চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74547
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74547 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মহানবী (সা.)-এর গায়েব সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্য

এতে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই যে, পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট কালাম421 অনুসারে মহানবী (সা.) গায়েব অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালের জগৎ সম্পর্কে খবর দিতে এবং পর্দার অন্তরালের রহস্যাবলী- যা মানব জাতির কাছে গোপন রয়েছে,- সেগুলো উন্মোচন করতে সক্ষম ছিলেন। তবে মহানবীর এ জ্ঞান সীমিত ছিল এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ কারণেই এটা সম্ভব যে, কখনো কখনো সবচেয়ে সরল বিষয় সম্পর্কে তাঁর কোন তথ্য জানা নাও থাকতে পারে, যেমন কখনো কখনো তিনি ঘরের চাবি বা টাকা-পয়সা হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং কোথায় তা রেখেছেন বা হারিয়েছেন, তা তাঁর জানা নাও থাকতে পারে। আবার কখনো কখনো তিনি সবচেয়ে জটিল ও দুর্বোধ্য গায়েবী বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে বিশ্ববাসীদের বুদ্ধিমত্তাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিতেও সক্ষম। মহান আল্লাহ্ ইচ্ছা করলেই তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালের বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাপন করবেন। আর তা না হলে সাধারণ মানুষের মতো তাঁরও কোন তথ্য থাকবে না।422

পথিমধ্যে মহানবী (সা.)-এর উট হারিয়ে যায়। মহানবীর একদল সাহাবী সেই উটের খোঁজে বের হন। তখন এক মুনাফিক দাঁড়িয়ে বলেছিল : তিনি বলেন : আমি মহান আল্লাহর নবী এবং আমি ঊর্ধ্বজগতের তথ্য প্রদান করি। অথচ এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, নিজের উট কোথায় আছে, তা তিনি জানেন না! এ কথা মহানবীর কানে পৌঁছায়। তিনি একটি বলিষ্ঠ ভাষণ প্রদান করে সত্য উন্মোচন করে বলেছিলেন :

و انى و الله ما اعلم الا ما علمنى الله و قد دلنى الله عليها وهي من هذا الوادي فى شعب كذا قد حبستها شجرة بزمامها فانطلقوا حتى تأتونى بها

-মহান আল্লাহর শপথ! তিনি যা আমাকে শিখিয়েছেন, কেবল তা-ই আমি জানি। এখন মহান আল্লাহ্ আমাকে উষ্ট্রীটি কোথায় আছে দেখিয়েছেন। উষ্ট্রীটি এ মরু এলাকার অমুক উপত্যকায় আছে এবং ওটার রশি একটি গাছের সাথে জড়িয়ে গেছে এবং এর ফলে সে আর হাঁটতে পারছে না। তোমরা ওখানে গিয়ে উষ্ট্রীটিকে নিয়ে এস।423 তৎক্ষণাৎ কয়েকজন লোক যে স্থানটির ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, সেখানে গেলেন এবং তিনি যেভাবে বলেছিলেন, ঠিক সেভাবে তাঁরা উষ্ট্রীটিকে পেয়েছিলেন।

গায়েবী জগৎ সম্পর্কে আরেক তথ্য প্রদান

হযরত আবু যার গিফারী (রা.)-এর উট পথ চলা বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে তিনি ইসলামী সেনাবাহিনী থেকে পিছে পড়ে যান। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন এবং ভাবলেন, সম্ভবত উটটি দাঁড়িয়ে যাবে এবং আবার তা পথ চলা শুরু করবে। কিন্তু তাঁর অপেক্ষায় কোন ফল হলো না। এ কারণে তিনি উটটিকে ঐ স্থানে ফেলে রেখে সফরের সাজ-সরঞ্জাম পিঠে নিয়ে পথ চলা শুরু করলেন, যাতে তিনি যত শীঘ্র সম্ভব মুসলিম বাহিনীর সাথে মিলিত হতে পারেন। ইসলামী বাহিনী মহানবীর নির্দেশে বিশ্রামের জন্য একটি স্থানে যাত্রাবিরতি করে। হঠাৎ অত্যন্ত ভারী বোঝা পিঠে নিয়ে পথ চলা এক ব্যক্তির মুখমণ্ডল দূর থেকে পরিদৃষ্ট হলো। একজন সাহাবী মহানবীকে এ ঘটনা জানালে তিনি বলেছিলেন : সে আবু যার; মহান আল্লাহ্ আবু যারকে ক্ষমা করুন; সে একাকী পথ চলে, একাকী মৃত্যুবরণ করবে এবং একাকী পুনরুত্থিত হবে।

ভবিষ্যৎ অর্থাৎ পরবর্তী যুগ বা বছরগুলোয় মহানবী (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণরূপে বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তিনি জনবসতি থেকে দূরে অবস্থিত রাবযার মরুপ্রান্তরে নিজ কন্যার পাশে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় ইন্তেকাল করেছিলেন।424

তাবুক যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)-এর প্রদত্ত এ ভবিষ্যদ্বাণী দীর্ঘ 23 বছর পর বাস্তবায়িত হয়েছিল। স্বাধীনচেতা-মুক্তমনা ও বেহেশতী ব্যক্তি সত্য বলা এবং জনগণকে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করার আহবান জানানোর অপরাধে রাবযা’ এলাকায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। সেখানে ধীরে ধীরে তিনি দৈহিক শক্তি ও স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলেন এবং তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করা কালে তাঁর স্ত্রী তাঁর নূরানী মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তীব্র দুঃখ ও কষ্ট সহকারে কাঁদছিলেন এবং স্বামীর কপালের ঘামের বিন্দুগুলো মুছে দিচ্ছিলেন। হযরত আবু যার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কেন কাঁদছ? স্ত্রী উত্তর দিলেন : এ কারণে কাঁদছি যে, আপনি এখন মারা যাবেন এবং যে কাপড় দিয়ে আপনাকে কাফন দেব, তা আমার কাছে নেই।”

দিকচক্রবাল রেখার উপর অস্তগামী সূর্যের মতো অতি কষ্টে স্মিত হাসির রেখা হযরত আবু যারের ওষ্ঠদ্বয়ের উপর ফুটে উঠল। তিনি বললেন : শান্ত হও। কেঁদো না। একদিন আমি মহানবী (সা.)-এর কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সান্নিধ্যে বসেছিলাম। মহানবী আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন : তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি এক মরু এলাকায় একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে এবং একদল মুমিন তাকে দাফন করবে।

ঐ সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সবাই জনগণের মাঝে জনপদে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন আমি ছাড়া তাঁদের মধ্যেকার আর কোন ব্যক্তিই জীবিত নেই। তাই আমি নিশ্চিত, মহানবী (সা.) যে ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেই ব্যক্তিটি আমি। আমার মৃত্যুর পর ইরাকের হাজীদের যাত্রাপথে বসে থাকবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে একদল মুমিন আসবে। তখন তাদেরকে আমার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করবে।

হযরত আবু যারের স্ত্রী বললেন : এখন হজ্ব কাফিলাসমূহের গমনাগমনের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।” হযরত আবু যার তখন বললেন : তুমি রাস্তার উপর লক্ষ্য রাখবে। মহান আল্লাহর শপথ! না আমি মিথ্যা বলছি আর না আমি মিথ্যা শুনেছি।” এ কথা বলার পরপরই হযরত আবু যারের প্রাণপাখি ঊর্ধ্বলোকের বেহেশতের দিকে পাখা মেলে উড়ে যায়।425

হযরত আবু যার সত্য বলেছিলেন। মুসলমানদের একটি কাফিলা দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে আসছিল, যাঁদের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, হুজর ইবনে আদী ও মালিক আশতারের মতো বড় বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ দূর থেকে এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখতে পেলেন। একটি নিস্প্রাণ দেহ রাস্তার পাশে পড়ে আছে এবং তার কাছে একজন মহিলা ও একটি ছোট ছেলে কাঁদছে।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ ঐ দু জনের কাছে গিয়ে লাগাম টেনে সওয়ারী পশুকে থামালে কাফিলার অন্যান্য সদস্যও তাঁকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ যখনই ঐ মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তখনই তাঁর দৃষ্টি তাঁর দীনী ভাই ও বন্ধু আবু যারের উপর স্থির হয়ে গেল।

তাঁর নয়নযুগল অশ্রুসজল হয়ে গেল। তিনি আবু যারের পবিত্র লাশের কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং তাবুক যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে বললেন : মহানবী (সা.) সত্য বলেছিলেন : তুমি একাকী পথ চলবে, একাকী মৃত্যুবরণ করবে এবং একাকী কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত হবে।426

অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ হযরত আবু যারের জানাযার নামায পড়লেন।427 এরপর তাঁর লাশ দাফন করা হয়। লাশ দাফন শেষ হলে মালিক আশতার তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন :

“হে প্রভু! এ আবু যার মহানবী (সা.)-এর সাহাবী ছিলেন, যিনি জীবনভর আপনার ইবাদত-বন্দেগী করেছেন; আপনার পথে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন এবং কখনই তিনি সত্য ধর্ম অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নিজ আদর্শ, পথ ও পদ্ধতি পরিবর্তন করেন নি। তবে তিনি মুখের ভাষা ও অন্তর দিয়ে দুর্নীতি, অসৎ ও মন্দ কাজের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন বলে অত্যাচারিত, বঞ্চিত, অপদস্থ এবং নির্বাসিত হয়েছিলেন এবং অবশেষে বিদেশ-বিভূঁইয়ে নির্বাসনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।”

তাবুক অঞ্চলে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রবেশ

তাওহীদী বাহিনী হিজরতের নবম বর্ষের শাবান মাসের শুরুতে তাবুক অঞ্চলে প্রবেশ করে। তবে রোমান বাহিনীর কোন চিহ্ন তারা সেখানে দেখতে পেল না, যেন রোমের নেতৃবৃন্দ ইসলামের সৈনিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের অতুলনীয় সাহসিকতা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগ (যার একটি ক্ষুদ্র নমুনা তারা কাছে থেকে মুতার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করেছিল) সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত হয়েছিল এবং তারা এ বিষয়কে কল্যাণকর বলে বিবেচনা করেছিল যে, তারা তাদের সেনাবাহিনী তাদের রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাবে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সৈন্য সমাবেশের খবর অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে এমন একটা ভাব দেখাবে যে, কোন সময়ই (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) আক্রমণের চিন্তা তাদের মনে ছিল না; যার ফলে তারা এভাবে আরব উপদ্বীপে যে সব ঘটনা প্রবাহের উদ্ভব হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।428

এ সময় মহানবী তাঁর উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণকে একত্রিত করে و شاورهم فِى الأمر   (এবং তাঁদের সাথে সকল বিষয়ে পরামর্শ করুন)- ইসলামের এ দৃঢ় মূলনীতির ভিত্তিতে শত্রুপক্ষের ভূ-খণ্ডের অভ্যন্তরে অগ্রসর হওয়া বা মদীনা নগরীতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে তাঁদের সাথে পরামর্শ করলেন।

সামরিক পরামর্শের ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তাবুক গমনপথ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে ইসলামী বাহিনীকে যে অপরিসীম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সে কারণে পুনঃ শক্তি সঞ্চয় করার জন্য তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবে। অধিকন্তু মুসলিম সেনাবাহিনী তাদের এ সামরিক অভিযানে রোমান বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার সুমহান লক্ষ্য অর্জন করেছিল এবং রোমীয়দের অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করেছিল। আর এ ভীতি তাদের দীর্ঘকাল পর্যন্ত আক্রমণ ও সামরিক শক্তি পুনর্গঠন থেকে বিরত রাখবে। এতটুকু ফলাফল, যা বেশ কিছু কাল উত্তর দিক থেকে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করছিল, তা ভবিষ্যতে মহান আল্লাহ্ কী ইচ্ছা করেন, সে পর্যন্ত আমাদের (মুসলমানদের) জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরামর্শ সভার প্রধান পরামর্শদাতাগণ মহানবীর মর্যাদা ও অবস্থান রক্ষা করার জন্য এবং যাতে করে তাঁদের অভিমত প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়, সেজন্য এ কথাও বলেছিলেন : এ সত্বেও আল্লাহ্পাকের পক্ষ থেকে যদি আপনি (শত্রু ভূ-খণ্ডে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে) আদিষ্ট হয়ে থাকেন, তা হলে আপনি যাত্রা শুরু করার আদেশ দান করুন এবং আমরাও আপনার পেছনে আছি।429

মহানবী (সা.) বললেন : মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আদেশ আসে নি। আর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আদেশ এসে থাকলে আমি তোমাদের সাথে পরামর্শ করতাম না। আমি পরামর্শ সভার অভিমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাব। যে সব শাসনকর্তা সিরিয়া ও হিজায সীমান্তে বসবাস করত, তারা সবাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ছিল এবং তাদের নিজেদের গোত্র ও আবাসভূমিতে তাদের অভিমতের কার্যকরী প্রভাব ছিল। এ কারণেই এ সম্ভাবনাও ছিল যে, রোমান বাহিনী একদিন তাদের স্থানীয় সেনাশক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং তাদের সহায়তা নিয়ে হিজায আক্রমণ করতে পারে। এ কারণেই এটা অপরিহার্য হয়ে গিয়েছিল যে, মহানবী (সা.) তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করবেন এবং এভাবে তিনি তাদের পক্ষ থেকে হুমকির সম্মুখীন না হওয়ার ব্যাপারে স্বস্তি লাভ করবেন এবং অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন।

তিনি তাবুকের কাছে বসবাস রত সীমান্তরক্ষী ও শাসনকর্তাদের সাথে নিজেই যোগাযোগ করেন এবং বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন। তিনি বেশ কিছু দলকেও তাবুক থেকে দূরে অবস্থিত অঞ্চলগুলোয় প্রেরণ করেছিলেন যাতে মুসলমানদের জন্য অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

আইলা, আযরু ও জার্বার শাসনকর্তাদের সাথে তিনি নিজে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন। সমুদ্র তীরবর্তী নগরী আইলা লোহিত সাগরের তীরে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং শামের সাথে এ নগরীর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না। সেখানকার শাসনকর্তা ইউহান্না ইবনে রৌবাহ্ বুকে স্বর্ণনির্মিত ক্রুশ ঝুলিয়ে তাঁর শাসনকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তাবুক অঞ্চলে এসে মহানবীকে একটি সাদা খচ্চর উপঢৌকন দিয়েছিলেন এবং মহানবীর প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। মহানবীও তাঁকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে উপঢৌকন প্রদান করেছিলেন।

তিনি খ্রিষ্টধর্মে বহাল থেকে প্রতি বছর তিন শ’ দীনার জিযিয়া (প্রত্যেক বিধর্মী নাগরিক ইসলামী হুকুমতের আওতা ও তত্ত্বাবধানে বসবাস করে ইসলামী প্রশাসনকে যে কর প্রদান করে) এবং আইলা অঞ্চল অতিক্রমকারী মুসলমানকে আপ্যায়ন করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। এ মর্মে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নরূপ একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় :

“এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে ইউহান্না ও আইলার অধিবাসীদের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি। এ চুক্তি মোতাবেক জল ও স্থলপথে ব্যবহৃত তাদের সমুদয় যানবাহন এবং শাম, ইয়েমেন ও সমুদ্র পথে যারা তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাদের সবাইকে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদান করা হলো। তবে তাদের মধ্য থেকে যে কেউ কোন অপরাধ করবে এবং আইনবিরোধী কোন কাজ করবে, তার সম্পত্তি তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। সকল জল ও স্থলপথ তাদের জন্য উন্মুক্ত এবং এ সব পথে তাদের যাতায়াতের অনুমতিও প্রদান করা হলো।430

এ সন্ধিপত্র থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কোন জাতি মুসলমানদের সাথে আপোষ ও সন্ধি করলে তাদের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হতো।

মহানবী (সা.) আযরু ও জার্বা অঞ্চলের অধিবাসীদের ন্যায় অন্য সকল সীমান্তবর্তী জনপদ, যাদের ভূ-খণ্ড সৈন্য সমাবেশের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের সাথেও বেশ কিছু চুক্তি সম্পাদন করে উত্তর দিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।

দাওমাতুল জান্দাল অঞ্চলে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে প্রেরণ

দাওমাতুল জান্দাল এক জন-অধ্যুষিত অঞ্চলকে বলা হতো, যা সবুজ গাছপালা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল এবং সেখানে নহর ও ঝরনার প্রবহমান পানি ছিল। এ অঞ্চলটি একটি শক্তিশালী দুর্গের পাশে অবস্থিত ছিল এবং শামের সাথে এ অঞ্চলের দূরত্ব ছিল প্রায় 50 ফারসাখ।431

তখন উকাইদার ইবনে আবদুল মালিক মাসীহী দাওমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা ছিলেন। মহানবী (সা.) আশংকা করছিলেন, রোমান বাহিনী পুনরায় আক্রমণ চালালে দাওমার খ্রিষ্টান শাসনকর্তা তাদেরকে সাহায্য করবে। আর এভাবে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য তিনি বিদ্যমান সেনাশক্তির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার এবং খালিদের নেতৃত্বে একটি সেনাদল প্রেরণ করে দাওমা অঞ্চলকে (ইসলামী হুকুমতের প্রতি) বশ্যতা স্বীকার করানোর বিষয়কে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করছিলেন।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ দ্রুত একদল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দাওমাতুল জান্দালের কাছাকাছি চলে যান এবং দুর্গের বাইরে গোপনে অবস্থান গ্রহণ করেন।

আলোকোজ্জ্বল ঐ চাঁদনী রাতে ভাই হাসসানকে সাথে নিয়ে উকাইদার শিকারের উদ্দেশ্যে দুর্গের বাইরে আসেন। তখনও তিনি দুর্গ থেকে দূরে যান নি; হঠাৎ তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীসহ খালিদের সেনাদলের মুখোমুখি হন। তাদের ও মুসলিম সৈন্যদের মাঝে ছোট একটি সংঘর্ষ হয়। এতে উকাইদারের ভাই নিহত হয়। উকাইদারের সঙ্গীরা দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেয় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু উকাইদার মুসলিম সেনাদলের হাতে বন্দী হন।

খালিদ তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, দুর্গের অধিবাসীরা তাঁর নির্দেশে ইসলামী সেনাদলের জন্য দুর্গের দরজা খুলে দিলে এবং অস্ত্র সমর্পণ করলে তিনি তাঁর দোষ উপেক্ষা করবেন এবং তাঁকে মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাবেন।

উকাইদার মুসলমানদের সত্যবাদিতা এবং চুক্তির প্রতি তাদের নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত থাকার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন। এ কারণেই তিনি দুর্গের দরজা খুলে দেয়া ও অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলেন। দুর্গের মধ্যে বিদ্যমান অস্ত্র ছিল নিম্নরূপ : চার শ’ বর্ম, পাঁচ শ’ তরবারি এবং চার শ’ বর্শা। খালিদ এসব যুদ্ধলব্ধ গনীমত ও উকাইদারকে সাথে নিয়ে পবিত্র মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হন।

মদীনায় প্রবেশ করার প্রাক্কালে খালিদ উকাইদারের স্বর্ণখচিত হাতাহীন আলখাল্লা, যা তিনি রাজাদের মতো কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিতেন এবং যা খালিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা মহানবী (সা.)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। স্বর্ণখচিত এ রেশমী পোশাকটির উপর দৃষ্টি পড়লে একদল দুনিয়া-অন্বেষী লোকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। অথচ মহানবী (সা.) ঐ পোশাকটির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন : বেহেশতবাসীদের পোশাক এর চেয়েও অধিক শানদার ও আশ্চর্যজনক।”

উকাইদার মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালেন। তবে তিনি মুসলমানদের কর প্রদানের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করলেন। মহানবী (সা.) ও তাঁর মাঝে একটি চুক্তিনামা সম্পাদিত হলো। এরপর মহানবী (সা.) তাঁকে অত্যন্ত মূল্যবান উপহার প্রদান করলেন এবং তাঁকে নিরাপদে দাওমাতুল জান্দালে পৌঁছে দেবার জন্য আব্বাদ ইবনে বিশ্রকে দায়িত্ব দিলেন।432

তাবুক অভিযান মূল্যায়ন

মহানবী (সা.) অত্যন্ত কষ্টকর এ অভিযানে শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হন নি এবং তাদের সাথে কোন সংঘর্ষেও লিপ্ত হন নি। তবে তিনি কিছু আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্যাণ লাভ করেছিলেন, যেসব হচ্ছে নিম্নরূপ :

1. এর মাধ্যমে তিনি ইসলামী সেনাবাহিনীর মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন এবং হিজাযের অধিবাসীদের ও শামের সীমান্ত এলাকাগুলোর বাশিন্দাদের অন্তরে তাঁর সম্মান ও ক্ষমতা দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর শত্রু-মিত্র সবাই বুঝতে পেরেছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের সামরিক শক্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মোকাবেলা করতে এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম।

বিরুদ্ধাচরণ ও সীমালঙ্ঘন যে আরব গোত্রগুলোর অস্তিত্ব ও স্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল, তাদের মাঝে এ বিষয়টি প্রচারিত হয়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছুকালের জন্য তাদের মন থেকে (ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর) বিরুদ্ধাচরণ ও বিদ্রোহ করার চিন্তা উবে গিয়েছিল এবং তারা এ ধরনের চিন্তার ধারে-কাছেও আর যায় নি।

এ কারণেই মদীনা নগরীতে মহানবীর প্রত্যাবর্তনের পর যে সব গোত্র তখনও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নি, তাদের প্রতিনিধিরা মদীনা নগরীতে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণ এবং মহানবীর প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিতে থাকে। ফলে হিজরতের নবম বর্ষকে আমুল উফূদ’ (عام الوفود ) অর্থাৎ প্রতিনিধি দলগুলোর বর্ষ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

2. হিজায ও সিরিয়ার সীমান্তবাসীদের সাথে বেশ কিছু সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার মাধ্যমে মুসলমানরা আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছিল এবং নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, ঐ সব অঞ্চলের গোত্রপতি ও নেতারা রোমান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করবে না।

3. মহানবী (সা.) কষ্টকর এ অভিযান পরিচালনা করে আসলে পরবর্তী কালে শাম বিজয়ের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণকে এ ক্ষেত্রে সঠিক পথ প্রদর্শন এবং এ অঞ্চলে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার সাথে তাঁদেরকে পরিচিত করিয়েছিলেন। আর সে সাথে তখনকার পরাশক্তিগুলোর মোকাবেলায় কিভাবে সৈন্য পরিচালনা করতে হবে, তাও তিনি তাঁদেরকে শিখিয়েছিলেন। তাই মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানরা সর্বপ্রথম যে অঞ্চল জয় করেছিলেন, তা ছিল শাম ও সিরিয়া।433

4. তাবুক অভিযানে গণবাহিনী পুনর্গঠনের সময় মুমিন ও মুনাফিক পরস্পর চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর এর ফলে মুসলিম সমাজে ব্যাপক শুদ্ধি প্রক্রিয়াও সাধিত হয়েছিল।