চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74532
ডাউনলোড: 6136


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74532 / ডাউনলোড: 6136
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মদীনায় গোপন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আবিষ্কৃত

ইসলাম ধর্মের মহান নেতা মহানবী (সা.) তথ্য লাভ করার ব্যাপারে অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং যে সব বিজয় তিনি অর্জন করেছিলেন, সেসবের অর্ধেকই ছিল শত্রু ও ফিতনা সৃষ্টিকারীদের অবস্থা সংক্রান্ত তাঁর তথ্য লাভ করার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ কারণেই তিনি বহু শয়তানী অপকর্ম ও ইসলাম বিরোধী উস্কানি অঙ্কুরেই নস্যাৎ করে দিতেন।

মহানবী (সা.)-এর কাছে একটি গোপন গোয়েন্দা তথ্য আসে, ইহুদী সুওয়াইলিমের বাড়ি ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং মুনাফিকরা সেখানে জড়ো হয়ে মুসলমানদের জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার নীলনকশা প্রণয়ন করছে। ষড়যন্ত্রকারীরা, যারা আবারও নিজেদের মস্তিষ্কে এ ধরনের শয়তানী চিন্তা শুরু করেছিল, তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য মহানবী (সা.) তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে একদল সাহসী সঙ্গী নিয়ে গোপন বৈঠক শুরু হওয়ার সময় ঐ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মনে তীব্র ভীতি সৃষ্টি করার দায়িত্ব দেন। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন পরস্পর কথোপকথন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নীলনকশা প্রণয়নে মশগুল ছিল, ঠিক তখনই তিনি তাদেরকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে ঐ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। তাদের সবাই তখন আগুনের প্রজ্বলিত লেলিহান শিখার মধ্যে পালিয়ে যায় এবং পালানোর সময় তাদের এক ব্যক্তির পা ভেঙে যায়। এ কাজ এতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল যে, তা পরবর্তীকালে মুনাফিক গোষ্ঠীর জন্য এক বিরাট শিক্ষায় পরিণত হয়েছিল।413

3. ক্রন্দনকারী দল : এ পবিত্র জিহাদে অংশগ্রহণের তীব্র আগ্রহ পোষণকারী মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁদের পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য তাঁর কাছে সফর করার বাহন চাইলেন। কিন্তু তাঁরা যখন মহানবীর পক্ষ থেকে না সূচক জবাব পেলেন এবং যেহেতু মহানবীর হাতে এমন কোন বাহন ছিল না, যার উপর চড়ে তাঁরা জিহাদে গমন করবেন, সেহেতু তাঁরা ভীষণভাবে কাঁদতে লাগলেন এবং তাঁদের মুখমণ্ডলের উপর দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং (খোঁড়া) অজুহাত পেশকারী ব্যক্তিরা থেকে থাকলেও তাদের বিপরীতে এমন সব ব্যক্তিও ছিলেন, যাঁরা জিহাদ- যা কখনো কখনো তাঁদের শাহাদাতের কারণ হতো,- তাতে অংশগ্রহণ করতে না পারার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন এবং তাঁদের মুখমণ্ডল বেয়ে অশ্রু ঝরত। ইতিহাসের ভাষায় এ গোষ্ঠীকে বাকবাইন’ অর্থাৎ ক্রন্দনকারীরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনেও তাঁদের দৃঢ় ঈমান প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে :

) و لا علي الّذين إذا ما أتوك لتحملهم قلت لا أجد ما أحملكم عليه تولّوا و أعينهم تفيض من الدّمع حزنا ألّا يجدوا ما يُنفقون(

“আর যারা আপনার কাছে এসেছিল এ উদ্দেশ্যে যে, আপনি তাদের হাতে কোন সওয়ারী পশু বা বাহন অর্পণ করবেন এবং আপনিও যখন তাদেরকে বললেন যে, আমার হাতে এমন কোন সওয়ারী পশু বা বাহন নেই, যার উপর তোমাদেরকে বসিয়ে আমি নিয়ে যাব; আর মহান আল্লাহর পথে (জিহাদে) ব্যয় করার মতো তেমন কোন অর্থ বা সম্পদ তাদের হাতে না থাকার দুঃখে তারাও আপনার কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরে গেল, তখন তাদের ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই।” (সূরা তাওবা : 92)

4. ফসল সংগ্রহকারীরা : কা ব, হিলাল ও মুরারার মতো আরো কিছুসংখ্যক ব্যক্তি দীন ইসলাম ও জিহাদের ব্যাপারে পুরোপুরি আগ্রহ থাকা সত্বেও যেহেতু তখনো তারা (ক্ষেত থেকে) ফসল সংগ্রহ করেন নি, সেহেতু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ফসল উঠানোর পর মদীনা থেকে বের হয়ে রণাঙ্গনে ইসলামের মুজাহিদগণের সাথে যোগ দেবেন। তারা পবিত্র কুরআনের ভাষায়414 অমান্যকারী ঐ তিন ব্যক্তি যাঁদেরকে মহানবী (সা.) তাবুক থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেছিলেন, যা অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিল।

5. আত্মোৎসর্গকারী দল : তাঁরা ছিলেন ঐ সব ব্যক্তি, যাঁরা সফরের উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম যোগাড় হয়ে যাওয়ার পর (জিহাদের উদ্দেশ্যে) যাত্রা করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন এবং এ পথে তাঁরা কোন কিছু পরোয়া করেন নি।

এ যুদ্ধে অংশগ্রহণে হযরত আলী (আ.)-এর বিরত থাকা

হযরত আলী (আ.)-এর অন্যতম গৌরব ও কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে, তিনি সকল যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে থেকেছেন এবং একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া সকল ইসলামী যুদ্ধে তাঁর পতাকা বহন করেছেন। মহানবীর নির্দেশে তিনি মদীনায় থেকে যান এবং এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। কারণ মহানবী ভালোভাবেই জানতেন, মুনাফিক চক্র এবং কতিপয় কুরাইশ তাঁর অনুপস্থিতিতে অবস্থা পরিবর্তন করে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমতের পতন ঘটানোর সুযোগ সন্ধান করবে এবং এ সুযোগ তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন মহানবী এবং তাঁর সাহাবীগণ মদীনা থেকে দূরে যাবেন এবং কেন্দ্রের সাথে তাঁদের যোগাযোগ থাকবে না।

তাবুক ছিল (মদীনা থেকে) সবচেয়ে দূরবর্তী স্থান যেখানে মহানবী (সা.) সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য গমন করেছিলেন। তিনি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠীগুলো পরিস্থিতি পরিবর্তন করে দেবে এবং হিজাযের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের সমমনা লোকদের জড়ো করে সংগঠিত হবে। তিনি মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমকে মদীনায় তাঁর স্থলবর্তী নিযুক্ত করা সত্বেও হযরত আলীকে বলেছিলেন : তুমি আমার আহলে বাইত ও নিকটাত্মীয় এবং মুহাজিরদের তত্ত্বাবধায়ক এবং এ কাজের জন্য একমাত্র আমি এবং তুমি ছাড়া আর কেউ উপযুক্ত নয়।

মদীনায় আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর উপস্থিতি ষড়যন্ত্রকারীদের খুব অসন্তুষ্ট করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, তাঁর উপস্থিতি এবং সার্বক্ষণিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের কারণে তারা তাদের নীল-নকশা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ কারণেই যাতে হযরত আলী মদীনা নগরী ত্যাগ করেন সেজন্য তারা একটি ফন্দি আঁটে এবং প্রচার করে যে, যদিও মহানবী (সা.) পূর্ণ ইচ্ছা সহকারে হযরত আলীকে জিহাদে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়েছিলেন, কিন্তু পথ অনেক দীর্ঘ হওয়া ও প্রচণ্ড গরম পড়ার কারণে আলী এ পবিত্র জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। হযরত আলী (আ.) মুনাফিকদের এ মিথ্যা অপবাদ খণ্ডনের জন্য মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করেন। মহানবী (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক উক্তি- যা মহানবীর পরপরই হযরত আলীর প্রত্যক্ষ ইমামত ও খিলাফত অর্থাৎ ইমাম ও খলীফা হবার বিষয়টির সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণসমূহের অন্তর্ভুক্ত,-ব্যক্ত করেছিলেন :

“ভাই আমার, তুমি মদীনায় ফিরে যাও। কারণ আমি ও তুমি ছাড়া আর কেউ মদীনার সার্বিক বিষয় ও পরিস্থিতি রক্ষার জন্য উপযুক্ত নয়। তুমি আমার আহলে বাইত ও নিকটাত্মীয়দের মাঝে আমার প্রতিনিধি...। তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, মূসার কাছে হারুন যেমন ছিলেন, তুমিও আমার কাছে তেমনই হবে; তবে পার্থক্য এই যে, আমার পর কোন নবী নেই (অর্থাৎ যেমনভাবে হারুন মূসার প্রত্যক্ষ স্থলবর্তী ছিলেন, তেমনি তুমিও আমার পর আমার স্থলবর্তী ও খলীফা)।415

তাবুকের দিকে ইসলামী সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা

মহানবী (সা.)-এর কর্মপদ্ধতি এই ছিল যে, যে গোষ্ঠী ইসলামের অগ্রগতি ও প্রসারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত বা আক্রমণ ও ধ্বংসসাধন করার ইচ্ছা এবং অন্য কোন অসদুদ্দেশ্য পোষণ করত, তাদেরকে দমন করার অভিযানে যাত্রার সময় তিনি তাঁর সৈন্য ও সেনাপতিদের কাছে নিজ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করতেন না এবং সেনাবাহিনীকে প্রধান যাত্রাপথ বা মহাসড়কের উপর দিয়ে না নিয়ে শাখা-সড়ক পথে (রণাঙ্গনের দিকে) পরিচালনা করতেন। আর এভাবে তিনি শত্রুপক্ষকে তাঁর যাত্রা সম্পর্কে আঁচ করতে দিতেন না এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে হতভম্ব করে ফেলতেন।416

ইসলামী ভূ-খণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার জন্য শাম-সীমান্তে সমবেত রোমীয়দেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেবার ব্যাপারে তিনি যেদিন সর্বসাধারণের মধ্যে যুদ্ধপ্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেদিন থেকেই তিনি নিজ লক্ষ্য ও গন্তব্যস্থল সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছিলেন এবং এভাবে তিনি চেয়েছিলেন যে, মুজাহিদরা জিহাদের সফরের গুরুত্ব ও তা যে কষ্টকর, সে ব্যাপারে জ্ঞাত থাকেন এবং এ অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদপত্র নিজেদের সাথে নেন।

এছাড়াও ইসলামী সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য মহানবী নিরুপায় হয়ে মদীনা থেকে বহু দূরে বসবাসরত তামীম, গাতফান ও তাঈ গোত্রের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি উল্লিখিত গোত্রগুলোর সর্দারদের কাছে বেশ কিছু পত্র লিখেছিলেন এবং পবিত্র মক্কা নগরীর তরুণ শাসনকর্তা উত্তাব ইবনে উসাইদের কাছেও পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ঐ সব গোত্রের লোকদেরকে এবং পবিত্র মক্কার যুবকদের এ পবিত্র জিহাদে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়েছিলেন।417 আর কখনোই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গোপন রেখে এ ধরনের সাধারণ আহবান বাস্তবায়ন মোটেই সম্ভব নয়। কারণ পুরো ব্যাপারটা গোত্রের সর্দারদের কাছে উত্থাপন করে তাদেরকে গুরুত্ব অনুধাবন করানো অত্যাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল, যাতে তারা তাদের লোকদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদপত্র অর্পণ করে।

মহানবী (সা.)-এর সামনে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ ও সামরিক মহড়া

ইসলামী সেনাবাহিনীর রণাঙ্গনের উদ্দেশে যাত্রার সময় হয়ে এল। মহানবী (সা.) সেদিন মদীনার সেনা সমাবেশকেন্দ্রে ইসলামী বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। একদল ঈমানদার ও আত্মত্যাগী ব্যক্তি- যাঁরা সুশীতল ছায়ায় আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করার ওপর লক্ষ্য অর্জনের পথে কষ্ট সহ্য করা ও মৃত্যুবরণকে অগ্রাধিকার প্রদান করে আবেগ-উদ্দীপনা সহকারে ও ঈমানে পরিপূর্ণ অন্তর নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিলেন,- সত্যিই তাঁদের কুচকাওয়াজের জাঁকালো দৃশ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল এবং তা দর্শকদের মন-মানসিকতার ওপর অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

মালিক ইবনে কাইসের ঘটনা

ইসলামী সেনাবাহিনীর রণাঙ্গন যাত্রার পর যেদিন আবহাওয়া খুবই উষ্ণ ছিল, সেদিন মালিক ইবনে কাইস (আবু খাইসামাহ্) সফর শেষে মদীনায় ফিরে আসেন। মদীনা শূন্য দেখে তিনি ইসলামী সেনাদলের রণাঙ্গন যাত্রার ব্যাপারে অবহিত হন। এ সময় তিনি তাঁর বাগানবাড়িতে প্রবেশ করে তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে দেখতে পান, সে বাগানের মাঝখানে তাঁর জন্য একটি শামিয়ানা খাটিয়ে রেখেছে। তিনি স্ত্রীর সুশ্রী মুখমণ্ডলের দিকে একটু তাকালেন এবং তাঁর জন্য যে খাবার ও পানীয় প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন! তিনি এ সময় মহানবী (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ- যাঁরা এ উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর পথে মৃত্যু ও জিহাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন- তাঁদের করুণ অবস্থার কথা কিছুটা চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি খাদ্য-পানীয় ও শামিয়ানা ব্যবহার করবেন না এবং একটি সওয়ারী পশুর উপর আরোহণ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুজাহিদগণের সাথে যোগ দেবেন। এ কারণে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন : এটা কখনই ন্যায়সঙ্গত আচরণ নয় যে, আমি আমার স্ত্রীর সান্নিধ্যে শামিয়ানার নিচে আরামে বিশ্রাম করব, উপাদেয় খাবার খাব এবং শীতল ও সুপেয় পানি পান করব, আর আমার নেতা প্রখর রোদের মধ্যে জিহাদের ময়দানের দিকে যেতে থাকবেন। না, এ কাজ ইনসাফ, মৈত্রী ও বন্ধুত্বের নীতি থেকে অনেক দূরে। ঈমান ও ইখলাস (নিষ্ঠা) আমাকে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হবার অনুমতি দেয় না।” এ কথা বলেই তিনি সামান্য পাথেয় নিয়ে বের হয়ে গেলেন এবং পথিমধ্যে ইসলামী সেনাবাহিনী থেকে পিছিয়ে পড়া আমর ইবনে ওয়াহাবের সাথে মিলিত হলেন। আর মহানবী (সা.) যখন তাবুক এলাকায় প্রবেশ করলেন তখনই তাঁরা দু জন তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন।418

এই ব্যক্তি শুরুতে মহানবী (সা.)-এর সাথে একত্রে জিহাদের ময়দানে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন না করলেও পরিণতিতে প্রশংসনীয় আত্মত্যাগের কারণে নিজেকে সৌভাগ্যের কোলে সঁপে দিতে পেরেছিলেন। তিনি কখনোই ঐ গোষ্ঠীর মতো ছিলেন না, যাদের দোরগোড়ায় সৌভাগ্য এসে উপস্থিত হওয়া সত্বেও যোগ্যতা না থাকার কারণে নিজেদের সৌভাগ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে দুর্ভাগ্য কবলিত করে এবং নিজেদের পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করে।

উদাহরণস্বরূপ, মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই মহানবীর সেনা সমাবেশকেন্দ্রে মহানবীর সাথে এ জিহাদে যোগদানের জন্য তাঁবু স্থাপন করেছিল। কিন্তু সে অপবিত্র ও ইসলাম ধর্মের শত্রু ছিল বিধায় সেনাবাহিনীর রণাঙ্গনে যাত্রার মুহূর্তে সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য নিজ লোকজন সহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। মহানবী (সা.) তার নিফাক (কপটতা) সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন এবং জিহাদে তার যোগদান তেমন কল্যাণকর মনে করেন নি বলে তার এহেন আচরণের ব্যাপারে মোটেই গুরুত্ব দেন নি।

সফরের কষ্ট

মদীনা থেকে তাবুক যাত্রার পথে ইসলামী সেনাবাহিনী প্রভূত কষ্টের শিকার হয়েছিল। এ কারণেই এ সেনাবাহিনীর নামকরণ করা হয়েছিল জাইশুল উসর’ অর্থাৎ কষ্ট ও দুর্ভোগের সেনাবাহিনী । তাদের ঈমান ও আগ্রহ তাদের এ সব কষ্ট সহজ করে দিয়েছিল। ইসলামী বাহিনী সামূদ জাতির ভূ-খণ্ডে উপনীত হলে তপ্ত হাওয়া প্রবাহিত হওয়ার কারণে মহানবী (সা.) একটি কাপড় দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে রেখেছিলেন এবং তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর-বাড়ি ও জনপদ দ্রুত অতিক্রম করেছিলেন। তখন তিনি সঙ্গী-সাথীগণকে বলেছিলেন : নাফরমানীর জন্য মহান আল্লাহর শাস্তিপ্রাপ্ত সামূদ জাতির শেষ পরিণতি সম্পর্কে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করবে এবং তোমাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, কোন ঈমানদারেরই নিশ্চিত হওয়া অনুচিত যে, তার শেষ পরিণতি সামূদ জাতির মতো হবে না।” এ ভূ-খণ্ডে বিরাজমান মৃত্যুপুরীর নীরবতা, ধ্বংসপ্রাপ্ত ও গভীর নীরবতার মধ্যে নিমজ্জিত বিরান এ ঘর-বাড়িগুলো অন্যান্য জাতির জন্য দৃষ্টান্ত, শিক্ষা, সতর্কবাণী ও উপদেশে পরিণত হয়েছে।

অতঃপর তিনি নির্দেশ দিলেন, ইসলামী সেনাবাহিনী যেন এ ভূ-খণ্ডের পানি পান না করে এবং তা দিয়ে খাবার ও রুটি প্রস্তুত না করে। আর যদি তারা এ স্থানের পানি দিয়ে কোন খাবার তৈরি বা আটা খামীর করে থাকে, তা হলে তারা যেন তা চতুষ্পদ জন্তুদের দিয়ে দেয়।

ইসলামী বাহিনী এ নির্দেশ লাভ করার পর মহান নেতার নেতৃত্বে পথ চলা অব্যাহত রাখে। রাতের একটি অংশ অতিবাহিত হলে তারা একটি কূপের কাছে পৌঁছে। উল্লেখ্য, হযরত সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী এ কূপ থেকে পানি পান করত। মহানবী (সা.) সবাইকে সেখানে যাত্রা-বিরতি ও অবতরণ করে বিশ্রাম নেয়ার নির্দেশ দেন।

সতর্কতামূলক নির্দেশাবলী

মহানবী (সা.) ঐ ভূ-খণ্ডের মারাত্মক দূষিত রায়ু ও প্রবল ঝড়- যা কখনো কখনো মানুষ ও উটকে উড়িয়ে নিয়ে বালুর স্তূপের নিচে চাপা দিত,- সম্পর্কে পূর্ণরূপে জ্ঞাত ছিলেন। সেজন্য তিনি সকল উটের হাঁটু বেঁধে রাখার নির্দেশ দেন এবং রাতের বেলা কাউকে বিশ্রামের স্থান থেকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও প্রমাণিত হয়েছিল, মহানবী (সা.)-এর এ সব সতর্কতামূলক নির্দেশ অত্যন্ত কল্যাণকর ছিল। কারণ বনী সায়েদা গোত্রের দু ব্যক্তি নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের বিশ্রামাগার থেকে রাতের বেলা বের হলে প্রচণ্ড মরুঝড়ে একজন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং আরেকজনকে তা পাহাড়ের বুকে নিক্ষেপ করে। মহানবী (সা.) ঘটনাটা জানতে পারলেন এবং ঐ দু ব্যক্তির নির্দেশ লঙ্ঘন এবং মৃত্যু তাঁকে খুব ব্যথিত করে।419

ইসলামী বাহিনীর নিরাপত্তা সংরক্ষণের দায়িত্বভার প্রাপ্ত একটি সেনাদলের420 অধিনায়ক আব্বাদ ইবনে বশীর মহানবীকে রিপোর্ট প্রদান করলেন, ইসলামী মুজাহিদরা তীব্র পানি সংকটের মধ্যে পড়েছে এবং তাদের জমাকৃত পানি প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ কারণে কতিপয় লোক মূল্যবান উট যবেহ করে পেটের ভেতরে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করছে এবং কেউ কেউ মহান আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করে জ্বলন্ত হৃদয় নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে মুক্তির জন্য প্রতীক্ষা করছে।

যে স্রষ্টা মহানবীকে সাহায্য ও বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তিনি আবারও তাঁকে ও তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী-সাথীগণকে সাহায্য করলেন। প্লাবনের মতো মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হলো এবং তা সবার পানির তৃষ্ণা মিটিয়ে দিল। রসদপত্র সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এবং সৈন্যরা সবাই নিজেদের ইচ্ছা মতো পানি সংগ্রহ করলেন।