সৃষ্টির পরশমনি

সৃষ্টির পরশমনি 0%

সৃষ্টির পরশমনি লেখক:
: মোহাম্মাদ আলী মোর্ত্তজা
প্রকাশক: বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র কোম,ইরান।
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

সৃষ্টির পরশমনি

লেখক: মুহাম্মদ মাহদী হায়েরীপুর,মাহদী ইউসুফিয়ান ও মুহাম্মদ আমীন বালাদাসতিয়ান
: মোহাম্মাদ আলী মোর্ত্তজা
প্রকাশক: বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র কোম,ইরান।
বিভাগ:

ভিজিট: 20544
ডাউনলোড: 3370

পাঠকের মতামত:

সৃষ্টির পরশমনি
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 40 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 20544 / ডাউনলোড: 3370
সাইজ সাইজ সাইজ
সৃষ্টির পরশমনি

সৃষ্টির পরশমনি

লেখক:
প্রকাশক: বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র কোম,ইরান।
বাংলা

চতুর্থ ভাগ : অন্যান্যদের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.)

যদি অন্যরা প্রশংসা করতে বাধ্য হয় ,

তবে সেটাই হচ্ছে বড় গৌরবের।

ইমাম মাহদী (আ.) ও তার বিশ্বজনীন বিপ্লবের বিষয়টি কেবল মাত্র শিয়া মাযহাবের গ্রন্থেই বর্ণিত হয় নি বরং তা মুসলমানদের সকল মাঝহাবেই বর্ণিত হয়েছে এবং এ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে। তারাও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অস্তিত্ব ও আবির্ভাব এবং তিনি যে রাসূল (সা.)-এর বংশ হতে এবং হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (আ.)-এর সন্তান 39 এ সম্পর্কে একমত। আহলে সুন্নত যে মাহ্দীবাদের প্রতি বিশ্বাসী তা জানার জন্য তাদের বিশিষ্ট আলেমদের গ্রন্থসমূহের শরণাপন্ন হতে হবে। আহলে সুন্নতের মোফাসসেরগণও তাদের তাফসীর গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করেছেন যে ,কোরআন পাকের কিছু আয়াত শেষ যামানায় ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের প্রতি ঈঙ্গিত করে। যেমন: ফাখরে রাযী 40 ,কুরতুবি 41 ... ।

অনুরূপভাবে তাদের অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণও ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কিত হাদীসসূহকে তাদের স্ব-স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে তাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহও রয়েছে। যেমন: সিহাহ সিত্তা 42 , মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল ...।

আহলে সুন্নতের পূর্বের ও বর্তমানের অনেক পণ্ডিতরাই ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন: আবু নাঈম ইস্পাহানী ,মাজমাউল আরবাইন গ্রন্থ লিখেছেন এবং সূয়ূতী ,আল ওরফুল ওয়ারদী ফী আখবারিল মাহ্দী (আ.) গ্রন্থ রচনা করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে ,আহলে সুন্নতের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ইমাম মাহ্দীর প্রতি বিশ্বাসের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন এবং যারা বিষয়টিকে অস্বীকার করে তাদের বিপক্ষে গ্রন্থ লিখেছেন। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ সিদ্দিক মাগরেবী এবং ইবনে খালদুন উল্লেখযোগ্য। 43 এটা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি আহলে সুন্নতের বিশ্বাসের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। আহলে সুন্নতের গ্রন্থে উল্লেখিত শত শত হাদীসের মধ্যে সংক্ষিপ্ততার প্রতি দৃষ্টি রেখেই দু টি হাদীস তুলে ধরা হল: রাসূল (সা.) বলেছেন:

যদি মাহপ্রলয়ের একদিনও অবশিষ্ট থাকে আল্লাহ তা আলা সেদিনকে এত দীর্ঘায়িত করবেন যে ,আমার বংশ হতে এক ব্যক্তিকে আবির্ভাব ঘটাবেন তিনি দুনিয়াকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবেন যেমনিভাবে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল। যার নাম আমার নামের অনুরূপ। 44

তিনি আরও বলেছেন:

আমার বংশ হতে এমন এক মহাপুরুষ আবির্ভূত হবেন যিনি সবদিক থেকেই আমার অনুরূপ। তিনি দুনিয়াকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবেন যেমনিভাবে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল। 45

শেষ যামানায় ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের বিষয়টি সকলেই বিশ্বাস করেন। মাহ্দীবাদ হল গোটা মানবের চাওয়া পাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা বিভিন্ন ধর্ম ও মাযহাবের অনুসারী হয়েও তারা এ অভিন্ন বিষয়ের মুখপানে ধাবিত। মাহ্দীবাদ হল মানব প্রকৃতির এক ঐশী আহবানের স্বচ্ছ স্ফুরণ যার পথ ধরে বিভিন্ন আক্বীদা বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ প্রতিশ্রুত দিনকে অবলোকন করে থাকেন। পবিত্র তৌরাত ,যাবুর ,ইঞ্জিল এমনকি হিন্দুদের গ্রন্থে এবং অগ্নিপুজকদের গ্রন্থেও ইমাম মাহ্দী সম্পর্কে ঈঙ্গিত করা হয়েছে। তবে প্রত্যেকেই তাকে ভিন্ন নামে চিনে থাকে। অগ্নিপুজকরা তাকে সুশিনাস অর্থাৎ বিশ্বমানবতার মুক্তিদাতা ,খ্রীষ্টানরা তাকে মাসিহ মাওউদ এবং ইহুদিরা তাকে সারওয়ারে মিকাইলি নামে আখ্যায়িত করেছেন। অগ্নিপুজকদের জামাসাব নামে গ্রন্থে এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

আরবদের নবীই শেষ নবী যিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করবেন এবং তিনি মানুষের সাথে তাদের মতই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন। তার দ্বীনই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তার কিতাব (কোরআন) সকল কিতাবকে বাতিল করবে। তার কন্যার সন্তানরা যারা পৃথিবীর সূর্য এবং যুগের নেতা (ইমাম) নামে ভুষিত। আল্লাহর নির্দেশে ঐ নবীর শেষ উত্তরাধিকারীর শাসনব্যবস্তা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। 46

তৃতীয় অধ্যায় :অদৃশ্য ইমামের প্রতিক্ষায়

প্রথম ভাগ :অদৃশ্য

বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা ,হযরত আদম থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকারী এবং আল্লাহর শেষ গচ্ছিত সম্পদ হযরত হুজ্জাত ইবনেল হাসান আসকারী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার পর এখন তার জীবনের অপর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অর্থাৎ অদৃশ্য সম্পর্কে কথা বলব।

অদৃশ্যের তাৎপর্য

প্রথম লক্ষণীয় বিষয়টি হল অদৃশ্য অর্থাৎ দৃষ্টির অন্তরালে থাকা ,অনুপস্থিত থাকা নয়। সুতরাং এ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব যে ইমাম মাহদী (আ.) লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন এবং তারা তাকে দেখতে পায়না কিন্তু তিনি তাদের মাঝে উপস্থিত রয়েছেন এবং তাদের সাথে জীবন-যাপন করছেন। এ সত্যটি মাসুম ইমামগণের হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:

আমার প্রভুর শপথ মানুষের মাঝে আল্লাহর হুজ্জাত রয়েছে এবং তিনি মানুষের মাঝেই বিচরণ করেন। মানুষের বাড়ীতেও আসা যাওয়া করেন। তিনি পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজমান। মানুষের কথোপকথোন শোনেন এবং তাদেরকে সালাম দেন। তিনি দেখেন কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতে পাবে না। 47 তবে আরেক ধরনের অদৃশের কথাও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মাহদী (আ.)-এর দ্বিতীয় প্রতিনিধি বলেন:

ইমাম মাহদী (আ.) প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে সেখানে উপস্থিত হন। তিনি সবাইকে দেখেন এবং চেনেন । আর মানুষও তাকে দেখতে পায় কিন্তু তাকে চিনতে পারে না। 48

সুতরাং হযরত মাহদী (আ.) সম্পর্কে দুই ধরনের অদৃশ্য ঘটতে পারে: তিনি কখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন আবার কখনো পরিদৃষ্ট হয়ে থাকেন কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারে না। ইমাম সর্বদাই মানুষের মাঝে বিরাজমান।

অদৃশ্যের ইতিকথা

অদৃশ্য তথা দৃষ্টির অন্তরালে জীবন-যাপন এমন বিষয় নয় যা কেবলমাত্র আল্লাহর শেষ প্রতিনিধির বেলায় ঘটেছে। বরং হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা জানা যায় যে ,আল্লাহর বিশেষ কয়েকজন নবীও তাদের জীবনের কিয়দাংশকে অদৃশ্যে তথা দৃষ্টির অন্তরালে অতিবাহিত করেছেন। এ ঘটনা আল্লাহর নির্দেশেই ঘটেছিল তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা বা পারিবারিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়।

সুতরাং অদৃশ্য হচ্ছে আল্লাহর একটি পন্থা 49 যা বিভিন্ন নবী যেমন: হযরত ইদ্রিস ,নূহ ,সালেহ ,ইব্রাহীম ,ইউসুফ ,মুসা ,শোয়েব ,ইলিয়াস ,সুলাইমান ,দানিয়াল (আ.)-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে। আল্লাহর নির্দেশে তাদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অদৃশ্যে থেকেছেন এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রে তা এখনো অব্যহত রয়েছে। 50     একারণেই ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যকে নবীগণের একটি সুন্নত বা রীতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে । ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যের একটি দলিল হচ্ছে তার জীবনে নবীদের সুন্নত বাস্তবায়িত হবে। ইমাম জা ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:

আমাদের কায়েমের জন্য অদৃশ্য রয়েছে যা দীর্ঘায়িত হবে । রাবী প্রশ্ন করল: হে রাসূলাল্লাহর সন্তান এ অদৃশ্যের কারণ কি ?

ইমাম বললেন: আল্লাহ চান যে নবীদের সুন্নত তার জীবনে বাস্তবায়িত হোক। 51

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের বিষয়টি তার জন্মের পূর্বেই আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে স্থান পেয়েছিল। ইসলামের নেতাগণ অর্থাৎ রাসূল (সা.) থেকে শুরু করে হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.) পর্যন্ত সকলেই ইমাম মাহ্দীর অদৃশ্যের ঘটনা ,তার বৈশিষ্ট্য এবং তা ঘটার সময় সস্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। এমনকি সে সময়ে মুসলমানদের কর্তব্যও বর্ণনা করেছেন। 52

রাসূল (সা.) বলেছেন:

মাহ্দী আমার সন্তানদের মধ্য থেকে সে অদৃশ্যে থাকবে যখন মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে তখন সে আবির্ভূত হবে উজ্জল তারার ন্যায়। সে পৃথিবীকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবে যেমনিভাবে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল। 53

অদৃশ্যের দর্শন

সত্যি ,কেন ইমাম তথা আল্লাহর হুজ্জাত দৃষ্টির অন্তরালে আছেন এবং কি কারণে জনগণ তার আবির্ভাবের বরকত থেকে বঞ্চিত রয়েছে ?

এ বিষয়ে অনেক বক্তব্য রয়েছে এবং বহুসংখ্যক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। তবে উপরিউক্ত প্রশ্নসমূহের উত্তর দেওয়ার পূর্বে একটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করাকে প্রয়োজন মনে করছি।

আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ তা আলার কোন কাজই তাই সে ছোট হোক আর বড়ই হোক নিরর্থক নয়। তিনি প্রতিটি কর্মই হিকমতের সাথে করে থাকেন এখন আমরা তা বুঝি আর নাই বুঝি। তাছাড়াও পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাও আল্লাহর নির্দেশে সংঘটিত হয়ে থাকে আর তার মধ্যে অন্যতম হল ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের ঘটনাটি। সুতরাং তার অদৃশ্যের ঘটনাটিও আল্লাহর হিকমতের মাধ্যমেই ঘটেছে যদিও আমরা তার দর্শন না জেনে থাকি।

ইমাম জা ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:

নিঃসন্দেহে আমাদের সাহেবুল আমর দৃষ্টির অন্তরালে থাকবে এবং অসত্যপন্থিরা বিভ্রান্তিতে পড়বে।

রাবী এর কারণ সম্পর্কে ইমাম (আ.) -এর কাছে জানতে চাইলে ,ইমাম (আ.) বলেন:

যে কারণে অন্তর্ধান ঘটবে তা বলা নিষিদ্ধ...। অদৃশ্য আল্লাহর রহস্যের মধ্যে একটি। যেহেতু আমরা জানি যে ,মহান আল্লাহ হাকিম সুতরাং আমরা তা মেনে নিয়েছি। আল্লাহর প্রতিটি কর্মই হিকমতপূর্ণ তাই আমরা তার কারণ জানি বা নাই জানি। 54

তবে এমনটিও হতে পারে একজন মানুষ আল্লাহর সকল কার্যাবলীকে হিকমতপূর্ণ মেনে নেওয়ার পরও আত্মিক তৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সৃষ্টির কিছু কিছু রহস্য জানার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। সুতরাং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের হিকমত সম্পর্কে বিশ্লেষণ করব এবং সে সম্পর্কিত কিছু রেওয়ায়াতের প্রতি আলোকপাত করব:

ক)- মানুষের শিক্ষার জন্য

যখন উম্মত নবী ও ইমামের মর্যাদা বোঝেনা এবং তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করে না বরং তাদের নির্দেশ লঙ্ঘন করে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাদের নেতাকে তাদের থেকে পৃথক করে দেন যেন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং ইমামের অদৃশ্যকালীন সময়ে তার বাহ্যিক উপস্থিতির বরকত ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পারে। অতএব ইমামের অদৃশ্য উম্মতের জন্য কল্যাণকর যদিও তারা তা উপলব্ধি করতে অক্ষম।

ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে:

আল্লাহ যখন কোন সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের ওঠা-বসাকে অপছন্দ করেন তখন আমাদেরকে তাদের মাঝ থেকে উঠিয়ে নেন। 55

ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ার কারণে যারা কোন পরিবর্তন ও বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টায় থাকে তারা সংগ্রামের প্রথমে বিরোধীদের কারো কারো সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয় ,যার মাধ্যমে তারা উদ্দেশ্যের পানে অগ্রসর হন। কিন্তু প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আ.) এমনই একজন সংস্কারক যিনি বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিশ্বজনীন ন্যায় পরায়ণ শাসন ব্যাবস্থার প্রচলন ঘটাতে কোন অত্যাচারী শক্তির সাথে আপোস করবেন না। কেননা হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি হচ্ছেন সকল প্রকার অত্যাচার ও অত্যাচারীর প্রকাশ্য নির্মূলকারী। আর একারণেই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অদৃশ্যে থাকবেন যেন তাকে কোন অত্যাচারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ না হতে হয়। ইমাম রেযা (আ.) অদৃশ্যের কারণ সম্পর্কে বলেছেন:

এ জন্য যে ,যখন তিনি সংগ্রাম করবেন তখন যেন কারো সাথে তার চুক্তিবদ্ধতা না থাকে। 56

খ)- মানুষের পরীক্ষার জন্য

মানুষকে পরীক্ষা করা আল্লাহর সুন্নতসমূহের একটি। তিনি তার বান্দাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন যার মাধ্যমে সত্যের পথে তাদের দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়। যদিও পরীক্ষার ফলাফল স্পর্কে আল্লাহ জ্ঞাত কিন্তু এই পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দাগণ শিক্ষা পাবে এবং নিজেদের সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে শিখবে।

ইমাম কাযেম (আ.) বলেছেন:

যখন আমার বংশের পঞ্চম পুরুষ অদৃশ্যে থাকবে তখন তোমরা দ্বীনের প্রতি যত্নবান থেকো। তেমাদের মধ্য থেকে কেউ যেন বিচ্যুত না হয়। আমাদের মাহ্দী (আ.) অদৃশ্যে থাকবে এবং এ সময় অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করবেন। 57

গ)- ইমামের জীবন রক্ষার জন্য

উম্মতের কাছ থেকে নবীগণের অদৃশ্য হয়ে থাকার অপর একটি কারণ হল নিজের জীবন রক্ষা করা। তারা পরবর্তীতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করার তাগিদে বিপদের সময়ে অদৃশ্য হতেন যেমন রাসূল (সা.) মক্কা থেকে বেরিয়ে গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। তবে এ সবই আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছায় ঘটে থাকে। ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্য হওয়ার কারণ সম্পর্কেও বিভিন্ন রেওয়ায়েতে ঠিক একই দলিল বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম জা ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:

ইমাম মাহ্দী (আ.) তার সংগ্রামের পূর্বে কিছুদিন যাবত অদৃশ্যে থাকবে। কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ইমাম বলেন: জীবন রক্ষার জন্য। 58

যদিও ঐশী মহামানবরা শহীদ হওয়ার প্রার্থনা করে থাকেন। তবে সেই শাহাদত অর্থবহ যখন তা কর্তব্যপালন করতে গিয়ে এবং সমাজ ও আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু যদি হত্যার মাধ্যমে মানুষের উদ্দেশ্য অর্জিত না হয় ও তা বৃথা যায় তখন জীবন বাচাঁনো ফরজ এবং তা বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পছন্দনীয়। দ্বাদশ ইমাম যিনি আল্লাহর শেষ গচ্ছিত সম্পদ তিনি যদি এভাবে মারা যান তাহলে মানুষের সকল আশা বৃথা যাবে এবং সকল নবীদের শ্রম ব্যর্থ হবে। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ,ন্যায়নিষ্ঠ্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিভিন্ন হাদীসে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের আরও অনেক কারণ বর্ণিত হয়েছে ,তবে সংক্ষিপ্ততার জন্য তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা হল। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যা পূর্বেও বলা হয়েছে , অদৃশ্য আল্লাহর রহস্যের মধ্যে একটি এবং এই অদৃশ্যের প্রকৃত কারণ ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের পর উদঘাটিত হবে। (এতটুকু বলা যেতে পারে) যা আলোচনা করা হয়েছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যে তার প্রভাব রয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগ :অদৃশ্যের প্রকারভেদ

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্য হওয়ার বিষয়টি একান্ত জরুরী। কিন্তু যেহেতু আমাদের মহান ইমামগণের প্রত্যেকটি পদক্ষেপই জনগণের ঈমান ও বিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য। তাই ভয় ছিল যে ,আল্লাহর শেষ হুজ্জাত (আ.)-এর অন্তর্ধান মুসলমানদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে দাড়াবে তাই অদৃশ্যের সময়টি ক্রমান্বয়ে এবং যথাযথভাবে শুরু হয়ে চলতে থাকে।

দ্বাদশ ইমামের জন্মের বহু দিন পূর্বে থেকেই তার অদৃশ্য এবং এর অপরিহার্যতা সম্পর্কে ইমামগণ এবং তাদের সাথীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। অনুরূপভাবে ইমাম হাদী (আ.) ও ইামাম আসকারী (আ.) তাদের অনুসারীদেরকে বিশেষভাবে বিষয়টিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে ধীরে ধীরে আহলে বাইতের অনুসারীরা বুঝে নিয়েছিলেন যে ,দুনিয়া এবং আখেরাতের বিভিন্ন সমস্যাতে সর্বদা উপস্থিত ইমামের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই বরং তাদের নায়েবদের (প্রতিনিধিদের) মাধ্যমেও এসবের সমাধান করা সম্ভব। ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদত এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্য শুরু হওয়ার পরও উম্মতের সাথে ইমামের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয় নি। বরং জনগণ ইমামের বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের মহান ইমামের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতেন। এসময়েই জনগণ এবং দ্বীনি আলেমদের মধ্যে ব্যপক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মানুষ বুঝে নিয়েছিল যে ,ইমাম অদৃশ্যে থাকলেও তাদের দ্বীনি কর্তব্য পালনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় নি। এটাই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্য উপযুক্ত সময় ছিল যে ,তিনি দীর্ঘমেয়াদী অদৃশ্যে যাবেন। আর এভাবে ইমাম এবং জনগণের মধ্যে সাধারণ সম্পর্ক স্থগিত হয়ে যায়।

এখন স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী অদৃশ্যকালের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অলোচনা তুলে ধরা হল:

স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্যকাল (অন্তর্ধান)

260 হিজরীতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর দ্বাদশ ইমাম (আ.)-এর ইমামত শুরু হয় এবং তখন থেকেই তার স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্য শুরু হয় যা গাইবাতে সোগরা নামে পরিচিত আর এ অদৃশ্যকাল 329 হিজরী পর্যন্ত (প্রায় 70 বছর) চলে।

স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্যকালের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এসময়ে জনগণ ইমামের বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ইমাম মাহদী (আ.)-এর সাথে যোগাযোগ রাখতেন ,তাদের মাধ্যমে ইমামের নির্দেশ পেতেন এবং নিজেদের কৃত প্রশ্নের জবাব পেতেন। 59 কখনো আবার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করতেন।

ওই বিশেষ চারজন প্রতিনিধির সকলেই হচ্ছেন শিয়া মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর মনোনীত ছিলেন। উক্ত চারজন হলেন যথাক্রমে:

(1) উসমান ইবনে সাঈদ আমরী (রহ.)। তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের প্রথম থেকে প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করেন এবং 267 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ইমাম হাদী আন্ নাকী (আ.) এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এরও প্রতিনিধি ছিলেন।

(2) মুহাম্মদ বিন উসমান ইবনে সাঈদ আমরী (রহ.)। তিনি প্রথম প্রতিনিধির সন্তান এবং পিতার মৃত্যুর পর তিনি ইমামের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন এবং 305 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

(3) আবুল কাসেম হুসাইন ইবনে রুহ নৌবাখতী (রহ.)। তিনি দীর্ঘ 21 বছর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করার পর 326 হিজরীতে ইহধাম ত্যাগ করেন।

(4) আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ সামুরী (রহ.)। তিনি 329 হিজরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তার মৃত্যুর মাধ্যমেই স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানের পরিসমাপ্তি ঘটে।

বিশেষ প্রতিনিধিদের সকলেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং মানুষের কাছে পরিচয়লাভ করেছিলেন। শেখ তুসী (রহ.) তার আল গাইবাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ,একদা চল্লিশজন শিয়া উসমান ইবনে সাঈদকে (প্রথম নায়েব) নিয়ে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হন। ইমাম তার সন্তানকে তাদেরকে দেখিয়ে বলেন:

আমার পর এই সন্তানই তোমাদের ইমাম। তাকে অনুসরণ করো ,জেনে রাখ আজকের পর থেকে প্রাপ্ত বয়ষ্ক না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাকে আর দেখতে পাবে না। সুতরাং তার অদৃশ্যকালে উসমান যা বলে তাই মেনে নিও এবং তার অনুসরণ করো। কেননা ,সে তোমাদের ইমামের প্রতিনিধি এবং সকল দায়িত্ব তার উপর ন্যাস্ত। 60

অপর একটি হাদীস থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দ্বিতীয় প্রতিনিধিকেও ইমাম হাসান আসকারী (আ.) নির্বাচন করেছিরেন। শেখ তুসী (রহ.) বর্ণনা করেছেন:

উসমান বিন সাঈদ শিয়া মাযহাবের ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে যে সকল মাল জিনিস নিয়ে এসেছিলেন ইমাম তা গ্রহণ করলেন। যারা এঘটনাটির সাক্ষী ছিল তারা বললেন , আমরা জানি যে ,উসমান আপনার অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম তবে আপনার এ কাজের মাধ্যমে আমাদের কাছে তা আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে গেল। ইমাম (আ.) বললেন , হ্যাঁ তোমরা জেনে রাখ যে ,উসমান আমার প্রতিনিধি এবং তার পুত্র মুহাম্মাদ আমার পুত্র মাহ্দীর প্রতিনিধি হবে। 61

এগুলি ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যের পূর্বের ঘটনা এবং স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্যকালে প্রত্যেক প্রতিনিধি তার মৃত্যুর পূর্বে ইমাম মাহদী (আ.)-এর নির্দেশে পরবর্তী প্রতিনিধিকে নির্বাচন করে যেতেন।

এই মহান ব্যক্তিত্বরা বিশেষ গুনে গুনান্বিত হওয়ার কারণেই ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

আমানতদারীতা ,পবিত্রতা ,কথা এবং কাজে ন্যায়পরায়ণতা ,আহলে বাইত (আ.)-এর গোপন তথ্য গোপন রাখা ইত্যাদি তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা ইমামগণের বিশ্বস্ত এবং প্রিয় ছিলেন। তাদের অনেকে আবার 11 বছয় বয়স থেকে ইমামদের সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছিলেন এবং ঈমানের পাশাপশি জ্ঞানের দিক থেকেও সবার শীর্ষে ছিলেন। সকলেই তাদেরকে ভালমানুষ হিসাবে জানত। তারা এত বেশী সহনশীল ও মহৎপ্রাণ ছিলেন যে ,অতি কঠিন মূহুর্তেও তারা পুরোপুরি ইমামের অনুগত ছিলেন। এই উত্তম বৈশিষ্ট্যের পাশাপশি তারা শিয়া মাযহাবের নেতৃত্বের যোগ্যতাও রাখতেন। অনেক প্রতিকুলতা থাকা সত্বের তারা সামান্য উপকরণের মাধ্যমে শিয়া সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পেরেছিলেন এবং স্বপ্লমেয়াদী অন্তর্ধানকে সফলভাবে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর স্পল্পমেয়াদী অন্তর্ধানকে অধ্যায়ন করলে বোঝা যায় যে ,তার প্রতিনিধিগণ কত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইমাম ও উম্মতের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই যোগাযোগ এবং কারো কারো সাথে ইমামের সাক্ষাৎ ইমামের জন্ম ও অস্তিত্ব প্রমাণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আর এ ঘটনাটি ঠিক তখন ঘটেছিল যখন শত্রুরা শিয়া মাযহাবের ইমামের জন্মের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ফেলতে চেয়েছিল। তাছাড়াও এ সময়টি দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও যথেষ্ট সহায়ক ভুমিকা রেখেছিল। কেননা ,দীর্ঘমেয়াদী অদৃশ্যে নায়েবদের মাধ্যমেও ইমামের সাথে যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন মানুষ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে ,তাদের মহান ইমাম অস্তিত্বমান তবে তিনি দৃষ্টির অন্তরালে।