চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 74571
ডাউনলোড: 6139


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 74571 / ডাউনলোড: 6139
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

রোমানদের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা

আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদারদের আবির্ভাব সে দেশের ধর্মীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হওয়া সত্বেও রোমানদের ব্যাপারেই মহানবী (সা.) সবচেয়ে বেশি ভাবতেন। শামদেশ ও ফিলিস্তিন তখন রোমানদের উপনিবেশ ও শাসনাধীন ছিল। কারণ তিনি জানতেন, ইয়ামামাহ্ ও ইয়েমেনের যোগ্য শাসনকর্তারা খুব ভালোভাবে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারদের পরাস্ত করতে পারবেন। মহানবী (সা.)-এর ওফাতের একদিন আগে তাঁর যুগের নবুওয়াতের দ্বিতীয় ভণ্ড দাবীদার আসওয়াদ আনাসী ইয়েমেনের শাসনকর্তার গৃহীত পদক্ষেপের কারণে নিহত হয়।

মহানবী (সা.) নিশ্চিত ছিলেন, শক্তিশালী রোমান সরকার- যা ইসলামী রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রত্যক্ষ করছে, তা- যেহেতু মহানবী আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদীদের বহিষ্কার এবং একদল খ্রিষ্টান অধিবাসীকেও ইসলামী রাষ্ট্রের করদাতায় পরিণত করেছেন,- সেহেতু খুব ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। তিনি অনেক দিন ধরেই রোমানদের হুমকি ও বিপদকে খুব গুরুতর বিবেচনা করে আসছিলেন এবং এজন্যই তিনি হিজরতের অষ্টম বর্ষে জাফর ইবনে আবী তালিব, যাইদ ইবনে হারিসাহ্ এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহার নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী রোমান শাসনাধীন অঞ্চলের দিকে প্রেরণ করেছিলেন। এ যুদ্ধে এ তিন সেনাপতি শাহাদাত বরণ করেন এবং ইসলামী সেনাবাহিনী খালিদ ইবনে ওয়ালীদের পরিকল্পনায় বিজয় অর্জন না করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে।

হিজরতের নবম বর্ষে হিজায আক্রমণের জন্য রোমানদের প্রস্তুতি গ্রহণের সংবাদ মদীনা নগরীতে প্রচারিত হলে মহানবী (সা.) নিজেই ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাবুক অভিযানের উদ্দেশ্যে বের হন এবং শত্রুদের সাথে যুদ্ধ ছাড়াই তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই মহানবীর কাছে রোমানদের পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা অস্বাভাবিকভাবে গুরুতর বিবেচিত হয়েছিল। এজন্যই বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় ফিরে এসে মহানবী (সা.) আনসার ও মুহাজিরগণকে নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। হযরত আবু বকর, হযরত উমর, হযরত আবু উবাদাহ্, হযরত সা দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস প্রমুখের ন্যায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও এ সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহানবী (সা.) একইভাবে মুহাজিরগণের মধ্যে যারা অন্যদের আগে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তাঁদের সবাইকে এ সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।533

মহানবী (সা.) মুহাজিরগণের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি জাগ্রত করার জন্য নিজের হাতে একটি পতাকা বেঁধে তা উসামাহ্ ইবনে যাইদের হাতে দিলেন534 এবং নির্দেশ দিলেন :

“মহান আল্লাহর নামে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। প্রত্যুষে উনবার535 অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালাবে। আর (রণাঙ্গনের) এ দূরত্বটা এত দ্রুত অতিক্রম করবে যে, ঐ এলাকায় তোমাদের অগ্রযাত্রার সংবাদ পৌঁছানোর আগেই তুমি এবং তোমার সৈন্যরা সেখানে পৌঁছে যাবে।”

উসামাহ্ এ পতাকা বুরাইদার হাতে অর্পণ করেন এবং জুরফ536 এলাকায় সেনা ছাউনী স্থাপন করেন যাতে মুজাহিদগণ দলে দলে সেখানে উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত সময়ে যাত্রা করতে সক্ষম হন।

মহানবী (সা.) যেহেতু একজন নবীন যুবককে এই সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং আনসার ও মুহাজিরগণের মধ্যেকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তাঁর অধীন করেছিলেন, সেহেতু এ ক্ষেত্রে তাঁর দু টি লক্ষ্য ছিল :

প্রথমত তিনি উসামার ওপর যে মুসীবত আপতিত হয়েছিল, তা এ পথে নিরসন করতে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বকে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। কারণ উসামা রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাঁর পিতা যাইদ ইবনে হারিসাকে হারিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত তিনি ব্যক্তিত্ব’ ও যোগ্যতার’ ভিত্তিতে দায়িত্ব ও পদ বণ্টনের নিয়মকে জীবিত ও প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সামাজিক পদমর্যাদা ও অবস্থান যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই চায় না এবং তা কখনোই বয়সের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আর তা এজন্য যে, যে সব যুবক যোগ্যতাসম্পন্ন, তারা যেন কতকগুলো কঠিন সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে এবং তাদের জানা থাকা প্রয়োজন, ইসলামে বয়সের সাথে নয়, বরং যোগ্যাতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সাথে পদ, অবস্থান ও মর্যাদার সরাসরি সম্পর্ক আছে।

ইসলাম আসলে মহান আল্লাহর মহান শিক্ষামালার বরাবরে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা। আর সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম, যে রণাঙ্গনের সৈনিকের মতো মহান আল্লাহর আদেশ-নির্দেশসমূহের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং মনে-প্রাণে সেসব গ্রহণ করে- তা তার স্বার্থানুকূলেই থাক বা তার ক্ষতির কারণ হোক বা তার অভ্যন্তরীণ প্রবণতা ও আকাঙ্ক্ষাগুলোর অনুকূলে থাকুক বা প্রতিকূলে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ছোট অথচ খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত এক বাণীতে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এভাবে ব্যক্ত করেছেন :الإسلام هو التّسليم ইসলাম (মহান আল্লাহর বিধানাবলীর সামনে) আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই নয়।”537

যারা ইসলামের বিধানসমূহ পালনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের পথ বেছে নেয় এবং যেখানে ইসলামকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাওয়া-পাওয়ার পরিপন্থী দেখতে পেয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের বাহানা করে দায়িত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করে, তারাই ইসলামী শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাবোধশূন্য এবং এরা আসলে প্রকৃত আত্মসমর্পণের মনোবৃত্তি রাখে না; অথচ প্রকৃত আত্মসমর্পণই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের ভিত্তি।

20 বছরের538 অনধিক অল্পবয়স্ক তরুণ অধিনায়ক উসামাহ্ ইবনে যাইদ আমাদের আলোচ্য বিষয়ের জীবন্ত সাক্ষী। কারণ, তাঁর অধিনায়কত্ব তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ বয়সের একদল সাহাবীর জন্য মেনে নেয়া অত্যন্ত কষ্টকর ও দুরূহ হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রতিবাদ ও নিন্দা করতে থাকে এবং এমন সব কথা বলতে থাকে, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মুসলিম সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মহানবী (সা.)-এর প্রতি আত্মসমর্পণের মনোবৃত্তি এবং (রণাঙ্গনে উপস্থিত) সৈনিকের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তাদের মাঝে ছিল না। তাদের বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল এটাই যে, মহানবী (সা.) প্রবীণ সাহাবীগণের উপর একজন অল্পবয়স্ক তরুণকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন।539 তারা মহানবীর এ কাজের গুরুত্বপূর্ণ দিক ও কল্যাণসমূহ সম্পর্কে অমনোযোগী ছিল এবং তারা তাদের নিজেদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সব কিছু মূল্যায়ন করত।

মহানবী (সা.) এ সেনাবাহিনী সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন- নিকট থেকে এ বিষয়টি তারা উপলব্ধি করা সত্বেও কতিপয় অদৃশ্য ও রহস্যজনক হাতের ইশারায় জুরফ’ সেনাছাউনী থেকে এ সেনাবাহিনীর যাত্রা বিলম্বিত হতে থাকে এবং গোপনে তা ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টাও চলতে থাকে।

যেদিন মহানবী (সা.) উসামার জন্য পতাকা বেঁধে দিয়েছিলেন, সে দিনের পরের দিন তিনি তীব্র মাথা ব্যথা ও প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তাঁর এ অসুস্থতা বেশ কয়েক দিন অব্যাহত থাকে। অবশেষে তিনি এ রোগেই ইন্তেকাল করেন।

মহানবী (সা.) অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী থাকাবস্থায় জানতে পারলেন, সেনাছাউনী থেকে সেনাবাহিনীর যাত্রা করার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং একদল লোক উসামাকে সেনাপতি নিযুক্ত করার ব্যাপারে সমালোচনা করছে। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে মহানবী খুবই রাগান্বিত হয়েছিলেন। মাথায় পট্টি বেঁধে এবং কাঁধে তোয়ালে রেখে নিকট থেকে জনতার সাথে কথা বলা এবং এ ধরনের বিরুদ্ধাচরণের বিপদ সম্পর্কে তাদের সতর্ক করার জন্য তিনি মসজিদের দিকে গমন করেন। তিনি প্রচণ্ড জ্বর নিয়েই মিম্বারের উপর আরোহণ করে মহান আল্লাহর প্রশংসা করার পর বলেন :

“হে লোকসকল! সেনাবাহিনীর যাত্রায় দেরী হওয়ার দরুন আমি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। উসামার নেতৃত্ব তোমাদের মধ্যেকার একটি গোষ্ঠীর কাছে ভারী হয়ে গেছে এবং তোমরা সমালোচনা করছ। কিন্তু তোমাদের সমালোচনা এবং অবাধ্যতা নতুন কোন বিষয় নয়। তোমরা এর আগেও তার পিতা যাইদের অধিনায়কত্বের সমালোচনা করেছিলে। মহান আল্লাহর শপথ! তার পিতাও যেমন এ পদের জন্য যোগ্য ছিল, তেমনি সেও এ পদের জন্য যোগ্য। আমি তাকে খুব ভালোবাসি। হে লোকসকল! তার সাথে তোমরা সদাচরণ কর এবং অন্যদেরও তার সাথে সদাচরণের উপদেশ দাও। সে তোমাদের পুণ্যবানদের একজন।”

মহানবী (সা.) এখানেই তাঁর ভাষণ সমাপ্ত করেন এবং মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসেন। তীব্র জ্বর ও অচল দেহ নিয়ে তিনি বিছানায় পড়ে যান। সাহাবীগণের মধ্য থেকে বড় বড় ব্যক্তিত্ব, যাঁরাই তাঁকে দেখতে আসতেন, তাঁদেরকেই তিনি নির্দেশ দিতেন :أُنفذوا بعث أُسامة তোমরা উসামার সেনাদলকে যাত্রা করাও।”540

মহানবী (সা.) উসামার সেনাবাহিনীর রণাঙ্গনের উদ্দেশে যাত্রার ব্যাপারে এতটা তাকীদ দিতেন যে, রোগশয্যায় শায়িত থেকেও যখন তিনি তাঁর সাহাবীগণকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন উসামার সেনাবাহিনীকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত কর’, তখন যারা উসামার সেনাদল থেকে পৃথক হয়ে মদীনায় থেকে যেতে চাচ্ছিল, তাদেরকে তিনি লানত দিতে থাকেন।541

মহানবীর এ সব আদেশের কারণে আনসার ও মুহাজিরগণ বিদায় নেয়ার জন্য তাঁর কাছে উপস্থিত হতে থাকে এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মদীনা থেকে বের হয়ে জুরফের সেনাছাউনীতে অবস্থানরত উসামার সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে থাকে।

ঐ দু তিন দিন উসামাহ্ যখন সেনাবাহিনীর রণাঙ্গনের যাত্রার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই মদীনা থেকে তাঁদের কাছে মহানবী (সা.)-এর শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর আসতে থাকে, যার ফলে যাত্রার ব্যাপারে তাঁদের সিদ্ধান্ত শিথিল হয়ে যায়। আর এ শৈথিল্য ঐ সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, যখন সেনাবাহিনীর অধিনায়ক বিদায় নেয়ার জন্য মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে তাঁর মুখমণ্ডলে আরোগ্যের লক্ষণসমূহ প্রত্যক্ষ করেন।

মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন : তুমি তোমার গন্তব্যস্থলের দিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাত্রা কর। উসামাহ্ সেনাছাউনীতে ফিরে রণাঙ্গনের উদ্দেশে যাত্রা করার আদেশ দিলেন। সেনাবাহিনী জুরফ থেকে রণাঙ্গনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে নি, এমন সময় সেখানে মদীনা থেকে সংবাদ এসে পৌঁছায়, মহানবী (সা.) মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন। যারা না যাওয়ার অজুহাত সন্ধান করছিল এবং বিভিন্ন উপায়ে সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে 16 দিন পিছিয়ে দিয়েছিল, তারা পুনরায় মহানবীর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়াকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে মদীনায় ফিরে যায় এবং তাদের পিছে পিছে সেনাবাহিনীর বাকী সদস্যরাও মদীনার পথ ধরে। আর ঠিক এভাবে সেনাবাহিনীর কতিপয় নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তির উচ্ছৃংখলা ও অবাধ্যতার কারণে মহানবী (সা.)-এর একটি মহান আকাঙ্ক্ষা তাঁর জীবনকালে আর বাস্তবায়িত হলো না।542

অযৌক্তিক অজুহাত

কতিপয় ব্যক্তি, যাঁরা পরবর্তীতে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের মহানবী (সা.)-এর খলীফা বলে অভিহিত করেছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে এ ধরনের ভুলের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। কিন্তু আহলে সুন্নাতের কতিপয় আলেম বিভিন্নভাবে তাঁদের এ অন্যায় ও আইন অমান্য করার বিষয় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তবে যতই তাঁরা এ ব্যাপারে চেষ্টা করুন না কেন, ঐসব আইন অমান্যকারীর পক্ষে কোন অজুহাত দাঁড় করাতে পারেন নি।543

জান্নাতুল বাকী কবরবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা

জীবনচরিত রচয়িতারা লিখেছেন : যে দিন মহানবী (সা.) তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে দিনের মধ্যরাতে তিনি তাঁর খাদেম আবু মুওয়াইহিবাকে544 সাথে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে গিয়েছিলেন।”

কিন্তু শিয়া ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন, যেদিন মহানবী (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেদিন তিনি হযরত আলীর হাত ধরে জান্নাতুল বাকী গোরস্তানের দিকে গমন করেন। একদল লোক তখন তাঁর পেছনে পেছনে আসছিলেন। যাঁরা তাঁর সাথে ছিলেন, তাঁদের তিনি বলেছিলেন : মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কবরবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।” বাকী গোরস্তানে প্রবেশ করে তিনি কবরবাসীকে সালাম করে এভাবে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন : হে ঐসব ব্যক্তি, যারা মাটির নীচে শায়িত! তাদের উপর আমার সালাম। যখন তোমরা এ অবস্থার মধ্যে আছ, তখন তা তোমাদের জন্য মুবারক ও আনন্দঘন হোক। ঘন আঁধার রাতের বলয় বা টুকরোগুলোর মতো ফিতনা দেখা দিয়েছে এবং একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত হয়েছে।” এরপর তিনি গোরস্তানবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। পরে হযরত আলীর দিকে545 মুখ করে বললেন : আমার কাছে পৃথিবীর সমুদয় গুপ্ত ধনভাণ্ডার এবং দীর্ঘ পার্থিব জীবন পেশ করা হয়েছিল এবং আমাকে এগুলো এবং রবের সাথে সাক্ষাৎ ও বেহেশতে প্রবেশের মধ্যে যে কোন একটি বাছাই করার স্বাধীনতা দেয়া হলে আমি মহাপ্রভু আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এবং বেহেশতে প্রবেশকেই প্রাধান্য দিয়েছি।

ওহীর ফেরেশতা প্রতি বছর একবার আমার কাছে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতেন; কিন্তু এ বছর তিনি আমার কাছে দু বার পবিত্র কুরআন উপস্থাপন করেছেন; তাই আমার মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে আসা ছাড়া এর আর কোন কারণ থাকতে পারে না।”546

যারা বস্তুবাদী দৃষ্টি নিয়ে এ সৃষ্টিজগতের দিকে তাকায় এবং অস্তিত্বের বলয়কে কেবল বস্তু এবং এর সমুদয় নিদর্শন ছাড়া আর কিছু জানে না, সম্ভবত তারা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে নিজেদের বলতে পারে যে, আত্মার সাথে কিভাবে কথা বলা সম্ভব? আত্মার সাথে কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব? কখন সে মৃত্যুবরণ করবে, তা কিভাবে মানুষ অবগত হয়? কিন্তু যারা বস্তুবাদের প্রাচীর ভেঙে ফেলেছে এবং বস্তুগত এ দেহ থেকে মুক্ত ও অজড় আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে, তারা কখনোই আত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি অস্বীকার করে না547 এবং তা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব ও বাস্তব বলে মেনে নেয়। ওহী জগৎ এবং আরো অন্যান্য অবস্তুগত ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত জগতের সাথে যে নবীর যোগাযোগ আছে, মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনিই কেবল নিশ্চিতভাবে তাঁর অন্তিম মুহূর্ত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম।

চৌষট্টিতম অধ্যায় : একাদশ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

অলিখিত পত্র

মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষ দিনগুলো ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত সংবেদনশীল অধ্যায়সমূহের অন্তর্গত। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্ ঐ দিনগুলোয় অত্যন্ত বেদনাদায়ক মুহূর্ত অতিবাহিত করছিল। উসামাহ্ ইবনে যাইদের নেতৃত্বে সেনাদলে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা ও অবাধ্যতা তাদের কতকগুলো গোপন তৎপরতা এবং মহানবীর ওফাতের পর প্রশাসন (রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা), নেতৃত্ব ও ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়াদি কুক্ষিগত করা এবং মহানবীর আনুষ্ঠানিক উত্তরাধিকারী, যিনি গাদীরে খুমের দিবসে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁকে পিছু হটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তাদের দৃঢ় সিদ্ধান্তের কথাই ব্যক্ত করে।

মহানবীও সার্বিকভাবে তাদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন। এ কারণেই তাদের অপতৎপরতা প্রশমিত করার জন্য তিনি উসামার সেনাদলে সকল সাহাবী যোগদান করে রোমানদের সাথে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মদীনা ত্যাগ করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করছিলেন। তবে যারা রাজনীতির মঞ্চের অভিনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তারা তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে উসামার সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। এমনকি মহানবী (সা.) যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেদিন পর্যন্ত তারা সেনাবাহিনীর যাত্রাও ঠেকিয়ে রেখেছিল। অবশেষে 16 দিন যাত্রাবিরতি ও বেকার বসে থাকার পর মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ প্রচারিত হবার ফলে পুনরায় তারা মদীনায় ফিরে আসে। মহানবীর মূল লক্ষ্য ছিল, তাঁর ওফাতের দিনে মদীনা নগরী ঐসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অসুবিধা সৃষ্টিকারী লোক থেকে খালি হয়ে যাবে, যারা তাঁর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী ও স্থলবর্তীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে। অথচ তাঁর এ লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয় নি। তারা শুধু মদীনা নগরীতেই অবস্থান করে নি; বরং তারা মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর অবস্থান দৃঢ়ীকরণ সংক্রান্ত যে কোন ধরনের উদ্যোগে বাধা দেয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে মহানবীকে এ ব্যাপারে কথা বলা থেকে বিরত রাখারও চেষ্টা করেছে।

মহানবী (সা.), তাঁদের কতিপয় কন্যা, যাঁরা তাঁর স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাঁদের ঘৃণ্য ও গোপন তৎপরতা সম্পর্কে অবগত হলে প্রচণ্ড জ্বর নিয়েই মসজিদে উপস্থিত হন এবং মিম্বারের পাশে দাঁড়িয়ে এতটা উচ্চকণ্ঠে জনগণের উদ্দেশে কথা বলতে থাকেন যে, তাঁর কণ্ঠস্বর মসজিদের বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছিল। তিনি তখন বলছিলেন :

أيّها النّاس سعرت النّار، و أقبلت الفتن كقطع الليل المظلم و إنّى و الله ما تمسكون عَلَىَّ بشىء، إنّى لم اُحلّ إلّا ما اَحلّ القرآن و لم اُحرّم إلّا ما حرّم القرآن

“হে লোকসকল! (ফিতনার) অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে; ফিতনা আঁধার রাতের বলয়গুলোর মতো আবির্ভূত হয়েছে এবং আমার বিপক্ষে তোমাদের কোন প্রমাণ নেই। নিশ্চয়ই পবিত্র কুরআন যা হালাল করেছে, তা ছাড়া আর কিছুই আমি হালাল করি নি এবং পবিত্র কুরআন যা হারাম করেছে, তা ছাড়া আর কিছুই আমি হারাম করি নি।”548

এ বাক্যগুলো তাঁর ওফাতের পর ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাঁর তীব্র উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কথাই ব্যক্ত করে। (ফিতনার) যে অগ্নি প্রজ্বলিত হবার কথা তিনি বলেছেন, তার অর্থ কী? তা কি অনৈক্যের আগুন নয়, যা মুসলমানদের জন্য ওঁৎ পেতে বসেছিল এবং মহানবীর ওফাতের পর প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং এখনো তার স্ফুলিঙ্গগুলো নিভে তো যায়ই নি; বরং প্রজ্বলিতই রয়ে গেছে?