হযরত আলী (আ.)

হযরত আলী (আ.)0%

হযরত আলী (আ.) লেখক:
: মোহাম্মাদ আলী মোর্ত্তজা
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 21 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 5620 / ডাউনলোড: 3868
সাইজ সাইজ সাইজ
হযরত আলী (আ.)

হযরত আলী (আ.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

হযরত আলী (আ .)

মূল :দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

ভাষান্তরে : মোহাম্মাদ আলী মোর্ত্তজা

  

ভূমিকা

এখন আমরা এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের কথা আলোচনা করব ,যাকে কবিতার ছোঁয়ায় অঙ্কিত করা যায় না ,যায় না তাঁকে মসির আঁচড়ে প্রকৃতরূপে বর্ণনা করাও।

তিনি তো ,বর্ণনার চেয়েও উৎকৃষ্ট ,কল্পনার চেয়েও সুন্দর ,অভিব্যক্তির চেয়েও সমুন্নত। তিনি তো বিস্ময়কর উৎকর্ষে প্রস্ফুটিত ,জীবন যাপন করেছিলেন একরূপে ,বেঁচে ছিলেন অন্যরূপে ,আর বিদায় নিয়েছিলেন উত্তমরূপে। তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব ,যিনি পর্বতসম অটুট মহা মর্যাদাবান ,কোমল স্বভাবাধিকারী ,নির্মল বারিসম ,বিজলীসম কলরবপূর্ণ ,সূর্য্যসম তপ্ত ,সমুদ্রের মত প্রশস্ত ,ঘন শ্যামল অরণ্যের মত বিস্তৃত ,বিস্তীর্ণ মরুর মত সরল ,ঐশী মালাকুত সম পবিত্র ,যেন সকল গুণের সমাহার তাঁর ব্যক্তিত্বে দীপ্তিময়। তিনি তো বিশ্বের বিস্ময় ;বিস্ময়কর তাঁর জীবন ব্যবস্থা ,আর বিস্ময় ছড়িয়ে দিয়েই তিনি বিদায় নিলেন আমাদের আঁখির আড়ালে।

এখন আমরা সামগ্রিকভাবে তাঁর চরিত্রের ঐ সকল বিস্ময়কর দিক সমূহের আলোচনায় মনোনিবেশ করব।

জন্ম

ইবনে কা নাব বলেন : আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও অন্যান্যদের সাথে কাবা গৃহের সম্মুখে বসেছিলাম। ফাতেমা বিনতে আসাদ আল্লাহর গৃহের নিকটবর্তী হলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে এরূপ বললেন : প্রভু হে! তোমাকে ,তোমার নবিগণ ও তাদের গ্রন্থসমূহের উপর আস্থা রাখি। স্বীয় পিতামহ ইবরাহীম (আ.)-এর কথা সত্য বলে বিশ্বাস করি ,যেমন বিশ্বাস করি যে ,তিনি তোমার আদেশে এ গৃহ নির্মাণ করেছিলেন... তোমাকে তার (হযরত ইবরাহীমের) কসম ,আর কসম আমার গর্ভে বিদ্যমান এ শিশুর ;তাকে প্রসব করা আমার জন্য সহজ কর।

এ সময় আমরা আশ্চর্য হয়ে স্বচক্ষে দেখলাম যে ,আল্লাহর গৃহের প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং ঐ মহিয়সী নারী গৃহাভ্যন্তরে পা রাখলেন ,অতঃপর পুনরায় প্রাচীর পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল...অনতিবিলম্বে গৃহদ্বার খোলার জন্য উঠে দাঁড়ালাম ,কিন্তু দ্বার খুললো না... অনুধাবন করলাম যে এ কর্মে আল্লাহর হিকমাত বিদ্যমান... চার দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ঐ সম্মানিতা নারী বাহু যুগলে এক শিশু জড়িয়ে গৃহ থেকে বাইরে এলেন ,যে তাঁর জন্য এনেছিল গৌরব... এবং বললেন : অদৃশ্য হতে এক সংবাদ শ্রবণ করলাম যে ,তাঁর নাম রাখবে আলী। 1

আর এ ঘটনাটি 13ই রজব ,30শে আ 'মূল ফিল (হিজরতের 23 বছর পূর্বে) শুক্রবারে ঘটেছিল। 2

শৈশবে মহানবী (সা.)-এর আশ্রয়ে

স্বয়ং ইমাম আলী (আ.) তাঁর শৈশব দিনগুলো সম্পর্কে বলেন : শৈশবে নবী (সা.) আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরতেন ,খাবার চিবিয়ে আমার মুখে দিতেন এবং স্বীয় সুগন্ধিতে আমাকে সুগন্ধময় করতেন। তিনি আমার কথায় মিথ্যা ,কর্মে ভ্রান্তি ও অজ্ঞতা কখনো দেখতে পাননি।

মহান আল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর দুগ্ধ পোষ্যকালীন সময় অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরই মহান ফেরেশতাগণকে তাঁর সহচর করেছিলেন ,যাতে তাঁকে পৃথিবীর সর্বোত্তম কর্মসমূহের পথে সহযোগিতা করতে পারে। আমিও নবী (সা.)-কে সেরূপে অনুসরণ করতাম যেমন করে কোন দুগ্ধপোষ্য শিশু তার মাতাকে অনুসরণ করে।

তিনি সর্বদা আমাকে আদেশ করতেন ;আর আমি তাঁর সকল কর্মের পদাঙ্ক অনুসরণ করতাম। প্রতি বছর তিনি হেরা পর্বতে যেতেন এবং তখন আমি ব্যতীত তাঁকে আর কেউ দেখতে পেতনা...।

যখন ইসলাম কোন গৃহে প্রবেশ করেনি এবং কেবলমাত্র নবী (সা.) ও তাঁর পত্নী হযরত খাদিজা মুসলমান ছিলেন ,আর আমি তৃতীয় মুসলমান ছিলাম ,তখন হেদায়েত ও রেসালতের জ্যোতি দেখতে পেতাম এবং নবুওয়াতের সুগন্ধ অনুভব করতাম। 3

মহানবী (সা.) তাঁর নবুওয়াত লাভের পর ,তিন বছর পর্যন্ত এরূপ কোন আদেশ প্রাপ্ত হননি যে ,প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার করবেন। আর তখন হাতে গণা কয়েকজন মাত্র ঈমান এনেছিলেন এবং আলী (আ.) ছিলেন পুরুষদের মধ্যে প্রথম। 4

এমতাবস্থায় যখন এ আয়াত নাযিল হয়েছে যে ,

) وانذر عشيرتك الاقربين (

অর্থাৎ আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন তখন আলী (আ.) মহানবীর আদেশে তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে 40 জনকে নিমন্ত্রণ করলেন। এদের মধ্যে আবু লাহাব ,আব্বাস এবং হামযার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। একজনের পরিমাণেও যথেষ্ট নয় এ পরিমাণের খাবার তৈরী করা হল। কিন্তু মহান আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে সকলেই পরিতৃপ্ত হলেন ,অথচ ঐ খাবারের কোন ঘাটতি ঘটল না। যেহেতু নবী (সা.) চেয়েছিলেন তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করবেন ,আবু লাহাব বলল : মুহাম্মাদ তোমাদেরকে যাদু করেছে! আর তার এ বক্তব্যের ফলেই উপস্থিত সবাই ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেল এবং অনুষ্ঠান ব্যর্থ হলো।

সঙ্গত কারণেই মহানবী (সা.) অন্য একদিন সকলকে নিমন্ত্রণ করলেন এবং ভোজন সমাপনান্তে বক্তব্য শুরু করলেন : হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ! আরব যুবকদের মধ্যে এমন কাউকে আমি চিনি না যে ,তোমাদের জন্য আমি যা এনেছি তার চেয়ে উত্তম কোন কিছু তোমাদের জন্য এনেছে। আমি এ বিশ্ব ও অন্য জগতের কল্যাণের সুসংসবাদ এনেছি। আমি মহান আল্লাহর দিকে তোমাদেরকে আহবান করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। অতএব ,তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে আমাকে সাহায্য করবে এবং আমার ভাই ,আমার ওয়াসী ও উত্তরাধিকারী হবে ?

মহানবী (সা.) এ প্রশ্নটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন এবং প্রতিবারই আলী (আ.) উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন ও স্বীয় প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছিলেন...।

অতঃপর মহানবী (সা.) বললেন : এই হলো আমার ভাই ,ওয়াসী ও উত্তরাধিকারী ;তার কথা তোমরা শ্রবণ করবে এবং তার আদেশ পালন করবে। 5

হিজরতের প্রথম রাত্রিতে আলী (আ.)

ইসলামের প্রকাশ লাভের ফলে কোরাইশদের জন্য মহানবী (সা.) বিপদ জনকরূপে প্রতীয়মান হলেন। কোরাইশদের গোত্রপতিরা দারুন্নাদ ওয়াহ নামক স্থানে মিলিত হলো এবং মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার জন্য পরামর্শ সভায় বসল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো যে ,প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে নির্বাচিত ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে মহানবীর বাড়ীতে আক্রমণ করে তাঁকে সম্মিলিতভাবে হত্যা করবে।

মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে অবগত হলেন এবং ঐ রাতে স্বীয় স্থানে না ঘুমানোর জন্য ও ঐ রাতেই হিজরত করার জন্য আদিষ্ট হলেন। 6

মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে হযরত আলীকে অবহিত করলেন এবং তাঁকে তাঁর (মহানবীর) শয্যায় এমনভাবে ঘুমানোর নির্দেশ দিলেন ,যাতে অন্য কেউ জানতে না পারে যে তিনি মহানবীর শয্যায় ঘুমিয়েছেন। আলী (আ.) নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা করলেন এবং এ মহান কর্মের জন্য সম্ভাব্য বিপদের ভার নিজ স্কন্ধে ধারণ করলেন। আর এ কর্মটি এতই আকর্ষণীয় ছিল যে ,মহান আল্লাহ্ এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল করলেন।

) ومن النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله والله رئوف بالعباد (

মানুষের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে নিজের জীবনকে বাজী রাখে। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাগণের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র (সূরা বাকারা : 207)।

রাত হলো এবং সর্বত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো। হত্যার জন্য আদিষ্টরা মহানবীর গৃহকে চার দিক থেকে পরিবেষ্টন করল... মহানবী (সা.) সূরা ইয়াসীনের একটি আয়াত পড়তে পড়তে ঘর থেকে রেরিয়ে এলেন এবং ভিন্ন এক পথে সাওর বা সউর পর্বতের গুহার দিকে দ্রুত ধাবিত হলেন...।

নরহন্তারা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে মহানবী (সাঃ)-এর শয্যা পাশে উপস্থিত হলো ;আলী (আ.) শায়িত অবস্থা থেকে উঠে শয্যার উপর বসলেন। হন্তারা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল : মুহাম্মদ কোথায় ?

আলী (আ.) জবাবে বললেন : আমি তাঁকে নজরদারী করার জন্য আদিষ্ট ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলাম কি ?

তারা আলী (আ.)-কে প্রহার করতে করতে মসজিদুল হারামে নিয়ে গেল এবং সেখানে কিছু সময় আটক রাখার পর মুক্তি দিয়েছিল। 7

হযরত আলী মহানবীর আস্থাভাজন ছিলেন

মহানবী (সা.) স্বয়ং কোরাইশদের আস্থাভাজন ছিলেন এবং সকল আমানতসমূহ তাঁর নিকট ছিল নিরাপদ। কিন্তু যখন মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন ,তখন তাঁর গোত্র ও গৃহে আলী (আ.) অপেক্ষা বিশ্বস্ত আর কাউকে পাননি। সুতরাং তিনি তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করলেন ,যাতে মানুষের আমানত সঠিকরূপে প্রকৃত মালিকের নিকট ফিরিয়ে দিতে পারেন। আর সেই সাথে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন এবং তাঁর (মহানবীর) কন্যা ও নারীগণকে মদীনায় পৌঁছাতে পারেন...।

আলী (আ.) ,এ সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মসমূহ সম্পাদনের পর তাঁর মাতা ফাতেমা ,মহানবীর কন্যা ফাতেমা এবং যুবাইরের কন্যা ফাতেমা ও অন্যান্যদেরকে নিয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা করলেন। পথিমধ্যে মক্কার কাফেরদের মধ্যে আটজনের সাথে দেখা হলো। তারা তাঁরা যাত্রা পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। আলী (আ.) তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতঃ মদীনার নিকটবর্তী স্থানে যেখানে মহানবী তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পৌঁছলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে নিয়ে মদীনায় পৌঁছলেন। 8

আলী (আ.) ও আল্লাহর পথে সংগ্রাম

ইসলাম শান্তি ও প্রাণবন্ত ধর্ম। নরহত্যাকে ইসলাম সমর্থন করে না। আর এ জন্যে যে ব্যক্তি অকারণে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করে তার জন্যে ইসলাম অনন্ত শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। তদুপরি ইসলাম ,সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ,এক বিশ্বজনীন ধর্ম। সুতরাং সকল মানুষকে এ ধর্মের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আর তাই সকলকে এদিকে আহবান করা এবং এর প্রচারের প্রয়োজন।

স্পষ্টতই প্রথম থেকেই যারা ইসলাম গ্রহণ এবং এর বিস্তৃতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করল ,তারা এর বিরোধিতা শুরু করেছিল। আর এখানেই ইসলাম জিহাদের নিয়ম প্রবর্তন ও প্রণয়ন করল ,যাতে ইসলামের প্রতি যারা শক্রতা পোষণ করে তাদেরকে নির্মূল করতে পারে।

অনুরূপ ,বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ,যেখানে শক্ররা মুসলমানদের প্রতি আক্রমণ করবে সেখানে আত্মরক্ষা করাটা অপরিহার্য। ফলে শক্রদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও আত্মরক্ষা করা ইসলামী জিহাদেরই একটি শাখা রূপে পরিগণিত হয় ,যার বৈধতা সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তি ,ফিতরাত ও ন্যায়চিন্তা স্বীকৃতি প্রদান করে। আর মহানবীর অধিকাংশ যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং হযরত আলী (আ.) অধিকাংশ যুদ্ধেই উপস্থিত থাকতেন ,যিনি আল্লাহ্ ব্যতীত কাউকে ভয় করতেন না। তিনি সমরাঙ্গনে ছিলেন অক্লান্ত ,অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অগ্রপথিক। সিংহসম গর্জন ও ঝড়গতিতে শক্রপক্ষকে ঘুর্ণিবাতের মত নাস্তানাবুদ ও ধ্বংস করতেন। সমরাঙ্গনে থেকে কখনোই পিছু হটতেন না বলে তাঁর বর্মের পশ্চাদ্বেশ ছিল না। তিনি শক্রদেরকে কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শণ করতেন না। তাঁর তীক্ষ্ণ তরবরির আঘাত নিশ্চিত মৃত্যু বয়ে আনত ,একাধিক আঘাতের কোন প্রয়োজন ছিল না। তাঁর তরবারী আঘাত হানলে শক্রর জীবন হরণ ব্যতীত উত্থিত হতো না... ।

এখন আমরা তাঁর সমর-জীবনের ইতিহাস থেকে কিছুটা আলোকপাত করব।

খন্দকের যুদ্ধে আলী (আ.)

ইসলামের শক্রদের একাধিক দল ও গোত্র সম্মিলিত ভাবে মদীনা আত্রমণ করে ইসলামকে নির্মূল করার জন্য সিদ্ধান্ত নিল। মহানবী (সা.) হযরত সালমান ফার্সীর পরামর্শে মদীনার চারিদিকে পরিখা খননের জন্য নির্দেশ দিলেন।

দু পক্ষের সৈন্যরা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শক্র সেনাদের মধ্যে আরবদের খ্যাতিমান যোদ্ধা আশি বছর বয়স্ক আমর ইবনে আব্দে উদ বীরত্বগাঁথা গেয়ে ,ছুটোছুটি করে ,ক্রোধান্বিত হয়ে যুদ্ধের জন্য আহবান জানাল।

আলী (আ.) সম্মুখে এগিয়ে গেলেন। আমর বলল : ফিরে যাও ,আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। আলী (আ.) বললেন : তুমি তোমার খোদার সাথে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলে যে ,কোরাইশের মধ্যে যে কেউ তোমার নিকট দু টি প্রত্যাশা করবে ,তুমি একটিকে গ্রহণ করবে।

আমর বলল : হ্যাঁ ,তোর প্রত্যাশা কী ?

আলী (আ.) বললেন : প্রথমতঃ ইসলাম গ্রহণ কর ,মহান আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর এবং নবীর উপর ঈমান আন।

আমর বলল : এগুলোর কোন প্রয়োজন নেই।

আলী (আ.) বললেন : তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও!

আমর বলল : ফিরে যা ,তোর পিতার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল ,আমি তোকে হত্যা করতে চাই না!

আলী (আ.) বললেন : কিন্তু আমি তো মহান আল্লাহর শপথ করেছি যে ,যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি সত্য থেকে দূরে থাকবে ,তোমাকে হত্যা করতে সচেষ্ট থাকব।

আমর ঘোড়া থেকে নেমে আসল এবং হযরত আলীর উপর তরবারির আঘাত হানল। আলী (আ.) ঢাল তুলে নিলে আমরের তরবারি তাতে আঘাত হানল। ফলে সে আঘাত ব্যর্থ হলো...। অতঃপর এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করলেন ও হত্যা করলেন। ...অন্যান্যরা এ দৃশ্য দেখে হযরত আলীর নাগাল থেকে পলায়ন করল। 9

আলী (আ.) বিজয়ী বেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন , সাবাস আলী! যদি ইসলামের অনুসারীদের সকল কল্যাণ কর্মকে তোমার অদ্যকার যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয় ,তবে তোমার কর্মই সর্বোৎকৃষ্ট হবে। কারণ ,এর মাধ্যমে কাফেরদের জন্য অসম্মান ও হতাশা ব্যতীত কিছুই রইল না। অপরদিকে মুসলমানদের জন্য তা বয়ে এনেছে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব। 10

খায়বার যুদ্ধ

মহানবী (সা.) ইহুদীদের ঘাঁটি খায়বারের দিকে গেলেন। এ যুদ্ধে হযরত আলী (আ.) চক্ষুযন্ত্রণার কারণে যুদ্ধে যেতে অপারগ ছিলেন। মহানবী (সা.) হযরত আবু বকরকে ডেকে পতাকা প্রদান করলেন। হযরত আবু বকর মোহাজিরদের মধ্য থেকে একদল সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে গেল ,কিন্তু দূর্গ জয় না করেই ফিরে আসলেন। পরদিন একই ভাবে হযরত উমরও যুদ্ধ করতে গেলেন এবং বিফল হয়ে ফিরে আসলেন। আর তিনি মুসলমানদেরকে যুদ্ধ সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত করলেন এবং মুসলমানরাও তাকে ভীতির কথা শুনাল।

মহানবী (সা.) বললেন : সেনাপতিত্বের জন্য এরা কেউ উপযুক্ত ছিল না ,আলীকে আসতে বল!

উত্তরে বলা হলো : তিনি চক্ষু যন্ত্রণায় আক্রান্ত।

মহানবী (সা.) বললেন : তাকে নিয়ে আস। তিনি এমন এক ব্যক্তি যাকে মহান আল্লাহ ও তাঁর নবী ভালবাসেন। আর তিনিও আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসেন ।

হযরত আলীকে আনা হলো। নবী (সা.) বললেন : আলী তোমার কি অসুবিধা ?

আলী (আ.) বললেন : চক্ষু যন্ত্রণা ও মাথা ব্যথা। মহানবী (সা.) তাঁর জন্য দোয়া করলেন এবং স্বীয় মুখের লালা দিয়ে তাঁর চোখ ও মাথায় মালিশ করে দিলেন। ব্যথা দূরীভূত হলো। অতঃপর আলী (আ.)ও শুভ্র পতাকা ধারণ করলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন : জিবরাইল তোমার সাথে ,বিজয় তোমার জন্য অনিবার্য ,মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তরে ভয় ও ভীতি সঞ্চার করেছেন। জেনে রাখ ,তারা তাদের কিতাবে জানতে পেরেছে যে ,যে ব্যক্তি তাদেরকে পরাজিত করবে তার নাম ইলিয়া (আলী)। যখনই তাদের কাছে পৌঁছবে বলবে যে , আমার নাম আলী । মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।

আলী (আ.) সমরাঙ্গনে গেলেন। প্রথমে ইহুদীদের নেতৃস্থানীয় মারহাবের মুখোমুখি হলেন ও তর্কবিতর্কের পর তাকে তরবারির আঘাতে পরাস্ত করলেন। ইহুদীরা দুর্গাভ্যন্তরে আশ্রয় নিল এবং দ্বার বন্ধ করে দিল। আলী (আ.) দ্বারের নিকটবর্তী হলেন এবং যে দ্বার বিশজন একত্রে বন্ধ করেছিল তা এক টানে খুলে ফেললেন। অতঃপর ইহুদীদের দুর্গের পরিখার উপর ছুড়ে ফেললেন যাতে মুসলমানরা তার উপর দিয়ে পার হয়ে দূর্গে পৌঁছতে পারে...। অবশেষে তিনি খায়বার দূর্গ জয় করলেন। 11

হযরত আলীর জ্ঞান

ইবনে আব্বাস মহানবীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন : আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচারকার্যে সকলের চেয়ে উত্তম। মহানবী (সা.) বলেন :

انا مدينة العلم و علي بابها فمن أراد العلم فليقتبسه من عليّ

আমি জ্ঞানের শহর ,আলী তার দ্বার। যে কেউ জ্ঞানার্জন করতে চায় সে যেন আলী থেকেই জ্ঞানার্জন করে।

ইবনে মাসউদ বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন আলী ফিরে আসলেন ,তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কী আলোচনা করছিলেন ?তিনি বললেন : মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন ,প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্র দ্বার উন্মুক্ত হয়!

একদা হযরত আলী (আ.) মিম্বারে বললেন :

يا معشر النّاس سلوني قبل ان تفقدوني

হে লোক সকল! আমাকে হারানোর পূর্বেই ,আমার কাছে জিজ্ঞাসা কর।

আমার নিকট থেকে জেনে নাও ,কেননা পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তীদের জ্ঞান আমার নিকট বিদ্যমান। আল্লাহর শপথ ,যদি বিচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয় ,ইহুদীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে ,ইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য সে কিতাব থেকে ,যবূরের অনুসারীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে ,আর কোরআনের অনুসারীদের জন্য কোরআন থেকে তবে সেভাবেই বিচার করব... আল্লাহর শপথ ,আমি কোরআন ও তার ব্যাখ্যায় সকলের চেয়ে জ্ঞানী।

অতঃপর পুনরায় বললেন :

سلوني قبل ان تفقدوني

আমাকে হারানোর পূর্বেই আমাকে জিজ্ঞাসা কর। কোরআনের যে কোন আয়াত সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা কর ,আমি তার জবাব দিব ;বলতে পারব তার অবতীর্ণ হওয়ার সময় সম্পর্কে ,কার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে ,নাসেখ ও মানসূখ সম্পর্কে ,আর বলতে পারব সাধারণ ও বিশেষ আয়াত সম্পর্কে ,মোহকাম ও মোতাশাবিহ আয়াত সম্পর্কে ,মাক্কী ও মাদানী আয়াতসমূহ সম্পর্কে...। 12

রাসূল (সা.) হযরত আলীর সকল প্রকৃষ্টতার ভিত্তিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী হওয়ার কথাটি মানুষের নিকট ঘোষণা করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন এবং এ কর্ম বিভিন্ন ভাবে তিনি সম্পাদন করেছিলেন। যেমন : গাদীর দিবসে যিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মহানবী (সা.) দশম হিজরী সালে মক্কায় হজ পালনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ঐ বছর মহানবীর সঙ্গী এক লক্ষ বিশ হাজার বলে বর্ণিত হয়েছে এবং হজ থেকে আসার সময়ও অনুরূপ সংখ্যক মানুষ তাঁর সাথে ছিল। তিনি 18ই যিলহজ অর্ধ দিবসের সময় জোহফা প্রান্তরে গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছলেন। এ সময় নামাজের জন্য আযান ধ্বনিত হলো। মানুষ একত্র হয়ে নামায সম্পন্ন করল। অতঃপর উটের পিঠের একাধিক গাঁট বাঁধ দিয়ে উঁচু স্থান তৈরী করা হলো। মহানবী (সা.) ঐ উঁচু স্থানে দাঁড়ালেন এবং মহান আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনান্তে বললেন : তোমরা এবং আমি (মহান আল্লাহর নিকট) দায়বদ্ধ ,তাই নয় কি ?জবাবে বলা হলো : আমরা সাক্ষী দিচ্ছি যে ,আপনি আমাদের নিকট সত্য দীনের প্রচার করেছেন এবং এ পথে আপনি যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন ;মহান আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন।

মহানবী (সা.) বললেন : হে লোকসকল! তোমরা মহান আল্লাহর একত্বে ও তাঁর বান্দা মুহাম্মদের নবুয়্যতের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান কর কি ?বেহেশত ,দোযখ ,মৃত্যু ,পুনরুত্থান ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সত্যতায় বিশ্বাস কর কি ?জবাবে তারা বলল : আমরা সাক্ষ্য প্রদান করছি। মহানবী (সা.) বললেন : প্রভু হে ,তুমি সাক্ষী থাক।

অতঃপর মানুষের দিকে ফিরে পুনরায় বললেন : হে লোকসকল! আমরা হাউজে কাউসারের নিকট পরস্পরের সাক্ষাৎ পাব। আমার পর আমার দুটি মহামূল্যবান সম্পদ সম্পর্কে তোমারা সাবধান থেকো যে ,এতদুভয়ের প্রতি তোমরা কিরূপ আচরণ করছ ?

জনতা বলল : হে আল্লাহর রাসূল ঐ দুটি বস্তু কী ?

তিনি জবাবে বললেন : ঐ দুটি মহামূল্যবান বস্তু হলো : আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত । মহান আল্লাহ্ আমাকে অবহিত করেছেন যে ,তারা আমার নিকট হাউজে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ...তাদের অগ্রবর্তী হয়ো না ,তাহলে ধ্বংস হবে ,তাদের পশ্চাদবর্তী হয়ো না ,তাহলেও ধ্বংস হবে।

এ পর্যায়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর হস্ত মোবারক সমুন্নত করে ধরলেন যাতে সবাই তাঁকে দেখতে পায় ও চিনতে পারে এবং ঐ অবস্থায় বললেন :

ايهّا النّاس ! من أولى النّاس بالمؤمنين من انفسهم ؟

হে মানবসকল! মুমিনদের মধ্যে তাঁর (আলীর) চেয়ে উত্তম কে আছে যে তাদের উপর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পেতে ও নেতৃত্ব দিতে পারে ?জনতা বলল : আল্লাহ্ ও তাঁর নবীই ভাল জানেন। নবী (সা.) বললেন : মহান আল্লাহ্ আমার উপর বেলায়েত (কর্তৃত্ব) রাখেন এবং আমি মুমিনদের উপর। আমি মুমিনগণের নিজেদের চেয়ে (তাদের উপর বেলায়েতের জন্য) শ্রেয়তর। 13 অতএব ,

من كنت مولاه فهذا عليّ مولاه

আমি যার মাওলা ,এ আলীও তার মাওলা। হে আমার প্রভূ! যে তাঁর বন্ধু হয় ,তুমিও তার বন্ধু হও এবং যে তাঁর শত্রু হয় ,তুমিও তার শত্রু হও। আর তাকে তুমি সাহায্য কর যে তাঁকে সাহায্য করে ;তাকে তুমি শাস্তি দাও যে তাঁর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ...ওহে! প্রত্যেকেই যে এখানে উপস্থিত ,সে যেন অনুপস্থিত সকলকে এ সংবাদ পৌঁছে দেয়।

সভাভঙ্গ না হতেই নিম্নলিখিত আয়াতটি অবতীর্ণ হলো :

) اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الاسلام دينا (

অদ্য তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম (মায়েদাহ : 3)। 14

সমান অধিকার

হযরত আলী (আ.) মুসলমানদের শাসনভার হাতে নেয়ার প্রাক্কালে মিম্বরে গেলেন এবং মহান আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করার পর বললেন : আল্লাহর শপথ ,যতক্ষণ পর্যন্ত মদীনার একটি খোরমা গাছও আমার অধিকারে থাকবে ,ততক্ষণ পর্যন্ত বাইতুল মাল থেকে কিছুই গ্রহণ করব না। চিন্তা করে দেখ যে ,যখন আমিই মুসলমানদের বাইতুল মাল থেকে কোন অংশ না নিই ,তবে তা কি (অন্যায়ভাবে) তোমাদেরকে দিব ?

আকীল উঠে দাঁড়াল এবং বলল : আমাকে মদীনার কৃষ্ণবর্ণদের সাথে এক রকম করে দেখছ ?

আমীরুল মুমিনীন বললেন : হে আমার ভাই! বস ,তুমি ব্যতীত আর কেউ কি এখানে কথা বলার জন্য ছিল না ?ঐ কৃষ্ণ বর্ণের ব্যক্তির উপর ঈমান ও সংযম ব্যতীত তোমার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। 15

হযরত আলীর কিছু অনুসারী তাঁর নিকট নিবেদন করেছিল : হে আমীরুল মুমিনীন! প্রথমেই যদি বাইতুল মাল থেকে দলপতিদেরকে সিংহ ভাগ প্রদান করেন তবে আপনার শাসনক্ষমতা সুস্থিত হতো ;অতঃপর সর্বস্তরে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠিত করতেন ,এটাই কি উত্তম হত না ?

ইমাম বললেন : ধিক তোমাদেরকে ,যে আমাকে পরামর্শ দিচ্ছ স্বীয় শাসনক্ষমতাকে অন্যায় ও অবিচারের মাধ্যমে মানুষের উপর প্রতিষ্ঠা করতে। না ,কখনোই না! আল্লাহর শপথ আমা হতে এহেন কর্ম কখনোই হবে না। আল্লাহর শপথ ,মুসলমানদের সম্পদ যদি আমার নিজের জন্যও হতো ,তারপরও আমি এক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখতাম ,তাদের সম্পদের ক্ষেত্রে তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। 16