঁদের নিজ নিজ সকল সৈন্যের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর কাছে মক্কাবাসীদের আত্মিক অবস্থা স্পষ্ট হলেও পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করার সময় তিনি সামরিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সতর্কতামূলক পরিকল্পনা ছিল এরূপ :

সকল সামরিক ইউনিট এক পথে যী তূওয়ায় পৌঁছে। যী তূওয়া একটি উঁচু স্থান, যেখান থেকে পবিত্র মক্কা নগরী, বাইতুল্লাহ্ (কাবা) এবং মসজিদুল হারাম দৃষ্টিগোচর হয়। ঐ সময় মহানবী (সা.) পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি সেনা-ব্রিগেড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। মহানবীর দৃষ্টি পবিত্র মক্কার ঘর-বাড়িগুলোর উপর পড়লে তাঁর দু চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় এবং কুরাইশদের প্রতিরোধ ছাড়াই যে মহান বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মাথা এতটা নত করেন যে, তাঁর পবিত্র শ্মশ্রূ উটের উপর স্থাপিত গদি স্পর্শ করেছিল। তিনি সতর্কতা অবলম্বন স্বরূপ তাঁর সেনাবাহিনীকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন। একটি অংশকে পবিত্র মক্কার উঁচু অংশ দিয়ে এবং আরেকটি অংশকে পবিত্র মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে পরিচালনা করেছিলেন। এতটুকু করেও তিনি ক্ষান্ত হন নি। তিনি শহরগামী সকল সড়ক থেকে বেশ কয়েকটি সেনা ইউনিট শহরের দিকে প্রেরণ করেন। সকল সেনা ইউনিট সংঘর্ষ ছাড়াই পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে এবং ঐ সময় শহরের দ্বারগুলো উন্মুক্ত ছিল। তবে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বাধীন সেনা ইউনিটের প্রবেশপথের দ্বারে ইকরামাহ্ ও সুহাইল ইবনে আমরের প্ররোচনায় এক দল লোক মুসলিম সেনা ইউনিটটির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা তীর নিক্ষেপ ও তরবারি সঞ্চালন করে মুসলিম সেনা ইউনিটটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল। তবে তাদের বারো বা তের জন নিহত হলে প্ররোচণাকারীরা পালিয়ে যায় এবং অন্যরাও পলায়নে বাধ্য হয়।348 আবারও আবু সুফিয়ান এ ঘটনায় নিজের অজান্তেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের অনুকূলে কাজ করেছিল। তখনও ভয়-ভীতি তাকে ঘিরে রেখেছিল এবং সে ভালোভাবে জানত যে, বাধাদান কেবল ক্ষতিই বয়ে আনবে। তাই রক্তপাত এড়ানোর জন্য সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল : কুরাইশ গোত্র! তোমরা তোমাদের জীবন বিপদের সম্মুখীন করো না। কারণ, মুহাম্মদের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধে আসলেই কোন ফায়দা হবে না। তোমরা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজেদের ঘর-বাড়িতে বসে থাক এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও বা মসজিদুল হারাম ও পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নাও। তা হলে তোমাদের জীবন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

আবু সুফিয়ানের এ বক্তব্য কুরাইশদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। তাই একদল কুরাইশ নিজেদের ঘর-বাড়িতে এবং আরেক দল মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছিল।

মহানবী (সা.) আযাখির নামক একটি স্থান থেকে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের সেনা ইউনিটের সৈন্যদের তরবারি পরিচালনায় সৃষ্ট ঝলকানির দ্যূতি-যা তখন উঠা-নামা করছিল,- দেখতে পেলেন এবং সংঘর্ষের কারণ জানতে পেয়ে বললেন :قضاء الله خير মহান আল্লাহর ফয়সালাই সর্বোত্তম।”

মহানবী (সা.)-কে বহনকারী উট পবিত্র মক্কা নগরীর সবচেয়ে উঁচু এলাকা দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে এবং হুজূন এলাকায় মহানবীর চাচা হযরত আবু তালিবের কবরের পাশে এসে থামে। বিশ্রাম করার জন্য এখানে একটি বিশেষ তাঁবু স্থাপন করা হয়। কারো বাড়িতে থাকার জন্য জোর অনুরোধ করা হলেও মহানবী তা গ্রহণ করেন নি।

মূর্তি ভাঙ্গা ও পবিত্র কাবা ধোয়া

যে মক্কা নগরী বহু বছর যাবত শিরক ও মূর্তিপূজার ঘাঁটি ছিল, তা তাওহীদী আদর্শের (ইসলাম) সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এ নগরীর সকল অঞ্চল ইসলামের সৈনিকদের অধিকারে আসে। হুজূন’ নামক স্থানে মহানবী (সা.) তাঁর জন্য খাটানো তাঁবুতে কিছু সময় বিশ্রাম করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে মহান আল্লাহর ঘর (কাবা) যিয়ারত ও তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামের দিকে রওয়ানা হন। তিনি যুদ্ধের পোশাক ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত ছিলেন এবং আনসার ও মুহাজিরগণ খুব মর্যাদার সাথে তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবীর উটের লাগাম মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে ছিল এবং তাঁর চলার পথের দু ধারে মুসলিম ও মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। একদল ক্রোধে ও ভীতিজনিত কারণে হতবাক হয়ে গিয়েছিল এবং আরেক দল আনন্দ প্রকাশ করছিল। মহানবী কতিপয় কারণে উটের পিঠ থেকে নামলেন না এবং উটের পিঠে আরোহণ করেই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন। হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) সামনে স্থিত হয়ে হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ ছোঁয়ার পরিবর্তে তাঁর হাতে যে বিশেষ ছড়ি ছিল, তা দিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে তাকবীর দিলেন।

মহানবী (সা.)-এর চারপাশ ঘিরে প্রদীপের চারপাশে ঘূর্ণনরত পতঙ্গের মতো আবর্তিত সাহাবীগণ মহানবীকে অনুসরণ করে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দিলেন। তাঁদের তাকবীর-ধ্বনি মক্কার মুশরিকদের কানে পৌঁছলে তারা নিজেদের বাড়ি এবং উঁচু এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নিল। মসজিদুল হারামে এক অভিনব শোরগোল প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জনগণের তুমুল হর্ষধ্বনির কারণে মহানবী প্রশান্ত মনে ও চিন্তামুক্তভাবে তাওয়াফ করতে পারছিলেন না। জনগণকে শান্ত করার জন্য মহানবী তাদের দিকে এক ইশারা করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মসজিদুল হারাম জুড়ে সুমসাম নীরবতা নেমে এলো। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন বুকের মধ্যে বন্দী হয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না)। মসজিদুল হারামের ভেতরে ও বাইরে অবস্থানরত জনতার দৃষ্টি তখন তাঁর দিকে নিবদ্ধ ছিল। তিনি তাওয়াফ শুরু করলেন। তাওয়াফের প্রথম পর্যায়েই পবিত্র কাবার দরজার উপর স্থাপিত হুবাল, ইসাফ ও নায়েলা নামের কতিপয় বড় বড় প্রতিমার উপর মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি হাতের বর্শা দিয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত করে ঐ প্রতিমাগুলো মাটিতে ফেলে দিলেন এবং নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন :

) قل جاء الحق و زهق الباطل إنّ الباطل كان زهوقا(

“আপনি বলে দিন : সত্য (গৌরবের সাথে ও বিজয়ী বেশে) প্রকাশিত হয়েছে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা (প্রথম থেকেই) ভিত্তিহীন ছিল।” (সূরা বনী ইসরাঈল)

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে মুশরিকদের চোখের সামনেই হুবালের প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো। এ বড় মূর্তিটি- যা বছরের পর বছর ধরে আরব উপদ্বীপের জনগণের চিন্তা-চেতনার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল,- তাদের চোখের সামনে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। ঠাট্টা করে যুবাইর আবু সুফিয়ানের দিকে মুখ তুলে বললেন : হুবাল- এ বড় প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো।”

আবু সুফিয়ান অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যুবাইরকে বলেছিল : আমাদের থেকে হাত উঠিয়ে নাও তো (অর্থাৎ এ ধরনের কথা আর বলো না)। হুবালের দ্বারা যদি কোন কাজ হতো, তা হলে পরিণামে আমাদের ভাগ্য এমন হতো না।” আর সে বুঝতে পেরেছিল, তাদের ভাগ্য আসলে কখনোই তার হাতে ছিল না।

তাওয়াফ শেষ হলে মহানবী মসজিদুল হারামের এক কোণে একটু বসলেন। তখন পবিত্র কাবার চাবিরক্ষক ছিল উসমান ইবনে তালহা এবং এ পদটি তার বংশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহাল ছিল। মহানবী (সা.) হযরত বিলালকে উসমানের ঘরে গিয়ে পবিত্র কাবার চাবি নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন। বিলাল চাবিরক্ষকের কাছে মহানবীর নির্দেশবার্তা পৌঁছে দিলেন। কিন্তু তার মা তাকে মহানবীর কাছে চাবি হস্তান্তরে বাধা দিল এবং বলল : পবিত্র কাবার চাবি রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের বংশীয় গৌরব এবং আমরা কখনই এ গৌরব হাতছাড়া হতে দেব না।” উসমান মায়ের হাত ধরে নিজের বিশেষ কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলল : আমরা যদি নিজ ইচ্ছায় চাবি না দিই, তা হলে তুমি নিশ্চিত থেকো, বলপ্রয়োগ করে আমাদের থেকে তা নিয়ে নেয়া হবে।”349 চাবিরক্ষক এসে পবিত্র কাবার তালা খুলে দিল। মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পেছনে উসামাহ্ ইবনে যায়েদ ও বিলাল প্রবেশ করলেন এবং স্বয়ং চাবিরক্ষকও প্রবেশ করলো। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে পবিত্র কাবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়ে জনতাকে দরজার সামনে ভীড় করা থেকে বিরত রাখছিলেন। পবিত্র কাবার অভ্যন্তরীণ প্রাচীর নবীগণের চিত্রকলা দিয়ে পূর্ণ ছিল। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে কাবার প্রাচীরগুলো যমযম কূপের পানি দিয়ে ধোয়া হলো এবং কাবার দেয়ালে যে সব চিত্র ছিল, সেগুলো উঠিয়ে এনে ধ্বংস করা হলো।