চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74552
ডাউনলোড: 6138


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74552 / ডাউনলোড: 6138
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অন্যায্য ও পক্ষপাতদুষ্ট গোঁড়ামি

মহান আল্লাহর আদেশে সম্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত আয়াতসমূহ পাঠ ও ঘোষণা দানের দায়িত্ব থেকে হযরত আবু বকরকে অপসারণ ও সেস্থলে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর নিযুক্তি নিঃসন্দেহে হযরত আলীর একটি অকাট্য ও অনস্বীকার্য শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু একদল গোঁড়া লেখক এ ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। আলূসী বাগদাদী তাঁর নিজ তাফসীর গ্রন্থে450 এ ঘটনা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন :

“হযরত আবু বকর স্নেহ, দয়া ও নম্রতার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। হযরত আলী আত্মিক সাহস ও দৃঢ় মনোবলের ক্ষেত্রে তাঁর ঠিক বিপরীত ছিলেন। যেহেতু সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহ পাঠ ও মুশরিকদেরকে হুমকি প্রদানের ক্ষেত্রে আত্মিক সাহস ও দৃঢ় মনোবলের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি এবং আবু বকরের চেয়ে আলীর মধ্যে এ সব বিষয় অধিক বিদ্যমান ছিল, সেহেতু তাঁর স্থলে আলী দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

এ ধরনের ব্যাখ্যা- যার উৎসই হচ্ছে অন্ধ গোঁড়ামি,- মহানবীর বক্তব্যের সাথে মোটেই খাপ খায় না। কারণ তিনি আবু বকরের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন : মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন যে, এ আয়াতসমূহ হয় আমি পাঠ করব অথবা আমার আত্মীয় কেউ পাঠ করবে।” এ দু ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ এসব প্রচার করার যোগ্যতা রাখেন না। মহানবীর এ জবাবে স্নেহ, দয়া ও সাহসিকতার বিষয় মোটেই উত্থাপিত হয় নি।

অধিকন্তু স্বয়ং মহানবী (সা.) ছিলেন স্নেহ, করুণা ও মমতার পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ।451 সুতরাং এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবীরও সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহের ঘোষণা ও প্রচারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়া ছিল অনুচিত। অথচ ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশ ছিল এই যে, সম্পর্কচ্ছেদের আয়াতসমূহ অবশ্যই মহানবী নিজে অথবা তাঁর আহলে বাইতভুক্ত কোন ব্যক্তি প্রচার করবেন।

কেউ কেউ এ ব্যাপারটি আরেকভাবে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, যে কোন চুক্তি বাতিল ও প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে আরবদের প্রথা ছিল এই যে, অবশ্যই চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি নিজে বা তাঁর কোন নিকটাত্মীয় চুক্তি ভঙ্গ ও বাতিলের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আর তা না হলে চুক্তি বলবৎ থাকবে। যেহেতু হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়গণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সেহেতু এসব আয়াত পাঠ করার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। তবে এ ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়। কারণ মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়গণের মধ্যে তাঁর চাচা হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবও ছিলেন, মহানবীর সাথে যাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক আলী (আ.)-এর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। তাই তাঁকে কেন এ দায়িত্ব প্রদান করা হয় নি?

যদি আমরা নিরপেক্ষ মন নিয়ে এ ঐতিহাসিক ঘটনা বিচার করি, তা হলে আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, এই অপসারণ ও নিযুক্তি না ছিল ক্ষমতালিপ্সা, আর না ছিল তা মহানবীর সাথে হযরত আলীর আত্মীয়তার সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত। বরং এ পরিবর্তনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এই যে, কার্যত যেন ইসলামী হুকুমত ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রে হযরত আলীর যোগ্যতা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং জনগণও বুঝতে সক্ষম হয় যে, তিনি যোগ্যতা ও মনোবলের দিক থেকে মহানবীর সঙ্গী ও অংশীদার।

আর কিছুকাল পরে যদি রিসালতের সূর্য্য অস্তমিত হয়, তা হলে খিলাফত, প্রশাসন ও রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় তাঁর (আলী) হাতে ন্যস্ত হবে। তিনি ছাড়া আর কোন ব্যক্তি এ কাজের যোগ্য নন এবং মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর এ সব বিষয়কে কেন্দ্র করে কখনোই মুসলমানদের সংকট ও দ্বিধা-বিভক্তির শিকার হওয়া উচিত নয়। কারণ তারা স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে যে, চুক্তিসমূহ বাতিল ও রহিতকরণ সংক্রান্ত খোদায়ী নির্দেশ মোতাবেক মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে হযরত আলী (আ.) দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর চুক্তি বাতিল ও রহিতকরণ হচ্ছে শাসনকর্তা ও পরিচালনাকারীর একান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিরই অন্তর্ভুক্ত।

সাতান্নতম অধ্যায় : দশম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

পুত্র ইবরাহীমের ইন্তেকালে মহানবী (সা.)-এর শোক

“প্রিয় ইবরাহীম! তোমার জন্য আমাদের আর কিছু করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ্ যা ফয়সালা করেন, তা প্রতিহত করা ও ফেরানো অসম্ভব। তোমার পিতার নয়ন তোমার মৃত্যুতে অশ্রুসিক্ত এবং তার হৃদয় শোকসন্তপ্ত ও দুঃখভারাক্রান্ত। তবে যে কথা মহান আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেককারী, তা কখনো মুখে উচ্চারণ করব না। আমরা যে তোমার পেছনে আসব (মৃত্যুবরণ করব এবং তোমার সাথে মিলিত হব)- এ সংক্রান্ত মহান আল্লাহর ইলাহী প্রতিশ্রুতি যদি বিদ্যমান না থাকত, তা হলে আমরা তোমার বিয়োগ-ব্যথায় ক্রন্দন করতাম এবং দুঃখভারাক্রান্ত হতাম। 452

স্নেহাস্পদ পুত্রসন্তান ইবরাহীম (আ.) যখন মহানবী (সা.)-এর কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন, তখন তিনি তাঁর সন্তানের ফুলের মতো কোমল ও সুশ্রী মুখমণ্ডলের উপর ওষ্ঠদ্বয় রেখে এ কথা বলেছিলেন। বুকভরা বেদনা ও আবেগ সহ শোকার্ত বদনে অথচ খোদায়ী ফয়সালা ও নির্ধারণকৃত ভাগ্যের প্রতি সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট থেকেই তিনি নিজ পুত্রসন্তানকে চির বিদায় দিয়েছিলেন।

সন্তানের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা আসলে মানবাত্মার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ও সবচেয়ে পবিত্র বহিঃপ্রকাশ। আর তা মানুষের আত্মিক সুস্থতা এবং তার চিত্তের নমনীয়তা ও সৌন্দর্যেরও পরিচায়ক।

মহানবী (সা.) বলতেন : তোমরা তোমাদের সন্তানদের প্রতি স্নেহ-মমতা প্রদর্শন করবে    (أكرموا أولادكم453 কারণ সন্তানবাৎসল্য মহানবী (সা.)-এর প্রশংসনীয় গুণাবলীরই অন্তর্ভুক্ত।”454

বিগত বছরগুলোয় মহানবী (সা.) কাসিম, তাহির ও তাইয়্যেব455 নামের তিন পুত্রসন্তান এবং যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম নামের তিন কন্যাসন্তানের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং তাঁদের বিয়োগ-ব্যথায় অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র সন্তান হযরত ফাতিমা (আ.) তাঁর মহতী সহধর্মিনী হযরত খাদীজা (আ.)-এর গর্ভজাত ছিলেন।

মহানবী (সা.) হিজরতের ষষ্ঠ বর্ষে বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকজন দূত প্রেরণ করেছিলেন। তিনি মিসরের শাসনকর্তার কাছেও একটি পত্র পাঠিয়ে তাকে তাওহীদী ধর্মের দিকে আহবান করেছিলেন। বাহ্যত মিসরের শাসনকর্তা মহানবী (সা.)-এর আহবানে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি; তবে মারিয়া’ নাম্নী এক দাসীসহ কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করে মহানবীর পত্রের জবাব দিয়েছিল।

এ দাসী পরবর্তীতে মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী হবার গৌরব অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর গর্ভে ইবরাহীম’ নামে মহানবীর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। মহানবী তাঁর এ সন্তানকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ইবরাহীমের জন্ম বেশ কিছুটা হলেও মহানবীর ছয় সন্তান হারানোর বেদনা লাঘব করেছিল এবং তাঁর অন্তরে আশার আলো জ্বালিয়েছিল। কিন্তু আফসোস! এ আলো 18 মাস পর নিভে গেল। একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য মহানবী বাড়ীর বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তিনি সন্তানের সংকটাপন্ন অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন. তখনই তিনি ঘরে ফিরে আসেন এবং তাঁকে মায়ের কোল থেকে নিজ কোলে তুলে নেন। ঐ সময় তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে বেদনার চিহ্ন প্রকাশ পায়!

পুত্রের মৃত্যুতে মহানবীর অশ্রুপাত ও দুঃখ প্রকাশ তাঁর মানবীয় আবেগ-অনভূতিরই নিদর্শনস্বরূপ যা তাঁর মৃত্যুর পরও অব্যাহত ছিল। আবেগ-অনুভূতি এবং শোক প্রকাশ মহানবীর আত্মিক মানবীয় আবেগ-অনুভূতিগত দিককেই তুলে ধরে, যা আপনাআপনি প্রকাশিত হয়েছিল। তবে মহানবী (সা.) যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিরোধী কোন কথা বলেন নি, তা ছিল বাস্তবিক পক্ষে মহান আল্লাহর ফয়সালা ও নির্ধারিত ভাগ্যের (তাকদীর) প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও সন্তুষ্ট থাকার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। আর মহান আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য থেকে কারো পক্ষে পলায়ন মোটেই সম্ভব নয়।

একটি ভ্রান্ত ও অবান্তর আপত্তি

আনসার সাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত আবদুর রহমান ইবনে আউফ মহানবীকে কাঁদতে দেখে খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন এবং প্রতিবাদের সুরে বলেছিলেন : আপনি আমাদের মৃতদের ব্যাপারে কাঁদতে নিষেধ করতেন। কিন্তু এখন আপনি কেন আপনার সন্তানের মৃত্যুতে কাঁদছেন? এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আপত্তিকারী ইসলাম ধর্মের সুমহান ভিত্তিসমূহের সাথেই কেবল অপরিচিত ছিলেন না, বরং স্রষ্টা মানুষের অন্তরে (মানব প্রকৃতির মাঝে) যেসব বিশেষ মানবীয় অনুভূতি আমানতস্বরূপ স্থাপন করেছেন, সেসবের ব্যাপারেও সে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলেন। বিশেষ বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য মানবীয় সহজাত প্রবণতাসমূহ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যথাসময়ে সেসবের প্রকাশ পাওয়াও অত্যাবশ্যক। যে ব্যক্তি তার আপনজনদের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হয় না এবং যার হৃদয় বিগলিত ও নয়নযুগল অশ্রুসিক্ত হয় না অর্থাৎ সে যদি তাদের বিয়োগ-ব্যথায় কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে, তা হলে সে এক টুকরো পাথর ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এ ধরনের ব্যক্তিকে মানুষ’ বলে অভিহিত করাও যায় না।

তবে এখানে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয় আাছে। কারণ এ ধরনের আপত্তি ভিত্তিহীন হওয়ার পাশাপাশি আরো একটি বাস্তবতা উন্মোচিত করে দেয়। তা হলো, তদানীন্তন নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। এ কারণেই একজন নাগরিক পূর্ণ স্বাধীনতা সহ কোন ধরনের ভয়-ভীতি ছাড়াই নিজ নেতার কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপের সমালোচনা করার সাহস পেত। তাই মহানবীও তার আপত্তির উত্তরে বলেছিলেন :

“আমি কখনোই বলি নি যে, আপনজনদের মৃত্যুতে তোমরা কেঁদো না। কারণ এসব অনুভূতি আসলে সহানুভূতি ও মমতার নিদর্শন। আর যে ব্যক্তির অন্তর অন্যদের অবস্থা দেখে বিদগ্ধ না হয়, সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া পাবে না।”456

“তবে আমি বলেছি, তোমাদের আপনজনদের মৃত্যুতে বিলাপ (উচ্চৈঃস্বরে ফরিয়াদ) করো না এবং কুফরী উক্তি ও এমন কথা ব্যক্ত করো না, যা থেকে আপত্তির গন্ধ পাওয়া যায়। আর তোমরা শোক-দুঃখের আতিশয্যে নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র বিদীর্ণ করো না।”457

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইবরাহীমের মৃতদেহ গোসল দেন এবং কাফনের কাপড় পরান। এরপর মহানবীর একদল সাহাবী ইবরাহীমের লাশ জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে বহন করে নিয়ে গিয়ে দাফন করেন।

মহানবী (সা.) ইবরাহীমের কবরের দিকে তাকিয়ে কবরটির এক কোণায় একটি গর্ত দেখতে পান। ঐ গর্তটি ভরাট করার জন্য তিনি মাটির উপর বসে পড়েন এবং নিজ হাতে কবরের উপরিভাগ সমান করে দেন। এরপর তিনি বলেছিলেন :إذا عمل أحدكم فليُتقن যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কোন কাজ করবে, তখন তার উচিত তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়া।”458

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

ইবরাহীমের ইন্তেকালের দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সৃষ্টিজগতের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরা ধারণা করেছিল, ইবরাহীমের মৃত্যুর কারণে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের চিন্তা অলীক ছিল। তবে তা বাহ্যত মহানবী (সা.)-এর সম্পূর্ণ অনুকূলেই ছিল। আর মহানবী যদি একজন সাধারণ বস্তুবাদী নেতা হতেন, তা হলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তার স্বীকৃতি প্রদান করে এ পথে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার অবকাশ থাকত। (কিন্তু তিনি যেহেতু আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন, তাই পার্থিব হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ ধরনের পদ্ধতি কখনই কাজে লাগান নি।)

কিন্তু মহানবী (সা.) এ ধরনের অমূলক ধ্যান-ধারণা খণ্ডন করার জন্য মিম্বারে আরোহণ করে জনগণকে বাস্তবতা অবহিত করলেন এবং বললেন :

إنّ الشّمس و القمر آيتان من آيات الله يجريان بأمره مطيعان له، لا ينكسفان لموت أحد و لا لحياته

“হে লোকসকল! তোমাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, নিশ্চয়ই সূর্য ও চন্দ্র্র মহান আল্লাহর নিদর্শনাদির অন্তর্ভুক্ত এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে তারা আকাশে প্রদক্ষিণরত এবং তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল রয়েছে। তাই কারো মৃত্যুতে বা জন্মগ্রহণ করার কারণে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয় না।”459

যে সব সুযোগ-সন্ধানী ব্যক্তি বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতি কেবল নিজের স্বার্থেই ব্যাখ্যা করে না, বরং তারা সাধারণ জনগণের মূর্খতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও পৌরাণিক কল্প-কাহিনীতে বিশ্বাস থেকে ফায়দা উঠায়, তাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে মহানবী (সা.) কখনই সত্য অবস্থা গোপন রেখে জনগণের অজ্ঞতাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন নি। তিনি যদি সেদিন এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণার অনুমোদন দিতেন, তা হলে বর্তমান যুগে যখন প্রাকৃতিক জগতের রহস্যাবলী আবিষ্কৃত ও উন্মেচিত হচ্ছে এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণগুলোর ক্ষেত্রে বস্তুজগতের নিয়ম-কানুনসমূহ স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তখন সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা এবং এর নিয়মকানুন সৃষ্টিকারী মহান আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি এবং সমগ্র মানব জাতির শাশ্বত নেতা হিসেবে দাবী করা তাঁর পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব হতো না।

মহানবী (সা.)-এর আহবান বিশেষ করে আরব জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তাঁর আহবান স্থান-কালের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় (অর্থাৎ তা হচ্ছে শাশ্বত ও সর্বজনীন)। তিনি যেমন অতীত কালের মানুষের নেতা ছিলেন, তেমনি তিনি আধুনিক মহাকাশ যুগ এবং প্রকৃতি জগতের রহস্যাবলী আবিষ্কার ও উন্মোচনের যুগের মানুষেরও নেতা। যে কোন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য এতটা দৃঢ় ও যুক্তিপূর্ণ যে, সাম্প্রতিক কালের বৈজ্ঞানিক প্রগতি ও বিবর্তনাদি, যা অতীতের সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পরিবর্তন করে দিয়েছে, তাঁর বক্তব্যের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্রুটিও বের করতে পারে নি।

আটান্নতম অধ্যায় : দশম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ